আমার অংশের তিস্তা দিয়ে কি করব?
তিস্তা অনেক র্দীর্ঘ একটি আন্তর্জতিক নদী। এর উৎস ভারতের হিমালয়ের পাদেদেশ। পূর্ব হিমালয়ে ভারতের সিকিম রাজ্যের তিস্তা কংসী ও কংচুং এবং সোহামো লেকের নিকটবর্তী পৌহুনরী গ্লেসিয়ার থেকে এর উৎপত্তি। বরফগলা ও বৃষ্টির পানি তিস্তা স্রোতস্বিনীর মূল উৎস। ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার সীমান্ত পেরিয়ে এর গতির দৌড় শেষ হয়েছে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে রংপুরের গঙ্গাচড়া, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা ও কুড়িগ্রামের উলিপুর ও হয়ে গাইবান্ধা জেলায় ব্রহ্মপুত্র নদে মিলিত হওয়া পর্যন্ত। এই ৩১৫ কি: মি: ক্যাচমেন্ট এলাকার দীর্ঘ স্রোতধারা আমাদের তিস্তা নদী। এই নদীকে ঘিরে নানা সমস্যা থাকলেও সম্ভাবনা অনেক। অনেক আশা, ভরসা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তিস্তাকে ঘিরে করা হচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘদিন তিস্তা গাছে ফুল ফুটছে না, ফলও ধরছে না। এই তিস্তা এখন দহন-মরণের নদী।
আগের চোহারায় তিস্তার প্রকৃতি চরিত্রের হিসেব এখন মেলানো দায়। কারণ, এখন সারা বছর তিস্তার সমস্যা তৈরী হয়। প্রতিবছর ছয়-সাতবার পানি বাড়ে। হঠাৎ বন্যা আসে। দুকূল ছাপিয়ে লোকালয় পর্যন্ত থৈ থৈ পানিতে ডুবিয়ে দেয়। কার্তিকে বন্যা হয় তিস্তার তীরে তীরে। এমনকি চৈত্রেও বন্যা হবার উদাহরণ তৈরী হয়েছে। গুণে গুণে প্রতিমাসেই বন্যার পানি ধেয়ে আসে। একটি বন্যার ক্ষয়-ক্ষতির রেশ সামাল দেবার পূর্বেই আরেকটি বন্যা এস সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়ে ধুয়ে মুছে নিয়ে যায়। এটাই এখন তিস্তার খেয়ালী চরিত্র।
এ বছর অর্থ্যাৎ ২০২২ সালের শুরু থেকে তিস্তার প্রলয়ঙ্কারী হিসেব কষা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। উজানে মানুষ শুধু সুখ-দুঃখের সংবাদ শুনে ক্ষান্ত হয়ে মুচকি হাসেন। কিন্তু যা কষ্ট ও দু:খের তার কাহিনী শুধু এর দু’পাড়ের ভুক্তভোগীরাই হৃদয়ঙ্গম করে থাকেন।
গত আগষ্ট ০২ তারিখে তিস্তায় এবছরের চতুর্থবার বন্যা ধেয়ে এসেছে। পানির চাচে ডালিয়া ব্যারেজের ৪৪টি গেইট খুলে দিতে হয়েছে। আতঙ্কিত মানুষ গবাদি পশু, আসবাব, বিছানা, বইপত্র নিয়ে উচু জায়গায় চরে গেছেন। তাদের অনেকের মধ্যে সিলেট এলাকার সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যার পানির তোড়ের কথা মনে হয়েছে। কারণ, সীমান্তের নদীগুলো ভরাট হয়ে তাদের পানি ধারণ করার ক্ষমতা হারিয়ে অতীতের মতো নিরাপদ নদী-চরিত্র আর দেখাতে পারে না। সীমান্তের ওপারের বাঁধগুলোর দরজা খোলা-বাঁধা করার সঠিক সময় ও তথ্যও আমাদের হাতে পৌঁছায় না। এটা যেন ছোটবেলার পাঠ্য বইয়ে বাবার দেয়া একটি গাভীর দুই ভাইয়ের মধ্যে ভাগাভাগি করার গল্পের মতো মনে হয়।
গল্পটা সবাই হয়তো জানেন। তবুও আংশিক বলছি। বাবা দু’ছেলেকে তিনটি সম্পদ দিয়ে মারা গেছেন। সম্পদ তিনটির মধ্যে একটি গাভী ছিল। দু’ভাই, একটি গাভী। কেমনে ভাগ হবে? বড়ভাই চালাক। সে গাভীর পিছনের অংশটা নিয়ে নিল। ছোটভাই গাভীর সামনের অংশ নিয়ে শুধু খাবার খেতে দেয়। বড়ভাই পিছনের অংশ থেকে প্রতিদিন গাভীর দুধ দুইয়ে নেয়। ছোটভাইকে কিছুই দেয় না। একথা একদিন গ্রামের মান্যবর সৎ মোড়ল জানতে পেরে ছোট ছেলেকে একটি উপায় বাতলে দিলেন। তিনি বললেন, যখন তোর বড়ভাই দুধ দোহাতে থাকবে তখন তুমিও তোমার গাভীর সামনের অংশে বেত দিয়ে মারতে থাকবে। যেই বলা সেই কাজ শুরু। সেদিনই বড়ভাইয়ের দুধ দোহানোর সময় ছোটভাই গাভীর সামনের অংশে বেত্রাঘাত শুরু করলে গাভীটি লাফাতে থাকলো। লাফানো গাভী থেকে বড় ছেলে আর দুধ দোহাতে পারলো না। নিরুপায় হয়ে সে গাভীকে মারতে নিশেধ করলো এই বলে যে, আজ থেকে সে দুধের অর্ধেক ভাগ তার বঞ্চিত ছোট ভাইটিকে দেবে। এভাবে দু’ভাইয়ের মধ্যে গাভী ভাগ-বাটোয়রা করা সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হয়েছিল।
এখানে মূল উপায় হলো- ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পদের ভাগ-বাটোয়রা নিয়ে বিকল্প সমাধান বের করা। উভয় পক্ষের কোন অর্থনৈতিক ক্ষতি না হয়-এমন অনেক সমাধানের কথা বলা হলেও তিস্তা নিয়ে অদ্যাবধি কোন সফল সমাধানের দিকে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না, একপক্ষের ছাড় না দেবার কারণে। তাই কোনভাবেই প্রতিপক্ষের কোন ছাড় না পেলে আমাদের অংশের ৩১৫ কি:মি: তিস্তাকে নিয়ে আমাদের নিজস্ব পরিকল্পনা গ্রহণ ও আশু বাস্তবায়ন করা ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। প্রয়োজনে ছোট ছোট ড্যাম বানিয়ে ও চরের মধ্যে বড় বড় জলাধার খনন করে শুধু বর্ষার পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহার কৌশল নিয়ে বাংলাদেশ অংশের তিস্তা নদীকে কাজে লাগাতে হবে।
কারণ, চৈত্রের অকাল বন্যায় আমাদের চরের উঠতি ফসল নষ্ট হয়ে যায়। উজানের হঠাৎ ঢল বা ‘ফ্লাস-ফ্লাড’ থেকে এই বন্যা সৃষ্ট। আষাঢ়- শ্রাবণের বন্যা তো ধর্তব্যোর মধ্যে নেই। ভাদ্র-আশি^নের বন্যা এই অঞ্চলের জীবন-জীবিকার প্রধান অবলম্বন আমন ধান ও বীজতলা ডুবিয়ে খাদ্যাভাব সৃষ্টি করে। উত্তরাঞ্চলের একসময়ের ঘোর মঙ্গা এবং কার্তিকের খাদ্যাভাব হওয়ার অন্যতম বড় কারণ বার বার আমন ধান নষ্ট হওয়া। এবছর (২০২২) সালে অনাবৃষ্টির ফলে এই এলাকার কৃষকগণ শ্যালো মেশিনের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানিতে সেচ দিয়ে আমনের চারা রোপন করেছেন। কিন্তু এই ব্যয়বহুল ও কষ্টকর প্রচেষ্টাকে বার বার তিস্তার হঠাৎ বন্যা এস ডুবিয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এত কৃষকের মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে। জ্বালানি তেল তথা ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং মৌসুমের সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় পুনর্বার আমনের চারা রোপন করার উপায় নেই তাদের।
তাই এবছর আসন্ন খাদ্যাভাব নিয়ে তারা খুবই আশঙ্কিত। এর সাথে বৈশি^ক মহামারী, ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব, মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুৎ-এর চরম সংকট মানুষের মধ্যে নাভিশ^াস তৈরী করে চলেছে। তিস্তা তীরবর্তী প্রান্তিক কৃষক যারা বর্গাচাষ করেন বিভিন্ন উৎস থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে তাদের সেই ঋণ শোধ দেবার উপায় থাকে না। এভাবে এই এলাকার অনেক দরিদ্র মানুষ প্রতিবছর ভাসমান জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়ে অতি-দারিদ্র্যর গতিকে বাড়িয়ে দেয়। এরা গ্রাম থেকে দলে দলে শহরে স্থানান্তরিত হয়ে শহুরে গণ-দারিদ্রের অন্যতম উপাদান হিসেবে কাজ করে। এসব মানুষ আমাদের আমশুমারী বা জনশুমারীতে ঠিকমতো ঠাঁই পায় না।
তিস্তায় বার বার বন্যার জন্য উজানের তথ্য না পাবার বিষয়টিকে বিশেষজ্ঞগণ বেশ গুরুত্ব দিচ্ছেন। এই আধুনিক ডিজিটাল যুগে কোন আগাম তথ্য বা পূর্বাভাষ ছাড়াই হঠাৎ হু হু করে উজানের পানি বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। এ নিয়ে আমাদের কর্তৃপক্ষের কোন বিকার থাকলেও কার্যকর প্রতিকারের ক্ষমতা নেই। তারা সমস্যার কথা এতটুকু বলেই পার পেতে চান। শুধু অন্যকে দোষারোপ করে দায়িত্ব এড়ানো যেন আমাদের মজ্জাগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের দেশের আবহাওয়বিদ ও সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা নিজেদের প্রযুক্তি ডেভলপ করতে পারেন না? ধরেই নিতে হবে নিজেদের কল্যাণের জন্য নিজেদেরকেই আধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত জ্ঞান ও কৌশলে স্বাবলম্বী হতে হতে হবে। অন্যের মুখপানে চেয়ে থাকার দিন শেষ। তথ্যের জন্য নিজেদের ভাবনা নিজেকেই ভাবার যুগ এখন। বিশেষ করে আবহাওয়া সম্পর্কিত বিষয়ে তথ্যের সত্যতা যাচাই-বাছাই নিজেকে করতে শেখা ও প্রয়োগ করতে হবে।
চীনা প্রকল্প নিয়ে ভাবনার অন্ত নেই। কিন্তু এই প্রকল্পের কালক্ষেপণের অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় চীন এ ব্যাপারে ভারতকে কোনভাবে নাড়াতে চায় না। পাশাপাশি আমাদেরকে শতভাগ বিশ্বাস করতে চায় না। এবছর আগষ্টের শুরুতে তারা নিজেরা আলোচনার জন্য ডেকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও এই অঞ্চলের নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চেয়েছে। তারা তিস্তা রিভার রেস্টোরেশন প্রকল্প নিয়ে অনেক আগ্রহ দেখালেও এখনও প্রাথমিক কথা ছাড়া কোন অগ্রগতি হয়নি, অর্থ ছাড় দেয়নি, কাজও শুরু হয়নি। এভাবে তিস্তা সমস্যা নিয়ে সবাই গড়িমসি করলে আমাদের ভৌগোলিক অংশে এর সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের ভাবনা আমাদেরকে অবশ্যই দ্রুত গতিতে শুরু করতে হবে।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]