সেলফি’র সমাজতাত্ত্বিক তাৎপর্য
২০১৪ সালের মার্চে পিউ রিসার্চ সেন্টার ঘোষণা করে যে এক চতুর্থাংশ আমেরিকান অনলাইনে একটি করে ‘সেলফি’ শেয়ার করেছেন। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, নিজের ছবি তোলা এবং সেই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করার অভ্যাসটি শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ একটি বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। পিউ রিসার্চ সেন্টার আরো উল্লেখ করেছে, সমীক্ষার সময় ১৮ থেকে ৩৩ বছর বয়সী প্রতি দুইজনের মধ্যে একজন সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি করে সেলফি শেয়ার করেছেন।
সেলফি এখন মূলধারায় চলে এসেছে।‘সেলফি’ মূলধারার চলে আসার প্রমাণ আমাদের সংস্কৃতির অন্যান্য দিকগুলিতেও দেখা যায়। ২০১৩ সালে ‘সেলফি’ অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারীতে যুক্ত হয় এবং বছরের সেরা শব্দ হিসেবে পরিচিতি পায়। ২০১৪ সালের জানুয়ারির শেষের দিকে, The Chainsmokers-এর "#Selfie"-এর মিউজিক ভিডিওটি YouTube-এ ২৫০ মিলিয়ন বার দেখা হয়।
আমরা কেন ‘সেলফি’ শেয়ার করি? সহজ কথায়, ভৌত এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি এটিকে সম্ভব করে তোলে, তাই আমরা এটি করি। প্রযুক্তি সামাজিক বিশ্ব এবং আমাদের জীবন গঠন করে এমন ধারণাটি মার্কসের মতোই একটি সমাজতাত্ত্বিক যুক্তি, এবং তাত্ত্বিক ও গবেষকদের দ্বারা বারবার পুনরাবৃত্তি হয় যারা সময়ের সাথে যোগাযোগ প্রযুক্তির বিবর্তনকে নজরে রেখেছেন।
সেলফি অভিব্যক্তির নতুন রূপ নয়। শিল্পীরা হাজার বছর ধরে স্ব-প্রতিকৃতি তৈরি করেছেন, গুহা থেকে ক্লাসিক্যাল পেইন্টিং, প্রাথমিক ফটোগ্রাফি এবং আধুনিক শিল্প পর্যন্ত। আজকের সেলফিতে নতুন যা আছে তা হল এর সাধারণ প্রকৃতি এবং এর সর্বব্যাপীতা। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি শিল্পজগত থেকে স্ব-প্রতিকৃতিকে মুক্ত করেছে এবং জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে।
অনেকেই বলেন ভৌত ও ডিজিটাল প্রযুক্তিগুলি (ডিজিটাল ডিভাইস ও সফট্ওয়ার) যেগুলি সেলফি তোলায় সহায়তা দেয় সেগুলি "প্রযুক্তিগত যৌক্তিকতা" হিসেবে আমাদের উপর কাজ করে।সেগুলোর নিজস্ব একটি যৌক্তিকতা প্রয়োগ করে যা আমরা কীভাবে আমাদের জীবনযাপন করি তার আকার দেয়।
ডিজিটাল ফটোগ্রাফি, ফ্রন্ট-ফেসিং ক্যামেরা, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এবং ইন্টারনেট কমিউনিকেশন অনেক প্রত্যাশা এবং নিয়মের জন্ম দিয়েছে যা এখন আমাদের সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে। আমরা যা পারিতাই আমরা করি। কিন্তু এছাড়াও, আমরা করি কারণ প্রযুক্তি এবং আমাদের সংস্কৃতি উভয়ই তা আমাদের কাছে প্রত্যাশা করে।
আমাদের পরিচিতির কাজ এখন ডিজিটাল হয়ে গেছে। আমরা কঠোরভাবে পৃথক জীবনযাপনকারী বিচ্ছিন্ন প্রাণী নই। আমরা সামাজিক জীব যারা সমাজে বাস করি, এবং আমাদের জীবন মৌলিকভাবে অন্যান্য ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক কাঠামোর সাথে সামাজিক সম্পর্কের দ্বারা গঠিত।
সুতরাং সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘সেলফি’ শেয়ার দ্বারা বোঝানো হয়েছে, সেলফি ব্যক্তিগত কাজ নয় বরংএটি একটি সামাজিক কাজ। সমাজবিজ্ঞানী David Snow এবং Leon Anderson‘সেলফি’ দ্বারা সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের উপস্থিতিকে "পরিচয় কাজ" হিসেবে বর্ণনা করেছেন।যে কাজটি আমরা দৈনন্দিন ভিত্তিতে করি এই প্রত্যাশা থেকে যে অন্যদের পছন্দের জন্য আমরা নিজেদের উপস্থাপন করি।
পরিচয়ের কারুকাজ এবং প্রকাশকে একটি সহজাত বা অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া হিসেবে সমাজবিজ্ঞানীরা একটি সামাজিক প্রক্রিয়া হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বুঝার চেষ্টা করে আসছেন।আমরা যে সেলফিগুলি তুলি এবং শেয়ার করি সেগুলি আমাদের একটি নির্দিষ্ট চিত্র উপস্থাপন করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, এবং এইভাবে, অন্যদের দ্বারা আমাদের সম্পর্কে একটি গভীর অনুভূতি (ভালো বা মন্দ) তৈরি করার জন্য।
বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী Erving Goffman তার বই The Presentation of Self in Everyday Life – এ “ইমপ্রেশন ম্যানেজমেন্ট" এর প্রক্রিয়া বর্ণনা করেছেন। এই শব্দটি এই ধারণাটিকে বোঝায় যে অন্যরা আমাদের কাছে কী প্রত্যাশা করে বা অন্যরা আমাদের সম্পর্কে কী অনুভূতি প্রকাশ করবে সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা রয়েছে এবং এটি আমরা কীভাবে নিজেদেরকে উপস্থাপন করি তার আকার প্রদান করে।
আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী Charles Horton Cooley নিজেকে তৈরি করার একটি প্রক্রিয়া বর্ণনা করেছেন যা আমরা কল্পনা করি যে অন্যরা আমাদেরকে "দ্যা লুকিং-গ্লাস সেলফ" হিসাবে ভাববে, যার ফলে সমাজ এমন একটি আয়না হিসাবে কাজ করে যেখানে আমরা নিজেদেরকে ধরে রাখি।
ডিজিটাল যুগে, আমাদের জীবন ক্রমবর্ধমানভাবে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রজেক্ট করা, ফ্রেম করা এবং ফিল্টার করা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বড় একটি অংশ সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিবাহিত হয়। সুতরাং বোঝা যায়, আমাদের পরিচিতিটাও এখন এখানে উপস্থাপন করা হয়।
আগে আমরাআমাদের আশেপাশের এলাকা, স্কুল এবং কর্মসংস্থানের জায়গার মধ্য দিয়ে চলার সময় পরিচয়ের কাজে নিযুক্ত হতাম। নিজেদের পোশাক, আচরণ, ফ্যাশন, বাকশৈলী, হাঁটাচলা ও দেহের ভঙ্গীর মাধ্যমে পরিচিত হতাম। আমরা টেলিফোন ও চিঠিপত্রের মাধ্যমেও পরিচিত হতাম।
কিন্তু এখন আমরা Email, Text Message, Facebook, Twitter, Instagram, YouTube এবং LinkedIn-এর মাধ্যমেপরিচিত হয়ে থাকি। একটি স্ব-প্রতিকৃতি (self-portrait) হল পরিচিত হওয়ার সবচেয়ে সুস্পষ্ট চাক্ষুষ রূপ এবং এটি সামাজিকভাবে মধ্যস্থতাকৃত রূপ (socially mediated form), সেলফি, এখন সেই কাজের একটি সাধারণ, এমনকি প্রয়োজনীয় রূপ।
বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী Richard Dawkins তার বই, The Selfish Gene- এ উল্লেখ করছেন, সেলফি তুলতে মেম (Meme) আমাদেরকে বাধ্য করে। তিনি মেমের একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন যা সাংস্কৃতিক অধ্যয়ন, মিডিয়া স্টাডিজ এবং সমাজবিজ্ঞানের জন্য গভীরভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। উল্লেখ্য মেমকে অনেকে পপুলার কালচার সংক্ষেপে পপ কালচার বা জনপ্রিয় সংস্কৃতি হিসেবেও তুলনা করেন।
Dawkins মেমকে একটি সাংস্কৃতিক বস্তু বা সত্তা হিসাবে বর্ণনা করেছেন যা তার নিজস্ব প্রতিলিপিকে উৎসাহিত করে। এটি সঙ্গীতের রূপ নিতে পারে, নাচের শৈলীতে দেখা যেতে পারে এবং অন্যান্য অনেক কিছুর মধ্যে ফ্যাশন প্রবণতা এবং শিল্প হিসাবে প্রকাশ পেতে পারে।
এখন ইন্টারনেটে মেমস প্রচুর, প্রায়শই হাস্যকরসুরে, অদ্ভূত দেহভঙ্গিতে তাদের উপস্থিতিক্রমবর্ধমানএবং এটি যোগাযোগের একটি ফর্ম হিসেবেও আর্বিভূত হয়েছে। টিকটক ভিডিও অনেকটাই মেমের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আমাদের ফেসবুক এবং টুইটার ফিডগুলি ভরে থাকেমেম দিয়ে।পুনরাবৃত্ত চিত্র এবং বাক্যাংশের সংমিশ্রণে মেমস একটি শক্তিশালী যোগাযোগের দিকে তাড়িত করে।
তারা প্রতীকী অর্থের সাথে গভীর ভাবে ভারাক্রান্ত। যেমন, তারা তাদের প্রতিলিপি করতে বাধ্য করে; কারণ, যদি তারা অর্থহীন হত, যদি তাদের কোন সাংস্কৃতিক মুদ্রা না থাকত, তারা কখনই একটি মেম হয়ে উঠত না।
এই অর্থে, সেলফি অনেকটাই একটি মেম। এটি একটি আদর্শিক বিষয় হয়ে উঠেছে যা আমরা করি। যার ফলে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করার একটি প্যাটার্নযুক্ত এবং পুনরাবৃত্তিমূলক উপায় হয়।উপস্থাপনের সঠিক শৈলী পরিবর্তিত হতে পারে কিন্তু ফর্ম এবং সাধারণ বিষয়বস্তু— ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ছবি যারা ফ্রেম পূরণ করে একই থাকে।
এটি একটি সাংস্কৃতিক গঠন যা আমরা সম্মিলিতভাবে তৈরি করেছি, আমরা কীভাবে আমাদের জীবনযাপন করি, কীভাবে আমরা নিজেকে প্রকাশ করি এবং অন্যরা আমাদের কিভাবে দেখে তার প্রকাশ ঘটে সেলফির মাধ্যমে।সেলফি, একটি মেম হিসাবে, একটি সাংস্কৃতিক গঠন এবং যোগাযোগের একটি রূপ যা এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে গভীরভাবে মিশে গেছে এবং অর্থ ও সামাজিক তাৎপর্য দ্বারা পূর্ণ হয়েছে।
মো. বজলুর রশিদ, সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।