‘অনুপস্থিত’ অর্থমন্ত্রী যদি অব্যাহতি নিতেন!
আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর− সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল (আ হ ম মুস্তাফা কামাল)। তিনি তার পূর্বসূরির মতো সফল হতে পারেননি। বরং বর্তমান অর্থমন্ত্রীর সময়ে দেশ পড়তে যাচ্ছে অনিশ্চয়তায়।
আবুল মাল আবদুল মুহিত সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতি হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।
মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীকে যেখানে টেনে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল সেটা এখন হচ্ছে না। টালমাটাল বিশ্ববাজার, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধজনিত পরিস্থিতিতে বিশ্বের দেশে-দেশে অর্থনৈতিক দুরবস্থা চলছে সত্য, তবে প্রতি দেশ যেখানে পরিকল্পনা ধরে এগুচ্ছে সেখানে আমাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছুই জানা যাচ্ছে না। অভ্যন্তরীণ বাজার পরিস্থিতি, মূল্যস্ফীতিতে মানুষের জীবন যখন দুর্বিষহ তখন আমাদের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামালকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারের পরিকল্পনা নিয়ে তিনি যেখানে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করার কথা সেখানে তিনি নিজেই সবকিছুতে অনুপস্থিত।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, অর্থমন্ত্রী মুস্তাফা কামাল সচিবালয়ে নিয়মিত আসেন না। একনেকের বৈঠকের উপস্থিত হন না। মন্ত্রণালয়ের বৈঠকেও অংশ নেন না। নিজের বাসায় কাজ করেন বলে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দাবি করেছেন। ক্রান্তিকালে সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী যখন নিজেকে প্রায় গুঁটিয়ে নিয়েছেন তখন দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়তে নৈরাশ্যবাদী হওয়া লাগে না; আপনা থেকেই এটা ভর করে।
ক্রান্তিকাল না হোক, স্বাভাবিক সময়েও অর্থমন্ত্রীর মতো দায়িত্বশীল জায়গার কারও এমন অবস্থা মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু তা-ই হচ্ছে। সরকারপ্রধান অর্থমন্ত্রীর অনুপস্থিতিকে গ্রাহ্য করছেন। ঝঞ্ঝামুখর এই সময়ে একজন অর্থমন্ত্রী কিছুতেই নেই, এটা আর যাই হোক স্বাভাবিক কিছু নয়। অর্থমন্ত্রী কিছুতেই নেই, কিন্তু মন্ত্রী হিসেবে তিনি সরকারি সকল সুবিধা ভোগ করে যাচ্ছেন। কিছুদিন আগেও সরকারি খরচে চিকিৎসার জন্যে বিদেশ সফর করেও এসেছেন। এটা তার রুটিন স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়তো। যদি রুটিন স্বাস্থ্য পরীক্ষার বাইরে গুরুতর অসুস্থতার কারণে বাইরে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন, যদি তিনি অসুস্থতার কারণে অর্থমন্ত্রীর মতো গুরুদায়িত্ব পালনে সক্ষম না হয়ে থাকেন তবে তার উচিত হবে পদ আঁকড়ে না থাকা। কারণ সরকারপ্রধান তাকে দায়িত্ব দিয়েছেন কাজের জন্যে, দেশের জনগণ তার কাছ থেকে কাজ আশা করে; তিনি কাজের জন্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শারীরিক অসুস্থতা কিংবা অন্য কোন কারণে তিনি যদি অক্ষম হয়ে থাকেন তবে পদ আঁকড়ে থাকা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের নামান্তর। এটা তিনি করতে পারেন না, এটা কেউ করতে পারে না।
অর্থমন্ত্রী অসুস্থ হয়ে থাকলে তার সুস্থতা কামনা করি। সুস্থতা-অসুস্থতায় কারও হাতে থাকে না, কিন্তু দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়া নিশ্চয়ই সুস্থতা-অসুস্থতার মতো প্রকৃতিপ্রদত্ত কিছু নয়। এটা কাজ করার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারার সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত। তবে অসুস্থতায় স্বাভাবিকভাবে কাজ না করেও পদ ধরে রাখার প্রচেষ্টা কেবল সুবিবেচনা পরিপন্থিই নয়, এটা রাষ্ট্র-সরকার ও নাগরিকের সঙ্গে প্রতিশ্রুতিভঙ্গের অংশও কি হয়ে যায় না?
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিচ্ছেন না, এদিকে সরকারপ্রধানও তাকে অব্যাহতি নিতে বলছেন না−এটা বিস্ময়ের। নির্বাচনের এক বছর আগে দেশের ভবিষ্যৎ ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা নিয়ে শঙ্কার আলোচনার এই সময়ে অর্থমন্ত্রী পদত্যাগ করলে মানুষ কী বলবে এটাই কি ভয়? কিছুদিন আগে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে এমন একটা আলোচনা বেশ হাওয়া পেয়েছিল। বৈদেশিক রিজার্ভ কমতির দিকে, বাজার পরিস্থিতি যেকোনো সময়ের চাইতে ভয়াবহ, তেলের দাম বৃদ্ধিতে দিশেহারা মানুষ। আসছে বছরে দুর্ভিক্ষ আঘাত হানতে পারে এমনই বক্তব্য নিয়মিত দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। বিদ্যুতের লোডশেডিং পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ কবে সেটাও সঠিকভাবে বলতে পারছে না সরকার। এমন অবস্থায় অর্থমন্ত্রী পদত্যাগ করলে সরকার দল আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষ বিরূপ হবে এমনই কি শঙ্কা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার? হতে পারে। তবে এই শঙ্কার পথ ধরে অনেক কিছুতে অনুপস্থিত অর্থমন্ত্রীকে পদে টিকিয়ে রাখা কি দেশের জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী নয়?
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজ আর অন্য মন্ত্রণালয়গুলোর কাজ এক নয়। সকল মন্ত্রণালয়ের কাজের কেন্দ্রেও থাকে এ মন্ত্রণালয়, এখানে দরকার তাই কর্মক্ষম ও দক্ষ মন্ত্রী। কোনোমতে কাউকে দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়ার মত ক্ষেত্র এটা নয়। অসুস্থতায় পদে রেখে ‘সহানুভূতি’ দেখানোর জায়গা এটা নয়। এটা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার জায়গা, পদ-পদবি দখলের জায়গা মোটেও নয়। আর সারাবিশ্বের মতো আমরাও যখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি তখন এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বও বেশি।
আমরা দেখছি আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার কারণে ব্রিটেনে একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। বরিস জনসন, লিজ ট্রাস কেউ টিকতে পারেননি। নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ঋষি সুনাক। বদলেছে মন্ত্রিসভা। মূল্যস্ফীতিসহ প্রবল অর্থনৈতিক দুরবস্থায় দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে অর্থমন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীরা সেখানে টিকতে পারছেন না। দেশ এবং কেবলই দেশের জনগণকে গুরুত্ব দিয়ে সরকারপ্রধানসহ মন্ত্রিসভার পরিবর্তন হচ্ছে সেখানে। এমন না যে তাদের অর্থমন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীরা কাজ করেননি, তবু পদত্যাগ করতে হয়েছে জনগণের স্বার্থে। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্র ভিন্ন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাজ করছেন, এটা সন্দেহাতীতভাবে সত্য। কিন্তু তার মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল যখন সচিবালয়েই আসেন না, মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বৈঠকসহ বিদেশিদের সঙ্গে বৈঠকে দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন না তখনও তিনি টিকে আছেন, তাকে টিকিয়ে রাখা হচ্ছে। কেন, কীসের জন্যে, কার স্বার্থে, কোন যুক্তিতে?
মুস্তাফা কামাল তার পূর্বসূরি আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো অর্থনীতিবিদ নন। তিনি বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের মতো চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। পাশাপাশি ব্যবসায়ী তিনি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতো মহাগুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় সামলাতে তিনি কতটা সক্ষম সে প্রমাণ পেয়ে গেছে দেশ। বাজেট নিয়েও তিনি কোন সংসদ সদস্যের মতামতকে পাত্তা দিতেন না বলে সংসদেও এনিয়ে অভিযোগ এসেছিল। আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী একবার সংসদে বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, অর্থমন্ত্রী বাজেট নিয়ে কারও কথা শোনেন না। সাবের হোসেন চৌধুরী স্মৃতি রোমন্থন করে বলেছিলেন, আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকাকালে বাজেট-পূর্ব বিভিন্ন বৈঠকে এবং বাজেট আলোচনায় সকলের মতামত/প্রস্তাবকে নোট করতেন, গুরুত্ব দিতেন।
দেশের অর্থনৈতিক এই জরুরি পরিস্থিতিতে যেখানে অর্থমন্ত্রীকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা সেখানে তিনি নিজেই অনুপস্থিত। হতে পারে তিনি অসুস্থ, কিন্তু তার ব্যক্তিগত এই অসুস্থতায় কেন বলী হবে দেশ? দেশকে প্রবল অনিশ্চয়তায় রেখে কেন তিনি পদ আঁকড়ে থাকবেন? তিনি কিংবা মন্ত্রিসভার কেউ অসুস্থতায় কিংবা কোনো কারণে কর্মক্ষমতা হারালে তার/তাদের নিজ থেকেই সরে যাওয়া উচিত। দেশ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সরে যাওয়া উচিত। মন্ত্রিত্বের শপথের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক সরে যাওয়া উচিত। কিন্তু তা না করে পদ আঁকড়ে থাকা দৈহিক অসুস্থতার আলোচনা ছাপিয়ে নৈতিক অসুস্থতার আলোচনায় রূপ নেয়।
আমরা যখন দুর্দিনের মুখোমুখি, যখন উত্তরণে দরকার সঠিক নেতৃত্ব, কাজ এবং কাজ; তখন অর্থমন্ত্রীকে টিকিয়ে না রেখে তাকে অব্যাহতি দেওয়া উচিত। সরকার ও জনগণ আ হ ম মুস্তাফা কামালের প্রতি দায়বদ্ধ নয়, বরং মুস্তাফা কামালই জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। অর্থমন্ত্রী ব্যক্তি নয়, প্রতিষ্ঠানের অন্যতম ব্যক্তি। ব্যক্তি এখানে কাজের জন্যে শপথ নিয়েছেন। কাজ করার ক্ষমতা হারালে সরে যাওয়া নৈতিক দায়িত্ব তার। প্রধানমন্ত্রী তাকে নিয়োগ দিয়েছেন। কাজ ছাড়া সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীকে কেন টিকিয়ে রাখছেন প্রধানমন্ত্রী?
শুরু করেছিলাম সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে দিয়ে। মুহিতের মৃত্যুতে দেশ যে প্রাজ্ঞজনকে হারিয়েছিল তার প্রভাব এখন স্পষ্ট। তিনি কী ছিলেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামালকে দিয়েই আমরা টের পাচ্ছি। চৌদ্দ বছর আগে দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও বিশ্বমন্দা পরিস্থিতি সত্ত্বেও আবুল মাল আবদুল মুহিত যেখানে বাংলাদেশকে পথ দেখিয়েছিলেন সেখানে বর্তমান টালমাটাল বিশ্বে চাপ সইতে না পারা অর্থমন্ত্রী মুস্তাফা কামাল দেশকে অনিশ্চয়তার পথেই নিয়ে যাচ্ছেন। এই মুহূর্তে তিনি হয়তো একমাত্র সমস্যা নন, কিন্তু অন্যতম সমস্যা হয়ে ওঠেছেন।
আ হ ম মুস্তাফা কামাল আপনি অসুস্থ। আপনার নিরবচ্ছিন্ন বিশ্রাম দরকার। শারীরিক অসুস্থতায় বহুবিধ চাপ আপনাকে আরও অসুস্থ করে দিচ্ছে হয়তো। শারীরিক অসুস্থতার কারণে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিলে নতুন কেউ অন্তত আপনার জায়গায় এসে কাজ করার চেষ্টা করতে পারত। দয়া করে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিন। মন্ত্রিত্ব নয়, দেশই হোক অগ্রাধিকার!
কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।
ইমেইল: [email protected]