একুশে আগস্টের নৃশংসতা ও বিরোধী রাজনীতি নির্মূলের পরিকল্পনা



ড. প্রণব কুমার পান্ডে
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আগস্ট মাস বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয় কারণ এই মাসেই ইতিহাসের জঘন্যতম দুটি ঘটনা ঘটেছিল। একটি ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট যেদিন বিশ্বাসঘাতকের দল দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। সেদিন ঘাতকদের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলার ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে চিরতরে মুছে ফেলা। তারা নিশ্চিত করতে চেয়েছিল যে বঙ্গবন্ধুর কোন বংশধর যেন বাংলার মাটিতে বেঁচে না থাকে। আর এই জন্যই খুনিরা ছোট্ট রাসেলকেও হত্যা করতে দ্বিধা করেনি। কিন্তু তাদের সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি কারণ বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা-শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা- সেই সময় দেশের বাইরে অবস্থান করায় বেঁচে যান।

যেহেতু শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে এসে সামরিক শাসনের নিষ্পেষণে নিষ্পেষিত ভঙ্গুর আওয়ামী লীগের দায়িত্ব গ্রহণ করে দলকে শক্তিশালী করে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন, সেহেতু এই হায়নার দল আবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় শেখ হাসিনাকে হত্যার। ২০০১ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসতে ব্যর্থ হলে বিএনপি'র নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার গঠন করার পর থেকেই আওয়ামী লীগের ওপরে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন চালানো হয় সরকারি পিষ্টপোষকতায়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ২১ শে আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের জনসভায় শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়।

১৫ই আগস্ট এর মত ২১ শে আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসের আর একটি জঘন্যতম দিন কারণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তৎকালীন সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী তথা আওয়ামী লীগের সভানেত্রীকে হত্যার উদ্দেশ্যে জঘন্যতম গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। এই ধরনের হামলা সভ্য সমাজে বিরল ঘটনা। সেই দিন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের জীবনের বিনিময়ে শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হন। শেখ হাসিনাসহ প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ নেতা-কর্মী আহত হন যারা আজও নিজেদের শরীরে গ্রেনেডের স্প্রিন্টার বহন করে বেঁচে আছেন অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে।

এই গ্রেনেড হামলাকে কেন জঘন্যতম ঘটনা বলা হয় কারণ আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি তৎকালীন সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর জ্ঞাতসারেই এই হামলা চালানো হয়েছিল। হামলা পরবর্তী সময়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আমরা জজ মিয়া নাটকের মঞ্চায়ন দেখেছিলাম। কিন্তু যে বিষয়টি ঘাতকেরা কখনোই মনে রাখে না সেটা হল সত্য কখনোই চাপা থাকে না। সত্য একদিন প্রকাশ হবেই। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট এর ঘটনার পেছনের মূল নায়কদের মুখোশ উন্মোচিত হতে দেখেছি। বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রাহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন এবং ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে এই মামলায়। আর এই কারনেই বলা হয়েছে যে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সেই হামলা চালান হয়েছিল। কোন একটি রাজনৈতিক দলকে নিশ্চিহ্ন করার নিমিত্তে সেই দলের নেতাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে গ্রেনেড হামলা করা কোন সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কখনোই কাম্য হতে পারে না।

আমরা যদি একুশে আগস্টের ঘটনাটিকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি তাহলে যে জিনিসটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে সেটি হচ্ছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের প্রেতাত্মারা এই ঘটনার পেছনের মূল চালিকাশক্তি ছিল। কারণ সেই দিন এই ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে বঙ্গবন্ধু বা তাঁর ঔরসজাত কেউ বাংলাদেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। কিন্তু তখন তারা ভুলে গিয়েছিল যে ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। যেহেতু শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সেদিন ভাগ্যের জোরে দেশের বাইরে থাকার কারণে বেঁচে গিয়েছিলেন এই ঘাতকেরা কখনোই এটি ভেবেছিল না যে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা একদিন দেশে ফিরে এসে তার বাবার হত্যার বিচার করবে এবং ফাঁসির রায় কার্যকর করবে।

শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার পর থেকেই এই ঘাতকেরা পুনরায় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং তাদের ষড়যন্ত্র পূর্ণতা পায় ২০০১ সালের নির্বাচনে যখন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হয়। সেই দিক থেকে বিচার করলে একথা স্পষ্টভাবে বলা যায় যে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া বন্ধের জন্যই আসলে ঘাতকের দল চেয়েছিল শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে হত্যা করতে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। আর তাঁকে হত্যা করা গেলে আওয়ামী লীগ পুনরায় বিভিন্ন অংশে খন্ডিত হয়ে যেত এবং আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় আসতে পারতো না। যদি ক্ষমতায় আসতে না পারত তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বাংলার মাটিতেই কখনোই হতো না। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কারণেই একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল।

একুশে আগস্ট এর ঘটনায় আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রাণে বেঁচে গেলেও তিনি বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হন। তিনি তাঁর শ্রবণশক্তি প্রায় হারিয়েই ফেলেছিলেন। একই সাথে অনেক কেন্দ্রীয় নেতা এবং কর্মী আজ পর্যন্ত নিজেদের শরীরে স্প্রিন্টা্রের অসহ্য বেদনা বহন করে চলেছেন যা সত্যিই খুব কষ্টের। তবে সুখের বিষয় হচ্ছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে একদিকে যেমন তাঁর বাবার হত্যার বিচার করেছেন ঠিক তেমনি একুশে আগস্টের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করেছেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে জড়িত সকল খুনিদের যেমন বিচারিক আদালতের রায় কার্যকর করা সম্ভব হয়নি, ঠিক তেমনি ২১ শে আগস্টের ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন আসামীকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসে মামলার রায় কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। ফলে এই মুহূর্তে সরকারের উচিত উভয় মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসে বিচারের রায় কার্যকর করা। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন বঙ্গবন্ধুর আত্মা শান্তি পাবে, ঠিক তেমনিভাবে একুশে আগস্টে যারা নিহত হয়েছেন এবং যারা আজও পর্যন্ত স্প্রিন্টারের অসহনীয় যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন তারাও শান্তি পাবেন।

বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি কাজ করে গেছেন বিধায় সংবিধানের মূল ধারায় ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি সংযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে বিভিন্ন সময়ে এই ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়টিকে বাংলাদেশের সংবিধান থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এটি মুছে দেওয়ার কারণেই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি শক্তিশালি হয়েছে। একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার সরকার দেশ পরিচালনা করবে এটাই কাম্য হওয়া উচিত। কিন্তু অনেকেই এই বিষয়টির সাথে দ্বিমত পোষণ করেন বিধায় সর্বদা চেষ্টা করেন বাংলাদেশে যে কোন প্রক্রিয়ায় অসম্প্রদায়িক সরকারকে উৎখাতের।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যেহেতু ২০০৮ সাল থেকে প্রায় সাড়ে তের বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় রয়েছে সেহেতু সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে হয়তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতাও রয়েছে। সেটি একেবারেই প্রাসঙ্গিক। কারণ কোন দেশের সরকারই সব সময় এটা দাবি করতে পারে না যে তারা সব সময় ভালো কাজ করবে। আর দল যখন দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতায় থাকে তখন দলে এক শ্রেণীর অনুপ্রবেশকারীর জন্ম হয় যারা দলের নাম ভাঙ্গিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করে। কিন্তু বর্তমান সরকারকে সাধুবাদ জানাতে হবে এই জন্য যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে তারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অবশ্যই এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে রাজনীতির কারণে হয়তো কখনও কখনও বিভিন্ন পক্ষের সাথে সরকার আপস করেছে যেটি হয়তো অনেকেই আওয়ামী লীগের কাছে প্রত্যাশা করে নি। ফলে, সরকারের তরফ থেকে বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করা দরকার। তাদের এই বিষয়টি মনে করা দরকার যে এই সমস্ত শক্তির সাথে আপোষ দেশ ও জাতির জন্য কল্যান বয়ে আনবে না।

গত দুই বছরের বেশি সময় বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সকল দেশ কোভিড-১৯ অতিমারীর বিপর্যয় মোকাবিলায় ব্যস্ত সময় পার করছে। আমাদের দেশ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য নেতৃত্বে বেশ ভালোভাবেই এই অতিমারী মোকাবিলা করছে। অতিমারী থেকে বাঁচবার সবচেয়ে বড় অস্ত্র ভ্যাকসিন পৃথিবীর অনেক দেশ পর্যাপ্ত পরিমাণ যোগাড় করতে না পারলেও আমাদের দেশে ভ্যাকসিনের সরবরাহ যথেষ্ট পরিমান রয়েছে। দেশের ৭৮ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে বিধায় দেমে করোনা সংক্রমন নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। তবে এই আগস্ট মাসে আমাদের সকলের উচিত জাতীয় শোক দিবস এবং একুশে আগস্টের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানানো। আসুন আমরা সকলে এই দুটো শোক থেকে শক্তি সঞ্চার করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে পৃথিবীর মানচিত্রে উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করি।

লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসনের একজন প্রফেসর।

 

   

রোহিঙ্গা পরিস্থিতি

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা ও আরাকান আর্মি



ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির (এ এ) সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘাত চলমান রয়েছে। মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ এই সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে উত্তোরনের কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। রাখাইনে প্রায় ছয় লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত অবস্থায় আছে এবং সেখানে ভয়াবহ মানবিক সংকট চলছে। চলমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছে এবং রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজতে ১২ মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে। তারা সেখানে রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া জোরদারকরণে করণীয় সম্পর্কে এবং শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় বলে জানায় রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কবে নাগাদ মিয়ানমার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তা কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাই এই সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের সহায়তা নিশ্চিতে পাশাপাশি রাখাইনে তাদের ফিরে যাবার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতে কার্যক্রম চলমান রাখতে হবে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাসীরা সক্রিয় রয়েছে, তারা সেখানে হত্যা, মারামারি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো কিছু এন জি ও’র সহায়তায় ক্যাম্পে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রত্যাবাসন বিরোধী প্রচারণার দায়ে দুটি এনজিওকে নিষিদ্ধ করা হয় এবং এর পরপরই এনজিওগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত এনজিওগুলো যাতে প্রত্যাবাসন বিরোধী কার্যক্রমে জড়িত না থাকে তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) আধিপত্য বিস্তার কোন্দলসহ খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাদের বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ড পরিচালনা ও পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নাশকতার সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাদেরকে ধরার জন্য উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড়ে তাদের আস্তানায় অভিযান চালায়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন কারণে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কর্তৃক ২০২৩ সালে ৬৪ জন এবং ২০২৪ সালে এ পর্যন্ত ১৬ জন নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। ত্রাণ সহায়তা কমে যাওয়ার কারণে রোহিঙ্গারা জীবিকার তাগিদে ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে কাজ করছে। যারা এই অবৈধ কাজে জড়িত এবং যারা রোহিঙ্গাদেরকে নিয়োগ দিচ্ছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে তাদের সদস্য সংগ্রহ করছে এবং এর ফলে বাংলাদেশে সংকট সৃষ্টির পাশাপাশি আশপাশের দেশেও সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক বিস্তারজনিত সমস্যা তৈরি হচ্ছে। রোহিঙ্গারা বিভিন্ন দল ও উপগোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং তারা অভ্যন্তরীণ কোন্দলে লিপ্ত রয়েছে। আইওএম মহাপরিচালক কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে ৭ মে প্রধানমন্ত্রীর কাছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার বিষয়টি তুলে ধরে। বাংলাদেশ সরকার কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের নিরাপদ অবস্থান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত সংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ করেছে এবং ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছে।

রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় প্রতি বছর আন্তর্জাতিক সহায়তা কমেছে এবং এই ধারা অব্যাহত থাকলে রোহিঙ্গাদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে বলে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, নরওয়ে, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ডের প্রতিনিধিরা তাদের মত ব্যক্ত করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা বাড়ানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য আরো মানবিক ও টেকসই সহায়তা অব্যাহত রাখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ২০২৪ সালের জয়েন্ট রেসপন্স প্লানকে (জে আর পি) সমর্থন জানাতে হবে। এতে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে অবস্থানরত রোহিঙ্গা ও স্থানীয় মিলে সাড়ে ১৩ লাখ মানুষের জন্য ৮৫২.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চাহিদা উপস্থাপন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৭.৬ মিলিয়ন, জাপান ২.৬ মিলিয়ন ডলার এবং নরওয়েও ৬.৫ মিলিয়ন ক্রোনার দেয়ার প্রতিশ্রতি দিয়েছে। সুইডেন এবং সুইজারল্যান্ড জে আর পি’কে সমর্থন জানিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য তহবিল কমে যাওয়ার ফলে যেসব সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে তা থেকে উত্তোরন এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য নতুন উৎস থেকে আরও তহবিল সংগ্রহের জন্য এবং ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করতে আইওএমকে সহায়তা করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বর্তমানে রাখাইনের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল ও সংঘাতপূর্ণ। এ এ জাতিগত রাখাইন জনগোষ্ঠীর জন্য স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এ এ রাখাইনের ১৯ টা টাউন শিপের মধ্যে ১৭ টাতে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। রাখাইনে এ এ ৬ মে বুথিডাং শহরের কাছে মিলিটারি অপারেশন কমান্ড ১৫ দখলের জন্য আক্রমণ চালালে প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর জান্তা সৈন্যরা এ এ’র কাছে আত্মসমর্পণ করে। রোহিঙ্গা ও রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করা সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ, কম্বোডিয়ার তথ্য সংগ্রহকারীদের সঙ্গে সম্প্রতিকালে ২০১৬ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নিধনে অংশগ্রহণকারী অনেক রাখাইনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তারা জানায় যে, সে সময়ের ঘটনার জন্য তারা অনুতপ্ত এবং তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। সে সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যপক প্রচারণার মাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানো কারনে তারা এই কাজ করেছিল এবং তা ঠিক করেনি বলে জানায়। মিয়ানমার সেনাবাহিনী এখনও আরাকানে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে রাখাইনদের মধ্যে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। এর বিপরীতে কোনো মহলে তেমন কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা যায় না। মিয়ানমার সেনাবাহিনী সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা চালালেও সংখ্যাগরিষ্ঠ ভামারদের অনেকে তা গ্রহণযোগ্য মনে করছে না। সেনাবাহিনী রাখাইনে রোহিঙ্গাদেরকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে জাতিগত সংঘাত উস্কে দেয়ার চেষ্টা করছে, তবে এবার তাদের এই প্রচেষ্টা তেমন কার্যকরী হচ্ছে না। এ এ তাদের দখলকৃত এলাকাগুলোতে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কোনো বৈষম্য মূলক আচরণ করছে না বলে জানা যায়। তারা মিয়ানমার সেনা ক্যাম্প দখল করার পর সৈন্যদের পরিবারগুলোকে ও নিরাপদে হস্তান্তর করছে। এ ধরনের আচরণ তাদের সহনশীলতা ও দূরদৃষ্টির পরিচয় দেয়।

এ এ’কে তাদের সুদূর প্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেক গবেষক এই সহস্রাব্দের সশস্ত্র দল হিসেবে আখ্যায়িত করে। এন এল ডি’র শাসনামলে এ একে সন্ত্রাসী দল হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। ২০২১ সালে সেনাঅভ্যুত্থানের অব্যবহিত পরেই সেনাসরকার সংগঠনটিকে কালো তালিকা থেকে বাদ দিয়ে তাদের সঙ্গে একটি অঘোষিত যুদ্ধবিরতির আয়োজন করে। আরাকান আর্মি এই সুযোগটি পুরোপুরি কাজে লাগায়। প্রায় দুই বছর তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সঙ্ঘাত এড়িয়ে পুরোপুরি রাজনীতিতে মনোনিবেশ করে ও রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক গণসংযোগ চালায়। প্রতিটি এলাকায় তারা তাদের রাজনৈতিক এবং বিচারিক নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দেয়। উত্তর এবং দক্ষিণ রাখাইনের মধ্যে যুগ যুগ ধরে বিদ্যমান দূরত্ব কমিয়ে এনে ধীরে ধীরে তারা রাখাইনবাসীদের একমাত্র আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠে। এ এ’র সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে রাখাইনবাসীদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ধর্মীয় সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অঙ্গীকার। মিয়ানমারের সেনা-সরকার এবং এনএলডি রোহিঙ্গাদের প্রতি বরাবরই বিদ্বেষমূলক আচরণ দেখিয়ে আসলেও এ এ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে চায় বলে জানিয়েছে। অতীতে বিভিন্ন সময় জান্তা সরকার অত্যন্ত কৌশলে রাখাইন ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে বিভক্ত করে রেখেছিল। বর্তমানে এ এ নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে রাখাইনদের এক ধরনের স্বস্তিমূলক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বলে জানা যায়।

২০২২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ) এর সামরিক শাখা এএ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের অন্যতম স্টেকহোল্ডার হিসেবে রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানায়। রাখাইনরা আরাকানে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইনদের সমর্থন ছাড়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে টেকসই প্রত্যাবাসন সম্ভব হবে না। মিয়ানমার সরকার আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিলেও রাখাইনে শান্তিতে বসবাস করতে হলে রোহিঙ্গাদেরকে রাখাইনদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতেই হবে। তাই বাংলাদেশ থেকে আরাকানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে মিয়ানমার সরকারের মতো আরাকানের রাজনৈতিক দল এবং জনগণের মতও গুরুত্বপূর্ণ। এ এ’র কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল তোয়াং ম্রা নায়েঙ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক নিয়ে জানায় যে, এ এ বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে চায় এবং এটা তাদের অগ্রাধিকার তালিকায় আছে।

এ এ জাতিগত রাখাইনদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে ও তাদের দূরদর্শী নেতৃত্ব মিয়ানমারের ফেডারেল কাঠামোর আওতায় একটা স্বশাসিত আরাকান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে এ এ’র সঙ্গে তাদের যোগাযোগ স্থাপন করেছে। সামনের দিনগুলোতে রাখাইনে তাদের প্রভাবের কারনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে তাদের সহযোগিতা দরকার হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জড়িত আন্তর্জাতিক সংস্থা, জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশকে এ এ’র সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ এ রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে আন্তরিক হলে তারা রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা রাখাইন জনগণের মধ্যে প্রচার করতে পারে। রাখাইন সমাজের ওপর তাদের প্রভাব থাকায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের পক্ষে রাখাইন সমাজে জনসচেতনতা তৈরিতে এ এ’র প্রচারণাই সবচেয়ে বেশি কার্যকরী হবে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি অন্যান্য দেশের সঙ্গেও নিয়মিত আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে যাতে রোহিঙ্গাদেরকে পূর্ণ নাগরিক অধিকারসহ ফেরত নেয়ার বিষয়ে তারা মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদেরকেও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে কোনো দ্বিমত বা বিভক্তি থাকতে পারবে না। নিজেদের ভিতরের বিভক্তি দূর করে তাদেকেও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সফল করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এম ফিল, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।

;

দহনজ্বালা, বজ্রপাত, প্রকৃতির বিরূপতা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপদ



ড. মাহফুজ পারভেজ
দহনজ্বালা, বজ্রপাত, প্রকৃতির বিরূপতা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপদ/ছবি: সংগৃহীত

দহনজ্বালা, বজ্রপাত, প্রকৃতির বিরূপতা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপদ/ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

তীব্র গরমে ফের জারি করা হয়েছে হিট অ্যালার্টের সতর্কতা। এপ্রিলের শেষ দিকে লাগাতার তাপপ্রবাহের জেরে অস্থির হয়েছিল স্বাভাবিক জনজীবন। মাঝে বৃষ্টির ছোঁয়ায় এসেছিল স্বস্তি। মে মাসের মাঝামাঝি পুনরায় শুরু হয়েছে দহনজ্বালা। আবার জনজীবনে নেমে এসেছে অস্বস্তি। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচণ্ড তাপদাহের দাপটে হিট অ্যালার্টের সতর্কতা ঘোষণা করতে হয়েছে।

এপ্রিলে স্মরণকালের তীব্র গরমে মানুষের প্রাণ ছিল ওষ্ঠfগত। স্কুল-কলেজসহ অন্যান্য স্বাভাবিক কাজকর্মেও নেমে এসেছিল স্থবিরতা। তারপর বহু প্রতীক্ষিত বৃষ্টির দেখা পেয়ে একটানা অগ্নিবাণে দগ্ধ ও ক্লান্ত জনজীবনে এসেছিল স্বস্থির পরশ। তবে, সে সময় অস্বস্তি বাড়িয়েছিল বৈশাখী বৃষ্টির দোসর বজ্রপাতের আধিক্য। যদিও গ্রীষ্মের তপ্ত পরিবেশে ঝোড়ো হাওয়া, বৃষ্টি, বজ্রপাত বাংলাদেশের চিরচেনা ছবি, তথাপি গত কয়েক বছরে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে দুশ্চিন্তার কারণ। সামান্য বৃষ্টি ও উতাল হাওয়ার মধ্যেই বিকট শব্দে সিরিজ বজ্রপাতের ঘটনা আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে এবং বাড়িয়েছে প্রাণহানি। এমনকি, ফাঁকা জায়গায় বজ্রপাতে মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি মর্মে প্রচলিত ধারণাকে উড়িয়ে দিয়ে শহরেও বাজ পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

এই যে তাপদাহের ফিরে আসা এবং বৃষ্টির সঙ্গে লাগাতার বজ্রপাতের ঘটনা, তা অবশ্যই বিরূপ প্রকৃতির প্রকাশ। প্রকৃতির বিরূপতা অতি উষ্ণায়ন, তীব্র শীত, বায়ু ও জলের দুষণ ইত্যাদি নানা বিপদের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রকাশ পাচ্ছে। যদিও আমরা এবং বিশ্ববাসী এসব বিপদের ব্যাপারে এখনও যথেষ্ট পূর্ব-সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে পারছি না। ফলে বিপদের প্রকোপ ও পরিধি ক্রমান্বয়েই বাড়ছে প্রকৃতির নানামুখী বিরূপ আচরণের মাধ্যমে।

এসব বিপদের বিষয়ে বিজ্ঞানীরা বার বার সতর্কতা জানিয়েছেন। পরিবেশবাদী ও সিভিল সোসাইটির পক্ষেও অবিরাম বলা হচ্ছে এসব বিষয়ে। ফলে সাধারণ জ্ঞান সম্পন্ন প্রতিটি মানুষই জানেন যে, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবেই তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হচ্ছে এবং পরিণামে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসছে। সর্বশেষ গবেষণা বলছে, জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন যদি ঠেকানো না যায় এবং ইতিবাচক দিকে না নেওয়া যায়, তাহলে বিশ্বে তাপপ্রবাহের আশঙ্কা বাড়বে ৪৫ গুণ। জলবায়ুর চোখরাঙানির জেরে বিশ্ব জুড়ে গড় তাপমাত্রা বাড়তে পারে ১.২ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমনই আশঙ্কার ছবি উঠে এসেছে নানা গবেষণায়। বিশেষত ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন (ডব্লিউডব্লিউএ)-এর সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টে তাপপ্রবাহ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে বিস্তর আলোকপাত করা হয়েছে।

গবেষণার উল্লেখযোগ্য দিক হলো, তাপপ্রবাহ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিপদ যে জনগোষ্ঠীকে সবচেয়ে বেশি ও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করবে, তা চিহ্নিতকরণ। বলা হচ্ছে, এসব কারণ সামগ্রিক জনজীবনে বিপদ বাড়াবে। তবে বিশেষত যাঁরা দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছেন, তাদের দুর্ভোগ বাড়বে সবচেয়ে বেশি। এর ফলে বিশ্বের দেশে দেশে বসবাসকারী দরিদ্র্য জনগোষ্ঠী, যারা আগে থেকেই ক্ষুধা, অপুষ্টি, বঞ্চনার শিকার, তারা আরো মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবেন প্রাকৃতিক বিরূপতার কারণে।

ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন (ডব্লিউডব্লিউএ)-এর গবেষণা রিপোর্টটি অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে প্রণীত। মালয়েশিয়া, ব্রিটেন, সুইডেন, নেদারল্যান্ডসের বিভিন্ন আবহাওয়া সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১৩ জন বিজ্ঞানী রিপোর্টটি তৈরি করেছেন। গত দু’বছরের রিপোর্টেও এ বারের মতোই ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির কার্যকারণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা আবহাওয়ার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখেছেন শিল্পবিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় বর্তমানে তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি।

নতুন রিপোর্টে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল বিশ্লেষণের জন্য পৃথক মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছিল। পশ্চিম এশিয়ায় (যেমন সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, প্যালেস্টাইন) মার্চ-এপ্রিলের তিন দিনের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা খতিয়ে দেখা হয়। ফিলিপিন্সে দৈনিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রার ১৫ দিনের গড় পর্যালোচনা করা হয়েছে। তবে ভারত, মিয়ানমার, লাওস-সহ দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে এপ্রিলের গড় তাপমাত্রাকে বিশ্লেষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। দেখা গিয়েছে, গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি। চলতি বছরের গ্রীষ্মেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে একই চিত্র ধরা পড়েছে।

রিপোর্ট যেমন বলছে, বাস্তবেও তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের জোরালো ইঙ্গিত মিলেছে বিশ্বের দেশে দেশে। প্রায় সব দেশেই তাপমাত্রা বেড়েছে। তাপপ্রবাহের বিপদও বেড়েছে। তবে আগে থেকেই উষ্ণ অঞ্চল, যেমন পশ্চিম এশিয়ায় তাপমাত্রা আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করেছেন বিজ্ঞানীদের। তাদের ধারণা, ২০৪০ বা ২০৫০ সালে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রি ছুঁতে পারে।

গবেষকরা বলছেন, ভৌগোলিক কারণেই সাধারণ ভাবে এপ্রিল মাসে এশিয়ায় তাপমাত্রা এমনিতে বেশি থাকে। তারপরেও এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চলকে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের অংশ রূপেই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সেই বাস্তবতা ক্রমেই বিলীন হওয়ার পথে। গবেষকরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক কালে নানা কারণে তাপমাত্রা যে বিপুল হারে বাড়ছে (বিশেষত কিছু শহরে), তা নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন। অত্যধিক তাপে যে সমস্ত প্রজাতির বিলুপ্তির আশঙ্কা রয়েছে, তাদের সুরক্ষার বন্দোবস্তেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তা না হলে ব্যাহত হতে পারে জীববৈচিত্র। যার পরিণতিতে সবুজ ও নাতিশীতোষ্ণ এশিয়ার দেশগুলোর ভাগ্যেও চরম বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ করতে ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কথা শুধু বলতেই শোনা যায়। কখনো কোনো প্রকল্প গৃহীত হলেও তা কার্যকর হয় কমই। উপরন্তু, শহরের দুষণ কমানো যাচ্ছেই না। নদী দখল থামছেই না। বৃক্ষ নিধন কমছেই না। তা হলে নতুন পরিকল্পনা কাজ করবে কেমন করে? বাংলাদেশে যখন এমনই শোচনীয় পরিস্থিতি, তখন বিশ্বের অবস্থাটাও বিশেষ ভালো নয়। অনেক অগ্রসর দেশই প্রকৃতি বিনাশের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তাদের কারণে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। বিনষ্ট হচ্ছে জলবায়ুর ভারসাম্য। এবং নেমে আসছে নানা বিপদ।

অতএব, বিশ্ব জুড়ে যদি অবিলম্বে তাপ নিঃসরণের হার নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, সে ক্ষেত্রে তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে বিশ্ববাসীকে। আগামী দিনে এই বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রিও ছাড়িয়ে যেতে পারে। আর তাপপ্রবাহের ক্ষেত্রে তা হতে পারে ৭ ডিগ্রি। বিশেষ করে, যেসব দেশ দারিদ্র্য ও যুদ্ধ বা সংঘাতের কারণে তছনছ হয়ে পড়েছে, সেখানে বিপদ আরো ভয়াবহ রূপ নেবে। একটি গবেষণা পরিসংখ্যানে জানা যাচ্ছে, ইসরায়েলি আক্রমণে বিধ্বস্ত গাজ়ায় ভিটেহারা ১৭ লক্ষ মানুষের জীবন আরো দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে অত্যধিক গরমে। এমন চিত্র বিশ্বের অন্যান্য শরণার্থী শিবিরেও দৃশ্যমান।

নগর ও উদ্বাস্তু জীবনের পাশাপাশি জলবাযু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের প্রভাব পড়ছে গ্রামীণ জনজীবনেও। অত্যধিক গরমে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চাষাবাদ। ফলে খাদ্যশস্যের জোগানে ঘাটতির আশঙ্কাও দেখা দেবে সামনের দিনগুলোতে। জলসঙ্কটের কারণ ঘটবে অত্যাধিক গরমের ফলে। শিক্ষা ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রেও ছেদ পড়বে বিরূপ পরিস্থিতির প্রভাবে। মৃত্যু হবে অসংখ্য গবাদি পশুর। মারা যাবে মানুষও। যেমন চলতি তাপদহনের কারণে গত এপ্রিলে মৃত্যুর সংখ্যা (সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী) বাংলাদেশে ২৮, ভারতে ৫ এবং গাজ়ায় ৩। থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্সেও দহনজ্বালায় মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে একজন করে। এমনকি, নির্বাচনের মতো গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় আয়োজনও থমকে যাবে বা স্থিমিত হবে তীব্র গরমের কারণে। যেমন, ভারতে চলমান লোকসভা নির্বাচনে ভোটদানের হারও বহু জায়গায় কমেছে তাপপ্রবাহের কারণে।

তাপমাত্রা জনিত কারণে যতগুলো বিপদ আপতিত হয়েছে, তার পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রয়েছে মানুষের অপরাধ। বিজ্ঞানীদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনে খলনায়ক মানুষই। বিশেষত সেইসব মানুষ, যারা রয়েছেন ক্ষমতায়, নেতৃত্বে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়। তাদের ভুলের কারণেই অত্যধিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হচ্ছে। অরণ্যবিনাশের মতো অপরাধ হতে পারছে। যার মাসুল গুনছেন বিশ্বের সাধারণ মানুষ।

বাংলাদেশের মতো বৃষ্টির আধিক্য রয়েছে যেসব দেশে, সেখানে উষ্ণায়নের কুপ্রভাব হিসাবে যে সকল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাত্রা বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হয়, বজ্রপাতও তার অন্তর্ভুক্ত। ফলে বন্যা, খরা, অতি গরম বা অতি ঠাণ্ডার মতোই বজ্রপাত নিয়েও মনোযোগী হওয়া দরকার। যে হারে বজ্রপাতের আধিক্য দেখা যাচ্ছে এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, তাতে বিষয়টি মোটেও উপেক্ষা করার মতো নয়। বরং এক্ষেত্রে আগাম সতর্কতা হিসাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পথে অগ্রসর হওয়াই কর্তব্য। তবে, নিঃসন্দেহে জনসচেতনতা বৃদ্ধি বজ্রপাতে প্রাণহানি ঠেকানোর পক্ষে অত্যাবশ্যক। বারংবার সতর্ক করা সত্ত্বেও বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠে খেলা, উঁচু ছাদে মোবাইলে কথা বলা আটকানো যায়নি। শহরে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়েছে এই কাণ্ডজ্ঞানহীনতা।

অন্য দিকে, প্রকৃত জ্ঞানের অভাবও বজ্রপাতে আহতদের চিকিৎসা সময়ে শুরু করতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বজ্রপাতে আহতদের স্পর্শ করলে নিজেরাও বিদ্যুৎপৃষ্ট হতে পারেন ভেবে প্রত্যক্ষদর্শীরা তাঁদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেন না। এই ভ্রান্ত ধারণাও দূর করা আবশ্যক। কালবৈশাখীর সময় পেরিয়ে যায়নি, বর্ষা শুরুর বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির দিনও সমাগতপ্রায়। বজ্রাঘাতে মৃত্যু ঠেকাতে এখনই উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন সরকার থেকে সাধারণ মানুষ— উভয় পক্ষেরই। বিশেষ করে, বার বার দহনজ্বালার ফিরে আসা এবং প্রকৃতির বিরূপতায় ধেয়ে আসা বিপদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বহুমুখী বিপদ যেন আরো বৃদ্ধি না পায়, সে ব্যবস্থা করার কথাও নীতিপ্রণেতাদের জরুরি ভিত্তিতে ভাবতে হবে। নইলে প্রাকৃতিক বিপদের পথ ধরে যে সামাজিক বিপদ ও অস্থিতিশীলতা নেমে আসবে, তা সামাল দেওয়া সত্যিই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসেোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

ব্যাংক ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের প্রভাব ও সম্ভাবনা



কানজুল কারাম কৌষিক, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ব্যাংক ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের প্রভাব ও সম্ভাবনা

ব্যাংক ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের প্রভাব ও সম্ভাবনা

  • Font increase
  • Font Decrease

ব্যাংক ব্যবস্থার আবিষ্কার একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে। বিশ্বের যেকোনো দেশের অর্থনীতিকে সুনির্দিষ্টভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যাংকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

শুধু মুনাফা অর্জনই ব্যাংক এর প্রধান এবং একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। মুনাফা অর্জন ছাড়াও একটি ব্যাংককে বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নানা চড়াই-উতরাই পার করে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। তার পেছনেও ব্যাংক ব্যবস্থার অবদান অনস্বীকার্য।

সম্প্রতি বাংলাদেশের নানা ইস্যুতে ব্যাংক ব্যবস্থার কার্যক্রম নিয়ে কৌতূহল জাগে। তাই ব্যাংক এর ব্যবস্থাপনা ও উদ্দেশ্য আমাদের ধারণা পরিষ্কার হওয়া উচিত।

একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন। একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাংক কিছু উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়। তার মধ্যে প্রথমেই ব্যাংকিং কাজকর্ম পরিচালনা করার মধ্য দিয়ে মুনাফা অর্জন করা অন্যতম।

ব্যাংক পরিচালনায় আমানত সংগ্রহ ও ঋণ প্রদান করাও ব্যাংকের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। তুলনামূলক বেশি সুদে ঋণ প্রদান করলেও মানুষ ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি অধিক আস্থা স্থাপন করায় ব্যাংক থেকেই ঋণগ্রহণ করে থাকে। শুধু লেনদেনই নয়, ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ভোক্তাদেরকে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান করা। ব্যাংকগুলো তাদের সেবা ব্যবস্থা অনুযায়ী বিনিময়ে কিছু সার্ভিস চার্জও আদায় করে থাকে।

এছাড়াও ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো- অর্থনীতিতে বিনিয়োগের মাধ্যম তৈরি করা। বিনিয়োগ পরিচালনা লাভজনক করার মাধ্যমে এবং আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করার জন্য চেক বিনিময় বিল ইত্যাদি প্রচলন করা ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঋণ ও মুদ্রা বাজারও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্যাবলির পাশাপাশি রয়েছে কিছু আর্থসামাজিক উদ্দেশ্যাবলি। তার মধ্যে অন্যতম হলো মূলধনের জোগান ব্যবস্থা। ব্যাংক জনগণের হাত থেকে অল্প অল্প অর্থ সঞ্চয় করে মূলধন সংগ্রহ করে এবং তার উপর নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান করে। শিক্ষিত ও দক্ষ বেকার লোকদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে এবং তাদের নিয়োগ দিয়ে বেকার সমস্যার সমাধানও ব্যাংক এর অন্যতম উদ্দেশ্য।

এছাড়াও ব্যাংক উদ্যোক্তাদের মূলধনের চাহিদা পূরণের জন্য ঋণ প্রদান করে এবং শিল্পায়নে সহযোগিতা করে । অর্থনীতিতে  প্রমাণিত যে, মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটলে মানুষের ব্যয় ও ভোগের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। বিনিয়োগ, ঋণদান, ব্যাবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির দ্বারা জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়। এটিও ব্যাংক এর কার্যক্রমের অন্যতম উদ্দেশ্য।

ব্যাংকের কিছু প্রতিনিধিত্বমূলক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। ব্যাংক গ্রাহকের এবং সরকারের পক্ষে প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখাও ব্যাংকের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য। কখনো কখনো ব্যাংক রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করার ক্ষেত্রেও ভূমিকা পালন করে। ব্যাংক পুঁজিবাদের স্বার্থরক্ষা করে তাদের উদ্বৃত্ত অর্থের ব্যবহার করে।

আধুনিক বিশ্ব একটি প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির সময় পার করছে। যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠিই হচ্ছে উন্নত ব্যাংক ব্যবস্থা। উন্নত ব্যাংক ব্যবস্থা একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাঠামোকে মজবুত করে।

দেশের অর্থনৈতিক চাকা সবল রাখতে ব্যাংক কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা পালন করতে পারে। তার মধ্যে অন্যতম মূলধন সৃষ্টি করা। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মূলধনের গুরুত্বই সর্বাধিক। তাই ব্যাংক জনগণের সঞ্চয়কৃত অর্থ আমানত হিসেবে গ্রহণ করে দেশের বাণিজ্য ও শিল্পের প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাব মিটানোর জন্য মূলধন সৃষ্টি করে থাকে। ব্যাংক সমাজের সকল স্তরের জনগণকে সঞ্চয়ী হতেও  উৎসাহিত করে। এছাড়াও শিল্প কারখানায় ব্যাংক শুধু পুঁজি সরবরাহ করেই ক্ষান্ত হয় না উপবস্তু শিল্প পরিচালনা ও গঠনেরনব্যাপারে সাহায্য করে শিল্পের প্রসারও ঘটায়।

মূলধন সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যাংক জনগণের সঞ্চয়কৃত অর্থ দেশের শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন মেয়াদে মূলধন হিসাবে সরবরাহ করে শিল্প ও ব্যবসায় বাণিজ্যের গতিকে সচল রাখে। বাংলাদেশের মতো কৃষি প্রধান দেশগুলোতে ব্যাংক বড় ভূমিকা পালন করে কৃষি উন্নয়নের জন্য সার, বীজ, কীটনাশক ঔষধ, চাষাবাদ সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি প্রভৃতি ক্রয়ের জন্য কৃষকদের ঋণ দিয়ে। এর মাধ্যমে ব্যাংক দেশের কৃষি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ব্যাংক দেশের ব্যবসায়ীদেরকে আর্থিক সাহায্য, লেনদেনের ক্ষেত্রে সহায়তা ও পরামর্শ দিয়ে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে সহায়তা করে। বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যাংক দেশের আমদানি ও রফতানি, ব্যবসায় বাণিজ্যে সহায়তা দান করে বৈদেশিক বাণিজ্য প্রসারের পথকে সুগম করে থাকে। ব্যাংক উৎপাদনের বিভিন্ন ক্ষেত্রসমূহে প্রয়োজনীয় ঋণ সরবরাহ করে, দেশের সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে।

এছাড়াও ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়মতান্ত্রিকভাবে ঋণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখে। একই রকমভাবে কলকারখানায় পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হওয়ার পর তার সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য ব্যাংক বিভিন্ন শ্রেণির ব্যবসায়ীদেরকে অর্থ সাহায্য এবং পরামর্শ দিয়ে থাকে এবং পরামর্শমূলক সহায়তা দান করে জাতীয় আয় বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।

দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন ব্যাংকসমূহ তাদের নিজস্ব শাখা খোলার মাধ্যমে এবং বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ সংস্থান করে বহুলোকের কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশেও এসব উদ্দেশ্যাবলি সাধনের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনসহ দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ব্যাংক ব্যবস্থা এ দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। ব্যাংক ব্যবস্থার অস্তিত্ব ছাড়া বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশের সামগ্রিক ব্যাংক ব্যবস্থা আরো দূরদর্শী ও সুপরিকল্পিত হোক এটাই আমাদের কামনা। 

;

জাতীয় বাজেট ২০২৪-২৫: কতখানি ঢেলে সাজানো হলো?



মাইশা মালিহা
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, ক্রমবর্ধমান ব্যাংকঋণের সুদের হারসহ প্রভৃতি চ্যালেঞ্জকে সাথে নিয়ে আগামী ৬ জুন পেশ হতে যাচ্ছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট। ইতোমধ্যে বাজেটের সারসংক্ষেপ অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বিপরীতে ৫ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে। ঘাটতি আড়াই লাখ কোটি টাকার সিংহভাগ পূরণ হবে বিদেশি ঋণে, বাকিটা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা থাকবে অভ্যন্তরীণ ঋণ ও ব্যাংকঋণে।

এবারের বাজেট নির্ধারণে অর্থ মন্ত্রণালয় বেশ হিসেবি থাকার চেষ্টা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সাবেক অর্থমন্ত্রীর ব্যর্থতার ফলাফল প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি, ভঙ্গুর ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে শুরু করে মন্থর সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের দায়, ক্রমহ্রাসমান জিডিপি প্রবৃদ্ধি। চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করতে  নির্বাচন-পরবর্তী নতুন অর্থমন্ত্রী ও অর্থ প্রতিমন্ত্রীর ওপর চাপটা যেন তাই স্বাভাবিকভাবেই বেশি।

আসন্ন বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৬.৭৫ শতাংশ। যেখানে চলতি বছরের বাজেটে তা ছিল ৭.৫০ শতাংশ। আদতেই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবতার ছাপ পাওয়া যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে হলেও অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। কারণ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে বিনিয়োগ। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই আশানুরূপ হচ্ছে না নানা কারণে। দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ডলার সংকট, জ্বালানি সংকট, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মতো নানাবিধ সমস্যাকে এর কারণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। বিদ্যমান মূল্যস্ফীতিও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করছে।

মূল্যস্ফীতি ঠেকেছে ১০ শতাংশের কোঠায়। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট বর্তমান বাজার কাঠামোকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। জনগণের মৌলিক সেবা নিশ্চিত হওয়াই এখন হুমকির মুখে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের লাগামছাড়া মূল্য বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষের জীবনে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে ছাড়িয়েছে ১০ শতাংশ। তাই এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির সাথে যেমন জনগণ পেরে উঠছে না, তেমনি এই চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হবে আগামী বছরের বাজেট প্রণেতাদেরকে।

মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা বৈশ্বিক কারণে বিভিন্ন দেশে, এমনকি ইউরোপ আমেরিকাতেও ৮-৯ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি দেখা গেছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে সাথে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক উন্নয়নশীল দেশও সংকটের মুখে পড়েছিল। অন্যান্য দেশ এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পেলেও বাংলাদেশ তা পারেনি নানা দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কারণে। সেই সাথে টাকা ছাপানোর মতো সিদ্ধান্ত মড়ার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে এসেছে।

বর্তমানে ডলারের বিপরীতে টাকার বড় রকমের অবমূল্যায়ন মূল্যস্ফীতিতে বড় রকম অবদান রাখছে। তাই উপায় এখন ডলার সরবরাহের সুযোগ বৃদ্ধি। প্রয়োজন প্রবাস আয় বৃদ্ধি ও হুন্ডির পথ পরিহার করে সঠিক নিয়মে তা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে প্রেরণ। দেশের রপ্তানি পণ্যের যথাযথ ভর্তুকির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করলে তা ডলার সরবরাহে ভূমিকা রাখতে পারে।

এই বাজেটে প্রণেতারা অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে দুটি উপায় মেনে চলবেন বলে জানিয়েছেন। এক, দেশের সবচেয়ে বড় আয়ের খাত রাজস্ব কর বাড়বে; দুই, সরকার ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করবে। রাজস্ব বাড়াতে হলে অবশ্যই একটি দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আদায় করা সম্ভব নয় এমন রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলে তা হিতে বিপরীতই হবে। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আয় আদায় করতে হলে করের হার না বাড়িয়ে করযোগ্য মানুষের কাছ থেকে সঠিক ও যথাযথ হারে কর আদায় করা গেলে সার্বিকভাবে চাপ কমবে জনগণের ওপর, এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

মাইশা মালিহা, ৩য় বর্ষ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

;