আমরা শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল চেয়েছিলাম!



প্রভাষ আমিন
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। তিনি আমাদের দাবি মেনে নিয়েছেন, প্রজ্ঞাপন হয়ে গেছে। এখন আর ১ম ও ২য় শ্রেণির চাকরিতে কোটা থাকবে না। সমাজের অনগ্রসর জনগোষ্ঠী অনগ্রসর চাকরি করবে। আর আমরা অগ্রসর অংশ মেধার লড়াই করে চাকরির ক্রিম খাবো। অনগ্রসর বা মুক্তিযোদ্ধার সেন্টিমেন্ট ব্যবহার করে চাকরি পাওয়ার দিন শেষ, বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ।

আমরা কিন্তু খুব কৌশলে সরকারকে ঘোল খাইয়েছি। মেধাবী তারুণ্যকে বোঝাতে পেরেছি, তোমাদের চাকরি পাওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরসুরীরা। স্বাধীনতার পর থেকেই সরকারি চাকরিতে কোটা ছিল। কিন্তু আমরা কৌশলে এমনভাবে আন্দোলন করেছি, যেন বর্তমান সরকারই কোটা চালু করে মেধাবী তারুণ্যের চাকরির পথ আটকে রেখেছে। এমনকি আমরা কৌশলে ছাত্রলীগের ছেলেদেরকেও রাজপথে নামিয়ে দিয়েছি।

২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে ব্যাপক জাগরণ ঘটেছিল। এর বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষেও একটা গণজাগরণ দরকার ছিল। তো স্বাধীন বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে বলতে বাধো বাধো ঠেকে, চক্ষুলজ্জায় আটকায়। তাই তরুণ প্রজন্মের বেকারত্বের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে তাদের মাঠে নামিয়ে দিলাম। ব্যস আমাদের কাজ অর্ধেক হয়ে গেল। তরুণ প্রজন্ম স্বাধীন বাংলাদেশের রাজপথে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে তালে তালে স্লোগান দিচ্ছে, এর চেয়ে বড় বিজয় আর কী হতে পারে আমাদের।

২০১৩ সালে কোটা আন্দোলনে সফল হতে না পারলেও গণজাগরণ মঞ্চ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে যে গণজোয়ার সৃষ্টি করতে পেরেছিল, আমরা কোটা আন্দোলন দিয়ে তা স্তিমিত করতে পেরেছি। যে শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে স্লোগান উঠেছে, সেই শাহবাগেই মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠেছে; এও তো আমাদের কম বড় বিজয় নয়।

২০১৩ সালে সফল না হলেও আমরা হাল ছাড়িনি। আমরা জানি নির্বাচনের আগে আগে ঠিকমত চাপ দিতে পারলে যে কোনো দাবি আদায় করা সম্ভব। তাই মাঝখানে ৫ বছর চুপ থেকে আমরা আবার মাঠে নেমেছি ঠিক নির্বাচনের আগে। তবে পুলিশ ভাইদের ধন্যবাদ। তারা হামলা চালিয়ে আমাদের কাজটা সহজ করে দেয়। ছাত্রীরা নেমে আসে রাস্তায়। ভিসির বাসায় চলে নারকীয় তান্ডব। সব মিলিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস আমাদের দখলে চলে আসে। শুধু ছবি দেখলে যে কেউ ভাববে বিপ্লব বুঝি হয়েই গেছে। বিশেষ করে 'পেছনে টিয়ার গ্যাসের ধোয়ায় অন্ধকারে সাথীদের রেখে একটি ছেলে পুলিশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, হাতে জাতীয় পতাকা' এমন একটি অসাধারণ ছবি তো ফেসবুকে গণ কাভার ফটো হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, কিন্তু তাদের হাতেই আবার তুলে দিলাম জাতীয় পতাকা। হা হা হা। একেই বলে বিষে বিষক্ষয়। আবার অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী বক্তৃতার আংশিক প্রচার করে তরুণ প্রজন্মকে ক্ষেপিয়ে তুলতে একটুও সময় লাগেনি। যে তরুণের বুকভরা দেশের জন্য ভালোবাসা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দারুণ কৌতুহল; তার বুকেই আমরা বুনে দিয়েছি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ঘৃণা। তারা এখন বুকে 'আমি রাজাকার' লিখে রাস্তায় দাড়ায়। এটা যে কত বড় বিজয়, বোঝাতে পারবো না।

আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, হুমায়ুন আহমেদ তার এক নাটকে পাখির মুখে 'তুই রাজাকার' স্লোগান বসিয়ে দিয়ে দেশজুড়ে রাজাকারের বিরুদ্ধে ঘৃণার প্লাবন বইয়ে দিয়েছিলেন। লেখক-সাহিত্যিকরা যেখানে ভালোবাসা ছড়ায়, সেখানে হুমায়ুন আহমেদ ছড়ালেন ঘৃণ।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি তুলে ঘৃণা ছড়ালেন জাহানারা ইমাম। আর সত্যি সত্যি ইসলামী চিন্তাবিদদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে সেই ঘৃনাকে স্থায়ী রূপ দিলেন শেখ হাসিনা। আচ্ছা বলুন, স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর এসে ভালোবাসা না ছড়িয়ে ঘৃণা ছড়ানোর কোনো মানে হয়? রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে জাতিকে যারা বিভক্ত করে, তারা দেশের উন্নয়ন চায় না। আমরা চাই, সবাই মিলেশিলে থাকবে, যে মেধাবী সে চাকরি পাবে; কার বাবা রাজাকার ছিল, এটা বিবেচনা করে যেন কাউকে বঞ্চিত করা না হয়। কার দাদা মুক্তিযোদ্ধা ছিল, সেটাও যেন বিবেচনা করা না হয়। এটাই আমাদের দাবি।

হুমায়ুন আহমেদের তুই রাজাকার, জাহানারা ইমামের গণআদালত আর শেখ হাসিনার ট্রাইব্যুনাল- মিলে যে ধারাবাহিক পরাজয়ের ইতিহাস; তার বিপরীতে বুকে 'আমি রাজাকার' লিখে রাজপথে কাউকে দাড় করাতে পারা যে কত বড় বিজয়, আসলেই বলে বোঝানো যাবে না।

৩০ বছর ধরে 'তুই রাজাকার' স্লোগান বুকে যে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছিল, 'আমি রাজাকার' তা সরিয়ে দিল। আহা কী যে প্রশান্তি! এক আন্দোলনের কত যে বিজয়। তুই রাজাকার সমান সমান আমি রাজাকার। গণজাগরণ মঞ্চ সমান সমান কোটা সংস্কার আন্দোলন। বাহ, সব সমান সমান। দারুণ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড।

শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু কন্যা। তাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার আবেগ একটু বেশি। তিনি মুক্তিযোদ্ধা কোটার পক্ষে একাধিকবার বলেছেন। কিন্তু আমরা পরিস্থিতি এমন জায়গায় নিয়ে গেলাম প্রধানমন্ত্রী রাগ করে কোটা বাতিল করে দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখের কথা শেষ পর্যন্ত প্রজ্ঞাপন আকারে নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের কলিজা ঠান্ডা হয়নি। আসলে আমাদের কলিজা কখনোই ঠান্ডা হবে না।

এখন আমরা বলছি, আমরা কোটা বাতিল চাইনি, সংস্কার চেয়েছি। হুম, সংস্কার চেয়েছি বটে। তবে আমাদের সংস্কার বাস্তবায়ন করা পৃথিবীর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের চাওয়ার আগেই সরকার সবচেয়ে বড় যৌক্তিক সংস্কারটা করে রেখেছিল- কোটায় লোক পাওয়া না গেলে পদ শূন্য না রেখে সাধারণ তালিকা থেকে তা পূরণ করা হবে। এবার এটি অর্ডার হয়েছে বটে, তবে গত তিনবছর ধরেই বিশেষ আদেশে এটি কার্যকর হচ্ছিল। আর তাতে ৫৫ ভাগ কোটা ৩০ ভাগে নেমে এসেছিল। তাতে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারতাম। কিন্তু সন্তুষ্ট হওয়া আমাদের লক্ষ্য নয়। আমরা চির অসন্তুষ্ট। কলিজা কেটে দিলেও আমাদের কলিজা ঠান্ডা হবে না।

আমাদের দাবি ছিল, কোটা ৫৫ ভাগ থেকে ১০ ভাগে নামিয়ে আনা। হা হা হা ১০ ভাগ কোটায় ৫ জনগোষ্ঠিকে ধারণ করা যে বানরের পিঠা ভাগের মতই অসম্ভব, সেটা যে কোনো বোকাও বুঝবে। কিন্তু মেধা যার, চাকরি তার; এই চটুল স্লোগান দিয়ে জাতিকে এমন ঘুম পাড়িয়েছি; তারা কিছুতেই বুঝতে পারছেন না আমাদের দুরভিসন্ধি। জেনেবুঝেই কোটা ১০ ভাগে নামিয়ে অসম্ভব দাবিটা আমরা দিনের পর দিন করে আসছি।

আসলে আমাদের মুখের দাবি আর মনের দাবি যে এক নয়, সেটা কেউ কেউ টের পেয়ে যান। সরকার কোটা বাতিল করে খুব অন্যায় করেছে। আমাদের তো দয়ার শরীর। আমরা সরকারের মত অবুঝ নই। আমরা প্রতিবন্ধী কোটা চাই, আদিবাসী কোটা চাই, নারী কোটাও চাই। আমাদের আপত্তি খালি মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। মুক্তিযুদ্ধের নাম শুনলেই আমাদের গায়ে জ্বালা ধরে যায়। স্বাধীনতার ৪৭ বছর আবার কিসের মুক্তিযোদ্ধা আর অমুক্তিযোদ্ধা। ২% পরিবারের জন্য ৩০% কোটা মহা অন্যায়। আপনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেন, সাহায্য দেন; তাদের পরিবারের কাউকে চাকরি দিয়েন না। তাদের চাকরি দিলে তো প্রশাসনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক বেড়ে যাবে। ৪৭ বছর আগে কি গন্ডগোল হয়েছিল, তা নিয়ে ভাবার টাইম আমাদের নাই। আমরা মেধাবী, সারাদিন পড়ি। আদর্শ-ফাদর্শ নিয়ে ভাবা, রাস্তায় মিছিল করা মানে সময় নষ্ট। পরীক্ষায় আমি ফার্স্ট। দেশ এখন কোটামুক্ত। আমার চাকরি ঠেকায় কে? যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি ঠেকাতে পারিনি, কিন্তু তরুণ প্রজন্মকে ভুল বুঝিয়ে তাদের মাথায় বন্দুক রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের কিন্তু ঠেকিয়ে দিয়েছি। হা হা হা। চিয়ার্স।

আসলে সত্যি কথা বলি, পুরো কোটা বাতিল করার দরকার ছিল না, খালি মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করলেই আমরা সন্তুষ্ট হতাম। মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাদ দিলে কোটা নেমে আসতো ২৫ ভাগে। তাতে আমাদের আপত্তি নেই। তখন চাইলে দয়া করে মুক্তিযোদ্ধাদের ২ ভাগ কোটা দিয়েও দিতে পারতাম। মুক্তিযোদ্ধারা মর্যাদায় সবার ওপরে থাকবে, এটাই আমাদের জ্বালা।

আমরা চাই তারা আমাদের করুণায় থাকুক। দেখেন না, এমন প্যাচ খেলেছি, মুক্তিযোদ্ধারা ফেসবুকে, আলোচনায় রীতিমত মাফ চাইছে, বাবারা আমরা দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি, চাকরির জন্য নয়। কোটা আমরা চাই না। তবুও তোমরা আমাদের আর অপমান করো না, গালাগাল করো না। মুক্তিযোদ্ধাদের এই করুণ দশা দেখতে আমাদের খুব ভালো লাগে। এটা আসলে এক ধরনের প্রতিশোধ।

এখন আরো মজা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের কেউ কেউ কোটা বহালের দাবিতে শাহবাগে রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন করেছে। কিন্তু বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধার কাছে কোটাকে আমরা অবমাননা হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছি। তাই তারা বা তাদের উত্তরসুরীরা সে আন্দোলনে যায়নি। অল্পকিছু নাছোরবান্দা সেখানে অবস্থান নিয়েছে। তাতে পুরো বিষয়টিকে হাস্যকর করে তোলা গেছে। কয়েকদিন রাস্তা বন্ধ রাখতে পারলে সাধারণ মানুষও তাদের অপছন্দ করবে। আহা, এক আন্দোলনে কত মাত্রিক বিজয় যে আসছে একের পর এক। দেখানো যাচ্ছে, দেশে মুক্তিযোদ্ধা কোটার পক্ষের লোক ২০ থেকে ২০০। আর কোটার বিপক্ষের লোক হাজার হাজার, লাখ লাখ।

আদিবাসী, নারী আর প্রতিবন্ধীদের জন্য একটু খারাপ লাগছে বটে, তবে মুক্তিযোদ্ধাদের ঠেকানো গেছে; এই অর্জনের তুলনায় সেই খারাপ লাগাটা কিছুই না। আমরা এখন মন দিয়ে পড়বো। কোটামুক্ত বিসিএসে পরীক্ষা দিয়ে ডিসি হবো, এসপি হবো, সচিব হবো। সারাজীবন ঘুষ খাবো। রিটায়ারমেন্টে গিয়ে ঘুষের টাকায় এমপি হবো, মন্ত্রী হবো। তবে আমরা আর দেশকে বিভক্তির পথে চলতে দিবো না। কে রাজাকার, কে মুক্তিযোদ্ধা; কে স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি, কে বিপক্ষ- ৪৭ বছর পর এসব বিতর্ক তুলে উন্নয়নের গতিকে মন্থর হতে দেবো না। একাত্তরে আমাদের বাপ-দাদারা যা পারেনি, আমরা তাদের সেই অসমাপ্ত স্বপ্ন শেষ করবো। তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ আমরা নেবোই নেবো।

জয়বাংলা। এই স্লোগানটা বলতে একটু অস্বস্তি লাগে বটে। কিন্তু যদ্দেশে যদাচার। আর কাটা তুলতে হয় কাটা দিয়েই।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।

   

জাতীয় বাজেট ২০২৪-২৫: কতখানি ঢেলে সাজানো হলো?



মাইশা মালিহা
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, ক্রমবর্ধমান ব্যাংকঋণের সুদের হারসহ প্রভৃতি চ্যালেঞ্জকে সাথে নিয়ে আগামী ৬ জুন পেশ হতে যাচ্ছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট। ইতোমধ্যে বাজেটের সারসংক্ষেপ অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বিপরীতে ৫ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে। ঘাটতি আড়াই লাখ কোটি টাকার সিংহভাগ পূরণ হবে বিদেশি ঋণে, বাকিটা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা থাকবে অভ্যন্তরীণ ঋণ ও ব্যাংকঋণে।

এবারের বাজেট নির্ধারণে অর্থ মন্ত্রণালয় বেশ হিসেবি থাকার চেষ্টা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সাবেক অর্থমন্ত্রীর ব্যর্থতার ফলাফল প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি, ভঙ্গুর ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে শুরু করে মন্থর সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের দায়, ক্রমহ্রাসমান জিডিপি প্রবৃদ্ধি। চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করতে  নির্বাচন-পরবর্তী নতুন অর্থমন্ত্রী ও অর্থ প্রতিমন্ত্রীর ওপর চাপটা যেন তাই স্বাভাবিকভাবেই বেশি।

আসন্ন বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৬.৭৫ শতাংশ। যেখানে চলতি বছরের বাজেটে তা ছিল ৭.৫০ শতাংশ। আদতেই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবতার ছাপ পাওয়া যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে হলেও অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। কারণ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে বিনিয়োগ। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই আশানুরূপ হচ্ছে না নানা কারণে। দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ডলার সংকট, জ্বালানি সংকট, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মতো নানাবিধ সমস্যাকে এর কারণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। বিদ্যমান মূল্যস্ফীতিও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করছে।

মূল্যস্ফীতি ঠেকেছে ১০ শতাংশের কোঠায়। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট বর্তমান বাজার কাঠামোকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। জনগণের মৌলিক সেবা নিশ্চিত হওয়াই এখন হুমকির মুখে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের লাগামছাড়া মূল্য বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষের জীবনে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে ছাড়িয়েছে ১০ শতাংশ। তাই এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির সাথে যেমন জনগণ পেরে উঠছে না, তেমনি এই চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হবে আগামী বছরের বাজেট প্রণেতাদেরকে।

মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা বৈশ্বিক কারণে বিভিন্ন দেশে, এমনকি ইউরোপ আমেরিকাতেও ৮-৯ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি দেখা গেছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে সাথে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক উন্নয়নশীল দেশও সংকটের মুখে পড়েছিল। অন্যান্য দেশ এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পেলেও বাংলাদেশ তা পারেনি নানা দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কারণে। সেই সাথে টাকা ছাপানোর মতো সিদ্ধান্ত মড়ার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে এসেছে।

বর্তমানে ডলারের বিপরীতে টাকার বড় রকমের অবমূল্যায়ন মূল্যস্ফীতিতে বড় রকম অবদান রাখছে। তাই উপায় এখন ডলার সরবরাহের সুযোগ বৃদ্ধি। প্রয়োজন প্রবাস আয় বৃদ্ধি ও হুন্ডির পথ পরিহার করে সঠিক নিয়মে তা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে প্রেরণ। দেশের রপ্তানি পণ্যের যথাযথ ভর্তুকির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করলে তা ডলার সরবরাহে ভূমিকা রাখতে পারে।

এই বাজেটে প্রণেতারা অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে দুটি উপায় মেনে চলবেন বলে জানিয়েছেন। এক, দেশের সবচেয়ে বড় আয়ের খাত রাজস্ব কর বাড়বে; দুই, সরকার ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করবে। রাজস্ব বাড়াতে হলে অবশ্যই একটি দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আদায় করা সম্ভব নয় এমন রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলে তা হিতে বিপরীতই হবে। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আয় আদায় করতে হলে করের হার না বাড়িয়ে করযোগ্য মানুষের কাছ থেকে সঠিক ও যথাযথ হারে কর আদায় করা গেলে সার্বিকভাবে চাপ কমবে জনগণের ওপর, এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

মাইশা মালিহা, ৩য় বর্ষ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

;

ঢাবি ভিসির গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রয়াস ও বিসিএস বিতর্ক



মিজানুর রহমান
ঢাবি ভিসির গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রয়াস ও বিসিএস বিতর্ক

ঢাবি ভিসির গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার প্রয়াস ও বিসিএস বিতর্ক

  • Font increase
  • Font Decrease

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও আবাসিক হলে ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণরা প্রবেশ করতে পারবেন না- বর্তমান উপাচার্যের এমন একটি বক্তব্যকে ঘিরে আলোচনা-সমালোচনা এখন তুঙ্গে।

ঢাবি শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমভিত্তিক গ্রুপ তথা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই বক্তব্য নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক চলছে। এর মধ্যে কিছু কথা উপাচার্যের মুখে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে- যা আদতে তিনি বলেনই নি। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এই সে সব কথা। অনেক বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী মূল বিষয়টি না যাচাই করেই মন্তব্য করছেন। কেউ কেউ অতীতের উপাচার্যদের বক্তব্যকে উদাহরণ হিসেবে টেনে এনে কটাক্ষ করছেন। একজন লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তার অবস্থান জানান দিতে মাঝে মধ্যে কিছু উদ্ভট কথা বলেন।’

গত ১০ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ‘নবীনবরণ ও অগ্রায়ন’ অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালের এক বক্তব্যের সূত্র ধরেই মূলত এই আলোচনা। সেখানে উপাচার্যের বক্তব্য উদ্ভট কিনা সে সম্পর্কে মতামত দেওয়ার আগে তিনি কী বলেছিলেন সেটা একবার জেনে নেওয়া যাক।

ওই অনুষ্ঠানে উপাচার্য বলেন, "আগামী বছর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ঢোকার জন্য নির্ধারিত আইডি কার্ড পাঞ্চ করে ঢুকতে হবে। যদি কেউ মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্র থাকে, কেউ যদি বহিরাগত থাকে, তারা হলে ঢুকতে পারবে না। আগামী এক মাসের ভিতরে লাইব্রেরিতে কার্ড পাঞ্চ করে ঢুকতে হবে। এছাড়া ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণদের যারা সেখানে (লাইব্রেরি) গিয়ে বিসিএস'র বই পড়ে আগামী মাস থেকে তাদের সেখানে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। কথাগুলো বলার কারণ হলো আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ট্রান্সফরমেশনের (রূপান্তর) কথা ভাবছি। আমাদের শিক্ষার্থীদেরও ভাবতে হবে তাদের ট্রান্সফরমেশনের কথা।"

বর্তমান উপাচার্য দায়িত্বগ্রহণের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি গবেষণাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে কিছু পদক্ষেপের কথা বলে আসছেন। তার এই বক্তব্য সেই প্রচেষ্টারই ধারাবাহিকতা তা বলাই বাহুল্য।

ওই আলোচনায় তিনি শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস, যারা গবেষণা করবে শুধু তাদেরকেই মাস্টার্সে ভর্তির সুযোগ দেওয়া এবং উন্নত বিশ্বের মতো বিদেশি তত্ত্বাবধায়কের অধীনে ফান্ডেড পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করার কথাও বলেন। গ্রন্থাগারে বিসিএসের বই পড়তে দেওয়া হবে না এমন কথা তিনি বলেননি। অথচ সামাজিক মধ্যমে এমন একটি কথাই বেশি ছড়িয়েছে এবং এই বিষয়টি নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছে।

ঢাবির কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে প্রায় ছয় লাখ বই ও সাময়িকী রয়েছে। সমৃদ্ধ এই গ্রন্থাগারে বর্তমান শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার সুযোগ পান না বলা চলে। কারণ অধিকাংশ আসন ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণ চাকরিপ্রত্যাশীদের দখলে থাকে। ফলে উপাচার্য যদি শুধু বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রবেশের উদ্যোগটি নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই লাভবান হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নত হবে।

আমি নিজের কথাই বলতে পারি। আমার মাস্টার্স শেষের দিকে। ফলে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে আমি নিজেও ঝামেলায় পড়ব। কিন্তু তারপরেও বলছি, গ্রাজুয়েশন শেষেও কেন বিশ্ববিদ্যালয় আমার দায়িত্ব নেবে? সেক্ষেত্রে উপাচার্যের কথাটি নিঃসন্দেহে যৌক্তিক।

অনেক শিক্ষার্থী কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে সরকারি চাকরিকেন্দ্রিক পড়াশোনা শুরু করে স্নাতকোত্তর শেষ হওয়ার পরে। কারণ ঢাবিতে সাধারণত চাকরি না হওয়া পর্যন্ত ফ্রিতে থাকা যায়। তাই অনেকে হলে রুম দখল করে দীর্ঘদিন ধরে থাকেন। ছাত্ররাজনীতিতে যারা জড়িত তাদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত অনুসন্ধানে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ৬০ জন শীর্ষ নেতা এক দশক ধরে হলে রয়েছেন।

হল নিয়ে যে পরিকল্পনার কথা উপাচার্য বলেছেন, সেটা একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতি এবং সদিচ্ছা থাকলেই কেবল বাস্তবায়ন সম্ভব। কারণ, হলে ছাত্রত্বের মেয়াদোত্তীর্ণদের অবস্থান করতে না দিলে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের অবস্থান দুর্বল হয়ে যাবে। তখন ক্যাম্পাসে অন্য সংগঠনের প্রভাব বাড়বে। ঢাবিতে অন্য সংগঠনের প্রভাব বাড়লে সেটা জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে, সেটা অতীত ইতিহাস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যদি সেটা প্রশাসন দিয়ে সামলাতে চান তাহলেই ঢাবি শতভাগ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হবে। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা প্রথম বর্ষেই বৈধ সিট পাবে। তাতে একজন শিক্ষার্থীর স্বপ্ন গণরুমে পচে যাবে না। হলের গণরুমে রাত কাটানোর বিনিময়ে জোরপূর্বক রাজনৈতিক প্রোগ্রামে অংশ নেওয়া লাগবে না। একজন শিক্ষার্থী নিজেকে পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ পাবে।

অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, পড়াশোনা শেষ হলেও চাকরি না পাওয়া এতগুলো বেকার শিক্ষার্থী কোথায় যাবে? সেটি একটি প্রশ্ন বটে। যার সমাধান খুঁজতে হবে। কিন্তু সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কী করণীয়? বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ ছাত্রদের দায়িত্ব নেওয়া। একজন শিক্ষার্থীর স্নাতকোত্তর শেষেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন দায়িত্ব নেবে?

আমি মনে করি একজন মেয়াদউত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নেওয়ার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত ক্যাম্পাসে  প্রথম পা দেওয়া একজন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নেওয়া। সে সময় শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি নাজুক অবস্থায় থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাশাগুলো যখন পূরণ হয়না তখন তারা আরও নাজুক আরও ভঙুর অবস্থায় পড়েন। একজন নবীন শিক্ষার্থীকে আবাসিক সুবিধা দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক দায়িত্ব। অথচ দেখা যায়  এই শিক্ষার্থীরা পাঁচজনের রুমে ২৫ জন, আর মেয়াদোত্তীর্ণ অছাত্ররা রুম দখল করে আরাম-আয়েশে কাটাচ্ছেন।

অতএব, উপাচার্য যদি তার ইচ্ছাকে শুধু বক্তব্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবায়ন করতে পারেন, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থীদের তথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ও সার্বিকভাবে দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলময় হবে।

লেখক: মিজানুর রহমান, সাংবাদিক, ঢাবি শিক্ষার্থী

;

ফারাক্কা লংমার্চের প্রয়োজন আজও ফুরায়নি



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৬ মে, ১৯৭৬। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত একটি দিন। আজ থেকে প্রায় ৪৯ বছর আগে ফারাক্কা অভিমুখে দীর্ঘ পদযাত্রার দিনটি প্রতিবছর মে মাস এলেই বেশি করে সবার নজরে আসে। সারাদেশে এবছর বৈরী তাপপ্রবাহ চলতে থাকায় প্রতিটি জীব-প্রাণের মধ্যে ত্রাহি অনুভব শুরু হয়েছে।

শহুরে বিত্তশালী মানুষ শীতাতপ যন্ত্রের ঘেরে বসে কিছুটা স্বস্তি খুঁজে পাওয়ার চেষ্ট করছে। কিন্তু শহুরে খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ এবং সারা দেশের গ্রামাঞ্চলের রৌদ্রজলা মানুষেরা এবছর বেশি নাকাল হয়ে পড়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কৃষকদের আবাদি জমিতে সেচের পানির আকাল। যারা নদীমাতৃক বাংলাদেশে অভিন্ন নদীর পানি সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের কল্যাণের জন্যই আন্দোলনে নেমেছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি।

মাওলানা ভাসানি কোনো রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন না। তিনি ছিলেন খেটে খাওয়া মানুষের কণ্ঠস্বর, একজন মজলুম জননেতা। তার নেতৃত্বেই সংগঠিত হয়েছিল পদ্মা নদীর পানি সুবিধা থেকে বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে ঐতিহাসিক পদযাত্রা যেটি ‘ফারাক্কা লংমার্চ’ নামে পরিচিত।

বাংলাদেশের মানুষ বহুযুগ আগে থেকে ভারতের পানি আগ্রাসনের শিকার। ভারত আন্তর্জাতিক গঙ্গা নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে উজান-ভাঁটি দুই দেশের মানুষের চরম ক্ষতি সাধন করে চলেছে। তবে এজন্য ভাটির দেশ বাংলাদেশ বেশি হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে।

ফারাক্কায় বাঁধ নির্মাণের শুরু থেকে মাওলানা ভাসানি এর প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৫২ সালে ভারত ফারাক্কায় বাঁ নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে তৎপরতা শুরু হলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এর প্রতিবাদ করে। তখন ভারত বলেছিল এটা অনুসন্ধান পর্যায়ে আছে। এ নিয়ে ১৯৬০ সালে এ বিষয়ে ভারত পাকিস্তান বৈঠক হয়। তবে ১৯৬১-৬২ সালে ভারত গোপনে বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু করে। এ কাজে সহায়তাকারী দেশ সোভিয়েত রাশিয়া এবং খরচ ধরা হয় এক বিলিয়ন ডলার। ফিডার খাল খননের কাজ ব্যতিরেকে ১৯৭০ সালে ফারাক্কা ব্যারেজের নির্মাণ কাজ শেষ করে ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলাকে সংযুক্ত করা ২,২৪০ মিটার দীর্ঘ ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মিত হয়ে চালু হওয়ার অপেক্ষায় থাকে।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর ভারত ফারাক্কার সংযোগ খালের কাজ দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করে। ১৯৭৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা ব্যারেজ চালু করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর নানা কৌশলে ২১ এপ্রিল থেকে ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা ব্যারেজ চালু করা হয়। যেটি আর বন্ধ হয়নি, আজ প্রায় ৪৮ বছর পেরিয়ে গেলেও সেটা পরীক্ষামূলকভাবে চালুই রয়ে গেছে।

মাওলানা ভাসানি ফারাক্কা ব্যারেজ চালু হওয়ার পর থেকে পদ্মায় একতরফা পানি প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন।

বাংলাদেশের কৃষি, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ সবকিছুর উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঠেকানোর জন্য ছিল তার এই আন্দোলন। ভারত প্রতিবছর ফারাক্কা ব্যারেজ দিয়ে বর্ষার অতিরিক্ত পানি আটকাতে না পেরে সব গেইট খুলে দিলে বাংলাদেশের জীবন রেখা পদ্মা নদীতে বর্ষায় ভয়াল রূপ, বন্যা ও নদীভাঙ্গন দেখা দেয়। খরায় গেট বন্ধ করে সামান্য জলধারা ছেড়ে দিলেও শীর্ণ-শুষ্ক নদীর কারণে জীবিকা হারানো দরিদ্র মানুষের দু:খ-দুর্দশা মাওলানা ভাসানির হৃদয়ে দোলা দিতে শুরু করে।

এমতাবস্থায় ১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল মাওলানা ভাসানি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি পত্র লিখেন। তিনি ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে ‘ফারাক্কা লংমার্চ’ কর্মসূচির বিষয়ে অবহিত করেন। সেই চিঠির উত্তরে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, “এটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, যিনি আমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও আত্মত্যাগের বেদনাকে একইভাবে সহমর্মিতা দিয়ে দেখেছেন, তিনি আমাদেরকে এত বেশি ভুল বুঝেছেন এমনকি আমাদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।” (বিবিসি বাংলা নিউজ মে ১৭, ২০১৫)।

এ বিষয়ে মাওলানা ভাসানির প্রত্যুত্তর ছিল, “আপনার ৪ মের পত্র ফারাক্কার উপর সরকারি ভাষ্যেরই পুনরাবৃত্তি। সুবিখ্যাত পূর্বপুরুষ মতিলাল নেহেরুর দৌহিত্রী ও পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর কন্যার কাছ থেকে এরূপ প্রত্যাশা ছিল না।”... “বাংলাদেশের উত্তরের জেলাগুলো সফর করে প্রকৃত চিত্রের প্রতিফলন দেখতে অনুরোধ জানাচ্ছি... সমস্যার ব্যাপকভিত্তিক সমাধান প্রয়োজন। এটি শুধু মৌসুমের দুমাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সারা বছরব্যাপী প্রবাহের যথাযথ বন্টনভিত্তিক হওয়া উচিত।”

এভাবে সময় গড়িয়ে গেলেও প্রকৃত সমস্যা আড়ালে থেকে যায়। যার প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে। মাওলানা ভাসানির দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনার জন্ম দেয় এই লংমার্চ।

এই লংমার্চ কর্মসূচির রুট ছিল পদ্মাতীরের বিভাগীয় নগর রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে ১৬ মে সকাল ১০টায় দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করে প্রেমতলী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পেরিয়ে কানসাট সীমান্ত দিয়ে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা ব্যারেজ এলাকার পয়েন্টে গিয়ে সমাপ্তি হওয়া। রাজশাহীর মাদরাসা ময়দানে বিশাল জনসভায় বক্তব্য দিয়ে তিনি এই যাত্রা শুরু করেন।

এসময় ৯০ বছর বয়সী বর্ষীয়ান নেতা মাওলানা ভাসানি বেশ অসুস্থ ছিলেন। তবুও তিনি দু’জন লোকের কাঁধে ভর দিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বজ্র-কঠোর ভাষায় বক্তব্য দিয়েছিলেন। এটাকে লংমার্চে অংশগ্রহণকারীরা আশ্চর্য ঘটনা মনে করেন।

মাওলানা ভাসানির বক্তব্য ছিল, “শিশুর যেমন মায়ের দুধে অধিকার, পানির উপর তোমাদের তেমনি অধিকার। তোমরা জাগ্রত হও, তোমাদের প্রকৃতি প্রদত্ত অধিকার যে হরণ করেছে, তার বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াও।” তিনি মানুষের এই প্রাকৃতিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করাটাকে অত্যন্ত অন্যায় ও জুলুম হিসেবে অভিহিত করেছিলেন এবং “আকাশের দিকে হাত তুলে বলেছিলেন, আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদের বাঁচার পথ করে দিবেন।”

বৃদ্ধ বয়সে অনেক কষ্ট স্বীকার করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে সাথে নিয়ে এই দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করেন। লংমার্চকারীদের সাথে নিয়ে তিনি ভারতের অভ্যন্তরে ফারাক্কা পয়েন্টে যাবার ঘোষণা দিলেও সীমান্ত অতিক্রম করার পূর্বে সরকারি পরামর্শে কানসাট স্থলবন্দরে উপনীত হয়ে লংমার্চ সমাপ্ত ঘোষণা করেন।

এর প্রায় কুড়ি বছর পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচ.ডি দেবগৌড়ার মধ্যে ত্রিশ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তি সম্পন্ন হয়। যেটা অদ্যাবধি বলবৎ রয়েছে। তরে গঙ্গা চুক্তির ২৭ বছর পেরিয়ে গেলেও কি পেয়েছে বাংলাদেশ, তা নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। একদিকে ফারাক্কা ব্যারেজের আয়ু ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সাথে গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ শেষের দিকে। এই চুক্তির নবায়ন কীভাবে করা হবে তা নিয়ে এখনও কিছু জানা যায়নি।

মেয়াদ উত্তীর্ণ ফারাক্কা ব্যারেজ যেহেতু উজান-ভাঁটি দু’দেশেরই ক্ষতির কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, সেক্ষেত্রে এটাকে ভেঙ্গে ফেলা হবে কি-না তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নানা জল্পনা-কল্পনা শোনা যাচ্ছে। ফারাক্কার কারণে এর উজানে ভারতের মাটিতে জলাবদ্ধতা, ভূমিধস, বন্যা, নদীভাঙ্গন ইত্যাদি ঘটনা সংবাদের শিরোনাম হতে দেখা যায়। ফারাক্কায় যে কোনো বড় দুর্যোগের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন সেখানকার অধিবাসীরা।

অন্যদিকে ফারাক্কায় একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে যে চুক্তি হয়েছে সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি না পাওয়ায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলার মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দিনাতিপাত করছেন। বাংলাদেশে পদ্মা নদীতে বর্ষায় অকাল বন্যা হলেও শীতের আগেই শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে পড়ে পদ্মা। এককালের প্রমত্তা পদ্মানদী যেখানে বড় বড় স্টিমারে চড়ে ঢাকা-কোলকাতা আসা যাওয়া চলতো এখন সেখানে নৌকা চালানোই দায় হয়ে পড়েছে।

পানির অভাবে নৌপথ বন্ধের সাথে পদ্মায় ইলিশ মাছসহ সাধারণ সব মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। এছাড়া নদীকেন্দ্রিক পেশা বন্ধ হয়ে জেলে, মাঝিমাল্লা, নৌশ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছে। পদ্মার শাখা ও উপনদীগুলো শুকিয়ে মরে গেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতার চরণ ‘পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি’- এখন পদ্মা ও তার শাখানদীগুলোর জন্য চরম সত্যবাক্যে রূপ নিয়েছে।

ফারাক্কা ব্যারেজের বিরূপ প্রভাবের ফলে বাংলাদেশে সার্বিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি, যা বিভিন্ন সেমিনার-কনফারেন্সে উপস্থাপিত গবেষণা রিপোর্ট থেকে প্রায়শই দেশে-বিদেশের সংবাদ মাধ্যমে শিরোনাম হতে দেখা যায়। ফারাক্কা সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে বহু গবেষক পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে নানা সুপারিশ প্রদান করলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সেগুলোকে পাত্তা দেয় না। গবেষণার সেসব ফলাফল নিয়ে তাদের কোনো বিকার কোনো কালেই লক্ষ্য করা যায় না।

এমনিকি তিস্তা নদীর পানিবণ্টন সমস্যা নিয়ে শত শত মিটিং-সেনিার, চুক্তি হওয়ার পরও অদ্যাবধি ঝুলে আছে। আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে ভারতের আন্তরিকতার অভাব ও একাই খাব নীতির কাছে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বঞ্চিত মানুষ যুগ যুগ ধরে শুধু আর্তনাদ করেই চলেছে। এমনকি বাংলাদেশের যথেষ্ট প্রচেষ্টার ফলেও নানা ভূ-রাজনৈতিক হিসেবের গড়মিলে বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।

আন্তরিকতার ঘাটতি, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, চুক্তি নিয়ে দোদুল্যমানতা ও বার বার প্রতারণার শিকার হয়ে বাংলাদেশ অনেকটা অসহায়ভাবে অভ্যন্তরীণ প্রচেষ্টায় পানি সমস্যার মোকাবেলা করে চলেছে। তবে নদীর পানি ভাগাভাগির বর্তমান বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করে একথা কারো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ফারাক্কা লংমার্চের প্রয়োজন এখন শেষ হয়েছে। বরং মাওলানা ভাসানির সেই ফারাক্কা লংমার্চের বজ্র-কঠিন ভাষণের দৃঢ়তা আজও ফুরায়নি।

আজও হারিয়ে যায়নি বাংলাদেশের চলার পথ, এগিয়ে যাবার দৃঢ় প্রত্যয়। নানা কূটকৌশল ও প্রতারণায় অনেক বঞ্চিত হয়েও মাওলানা ভাসানির মতো নৈতিক শক্তিমান অগ্রজদের দূরদৃষ্টি, দোয়া ও অনুপ্রেরণায় চারদিকের শত বাঁধা পেরিয়ে সামনের দিকে বহুদূর এগিয়ে যাবে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ- সবার সামনে নিকট ভবিষ্যতে।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।

;

রাজনীতির বিভক্তি: মার্কিন সম্পর্ক মূল্যায়নে যে তাগিদ বিশ্লেষকদের



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

দু’দিনের সফরে মঙ্গলবার ঢাকা এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। গেল ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ফের ক্ষমতায় আসার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী আইলিন লাউবাখেরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলের সফরের পর ডোনাল্ড লু’র এই সফর দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। মি. লু’র এই সফরকে ঘিরে ইতিমধ্যেই পরস্পরবিরোধী বাক্যবাণ ছোঁড়াছুড়ি শুরু করেছেন দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামীলীগ ও বিএনপি’র নেতারা।

তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তির নিরিখে ডোনাল্ড লু’র এই সফরকে মূল্যায়ন করা উচিত হবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারও যুক্তরাষ্ট্র। তাই বাংলাদেশকে বিদ্যমান এই সম্পর্ককে ইতিবাচকভাবে আরও সম্প্রসারণের দিকেই জোর দেওয়া উচিত।

সাবেক পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, শিক্ষাবিদ ও কুটনীতিক অ্যাম্বাসেডর ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী ডোনাল্ড লু’র এই সফর নিয়ে বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘নতুন সরকার আসার পর ডোনাল্ড লু’র এটি অফিসিয়াল লেভেল রুটিন ভিজিট। আমার মনে হয় নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার অংশই এই সফর। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই অর্থে যে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম কোন মার্কিন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার এই সফরটা হচ্ছে।’

‘তিনি কি বলবেন এই সফরের পর হয়ত জানা যাবে, তাই পূর্বমূল্যায়ন না করেও দৃশ্যত যেটি বোঝা যাচ্ছে, মি. লু’র এই সফর বাংলাদেশকে নতুন করে স্টাডির অংশ। তারা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নেই কাজ করবে। আশা করব, দুই দেশই সম্পর্ক ইতিবাচকভাবে আরও সম্প্রসারণের দিকে জোর দেবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তির নিরিখে একে মূল্যায়ন করা উচিত হবে না’-যোগ করেন সাবেক এই পেশাদার কুটনতিক।

বৈশ্বিক সম্পর্ক নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের আরও পরিণত চর্চার তাগিদ দিয়ে একুশে পদকজয়ী বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ আবুল মোমেন বলেন, ‘নানা বিষয়ে মতামত-মন্তব্য করাটাই রাজনীতিবিদদের কাজ। এখানে কেউ পরিপক্কভাবে দিতে পারে, কেউ পারেন না। আমেরিকা যেহেতু বেশকিছু আন্তর্জাতিক সংস্থারও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, বাংলাদেশও সেইসব সংস্থার থেকে সাহায্য নিচ্ছে; তাই সচরাচর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের চেয়েও বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক অনেক বর্ধিত, এটা স্বীকার করতেই হবে। রাজনীতিবিদদের সামগ্রিক পরিস্থিতি ও প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে তাদের রাজনৈতিক চর্চা করা উচিত।’

এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘একধরণের দৃশ্যমান এজন্ডা তো তাদের (যুক্তরাষ্ট্রের) আছেই, যেমন-গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন ইত্যাদি। এসব বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করাটাও তাদের রীতি। আবার সম্পর্কটাকে চালিয়ে নেওয়াও তাদের বৈশিষ্ট্য। ডোনাল্ড লু এসেছেন হয়ত সেই চাপকে অব্যাহত রাখতেই। তার মানে এই নয় যে-বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের যে চলমান সম্পর্ক সেখানে তাত কোন প্রভাব পড়বে।’

আবুল মোমেন বলেন, ‘ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে যেটি দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে দুটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র ভারত ও চীনের সঙ্গে একইসঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্কে রয়েছে। আমেরিকাও তৃতীয় আরেকটি শক্তি-সেই দিক থেকে এটা ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য এক ধরণের সুবিধাও বটে।’

‘বাংলাদেশের তো এখন উপায় নেই-সবার সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই চলতে হবে। বাংলাদেশ যদি মালদ্বীপের মত ক্ষুদ্র দেশ হতো তাহলে হয়ত চীনের সঙ্গে সম্পর্কে ঢুকে গিয়ে চলার কথা ভাবতে পারতো। কিন্তু বাংলাদেশ জনসংখ্যার দিক দিয়ে বড় দেশ। রাজনৈতিক আকাঙ্খাও বহুমুখি। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে মালদ্বীপের মত স্ট্যান্ড নেওয়া সম্ভব নয়’-বলেন প্রভাবশালী এই কলামিস্ট ও বিশ্লেষক।

উল্লেখ্য, ডোনাল্ড লু সফরকালে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। এ ছাড়া বৈঠক করবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গেও। সফরকালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও মতবিনিময়ের কথা রয়েছে তাঁর।

;