পাশের বাড়ির মমতাময়ী বড় বোন



প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন

প্রভাষ আমিন

  • Font increase
  • Font Decrease

শেখ হাসিনা আমার প্রিয় চরিত্র। তাঁকে নিয়ে কিছু লিখতে আমার একই সঙ্গে প্রচণ্ড আগ্রহ এবং তীব্র অনীহা রয়েছে। শেখ হাসিনা একজন মানবিক মানুষ, ভালো-মন্দ মিলিয়েই মানুষ। তাই তাঁকে ভালো যেমন বাসি, তেমনি কিছু সমালোচনাও আছে। আমি জানি, খোলা মনে সমালোচনা গ্রহণ করার ঔদার্য্য শেখ হাসিনার আছে। সমালোচনা গ্রহণ করার ব্যাপারে তার সহনশীলতায় আমার আস্থা আছে।

পরিবারের প্রায় সবাইকে হারিয়ে, ১৯ বার হত্যা চেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা আসলে সর্বংসহা। আমাদের এসব সমালোচনা আর কথার বাণ তাঁর অসীম সহ্যক্ষমতার দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। তবে তাঁর দলের লোকজনের সহনশীলতা নেই বললেই চলে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললেই তারা মামলা ঢুকে দেন, হামলা করেন। যেমন 'শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কটুক্তি' করার অভিযোগে ছাত্রলীগ নেতার দায়ের করা মামলায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইদুল ইসলাম এখন কারাগারে আছেন। এমন উদাহরণ আরো আছে। অথচ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌক্তিক সমালোচনা, এমনকি অযৌক্তিক সমালোচনাও অপরাধ নয়।

বঙ্গবন্ধু আমলে জাসদ নেতারা যে ভাষায় তাঁর সমালোচনা করেছে, এখন তা কল্পনা করতেও ভয় লাগে। শেখ হাসিনা একজন মানুষ। তাঁর ভালো যেমন আছে, মন্দও তেমনি আছে। কারো দৃষ্টিতে ভালো বেশি, কারো দৃষ্টিতে মন্দ। সহনশীলতা শেখ হাসিনার একটি মহৎ গুণ। সেই ভরসায়  তীব্র অনীহা কাটিয়ে প্রচণ্ড আগ্রহেরই জয় হয়েছে।

শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের পছন্দ করেন, আবার তাদের নানা কাজের, লেখার, বলার হুল ফোটানো সমালোচনাও করেন। এটাকে আমি সবসময় ইতিবাচকভাবেই নেই। তাঁকে সমালোচনা করা যদি আমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হয়, সেটার জবাব দেয়াও তো তাঁর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। তবুও এই সময়ে তাঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে তীব্র অনীহা এসেছে অন্য কারণে। শেখ হাসিনা সুযোগ পেলেই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে ভালোবাসেন। দেশের বাইরে গেলে ফিরে এসেই সংবাদ সম্মেলন করেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর যে মজার খুনসুটি হয়, তা দারুণ উপভোগ্য। এখন তো সব টেলিভিশন শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন সরাসরি সম্প্রচার করে। তবে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন সরাসরি সম্প্রচার করতেই হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তারপরও টেলিভিশনগুলো প্রতিযোগিতা করে সরাসরি সম্প্রচারে যায়, কারণ শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন একটি খুব দর্শকপ্রিয় অনুষ্ঠান। তখন সব চ্যানেলের টিআরপি থাকে হাই।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/28/1538127113929.jpg

আমি যখন মাঠের রিপোর্টার ছিলাম, তখন টেলিভিশনের এমন দৌরাত্ম্য ছিল না। তখন উপস্থিত থেকে এবং এখন টেলিভিশনে দেখে যতটা বুঝি, শেখ হাসিনা প্রশ্ন নিতে ভালোবাসেন। তাঁকে কী প্রশ্ন করা যাবে, কী করা যাবে না; তার কোনো পূর্ব নির্ধারিত ফরম্যাট নেই। প্রশ্ন যেমনই হোক তিনি উত্তর দেন দারুণ সপ্রতিভতায়। কখনো কখনো পাল্টা প্রশ্ন করে চমকে দেন প্রশ্নকর্তাকেই।

আগে তাঁর সংবাদ সম্মেলন কাভার করার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, ভিন্নমতের সাংবাদিকরাও তাঁর সংবাদ সম্মেলনে যেতে পারেন, প্রশ্ন করতে পারেন। আমাদের সময় সংবাদ সম্মেলনে প্রথম প্রশ্নটি করতেন নিউ নেশনের রিপোর্টার মোজাফফর হোসেন মানিক। প্রয়াত এই সাংবাদিক প্রথম প্রশ্নটিই একটু খোঁচা মেরে করতেন। শেখ হাসিনাও পাল্টা খোঁচা দিতেন। একবার এক সাংবাদিক বললেন, আপা, মানিক ভাইয়ের বাড়ি তো গোপালগঞ্জে। জবাবে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘গোপালগঞ্জে কি রাজাকার নাই?’ তখন দৈনিক দিনকালের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন কাভার করতে যেতেন মোখলেসুর রহমান চৌধুরী, যিনি পরে রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদের প্রেস সচিব হিসেবে আলোচিত হয়েছিলেন। মোখলেস ভাই সবসময় শ্রীলঙ্কার পত্রিকা দ্যা আইল্যান্ড-এর বাংলাদেশ সংবাদদাতা হিসেবে পরিচয় দিতেন। আর শেখ হাসিনা বলতেন, ‘আরে আগে বাংলাদেশেরটা বলেন।’ মোখলেস ভাই কাচুমাচু করে দিনকালের পরিচয় দিলেই শেখ হাসিনা জিজ্ঞেস করতেন, দিনকাল কেমন চলছে?

প্রস্তুতি না নিয়ে শেখ হসিনার সংবাদ সম্মেলনে গেলে খবর আছে। কদিন আগে এক সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প নিয়ে জানতে চাইলেন। জবাবে শেখ হাসিনা পাল্টা প্রশ্ন করলেন, মাতারবাড়িটা কোথায়? দেখা গেল উপস্থিত সাংবাদিকদের কেউই মাতারবাড়ি চেনেন না। কিন্তু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে তাদের অনেক উদ্বেগ! সব মিলিয়ে শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন সবসময়ই দারুণ উপভোগ্য অভিজ্ঞতা হতো সাংবাদিকদের জন্য। এই সংবাদ সম্মেলনকে ঘিরেই ছিল আমার অনীহা। সাম্প্রতিক কয়েকটি সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা পেশাগত পরিচয় ভুলে এমনভাবে প্রশ্ন করেছেন, যা আসলে প্রশ্ন নয়, অন্ধ দলীয় আনুগত্যের প্রকাশ। দলীয় নেতাকর্মীদের উপস্থিতি আর করতালির শব্দ শুনে মনে হয় না, এটি সংবাদ সম্মেলন।  

সাম্প্রতিক সংবাদ সম্মেলনের কারণে সাধারণ সাংবাদিকদের সম্পর্কে ধারণাটাই হয়েছে নেতিবাচক। তাই আমার শঙ্কা, শেখ হাসিনা সম্পর্কে লিখলেই সেই পারসেপশনের কবলে পড়তে হবে। কারণ সত্যি কথা লিখলেও তা তাঁর প্রশংসাসূচকই হবে। আমি দলনিরপেক্ষ, তবে আদর্শ নিরপেক্ষ নই। আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদার, গণতান্ত্রিক, উন্নত, সমৃদ্ধশালী, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চাই। আর এটাও জানি, এই লক্ষ্য অর্জনে এখনও শেষ আশ্রয় শেখ হাসিনাই। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের অনেক কাজের সমালোচনা করলেও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমি ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনার অনুরাগী। অনেক ভেবে দেখলাম, আমি কখনো রাজনীতি করবো না, সাংবাদিক নেতাও হবো না, কোনো পোস্টিংএ আগ্রহ নেই, কোনো পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, টেলিভিশনের মালিক হতে চাইবো না; তাই আশা করি যাই লিখি, তা ব্যক্তিগত স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে লিখতে পারবো। প্রশংসাসূচক লিখলেও, তা কোনো প্রাপ্তির প্রত্যাশায় নয়, সেটা নিশ্চিত। নিজের কাছে এটা নিশ্চিত হওয়ার পর শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখার ঝূঁকিটা আমি নিয়েছি।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/28/1538127204460.jpg

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দু’জন মানুষের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন রাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১০ মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার প্রতীক্ষায় তখন গোটা জাতি। তিনি এসে শুরু করেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজ। কিন্তু ৭৫এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে দেশে শুরু হয় পাকিস্তানীকরণ। স্বাধীনতা বিরোধীরা প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত হয়ে যান। রাজনীতি ঢুকে পড়ে ক্যান্টনমেন্টে। এই সময় ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৪ বছর। আওয়ামী লীগের মত বড়, কোন্দল কবলিত এবং বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সরকারি নিষ্পেষণে ধ্বংসপ্রায় একটি দলের সভাপতির দায়িত্ব নেয়াটা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। শেখ হাসিনা সেই দায়িত্ব কতটা পালন করতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয় ছিল অনেকেরই। দলের ঐক্যের প্রতীক হিসেবেই শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। যারা তাঁকে ফিরিয়ে এনেছেন, তাদেরও ধারণা ছিল, শেখ হাসিনাকে সামনে রেখে তারাই দল চালাবেন। কিন্তু শেখ হাসিনা সবাইকে চমকে দিয়েছেন। টানা ৩৭ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব শুধু পালনই করেননি; আওয়ামী লীগকে তুলে এনেছেন অন্যরকম উচ্চতায়।

এখন শুধু দল নয়, দেশ, এমনকি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও অনেকের আগ্রহের কেন্দ্রে শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা যখন দেশে ফেরেন, তখন আমি স্কুলের ছাত্র। তখন থেকেই রাজনীতির ব্যাপারে আমার আগ্রহ। তাই শেখ হাসিনাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি, আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রতি মুগ্ধতা বেড়েছে।

শেখ হাসিনা যে এখনও বেঁচে আছেন, এটা বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশে থাকলে, সেদিনই পরিবারের আর সবার সঙ্গে নিহত হতে পারতেন। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় বেঁচে যাওয়াটা তো অলৌকিক।

১৯৭৫ সালে যখন বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন, তখন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছিলেন জার্মানিতে। রাষ্ট্রপতির কন্যা থেকে হঠাৎ বনে যান অসহায়, এতিম। আগের দিন যারা মাথায় তুলে রেখেছিল, পরদিন তারাই মুখ ঘুরিয়ে নেন। দুই সন্তান আর ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে যাপন করেন উদ্বাস্তু জীবন। সেই উদ্বাস্তু জীবন থেকে কীভাবে শেখ হাসিনা বিশ্বের অন্যতম সেরা নেতায় পরিণত হলেন, তা নিয়ে একটি অসাধারণ সিনেমা হতে পারে। সেই চিত্রনাট্যে পদে পদে ষড়যন্ত্র, পদে পদে ঝুঁকি, অসম সাহসিকতা, দেশপ্রেম সবকিছুর অনবদ্য সব গল্প থাকবে।

সবকিছু ঠিক থাকলে হয়তো শেখ কামালই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক উত্তরসূরী হতেন। ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনাই শেখ হাসিনাকে রাজনীতিতে টেনে এনেছে। সাদা চোখে দেখলে শেখ হাসিনা উত্তরাধিকার সূত্রেই রাজনীতিতে এসেছেন। তবে ভুলে গেলে চলবে না তিনি ছাত্রজীবনেই ছাত্রলীগের মাঠের কর্মী ছিলেন। বড় সন্তান হিসেবে কাছ থেকে দেখেছেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দেখেছেন তাঁর মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের দৃঢ়তা। বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন রাজনীতির দীক্ষা আর মায়ের কাছ থেকে পেয়েছেন শত কষ্ট সয়েও আদর্শে অবিচল থাকার শিক্ষা।

শেখ হাসিনা যখন দেশে ফেরেন, তখন চলছে জিয়াউর রহমানের শাসন, যিনি ক্যান্টনমেন্টে বসে গণতন্ত্র চর্চা করছিলেন। কিন্তু একবছরের মাথায় জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর নানা নাটকীয়তা পেরিয়ে ক্ষমতায় আসেন আরেক সেনা প্রধান এইচ এম এরশাদ। তিনিও তার পুর্বসূরীকে অনুসরণ করে গণতন্ত্র চর্চা করেন ক্যান্টনমেন্টে বসেই। এরশাদের টানা নয় বছরের স্বৈরশাসনের সময়ে শেখ হাসিনা গণতন্ত্র মুক্তির আন্দোলন করে গেছেন রাজপথে। একই সময়ে বেগম খালেদা জিয়াও হাল ধরেন বিএনপির। রাজপথেই বিকশিত হন দুই নেত্রী। তবে শেখ হাসিনা এই ৩৭ বছরে নিজেকে এবং বাংলাদেশকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসবেন, ৮১ সালে এটা কেউ ভাবেননি, আমার ধারণা শেখ হাসিনা নিজেও না।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/28/1538127269863.jpg

শেখ হাসিনার চরিত্রের অনেকগুলো দিক আছে। তিনি আদর্শে অবিচল, প্রয়োজনে ইস্পাতের মত কঠিন। আবার নিমেষেই কুসুমের মত কোমল। ভুতের মত পরিশ্রম করা এবং দ্রুত ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দল এবং দেশ পরিচালনায় তাঁকে অপ্রতিদ্বন্দী করে তুলেছে। সিনেমায় যেমন এক অভিনেতা একাধিক চরিত্রে অভিনয় করে, তেমনি এক শেখ হাসিনায় যেন বাস করে অনেক শেখ হাসিনা। রাজনীতির মাঠের পাকা খেলোয়াড়কেই দেখা যায় ছেলের জন্মদিনে পোলাও রান্না করছেন। নাতির আবদার মেটাতে রীতিমত শঙ্কা নিয়ে মাছ রাধতে বসে যান। গণভবনের পেছনে ব্যাডমিন্টন খেলতে নেমে পড়া শেখ হাসিনার ছবিও ভাইরাল হয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটানোর ছবিও হুটহাট প্রকাশ হয়ে যায়। সাগরের পাড়ে গিয়ে খালি পায়ে নেমে পড়েন সমুদ্রে। ছোট বোনের সাথে তুষার নিয়ে খেলা করেন।

রাজনীতি করতে গেলে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক কিছু করতে হয়। ভোটের মাঠে জড়িয়ে ধরতে হয় বস্তির মানুষকেও। কিন্তু শেখ হাসিনা যখন কাউকে জড়িয়ে ধরেন, দেখলেই বোঝা যায়, নিছক রাজনীতি নয়, তাতে মিশে আছে মমতা। নিমতলীর আগুনে সর্বস্ব হারা দুই মেয়েকে বুকে টেনে নেন মায়ের মমতায়। এমনকি জামালপুর থেকে আসা হিজড়াদের জড়িয়ে ধরেন পরম আদরে। হিজড়াদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আসার গল্পটাও মজার। গত কোরবানীর ঈদের আগে এক হিজড়া প্রধানমন্ত্রীকে এসএমএস করে বলেছিলেন, তাদের কোরবানী দেয়ার সামর্থ্য নেই। শেখ হাসিনা জামালপুরের জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে তাদের জন্য গরু পাঠিয়েছিলেন। সেই কৃতজ্ঞতা জানাতেই তারা ছুটে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। রাজনৈতিক প্রচারের বাইরে কত মেধাবীর পড়ার খরচ জোগান শেখ হাসিনা, তা আড়ালেই রয়ে যায়। রয়ে যায়, কারণ শেখ হাসিনা সেই প্রচারণা চান না। সবাইকে কাছে টেনে নেয়ার, আপন করে নেয়ার এক বিরল ক্ষমতা রয়েছে তার। যারা দুজনকেই দেখেছেন, তারা বলেন, এই গুণটা তিনি বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন। এমন আটপৌড়ে ভঙ্গিতে কথা বলেন, বোঝাই যায় সেখানে আন্তরিকতার ছোঁয়া রয়েছে। নেতাকর্মী, শিক্ষক, সাংবাদিক, সংস্কৃতি কর্মী- সবার সঙ্গে তার শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-স্নেহের সম্পর্ক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যেমন ভোলেন না, তেমনি ভোলেন না তৃণমূলের কর্মীদেরও। সবকিছুর ওপরে তাঁর চরিত্রের যে মানবিক আবেদন, তাই অন্য সবার চেয়ে আলাদা করেছে শেখ হাসিনাকে। সাংবাদিকদের মধ্যে যারা তাঁর সঙ্গে সফর করেছেন, তারা পেয়েছেন, তাঁর এই স্নেহের পরশ। এখন হয়তো আর সম্ভব হয় না। তবে আশি ও নব্বইয়ের দশকে নিজে খোঁজ নিয়ে ডেকে সফরসঙ্গী সাংবাদিকদের থাকা-খাওয়ার তদারকি করতেন। সুযোগ পেলে পাতে তুলে খাইয়েছেন। যারা একবার এই স্নেহের সন্ধান পেয়েছেন, তারা আর তাঁকে ছেড়ে যেতে পারেন না। তবে শেখ হাসিনার চরিত্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশ তাঁর অসাধারণ হিউমার আর উইট। বুকে এমন বেদনার মহাসাগর ধারণ করে, জীবন থেকে এতটা রস নিংড়ে নেয়ার ক্ষমতা বুঝি শেখ হাসিনার একার।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/28/1538127289240.jpg

শেখ হাসিনার জীবনের অনেকগুলো অধ্যায় আছে। কিন্তু জাতির জনকের কন্যা, নিজেও দীর্ঘসময় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার পরও তিনি যে এতটাই মাটির কাছাকাছি, আমার ধারণা এর কারণ, তাঁর ছেলেবেলো কেটেছে তখনকার অজপাড়াগা টুঙ্গীপাড়ায়। উদার প্রকৃতি আর মধুমতি থেকে উড়ে আসা কোমল বাতাস তার হৃদয়ে এই বাংলার জন্য যে ভালোবাসার জন্ম দিয়েছে, তা ক্রমশ বেড়েছে, পরিণত হয়েছে এই দেশকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্বে। সেই থেকেই প্রকৃতির প্রতি তাঁর অপার ভালোবাসা, মানুষের জন্য অগাধ দরদ তাঁর মনে। সংসারের বড় সন্তান হিসেবে মায়ের পাশে থেকে দেখেছেন দেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ, আর সংসারের জন্য মায়ের কষ্ট। একাত্তরে অবরুদ্ধ বাংলায় মা হয়েছেন। তারপর বছর তিনেকের ‘ভিআইপি’ জীবন। সে ভিআইপি জীবন কেমন, তা এখনও দেখা যায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে গেলে। রাষ্ট্রপতির বাসার ড্রইরুম, বেডরুম, ডাইনিং রুমের সঙ্গে আর দশটা মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের কোনো তফাত নেই। ৭৫এর পর ৬ বছর উদ্বাস্তু জীবন। ৮১ থেকে রাজনৈতিক জীবন। তাঁর ৩৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনেও রয়েছে নানা বাঁক।

শেখ হাসিনা যখন দায়িত্ব নেন, তখন আওয়ামী লীগ এক কোন্দলকবলিত, ধ্বংসপ্রায় দল। তাঁকে দলের সভানেত্রী করা হয়েছিল ঐক্যের সূত্র হিসেবে। ৭৫এর পর থেকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়ে যান বঙ্গবন্ধু। নয়মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করে উল্টোপথে। স্বাধীনতাবিরোধীরা হয়ে যান দেশের প্রধানমন্ত্রী। এমন অন্ধকার সময়ে দেশে ফিরে শেখ হাসিনা শুরু করেন দ্বিমুখী সংগ্রাম। প্রথম কাজ হলো, ধ্বংসস্তুপ থেকে আওয়ামী লীগকে দাড় করানো। দ্বিতীয়ত দেশকে সামরিক ও স্বাধীনতাবিরোধীদের কবল থেকে মুক্ত করা। সমানতালে চলে তার কর্মযজ্ঞ। ৯০এ স্বৈরাচারের পতনের পর ৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে, এমন ধারণাই প্রচলিত ছিল। কিন্তু সব ধারণা পাল্টে দিয়ে জন রায় পায় বিএনপি। পরাজয়ের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু দলীয় নেতাকর্মীদের ভালোবাসার তোড়ে ভেসে যায় সব অভিমান। আওয়ামী লীগের জন্য অনেক করেছেন, তাই আওয়ামী লীগের সামান্য বিচ্যুতিও তাঁকে কষ্ট দেয়। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে একবার তিনি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রীর পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের ২০তম সম্মেলনকে সামনে রেখে একাধিকবার তিনি অবসর নেয়ার আকাঙ্খার কথা বলেছেন। কিন্তু যতই বলুন, এখনও আওয়ামী লীগ তো বটেই, দেশের জন্যও তাঁর বিকল্প নেই। তিনি অনায়াসে স্বীকার করেন, ‘আওয়ামী লীগের সবাইকে কেনা যায়, আমাকে ছাড়া।’ আরেকটা উপলব্ধি তাঁর অসাধারণ, ‘আওয়ামী লীগের নেতারা ওলটপালট করলেও কর্মীরা সবসময় ঠিক থাকে।’ ওয়ান-ইলাভেনের বিপদে বাঘা বাঘা নেতারা নানা মাইনাস তত্ত্বে মেতে উঠলেও কর্মীরাই তাঁকে রক্ষা করেছে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/28/1538127317935.jpg

২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এসেই কাঁধে তুলে নেন ২১ বছরের জঞ্জাল পরিস্কারের দায়িত্ব। প্রথম কাজ জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার বিচারের প্রতিবন্ধকতা দূর করা এবং বিচার শুরু। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনতে করেন শান্তিচুক্তি। ভারতের সঙ্গে করেন গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তি। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে শুরু শেখ হাসিনার নেতৃত্বের উৎকর্ষের চরম প্রকাশ। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকর করেন। এরপর শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এই দুটি বিচার করে তিনি গোটা জাতিকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। বিচারহীনতার সংস্কৃতির গ্লানি থেকে মুক্তি দিয়েছেন আমাদের। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার না হয় জাতির অপেক্ষার পাশাপাশি কন্যা হিসেবে তার দায়। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলো আদর্শের প্রতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি তার অবিচল আস্থার প্রকাশ।

এই দফায় ভারতের সঙ্গে ৬৮ বছরের সীমান্ত সমস্যা সমাধান করে ছিটমহলবাসীকে স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। এই দফায় শেখ হাসিনার মূল লক্ষ্য উন্নয়ন। মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের চেতনা উন্নত ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ। সেই লক্ষ্যেই অবিরাম ছুটে চলা তার। এবং এই ছুটে চলা গোয়ারের মত। পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে টানাপোড়েনের পর শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত দেন, নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু বানাবেন। তখন তাঁর মন্ত্রিসভার অনেকেও বিশ্বাস করেননি এটা সম্ভব। কিন্তু পদ্মা সেতু এখন আর কম্পিউটার গ্রাফিক্স নয়, স্বপ্ন নয়; বাস্তবতা। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান থেকে ফিরে আমি লিখেছিলাম ‘পদ্মা সেতু: শেখ হাসিনার গোয়ার্তুমির প্রতীক’। আসলেই গোয়ার্তুমি। এই গোয়ার্তুমি করেই তিনি বিদ্যুৎ উৎপাদনকে নিয়ে গেছেন অবিশ্বাস্য জায়গায়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোন উপেক্ষা করে কার্যকর করেন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি। তাঁর বক্তৃতায়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর অবয়ব থেকে যে আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ে সেটাই এখন বাংলাদেশের চিত্র। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। যে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে গিয়েছিল, সেই বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এসে দারিদ্র্য বিমোচনে বিশ্বকে বাংলাদেশ থেকে শিখতে বলে। বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ, এগিয়ে যাচ্ছে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার দিকে। দেশের ভালোর জন্য শেখ হাসিনা গোয়ার কিন্তু সবসময় অনঢ় নন। জনগণের দাবির মুখে সরে আসেন আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর স্থাপনের সিদ্ধান্ত থেকে। তবে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে অনঢ় অবস্থান, পরিবেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসার সমান্তরাল নয়। আধুনিক প্রযুক্তির কারণে হয়তো কম হবে, তবে রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে সুন্দরবনের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হবে, এটা প্রায় নিশ্চিত। তবুও আমি ধরে নিচ্ছি, সরকারের দাবিই সত্য, ক্ষতি হবে না। তবুও জনগণের আবেগ বিবেচনায় নিয়ে রামপাল প্রকল্প থেকে সরে আসলে তিনি সবার ধন্যবাদ পেতেন।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/28/1538127334995.jpg

শেখ হাসিনা বারবার নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের সৃষ্ট। কিন্তু সেই সমস্যার দায় এখন বাংলাদেশের কাঁধে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পোড়ামাটি নীতিতে রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে আসছে। আর শেখ হাসিনা তাদের আগলে রাখছেন মায়ের মমতায়। ১৬ কোটি মানুষের চাপে পিষ্ট বাংলাদেশের ওপর এখন ১০ লাখ রোহিঙ্গার দায়। শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চি গলায় যখন গণহত্যা আর জাতি নিধনের কলঙ্ক, তখন শেখ হাসিনাকে মানুষ বলছে ’মাদার অব হিউম্যানিটি’। শুধু আশ্রয় দিয়েই শেখ হাসিনা বসে থাকেননি। রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। জন্মদিনেও তিনি ব্যস্ত জাতিসংঘে। শেখ হাসিনার এই মানবিক নেতৃত্ব প্রশংসিত হয়েছে বিশ্ব পরিমন্ডলে। আর চাপ বাড়ছে অং সান সু চির ওপর। এর আগে পার্বত্য শান্তি চুক্তি, ছিটমহল সমস্যার সমাধান করেও সবার প্রশংসা পেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। এবার রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে তাঁর আন্তরিক ও মানবিক উদ্যোগ তাঁকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়।

নেতৃত্বের, ব্যক্তিত্বের এই চরম উৎকর্ষের সময়েই শেখ হাসিনার ইমেজে লেগেছে সবচেয়ে কলঙ্কের কালি। ৬৯ বছরজুড়েই গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করা আওয়ামী লীগের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কলঙ্ক ৫ জানুয়ারি নির্বাচন। এ যেন বিএনপির সমান হওয়ার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। বিএনপির ঝুলিতে একটা ১৫ ফেব্রুয়ারি আছে, আমাদের কেন ৫ জানুয়ারি থাকবে না? সাম্প্রতিক বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচন, আমাদের মনে করিয়ে দেয় জিয়া-এরশাদ আমলের ‘হোন্ডা-গুন্ডা-ডান্ডা, নির্বাচন ঠান্ডা’ তত্ত্ব। এটা দুর্ভাগ্যজনক। ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’র সময়েই দেশে গণতান্ত্রিক স্পেসের সবচেয়ে বড় সঙ্কটের অভিযোগ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নেয়ার শঙ্কা।

তার আমলে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে এখন বাংলাদেশে মানবাধিকার-গণতন্ত্রকে আড়াল করা হচ্ছে। এসবই সত্যি অভিযোগ। তাই মানতে বড় কষ্ট হয়। উন্নয়ন প্রশ্নে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, চীনকে উদাহরণ টেনে এসব অভিযোগকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক পন্থায় উন্নয়নই টেকসই উন্নয়ন। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্রে আমার আস্থা নেই পুরোপুরি। আমি বিশ্বাস করি ন্যায্যতার গণতন্ত্রে। আমি গণতন্ত্রের শেষ কথা মানি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের একটি লাইনকে, ‘আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো, এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজনও যদি হয় সে, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেবো।’ গণতন্ত্রের এই চেতনায় বিশ্বাস করেন শেখ হাসিনাও। ২০০৮ সালে নির্বাচনে ভূমিধ্বস জয় পাওয়ার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘বিরোধী দলকে আমি সংখ্যা দিয়ে গুণবো না।’ কিন্তু সেই চেতনা থেকে কি শেখ হাসিনা সরে গেছেন? তবে আরেকটি নির্বাচনকে সামনে রেখে শেখ হাসিনা বারবার অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আকাঙ্খার কথা বলছেন। বলছেন, 'জনগণ ভোট দিলে ক্ষমতায় আসবো, নইলে নাই'। আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু হলেই ৫ জানুয়ারির কলঙ্কের দাগ কিছুটা মুছবে।

দেশ অনেক এগিয়েছে, এগুচ্ছে। উন্নয়ন কাজ হচ্ছে অনেক। এখন শেখ হাসিনাকে নিশ্চিত করতে হবে দুর্নীতিমুক্ত টেকসই উন্নয়ন। নিশ্চিত করতে হবে সুশাসন। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের অনেকেই জনবিচ্ছিন্ন, কর্মীবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। অনেক এমপি নিজ নিজ এলাকায় একচ্ছত্র্য আধিপত্য কায়েম করেছেন। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেও অনেক অভিযোগ। আওয়ামী লীগের অনেকেই বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনার সত্যিকারের চেতনা ধারণ করে না। দলের দরজা খুলে দেয়ায় বিভিন্ন দল থেকে ক্ষমতালোভী ধান্দাবাজ হাইব্রিডদের ভিড় এখন আওয়ামী লীগে। এখানে শেখ হাসিনাকে শক্ত হতে হবে, নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। এমপি-মন্ত্রীদের পাঠাতে হবে মাটির কাছে, মানুষের কাছে।

ইতিবাচকভাবে নেন, আর নেতিবাচক; শেখ হাসিনা এখন দারুণ পলিটিশিয়ান। নিজের দল তো সামলানই, সামলাতে হয় মহাজোটে থাকা জাতীয় পার্টি, জাসদের অন্তর্দ্বন্দ্বও। আমার তো কেন জানি সন্দেহ হয়, বিএনপির অনেক কলকাঠিও কি শেখ হাসিনা নাড়েন? যুক্তফ্রন্ট, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার পেছনেও শেখ হাসিনার কোনো হাত থাকলেও আমি অবাক হবো না। আমরা প্রায়ই শেখ হাসিনাকে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার পরামর্শ দেই, চাপ দেই। কিন্তু যখন দেখি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দিনে বেগম খালেদা জিয়া ঘটা করে জন্মদিন পালন করেন, যখন জানি ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় বিএনপির শীর্ষ নেতাদের হাত আছে; তখন নিজেদের পরামর্শকেই অন্যায় মনে হয়। তবু শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে ফোন করেন, সন্তানের মৃত্যুতে খালেদা জিয়াকে সান্তনা জানাতে ছুটে যান। শেখ হাসিনার দৃষ্টিতে নিশ্চয়ই বিএনপি খারাপ। কিন্তু এটা তো মানতেই হবে দেশের জনগণের একটা বড় অংশ বিএনপিকে ভোট দেয়। সব দলের আদর্শ এক হবে না। তাই বলে তো বিরোধী মতকে ধ্বংস করে দেয়া যাবে না। ভিন্নমতেই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য্য। বিএনপি অংশ না নিলে আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কি নেবে না, সেটা তাদের ব্যাপার। তাদের জোর করে আনা যাবে না, এটাও সত্যি। কিন্তু শেখ হাসিনার আন্তরিক ইচ্ছা এবং নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে উদারতা বিএনপির নির্বাচনে আসার পথ সুগম হবে। বিএনপির নির্বাচনে আসাটা তাদের জন্য যেমন ভালো, আওয়ামী লীগের জন্যও ভালো; সবচেয়ে ভালো গণতন্ত্রের জন্য।

আগেই বলেছি, শেখ হাসিনা একসঙ্গে অনেক চরিত্রে অভিনয় করেন। শেখ হাসিনা হলেন বাঙালি মুসলমানের চিরন্তণ চরিত্র। যার দিন শুরু হয় ফজর নামাজ আর কোরান তেলাওয়াত দিয়ে, তাকেই কিনা শুনতে হয় নাস্তিকদের নেত্রীর অভিযোগ। আমি জানি তিনি ধর্মনিরপেক্ষ, সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক; তবুও ভোটের রাজনীতির বিবেচনায় তাকে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখতে হয়। শত্রু জেনেও হেফাজতে ইসলামকে আস্থায় রাখতে হয়। ’নাস্তিকদের নেত্রী’ এই বদনাম ঘোচাতে মেনে নেন হেফাজতের অনেক অন্যায় আবদারও।

আমি জানি, ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁকে প্রতিদিন এমন অনেক কিছু করতে হয়। দুঃখিনী রাজকন্যা শেখ হাসিনার হয়তো ইচ্ছা করে কবিতার বই পড়তে পড়তে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে; রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে পাখির মত উড়ে বেড়াতে; সেই তাকেই কিনা সারাক্ষণ থাকতে হয় এসএসএফ’এর নিরাপত্তার ঘেরাটোপে!

এত ব্যস্ততার মধ্যেও বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী শেখ হাসিনা বই পড়েন, সাহিত্যের খোঁজ খবর রাখেন। নিজে লেখালেখি করেন। কোনো অনুষ্ঠানে সুযোগ পেলেই প্রিয় গানে গলা মেলান। প্রিয় শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার জন্মদিনে টেলিভিশনের সরাসরি অনুষ্ঠানে ফোন করে চমকে দেন সবাইকে। চতুর্থ শ্রেনীর ছাত্রের চিঠির জবাব দেন। ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে আসা মুক্তামনির জন্য চকলেট পাঠান। গণজাগরণ মঞ্চে যেতে চাওয়ার আকুতির কথা বলেন প্রকাশ্যে। সৈয়দ শামসুল হককে দেখতে ছুটে যান হাসপাতালে। কবির শয্যাপার্শ্বে বসেন থাকেন গভীর মমতায়। সৈয়দ হকের মৃত্যুতে স্থগিত করে দেন নিজের জন্মদিনের সব আয়োজন। শহীদ কাদরির মৃত্যুর পর তার শেষ ইচ্ছা পূরণে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কবির মরদেহ দেশে আনার ব্যবস্থা করেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ বা কবি হেলাল হাফিজের অসুস্থতার খবর শুনে তাদের ডেকে এনে পাশে দাড়ান। কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের বিপদে এমন মমতা নিয়ে পাশে দাড়ান; কৃতজ্ঞ হয়ে যায় সবাই। শেখ হাসিনার যেন একশোটা হাত, হাজারটা চোখ। কোনো কিছুই তার দৃষ্টি এড়ায় না।

তাঁর বক্তব্যে জীবন সম্পর্কে, চারপাশের মানুষ সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণ দেখে আমি চমকে যাই। ছেলেরা শেভ করার সময় কল ছেড়ে রেখে পানির অপচয় করে; এ পর্যবেক্ষণ তো সাহিত্যিকের। শিশুদের শিক্ষা নিয়ে, স্কুলে শিশুদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান চমকে দেয়। ৭০ বছর বয়সেও তিনি এতটা প্রযুক্তিবান্ধব, ভাবলে অবাক হই। মাঝে মাঝে ভাবি, শেখ হাসিনা যদি প্রযুক্তিবান্ধব না হতেন, তাহলে আমরা আরো অনেক পিছিয়ে থাকতাম। আমি বারবার মুগ্ধ হই, অবাক হই; এতটা কষ্ট বুকে চেপেও এমন দৃঢ়তায় একটি দেশকে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাওয়া কীভাবে সম্ভব, কীভাবেই বা সম্ভব সবকিছুর এত খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করা?

শত্রুমিত্র খুব ভালো চেনেন শেখ হাসিনা। এটা চিনেছেন তিনি পরিবারের সবাইকে হারিয়ে। তবুও তিনি বিশ্বাস করেন, ক্ষমা করেছি, কিন্তু ভুলবো না। তাই তো মোশতাক মন্ত্রিসভার সদস্যরা তার দলের এমপি হন; ১৫ আগস্ট যিনি বঙ্গবন্ধুকে পালানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেই কাপুরুষ সেনাপ্রধানও বরিত হন আওয়ামী লীগে। যাদের জন্মই হয়েছিল আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করার জন্য, সেই জাসদ নেতারা তার মন্ত্রিসভায় থাকেন দাপটের সঙ্গে। ১৫ আগস্টের পর যিনি স্বনামে সম্পাদকীয় লিখেছিলেন, সেই তিনিও শেখ হাসিনার ক্যাবিনেটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ওয়ান ইলাভেনের মাইনাসপন্থিরাও তার চারপাশে ভিড়ে যায় অনায়াসে। শত্রুকে ক্ষমা করে দেয়ার এই মহৎ গুণটিও তিনি পেয়েছেন, তাঁর পিতার কাছ থেকে। শেখ হাসিনা জেনেশুনেই করেন এসব। তিনি জানেন, সুযোগ পেলে তার চারপাশের অনেকেই ছোবল মারার জন্য বিষ সঞ্চয় করছেন, তবুও শত্রুকে অনুগত রাখতে, চোখে চোখে রাখতেই বুঝি ভালো লাগে তার।

আমার এতকিছু ভালো লাগে না। আমার ভালো লাগে শেখ হাসিনাকে। প্রধানমন্ত্রী নয়, বিশ্বনেত্রী নয়, জননেত্রী নয়, গণতন্ত্রের মানসকন্যা নয়; সবসময়ই শেখ হাসিনাকে আমার মনে হয় পাশের বাড়ির মমতাময়ী বড় বোন।

৭২তম জন্মদিনে শেখ হাসিনার জন্য শুভেচ্ছা। দেশের স্বার্থেই তাঁর শতায়ু চাই।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।

 

   

রোহিঙ্গা পরিস্থিতি

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা ও আরাকান আর্মি



ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির (এ এ) সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘাত চলমান রয়েছে। মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ এই সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে উত্তোরনের কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। রাখাইনে প্রায় ছয় লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত অবস্থায় আছে এবং সেখানে ভয়াবহ মানবিক সংকট চলছে। চলমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছে এবং রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজতে ১২ মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে। তারা সেখানে রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া জোরদারকরণে করণীয় সম্পর্কে এবং শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় বলে জানায় রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কবে নাগাদ মিয়ানমার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তা কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তাই এই সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের সহায়তা নিশ্চিতে পাশাপাশি রাখাইনে তাদের ফিরে যাবার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতে কার্যক্রম চলমান রাখতে হবে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাসীরা সক্রিয় রয়েছে, তারা সেখানে হত্যা, মারামারি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো কিছু এন জি ও’র সহায়তায় ক্যাম্পে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রত্যাবাসন বিরোধী প্রচারণার দায়ে দুটি এনজিওকে নিষিদ্ধ করা হয় এবং এর পরপরই এনজিওগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত এনজিওগুলো যাতে প্রত্যাবাসন বিরোধী কার্যক্রমে জড়িত না থাকে তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) আধিপত্য বিস্তার কোন্দলসহ খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাদের বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ড পরিচালনা ও পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নাশকতার সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাদেরকে ধরার জন্য উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড়ে তাদের আস্তানায় অভিযান চালায়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন কারণে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কর্তৃক ২০২৩ সালে ৬৪ জন এবং ২০২৪ সালে এ পর্যন্ত ১৬ জন নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। ত্রাণ সহায়তা কমে যাওয়ার কারণে রোহিঙ্গারা জীবিকার তাগিদে ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে কাজ করছে। যারা এই অবৈধ কাজে জড়িত এবং যারা রোহিঙ্গাদেরকে নিয়োগ দিচ্ছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে তাদের সদস্য সংগ্রহ করছে এবং এর ফলে বাংলাদেশে সংকট সৃষ্টির পাশাপাশি আশপাশের দেশেও সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক বিস্তারজনিত সমস্যা তৈরি হচ্ছে। রোহিঙ্গারা বিভিন্ন দল ও উপগোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং তারা অভ্যন্তরীণ কোন্দলে লিপ্ত রয়েছে। আইওএম মহাপরিচালক কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে ৭ মে প্রধানমন্ত্রীর কাছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার বিষয়টি তুলে ধরে। বাংলাদেশ সরকার কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের নিরাপদ অবস্থান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত সংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ করেছে এবং ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছে।

রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় প্রতি বছর আন্তর্জাতিক সহায়তা কমেছে এবং এই ধারা অব্যাহত থাকলে রোহিঙ্গাদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে বলে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, নরওয়ে, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ডের প্রতিনিধিরা তাদের মত ব্যক্ত করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা বাড়ানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য আরো মানবিক ও টেকসই সহায়তা অব্যাহত রাখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ২০২৪ সালের জয়েন্ট রেসপন্স প্লানকে (জে আর পি) সমর্থন জানাতে হবে। এতে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে অবস্থানরত রোহিঙ্গা ও স্থানীয় মিলে সাড়ে ১৩ লাখ মানুষের জন্য ৮৫২.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চাহিদা উপস্থাপন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৭.৬ মিলিয়ন, জাপান ২.৬ মিলিয়ন ডলার এবং নরওয়েও ৬.৫ মিলিয়ন ক্রোনার দেয়ার প্রতিশ্রতি দিয়েছে। সুইডেন এবং সুইজারল্যান্ড জে আর পি’কে সমর্থন জানিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য তহবিল কমে যাওয়ার ফলে যেসব সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে তা থেকে উত্তোরন এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য নতুন উৎস থেকে আরও তহবিল সংগ্রহের জন্য এবং ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করতে আইওএমকে সহায়তা করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বর্তমানে রাখাইনের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল ও সংঘাতপূর্ণ। এ এ জাতিগত রাখাইন জনগোষ্ঠীর জন্য স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এ এ রাখাইনের ১৯ টা টাউন শিপের মধ্যে ১৭ টাতে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। রাখাইনে এ এ ৬ মে বুথিডাং শহরের কাছে মিলিটারি অপারেশন কমান্ড ১৫ দখলের জন্য আক্রমণ চালালে প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর জান্তা সৈন্যরা এ এ’র কাছে আত্মসমর্পণ করে। রোহিঙ্গা ও রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করা সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ, কম্বোডিয়ার তথ্য সংগ্রহকারীদের সঙ্গে সম্প্রতিকালে ২০১৬ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নিধনে অংশগ্রহণকারী অনেক রাখাইনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তারা জানায় যে, সে সময়ের ঘটনার জন্য তারা অনুতপ্ত এবং তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। সে সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যপক প্রচারণার মাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানো কারনে তারা এই কাজ করেছিল এবং তা ঠিক করেনি বলে জানায়। মিয়ানমার সেনাবাহিনী এখনও আরাকানে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে রাখাইনদের মধ্যে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। এর বিপরীতে কোনো মহলে তেমন কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা যায় না। মিয়ানমার সেনাবাহিনী সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা চালালেও সংখ্যাগরিষ্ঠ ভামারদের অনেকে তা গ্রহণযোগ্য মনে করছে না। সেনাবাহিনী রাখাইনে রোহিঙ্গাদেরকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে জাতিগত সংঘাত উস্কে দেয়ার চেষ্টা করছে, তবে এবার তাদের এই প্রচেষ্টা তেমন কার্যকরী হচ্ছে না। এ এ তাদের দখলকৃত এলাকাগুলোতে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কোনো বৈষম্য মূলক আচরণ করছে না বলে জানা যায়। তারা মিয়ানমার সেনা ক্যাম্প দখল করার পর সৈন্যদের পরিবারগুলোকে ও নিরাপদে হস্তান্তর করছে। এ ধরনের আচরণ তাদের সহনশীলতা ও দূরদৃষ্টির পরিচয় দেয়।

এ এ’কে তাদের সুদূর প্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেক গবেষক এই সহস্রাব্দের সশস্ত্র দল হিসেবে আখ্যায়িত করে। এন এল ডি’র শাসনামলে এ একে সন্ত্রাসী দল হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। ২০২১ সালে সেনাঅভ্যুত্থানের অব্যবহিত পরেই সেনাসরকার সংগঠনটিকে কালো তালিকা থেকে বাদ দিয়ে তাদের সঙ্গে একটি অঘোষিত যুদ্ধবিরতির আয়োজন করে। আরাকান আর্মি এই সুযোগটি পুরোপুরি কাজে লাগায়। প্রায় দুই বছর তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সঙ্ঘাত এড়িয়ে পুরোপুরি রাজনীতিতে মনোনিবেশ করে ও রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক গণসংযোগ চালায়। প্রতিটি এলাকায় তারা তাদের রাজনৈতিক এবং বিচারিক নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দেয়। উত্তর এবং দক্ষিণ রাখাইনের মধ্যে যুগ যুগ ধরে বিদ্যমান দূরত্ব কমিয়ে এনে ধীরে ধীরে তারা রাখাইনবাসীদের একমাত্র আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠে। এ এ’র সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে রাখাইনবাসীদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ধর্মীয় সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অঙ্গীকার। মিয়ানমারের সেনা-সরকার এবং এনএলডি রোহিঙ্গাদের প্রতি বরাবরই বিদ্বেষমূলক আচরণ দেখিয়ে আসলেও এ এ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে চায় বলে জানিয়েছে। অতীতে বিভিন্ন সময় জান্তা সরকার অত্যন্ত কৌশলে রাখাইন ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে বিভক্ত করে রেখেছিল। বর্তমানে এ এ নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে রাখাইনদের এক ধরনের স্বস্তিমূলক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বলে জানা যায়।

২০২২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ) এর সামরিক শাখা এএ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের অন্যতম স্টেকহোল্ডার হিসেবে রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানায়। রাখাইনরা আরাকানে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইনদের সমর্থন ছাড়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে টেকসই প্রত্যাবাসন সম্ভব হবে না। মিয়ানমার সরকার আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিলেও রাখাইনে শান্তিতে বসবাস করতে হলে রোহিঙ্গাদেরকে রাখাইনদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতেই হবে। তাই বাংলাদেশ থেকে আরাকানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে মিয়ানমার সরকারের মতো আরাকানের রাজনৈতিক দল এবং জনগণের মতও গুরুত্বপূর্ণ। এ এ’র কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল তোয়াং ম্রা নায়েঙ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক নিয়ে জানায় যে, এ এ বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে চায় এবং এটা তাদের অগ্রাধিকার তালিকায় আছে।

এ এ জাতিগত রাখাইনদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে ও তাদের দূরদর্শী নেতৃত্ব মিয়ানমারের ফেডারেল কাঠামোর আওতায় একটা স্বশাসিত আরাকান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে এ এ’র সঙ্গে তাদের যোগাযোগ স্থাপন করেছে। সামনের দিনগুলোতে রাখাইনে তাদের প্রভাবের কারনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে তাদের সহযোগিতা দরকার হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জড়িত আন্তর্জাতিক সংস্থা, জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশকে এ এ’র সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ এ রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে আন্তরিক হলে তারা রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা রাখাইন জনগণের মধ্যে প্রচার করতে পারে। রাখাইন সমাজের ওপর তাদের প্রভাব থাকায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের পক্ষে রাখাইন সমাজে জনসচেতনতা তৈরিতে এ এ’র প্রচারণাই সবচেয়ে বেশি কার্যকরী হবে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি অন্যান্য দেশের সঙ্গেও নিয়মিত আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে যাতে রোহিঙ্গাদেরকে পূর্ণ নাগরিক অধিকারসহ ফেরত নেয়ার বিষয়ে তারা মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদেরকেও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে কোনো দ্বিমত বা বিভক্তি থাকতে পারবে না। নিজেদের ভিতরের বিভক্তি দূর করে তাদেকেও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সফল করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এম ফিল, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।

;

দহনজ্বালা, বজ্রপাত, প্রকৃতির বিরূপতা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপদ



ড. মাহফুজ পারভেজ
দহনজ্বালা, বজ্রপাত, প্রকৃতির বিরূপতা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপদ/ছবি: সংগৃহীত

দহনজ্বালা, বজ্রপাত, প্রকৃতির বিরূপতা ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপদ/ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

তীব্র গরমে ফের জারি করা হয়েছে হিট অ্যালার্টের সতর্কতা। এপ্রিলের শেষ দিকে লাগাতার তাপপ্রবাহের জেরে অস্থির হয়েছিল স্বাভাবিক জনজীবন। মাঝে বৃষ্টির ছোঁয়ায় এসেছিল স্বস্তি। মে মাসের মাঝামাঝি পুনরায় শুরু হয়েছে দহনজ্বালা। আবার জনজীবনে নেমে এসেছে অস্বস্তি। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচণ্ড তাপদাহের দাপটে হিট অ্যালার্টের সতর্কতা ঘোষণা করতে হয়েছে।

এপ্রিলে স্মরণকালের তীব্র গরমে মানুষের প্রাণ ছিল ওষ্ঠfগত। স্কুল-কলেজসহ অন্যান্য স্বাভাবিক কাজকর্মেও নেমে এসেছিল স্থবিরতা। তারপর বহু প্রতীক্ষিত বৃষ্টির দেখা পেয়ে একটানা অগ্নিবাণে দগ্ধ ও ক্লান্ত জনজীবনে এসেছিল স্বস্থির পরশ। তবে, সে সময় অস্বস্তি বাড়িয়েছিল বৈশাখী বৃষ্টির দোসর বজ্রপাতের আধিক্য। যদিও গ্রীষ্মের তপ্ত পরিবেশে ঝোড়ো হাওয়া, বৃষ্টি, বজ্রপাত বাংলাদেশের চিরচেনা ছবি, তথাপি গত কয়েক বছরে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে দুশ্চিন্তার কারণ। সামান্য বৃষ্টি ও উতাল হাওয়ার মধ্যেই বিকট শব্দে সিরিজ বজ্রপাতের ঘটনা আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে এবং বাড়িয়েছে প্রাণহানি। এমনকি, ফাঁকা জায়গায় বজ্রপাতে মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি মর্মে প্রচলিত ধারণাকে উড়িয়ে দিয়ে শহরেও বাজ পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

এই যে তাপদাহের ফিরে আসা এবং বৃষ্টির সঙ্গে লাগাতার বজ্রপাতের ঘটনা, তা অবশ্যই বিরূপ প্রকৃতির প্রকাশ। প্রকৃতির বিরূপতা অতি উষ্ণায়ন, তীব্র শীত, বায়ু ও জলের দুষণ ইত্যাদি নানা বিপদের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত প্রকাশ পাচ্ছে। যদিও আমরা এবং বিশ্ববাসী এসব বিপদের ব্যাপারে এখনও যথেষ্ট পূর্ব-সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে পারছি না। ফলে বিপদের প্রকোপ ও পরিধি ক্রমান্বয়েই বাড়ছে প্রকৃতির নানামুখী বিরূপ আচরণের মাধ্যমে।

এসব বিপদের বিষয়ে বিজ্ঞানীরা বার বার সতর্কতা জানিয়েছেন। পরিবেশবাদী ও সিভিল সোসাইটির পক্ষেও অবিরাম বলা হচ্ছে এসব বিষয়ে। ফলে সাধারণ জ্ঞান সম্পন্ন প্রতিটি মানুষই জানেন যে, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবেই তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হচ্ছে এবং পরিণামে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসছে। সর্বশেষ গবেষণা বলছে, জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন যদি ঠেকানো না যায় এবং ইতিবাচক দিকে না নেওয়া যায়, তাহলে বিশ্বে তাপপ্রবাহের আশঙ্কা বাড়বে ৪৫ গুণ। জলবায়ুর চোখরাঙানির জেরে বিশ্ব জুড়ে গড় তাপমাত্রা বাড়তে পারে ১.২ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমনই আশঙ্কার ছবি উঠে এসেছে নানা গবেষণায়। বিশেষত ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন (ডব্লিউডব্লিউএ)-এর সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টে তাপপ্রবাহ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে বিস্তর আলোকপাত করা হয়েছে।

গবেষণার উল্লেখযোগ্য দিক হলো, তাপপ্রবাহ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিপদ যে জনগোষ্ঠীকে সবচেয়ে বেশি ও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করবে, তা চিহ্নিতকরণ। বলা হচ্ছে, এসব কারণ সামগ্রিক জনজীবনে বিপদ বাড়াবে। তবে বিশেষত যাঁরা দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছেন, তাদের দুর্ভোগ বাড়বে সবচেয়ে বেশি। এর ফলে বিশ্বের দেশে দেশে বসবাসকারী দরিদ্র্য জনগোষ্ঠী, যারা আগে থেকেই ক্ষুধা, অপুষ্টি, বঞ্চনার শিকার, তারা আরো মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবেন প্রাকৃতিক বিরূপতার কারণে।

ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন (ডব্লিউডব্লিউএ)-এর গবেষণা রিপোর্টটি অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে প্রণীত। মালয়েশিয়া, ব্রিটেন, সুইডেন, নেদারল্যান্ডসের বিভিন্ন আবহাওয়া সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১৩ জন বিজ্ঞানী রিপোর্টটি তৈরি করেছেন। গত দু’বছরের রিপোর্টেও এ বারের মতোই ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির কার্যকারণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা আবহাওয়ার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখেছেন শিল্পবিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় বর্তমানে তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি।

নতুন রিপোর্টে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল বিশ্লেষণের জন্য পৃথক মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছিল। পশ্চিম এশিয়ায় (যেমন সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, প্যালেস্টাইন) মার্চ-এপ্রিলের তিন দিনের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা খতিয়ে দেখা হয়। ফিলিপিন্সে দৈনিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রার ১৫ দিনের গড় পর্যালোচনা করা হয়েছে। তবে ভারত, মিয়ানমার, লাওস-সহ দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে এপ্রিলের গড় তাপমাত্রাকে বিশ্লেষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। দেখা গিয়েছে, গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি। চলতি বছরের গ্রীষ্মেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে একই চিত্র ধরা পড়েছে।

রিপোর্ট যেমন বলছে, বাস্তবেও তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের জোরালো ইঙ্গিত মিলেছে বিশ্বের দেশে দেশে। প্রায় সব দেশেই তাপমাত্রা বেড়েছে। তাপপ্রবাহের বিপদও বেড়েছে। তবে আগে থেকেই উষ্ণ অঞ্চল, যেমন পশ্চিম এশিয়ায় তাপমাত্রা আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করেছেন বিজ্ঞানীদের। তাদের ধারণা, ২০৪০ বা ২০৫০ সালে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রি ছুঁতে পারে।

গবেষকরা বলছেন, ভৌগোলিক কারণেই সাধারণ ভাবে এপ্রিল মাসে এশিয়ায় তাপমাত্রা এমনিতে বেশি থাকে। তারপরেও এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চলকে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের অংশ রূপেই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সেই বাস্তবতা ক্রমেই বিলীন হওয়ার পথে। গবেষকরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক কালে নানা কারণে তাপমাত্রা যে বিপুল হারে বাড়ছে (বিশেষত কিছু শহরে), তা নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন। অত্যধিক তাপে যে সমস্ত প্রজাতির বিলুপ্তির আশঙ্কা রয়েছে, তাদের সুরক্ষার বন্দোবস্তেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তা না হলে ব্যাহত হতে পারে জীববৈচিত্র। যার পরিণতিতে সবুজ ও নাতিশীতোষ্ণ এশিয়ার দেশগুলোর ভাগ্যেও চরম বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ করতে ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কথা শুধু বলতেই শোনা যায়। কখনো কোনো প্রকল্প গৃহীত হলেও তা কার্যকর হয় কমই। উপরন্তু, শহরের দুষণ কমানো যাচ্ছেই না। নদী দখল থামছেই না। বৃক্ষ নিধন কমছেই না। তা হলে নতুন পরিকল্পনা কাজ করবে কেমন করে? বাংলাদেশে যখন এমনই শোচনীয় পরিস্থিতি, তখন বিশ্বের অবস্থাটাও বিশেষ ভালো নয়। অনেক অগ্রসর দেশই প্রকৃতি বিনাশের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তাদের কারণে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। বিনষ্ট হচ্ছে জলবায়ুর ভারসাম্য। এবং নেমে আসছে নানা বিপদ।

অতএব, বিশ্ব জুড়ে যদি অবিলম্বে তাপ নিঃসরণের হার নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, সে ক্ষেত্রে তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে বিশ্ববাসীকে। আগামী দিনে এই বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রিও ছাড়িয়ে যেতে পারে। আর তাপপ্রবাহের ক্ষেত্রে তা হতে পারে ৭ ডিগ্রি। বিশেষ করে, যেসব দেশ দারিদ্র্য ও যুদ্ধ বা সংঘাতের কারণে তছনছ হয়ে পড়েছে, সেখানে বিপদ আরো ভয়াবহ রূপ নেবে। একটি গবেষণা পরিসংখ্যানে জানা যাচ্ছে, ইসরায়েলি আক্রমণে বিধ্বস্ত গাজ়ায় ভিটেহারা ১৭ লক্ষ মানুষের জীবন আরো দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে অত্যধিক গরমে। এমন চিত্র বিশ্বের অন্যান্য শরণার্থী শিবিরেও দৃশ্যমান।

নগর ও উদ্বাস্তু জীবনের পাশাপাশি জলবাযু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের প্রভাব পড়ছে গ্রামীণ জনজীবনেও। অত্যধিক গরমে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চাষাবাদ। ফলে খাদ্যশস্যের জোগানে ঘাটতির আশঙ্কাও দেখা দেবে সামনের দিনগুলোতে। জলসঙ্কটের কারণ ঘটবে অত্যাধিক গরমের ফলে। শিক্ষা ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রেও ছেদ পড়বে বিরূপ পরিস্থিতির প্রভাবে। মৃত্যু হবে অসংখ্য গবাদি পশুর। মারা যাবে মানুষও। যেমন চলতি তাপদহনের কারণে গত এপ্রিলে মৃত্যুর সংখ্যা (সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী) বাংলাদেশে ২৮, ভারতে ৫ এবং গাজ়ায় ৩। থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্সেও দহনজ্বালায় মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে একজন করে। এমনকি, নির্বাচনের মতো গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় আয়োজনও থমকে যাবে বা স্থিমিত হবে তীব্র গরমের কারণে। যেমন, ভারতে চলমান লোকসভা নির্বাচনে ভোটদানের হারও বহু জায়গায় কমেছে তাপপ্রবাহের কারণে।

তাপমাত্রা জনিত কারণে যতগুলো বিপদ আপতিত হয়েছে, তার পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রয়েছে মানুষের অপরাধ। বিজ্ঞানীদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনে খলনায়ক মানুষই। বিশেষত সেইসব মানুষ, যারা রয়েছেন ক্ষমতায়, নেতৃত্বে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়। তাদের ভুলের কারণেই অত্যধিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হচ্ছে। অরণ্যবিনাশের মতো অপরাধ হতে পারছে। যার মাসুল গুনছেন বিশ্বের সাধারণ মানুষ।

বাংলাদেশের মতো বৃষ্টির আধিক্য রয়েছে যেসব দেশে, সেখানে উষ্ণায়নের কুপ্রভাব হিসাবে যে সকল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাত্রা বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হয়, বজ্রপাতও তার অন্তর্ভুক্ত। ফলে বন্যা, খরা, অতি গরম বা অতি ঠাণ্ডার মতোই বজ্রপাত নিয়েও মনোযোগী হওয়া দরকার। যে হারে বজ্রপাতের আধিক্য দেখা যাচ্ছে এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, তাতে বিষয়টি মোটেও উপেক্ষা করার মতো নয়। বরং এক্ষেত্রে আগাম সতর্কতা হিসাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পথে অগ্রসর হওয়াই কর্তব্য। তবে, নিঃসন্দেহে জনসচেতনতা বৃদ্ধি বজ্রপাতে প্রাণহানি ঠেকানোর পক্ষে অত্যাবশ্যক। বারংবার সতর্ক করা সত্ত্বেও বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠে খেলা, উঁচু ছাদে মোবাইলে কথা বলা আটকানো যায়নি। শহরে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়েছে এই কাণ্ডজ্ঞানহীনতা।

অন্য দিকে, প্রকৃত জ্ঞানের অভাবও বজ্রপাতে আহতদের চিকিৎসা সময়ে শুরু করতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বজ্রপাতে আহতদের স্পর্শ করলে নিজেরাও বিদ্যুৎপৃষ্ট হতে পারেন ভেবে প্রত্যক্ষদর্শীরা তাঁদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেন না। এই ভ্রান্ত ধারণাও দূর করা আবশ্যক। কালবৈশাখীর সময় পেরিয়ে যায়নি, বর্ষা শুরুর বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির দিনও সমাগতপ্রায়। বজ্রাঘাতে মৃত্যু ঠেকাতে এখনই উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন সরকার থেকে সাধারণ মানুষ— উভয় পক্ষেরই। বিশেষ করে, বার বার দহনজ্বালার ফিরে আসা এবং প্রকৃতির বিরূপতায় ধেয়ে আসা বিপদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে বহুমুখী বিপদ যেন আরো বৃদ্ধি না পায়, সে ব্যবস্থা করার কথাও নীতিপ্রণেতাদের জরুরি ভিত্তিতে ভাবতে হবে। নইলে প্রাকৃতিক বিপদের পথ ধরে যে সামাজিক বিপদ ও অস্থিতিশীলতা নেমে আসবে, তা সামাল দেওয়া সত্যিই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসেোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

ব্যাংক ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের প্রভাব ও সম্ভাবনা



কানজুল কারাম কৌষিক, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ব্যাংক ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের প্রভাব ও সম্ভাবনা

ব্যাংক ব্যবস্থা ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের প্রভাব ও সম্ভাবনা

  • Font increase
  • Font Decrease

ব্যাংক ব্যবস্থার আবিষ্কার একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে। বিশ্বের যেকোনো দেশের অর্থনীতিকে সুনির্দিষ্টভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যাংকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

শুধু মুনাফা অর্জনই ব্যাংক এর প্রধান এবং একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। মুনাফা অর্জন ছাড়াও একটি ব্যাংককে বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নানা চড়াই-উতরাই পার করে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। তার পেছনেও ব্যাংক ব্যবস্থার অবদান অনস্বীকার্য।

সম্প্রতি বাংলাদেশের নানা ইস্যুতে ব্যাংক ব্যবস্থার কার্যক্রম নিয়ে কৌতূহল জাগে। তাই ব্যাংক এর ব্যবস্থাপনা ও উদ্দেশ্য আমাদের ধারণা পরিষ্কার হওয়া উচিত।

একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন। একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাংক কিছু উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়। তার মধ্যে প্রথমেই ব্যাংকিং কাজকর্ম পরিচালনা করার মধ্য দিয়ে মুনাফা অর্জন করা অন্যতম।

ব্যাংক পরিচালনায় আমানত সংগ্রহ ও ঋণ প্রদান করাও ব্যাংকের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। তুলনামূলক বেশি সুদে ঋণ প্রদান করলেও মানুষ ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি অধিক আস্থা স্থাপন করায় ব্যাংক থেকেই ঋণগ্রহণ করে থাকে। শুধু লেনদেনই নয়, ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ভোক্তাদেরকে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান করা। ব্যাংকগুলো তাদের সেবা ব্যবস্থা অনুযায়ী বিনিময়ে কিছু সার্ভিস চার্জও আদায় করে থাকে।

এছাড়াও ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো- অর্থনীতিতে বিনিয়োগের মাধ্যম তৈরি করা। বিনিয়োগ পরিচালনা লাভজনক করার মাধ্যমে এবং আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করার জন্য চেক বিনিময় বিল ইত্যাদি প্রচলন করা ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঋণ ও মুদ্রা বাজারও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্যাবলির পাশাপাশি রয়েছে কিছু আর্থসামাজিক উদ্দেশ্যাবলি। তার মধ্যে অন্যতম হলো মূলধনের জোগান ব্যবস্থা। ব্যাংক জনগণের হাত থেকে অল্প অল্প অর্থ সঞ্চয় করে মূলধন সংগ্রহ করে এবং তার উপর নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান করে। শিক্ষিত ও দক্ষ বেকার লোকদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে এবং তাদের নিয়োগ দিয়ে বেকার সমস্যার সমাধানও ব্যাংক এর অন্যতম উদ্দেশ্য।

এছাড়াও ব্যাংক উদ্যোক্তাদের মূলধনের চাহিদা পূরণের জন্য ঋণ প্রদান করে এবং শিল্পায়নে সহযোগিতা করে । অর্থনীতিতে  প্রমাণিত যে, মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটলে মানুষের ব্যয় ও ভোগের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। বিনিয়োগ, ঋণদান, ব্যাবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির দ্বারা জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়। এটিও ব্যাংক এর কার্যক্রমের অন্যতম উদ্দেশ্য।

ব্যাংকের কিছু প্রতিনিধিত্বমূলক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। ব্যাংক গ্রাহকের এবং সরকারের পক্ষে প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখাও ব্যাংকের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য। কখনো কখনো ব্যাংক রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করার ক্ষেত্রেও ভূমিকা পালন করে। ব্যাংক পুঁজিবাদের স্বার্থরক্ষা করে তাদের উদ্বৃত্ত অর্থের ব্যবহার করে।

আধুনিক বিশ্ব একটি প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির সময় পার করছে। যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠিই হচ্ছে উন্নত ব্যাংক ব্যবস্থা। উন্নত ব্যাংক ব্যবস্থা একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাঠামোকে মজবুত করে।

দেশের অর্থনৈতিক চাকা সবল রাখতে ব্যাংক কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা পালন করতে পারে। তার মধ্যে অন্যতম মূলধন সৃষ্টি করা। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মূলধনের গুরুত্বই সর্বাধিক। তাই ব্যাংক জনগণের সঞ্চয়কৃত অর্থ আমানত হিসেবে গ্রহণ করে দেশের বাণিজ্য ও শিল্পের প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাব মিটানোর জন্য মূলধন সৃষ্টি করে থাকে। ব্যাংক সমাজের সকল স্তরের জনগণকে সঞ্চয়ী হতেও  উৎসাহিত করে। এছাড়াও শিল্প কারখানায় ব্যাংক শুধু পুঁজি সরবরাহ করেই ক্ষান্ত হয় না উপবস্তু শিল্প পরিচালনা ও গঠনেরনব্যাপারে সাহায্য করে শিল্পের প্রসারও ঘটায়।

মূলধন সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যাংক জনগণের সঞ্চয়কৃত অর্থ দেশের শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন মেয়াদে মূলধন হিসাবে সরবরাহ করে শিল্প ও ব্যবসায় বাণিজ্যের গতিকে সচল রাখে। বাংলাদেশের মতো কৃষি প্রধান দেশগুলোতে ব্যাংক বড় ভূমিকা পালন করে কৃষি উন্নয়নের জন্য সার, বীজ, কীটনাশক ঔষধ, চাষাবাদ সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি প্রভৃতি ক্রয়ের জন্য কৃষকদের ঋণ দিয়ে। এর মাধ্যমে ব্যাংক দেশের কৃষি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ব্যাংক দেশের ব্যবসায়ীদেরকে আর্থিক সাহায্য, লেনদেনের ক্ষেত্রে সহায়তা ও পরামর্শ দিয়ে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে সহায়তা করে। বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যাংক দেশের আমদানি ও রফতানি, ব্যবসায় বাণিজ্যে সহায়তা দান করে বৈদেশিক বাণিজ্য প্রসারের পথকে সুগম করে থাকে। ব্যাংক উৎপাদনের বিভিন্ন ক্ষেত্রসমূহে প্রয়োজনীয় ঋণ সরবরাহ করে, দেশের সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে।

এছাড়াও ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়মতান্ত্রিকভাবে ঋণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখে। একই রকমভাবে কলকারখানায় পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হওয়ার পর তার সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য ব্যাংক বিভিন্ন শ্রেণির ব্যবসায়ীদেরকে অর্থ সাহায্য এবং পরামর্শ দিয়ে থাকে এবং পরামর্শমূলক সহায়তা দান করে জাতীয় আয় বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।

দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন ব্যাংকসমূহ তাদের নিজস্ব শাখা খোলার মাধ্যমে এবং বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ সংস্থান করে বহুলোকের কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশেও এসব উদ্দেশ্যাবলি সাধনের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনসহ দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ব্যাংক ব্যবস্থা এ দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। ব্যাংক ব্যবস্থার অস্তিত্ব ছাড়া বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশের সামগ্রিক ব্যাংক ব্যবস্থা আরো দূরদর্শী ও সুপরিকল্পিত হোক এটাই আমাদের কামনা। 

;

জাতীয় বাজেট ২০২৪-২৫: কতখানি ঢেলে সাজানো হলো?



মাইশা মালিহা
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, ক্রমবর্ধমান ব্যাংকঋণের সুদের হারসহ প্রভৃতি চ্যালেঞ্জকে সাথে নিয়ে আগামী ৬ জুন পেশ হতে যাচ্ছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট। ইতোমধ্যে বাজেটের সারসংক্ষেপ অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বিপরীতে ৫ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে। ঘাটতি আড়াই লাখ কোটি টাকার সিংহভাগ পূরণ হবে বিদেশি ঋণে, বাকিটা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা থাকবে অভ্যন্তরীণ ঋণ ও ব্যাংকঋণে।

এবারের বাজেট নির্ধারণে অর্থ মন্ত্রণালয় বেশ হিসেবি থাকার চেষ্টা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সাবেক অর্থমন্ত্রীর ব্যর্থতার ফলাফল প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি, ভঙ্গুর ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে শুরু করে মন্থর সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের দায়, ক্রমহ্রাসমান জিডিপি প্রবৃদ্ধি। চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করতে  নির্বাচন-পরবর্তী নতুন অর্থমন্ত্রী ও অর্থ প্রতিমন্ত্রীর ওপর চাপটা যেন তাই স্বাভাবিকভাবেই বেশি।

আসন্ন বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৬.৭৫ শতাংশ। যেখানে চলতি বছরের বাজেটে তা ছিল ৭.৫০ শতাংশ। আদতেই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবতার ছাপ পাওয়া যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে মনে হলেও অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। কারণ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে বিনিয়োগ। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই আশানুরূপ হচ্ছে না নানা কারণে। দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ডলার সংকট, জ্বালানি সংকট, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মতো নানাবিধ সমস্যাকে এর কারণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। বিদ্যমান মূল্যস্ফীতিও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করছে।

মূল্যস্ফীতি ঠেকেছে ১০ শতাংশের কোঠায়। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট বর্তমান বাজার কাঠামোকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। জনগণের মৌলিক সেবা নিশ্চিত হওয়াই এখন হুমকির মুখে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের লাগামছাড়া মূল্য বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষের জীবনে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে ছাড়িয়েছে ১০ শতাংশ। তাই এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির সাথে যেমন জনগণ পেরে উঠছে না, তেমনি এই চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হবে আগামী বছরের বাজেট প্রণেতাদেরকে।

মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা বৈশ্বিক কারণে বিভিন্ন দেশে, এমনকি ইউরোপ আমেরিকাতেও ৮-৯ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি দেখা গেছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে সাথে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক উন্নয়নশীল দেশও সংকটের মুখে পড়েছিল। অন্যান্য দেশ এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পেলেও বাংলাদেশ তা পারেনি নানা দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কারণে। সেই সাথে টাকা ছাপানোর মতো সিদ্ধান্ত মড়ার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে এসেছে।

বর্তমানে ডলারের বিপরীতে টাকার বড় রকমের অবমূল্যায়ন মূল্যস্ফীতিতে বড় রকম অবদান রাখছে। তাই উপায় এখন ডলার সরবরাহের সুযোগ বৃদ্ধি। প্রয়োজন প্রবাস আয় বৃদ্ধি ও হুন্ডির পথ পরিহার করে সঠিক নিয়মে তা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে প্রেরণ। দেশের রপ্তানি পণ্যের যথাযথ ভর্তুকির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করলে তা ডলার সরবরাহে ভূমিকা রাখতে পারে।

এই বাজেটে প্রণেতারা অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে দুটি উপায় মেনে চলবেন বলে জানিয়েছেন। এক, দেশের সবচেয়ে বড় আয়ের খাত রাজস্ব কর বাড়বে; দুই, সরকার ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করবে। রাজস্ব বাড়াতে হলে অবশ্যই একটি দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আদায় করা সম্ভব নয় এমন রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলে তা হিতে বিপরীতই হবে। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আয় আদায় করতে হলে করের হার না বাড়িয়ে করযোগ্য মানুষের কাছ থেকে সঠিক ও যথাযথ হারে কর আদায় করা গেলে সার্বিকভাবে চাপ কমবে জনগণের ওপর, এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

মাইশা মালিহা, ৩য় বর্ষ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

;