বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা: একান্ত ব্যক্তিগত ভাবনা



ড. ভূঁইয়া মো. মনোয়ার কবীর
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

কর্তৃপক্ষ তার চরিত্র নিরপেক্ষ হয়ে পাবলিক উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমুহকে একবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অনুগামী, সাপোর্টিভ প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে ওঠার প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক কমিটমেন্টসহ তার অনুষঙ্গ অর্থনৈতিক বিনিয়োগ করতে রাজী আছে কি, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি কমিটমেন্ট থাকে, তবে, আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে, সীমিত অভিজ্ঞতায় বলতেই পারি যে, অন্তত ন্যূনতম নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো সরকারকে অবশ্যই নেয়া দরকার।

১. এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমুহকে প্রকৃত অর্থেই যদি Centers of Academic Excellence হিসাবে রূপান্তরিত করতেই হয়, তবে এগুলোকে নিম্নবর্গের তরুণদের ডাম্পিং গ্রাউন্ডে পরিণত না করে অনার্স লেভেলে শিক্ষার্থী ভর্তি যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনতে হবে। প্রকৃত অর্থেই সাধারণ বাংলাদেশী নাগরিকদের সন্তানদের জন্য যথাযথ শিক্ষাদানের অঙ্গীকার থাকতে হবে। আর তা যদি থাকে, তবে এফেক্টিভ শিক্ষা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহকে গড়ে তোলার বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিতেই হবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোন অবস্থাতেই সাধারণ পরিবারের সন্তানদের মানবেতর জীবনের ও নিম্নমানসম্পন্ন "শিক্ষা"র বৃত্ত/চক্র ব্রেক করার সিদ্ধান্ত ও বাস্তব পদক্ষেপ নিতেই হবে। ক্লাস সাইজ যৌক্তিক পর্যায়ে আনতে হবে। স্টুডেন্টদের আধুনিক শিক্ষার উপকরণাদি ও সুযোগ-সুবিধাদি পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোভাইড করতে হবে। উন্নত ও মানসম্পন্ন আবাসন ও খাবারের ব্যবস্থা, সহজলভ্য ও উন্নত আরামদায়ক ট্রান্সপোর্ট সুবিধা, উন্নত লাইব্রেরী, কম্পিউটার ফ্যাসিলিটিজ, ইন্টারনেট সংযোগ, উন্নতমানের ও সকল সুযোগসম্পন্ন শ্রেণীকক্ষের ব্যবস্থা, ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

২. বর্তমানের মাস্টার্স প্রোগ্রামকে নতুনভাবে পুনর্গঠন করতে হবে। ঢেলে সাজাতে হবে। এক্ষেত্রে, বর্তমানের এক বছরের মাস্টার্স প্রোগ্রামকে দুই বছরের বাধ্যতামুলক গবেষণা ভিত্তিক মাস্টার্স প্রোগ্রামে রূপান্তরিত করতে হবে। এক্ষেত্রে, অভিজ্ঞতার আলোকে এটা বলা চলে যে, বর্তমানে প্রচলিত একবৎসরের মাস্টার্স প্রোগ্রাম একটি চরম রকমের ব্যর্থ ব্যবস্থায় পর্যবসিত হয়েছে। যেহেতু, শুধুমাত্র উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকতার চাকরি ব্যতীত আর সকলপ্রকার জবের জন্য চারবছর মেয়াদী ব্যাচেলর ডিগ্রিই সাফিশিয়েন্ট, সেহেতু মাস্টার্স ডিগ্রি প্রোগ্রামটা সীমিত শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট থাকা প্রয়োজন। বর্তমানের মতো অনার্স শ্রেণীর সকল শিক্ষার্থীর জন্য ওপেন থাকা নিষ্প্রয়োজন। বরং, এক্ষেত্রে, চারবছর মেয়াদী অনার্স ডিগ্রী অর্জনকারী সকলেই এই মাস্টার্স প্রোগ্রামে আসতে পারবেনা। শুধুমাত্র যাদের অনার্সের সিজিপিএ বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের ন্যূনতম সিজিপিএ (উদাহরণ হিসাবে ৩.২৫ বা ৩.৫০ ইত্যাদি) থাকবে, কেবল তারাই মাস্টার্স শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারবে। এ ক্ষেত্রে বাহুল্য এমফিল প্রোগ্রাম বিলুপ্ত করতে হবে। দুই বছরের থিসিস সহ মাস্টার্স করে তারা সরাসরি পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হতে পারবে।

৩. শিক্ষক নিয়োগের শর্তাবলী ও প্রক্রিয়ায় মৌলিক পরিবর্তন আনা জরুরী। এই নিয়োগের নীতিমালায় সৃজনশীলতা আনতে হবে। আমি বা আমরা যখন শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পাই সেই ১৯৮৩ সালে, এখনও সেই মান্ধাতা আমলের নিয়োগ পদ্ধতি বিদ্যমান রয়েছে। এটা কোনভাবেই চলতে পারেনা।  বরং কোথাও কোথাও লিখিত পরীক্ষার নামে প্রক্রিয়াটাকে আরও জটিল ও অবাস্তব করে তোলা হয়েছে।

৪. আমি স্বয়ং একবার একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডে ছিলাম যেখানে লিখিত পরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল। সকাল দশটায় আনুমানিক ২০+ প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষা নেয়া হলো। দু'ঘন্টার পরীক্ষা। এরপর বোর্ডের চারজন বোর্ড সদস্যের তিনজন সদস্য (ভিসি মহোদয় বাদে) এই খাতাগুলো দেখা শুরু করে শেষ হতে হতে বেজে গেল প্রায় বিকেল পাঁচটা। ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি সময়। ছোট বেলা। সন্ধ্যা প্রায় হয় হয়। তখন লাঞ্চের ফুরসৎ হলো। ভিসি মহোদয় ততক্ষণে আরেকটি ডিপার্টমেন্টের নিয়োগ বোর্ডের ভাইভা নিচ্ছিলেন। সেটা শেষ হতে হতে বেজে গেল রাত সাড়ে সাতটা। আমরা ভাইভা নিতে শুরু করলাম রাত পৌনে আটটার দিকে। সবারই মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হলো। কারণ, লিখিত পরীক্ষায় বাদ দেয়ার সুযোগ ছিল না। এ আরেক বিড়ম্বনা। তো, ডিনারটা স্ন্যাক্স দিয়ে সারা হলো। বোর্ডের রেজ্যুলেশন হতে হতে বেজে গেল রাত আনুমানিক আড়াইটা। আমি গেস্ট হাউজে গেলাম। হাইপেগ্লাসিমা'র পেশেন্ট। সুগার নেমে যাচ্ছিল। মধ্য-ফেব্রুয়ারীর রাত আড়াইটার সময় গেস্ট হাউজে আমার জন্য রাখা হিম-শীতল ভাত আর ততোধিক শীতল লোহার মত শক্ত মাংস ও রুই মাছের টুকরো নিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে হাজির গেস্ট হাউজের টেবিল বয়। যে শিক্ষক মহোদয় আমার সাথে ছিলেন, তাঁর চেহারায় লজ্জার ছাপ ছিল স্পষ্ট।

৫. যাহোক, কথা হলো, যেখানে প্রার্থী সংখ্যা এত বেশী, সেখানে লিখিত পরীক্ষার আইডিয়াটা অত্যন্ত অবাস্তব। তদুপরি, যেক্ষেত্রে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলী পাঁচ বৎসর নানান জাতের পরীক্ষা নিয়েছেন, গ্রেডিং করেছেন, তাঁদের মুল্যায়নেই তো এই প্রার্থীরা ভালো  করেছে, এখন এই ১-২ ঘন্টার পরীক্ষায় কি মেধা যাচাই করা সম্ভব!! জানিনা। আমার সীমিত অভিজ্ঞতায় আমার কাছে অবাস্তব ও অপ্রয়োজনীয় চর্চা মনে হয়েছে। প্রচলিত মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের যে ত্রুটিগুলো ও দূর্বলতাগুলো আছে, তা রোধ করতে লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের পদ্ধতি মোটেও কার্যকর নয়।

৫. আসলে, মাস্টার্স প্রোগ্রাম রিস্ট্রাক্চার করার পাশাপাশি শিক্ষক নিয়োগের শর্তাবলী ও পদ্ধতিতেও আমূল পরিবর্তন আনা অত্যাবশ্যক। যোগ্য, দক্ষ, ডেডিকেটেড শিক্ষক পেতে চাইলে নিয়োগের শর্তাবলী ও পদ্ধতিতে পরিবর্তন মাস্ট।

এক্ষেত্রে,

ক.শিক্ষক নিয়োগের ন্যূনতম শর্ত হওয়া উচিৎ:

(১) হয় প্রস্তাবিত দুই বছরের মাস্টার্স ডিগ্রী ও একটি পাবলিকেশন। আর পুরাতন পদ্ধতি অনুযায়ী ন্যূনতম এমফিল ডিগ্রী ও ন্যূনতম একটি পাবলিকেশন, অথবা, বিদেশী সেকেন্ড মাস্টার্স ডিগ্রী ও ন্যূনতম একটি পাবলিকেশন, অথবা দেশী বা বিদেশী পিএইচডি ডিগ্রী। এক্ষেত্রে, অনার্স ডিগ্রীর নীচের (এসএসসি ও এইচএসসি ও সমমানের) ডিগ্রীর জিপিএ দেখা নিরর্থক।

(২) অথবা, বিকল্প হিসাবে, এখানে প্রস্তাবিত পদ্ধতি অনুযায়ী শিক্ষক হবার জন্য দরখাস্ত করার ন্যূনতম শর্ত হওয়া উচিৎ পিএইচডি ডিগ্রী ও ন্যূনতম একটি পাবলিকেশন। প্রথম নিয়োগপ্রাপ্ত পদ হবে সহকারী অধ্যাপক। আমার ব্যক্তিগত প্রেফারেন্স এই বিকল্পের পক্ষে।

খ. সেক্ষেত্রে, মাস্টার্স প্রোগ্রামের শিক্ষার্থীরা বিভাগের শিক্ষকদের প্রয়োজন মোতাবেক গবেষণা সহকারী হিসাবে, এবং পিএইচডি প্রোগ্রামের শিক্ষার্থীরা চিচিং এসিসট্যান্ট হিসাবে ক্লাশ নেবেন অথবা ক্লাশ নেয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকগণকে সহায়তা করবেন। গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের শিক্ষার্থীদেরকে অবশ্যই ফুলটাইম রেগুলার স্টুডেন্ট হতেই হবে। তাদের আ্যাসিসটেন্টশীপ দেয়া হবে যৌক্তিক হারে। কোন শিক্ষক তাঁর গবেষণা প্রকল্প থেকেও নিজের জন্য গবেষণা সহকারীকে নিয়োগ ও ফান্ডিং করতে পারেন। ফান্ডিংটা একবৎসর মেয়াদী ও মুল্যায়নের ভিত্তিতে নবায়নযোগ্য। এর ফলে, এই গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের শিক্ষার্থীদের আর্থিক সাপোর্টের পাশাপাশি তাদের গবেষণা ও শিক্ষকতায় বিশেষ ট্রেনিংও লাভ করা সম্ভব হবে।

গ. এর ফলে, শিক্ষক হিসাবে যারা নিয়োগ পাবেন, তাঁরা ইতিমধ্যেই গবেষণা, শিক্ষকতা ও পাবলিকেশনের ব্যাপারে অভিজ্ঞ হবেন। ফলে, বর্তমানে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মত তাদেরকে on job training প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কয়েক বছর যেতে হবেনা। শুরু থেকেই এ প্রস্তাবিত নিয়োগ পদ্ধতি অনুযায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা পুরোপুরি সার্ভিস দিতে পারবেন। তখন তাদের প্রমোশানের শর্তাবলী আরো কিছুটা চ্যালেন্জিং করলেও তারা সেটা মোকাবিলায় সক্ষম হবেন। এতে, সার্বিকভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে গবেষণার সংখ্যা, গুণ ও মান বৃদ্ধি পাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

ঘ. ফলে, একাধারে দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও শিক্ষকতার প্রতি কমিটেড শিক্ষক পাওয়া বহুলাংশে নিশ্চিত হবে। কারণ, চলতি পদ্ধতি অনুযায়ী, একজন স্টুডেন্টের রেজাল্ট ভালো হলেই তার নিয়োগপ্রাপ্তির সম্ভাবনা তৈরী হয়ে যায় যদিও ওই পর্যায়ে তিনি নিশ্চিত থাকেননা যে, তিনি শিক্ষকতাকে ক্যারিয়ার হিসাবে প্রেফার করেন কি-না। হয়তোবা "আয়েশী" চাকরি হিসাবে শিক্ষকতায় যোগ দিতে চান, যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার দাবী ও কমিটমেন্ট সম্পর্কে তাঁর তেমন কোন ধারণাই ডেভেলপ করেনি। নিয়োগদাতাদের রাজনৈতিক-আদর্শিক তরিকা, "সঠিক" আঞ্চলিক ম্যাচ, যারা নিয়োগে ম্যাটার করে, তাদের সাথে গুড" কানেকশন, তদ্বীর ঠিকঠাক মিলে গেলেই শিক্ষকতার "চাকরি" পাওয়া নিশ্চিত হয়ে যেতে পারে। এই প্রক্রিয়া একজন ভালো স্টুডেন্ট হয়তো পাওয়া যেতেও পারে, কিন্তু ভালো শিক্ষক যে পাওয়া যাবে,তা নিশ্চিত করেনা। বরং, ভালো স্টুডেন্টটির হয়তো চাকরি দরকার, তাই "আরামে"র চাকরি  হিসাবেই শিক্ষকতাকে নেয়, অথবা এটা আগে পাওয়া গিয়েছে, তাই শিক্ষক হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু শিক্ষক হবার আগ্রহ বা কমিটমেন্ট তার নাও থাকতে পারে।

ঙ. ফলে, এঁরা কখনোই নিজেদেরকে শিক্ষক হিসাবে গড়ে তোলায় আগ্রহী হননা। তাদের একাংশ যদি আয়েশী হয়, আরেক অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরেই ক্ষমতা অর্জনের পিছনে ছুটেন। আর এ ব্যাপারে মুরুব্বী বা মেন্টর পাওয়া মোটেও কোন দুষ্কর বিষয় না। প্রক্টরিয়াল বডিতে কাজ করা, হল প্রশাসনে কাজ করা, বিভিন্ন কমিটিতে কাজ করা তাদের নিকট বেশী থ্রিলিং মনে হয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদোন্নতির শিথিল শর্তের ফলে বিভিন্ন উপায়ে পদোন্নতির জন্য ন্যূনতম পাবলিকেশন "করে" বা "ম্যনেজ" করে পদোন্নতি "সঠিক" সময়ে পাওয়া যায় বিধায় একাডেমীক ডিভোশনের দিকে না গিয়ে অন্য কাজ করলেও কোন সমস্যা হয়না। আর "দল" তো আছেই। সংশ্লিষ্ট দলের এমন "ইমারজিং", "প্রমিজিং" "নেতা" দের প্রমোশন নিশ্চিত করতে। ফলে, বর্তমান নিয়োগ পদ্ধতিতে ও শর্তে ভালো শিক্ষক, গবেষক পাওয়ার অকারণ আশা হাস্যকর ছাড়া আর কিছুই না। তারপরও যদি কালেভদ্রে এক-আধটা পাওয়া যায়, তবে তা ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম দিয়ে একটা সিস্টেম প্রোপারলি চলতে পারেনা। এঁরা ক্রমেই বিরল প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ছেন।

চ. ভালো শিক্ষক ও গবেষক আপনা-আপনি পাওয়ার যুগ শেষ। সেদিন গত হয়েছে, যখন মনে করা হতো, স্বরস্বতী লক্ষী'র উপর প্রাধান্য বিস্তার করবে। মাষ্টার খাক বা না খাক, সে নিবেদিতপ্রাণভাবে মাষ্টারী করবেই। আসলে, এধরণের পারসেপশান একটা শিক্ষক শোষণমূলক আইডিওলজি, যা আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দৈন্যের অন্যতম বড় কারণ। শিক্ষক শোষণমূলক শিক্ষাদর্শণ কখনোই ভালো শিক্ষক ও উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রোডিউস করতে পারেনা। এই বিষয়ে আমাদের সমাজের ও নীতিনির্ধারকদের চিন্তার ও বোধের ক্ষেত্রে একটা ব্যাপক "প্যারাডাইম শিফট" (Paradigm Shift) অপরিহার্য। এটা মানতে হবে যে, শিক্ষকদের জীবনযাত্রা কম কমফোর্টেবল রেখে তাদের কাছ থেকে বেশী বেশী দাবী করা যায়না। কোনদিনও সেটা হবেনা। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথেও যদি তুলনা করা হয়, দেখা যাবে, বেতন, ভাতা, সুবিধাদির ক্ষেত্রে  অন্য দেশগুলোর তুলনায় আমরা কি নিদারুণভাবে পিছিয়ে আছি।

ছ. অনেকেই মনে করেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ ক্লাশ নেন না, কোন কাজ করেন না, কেবল বসে বসে বেতন খান, আর দলবাজি, রাজনীতি করেন। লাল, নীল, সাদা, হলুদ, গোলাপী "দল" করেন। দলমন্য শিক্ষকেরা দলবাজী করেন। হ্যাঁ, একটা অংশ শিক্ষক নিশ্চয়ই তেমন আছেন। এ প্রসঙ্গে বলতে দ্বিধা নেই যে, আমিও আমার দৃষ্টভঙ্গীর সাথে সামন্জস্যপূর্ণ শিক্ষক গ্রুপের সঙ্গে কখনো বেশী সক্রিয়ভাবে, কখনো কম সক্রিয়ভাবে, কখনোবা প্রায় নিষ্ক্রিয়ভাবে সেই গ্রুপের সাথে সেই শিক্ষকতা জীবনের শুরুর দিন থেকেই জড়িত আছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শিক্ষার মান এখনও যুক্তিসাপেক্ষে (arguably) অনেক উন্নত। সেখানেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ভিতর ডেমোক্র্যাট-রপাবলিকান ডিভিশন স্পষ্ট। দলীয় কারণ কোন কোন ক্ষেত্রে স্থায়ীকরণ না হওয়ার ও ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে চাকরি চলে যাওয়ার ব্যাপারে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখে। আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন Thomas Vogy. তিনি সক্রিয় শিক্ষকতা করা অবস্থায় Tucson সিটির দলীয় টিকিটে নির্বাচিত মেয়র ছিলেন। আর রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে শিখেছি রাজনীতির সর্বব্যাপ্তির বাস্তবতা। ফলে, আমি আপনি চাই বা না চাই, রাজনীতি থাকবেই। আসল কথা হলো, কিভাবে রাজনীতির স্খলন ও তার স্খলিত প্রভাব পাবলিক  বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক এনভায়রনমেন্ট ও মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে। কিছু শিক্ষক আছেন, যাঁরা প্রকাশ্যে দল না করলেও কোন না কোন মতের দৃঢ় সমর্থক, বা অন্য কোন একটা মতের কঠিন বিরোধী। বলা চলে, বিদ্বেষী। তাঁরা নিজেদেরকে আপাতঃইনোসেন্ট "বর্ণহীন" বলতে পছন্দ করলেও তাদের কেউ কেউ আসলে "বর্ণহীনে"র আড়ালে "বর্ণচোরা" বলে মনে হয়। এঁদেরকে আমার কাছে  রাজনীতি করা অনেকের চেয়ে বেশী সমস্যাপূর্ণ বলে মনে হয়। তবে, বেশীরভাগ শিক্ষকই এখনও তাঁদের দায়িত্ব পালনে আন্তরিক। তারপরও যদি রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব থেকে একাডেমিক এনভায়রনমেন্ট ও মানকে বিযুক্ত করার জন্য ১৯৭৩ সালের অর্ডিন্যান্সের কোন দিককে রিভিউ করা প্রয়োজন মনে হয়, সেটাও বিবেচনা করতে কোন সমস্যা থাকা উচিৎ নয়।

জ. আচ্ছা, আপনিই বলুন তো, একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের দায়িত্ব কি? আপনি সরলভাবেই বলবেন, "কেন, ঠিকমতো ক্লাস নেয়া ও সে সাথে গবেষনা তথা জ্ঞান দান করা ও জ্ঞান সৃষ্টি করা"। জ্বী, আপনি একদম ঠিক বলেছেন। কিন্ত, আপনি জানেন কি, একজন শিক্ষককে এই দুটি কাজের বাইরে আরো কি কি কাজ করতে হয়? গড়পড়তা ৩৬-৪০ পৃষ্ঠার ১২৫-১৫০ টি বা কখনো কখনো তারও বেশী খাতা একটা ইয়ারের একটি কোর্সের জন্য গ্রেডিং করতে হয়। বছরে প্রায় তিনটে, কোন কোন ক্ষেত্রে, আরো বেশী কোর্সের খাতা গ্রেডিং করতে হয়, টিউটোরিয়াল ক্লাস, পরীক্ষা নিতে হয়, উপস্থিতি ক্যালকুলেট করতে হয়, পরীক্ষা কমিটির কাজ করতে হয়, প্রশ্ন লিখতে, ও ফটোকপি করতে হয়, পরীক্ষার ডিউটি দিতে হয়, বিশাল বিশাল টেবুলশান শীট নিয়ে দিনরাত কাজ করতে হয়, মার্কশীট লিখতে হয়, কারেকশান করতে হয়। এই কাজগুলো কি শিক্ষকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ার কথা!! অনেককে আবার প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। বলতে পারেন, সবাইকে তো আর করতে হয়না। কথা ঠিক। কিন্তু, কাউকে না কাউকে তো অবশ্যই করতে হবে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধান মতে, এ কাজগুলো অবশ্যই শিক্ষকদের দ্বারাই সম্পন্ন হতে হবে। এরপর আপনি চাইবেন, ক্লান্ত মন-শরীর নিয়ে, খিটখিটে মেজাজ নিয়ে, "নুন আনতে পান্তা ফুরায়" মাষ্টার সুপারম্যানের মতো ফান্ডিং ছাড়াই দেনা করে, বা পৈতৃক সম্পত্তি ব্যয় করে গবেষণা করবেন, জ্ঞান সৃষ্টি করবেন!! অবশ্য, তেমন "পাগল"ও কিছু নাই যে, তা নয়। এমন গুটিকয়েক "পাগল" দিয়ে তো আর সবকিছু হবেনা।

ঝ. অতএব, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, গবেষণা সুবিধাদী,  উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো আবশ্যক। এক্ষেত্রে, আমি বলতে চাই যে, এই বৃদ্ধি প্রাথমিক শিক্ষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পর্যন্ত সকল পর্যায়ে হতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষকদের আলাদা বেতনস্কেল থাকতে হবে। শিক্ষায় বিনিয়োগ কয়েকগুন বৃদ্ধি করতে হবে, সংস্কার করতে হবে, জবাবদিহিতা তখন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। ইউনেস্কো সম্ভবতঃ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ জিডিপির ৬% হওয়া উচিৎ বলে হিসাব করেছে, আমি মনে করি, এই বরাদ্দ ১০% এর কম হওয়া উচিৎ না।

ঞ. শিক্ষকদের কাজের চাপ বাড়িয়ে কিছু হবেনা, যদি না শিক্ষকতার পেশাটা তাদের জন্য রিওয়ার্ডিং হয়; বৈষয়িক ভাবে ও মানসিক ভাবে। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কোন উন্নতি অসম্ভব শিক্ষকদের জীবনমান, মর্যাদা, গবেষণার সুযোগ সুবিধা না দিয়ে শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের উপর বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে না বাড়িয়ে এটা সেটা করে, IQAC র মাধ্যমে তেমন দীর্ঘমেয়াদী কোন সাফল্য আসবেনা বলে আমি মনে করি।

   

ভোটে ফেরাতে হবে মানুষকে



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা বাদে নির্বাচন ছিল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ। নির্বাচনে জাল ভোট হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের অনেকের প্রভাব ছিল সত্য, তবে মোটাদাগে বড়ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এ-ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সন্তুষ্টির কারণ রয়েছে। তবে বিব্রত হওয়ার প্রধান কারণ ভোটার উপস্থিতি। অনেক আলোচনার মধ্যেও এবারের নির্বাচনে আশানুরূপ ভোটার আসেননি।

ভোটগ্রহণের পরের দিন বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, প্রথম ধাপের নির্বাচনে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পড়েছে। ইলেকট্রেনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হয়েছে ২২ উপজেলায় এবং বাকি ১১৭ উপজেলায় হয়েছে ব্যালট পেপারে। ইভিএমে ভোটের হার ৩১ দশমিক ৩১ শতাংশ আর ব্যালটে ৩৭ দশমিক ২২ শতাংশ। সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে সোনাতলা, মীরসরাই ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলায়। সেসব জায়গায় ভোট পড়েছে মাত্র ১৭ শতাংশ। সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলায়। সেখানে ভোট পড়েছে ৭৩ দশমিক ১ শতাংশ।

সবচেয়ে বেশি ভোট পড়া এলাকা জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলায় মোট ভোটার ৯৫ হাজার ১৯১ জন। এর মধ্যে ৬৪ হাজার ৭৩০ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। ওখানে পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি দুলাল মিয়া সরদার ৩০ হাজার ৩৯০ ভোট পান। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ নেতা তাইফুল ইসলাম তালুকদার পান ২২ হাজার ৯০১ ভোট।

কম ভোট পড়া এলাকাগুলোর মধ্যে বগুড়া সোনাতলায় ভোটার ছিলেন ১ লাখ ৬৪ হাজার ৩৩২ জন। এর মধ্যে ভোট দিয়েছেন ২৮ হাজার ২৭৮ জন। ওখানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মিনহাদুজ্জামান লিটন ২০ হাজার ৪৮৩ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান পদে পুনরায় বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মো. জাকির হোসেন পান ৭ হাজার ৩৪৫ ভোট। মিনহাদুজ্জামান লিটন সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নানের ছোট ভাই। আওয়ামী লীগের এই এমপির ভাইই কেবল নির্বাচনে বিজয়ী হননি, জেলার অপর এক উপজেলা সারিয়াকান্দিতে বিজয়ী হয়েছেন তার ছেলে সাখাওয়াত হোসেন সজল।

কম ভোট পড়া আরেক উপজেলা কুষ্টিয়া সদর। এখানে ৪ লাখ ২০ হাজার ৮৩৩ জন ভোটারের মধ্যে মাত্র ৭৩ হাজার ২৯৯ জন ভোটার ভোট দেন। কুষ্টিয়া সদর আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতা ৬৭ হাজার ৪৮১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী আবু আহাদ আল মামুন পেয়েছেন ৩ হাজার ৫৬৪ ভোট।

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দেওয়া তথ্যের আরেক কম ভোট পড়া উপজেলা হচ্ছে চট্টগ্রামের মীরসরাই। ৩ লাখ ৭২ হাজার ২৫৭ জন ভোটারের ওই উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে এনায়েত হোসেন নয়ন ৩৩ হাজার ৭০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ মোহাম্মদ আতাউর রহমান পান ২০ হাজার ৭৬৭ ভোট।

নির্বাচন কমিশনের ভাষ্যমতে, ভোট কম পড়ার কারণ হচ্ছে ধান কাটার মৌসুম, ঝড়বৃষ্টি, জনপ্রিয় প্রার্থীর অভাব, শহর এলাকায় ছুটি থাকায় মানুষের বাড়ি চলে যাওয়া, এবং বড় রাজনৈতিক দলের ভোটে অংশগ্রহণ না করা। এগুলোকে কারণ হিসেবে বললেও এটা যে স্রেফ অজুহাত দাঁড় করানো সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। নির্বাচন কমিশন ভোট কম পড়ার যে ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে সেটাই কি আসল কারণ মূলত? ধান কাটার মৌসুম, ঝড়বৃষ্টির ওপর মানুষের হাত নেই, কিন্তু বাকিগুলো নির্ভর করে মানুষের ওপরই। ইসি যেভাবে ঝড়বৃষ্টিকে কারণ হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছে সেটা মোটেও মূল কারণের মধ্যে পড়ে না, কারণ নির্বাচনের দিন কোথাও উল্লেখের মতো ঝড়বৃষ্টি হয়নি। ধান কাটার মৌসুমেও মানুষ আগে ভোট দিয়েছে, নির্বাচনের দিন প্রতিবারই ছুটি থাকে, এবং একদিনের এই ছুটিতে সচরাচর মানুষ গ্রামে চলে যায় না, বিশেষত ঠিক পরের দিন যেখানে আর কোন ছুটি নাই।

ইসি বলতে চাইছে, জনপ্রিয় প্রার্থীর অভাব ছিল নির্বাচনে। এটা কীভাবে মেনে নেওয়া যায়? দলীয় প্রতীকে এবার নির্বাচন না হলেও ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, অংশ নিয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যানরাও। যে তিন উপজেলায় সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে বলছে ইসি, সেই তিন উপজেলার অন্তত দুই উপজেলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় দুই সংসদ সদস্যের নিকটাত্মীয় হয়েছেন বিজয়ী। তাহলে ইসি কি বলতে চায় নির্বাচন বর্জন করছে যে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নেতারাই মূলত কেন্দ্রে ভোটার টানার মতো প্রার্থী?

ইসিও বলছে, নির্বাচনে ভোটার স্বল্পতার অন্যতম কারণ বিএনপির অংশ না নেওয়া। এটা এমনই অপ্রিয় সত্য যা অস্বীকারের উপায় নাই। হ্যাঁ, নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপির সকল বা বেশিরভাগ নেতাই বিজয়ী হয়ে যেতেন এমন না, তবে তাদের নির্বাচন বর্জনের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় দলটির সমমনাদের কেউ অংশ নেয়নি। এমনকি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যে সকল রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল তাদের কেউও নির্বাচনে অংশ নেয়নি।

দলের মধ্যকার কোন্দলকে প্রকাশ্য রূপ না দিতে আওয়ামী লীগ না হয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক দেয়নি; কিন্তু কোথায় জাতীয় পার্টি, কোথায় ১৪-দলের শরিক দলগুলো, কোথায় সেই ‘কিংস পার্টি’ যারা বিগত সময়ে হঠাৎ গজিয়ে ওঠে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল? জাতীয় পার্টি জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধীদলের স্বীকৃতি পেলেও প্রান্তিক পর্যায়ে এই দলটির অস্তিত্ব যে আদতে নেই, এটা স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে তাদের অংশগ্রহণের ইতিহাস দেখলে সহজেই অনুমেয়। সরকারের অনুকম্পায় টিকে থাকা দলটি নেতাকর্মী সংকটে তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপ সেটা আরও একবার প্রমাণ করল।

প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অনুমিতভাবে নির্বাচিতদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অথচ নির্বাচনে নেই উল্লেখের মতো ভোটার উপস্থিতি। এবারের ভোট প্রদানের হার বিগত সংসদ নির্বাচনের ভোটের হারের চাইতেও কম। এর দ্বারা কি প্রমাণ হচ্ছে না আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-প্রার্থীরা ভোটারদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছেন? এই ব্যর্থতা কি তবে অনাস্থার বিমূর্ত প্রকাশ?

ধান কাটা মৌসুম, ঝড়বৃষ্টিসহ হালকা-ঢঙের যতই অজুহাত দাঁড় করাক না কেন নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত সত্যি কি ভোটের হাওয়া বইছিল নির্দিষ্ট ওই ১৩৯ উপজেলাজুড়ে? বাস্তবতা বলছে, কখনই মনে হয়নি ভোট এসেছে। ভোটের প্রতি মানুষের এই অনাগ্রহ কী কারণে ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে সেটা বের করা জরুরি।

যারা ভোট দিতে যায়নি, তাদের সকলেই যে বিএনপির নেতাকর্মী-সমর্থক, এমনটা ভাবার কারণ নাই। দেশে এত এত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী তারাও কি ভোট দিতে গেছে? ভোটার উপস্থিতির হার বলছে, তারাও নির্বাচনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে বসেছে। মানুষ ভোট দিতে যায়নি মূলত ‘ভোট দিয়ে কী হবে’ এমন একটা ধারণা কিংবা বিশ্বাস থেকেই।

ব্যক্তিগতভাবে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি, এবং বেশিরভাগেরই অভিন্ন মতামত। এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকার-রাখার হুমকিসম। মানুষ দিন দিন ভোটে অনাগ্রহী হয়ে পড়ার কারণে ‘অন্ধকারের আততায়ীরাও’ যদি কখনও ক্ষমতার কেন্দ্রের কাছাকাছি পৌঁছায়, তবে এখান থেকে মুক্তির পথ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়ত হতে থাকবে। নির্বাচন এককালে ছিল আমাদের অন্যতম এক উৎসব। ভোট ও প্রার্থীদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলত সবখানে, কিন্তু এখন সে দিন হারিয়ে গেছে অনেকটাই।

ভোটবিমুখ মানুষকে ভোটে ফেরাতে হবে, দিতে হবে অভয়, গড়তে হবে সম-মর্যাদা ও সম-সুযোগের মাঠ। ভোট যে অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার; এই বোধের জাগরণ দরকার। দরকার কেন্দ্র আর প্রান্তের মধ্যে যোগাযোগ ও আস্থার পরিবেশ। আস্থার পরিবেশ না ফিরলে মানুষ ভোট ও গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বিমুখ হতেই থাকবে!

;

স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রশ্নে ছাত্র সংহতি: অন্যরা ঘুমিয়ে কেন?



আশরাফুল ইসলাম পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

পশ্চিমা মদদ আর আরব বিশ্বের আশ্চর্যজনক নীরবতায় ফিলিস্তিনের হতভাগ্য নাগরিকদের ওপর যুগ যুগ ধরে চলা ইহুদীবাদী ইসরায়েলের অব্যাহত বর্বরতায় বিশ্ব নতুন করে জেগে উঠেছে। এই ‘বিশ্ব’ বলতে আপামর বিশ্ববাসী বললে ভুল হবে, মূখ্যত সাম্প্রতিক সময়ের নজিরবিহীন নারকীয়তায় যারপারনাই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে বিশ্বের ছাত্র-তরুণ আর মুক্তিকামী মানুষদের একটি অংশ, যারা তাদের বিবেক দ্বারা চালিত হচ্ছেন। কৌশল বা কোন সমীকরণের ধার ধারছেন না তারা।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে মানবতার মেকি সবক দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ছাত্র-তরুণরাও তাদের শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তীব্র ক্ষোভে মজলুম ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি প্রকাশে পথে নেমে এসেছেন। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী-তরুণদের থামাতে বলপ্রয়োগ আর ভীতি প্রদর্শনের কিছুই অবশিষ্ট রাখছে না দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরিণতিতে বহু ছাত্র-তরুণ এমনকি শিক্ষকরাও গ্রেপ্তারবরণ করছেন।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, মার্কিন মুলুকে ফিলিস্তিন সংহতির এই প্রকাশ ঘটছে ইউরোপসহ বিশ্বের নানাপ্রান্তে। ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনের জনগণের পাশে থাকা বাংলাদেশের ছাত্র-তরুণরাও গেল কয়েকদিন ধরে ‘স্বাধীন ফিলিস্তিন’ এর পক্ষে ও ইসরাইলি বর্বরতা বন্ধের দাবিতে পথে নেমেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েকটি সমাবেশের ধারাবাহিকতায় আজ বৃহস্পতিবারও একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্মলাভ করা বাংলাদেশের কাছে পরাধীনতার গ্লানি অচেনা নয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিসহ রাজনৈতিক মেরুকরণের নানা বাস্তবতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষের মনে পীড়িত ফিলিস্তিনের মজলুম জনতার জন্য ভালোবাসা আর সংহতির কোন কমতি নেই। আমরা লক্ষ্য করছি, বর্তমান সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারাও ফিলিস্তিনে বর্বরতার বিরুদ্ধে জোরাল অবস্থান নিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার জন্যই যে এই অবস্থান তা অনেকে বলবার চেষ্টা করলেও আমরা মনে করি, দলমত নির্বিশেষে নিপীড়িত ফিলিস্তিনের জন্য সকলের একাট্টা হওয়াই উচিত। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নিরিখে এই সংহতি প্রকাশে অবস্থান গ্রহণে তারতম্য থাকা উচিত নয়। সেই সঙ্গে সংহতি প্রকাশে কাজ করা উচিত নয় ধর্মীয় বিবেচনাও।

মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহ্যিক পরম্পরাকে লালন করা একটি দেশ হিসাবে আমাদের বিশ্বের যেকোন প্রান্তের নির্যাতিত মানুষের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করাই কর্তব্য হওয়া উচিত। মুক্তিকামী মানুষের অনুভূতি যে অভিন্ন তা আমরা ১৯৪৭ সালে ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণার সময়ে ব্রিটিশ শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের কণ্ঠেও ধ্বনিত হতে শুনেছি। সেদিন তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাবে স্বীকার করেছিলেন, `Freedom Loving People Everywhere’.

কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মেরুকরণে স্বাধীন ফিলিস্তিনের সংহতি প্রকাশে এখানকার রাজনৈতিক দলগুলির দ্বিধাবিভক্ত অবস্থান। সরকার বিরোধিতায় কোন কোন দলের পশ্চিমাশক্তির মদদপ্রাপ্তির আকাঙ্খা, ফিলিস্তিন নিয়ে তাদের আশ্চর্যরকম নীরবতার কারণ বলে অভিযোগ আছে। ধর্মীয় উন্মাদনার জিগির তুলে ইসলামী দলগুলো অনেক অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে তুলকালাম বাধিয়ে দিলেও ফিলিস্তিনের উপর চলমান বর্বরতায় তাদের উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি দৃশ্যমান নয়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের এ নিয়ে মূল্যায়ন এরকম যে, দলীয় ও গোষ্ঠীগত স্বার্থে এসকল দল ও সংগঠন একাট্টা হলেও নিপীড়িত মানুষের জন্য তাদের অবস্থান অস্পষ্ট।

অন্যদিকে আমরা গভীর বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করছি, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি ফিলিস্তিনের উপর যুগ যুগ ধরে চলা বর্বরতার বিরুদ্ধে বিস্ময়কর নীরবতা প্রদর্শনের ধারাবাহিকতায় চলমান ইসরাইলি ধ্বংসযজ্ঞেও তাদের কৌশলগত রক্ষণশীলতা অব্যাহত। মুখে মুসলিম সংহতি, পশ্চিমাবিষোদগার আর ইসরাইলের নিন্দা করে গেলেও তাদের পক্ষ থেকে জোরাল কোন পদক্ষেপ নেই। দেশগুলি তাদের নিজস্ব ব্যবসায়িক ও নিরাপত্তা স্ট্রাটেজিকেই সর্বাগ্রে প্রধান্য দিয়ে চলছেন।

প্রতিদিন শত শত নিরীহ ফিলিস্তিনি শিশু, নারী-বৃদ্ধ এমনকি চিকিৎসাধীনরা ইসরাইলি হামলার নিশানা হলেও আরববিশ্বের ঘুম ভাঙছে না। ইরানের সক্রিয় অবস্থানে যখন ইসরাইলসহ পশ্চিমারা নড়েচড়ে বসছেন সেই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি যদি মিনমিনে নিন্দার বদলে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলতো তবে এক সপ্তাহে দৃশ্যপট বদলে যেতে পারত। মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা বিশ্লেষকরা বলছেন, ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস যদি ইসরাইলি বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে না তুলতো তবে আরও বহুদূর বিস্তৃত হতো ইসরাইলি আস্ফালন ও ধ্বংসযজ্ঞ।

যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রসংবরণের যে আহ্বান তাকে যদি মেকিও ধরে নিই তারও যে একটা তাৎপর্য রয়েছে, বলা যায় স্পষ্টতই তা হামাসসহ অন্যান্য স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠনের জেগে উঠার ফলশ্রুতি। নানামূখি মেরুকরণে সুর মিলিয়ে কিংবা কৌশলী প্রতিবাদ-নিন্দায় যারা ‘ফিলিস্তিন সংহতি’তে সীমিত থাকছেন তাদের সেখান থেকে বেরিয়ে আসার বিকল্প নেই। বলাবাহুল্য, জোরদার বিশ্ব জনমতেরও একটি অবধারিত মূল্য রয়েছে। সব মতপার্থক্য ও ধর্মীয় পরিচয় ব্যতিরেকেই ফিলিস্তিনের জন্য নিরঙ্কুশ সংহতি সময়ের দাবি।

;

আলো ঝলমলে শহর ও বাইক চালকের অসহায় মুখ



আশরাফুল ইসলাম পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

তখন সন্ধ্যা ছুঁই ছুই। কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউতে হেটে কর্মস্থলে আসছিলাম। বাংলামটর মোড়ে রাস্তা পেরিয়ে পা বাড়াতেই মোটরসাইকেলে বসা এক তরুণ ডাক দিলেন, ‘ভাই যাবেন?’

অপ্রস্তুত ও খানিকটা বিরক্ত হয়েই জবাব দিলাম, ‘আমি কি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি?’

ওই তরুণ নিরুত্তর থাকেন, মলিন মুখে অন্যদিকে তাকায়। খানিকটা এগিয়ে থমকে দাঁড়াই এই ভেবে যে, মনে হয় তাকে অনেকটা কষ্ট দিয়ে ফেলাম। ভাবলাম, এভাবে না বললেও হতো। অনুশোচনায় ফিরে এসে, ‘দুঃখিত’ বলে জানতে চাইলাম, ‘অনেকক্ষণ যাত্রী পাচ্ছেন না বোধহয়?’

বেশ কষ্ট নিয়েই বাইক চালক জানালেন প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, নিয়ে যাওয়ার মতো কাউকেই পাচ্ছেন না। অনেক অপেক্ষার পর কেউ যেতে চাইলে তাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাইকচালকদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে। সেই সুযোগ নেন যাত্রীও। কম ভাড়ায় যেতে সম্মত হয়ে যান কেউ, তাই পথচারী কাউকে হেটে যেতে দেখলেও যেচে তাকে জিজ্ঞেস করেন বাইক চালকরা। ওই চালক জানালেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করে চাকুরি জুটাতে পারেননি, তাই বাধ্য হয়ে বাইক চালাতে নেমেছেন। বললেন, ‘এভাবে কাউকে ডাকতে যে সংকোচ হয় না তা নয়, তবে ক্ষুধা আর বেঁচে থাকার চেয়ে কিছুই বড় নয়।’

কর্মস্থলে আসতে রোজ একইভাবে বাইকচালকদের এভাবে মলিনমুখে দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। বলতে গেলে গোটা ঢাকা শহরজুড়েই তাদের এভাবে বেকার বসে থাকা চোখে পড়ে। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)সহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, রাজধানী ঢাকা শহরে ১০ লাখেরও বেশি মোটরবাইক চলে। ধারণা করা যায়, তাদের একটি বড় অংশই বিভিন্ন রাইড শেয়ারিং অ্যাপে সংযুক্ত হয়ে পথে নেমেছেন ভাড়ায় যাত্রী পরিবহণের জন্য। রাইড শেয়ারিং অ্যাপে কানেক্ট হলেও অধিকাংশ বাইকচালক এখন পথেই আগ্রহী যাত্রীদের সঙ্গে দরকষাকষি করে কাঙ্খিত গন্তব্যে যেতে সম্মত হয়ে যান।

২০২২ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৩২ লাখেরও বেশি নিবন্ধিত মোটর সাইকেল রয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও মোটর সাইকেলে ভাড়ায় যাত্রী পরিবহণের প্রচলন অনেক আগেই শুরু হয়েছে। ২০১০ সালে সুন্দরবনে বেড়াতে গিয়ে মোংলায় এক বাইকে দু’জন-তিনজন নিয়েও চলতে দেখেছি। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশের শিক্ষিত তরুণদের একটি বৃহৎ অংশ কাঙ্খিত চাকুরি না পেয়ে কিংবা চাকুরির আবেদন করে অপেক্ষায় থেকে থেকে জীবিকার প্রয়োজনে এই মোটর সাইকেলে যাত্রী পরিবহণে নেমেছেন। কিন্তু এই হুজুগে জাতির একজন কিছু করতে দেখলে বা কোন একটা সম্ভাবনার খবর পেলে সবাই তাতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। চিরাচরিত এই রেওয়াজে প্রয়োজনেরও অনেক বেশি বাইক চালক যাত্রী পরিবহণে নেমেছেন। তাই জীবিকার আশায় পথে নামলেও যাত্রীর দেখা পাচ্ছেন না, কাঙ্খিত আয় করতেও ব্যর্থ হচ্ছেন। তরুণ জনশক্তির একটি বড় অংশ এভাবে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে অনেক সময় পথ দুর্ঘটনায় পড়ছেন। কখনো কখনো জড়িয়ে পড়ছেন নানা সামাজিক অপরাধেও।

দ্রব্যমূল্যের চরম উর্ধ্বগতিতে জনজীবনে যে নাভিশ্বাস তা নীতিনির্ধারকরা অনেকেই আমলে নিতে চান না। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তাদের অনেককেই বলতে শোনা যায়, ‘বাজারে তো কোন জিনিসের সংকট নেই’ কিংবা ‘মানুষের ক্রয় ক্ষমতা এখন বেড়েছে’ ইত্যাদি। কিন্তু সমাজে যেই মানুষেরা শিক্ষা অর্জন করে এক ধরণের আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন হয়েছেন, যাঁরা চরম দারিদ্রেও নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশে কুণ্ঠিত-সেই শ্রেণীর জন্য বর্তমানে টিকে থাকা কতটা কঠিন তা দীর্ঘসময় যাত্রীর জন্য দাঁড়িয়ে থাকা সেই বাইকচালকের মুখাবয়ব দেখে সহজেই বুঝে নেওয়া যায়। বর্তমানে স্যোশাল মিডিয়ার কল্যাণে সমাজের ভেতরকার ক্ষোভ-উত্তাপ আন্দাজ করা যায় কঠিন নয়। আমরা লক্ষ্য করি, উঠতি ধণাঢ্য হয়ে একটি শ্রেণির বেপোরোয়া চাকচিক্যময় জীবনযাপন অন্যদিকে চরম হতাশায় দিনশেষে ক্ষুধার অন্ন জোগাড় করতে না পারার দুঃখ কিংবা মাস শেষে মেসের সামান্য কয়টা টাকা দিতে না পারায় ম্যানেজারের গঞ্জনা।

বাইকে যাত্রী পরিবহণ করে জীবন চালাতে না পারা এমন তরুণদের মতো বিভিন্ন পেশার আরও বহু তরুণদের আমরা দেখি যাদের অবস্থার আরও করুণ। ক’দিন আগে স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ঘটনা নিয়ে পরবর্তীতে মূলধারার সংবাদপত্রেও খবর হতে দেখেছি-কাওরানবাজারে বড় মাছ কিনে কাটিয়ে নেওয়ার পর মাছের অন্ত্রনালী, পাখনাসহ অন্যান্য ফেলে দেওয়া যেসব অংশ থাকে তাও ভাগা দিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। মুখ ঢেকে তাও কিনে নিয়ে যাচ্ছেন এক শ্রেণির মানুষ। প্রকাশিত খবরের তথ্য অনুযায়ী, তারা ভিখারি কিংবা ছিন্নমূল কেউ নন। যারা মাছের ওইসব ফেলে দেওয়া অংশের ভাগ কিনে নিচ্ছেন তারা অবস্থার পাকে পড়ে জীবনসংকটে থাকা শিক্ষিত বেকার মানুষ। ৭-৮শ’ টাকা কেজিতে মাছ কেনার সমার্থ্য তাদের নেই।

বর্তমানে দেশের অকাঠামোগত ও কিছু মানুষের বিপুল প্রতিপত্তি দেখে তথাকথিত ‘উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা’র সরলীকরণ করা যাবে না। এই উন্নয়ন যে সামগ্রিকভাবে আর্থ-সমাজিক অসমতাকে দূর করতে পারেনি তা আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবেই বলতে পারি। বাংলামটর মোড়ে দেড় ঘন্টা ধরে যাত্রীর জন্য দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষিত ওই তরুণটির কাছে এই আলোঝলমলে এই শহর যেমন একরাশ হতাশা ছাড়া কিছুই নয় তেমনি প্রত্যন্ত কোন গ্রামে ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া কৃষকের কাছেও ধূসর জীবনের সবই নিরানন্দ।

;

প্রতিষ্ঠার ১০ বছর সময়কাল দেশীয় বিমানসংস্থার জন্য ‘অশনি’ না ‘শুভ’ সংকেত!



মো. কামরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দশ বছর খুব কি বেশী সময় এভিয়েশনের কিংবা এয়ারলাইন্সের ইতিহাস বলার জন্য? কিন্তু বাংলাদেশ এভিয়েশনের জন্য ১০ বছর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা মাইল ফলক হয়ে আছে। এই সময়টা সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করতে পেরেছে কয়টি এয়ারলাইন্স? যার ফলাফল খুঁজতেই বাংলাদেশ এভিয়েশনের ছোট্ট অধ্যায়ের পাতা উল্টালেই খুব বেশি সুখকর স্মৃতি খুঁজে পাওয়া যাবে না। স্মৃতির পাতায় মোড়ানো বাংলাদেশ এভিয়েশনের ইতিহাসে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোর ১০ বছর সময়কাল কি ‘অশনি না শুভ সংকেত’ তা বোঝার চেষ্টা করেছি।

বাংলাদেশ এভিয়েশনে উত্থান আর পতনের মধ্য দিয়েই অগ্রসর হওয়ার গল্প লুকিয়ে আছে। এক ঘণ্টার আন্তর্জাতিক ফ্লাইট করে এসে ২ থেকে ৩ ঘণ্টার অপেক্ষা লাগেজের জন্য, নয়টার প্লেন কয়টায় যাবে যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, এয়ারক্রাফট এসি নাকি নন-এসি, ফ্লাইট আদৌ যাবে তো ইত্যাদি ইত্যাদি, যা হরহামেশা শুনা যেত যাত্রীদের কাছ থেকে। সেই সব বাক্যগুলো আজ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। আর সেই বাক্যগুলোকে ইতিহাসের পাতায় স্থান দিতে সহায়তা করেছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স।

আজ বাংলাদেশ এভিয়েশনের প্রায় ৫২ বছরের গল্প, যেখানে সুখকর গল্পের স্থান খুবই সামান্য। প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের ইতিহাস তো আরো নাজুক। জিএমজি, ইউনাইটেড, রিজেন্ট, বেস্ট এয়ারের মতো প্রায় ৮ থেকে ৯টি এয়ারলাইন্স বন্ধ হওয়ার মিছিলে যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে মাত্র তিনটি বেসরকারি বিমানসংস্থা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স, নভোএয়ার ও এয়ারঅ্যাস্ট্রা জাতীয় বিমানসংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর সাথে বাংলাদেশে আকাশ পরিবহন ব্যবসায় জড়িয়ে আছে।

১০ বছর সময়কাল বাংলাদেশের বেসরকারি বিমানসংস্থার জন্য অনেকটা চ্যালেঞ্জিং বছর। ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ও রিজেন্ট এয়ারওয়েজ ১০ বছর অতিক্রমকালীন সময়ে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। জিএমজি এয়ারলাইন্স ১০ বছর পর ব্যবসায় নিম্নমূখী প্রবণতা দেখা গেছে যা ১৪ বছরের সময় একেবারেই বন্ধ করে দিতে হয়েছে। বর্তমানে নভোএয়ার ১১ বছরের অধিক সময়কাল অতিক্রম করছে।

পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নকে সাথে নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট শুরু করার পর থেকেই ব্যবসা থেকে সেবাকেই প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে ইউএস-বাংলা। ইতিমধ্যে যাত্রীদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ১৭ জুলাই ২০১৪ সালে যাত্রা শুরু করে বর্তমানে ১০ বছর সময় অতিক্রম করছে। যাত্রা শুরুর পর থেকে দেশের মানুষকে আকাশ পথে সেবা দেয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলো। সেই প্রতিজ্ঞাকে বাস্তবে রূপ দিতেই ইউএস-বাংলা প্রতিনিয়ত কাজ করছে। লক্ষ্য একটাই সেবার মাধ্যমে বাংলাদেশি নাগরিকরা বিশ্বের যেসকল গন্তব্যে অবস্থান করছে, দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখছে, সেই সকল রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সেবা দেয়ার মানসে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স প্রতিমূহুর্তে বিমানবহরে নতুন নতুন উড়োজাহাজ যোগ করছে, যোগ করছে দেশের নাগরিকদের কাছে আকর্ষণীয় সকল গন্তব্য।

বেশ কিছু রুট পরিচালনার জন্য ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সকে বাংলাদেশ এভিয়েশন সব সময়ই মনে রাখবে। বিশেষ করে ভারতের চেন্নাই, চীনের গুয়াংজু, মালদ্বীপের রাজধানী মালে রুটগুলো অন্যতম। যেখানে জাতীয় বিমানসংস্থাও পরিকল্পনা সাজাতে পারেনি, সেখানে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স বাস্তব রূপ দিতে সক্ষম হয়েছে। ইউএস-বাংলাকে অনুসরণ করে অন্য এয়ারলাইন্সগুলো সেইসব রুটে ফ্লাইট শুরু করেছে। কিন্তু মালেতে দেশীয় একমাত্র ইউএস-বাংলাই ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এছাড়া কলকাতা, দুবাই, শারজাহ, আবুধাবি, মাস্কাট, দোহা, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, ব্যাংকক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ১৫ মিলিয়ন প্রবাসী বাংলাদেশিরা অবস্থান করছে, যার মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশ প্রবাসী তথা রেমিট্যান্স যোদ্ধারা বাস করছে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপ। উল্লেখিত প্রতিটি দেশেই ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। সম্প্রতি সৌদি আরবের জেদ্দায় ফ্লাইট পরিচালনা করতে যাচ্ছে।

২টি ড্যাশ ৮-কিউ৪০০ নিয়ে যাত্রা শুরু করা ইউএস-বাংলার বহরে বর্তমানে রয়েছে ৪৩৬ আসন বিশিষ্ট দুইটি এয়ারবাস ৩৩০-৩০০, নয়টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০, দশটি ব্র্যান্ডনিউ এটিআর ৭২-৬০০ ও তিনটি ড্যাশ৮-কিউ৪০০ এয়ারক্রাফট। এখানে উল্লেখ্য সংখ্যার বিচারে দেশের সরববৃহৎ এয়ারলাইন্স ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ রুটে সর্বপ্রথম ব্র্যান্ডনিউ এয়ারক্রাফট দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করেছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স।

দেশের এভিয়েশনের অগ্রযাত্রায়, বেকার সমস্যা দূরীকরণে, অর্থনীতির চালিকা শক্তিতে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখছে।

প্রতিষ্ঠার ১০ বছর সময়কাল যেন বাংলাদেশ এভিয়েশনে বেসরকারি বিমানসংস্থাগুলো নিকট অশনি সংকেত না হয়ে শুভ সংকেত রূপে স্থায়ী হয়, তা সকলের কাম্য।

লেখক
মো. কামরুল ইসলাম
মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স

;