‘বিশ্বরাজনীতিতে এশিয়া গুরুত্বপূর্ণ থিয়েটারে পরিণত হয়েছে’



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
প্রফেসর ড. ভূঁইয়া মো. মনোয়ার কবীর

প্রফেসর ড. ভূঁইয়া মো. মনোয়ার কবীর

  • Font increase
  • Font Decrease

[চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের বরিষ্ঠ শিক্ষক এবং 'সেন্টার ফর এশিয়ান স্টাডিজ'-এর প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক প্রফেসর ড. ভূঁইয়া মো. মনোয়ার কবীর বাংলাদেশের একজন অগ্রগণ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। দেশে-বিদেশে শিক্ষকতা ও গবেষণায় নিয়োজিত থেকে তিনি রচনা করেছেন আন্তর্জাতিক মানসম্মত গ্রন্থ ও প্রবন্ধ। তাঁর সঙ্গে বিশ্ব ও আঞ্চলিক রাজনীতির নানা প্রসঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর, বার্তা২৪.কম'র অ্যাসোসিয়েট এডিটর ড. মাহফুজ পারভেজ। প্রফেসর ড. ভূঁইয়া মো. মনোয়ার কবিরের বক্তব্যের চুম্বক অংশ পত্রস্থ হলো:]

এশিয়ার গুরুত্ব

বিশ্বরাজনীতিতে এশিয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ থিয়েটারে পরিণত হয়েছে এবং আগামীতেও আরো তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে। বিশেষ করে, চীনের অপ্রতিরোধ্য বিকাশ, ভারতের শক্তি বৃদ্ধি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং এ অঞ্চলে বেশ কিছু 'সিরিয়াস টেনশন' ও 'কনফ্লিক্ট জোন' থাকাতে এই এশীয় অঞ্চলের গুরুত্ব আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্রমেই বৃদ্ধি পাবে বৈ কমবে না। এই আন্তর্জাতিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর মধ্যে আছে কাশ্মীর ও সন্ত্রাসবাদ ইস্যু নিয়ে ভারত-পাকিস্তান বিরোধ, আফগানিস্তানে মার্কিন দখলদারিত্ব ও এর বিরুদ্ধে সশস্ত্র তালিবান প্রতিরোধ তথা আফগানিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন, চীনের উত্থান, চীন-ভারত রেষারেষি ও প্রতিযোগিতা, তাদের সীমান্ত নিয়ে বিরোধ ও ১৯৯২ সাল থেকে ক্রমবর্ধমান ইন্দো-মার্কিন কৌশলগত সখ্যতা, চীন-মর্কিণ দূরত্ব সৃষ্টি, চীনের শিন জিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলিমদের বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচেষ্টা ও এর বিরুদ্ধে চীনা সরকারের কঠোর ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ন্যায় পদক্ষেপ গ্রহণ, হংকংয়ের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ন্যায় পদক্ষেপ, তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যু, জাপান-চীন টানাপোড়েন, বিশেষ করে সেনকাকু দ্বীপের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব, কোরীয় উপদ্বীপের সঙ্কট, মধ্যপ্রাচ্যের/পশ্চিম এশিয়ার সংকট, ইসলামী উগ্রপন্থার বিকাশসহ মধ্য এশিয়ার নতুন রাষ্ট্রগুলোর বিভিন্নমুখীন সংকট আমরা লক্ষ্য করি, বিশ্বরাজনীতিতে এশিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধিতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে।

সেন্টার ফর এশিয়ান স্টাডিজ

হাল আমলে ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ হওয়া এশীয় অঞ্চলের নানা বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক-গবেষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি ও জারি রাখা খুবই জরুরি একটি প্রসঙ্গ। সেজন্যই একটি সম্পূর্ণ একাডেমিক উদ্দেশ্যে এমন একটা সেন্টার থাকলে ভালো, থাকা দরকার, এমন চিন্তা থেকেই :সেন্টার ফর এশিয়ান স্টাডিজ' প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি একটি non-profit organization. কোন দেশ বা সরকারের প্রতি এই সেন্টারের বিশেষ কোন রাগ, অনুরাগ, বিরাগ নেই। এই সেন্টার কোন শর্তযুক্ত বা শর্তের ইঙ্গিতপূর্ণ কোন সাহায্য-সহযোগিতামূলক সম্পর্কের বিরোধী। নিজস্ব সীমিত অর্থায়নে এর কার্য পরিচালিত হয়। ফলে, এর কার্যক্রমও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

তা সত্ত্বেও সেন্টার বেশ কয়েকটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করেছে, নিয়মিতভাবে ২০১৭ সাল থেকে এটি Journal of Asian Politics and Society -- JAPS নামক একটি অর্ধ-বার্ষিক একাডেমিক peer reviewed ও ISSN নম্বরযুক্ত জার্নাল প্রকাশ করে আসছে। আগামীতে Center for Asian Studies এর কার্যক্রম আরো সম্প্রসারিত করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে Center for Asian Studies-- CAS প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে। এটা প্রকৃতপক্ষে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশ সরকারের Higher Education Quality Enhancement Project  (HEQEP) এর একটি Subproject এর Off shoot. এই Sub-project টির বিষয়বস্তু ছিল অনেকটা নিম্নরূপ: Improving the Capability of Research on Political Science and Asian Studies in the Department of Political Science, University of Chittagong. ২০১১-২০১৩ পর্যন্ত এই তিনবছর মেয়াদী সাব-প্রজেক্ট শেষ হলে এই সাব-প্রজেক্টের টিম মেম্বারদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে এ বিষয়ে গবেষণা কাজ অব্যাহত রাখার আকাঙ্খা থেকেই এই Center for Asian Studies -- CAS প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেয়া হয়। সেই মোতাবেক এই সেন্টার গঠনের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের একাডেমিক কমিটির মিটিংয়ে, সমাজবিজ্ঞান অনুষদের মিটিংয়ে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের এবং সর্বশেষে সিন্ডিকেট মিটিংয়ে পাশ হয় ও তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রসঙ্গ: ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল

ইন্দো-প্যাসিফিক টার্ম-এর ব্যবহার নিয়ে প্রথম কথা হলো, এই টার্মটা যতটা না ভৌগোলিক, তারচেয়ে ঢের বেশি "সিকিউরিটি" ও "স্ট্র্যাটেজিক"। ইন্ডিয়ান ওশ্যান ও প্যাসিফিক ওশ্যানকে কানেক্ট করা হয়েছে এই টার্মের মাধ্যমে। এই টার্মটা সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন একজন ভারতীয় স্ট্র্যাটেজিক ও সিকিউরিটি আ্যানালিস্ট। পরবর্তীতে এটা সমমনা বাকী অনেক দেশ, যেমন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাস্ট্র ইত্যাদি দেশ এই 'ইন্দো-প্যাসিফিক' টার্মটি ব্যবহার করতে থাকে। পূর্বে প্রচলিত ও ব্যবহৃত টার্মটা ছিল 'এশিয়া-প্যাসিফিক' অঞ্চল। ইন্দো-প্যাসিফিক টার্ম আসলে মেরুকরণের প্রতীকী উপস্থাপন। অর্থাৎ, এই টার্ম দ্বারা এটাই বুঝানো হয় যে, ভারত মহাসাগরীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কৌশলগত স্বার্থকে একক পরিকল্পনার ভিতরে বিবেচনায় নিতে হবে বা দেখতে হবে। কারণ, উভয় অঞ্চলের কৌশলগত স্বার্থ, চ্যালেঞ্জ এবং সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার কৌশলও এই ভারত মহাসাগরীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে কৌশলগত সমন্বয়ের মাধ্যমে গ্রহণ করা আবশ্যক।

চীনের উত্থান

কিন্তু, প্রশ্ন রয়েই যায় যে, কেন এবং কি সেই মেরুকরণ? কি তার প্রকৃতি? কি হতে পারে এর প্রভাব? এক্ষেত্রে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মেরুকরণের প্রধান ও বলা যেতে পারে, একমাত্র কারণ হলো গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের উত্থান। অনেকেই হয়তো বলবেন, কেন? ইতিপূর্বে ধ্বংসস্তূপ থেকে জার্মানিতে, জাপানে, অর্থনৈতিক উত্থান ঘটেছে, এমন পোলারাইজেশানতো তখন ঘটেনি! এখন চীনকে কেন্দ্র করে কেন ঘটছে? এই প্রশ্নটাও নিশ্চয়ই করা যেতে পারে।  লক্ষণীয় বিষয় হলো, যখন ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষ দিকে জাপানের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিয়ে মার্কিন পলিসি মেকারগণ ও থিঙ্কট্যাঙ্কগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করতে থাকেন, তখন মার্কিন যুক্তরাস্ট্র জাপানের উপর নানাধরণের বিধিনিষেধ ও শর্ত আরোপ করা শরু করে।  জাপানি মাইক্রো চিপসের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, আনফেয়ার ট্রেড প্র্যাকটিস, মার্কিন কৃষি ও ফল, গাড়ি ইত্যাদি রফতানির জন্য বাধ্যতামুলক কোটা আরোপ, বোয়িং বিমান ক্রয়ে "রাজি" করানো ইত্যাদি পদক্ষেপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়েছিল। সিনিয়র বুশ ১৯৯১ সালের দিকে বিশাল বহর নিয়ে জাপান সফর করেন ও ট্রেড কনসেশানের জন্য চাপ দিতে থাকেন। এমন প্রচণ্ডরকমের চাপ আসে যে, মনে করা হয়, এই প্রেসার নিতে না পারায় আনুষ্ঠানিক বৈঠকের মধ্যেই তৎকালীন জাপানি প্রধানমন্ত্রী, একদার ঝানু বুরোক্র্যাট, মি. কিচি মিয়াজাওয়া অজ্ঞান হয়ে পড়েন। কনসেশান মার্কিনিরা ঠিকই আদায় করেছিলেন। এভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উঠতি অর্থনৈতিক শক্তিগুলোকে বশে রাখতে চেষ্টা করতো।

কিন্তু, চীনের উত্থানের বিষয়টা বহু দিক থেকে আলাদা। ইউরোপে উঠতি বড় অর্থনীতি জার্মানি ও এশিয়ার ইকনোমিক পাওয়ার হাউজ জাপান, কেউই কোন কমপ্রিহেনসিভ পাওয়ার ছিলনা, তেমন হওয়ার কোন সম্ভাবনা বা প্রয়াসও ছিল না। তদুপরি, তাদের উত্থান ঘটেছিল বেশ খানিকটা মার্কিন বদান্যতায়। আদর্শগতভাবে তারা মার্কিন-পশ্চিমা ভাবধারার অনুসারী ছিল। ফলে, সামরিক ও/বা আদর্শিক কোন চ্যালেঞ্জ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পলিসি মেকাররা এসব দেশের কাছ থেকে আশঙ্কা করেননি। সর্বোপরি, এই দেশগুলোর অর্থনীতি বড় হলেও এরা একটা অর্থনৈতিক পাওয়ার হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার ক্ষেত্রে "গ্লাস সিলিংয়ে" আটকা পড়ে যায়। এদের কারো টোটাল জিডিপির সাইজ ৪-৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের উপর উঠতে পারেনি।

পক্ষান্তরে, চীন এই জিডিপির গ্লাস সিলিং ব্রেক করে ফেলে। ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী চীনের টোটাল জিডিপি হলো ২১ ট্রিলিয়ন ডলারের মত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে প্রায় ০৫ ট্রিলিয়ন ডলারের মতো কম। বিভিন্ন প্রোজেকশান থেকে জানা যে, মোটামুটি ২০৩১ সালের দিকে নমিনাল জিডিপির হিসাবে চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করে যাবে। এমন বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নেয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নিঃসন্দেহে দুঃসহ। এটা হলে, 'প্যাক্স আমেরিকানা'র আইডিয়া হোঁচট খাওয়ার আশংকা রয়েছে। উল্লেখ্য যে, পিপিপির হিসাবে চীন ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।

চীন-মার্কিন প্রসঙ্গ

যদিও অন্যসব দেশের সাথে মার্কিন স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক তেমন কোনো কৌশলগত কোন বিষয়ও ছিলনা, তথাপি, চীনের ব্যাপারটা যথেষ্ট আলাদা। একথা নিঃসন্দেহে সত্য যে, চীনের অর্থনৈতিক উত্থান পর্বের প্রথমদিকে প্রায় দুই দশক (১৯৭২-১৯৮৯) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা ও পশ্চিমাপন্থী পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহের (যেমন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর) বিনিয়োগ, সহযোগিতা, মার্কেট এক্সেস ইত্যাদি অর্থনৈতিক নীতি চীনের উত্থানের জন্য পজিটিভ ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করেছে। তবে, এটা এদের সবারই জানা ছিল যে, চীনের অনুসৃত সংস্কার ও চার আধুনিকীকরণের (Four modernization) নীতির অন্যতম ছিল সামরিক সংস্কার, যার লক্ষ্য ছিল চীনের সামরিক শক্তিকে অত্যাধুনিক ও শক্তিশালী করে গড়ে তোলা। ফলে, চীনের উত্থানের একটা মৌলিক 'কম্পোনেন্ট' বা 'ইন্টিগ্রাল পার্ট'ই ছিল মিলিটারী রিফর্ম ও ডেভেলপমেন্ট। আসলে, এই সংস্কার কর্মসূচীর লক্ষ্যই ছিল চীনকে একটা টোটাল, কমপ্রিহেনসিভ পাওয়ার হিসাবে গড়ে তোলা। ১৯৮৯ সালের তিয়েনানমেন স্কোয়ারের ঘটনা, ঐ একই বছরে কোল্ডওয়ারের পরিসমাপ্তি চীনকে এক নতুন অপরিচিত বাস্তবতার মুখোমুখি করে দেয়। কিছুদিনের জন্য চীন নিজেকে "ক্ষুদ্র" হিসাবে দেখতে পায়। আপাতঃ কিংকর্তব্যবিমূঢ় চীন ১৯৯২ সালে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয় চলমান অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচীকে আরও বেগবান ও গভীর করার (deepening of reform)। এর মাধ্যমে ক্রমাগতভাবে চীন আরও বেশী  Liberalization, Privatization, Marketization, Globalization -- LPMG এর পথে অগ্রসর হয় ও আরো বেশি বেশি করে বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাথে ওতপ্রোতভাবে মাকড়সার জালের মত অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে যায়। চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা যেমন চলতেই থাকে, চীনের সামরিক শক্তিও তেমনিভাবে উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকে। সামরিক খাতে চীনের ক্রমবর্ধমান বাজেট বরাদ্দ থেকেই এটা বোঝা যায়। চীনের ব্যবসা, উন্নয়ন সহযোগিতা পূর্ব-এশিয়া, দক্ষিণ-এশিয়া, মধ্য-এশিয়া, আফ্রিকায় বিস্তৃত ও বর্ধিত হতে থাকে। চীনের এই বর্ধণশীল অবস্থা মার্কিন নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি এড়ায়নি।

ফলে, সেই বিংশ শতকের শেষ থেকে ও একবিংশ শতকের শুরু থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পলিসি মেকারদের ও থিঙ্কট্যাঙ্কের পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক ও আলোচনা চলতে থাকে 'চীনের পিসফুল রাইজ' নিয়ে। এটা কতটুকু পিসফুল, কতদিন পিসফুল থাকবে, কিভাবে চায়নার সঙ্গে ডিল করা যাবে, কনফ্রনটেশান না একোমোডেটিভ পলিসি নেয়া সঠিক হবে, সেসব বিষয় নিয়ে বিস্তর আলোচনা, তর্কবিতর্ক, মতামত প্রদান চলতে থাকে। এমনই পটভূমিতে চীনের উত্থানের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শংকার ক্ষেত্রগুলো নিম্নরূপ:

ক. চীন একটি একদল-শাসিত দেশ। গণতন্ত্রহীন। মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী। নানান উদাহরণ দিয়ে তা বোঝানো হয়। ফলে, আল্টিমেটলি গনতন্ত্র ও অগণতন্ত্রের বিরোধ-দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী।

খ. চীন ক্রমাগত একটি আগ্রাসী শক্তিতে পরিণত হচ্ছে।  সে তার ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধি ও প্রসারিত করছে। তাইওয়ানকে হুমকি দিচ্ছে। দক্ষিণ চীন সাগরে স্বীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপক ও আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী পদক্ষেপ নিচ্ছে। সেনকাকু/দাইয়ায়ুতি দ্বীপ নিয়ে জাপানের সাথে দ্বন্দ্ব বাড়িয়েই চলেছে।

গ. আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আনফেয়ার ট্রেড প্র্যাকটিস ফলো করছে। পাশ্চিমা দেশগুলোর কোম্পানিগুলোকে প্রযুক্তি হস্তান্তরে বাধ্য করছে। চীনের মোবাইল কোম্পানিগুলো তাদের প্রোডাক্টের মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলোর সেনসিটিভ সিকিউরিটি রিলেটেড ডাটা ও তথ্যাবলী পাচার করছে।

ঘ. সামরিকভাবে "ভয়ঙ্কর রকমের" assertive হয়ে যাচ্ছে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল ও ট্র্যাডিশনালি ভারতের সহজাত প্রভাব বলয়ের অঞ্চল হিসাবে দক্ষিণ এশীয়াতে চীনের ব্যাপক আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামরিক পেনিট্রেশন ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

ঙ. মধ্য এশীয়াতেও চীন তার উপস্থিতি সরব করেছে। সেখানকার তেল, গ্যাস ও অন্যান্য কাঁচামালের ক্রেতা হয়েছে চীন।

চ. আফ্রিকাতে চীনের বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে ও সেখানকার বিভিন্ন ধরনের কাঁচামালের বড় ক্রেতা হিসাবে চীন আবির্ভূত হয়েছে। ফলে, আফ্রিকাকে পূর্বের ন্যায় নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো ব্যবহার করা কমে যাচ্ছে। আফ্রিকার দেশগুলোর বার্গেইনিং পাওয়ার বাড়ার ফলে পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষে আগের ন্যায় আর সহজে আফ্রিকাকে এক্সপ্লয়েট করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের প্রতি চ্যালেঞ্জ

আরো কিছু বলা গেলেও, আপাততঃ এটুকু বলাই যথেষ্ট, চীন-মার্কিন সংশ্লিষ্ট পয়েন্টটা এস্টাবলিস করার জন্য। এখন উপরের বিষয়গুলো যদি আমরা একসঙ্গে বিবেচনা করি, তবে আমরা কি পাই? পরিষ্কার চ্যালেঞ্জ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার প্রতি। অন্ততঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তিসমুহ সেভাবেই বিষয়টা দেখে থাকেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের বিজয়ের মাধ্যমে কোল্ডওয়ার শেষ হবার পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীতে তার নির্দেশে ও তার নেতৃত্বে 'ইউনিপোলার নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার' তৈরির প্রয়াসে মত্ত হয়ে পড়ে। সারা দুনিয়াকে তারা পদানত করতে থাকে। কিন্তু, চীনের উত্থানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পলিসিমেকাররা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বপ্নের ইউনিপোলার নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের প্রতি চ্যালেঞ্জ বলে গণ্য করতে থাকেন। তারা চীনের কমপ্রিহেনসিভ পাওয়ার হয়ে ওঠার স্পষ্ট আলামত অবলোকন করেন ও এটাকে ডিল করার স্ট্র্যাটেজি হিসাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অনুসারী চারটি এশীয় দেশ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অষ্ট্রেলিয়া, ও ভারত) নিয়ে ২০০৭ সালে Quadrailateral Agreement -- QUAD গঠন করে। পরবর্তীতে চীনের বিরূদ্ধে বিভিন্ন মাত্রার বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা, প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞা, ইত্যাদি আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিভিন্ন পশ্চিমা দেশসমূহ। ২০১৩ সালে চীন তার মাল্টি-ট্রিলিয়ন ডলার বিশ্বব্যাপী অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগ (Belt and Road Initiative) গ্রহণ করার পর থেকে চীনকে নিয়ে মার্কিনী উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার এশীয় অনুসারী দেশসুমহ চীনের এই উত্থান ও ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি অগ্রহণযোগ্য ও উদ্বেগের বিষয় বলে মনে করেছে। ফলস্বরূপ একধরণের অলিখিত Containment of China পলিসি গ্রহণ করে। যেটাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন বলেছেন, নতুন স্নায়ুযুদ্ধ নয়, কিন্তু, policy of extreme competition। এ লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই কোল্ড ওয়ার আমলের মতো QUAD, Indo-Pacific Strategy -- IPS, AUKUS, Indo-Pacific Ecomomic Cooperston, ইত্যাদ বিভিন্ন নামে জোট গঠন করছে। এই মেরুকরণকে বলা হচ্ছে, গণতান্ত্রিক দেশসমূহের জোট, রুল বা বিধি বিধান ভিত্তিক জোট, আগ্রাসী-সম্প্রসারণবাদী চীন-বিরোধী জোট।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন, উভয়েই চাইবে বাংলাদেশকে তার সাথে পেতে। পরিস্থিতি আরও বেশি জটিল হয়েছে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক গুরুত্বের কারণে। বঙ্গোপসাগর বর্তমান প্রেক্ষাপটে নানা কারণে ও নানা দিক দিয়ে অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায়, চীন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী ও বিনিয়োগকারী ও সাহায্যদাতা দেশ। তদুপরি, চীনের সাথে রয়েছে আমাদের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক। এখনও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জন্য প্রায় সবটা হার্ডওয়্যারই আসে চীন থেকে। আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্যের বিবেচনাতেও চীন বাংলাদেশের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

একটা কথা কেউ সচরাচর প্রকাশ্যে না বললেও এটা সবাই অনুভব করেন যে, চীনের সাথে সুসম্পর্ক বাংলাদেশীদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক নিরাপত্তাবোধের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীন নিজেও চায় না যে, বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি কোন নতুন "এশিয়ার স্নায়ুযুদ্ধের জোটে" যোগদান করুক। বাংলাদেশস্থ চীনা রাষ্ট্রদূত থেকে খোদ চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পর্যন্ত বাংলাদেশ সফর করে বাংলাদেশ যেন কোন মার্কিন জোটে না যায়, সেটা স্পষ্ট করে বলেছেন। এ ব্যাপারে চীন তার অবস্থান পরিষ্কার করে জানিয়ে গিয়েছে।

অপরদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে এসে চীনের বিরূদ্ধে বিরূপ বক্তব্য দিয়ে গিয়েছেন ও বাংলাদেশকে চীনের সাথে অতি-ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে গিয়েছেন।

এদিকে ভারত তার নিজের চীনের সাথে তীব্র টানাপোড়েনের সম্পর্কের কারণে ও "চীন ঠেকাও" জোটের অংশীদার হিসাবে বাংলাদেশে চীনের প্রভাবের বাড়বাড়ন্তের ব্যাপারে বাংলাদেশকে বারবার যৌক্তিক ও অযৌক্তিকভাবে সতর্ক করে দিয়েছে, যা অনেকটা ভারতের দিক থেকে হিস্টিরিয়াতে পরিণত হয়েছে।

কিন্তু, এটা আমাদের ভুললে চলবেনা যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের কয়েক বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত আছে আর আমাদের রফতানির অন্যতম বৃহৎ বাজার হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সমগোত্রীয় ইউরোপীয় দেশসমূহ। কাজেই, একতরফাভাবে শুধু ভারত বা চীন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যাওয়া হবে আত্মঘাতী, হঠকারী ও বোকামীপূর্ণ। কোন পক্ষের দিকে "হেলে পড়ার" (Tilt) নীতি হবে 'দুঃখজনক' ও 'ভেরী আনস্মার্ট'। এটা এখন ভবিষ্যতের জন্য দেখার বিষয় যে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কতটুকু তার বন্ধু ভারতের বুদ্ধিতে বা মার্কিন চাপে, বা কোন তাৎক্ষনিক সুবিধার জন্য চীনের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করে কিনা। কিংবা যদি কখনো বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায়, তবে কি তার পশ্চিমপ্রিয়তা তাকে চীনের প্রতি অতিসতর্কতার নীতির দিকে ঠেলে দেবে? মনে হয়, মার্কিন ও পশ্চিমপ্রিয়তা সত্বেও বিএনপির সম্ভাব্য সরকার হয়তো ভারতের সাথে সম্পর্কের কাউন্টারভেলিং ফোর্স হিসাবে চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার নীতিই অনুসরণ করতে চাইবে।

মোদ্দা কথা হলো, আঞ্চলিক বা/ও বৈশ্বিক মেরুকরণের অভিঘাত বাংলাদেশের উপর পড়বেই। বাংলাদেশের উচিৎ হবে কোন অবস্থাতেই কোন একটি পক্ষে গিয়ে আরেক পক্ষের বিপরীতে নিজেকে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে ফেলা। বরং, বাংলাদেশকে এই সকল কনফ্লিকটইলিং পক্ষগুলোর সাথে সম্মানজনক ভারসাম্য বজায় রাখার মতো ডিপ্লোম্যাটিক স্কিল ডেভেলপ করা আবশ্যক। সেইসাথে জোট নিরপেক্ষতার নীতিকে দৃঢ়ভাবে এস্টাবলিশ করার ব্যাপক উদ্যোগের নেতৃত্ব দিতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, আমাদের জন্য চীন, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ সবাই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়। বাংলাদেশ এদের মধ্যে পক্ষ বেছে নেয়া এফোর্ড করতে পারেনা। সেটা করা সঠিকও নয়, সেটা করার বিলাসিতাও বাংলাদেশের জন্য মানায়ও না।

এশিয়া: ভবিষ্যতের সংকট/সম্ভাবনা

সকল কিছুরই দুটো দিকই থাকে। একদিকে যেমন অনেক সংকট থাকতে পারে, চ্যালেঞ্জ থাকতে পারে। আবার তেমনি সম্ভাবনাও থাকতে পারে। সম্ভাবনাগুলোকে সর্বোচ্চ কাজে লাগানোর দক্ষতা অর্জণ ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার ও সংকট সমাধানের দক্ষতা অর্জন আমাদেরকে অবশ্যই করতে হবে।

চ্যালেঞ্জ ও সংকট, আমার মতে, আপেক্ষিক। আমরা চ্যালেঞ্জ ও সংকট মোকাবিলায় কতটা দক্ষতার বা অদক্ষতার পরিচয় দিচ্ছি, তার উপরই নির্ভর করবে চ্যালেঞ্জ ও সংকটের ক্ষেত্র, তীব্রতা, মেয়াদ। সকল চ্যালেঞ্জ ও সংকটই মোকাবিলাযোগ্য।

আপাতদৃষ্টিতে চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে আছে: চীন-ভারত রেষারেষি, দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে জটিলতা, তাইওয়ান ইস্যু, ইত্যাদি। এছাড়াও, চীনের উত্থানের ফলে সৃষ্ট চীনের প্রভাবের বিস্তৃতি।

আর সম্ভাবনার কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, এশিয়া হলো পৃথিবীর গ্রোথ সেন্টার। ফলে, এশিয়ার বিকাশ ঘটতেই থাকবে। আর এর বেনিফিট সবাই পেতে থাকবে। আর এ অঞ্চলের কেউই হয়তোবা চাইবেনা, কোন সংকট সেই বিকাশের সম্ভাবনাকে স্তব্ধ করে দিক। তদুপরি, চীন আজ গ্লোবাল ইকনোমির সাথে এতটাই লিঙ্কড হয়ে গিয়েছে যে, চীন গ্লোবাল ইকনোমির ইন্টিগ্রাল পার্ট। সেই চীনকে এর থেকে ডি-লিঙ্ক করার চিন্তা ও চেষ্টা করাটা নিদেনপক্ষে মধ্যমেয়াদে হবে চরম হঠকারী ও ভয়ংকর। সম্পূর্ণ গ্লোবাল প্রোডাকশন ও সাপ্লাই চেইনে এত বড় অস্থিতিশীলতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে যে, সেই ঝুঁকি কেউই হয়তোবা নিতে চাইবেনা। কারণ, সেটা কারোরই স্বার্থানুকুল নয়। তাই,  অন্যান্য চ্যালেঞ্জের বেশীরভাগেরই হয়তোবা শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব।

   

ফারাক্কা লংমার্চের প্রয়োজন আজও ফুরায়নি



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৬ মে, ১৯৭৬। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত একটি দিন। আজ থেকে প্রায় ৪৯ বছর আগে ফারাক্কা অভিমুখে দীর্ঘ পদযাত্রার দিনটি প্রতিবছর মে মাস এলেই বেশি করে সবার নজরে আসে। সারাদেশে এবছর বৈরী তাপপ্রবাহ চলতে থাকায় প্রতিটি জীব-প্রাণের মধ্যে ত্রাহি অনুভব শুরু হয়েছে।

শহুরে বিত্তশালী মানুষ শীতাতপ যন্ত্রের ঘেরে বসে কিছুটা স্বস্তি খুঁজে পাওয়ার চেষ্ট করছে। কিন্তু শহুরে খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ এবং সারা দেশের গ্রামাঞ্চলের রৌদ্রজলা মানুষেরা এবছর বেশি নাকাল হয়ে পড়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কৃষকদের আবাদি জমিতে সেচের পানির আকাল। যারা নদীমাতৃক বাংলাদেশে অভিন্ন নদীর পানি সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের কল্যাণের জন্যই আন্দোলনে নেমেছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি।

মাওলানা ভাসানি কোনো রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন না। তিনি ছিলেন খেটে খাওয়া মানুষের কণ্ঠস্বর, একজন মজলুম জননেতা। তার নেতৃত্বেই সংগঠিত হয়েছিল পদ্মা নদীর পানি সুবিধা থেকে বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে ঐতিহাসিক পদযাত্রা যেটি ‘ফারাক্কা লংমার্চ’ নামে পরিচিত।

বাংলাদেশের মানুষ বহুযুগ আগে থেকে ভারতের পানি আগ্রাসনের শিকার। ভারত আন্তর্জাতিক গঙ্গা নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে উজান-ভাঁটি দুই দেশের মানুষের চরম ক্ষতি সাধন করে চলেছে। তবে এজন্য ভাটির দেশ বাংলাদেশ বেশি হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে।

ফারাক্কায় বাঁধ নির্মাণের শুরু থেকে মাওলানা ভাসানি এর প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৫২ সালে ভারত ফারাক্কায় বাঁ নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে তৎপরতা শুরু হলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এর প্রতিবাদ করে। তখন ভারত বলেছিল এটা অনুসন্ধান পর্যায়ে আছে। এ নিয়ে ১৯৬০ সালে এ বিষয়ে ভারত পাকিস্তান বৈঠক হয়। তবে ১৯৬১-৬২ সালে ভারত গোপনে বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু করে। এ কাজে সহায়তাকারী দেশ সোভিয়েত রাশিয়া এবং খরচ ধরা হয় এক বিলিয়ন ডলার। ফিডার খাল খননের কাজ ব্যতিরেকে ১৯৭০ সালে ফারাক্কা ব্যারেজের নির্মাণ কাজ শেষ করে ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলাকে সংযুক্ত করা ২,২৪০ মিটার দীর্ঘ ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মিত হয়ে চালু হওয়ার অপেক্ষায় থাকে।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর ভারত ফারাক্কার সংযোগ খালের কাজ দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করে। ১৯৭৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা ব্যারেজ চালু করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর নানা কৌশলে ২১ এপ্রিল থেকে ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা ব্যারেজ চালু করা হয়। যেটি আর বন্ধ হয়নি, আজ প্রায় ৪৮ বছর পেরিয়ে গেলেও সেটা পরীক্ষামূলকভাবে চালুই রয়ে গেছে।

মাওলানা ভাসানি ফারাক্কা ব্যারেজ চালু হওয়ার পর থেকে পদ্মায় একতরফা পানি প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন।

বাংলাদেশের কৃষি, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ সবকিছুর উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঠেকানোর জন্য ছিল তার এই আন্দোলন। ভারত প্রতিবছর ফারাক্কা ব্যারেজ দিয়ে বর্ষার অতিরিক্ত পানি আটকাতে না পেরে সব গেইট খুলে দিলে বাংলাদেশের জীবন রেখা পদ্মা নদীতে বর্ষায় ভয়াল রূপ, বন্যা ও নদীভাঙ্গন দেখা দেয়। খরায় গেট বন্ধ করে সামান্য জলধারা ছেড়ে দিলেও শীর্ণ-শুষ্ক নদীর কারণে জীবিকা হারানো দরিদ্র মানুষের দু:খ-দুর্দশা মাওলানা ভাসানির হৃদয়ে দোলা দিতে শুরু করে।

এমতাবস্থায় ১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল মাওলানা ভাসানি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি পত্র লিখেন। তিনি ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে ‘ফারাক্কা লংমার্চ’ কর্মসূচির বিষয়ে অবহিত করেন। সেই চিঠির উত্তরে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, “এটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, যিনি আমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও আত্মত্যাগের বেদনাকে একইভাবে সহমর্মিতা দিয়ে দেখেছেন, তিনি আমাদেরকে এত বেশি ভুল বুঝেছেন এমনকি আমাদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।” (বিবিসি বাংলা নিউজ মে ১৭, ২০১৫)।

এ বিষয়ে মাওলানা ভাসানির প্রত্যুত্তর ছিল, “আপনার ৪ মের পত্র ফারাক্কার উপর সরকারি ভাষ্যেরই পুনরাবৃত্তি। সুবিখ্যাত পূর্বপুরুষ মতিলাল নেহেরুর দৌহিত্রী ও পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর কন্যার কাছ থেকে এরূপ প্রত্যাশা ছিল না।”... “বাংলাদেশের উত্তরের জেলাগুলো সফর করে প্রকৃত চিত্রের প্রতিফলন দেখতে অনুরোধ জানাচ্ছি... সমস্যার ব্যাপকভিত্তিক সমাধান প্রয়োজন। এটি শুধু মৌসুমের দুমাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সারা বছরব্যাপী প্রবাহের যথাযথ বন্টনভিত্তিক হওয়া উচিত।”

এভাবে সময় গড়িয়ে গেলেও প্রকৃত সমস্যা আড়ালে থেকে যায়। যার প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে। মাওলানা ভাসানির দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনার জন্ম দেয় এই লংমার্চ।

এই লংমার্চ কর্মসূচির রুট ছিল পদ্মাতীরের বিভাগীয় নগর রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে ১৬ মে সকাল ১০টায় দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করে প্রেমতলী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পেরিয়ে কানসাট সীমান্ত দিয়ে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা ব্যারেজ এলাকার পয়েন্টে গিয়ে সমাপ্তি হওয়া। রাজশাহীর মাদরাসা ময়দানে বিশাল জনসভায় বক্তব্য দিয়ে তিনি এই যাত্রা শুরু করেন।

এসময় ৯০ বছর বয়সী বর্ষীয়ান নেতা মাওলানা ভাসানি বেশ অসুস্থ ছিলেন। তবুও তিনি দু’জন লোকের কাঁধে ভর দিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বজ্র-কঠোর ভাষায় বক্তব্য দিয়েছিলেন। এটাকে লংমার্চে অংশগ্রহণকারীরা আশ্চর্য ঘটনা মনে করেন।

মাওলানা ভাসানির বক্তব্য ছিল, “শিশুর যেমন মায়ের দুধে অধিকার, পানির উপর তোমাদের তেমনি অধিকার। তোমরা জাগ্রত হও, তোমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত অধিকার যে হরণ করেছে, তার বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াও।” তিনি মানুষের এই প্রাকৃতিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করাটাকে অত্যন্ত অন্যায় ও জুলুম হিসেবে অভিহিত করেছিলেন এবং “আকাশের দিকে হাত তুলে বলেছিলেন, আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদের বাঁচার পথ করে দিবেন।”

বৃদ্ধ বয়সে অনেক কষ্ট স্বীকার করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে সাথে নিয়ে এই দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করেন। লংমার্চকারীদের সাথে নিয়ে তিনি ভারতের অভ্যন্তরে ফারাক্কা পয়েন্টে যাবার ঘোষণা দিলেও সীমান্ত অতিক্রম করার পূর্বে সরকারি পরামর্শে কানসাট স্থলবন্দরে উপনীত হয়ে লংমার্চ সমাপ্ত ঘোষণা করেন।

এর প্রায় কুড়ি বছর পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচ.ডি দেবগৌড়ার মধ্যে ত্রিশ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তি সম্পন্ন হয়। যেটা অদ্যাবধি বলবৎ রয়েছে। তরে গঙ্গা চুক্তির ২৭ বছর পেরিয়ে গেলেও কি পেয়েছে বাংলাদেশ, তা নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। একদিকে ফারাক্কা ব্যারেজের আয়ু ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সাথে গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ শেষের দিকে। এই চুক্তির নবায়ন কীভাবে করা হবে তা নিয়ে এখনও কিছু জানা যায়নি।

মেয়াদ উত্তীর্ণ ফারাক্কা ব্যারেজ যেহেতু উজান-ভাঁটি দু’দেশেরই ক্ষতির কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, সেক্ষেত্রে এটাকে ভেঙ্গে ফেলা হবে কি-না তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নানা জল্পনা-কল্পনা শোনা যাচ্ছে। ফারাক্কার কারণে এর উজানে ভারতের মাটিতে জলাবদ্ধতা, ভূমিধস, বন্যা, নদীভাঙ্গন ইত্যাদি ঘটনা সংবাদের শিরোনাম হতে দেখা যায়। ফারাক্কায় যে কোনো বড় দুর্যোগের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন সেখানকার অধিবাসীরা।

অন্যদিকে ফারাক্কায় একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে যে চুক্তি হয়েছে সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি না পাওয়ায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলার মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দিনাতিপাত করছেন। বাংলাদেশে পদ্মা নদীতে বর্ষায় অকাল বন্যা হলেও শীতের আগেই শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে পড়ে পদ্মা। এককালের প্রমত্তা পদ্মানদী যেখানে বড় বড় স্টিমারে চড়ে ঢাকা-কোলকাতা আসা যাওয়া চলতো এখন সেখানে নৌকা চালানোই দায় হয়ে পড়েছে।

পানির অভাবে নৌপথ বন্ধের সাথে পদ্মায় ইলিশ মাছসহ সাধারণ সব মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। এছাড়া নদীকেন্দ্রিক পেশা বন্ধ হয়ে জেলে, মাঝিমাল্লা, নৌশ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছে। পদ্মার শাখা ও উপনদীগুলো শুকিয়ে মরে গেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতার চরণ ‘পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি’- এখন পদ্মা ও তার শাখানদীগুলোর জন্য চরম সত্যবাক্যে রূপ নিয়েছে।

ফারাক্কা ব্যারেজের বিরূপ প্রভাবের ফলে বাংলাদেশে সার্বিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি, যা বিভিন্ন সেমিনার-কনফারেন্সে উপস্থাপিত গবেষণা রিপোর্ট থেকে প্রায়শই দেশে-বিদেশের সংবাদ মাধ্যমে শিরোনাম হতে দেখা যায়। ফারাক্কা সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে বহু গবেষক পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে নানা সুপারিশ প্রদান করলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সেগুলোকে পাত্তা দেয় না। গবেষণার সেসব ফলাফল নিয়ে তাদের কোনো বিকার কোনো কালেই লক্ষ্য করা যায় না।

এমনিকি তিস্তা নদীর পানিবণ্টন সমস্যা নিয়ে শত শত মিটিং-সেনিার, চুক্তি হওয়ার পরও অদ্যাবধি ঝুলে আছে। আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে ভারতের আন্তরিকতার অভাব ও একাই খাব নীতির কাছে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বঞ্চিত মানুষ যুগ যুগ ধরে শুধু আর্তনাদ করেই চলেছে। এমনকি বাংলাদেশের যথেষ্ট প্রচেষ্টার ফলেও নানা ভূ-রাজনৈতিক হিসেবের গড়মিলে বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।

আন্তরিকতার ঘাটতি, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, চুক্তি নিয়ে দোদুল্যমানতা ও বার বার প্রতারণার শিকার হয়ে বাংলাদেশ অনেকটা অসহায়ভাবে অভ্যন্তরীণ প্রচেষ্টায় পানি সমস্যার মোকাবেলা করে চলেছে। তবে নদীর পানি ভাগাভাগির বর্তমান বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করে একথা কারো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ফারাক্কা লংমার্চের প্রয়োজন এখন শেষ হয়েছে। বরং মাওলানা ভাসানির সেই ফারাক্কা লংমার্চের বজ্র-কঠিন ভাষণের দৃঢ়তা আজও ফুরায়নি।

আজও হারিয়ে যায়নি বাংলাদেশের চলার পথ, এগিয়ে যাবার দৃঢ় প্রত্যয়। নানা কূটকৌশল ও প্রতারণায় অনেক বঞ্চিত হয়েও মাওলানা ভাসানির মতো নৈতিক শক্তিমান অগ্রজদের দূরদৃষ্টি, দোয়া ও অনুপ্রেরণায় চারদিকের শত বাঁধা পেরিয়ে সামনের দিকে বহুদূর এগিয়ে যাবে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ- সবার সামনে নিকট ভবিষ্যতে।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।

;

রাজনীতির বিভক্তি: মার্কিন সম্পর্ক মূল্যায়নে যে তাগিদ বিশ্লেষকদের



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

দু’দিনের সফরে মঙ্গলবার ঢাকা এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। গেল ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ফের ক্ষমতায় আসার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী আইলিন লাউবাখেরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলের সফরের পর ডোনাল্ড লু’র এই সফর দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। মি. লু’র এই সফরকে ঘিরে ইতিমধ্যেই পরস্পরবিরোধী বাক্যবাণ ছোঁড়াছুড়ি শুরু করেছেন দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামীলীগ ও বিএনপি’র নেতারা।

তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তির নিরিখে ডোনাল্ড লু’র এই সফরকে মূল্যায়ন করা উচিত হবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারও যুক্তরাষ্ট্র। তাই বাংলাদেশকে বিদ্যমান এই সম্পর্ককে ইতিবাচকভাবে আরও সম্প্রসারণের দিকেই জোর দেওয়া উচিত।

সাবেক পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, শিক্ষাবিদ ও কুটনীতিক অ্যাম্বাসেডর ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী ডোনাল্ড লু’র এই সফর নিয়ে বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘নতুন সরকার আসার পর ডোনাল্ড লু’র এটি অফিসিয়াল লেভেল রুটিন ভিজিট। আমার মনে হয় নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার অংশই এই সফর। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই অর্থে যে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম কোন মার্কিন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার এই সফরটা হচ্ছে।’

‘তিনি কি বলবেন এই সফরের পর হয়ত জানা যাবে, তাই পূর্বমূল্যায়ন না করেও দৃশ্যত যেটি বোঝা যাচ্ছে, মি. লু’র এই সফর বাংলাদেশকে নতুন করে স্টাডির অংশ। তারা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নেই কাজ করবে। আশা করব, দুই দেশই সম্পর্ক ইতিবাচকভাবে আরও সম্প্রসারণের দিকে জোর দেবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তির নিরিখে একে মূল্যায়ন করা উচিত হবে না’-যোগ করেন সাবেক এই পেশাদার কুটনতিক।

বৈশ্বিক সম্পর্ক নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের আরও পরিণত চর্চার তাগিদ দিয়ে একুশে পদকজয়ী বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ আবুল মোমেন বলেন, ‘নানা বিষয়ে মতামত-মন্তব্য করাটাই রাজনীতিবিদদের কাজ। এখানে কেউ পরিপক্কভাবে দিতে পারে, কেউ পারেন না। আমেরিকা যেহেতু বেশকিছু আন্তর্জাতিক সংস্থারও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, বাংলাদেশও সেইসব সংস্থার থেকে সাহায্য নিচ্ছে; তাই সচরাচর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের চেয়েও বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক অনেক বর্ধিত, এটা স্বীকার করতেই হবে। রাজনীতিবিদদের সামগ্রিক পরিস্থিতি ও প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে তাদের রাজনৈতিক চর্চা করা উচিত।’

এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘একধরণের দৃশ্যমান এজন্ডা তো তাদের (যুক্তরাষ্ট্রের) আছেই, যেমন-গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন ইত্যাদি। এসব বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করাটাও তাদের রীতি। আবার সম্পর্কটাকে চালিয়ে নেওয়াও তাদের বৈশিষ্ট্য। ডোনাল্ড লু এসেছেন হয়ত সেই চাপকে অব্যাহত রাখতেই। তার মানে এই নয় যে-বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের যে চলমান সম্পর্ক সেখানে তাত কোন প্রভাব পড়বে।’

আবুল মোমেন বলেন, ‘ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে যেটি দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে দুটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র ভারত ও চীনের সঙ্গে একইসঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্কে রয়েছে। আমেরিকাও তৃতীয় আরেকটি শক্তি-সেই দিক থেকে এটা ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য এক ধরণের সুবিধাও বটে।’

‘বাংলাদেশের তো এখন উপায় নেই-সবার সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই চলতে হবে। বাংলাদেশ যদি মালদ্বীপের মত ক্ষুদ্র দেশ হতো তাহলে হয়ত চীনের সঙ্গে সম্পর্কে ঢুকে গিয়ে চলার কথা ভাবতে পারতো। কিন্তু বাংলাদেশ জনসংখ্যার দিক দিয়ে বড় দেশ। রাজনৈতিক আকাঙ্খাও বহুমুখি। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে মালদ্বীপের মত স্ট্যান্ড নেওয়া সম্ভব নয়’-বলেন প্রভাবশালী এই কলামিস্ট ও বিশ্লেষক।

উল্লেখ্য, ডোনাল্ড লু সফরকালে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। এ ছাড়া বৈঠক করবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গেও। সফরকালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও মতবিনিময়ের কথা রয়েছে তাঁর।

;

ক্রমবর্ধমান ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের কারণ ও প্রভাব



মো. বজলুর রশিদ
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আধুনিক সমাজে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ধারণা ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব অর্জন করছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ হলো, ব্যক্তির স্বাধীনতা, স্বায়ত্তশাসন এবং আত্মপ্রকাশের ওপর জোর দেওয়ার একটি বিশ্বাস ব্যবস্থা।

এটি ব্যক্তিকে সমাজের নিয়ম ও রীতিনীতির চেয়ে নিজস্ব মূল্যবোধ ও বিশ্বাস অনুসরণ করার অধিকার প্রদান করে।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বৃদ্ধির অনেকগুলি কারণ রয়েছে। আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া ব্যক্তির জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। শিক্ষা, প্রযুক্তি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ব্যক্তির আরো স্বাধীন ও আত্মনির্ভর হতে সাহায্য করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ইন্টারনেটের প্রসার ব্যক্তির তথ্য ও জ্ঞানের অভূতপূর্ব ‘অ্যাক্সেস’ প্রদান করেছে, যা তার নিজস্ব মতামত গঠন এবং তার নিজস্ব পছন্দ অনুসরণ করতে সাহায্য করে।

বিশ্বায়ন বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধারণার সংস্পর্শে আসার সুযোগ করে দিয়েছে। এর ফলে ব্যক্তি তার নিজস্ব পরিচয় ও মূল্যবোধ সম্পর্কে আরো সচেতন হয়ে উঠেছেন। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যক্তি ঐতিহ্যবাহী নিয়মকানুন ও রীতিনীতি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন এবং তার নিজস্ব মূল্যবোধ অনুসারে জীবনযাপন করার জন্য আরো বেশি স্বাধীনতা চাইতে শুরু করেছেন।

আধুনিক সমাজে ব্যক্তিগত সম্পদ ও সাফল্যের ওপর জোর দেওয়া হয়। এর ফলে ব্যক্তি নিজস্ব লক্ষ্য ও স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে শেখেন। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষা ও কর্মজীবনের ওপর জোর দেওয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি তার নিজস্ব জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে এবং তার নিজস্ব স্বপ্ন পূরণ করতে আরো বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

'নারীবাদ', 'হিজড়া' অধিকার আন্দোলন ইত্যাদির মতো সামাজিক আন্দোলনগুলি ব্যক্তির স্বাধীনতা ও সমতা ধারণার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই আন্দোলনগুলি ব্যক্তি তার নিজস্ব পরিচয় গ্রহণ করতে এবং তার নিজস্ব অধিকারের জন্য দাঁড়াতে উৎসাহিত করেছে।

ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ, যেমন পারিবারিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সামাজিক রীতিনীতি, অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও আত্মপ্রকাশের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ হতে পারে। এর ফলে অনেকেই ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধের প্রতি হতাশাবোধ করতে পারেন এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ধারণার দিকে ঝুঁকে পড়তে পারেন।

প্রযুক্তির অগ্রগতি ব্যক্তির তথ্য ও জ্ঞানের অভূতপূর্ব ‘অ্যাক্সেস’ প্রদান করেছে। এর ফলে ব্যক্তি বিভিন্ন ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানতে সক্ষম হয়েছেন, যা তার নিজস্ব মূল্যবোধ ও বিশ্বাস গঠনে সাহায্য করেছে।

মানুষ স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতা পছন্দ করে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যক্তির নিজস্ব জীবনযাপন এবং নিজস্ব পছন্দ অনুসরণ করার স্বাধীনতা প্রদান করে। এর ফলে অনেকেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হন। তবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের অনেক ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকও রয়েছে।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যক্তির নিজস্ব পছন্দ ও বিশ্বাস অনুসরণ করার স্বাধীনতা প্রদান করে। এটি সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন এবং ব্যক্তিগত বিকাশকে উৎসাহিত করে।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বিভিন্ন ধারণা ও জীবনধারার প্রতি সহনশীলতাকে উৎসাহিত করে। এটি একটি আরো বৈচিত্র্যময় এবং গ্রহণযোগ্য সমাজ তৈরিতে সাহায্য করে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যক্তিকে নিজস্ব পছন্দ ও কর্মের জন্য দায়িত্বশীল করে তোলে। এটি ব্যক্তিগত উন্নয়ন এবং সামাজিক উন্নয়নের দিকে পরিচালিত করতে পারে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যক্তির নিজের ওপর জোর দেওয়ার ফলে সমাজের মধ্যে সংযোগ ও বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।

ব্যক্তিগত স্বার্থের ওপর অতিরিক্ত জোর দেওয়ার ফলে সামাজিক অস্থিরতা ও সংঘাত বৃদ্ধি পেতে পারে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যক্তির মধ্যে একাকী ও বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি করতে পারে।

‘নারীবাদ’ আন্দোলন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল এবং এর ফলে নারীদের জন্য ব্যাপক সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে অতিরিক্ত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ পারিবারিক মূল্যবোধের দুর্বলতা এবং পারিবারিক বিচ্ছেদের দিকে পরিচালিত করতে পারে।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ আধুনিক সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যার ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ধরনেরই প্রভাব রয়েছে। ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, সৃজনশীলতা এবং বৈচিত্র্যকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি এটি সামাজিক বন্ধন দুর্বল করতে পারে এবং ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি করতে পারে।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সুবিধাগুলি কাজে লাগানো এবং এর সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাবগুলি প্রশমিত করার জন্য ব্যক্তি, সমাজ, বেসরকারি সংস্থা এবং সরকারের পক্ষ থেকে সচেতন প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

মো. বজলুর রশিদ: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

;

আইএমএফের তৃতীয় কিস্তি ও আমাদের চ্যালেঞ্জ



ইরাজ নূর চৌধুরী
আইএমএফের তৃতীয় কিস্তি ও আমাদের চ্যালেঞ্জ

আইএমএফের তৃতীয় কিস্তি ও আমাদের চ্যালেঞ্জ

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশকে দেওয়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের তৃতীয় কিস্তি অনুমোদনে গ্রাউন্ড স্টাফ লেভেলে চুক্তি হয়েছে। বাংলাদেশকে এই কিস্তিতে আইএমএফ পূর্ব নির্ধারিত কিস্তির প্রায় দ্বিগুণ ১.২ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে চলমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও রিজার্ভ সংকট মোকাবেলায় ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ বাংলাদেশকে প্রদান করে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ইস্যুতে পিছিয়ে পড়া সামাজিক গোষ্ঠীর সুরক্ষা প্রদান, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিতে এই ঋণ দেওয়া হয়েছে বলে সংস্থাটি জানায়। ৪২ মাসে সাতটি কিস্তির মাধ্যমে এই ঋণ বাংলাদেশকে দেওয়া হবে বলে জানায় সংস্থাটি। এই কিস্তি পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে বলেও তখন জানানো হয়।

বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে এর আগে আরও দুই কিস্তিতে ঋণ পেয়েছে। এসময় সরকার আইএমএফের শর্তগুলো আংশিক পূরণ করতে পারলেও রিজার্ভ বাড়ানো, কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির মতো শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। গত জুনে আইএমএফের ঋণ পাওয়ার জন্য শর্ত আলোচনার ক্রিস পাপাজর্জিওর নেতৃত্বে আইএমএফের একটি দল ১৫ দিনের সফরে এসে সরকারের সাথে তাদের ঋণের শর্তগুলো পূরণ ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতা মোকাবেলায় সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেছে।

আইএমএফের এই দল ঋণের কিস্তির অনুমোদনের জন্য সরকারকে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ জানায়। এর মধ্যে ডলারের মান বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া, সেবা, শিক্ষা ও কৃষিখাতে কর আরোপ, ৩ কোটি টাকার বেশি রেভিনিউ উৎপাদনকারী ব্যবসায় ১৫ শতাংশ কর আরোপ অন্যতম। এছাড়া আইএমএফ বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ ও মুদ্রাস্ফীতি রিজার্ভ বাড়াতে সরকারের কর্মপরিকল্পনা ও জ্বালানি বিল নিষ্পত্তিতে সরকারের পরিকল্পনা জানতে চেয়েছে।

আইএমএফের এমন শর্তাবলির কারণে আসন্ন বাজেটে জনগণের উপর নতুন করে নানামুখী কর-এর খড়গ নেমে আসতে পারে বলে ধারনা করা হচ্ছে। আইএমএফের শর্তাবলির কারণে ইতোমধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষেরা। মূল্যস্ফীতি, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, তেল ও গ্যাসের বৃদ্ধিসহ নানা কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত। ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে সিংহভাগ মানুষের। এরই মধ্যে সেবা, শিক্ষা, কৃষিতে ১৫ শতাংশ কর আরোপ করা হলে দ্রব্যমূল্যসহ সব কিছুর দাম বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া ব্যাংকে আর্থিক অনিয়মের কারণে আমানতে যে মন্থরতা দেখা গিয়েছিল, ঠিক সেই ধরনের মন্থরতা দেখা যাবে বিনিয়োগে। ফলে সরকার নির্বাচনে কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেই প্রতিশ্রুতি অনেকটাই বিঘ্নিত হবে।

২০২৩ সালে বিদেশি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এ বছরও এমন অস্থিরতায় বিদেশি বিনিয়োগ কম হবে বলে ধারনা করা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে রিজার্ভ অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় কম রয়েছে। সরকার আমদানি কমিয়ে রিজার্ভ রক্ষার যে চেষ্টা করেছিল সেটি তেমন কাজে আসছে না। ডলারের বিনিময় হার বেঁধে দেওয়া হলে সেই বিনিময় হার কম হওয়ায় ২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে বৈধ উপায়ে বৈদেশিক মুদ্রা কম এসেছে। হুন্ডি ও অবৈধ পথে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানোর প্রবণতা বেশি দেখা গেছে। সরকার রেমিট্যান্স প্রদানকারীদের যে প্রণোদনা দিয়েছিল সেটিও খুব বেশি কাজে দেয়নি। দেশে প্রথম দশ মাসে ১৯.১১ বিলিয়ন ডলার এসেছে।

বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুসারে বাংলাদেশ এই অর্থবছরেও ২৩ বিলিয়ন ডলার পাবে। যা রিজার্ভ বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট নয়। এমন মুহূর্তে আইএমএফ ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছে এবং সরকার ডলারের দামও বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে দেশে হুন্ডি ও অবৈধ পথে টাকা পাঠানো বন্ধ হলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। এছাড়াও চলমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও গত বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বৈদেশিক বিনিয়োগ কম হয়েছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগ ১৬ শতাংশ কমেছে। তা বাড়ার তেমন কোন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।

এছাড়াও দেশে কর ছাড়ের প্রবণতার কারণে পোশাক শিল্প ছাড়া আর তেমন রপ্তানিমুখী শিল্প গড়ে উঠেনি। ফলে রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্যের অভাবেও দেশের রিজার্ভ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এছাড়া আইএমএফ তার ঋণের কিস্তির পরিমাণ দ্বিগুণ করা ও প্রয়োজনীয় রিজার্ভ ২০.১০ বিলিয়ন থেকে ১৪.৭৬ বিলিয়ন ডলার করা ইঙ্গিত দেয় যে খুব সহসা এই বৈদেশিক মুদ্রার সংকট হবে। এই সমস্যা সমাধানে একটি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

আবার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি তুলে নেওয়া হয়েছে একবছর আগে। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তেতে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন বছরে চার বার আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করে সেই দাম নির্ধারণ করার কথা বলেছে আইএমএফ। এছাড়াও ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে শিল্প উৎপাদন হুমকির মধ্যে পড়েছে। মফস্বল ও গ্রামে নিয়মিত লোডশেডিংয়ের কারণে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। এই সমস্যার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ জ্বালানি সংকটকে দায়ী করছে। রিজার্ভ সংকটের কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণ জ্বালানি আমদানি করা যাচ্ছে না। এই জ্বালানি তেলের সংকট সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আকুর বিল পরিশোধের পর দেশের রিজার্ভ আরও কমবে। 

সরকার রাজস্ব বাড়ানোর জন্য কর বৃদ্ধি ও কর আরোপের মত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যার ফলে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেয়েছে বটে। তবে এতে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ আর থাকছে না। দেশে বিনিয়োগ হ্রাসের কারণে কর্মসংস্থান কম হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে বেকারত্বের পরিমাণ ৩.৫১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দেশের চলমান জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ আদায় নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এছাড়াও দেশের খেলাপি ঋণ আদায়ে তেমন কোন উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। দুই শতাংশ ডাউন-পেমেন্টে ঋণ পুনঃতফসিল করার মাধ্যমে ঋণখেলাপিদের যে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে তাতে দেশের ব্যাংকিং খাত আরও বেশি বিপন্ন হবে বলে ধারনা করা যাচ্ছে। তথাপি ঋণ আদায় হলে দেশের মুদ্রাস্ফীতি পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণে আসবে। এতে করে আইএমএফের ঋণ শর্তাবলি পূরণ করাও যেমন সহজ হবে তেমনই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের উপর চাপও প্রশমিত হবে।

দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সরকারকে আইএমএফের সকল শর্ত পূরণ করতে হবে। এই সকল শর্তের চাপ থেকে নিম্ন আয়ের মানুষকে মুক্ত রাখতে সরকারকে উচ্চশ্রেণি ও ব্যবসায়ী মহলের প্রতি কঠোর হতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য অবৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স আসা বন্ধ করা, বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও ভবিষ্যতে রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। এছাড়াও মুদ্রা পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তাহলে এই অর্থনৈতিক সংকট থেকে দেশ মুক্তি লাভ করতে পারবে।

লেখক: ইরাজ নূর চৌধুরী, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

;