ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স: যশোর থেকে শারজাহ



মো. কামরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

লাল সবুজের পতাকাবেষ্টিত বাংলাদেশের একটি নবীন বিমানসংস্থা হিসেবে ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ঢাকা থেকে যশোর রুটে ফ্লাইট পরিচালনার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। ৭৬ আসনের দু’টি ড্যাশ৮-কিউ৪০০ এয়ারক্রাফট দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে। অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা, অনেক প্রত্যাশা নিয়ে যাত্রা শুরু করা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স এগিয়ে চলেছে নিজের লক্ষ্য পূরণের জন্য।

প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হয় নিজের কাছে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ নিজের ভবিষ্যতের কাছে। সেই প্রতিজ্ঞা পূরণের লক্ষ্য নিয়ে স্বপ্ন পূরণের ইচ্ছাগুলো পূর্ণ করে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের মানুষকে সেবা দেয়ার প্রত্যয় নিয়ে আকাশপথকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠার প্রথম বছরে দেশের প্রত্যেকটি চালু বিমানবন্দরে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স।। ঢাকা থেকে যশোরে ফ্লাইট শুরু করার পর ধারাবাহিকভাবে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সিলেট, সৈয়দপুর, রাজশাহী ও বরিশালে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে।

দেশের সবগুলো বিমানবন্দরে ফ্লাইট পরিচালনার পর দুই বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট শুরু করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলো ইউএস-বাংলা। সেই প্রত্যয়কে বাস্তবে রূপ দিয়েছে ২০১৬ সালের ১৫ মে ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু রুটে ফ্লাইটে পরিচালনার মধ্য দিয়ে। অনেক স্বপ্নকে সাথে নিয়ে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশ বিভূইয়ে যাত্রা শুরু করে জাতীয় বিমানসংস্থার সাথে দেশের পতাকাকে উচ্চাসনে তুলে ধরে বিদেশি বিমানসংস্থার সাথে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়।

কাঠমান্ডু রুটের ফ্লাইট শুরু করার পর ইউএস-বাংলার বিমানবহরে যুক্ত হয় ১৬৪ আসনের বোয়িং ৭৩৭-৮০০ এয়ারক্রাফট। এর পর বাংলাদেশিদের আধিক্য বজায় আছে এমন কয়েকটি রুটে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম রুট মাস্কাট, দোহায় ফ্লাইট শুরু করে ২০১৬ সাল শেষ হবার পূর্বেই। পূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুরে ফ্লাইট শুরু করে ২০১৭ সালে ইউএস-বাংলা। এর পর পার্শ্ববর্তী ভারতের অন্যতম গন্তব্য কলকাতায় যাত্রা শুরু করে।

বাংলাদেশের আকাশ পরিবহনে ৫০ বছরের ইতিহাসে জাতীয় বিমান সংস্থাসহ ইউএস-বাংলার পূর্বে চলাচলকারী সকল বেসরকারি বিমান সংস্থার স্বপ্ন ছিলো চীনের কোনো একটি প্রদেশে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করা। কিন্তু ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স প্রথম ও একমাত্র দেশীয় এয়ারলাইন্স ঢাকা থেকে চীনের গুয়াংজু রুটে সরাসরি রুটে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল।

গুয়াংজু রুটে ফ্লাইট শুরু করার পর চিকিৎসাসেবা নেয়ার জন্য গমণকারী বাংলাদেশিদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় গন্তব্য ভারতের চেন্নাইতে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে ২০১৮ সালের শেষদিকে। নানা প্রতিকূলতা ও কঠিন বাস্তবিক প্রতিযোগিতাকে সাথে নিয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স এগিয়ে চলার গল্পে যোগ করে অন্যতম পর্য্টক বান্ধব এশিয়ার অন্যতম গন্তব্য থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে।

স্বল্প সময়ের চলার পথে করোনা ভাইরাসের মতো অতিমারীর সম্মুখীন হতে হয়েছে সারা বিশ্বের আকাশ পরিবহনের মতো ইউএস-বাংলাকেও। কোভিড-১৯ কালীন সময়কে চরম বাস্তবতা মেনে নিয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স এগিয়ে চলেছে নিজের দেখানো আলোর পথে। কঠিন সময়ে ইউএস-বাংলার লক্ষ্যচূতি ঘটেনি। কোভিড কালীন সময়ে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারীতে বাংলাদেশিদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় রুট মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম গন্তব্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই ফ্লাইট শুরু করে ইউএস-বাংলা।

পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নকে সাথে নিয়ে শুরু থেকে ইউএস-বাংলা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় ক্রস কান্ট্রির ধারনা থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ যশোর থেকে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং সৈয়দপুর থেকে চট্টগ্রামে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে। এশিয়ার অন্যতম গন্তব্য ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের সেবা দেয়ার জন্য ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর ঢাকা থেকে মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে।

যাত্রা শুরুর পর থেকে অতীত সময়ের অভিজ্ঞতাকে সাথে নিয়েই ইউএস-বাংলা নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করে দেশের আকাশ পরিবহনকে সুসংগঠিত করায় সচেষ্টা করছে প্রতিনিয়ত। একাদশ আন্তর্জাতিক গন্তব্য হিসেবে চলতি বছরে প্রথম ঢাকা থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের অন্যতম গন্তব্য শারজাহ-তে আগামী ৩০ জানুয়ারি ফ্লাইট শুরু করতে যাচ্ছে।

ইউএস-বাংলার ইচ্ছা পূরণের অঙ্গীকার নিয়ে বাংলাদেশিরা বিশ্বের যেসব দেশ কিংবা অঞ্চলে অবস্থান করছে সেসব দেশ কিংবা অঞ্চলে ফ্লাইট পরিচালনার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এই এগিয়ে চলার পথে খুব শীঘ্রই ঢাকা থেকে কলম্বো, দিল্লী, সৌদি আরবের রিয়াদ, জেদ্দা, দাম্মাম, মদিনায় ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করবে।

দু’টি ড্যাশ ৮-কিউ৪০০ এয়ারক্রাফট নিয়ে যাত্রা শুরু করা ইউএস-বাংলার বিমানবহরে মোট ১৬টি এয়ারক্রাফট রয়েছে, যার মধ্যে ৬টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০, ৭টি ব্র্যান্ডনিউ এটিআর-৭২-৬০০ ও তিনটি ড্যাশ ৮-কিউ৪০০ এয়ারক্রাফট।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স এর এগিয়ে চলার গল্পের মূল চালিকাশক্তিই হচ্ছে যাত্রী সাধারণের আস্থা, সময়ানুবর্তিতা, ব্র্যান্ডনিউ এয়ারক্রাফট, আন্তর্জাতিক মানের ইনফ্লাইট সার্ভিস অন্যতম।          

লেখক: মো. কামরুল ইসলাম, মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স

   

আইএমএফের তৃতীয় কিস্তি ও আমাদের চ্যালেঞ্জ



ইরাজ নূর চৌধুরী
আইএমএফের তৃতীয় কিস্তি ও আমাদের চ্যালেঞ্জ

আইএমএফের তৃতীয় কিস্তি ও আমাদের চ্যালেঞ্জ

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশকে দেওয়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের তৃতীয় কিস্তি অনুমোদনে গ্রাউন্ড স্টাফ লেভেলে চুক্তি হয়েছে। বাংলাদেশকে এই কিস্তিতে আইএমএফ পূর্ব নির্ধারিত কিস্তির প্রায় দ্বিগুণ ১.২ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে চলমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও রিজার্ভ সংকট মোকাবেলায় ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ বাংলাদেশকে প্রদান করে। বাংলাদেশে বিভিন্ন ইস্যুতে পিছিয়ে পড়া সামাজিক গোষ্ঠীর সুরক্ষা প্রদান, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিতে এই ঋণ দেওয়া হয়েছে বলে সংস্থাটি জানায়। ৪২ মাসে সাতটি কিস্তির মাধ্যমে এই ঋণ বাংলাদেশকে দেওয়া হবে বলে জানায় সংস্থাটি। এই কিস্তি পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে বলেও তখন জানানো হয়।

বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে এর আগে আরও দুই কিস্তিতে ঋণ পেয়েছে। এসময় সরকার আইএমএফের শর্তগুলো আংশিক পূরণ করতে পারলেও রিজার্ভ বাড়ানো, কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির মতো শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। গত জুনে আইএমএফের ঋণ পাওয়ার জন্য শর্ত আলোচনার ক্রিস পাপাজর্জিওর নেতৃত্বে আইএমএফের একটি দল ১৫ দিনের সফরে এসে সরকারের সাথে তাদের ঋণের শর্তগুলো পূরণ ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতা মোকাবেলায় সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেছে।

আইএমএফের এই দল ঋণের কিস্তির অনুমোদনের জন্য সরকারকে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ জানায়। এর মধ্যে ডলারের মান বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া, সেবা, শিক্ষা ও কৃষিখাতে কর আরোপ, ৩ কোটি টাকার বেশি রেভিনিউ উৎপাদনকারী ব্যবসায় ১৫ শতাংশ কর আরোপ অন্যতম। এছাড়া আইএমএফ বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ ও মুদ্রাস্ফীতি রিজার্ভ বাড়াতে সরকারের কর্মপরিকল্পনা ও জ্বালানি বিল নিষ্পত্তিতে সরকারের পরিকল্পনা জানতে চেয়েছে।

আইএমএফের এমন শর্তাবলির কারণে আসন্ন বাজেটে জনগণের উপর নতুন করে নানামুখী কর-এর খড়গ নেমে আসতে পারে বলে ধারনা করা হচ্ছে। আইএমএফের শর্তাবলির কারণে ইতোমধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষেরা। মূল্যস্ফীতি, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, তেল ও গ্যাসের বৃদ্ধিসহ নানা কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত। ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে সিংহভাগ মানুষের। এরই মধ্যে সেবা, শিক্ষা, কৃষিতে ১৫ শতাংশ কর আরোপ করা হলে দ্রব্যমূল্যসহ সব কিছুর দাম বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া ব্যাংকে আর্থিক অনিয়মের কারণে আমানতে যে মন্থরতা দেখা গিয়েছিল, ঠিক সেই ধরনের মন্থরতা দেখা যাবে বিনিয়োগে। ফলে সরকার নির্বাচনে কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেই প্রতিশ্রুতি অনেকটাই বিঘ্নিত হবে।

২০২৩ সালে বিদেশি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এ বছরও এমন অস্থিরতায় বিদেশি বিনিয়োগ কম হবে বলে ধারনা করা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে রিজার্ভ অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় কম রয়েছে। সরকার আমদানি কমিয়ে রিজার্ভ রক্ষার যে চেষ্টা করেছিল সেটি তেমন কাজে আসছে না। ডলারের বিনিময় হার বেঁধে দেওয়া হলে সেই বিনিময় হার কম হওয়ায় ২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে বৈধ উপায়ে বৈদেশিক মুদ্রা কম এসেছে। হুন্ডি ও অবৈধ পথে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানোর প্রবণতা বেশি দেখা গেছে। সরকার রেমিট্যান্স প্রদানকারীদের যে প্রণোদনা দিয়েছিল সেটিও খুব বেশি কাজে দেয়নি। দেশে প্রথম দশ মাসে ১৯.১১ বিলিয়ন ডলার এসেছে।

বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুসারে বাংলাদেশ এই অর্থবছরেও ২৩ বিলিয়ন ডলার পাবে। যা রিজার্ভ বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট নয়। এমন মুহূর্তে আইএমএফ ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছে এবং সরকার ডলারের দামও বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে দেশে হুন্ডি ও অবৈধ পথে টাকা পাঠানো বন্ধ হলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। এছাড়াও চলমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও গত বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বৈদেশিক বিনিয়োগ কম হয়েছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগ ১৬ শতাংশ কমেছে। তা বাড়ার তেমন কোন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।

এছাড়াও দেশে কর ছাড়ের প্রবণতার কারণে পোশাক শিল্প ছাড়া আর তেমন রপ্তানিমুখী শিল্প গড়ে উঠেনি। ফলে রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্যের অভাবেও দেশের রিজার্ভ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এছাড়া আইএমএফ তার ঋণের কিস্তির পরিমাণ দ্বিগুণ করা ও প্রয়োজনীয় রিজার্ভ ২০.১০ বিলিয়ন থেকে ১৪.৭৬ বিলিয়ন ডলার করা ইঙ্গিত দেয় যে খুব সহসা এই বৈদেশিক মুদ্রার সংকট হবে। এই সমস্যা সমাধানে একটি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

আবার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি তুলে নেওয়া হয়েছে একবছর আগে। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তেতে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন বছরে চার বার আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করে সেই দাম নির্ধারণ করার কথা বলেছে আইএমএফ। এছাড়াও ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে শিল্প উৎপাদন হুমকির মধ্যে পড়েছে। মফস্বল ও গ্রামে নিয়মিত লোডশেডিংয়ের কারণে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। এই সমস্যার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ জ্বালানি সংকটকে দায়ী করছে। রিজার্ভ সংকটের কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণ জ্বালানি আমদানি করা যাচ্ছে না। এই জ্বালানি তেলের সংকট সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আকুর বিল পরিশোধের পর দেশের রিজার্ভ আরও কমবে। 

সরকার রাজস্ব বাড়ানোর জন্য কর বৃদ্ধি ও কর আরোপের মত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যার ফলে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেয়েছে বটে। তবে এতে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ আর থাকছে না। দেশে বিনিয়োগ হ্রাসের কারণে কর্মসংস্থান কম হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে বেকারত্বের পরিমাণ ৩.৫১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দেশের চলমান জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ আদায় নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এছাড়াও দেশের খেলাপি ঋণ আদায়ে তেমন কোন উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। দুই শতাংশ ডাউন-পেমেন্টে ঋণ পুনঃতফসিল করার মাধ্যমে ঋণখেলাপিদের যে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে তাতে দেশের ব্যাংকিং খাত আরও বেশি বিপন্ন হবে বলে ধারনা করা যাচ্ছে। তথাপি ঋণ আদায় হলে দেশের মুদ্রাস্ফীতি পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণে আসবে। এতে করে আইএমএফের ঋণ শর্তাবলি পূরণ করাও যেমন সহজ হবে তেমনই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের উপর চাপও প্রশমিত হবে।

দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সরকারকে আইএমএফের সকল শর্ত পূরণ করতে হবে। এই সকল শর্তের চাপ থেকে নিম্ন আয়ের মানুষকে মুক্ত রাখতে সরকারকে উচ্চশ্রেণি ও ব্যবসায়ী মহলের প্রতি কঠোর হতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য অবৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স আসা বন্ধ করা, বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও ভবিষ্যতে রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। এছাড়াও মুদ্রা পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তাহলে এই অর্থনৈতিক সংকট থেকে দেশ মুক্তি লাভ করতে পারবে।

লেখক: ইরাজ নূর চৌধুরী, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

;

এত ক্ষত প্রকৃতি সহ্য করবে কেন?



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রার প্রখরতা বাড়ছে। এবছর বাংলাদেশজুড়ে দুঃসহ তাপপ্রবাহ বিরাজ করায় এর প্রভাব পড়েছে অনেক গুণ বেশি। ইতোপূর্বে বাংলাদেশে এপ্রিল মাসে প্রকৃতির এত বৈরী আচরণ আর কখনও চোখে পড়েনি বলে অনেক বয়স্ক ব্যক্তিরা অভিমত পোষণ করেছেন। গরমের কারণে এবছর প্রথম হিট এলার্ট জারি করার পর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে স্কুল, কলেজ মাদ্রাসা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোথাও সীমিত আকারে ক্লাস নেয়া ও ঢাবি, জাবি-তে অনলাইনে পাঠদানের আদেশ জারি করা হয়েছে। ছয়দিন পর দ্বিতীয়বার পুনরায় হিট এলার্ট জারি হয়েছে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে দেশের নানা স্থানে হিট স্ট্রোকে গৃহবধূ, কৃষক, প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক, ব্যবসায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ট্রাফিক পুলিশ, বৃদ্ধসহ ষোল জনের প্রাণহানির খবর পওয়া গেছে।

এ অসহনীয় তাপমাত্রায় শিশুদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে ইউনিসেফ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ইউনিসেফ বলেছে, ‘বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ‘অতি উচ্চ ঝুঁকিতে’ রয়েছে শিশুরা। অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি শিশুদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে। বিশেষ করে নবজাতক, সদ্যোজাত ও অল্পবয়সী শিশুদের জন্য। হিট স্ট্রোক ও পানি শূন্যজনিত ডায়রিয়ার মতো, উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাবে সৃষ্ট অসুস্থতায় এই বয়সী শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে।’

শিশু ও বয়স্করা সূর্যের অতি তাপজনিত কারণে বেশি বেশি আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভিড় করছে। বড় বড় শহরের অভিজাত এলাকায় বিদ্দ্যুৎ সরবরাহ অনেকটা স্বাভাবিক থাকলেও বস্তি ও গ্রামের মানুষ বিদ্দ্যুৎহীনতায় হাঁসফাস করছেন। অতি খরার কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২৫-৩৮ ফুট নিচে নেমে যাওয়ায় কৃষি জমিতে সেচের পাম্পে পনি উঠছে না। গৃহস্থলির কাজে নিত্য ব্যবহার্য্য হস্তচালিত নলকূপে পানি না উঠায় সেগুলো বন্ধ হয়ে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়ে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও বরেন্দ্র এলাকার অনেক জায়গায়। গড়াই, তিস্তা প্রভৃতি নদীতে প্রয়োজনীয় পানিপ্রবাহ না থাকায় ডালিয়া, জিকে ইত্যাদি সেচপ্রকল্পে বোরো ধানের জমিতে সেচ দেয়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। ঝিনাইদহে পাম্প ও প্রকল্পের ক্যানেলে পানি না থাকায় সেচকাজ বন্ধ রয়েছে। শহর এলাকার অগভীর নলকূপে পানি উঠানো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বহুতল ভবনের ছাদের মধ্যে শখের ছাদবাগান বাঁচানো নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন অনেক সৌখিন ছাদবাগানী।

অনেক জেলায় বোরোধান, ভুট্টা, আখ, শাক-সবজির ক্ষেত মরে যাচ্ছে। বৃষ্টির অভাবে মাটিতে রস না থাকায় কাউন ও পাটের চারা গজাচ্ছে না। সূর্যের মাত্রাতিরিক্ত তাপে নতুন বোরা ধানের শীষ বেরানোর পর চিটা হয়ে যাচ্ছে।

আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম চাষিদের এবার মাথায় হাত পড়েছে। ব্যাপক হারে আমের মুকুল বের হলেও ফেব্রুয়ারিতে একদিনের টানা বৃষ্টির পর প্রায় এক সপ্তাহ যাবৎ চরম ভ্যাপসা গরমে ৯০ ভাগ আম ও ৭০ ভাগ লিচুর মুকুল ঝরে গছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রুয়েট ক্যাম্পাস ও আশেপাশের এলাকার হাজার হাজার আমগাছের ৯৯ ভাগ আম ঝড়ে গেছে। সেগুলোতে তাকালে শুধু মুকুলের শুকনো খালি ডান্ডাটি চোখে পড়ছে! ক্যাম্পাসে বসবাসরত শিক্ষার্থীরা এবার টিফিনের সময় ঘটা করে আম পেড়ে খেতে পারবে না বলে হতাশা প্রকাশ করছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্যান্য এলাকায় এরপরও যা কিছু অবশিষ্ট ছিল সেগুলো বৈশাখের অতিরিক্ত তাপমাত্রায় ক্রমাগত ঝরে পড়ছে। তাই এ বছর ফলন বিপর্যয়ে আমচাষি ও আমবাগান লিজ নেয়া ব্যবসায়ীরা দিশেহারা, তাদের গভীর দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে।

আম ছাড়াও সব ধরনের কৃষি উৎপাদনে প্রায় সারা দেশে বিপর্যয় নেমে এসেছে। এবারের গ্রীষ্মকালীন ফল-ফসলের ফলন বিপর্যয়ে খাদ্য ও নিত্যপণ্যের আরো একধাপ মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশাচালকসহ সব খেটে খওয়া মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে গেছে বহুগুণ।

গরমে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের পিচ গলে গাড়ি চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। মহাসড়কের বিভিন্ন জায়গা ও রাজধানীর রাজপথে কার্পেটিং গলে উঁচু-নিচু হয়ে গাড়ির চাকায় তরল বিটুমিন আটকানোর সংবাদ হয়েছে। কর্মচঞ্চল দিন কর্মস্থবির হয়েছে।

এমনকি দিনের বেলা সূর্যের খরতাপে হিটস্ট্রোকের ভয়ে মাঠের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক জায়গায় পাকা দান রক্ষার জন্য কৃষররা রাতের বেলা চাঁদের আলোয় ধান কাটার কাজ করছেন। যা অনেকটাই অস্বাভাবিক। গরমের কারণে রাতের বেলাতেও মানুষ রাস্তায় হাঁটতে বের হতে সাহস করছেন না।

এবছর প্রকৃতির এমন বৈরী আচরণকে কেউ স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না। তবুও নিরুপায় হয়ে প্রকৃতির এই চরম সিদ্ধান্তকে মানতে মানুষ বাধ্য হচ্ছে।

এরপরও আবহাওয়া অফিস থেকে এখনও বৃষ্টি হবার কোন সুখবর নেই। এরই মাঝে দেশের বিভিন্ন জেলার খরাক্রান্ত মানুষ বৃষ্টির জন্য মহান আল্লাহর দরবারে ইসতিসকার নামাজ আদায় করে বৃষ্টিভিক্ষা করে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন। এটাতো গেল আমাদের দেশের বৃষ্টিহীন পরিস্থিতির কথা।

এর মাঝে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে হঠাৎ করে মরুর দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানে অতিবৃষ্টিপাতের ফলে ফ্লাশ-ফ্লাড ঘটেছে। মরুভূমিতে অবস্থিত উভয় দেশে শতাধিক প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কথা জেনে কেমন জানি অদ্ভুত এক সময়ের কথা মনে হচ্ছে। প্রাচীনকালে পৃথিবীতে মহান আল্লাহর অবাধ্য ও পাপিষ্ঠ জনবসতিতে অতিখরা ও অতিবৃষ্টি বা মহাপ্লাবনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রাকৃতিক শাস্তি নাজিল হবার ঘটনা আমরা জানি। দেশে দেশে কিছু ধর্মপ্রাণ মানুষ সে ব্যাপারে সব সময় সতর্কতা অবলম্বন করে থাকে। এর পরেও কিছু মানুষ বিভিন্ন কারণে সেসব বাণী ভুলে গিয়ে চরম অবাধ্য ও বেপরোয়া জীবন যাপন করে। বিশেষ করে মানুষ আল্লাহ নির্দেশিত সীমা লঙ্ঘণ করে প্রকৃতির ওপর যখন অযাচিতভাবে নিষ্ঠুর হস্তক্ষেপ চালায় প্রকৃতিও তখন মানুষের উপর নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করতে দেরি করে না।

তাই সৌদি আরব, ওমান বা মরুর দেশের বিলাসী শহর দুবাইয়ে বন্যা, হিমালয়ের পাদদেশে সিকিমে ফ্লাশফ্লাড, রাশিয়া, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, জাপান প্রভৃতিতে হঠাৎ বন্যা, সুনামী ইত্যাদি একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কথা হলো, দেশে দেশে এসব দুর্যোগ কেন এত ঘন ঘন দেখা দিচ্ছে? বাংলাদেশে নাতিশীতষ্ণোমন্ডলে অবস্থিত হবার ফলে কেন এত বেশি তাপমাত্রাবৃদ্ধি সমস্যায় পড়ছে? কেন এমন দুর্যোগ হচ্ছে? জলবায়ুর অভিঘাত কেন এত ভয়ংকর রুপে আবির্ভূত হয়ে মানুষের জানমাল কেড়ে নিতে উদ্যত হচ্ছে?

এসব প্রশ্নে উত্তর মানুষের কাছে জানা। তদুপরি মানুষ আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে প্রকৃতি বিনাশে অতি তৎপর। বানাচ্ছে কংক্রীটের পাহাড়, বাড়ছে এসি, ফ্রীজের ব্যাপকতা। গাছ উজাড়, ঘাস নেই, জলাধার ভরাট, সূর্যের তাপে ধ্বংস হচ্ছে মাঠের ফসল, মাছ, পোল্ট্রি। নষ্ট হচ্ছে প্রকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যতা।

বাংলাদেশের প্রবল খরতাপে হিট এলার্ট জারিকৃত সময়ের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ন্যাম এক্সপো নামক জলবায়ু সম্মেলণ। চারদিনব্যাপী এই সম্মেলণে ১০৪টি দেশের গবেষক ও প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে প্রকৃতির খেয়ালী আচরণের প্রেক্ষিতে ধ্বংসলীলা সামলানোর জন্য নানা ইতিবাচক সুপারিশ প্রদান করে গেছেন। বাংলাদেশ দাবী করেছে যে, পৃথিবীতে কার্বণ নি:সরণের ১০০ ভাগের মধ্যে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ০.৩৮ শতাংশ। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে এই ক্ষুদ্র দেশটি। এর জন্য দায়ী কে বা কারা?

বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়িয়ে তোলার জন্য দায়ী দেশগুলো গাড়ি, এসি, ফ্রীজ, ভারী যন্ত্রাংশ, মারণাস্ত্র ও বিষাক্ত কেমিক্যাল তৈরী ও সেগুলোর জমজমাট ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব মানবতা বিধ্বংসী মারণাস্ত্র বিক্রির আয়ের উপর তাদের অর্থনীতি মজবুত হয়ে টিকে থাকার প্রয়াস পায়। মারণাস্ত্র বিক্রির আয় কমে গেলে তারা সেগুলোর বিক্রি বাড়ানোর জন্য দেশে দেশে যুদ্ধ লাগিয়ে দেবার পায়ঁতারা করে। সেখানে তারা সাফল্য লাভ করে বীরদর্পে টিকে থাকে। তারাই আবার দরিদ্র বিশ্বকে জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষা করার প্রেসক্রিপশন বাতলানোর জন্য সেমিনার ও কনফারেন্স আয়োজনের জন্য সহায়তা করে।

এসব ঘৃণ্য কৃতকর্ম ও নীতির বৈপরিত্যের মাঝে বিস্তর শুণ্যতা অবলোকন করে প্রকৃতি মুচকি মুচকি হাসছে। আর বার বার ঘটানো এসব জঘণ্য কার্যকলাপ সহ্য করতে না পেরে প্রকৃতি নিজেই প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হয়েছে।

কারণ, মানুষের এতসব অন্যায় প্রকৃতি আর কত সহ্য করবে? মুহর্মূহ: প্রকৃতির ওপর হস্তক্ষেপ, নির্বিচারে প্রকৃতির সাজানো অবয়ব ও কাঠামোর বিনাশ সাধন প্রকৃতি বার বার সহ্য করবে কেন?

মানুষের কারণে মানুষ প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণহীন করে মানুষের জানমালের ক্ষতির ভয়ে লাল সংকেত স্বরূপ হিট এলার্ট জারি করছে। প্রাণভয়ে মানুষ প্রকৃতির স্মরণাপন্ন হয়ে আঁকুতি জানিয়ে হাজারো উন্মুক্ত মাঠে ইস্তিসকার নামাজ পড়ে কান্নাকাটি করে বুক ভাসাচ্ছে। কিন্তু তওবা করেও ফিবছর আবারো প্রকৃতি বিনাশে তৎপর হয়ে উঠছে কেন? আসলে মানুষ সৃষ্টিকর্তার কাছে বড়ই অকৃতজ্ঞ। যেমন অকৃতজ্ঞ বিভিন্ন আর্থ-সামজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, মানসিক প্রতিজ্ঞার প্রতিপালনের বেলায়। এজন্য প্রকৃতি হঠাৎ করে বড় রুষ্ট হয়ে উঠে।

প্রতিদিন কত বাঁধ বা ড্যামে কত ট্রিলিয়ন কিউসেক পানি প্রকৃতির বুকে চেপে আটকানো হচ্ছে? মহাসাগরের বুকে কত কোটি টন ক্ষতিকর বর্জ্য ডাম্পিং করা হচ্ছে? ভূপৃষ্ঠের আকাশে বাতাসে কত লক্ষ লক্ষ টন বিষাক্ত বোমা ফাটানো হচ্ছে, কত শব্দ কত ঝলকানি দিয়ে নীরবতা ভেঙ্গে প্রৃকতির নিয়মের উপর বাহাদুরি করা হচ্ছে- অকৃতজ্ঞ মানুষ কি সেগুলোর হিসেব মাথায় রাখতে পেরেছে? প্রৃকতির উপর এত আঘাত, এত নিষ্ঠুর পরীক্ষা, এত ব্যবচ্ছেদ, এত ক্ষত নির্বাক প্রকৃতি সেটা বারংবার সহ্য করবে কেন? তাই হিট এলার্টের কবলে এবার আমাদের চিরসবুজ বদ্বীপ বাংলাদেশ!

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

;

‘মা লো মা’ বিতর্ক এবং সমাধানের পথ



কাজী বনফুল
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সম্প্রতি, কোক স্টুডিও বাংলা থেকে প্রচারিত হয়েছে ‘মা লো মা’ গানটি। গানটি প্রচারের পর পর থেকেই এর প্রকৃত স্বত্ব নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্কের ঝড়। কোক স্টুডিওতে গানটি পরিবেশনের সময় বাউল সাধক খালেক দেওয়ানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এই গান প্রকাশ এবং নাম উল্লেখ করার পর থেকেই বাউল সাধক রশিদ উদ্দিনের অনুসারীরা দাবি করছেন, গানটি রশিদ উদ্দিনের রচিত।

এখন কথা হচ্ছে, ‘মা লো মা’ গানটির একটি ভার্সন আমি প্রয়াত খালেক দেওয়ানের নিজের মুখের শুনেছি। সেখানে তিনি এই গানকে নিজের লেখা গান বলে উচ্চারণ করেছেন। বাউল সাধক রশিদ উদ্দিনের লেখা গানটিও শুনেছি। গান দুটির কথার মধ্যে সম্পূর্ণ মিল নেই। দুটির মধ্যে কিছুটি ভিন্নতা দৃশ্যমান।

এখনো আমাদের দেশে কয়েক প্রজন্মের মানুষ আছেন, যারা জ্ঞানী- গুণী, সাধক শ্রেণি। তাদের থেকে শুরু করে অনেক প্রবীণ ও বিজ্ঞজনদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন যে গানটি লিখেছেন এবং বাউল সাধক খালেক দেওয়ান যে গানটি লিখেছেন, দুটি গানের কথায় বেশ ভিন্নতা রয়েছে। গানের ভেতর অনেক কথা ও ভাষারও ভিন্নতা রয়েছে।

তারা বলছেন, তৎকালীন সময়ে ‘মা লো মা ঝি লো ঝি’ বা ‘মাগো মা ঝিগো ঝি’ এগুলো প্রচলিত বাগধারা বা শ্লোকের মতো ছিল। অনেকেই এই শ্লোক ব্যবহার করে গান লিখতেন, কবিতা লিখতেন। সেক্ষেত্রে ‘মা লো মা’ বা ‘মাগো মা’ থাকলেই সে গান শুধুমাত্র একজনেরই, এটা দাবি করার কোনো সুযোগ নেই।

বাউল সাধক খালেক দেওয়ান নিজের প্রকাশিত যে গীতবিতান রয়েছে, সেখানেও তাঁর এই গানটি রয়েছে। তাঁর সমসাময়িক অনেক প্রবীণ ব্যক্তি জানিয়েছেন, গানটি তাঁর নিজের লেখা এবং তিনি এটি অনেকবার অনেক স্থানে গেয়েছেন বলে ব্যক্ত করেছেন। আবার অনেক প্রাজ্ঞজন বলেছেন, এই গানটির বাউল সাধক রশিদ উদ্দিনের রচিত একটি ভার্সনও রয়েছে, যেখানে ভাষাগত কিছু ভিন্নতা রয়েছে। রশিদ উদ্দিনের গানটি মূলত ‘মাগো মা ঝি গো ঝি’ কিন্তু খুবই সাদৃশ্যপূর্ণ!

আবার অনেক গবেষক বলছেন যে, সংগীতের ক্ষেত্রেও অনেক কাকতালীয় বিষয় থাকে। সেক্ষেত্রে এখানেও হয়ত এই গান রচনার ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটেছে বা ঘটে থাকতে পারে। যেমন- একজনের ভাবের সঙ্গে আরেকজনের ভাব মিলে যেতে পারে বা কারো গানের কথার সঙ্গে আরেকজনের কথাও মিলে যেতে পারে কাকতালীয়ভাবেই, যেটা আমাদের সম্পূর্ণভাবে বিচার করার সুযোগ নেই।

এবার মূল কথায় আসা যাক। গানটি নিয়ে যে দুজন রচয়িতা সম্পর্কে যে বিতর্ক হচ্ছে, তাঁরা দুজনই এখন প্রয়াত। তাঁরা দুজনই ছিলেন বাউল সাধক। এখন তাঁরা আর কেউ এই পৃথিবীতে বেঁচে নেই। তৎকালীন সময়ে এই সাধক ও সংগীত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গুরুভিত্তিক চর্চার ব্যবস্থা ছিল। সেখানে একে অপরের সঙ্গে দেখা হতো। কথা হতো। বিভিন্ন অঞ্চলের গান ও সুর নিয়ে একে অপরের সঙ্গে বাক্য ও ভাব বিনিময় হতো। তৎকালীন সময়ে একজন সাধক বা বাউল আরেকজনের সঙ্গে মিলেমিশে গান রচনা করতেন।

একজন আরেকজনের সঙ্গে আত্মিক মিলনে আবদ্ধ থাকতেন। তাঁরা নিজেদের অভিন্ন সত্তা বলে মনে করতেন। বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন এবং বাউল সাধক খালেক দেওয়ান দুজনই ২০ বছরের ছোট বড়। তাঁদের ভেতরে যে সম্পর্কের গভীরতা হৃদয়ের তলদেশকে স্পর্শ করেনি, সেটা আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না! কিন্তু একটু অনুধাবন করতে পারি, যেহেতু তাঁরা দুজনই বাউল সাধক, সেহেতু তাঁদের ভেতর একটি আত্মিক বন্ধন ছিল, এটা অনিবার্য হয়ত!

তাঁরা বেঁচে থাকলে হয়ত এই বিষয় নিয়ে কোনো বিতর্কই হতো না। কারণ, তাঁরা এই জাগতিক নাম ও নিজস্বতার অনেক ঊর্ধ্বের মানুষ। তাঁদের মধ্যে হয়ত ভিন্ন শরীরে অভিন্ন আত্মার যোগসূত্র ছিল। যেহেতু, তাঁরা দুজনই শ্রদ্ধেয় এবং দুজনই প্রয়াত, তাঁদের কারো সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলার আর কোনো সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে এটা আমরা অনুমান করে নিতে পারি যে, এক্ষেত্রেও কাকতালীয়ভাবে এমনটাই ঘটেছে হয়ত।

খালেক দেওয়ান এবং রশিদ উদ্দিন সাহেব দুজনই আমাদের বাংলার সুফি জগতের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তাঁদের কাছ থেকে আমরা অনেক অনেক মূল্যবান সংগীত ও জ্ঞানের আলোর সন্ধান পেয়েছি। তাঁরা দুজনই আবহমান বাংলার আকাশে আলোর প্রদীপ স্বরূপ!

কোনো বিষয় নিয়ে বিতর্ক করলে সারাদিনই করা যায়। কিন্তু বিতর্কের সমাধানের পথের সন্ধান বেশি জরুরি। কারণ, অযথা ও অযাচিত বিতর্কে সমাজ পিছিয়ে যায়। আমরা সংগীত ও সংস্কৃতিতে এমনিতেই দিনে দিনে পিছিয়ে যাচ্ছি। তার ভেতর যদি নিজেদের আত্মিক বন্ধনের জায়গায় এমন ফাটল বা বিচ্ছেদের সূত্রপাত হয়, তাহলে আমরা ডুবে যাবো খুব দ্রুতই।

আমি কোক স্টুডিও’র গানটি শুনে দেখলাম, কোক স্টুডিও খালেক দেওয়ানের ভার্সনটিই করেছে। এখানে কণ্ঠ দিয়েছেন একজন আরিফ দেওয়ান এবং অন্যজন শরফুউদ্দিন দেওয়ান ওরফে সাগর দেওয়ান। গানটির সার্বিক কম্পোজ করেছেন প্রীতম হাসান।

আমাদের এই প্রযুক্তির নতুনত্বের ভিড়ে ধীরে ধীরে আমরা হারিয়ে ফেলছি, আমাদের ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত সব বিষয়, আঞ্চলিক বিষয়। আমাদের সেই আব্বাস উদ্দিন, বিজয় সরকার, জসিমউদ্দীন, খালেক দেওয়ান, রশিদ উদ্দিন, উকিল মুন্সি, যারা হচ্ছেন, বাংলার গানের ভুবনের প্রাণ ভ্রমর অথচ তাদের গান এখন আর কেউ শোনে না, গায়ও না। কারো মুখে এখন আর এই সব গান শোনা যায় না।

যখন কোনো বিষয়ের অনুশীলন বন্ধ হয়ে যাবে, তখন সে বিষয়টিও আমাদের থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে অগ্রসর হবে। তাই, অবশ্যই আমাদের সবাইকে সম্মিলিতভাবে কোক স্টুডিও’র এই প্রচেষ্টার সঙ্গে সহমত সমেত মানসিক সহযোগিতা প্রদান করতে হবে, যাতে গানগুলো আবার নতুন করে প্রাণ ফিরে পাওয়ার সুযোগ পায়।

এক্ষেত্রে কোক স্টুডিও এবং প্রীতম হাসান একটি অনন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তারা সম্মিলিতভাবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী ও আঞ্চলিক গানগুলোকে নতুন করে মানুষের মুখে মুখে রটানোর ব্যবস্থা করেছেন।

আমাদের যে নতুন প্রজন্ম, তারা মূলত আমাদের জারি, সারি, বিচ্ছেদ, ভাটিয়ালি, এসব গানের সঙ্গে খুব একটা পরিচিত নন। আমাদের এই নতুন প্রজন্মকে ওই সব গান ও গানের রচয়িতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটাকে আমি সম্মানের সঙ্গে স্বাগত জানাই।

এখন তরুণদের মুখে মুখে বেজে উঠেছে, ‘মা লো মা’ গানটি। তারা গাইছেন। তারা বুঝতে পারছেন, তাদেরও এমন সংগীতের গুরুত্বপূর্ণ ভাণ্ডার রয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রীতম হাসান অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

‘মা লো মা’ গানটির ভেতর সাগর দেওয়ান নামে প্রয়াত খালেক দেওয়ানের বর্তমান প্রজন্মের একজন কণ্ঠ দিয়েছেন। সাগর দেওয়ানের কণ্ঠ গানটিকে একটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তার কণ্ঠে সুরের যে মনিহারখচিত হীরা বসানো রয়েছে, সেটা ওই গানের ভেতর দিয়ে তার কণ্ঠের মুগ্ধতায় ছুঁয়ে গেছে ভক্তদের হৃদয়। সাগর দেওয়ানের কণ্ঠের নাগপাশে আবদ্ধ হয়েছেন সব সংগীত অনুরাগীরা।

কোক স্টুডিও এই যে, একটি ধারার প্রচলন করেছে, তারা নতুন ও প্রতিভাবান শিল্পীদের খুঁজে খুঁজে বের করে তাদের নিয়ে কাজ করা, এটি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। এর আগেও আমরা ‘দেওরা’ গানে ইসমাইল উদ্দিনসহ আরো অনেক নিভৃত প্রতিভাকে নিয়ে কোক স্টুডিওকে কাজ করতে দেখেছি, যা অবশ্যই কষ্টসাধ্য অনুসন্ধানের ফলেই সম্ভব হয়েছে।

পৃথিবীতে আর যত আনন্দ ও মুগ্ধতার বিষয় রয়েছে, তার মধ্যে সংগীত সর্বশেষ্ঠ। সংগীত সম্পর্কে জার্মান কবি ও দার্শনিক ফেডরিক নীৎসে বলেছেন, ‘আমি যখন নিজেকে হারিয়ে ফেলি তখন আমি গুন গুন করে গান গাই। গানের মধ্যে ডুবে গিয়ে আমি আবার নিজেকে খুঁজে পাই’!

গান সম্পর্কে সাধক রামপ্রসাদ বলেছেন, ‘গান হচ্ছে, এমন সুবাস, যা আমাদের সকল প্রাণকে এক অদৃশ্য সুতোয় বেঁধে রাখে। গান আমাদের সকল প্রাণের অনুভূতির একত্রিত জাগরণ’!

সর্বোপরি, আমাদের অঞ্চলে কোক স্টুডিও বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী সংগীত ও সংস্কৃতিকে নতুনভাবে টেনে তোলার জন্য যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে, তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।

আমরা যে তর্কে জড়িয়ে পড়েছি, এই তর্কের আসলে প্রকৃত ও নির্দিষ্ট কোনো সমাধান নেই। আমাদের দুই বাউল সাধক পরিবারের উভয়েরই উভয়ের প্রতি সহমর্মিতা সমেত বিষয়টি গ্রহণ করতে হবে। কারণ, কপিরাইট অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রশিদ উদ্দিনের ‘মাগো মা’ কিংবা খালেক দেওয়ানের ‘মালো মা’—কোনো গানই কপিরাইট অফিসে নিবন্ধন করা নেই। ফলে, গানটির মূল স্রষ্টা কে, তা কপিরাইট অফিস সঠিকভাবে বলতে পারছে না।

আবার লোকসংস্কৃতি–গবেষক সাইমন জাকারিয়া বলেন, ‘বাংলা লোকসংগীতের অনেক গান খুবই সমস্যাপূর্ণ। এসব নিয়ে আলাপ করতে গেলে এই নিয়ে অনেক বিতর্ক হবে’।

তাহলে এই যখন অবস্থা, সেক্ষেত্রে আমাদের সহমর্মিতা সমেত বিষয়টিকে গ্রহণ ছাড়া এই বিতর্ক বা দ্বন্দ্বের কোনো সঠিক সমাধানের পথ নেই। এক্ষেত্রে দুপক্ষেরই উচিত হবে, বিষয়টিকে সহজভাবে গ্রহণ করে এই অযাচিত, অনির্দিষ্ট এবং সমাধানহীন তর্কের অবসান ঘটিয়ে সহজভাবে গ্রহণ করে একে অপরের সহযোগী হিসেবে কাজ করা। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একত্রে সংগীতের এই পুনরুদ্ধারের কাজে সবাই মিলে একে অপরকে সহযোগিতা করে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী গানের ভুবনকে উজ্জীবিত করবো বলে আশা করি!

কাজী বনফুল: লেখক ও কলামিস্ট

;

সামাজিক যোগাযোগে প্রযুক্তির প্রভাব



মো. বজলুর রশিদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আধুনিক যুগে প্রযুক্তি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা তার ব্যতিক্রম নয়। ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোনের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে, মানুষ একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করার, সংযোগ স্থাপন করার এবং তথ্য শেয়ার করার নতুন নতুন উপায় খুঁজে পেয়েছে।

প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী মানুষের সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে এবং সহজেই যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব করে তুলেছে। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আমরা বন্ধু, পরিবার এবং পরিচিতদের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারি। এছাড়াও, নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হওয়া এবং নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলা সহজতর হয়েছে।

প্রযুক্তি আমাদের জ্ঞান ও তথ্য দ্রুত এবং সহজেই শেয়ার করার সুযোগ করে দিয়েছে। সংবাদ, নিবন্ধ, গবেষণাপত্র, শিক্ষামূলক উপকরণ সহজেই অনলাইনে পাওয়া যায়। এছাড়াও, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে আমরা নিজেদের মতামত, ধারণা এবং অভিজ্ঞতা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারি।

প্রযুক্তি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার এবং সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে মানুষ বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে এবং তাদের উত্থাপন করতে পারে। প্রযুক্তি আমাদের বিনোদনের জন্য নতুন নতুন মাধ্যম সরবরাহ করেছে। অনলাইন গেমস, ভিডিও, সঙ্গীত, ই-বই ইত্যাদি আমাদের অবসর সময়কে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

প্রযুক্তি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বিপ্লব এনেছে। অনলাইন শপিং, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, ফ্রিল্যান্সিং ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষ সহজেই তাদের পণ্য ও সেবা বাজারে তুলে ধরতে পারে।

প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার মানুষকে বাস্তব জগতের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করার ফলে মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের ক্ষতি হতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারের সঙ্গে বিষণ্ণতা, উদ্বেগ এবং নিম্ন আত্মসম্মানের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। অন্যদের সঙ্গে তুলনা করা, নেতিবাচক মন্তব্য এবং অনলাইন হয়রানির মুখোমুখি হওয়ার ফলে মানসিক চাপ বৃদ্ধি পেতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া খবর এবং ভুল তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি জনমতকে প্রভাবিত করতে এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। ব্যক্তিগত তথ্য অনলাইনে শেয়ার করার ফলে গোপনীয়তা লঙ্ঘনের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। হ্যাকিং, ডেটা লিক এবং সাইবার অপরাধের মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হতে পারে।

অনলাইনে হয়রানি ও হুমকির শিকার হওয়ার ফলে মানসিক ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব বেশি হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে অসুস্থ আসক্তি দেখা দিতে পারে। এটি ব্যক্তির ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

প্রযুক্তির প্রভাব, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে, ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই রয়েছে। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সুবিধা লাভের জন্য এবং এর সম্ভাব্য ক্ষতির ঝুঁকি কমানোর জন্য আমাদের সচেতনভাবে এবং দায়িত্বশীলভাবে এটি ব্যবহার করা উচিত। আমাদের সময় ব্যবস্থাপনা, গোপনীয়তা সেটিংস এবং অনলাইন আচরণ সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত। এছাড়াও, আমাদের সন্তানদের ইন্টারনেটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে আরও সহজ ও সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে। তবে, আমাদের সচেতন থাকতে হবে যে প্রযুক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত, আমাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত নয়।

মো. বজলুর রশিদ: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

 

;