হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বিশ্বনেতা, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেছিলেন গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ার এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে। বাংলাদেশের আর দশটি সাধারণ গ্রামের মতো গাছপালা, জঙ্গলঘেরা, নদীমাতৃক, গ্রামবাংলার এক নিভৃত কোণে টুঙ্গিপাড়া গ্রাম। পাশ দিয়ে প্রবাহিত ছোট শাখা নদী বাইগার। কিছু দূরে মধুমতি।
১৭ মার্চ ১৯২০ মঙ্গলবার দিবাগত রাত আটটায় বঙ্গবন্ধু জন্মগ্রহণ করেন। বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা সায়েরা খাতুন। বাবা-মা ‘খোকা’ নামে ডাকতেন। খেলার সাথীরা ডাকতেন ‘মুজিব’ বলে। বন্ধুরা ডাকতেন ‘মুজিব ভাই’। মা-বাবার দেওয়া প্রকৃত নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
শৈশবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন হালকা পাতলা, ছিপছিপে ধরনের সুদর্শন বালক। তাঁর চেহারায় এক ধরনের বৈশিষ্ট্য অনেকেরই চোখে পড়ত। স্বল্পভাষী বঙ্গবন্ধুর খাওয়া-দাওয়ার প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না। মাছমাংস খেতে চাইতেন না । নিরামিষ বা শাকসবজিই তিনি বেশি পছন্দ করতেন। বাল্যকালে তাঁর প্রিয় খাবার ছিল কলা ও ডুমুর। এছাড়া তিনি কৈ, শিং, মাগুর ও কাচকি মাছ পছন্দ করতেন। তিনি সারাজীবন দেশি ফলমূল খেয়েছেন। গোলাপ ফুল ছিল তাঁর খুবই প্রিয়। শৈশব থেকেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনচেতা ও সাহসী। সেই সঙ্গে তিনি কোমল হৃদয়েরও অধিকারী ছিলেন।
বাড়িতে গৃহশিক্ষকের কাছে কিছুদিন পড়ালেখা করার পর ১৯২৭ সালে সাত বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাজীবন শুরু হয় গিমাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরে ১৯২৯ সালে নয় বছর বয়সে তাঁকে গোপালগঞ্জ সীতানাথ একাডেমিতে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। আরো পরে তাঁকে বাবার কর্মস্থল মাদারীপুরে ইসলামিয়া হাইস্কুলে ভর্তি করানো হয়।
মাদারীপুরে অবস্থানকালে ১৯৩৪ সালে কিশোর বঙ্গবন্ধু বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন। এই রোগে তাঁর চোখে ছানি পড়ে এবং প্রায় অন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। মাদারীপুর ও আশেপাশের নামকরা ডাক্তারদের দিয়ে চিকিৎসা করিয়েও যখন কোনো ফল হলো না, তখন তাঁকে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে তৎকালীন উপমহাদেশের বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. টি. আহমদের তত্ত্বাবধানে তাঁর চোখের অপারেশন করা হয়। ঐ ডাক্তারের সফল চিকিৎসায় বঙ্গবন্ধুর চোখ মোটামুটি ভালো হয়ে যায়। তবে চিকিৎসকদের পরামর্শে সেই যে তিনি চশমা পরতে শুরু করেন, আজীবন তা অব্যাহত থাকে।
চোখের অসুখের জন্য বঙ্গবন্ধুর পড়ালেখা প্রায় চার বছর বন্ধ ছিল। কলকাতায় চোখের চিকিৎসা করিয়ে বঙ্গবন্ধু মাদারীপুর ফিরে যান। এসময় তিনি স্বদেশি আন্দোলনের প্রতি কিছুটা আকৃষ্ট হন। বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত সভাগুলোতে তিনি যোগদান করতে থাকেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনীতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর আগ্রহ সৃষ্টি হয়। স্বদেশি আন্দোলনের সভায় যোগদানের জন্য তিনি এসময় প্রায়ই গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর যাতায়াত করতেন এবং স্বদেশি আন্দোলনের কর্মীদের সাথে মেলামেশা করতেন।
তখন কেউ কি ভাবতে পেরেছিল, খোকা বড় হয়ে জননন্দিত রাজনীতিবিদ হবেন, বঙ্গবন্ধু নামে পরিচিত হবেন সারা বাংলাদেশে, এমনকি সারা বিশ্বে! যখন গ্রামে-গঞ্জে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে তাঁর নামে শ্লোগান উঠত—“তোমার ভাই আমার ভাই, মুজিব ভাই মুজিব ভাই” অথবা “তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব”—তখন কেউ কি বুঝতে পেরেছিল তাঁর নেতৃত্বেই ধাপে ধাপে একদিন স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হবে; তিনিই হবেন বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের মহান স্থপতি।
বঙ্গবন্ধুর পরিবারে প্রাচুর্য না থাকলেও স্বচ্ছলতা ছিল। নিজেদের জমির যে পরিমাণ ফসল গোলাঘরে উঠত তা দিয়ে সারাবছর স্বচ্ছন্দে চলে যেত। বাবা-মার আদর স্নেহের মাত্রাও বঙ্গবন্ধুর ওপর একটু বেশি ছিল। ইংরেজ রাজত্বের গোলামীর শৃঙ্খল ভাঙার দায়িত্ব খোকার ওপর বর্তাক তা বাবা চাননি। বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে বাবার আকাঙ্ক্ষা ছিল, বড় হয়ে তাঁর ছেলে স্বাধীন আইনজীবীর পেশা গ্রহণ করবে এবং এ পেশা গ্রহণ করলে দেশ ও দেশের জনগণের সেবাও করতে পারবে। তিনি আন্তরিকভাবেই চেয়েছিলেন, নিজে যা পারেননি, তা যেন বঙ্গবন্ধু পক্ষে সম্ভব হয়, তাঁর অন্তরের সব আকাঙ্ক্ষা বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমেই যেন পূর্ণতা পায়। তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন চলাফেরায় বা কাজকর্মে বাধা দেননি অথবা জোর করে তাঁর ওপর কিছু চাপিয়েও দেননি।
১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মিশন হাই স্কুলে ভর্তি হন বঙ্গবন্ধু। ততদিনে তাঁর বাবা মাদারীপুর থেকে বদলি হয়ে গোপালগঞ্জ ফিরে এসেছেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী আবদুল হামিদ মাস্টারকে বঙ্গবন্ধুর গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি সচেতন হওয়ার পেছনে গৃহশিক্ষক হামিদ মাস্টারের যথেষ্ট প্রভাব ছিল।
শিশুকাল থেকেই বঙ্গবন্ধু ডানপিটে ও একরোখা স্বভাবের ছিলেন বলে তাঁর ভয়-ভীতি আদৌ ছিল না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, সত্য ও উচিত কথা বলার অভ্যাস থাকায় কারো সামনেই তিনি কথা বলতে ভয় পেতেন না—তা সে খেলার সাথী, সহপাঠী অথবা গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের ডাক সাঁইটে হেডমাস্টার গিরিশ বাবু বা নিজের বাবা যিনিই হোন না কেন। প্রধান শিক্ষক গিরিশ বাবু কিশোর বঙ্গবন্ধুর সাহসিকতা, স্পষ্টবাদিতা আর দৃপ্ত বলিষ্ঠতার গুণেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। মিশন স্কুলে ভর্তি হওয়ার কিছু দিনের মধ্যে শুধু প্রধান শিক্ষককে নয়, বঙ্গবন্ধু সবাইকেই জয় করে নেন। সহপাঠীদের মুজিব ভাই হয়ে উঠলেন।
বাল্যকাল থেকেই খেলাধুলার প্রতি বঙ্গবন্ধুর প্রবল আকর্ষণ ছিল। ফুটবল খেলায় তিনি বেশ পারদর্শী হয়ে ওঠেন, ভলিবলেও তাঁর বেশ আগ্রহ ছিল। হাস্যোজ্জ্বল মুখের মিষ্টি কথা, অন্তরঙ্গ ব্যবহার এবং খেলোয়াড়সুলভ মনোভাবের কারণে অল্পদিনেই স্কুলের শিক্ষক-ছাত্র সবারই প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। স্কুলের যে কোনো উৎসব-অনুষ্ঠানে তাঁর থাকত সক্রিয় ভূমিকা, এমনকি অনেক সামাজিক কাজেও তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। যে কোনো ধরনের কাজেই বঙ্গবন্ধু এগিয়ে গেলেই অন্য ছাত্ররা তাঁর সাথে এগিয়ে যেত সেই কাজে। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে কোনো দাবি বা আবদার অথবা কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের ক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধুই এগিয়ে যেতেন। শৈশব-কৈশোরেই তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি দেখা গিয়েছিল। [চলবে]
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি দুনিয়ার নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা এই আগস্ট মাসে হারিয়েছি। শোকাবহ আগস্টের সেই কালরাতে ঘাতকের নির্মম বুলেটে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ জাতির পিতার পরিবারের অন্য সদস্যরা-তাদের সবাইকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। বঙ্গবন্ধুর কাছেই শুনেছি, তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর উপলব্ধি করেছি, এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয় নাই। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে।’ সেই লক্ষ্য সামনে রেখে জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন; কোনোদিন মাথা নত করেননি তিনি। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধীন বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা। আজ তিনি টুঙ্গিপাড়ার কবরে শায়িত। আর কোনোদিন ফিরে আসবেন না, দরদি কণ্ঠে বক্তব্য রাখবেন না। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি আমাকে আন্দোলিত করে। বঙ্গবন্ধুর চেতনা আমাদের চলার পথের প্রেরণা। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা যখন বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সংবর্ধনা দিয়ে কৃতজ্ঞ জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলাম, সেই থেকে শেষদিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলাম।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন দূরদর্শী নেতা। ’৭০-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সামরিক সরকার প্রণীত লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার তথা এলএফও’র অধীনে। অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে এলএফও’র অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে নিষেধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি এটা প্রমাণ করতে যে, কে বাংলার মানুষের নেতা।’ ’৭১-এর ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের সামনে নবনির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ করান স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। সেদিনের শপথ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘৬ দফা আজ আমার না, আমার দলেরও না, এই নির্বাচনের মাধ্যমে ৬ দফা আজ জাতীয় সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। যদি কেউ ৬ দফার সঙ্গে বেইমানি করে তবে বাংলার মানুষ তাকে জ্যান্ত কবর দেবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।’ এভাবেই বঙ্গবন্ধু ৬ দফাকে আপসহীন পর্যায়ে উন্নীত করেন। ’৭১-এ অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে বঙ্গভবনে ভুট্টোর সঙ্গে দেখা হলে বলেছিলেন, ‘মিস্টার ভুট্টো, পাকিস্তান আর্মি ষড়যন্ত্র করছে ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে। তুমি পাকিস্তান আর্মিকে বিশ্বাস কোরো না। ওরা প্রথমে আমাকে হত্যা করবে, পরে তোমাকে।’ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা হত্যা করতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী কর্মকর্তা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হয়। এরপর ঠিকই পাকিস্তান আর্মির জেনারেল জিয়াউল হক ভুট্টোকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করেন। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে এয়ার ভাইস মার্শাল আসগর খান বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘এরপর কী হবে?’ বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেন, ‘এরপর ইয়াহিয়া খান আসবে। ইয়াহিয়া খানকে অনুসরণ করে একটা টিম আসবে। সেই টিম নিয়ে একদিন আমার সঙ্গে আলোচনা শুরু করে হঠাৎ বাঙালিদের ওপর আক্রমণ চালাবে। আর সেদিনই পাকিস্তানের সমাধি রচিত হবে।’ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কী নিখুঁত বিশ্লেষণ! পরবর্তীকালে এসব ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তব রূপ আমরা দেখেছি।
জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি ধাপেই বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির জয়গান গেয়েছেন। দুবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ বাংলা ও বাঙালির জন্য তার হৃদয়ের ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। সমুদ্র বা মহাসমুদ্রের গভীরতা পরিমাপ করা সম্ভব; কিন্তু বাংলা ও বাঙালির জন্য বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের দরদ ও ভালোবাসার গভীরতা অপরিমেয়। দলীয় কর্মীদের দেখতেন পরিবারের সদস্যের মতো। সব সময় বলতেন, ‘নির্দিষ্ট আদর্শ ও সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের ঐক্যেই আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগ নেতার দল নয়-এ প্রতিষ্ঠান কর্মীদের প্রতিষ্ঠান।’ এমনকি বিরোধী নেতাকর্মীদের প্রতিও তার গভীর সহমর্মিতা ছিল।
মহান মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে ১৮ ডিসেম্বর প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসি। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন এবং ১৪ জানুয়ারি আমাকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তার রাজনৈতিক সচিব করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিদেশ সফর ছিল ’৭২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। সফরসঙ্গী হিসাবে দেখেছি কলকাতায় স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জনসভা। ২০ লক্ষাধিক মানুষের উদ্দেশে বক্তৃতার শেষে কৃতজ্ঞচিত্তে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘রিক্ত আমি নিঃস্ব আমি দেবার কিছু নাই, আছে শুধু ভালোবাসা দিয়ে গেলাম তাই।’ এরপর রাজভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বৈঠকে আমার উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। বৈঠক শেষে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমার জন্মদিনে আপনাকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু পুনরায় বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার সফরের আগেই আমি চাই ভারতের সেনাবাহিনী আপনি ফিরিয়ে আনুন।’ ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘আপনি যা চাইবেন আমি তাই করব।’ ’৭২-এর ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ১২ মার্চ বিদায়ি কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতের সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নেন। একই বছরের ১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের আরেক মিত্রদেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে গিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের সার্বিক সমর্থন জুগিয়েছে। সেদিন সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিন বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন এবং ক্রেমলিনে শীর্ষ নেতৃবৃন্দ-কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল লিওনিদ ইলিচ ব্রেজনেভ, সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। এটি ছিল বিরল ঘটনা। ’৭৩-এর ৩ আগস্ট কানাডার রাজধানী অটোয়াতে ৩২টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কমনওয়েলথ সম্মেলন। সব নেতার মাঝে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ’৭৩-এর ৯ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুসহ ৬ জন নেতার নামে তোরণ নির্মিত হয়েছিল। আলজেরিয়ার মঞ্চে দাঁড়িয়েই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে।’ ’৭৪-এর ২২ ফেব্রুয়ারি, পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরদিন তিনি ইসলামিক সম্মেলনে যান। সেদিন লাহোরে দেখেছি মানুষ রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে স্লোগান তুলেছে ‘জিয়ে মুজিব জিয়ে মুজিব’, অর্থাৎ মুজিব জিন্দাবাদ মুজিব জিন্দাবাদ। লাহোরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বঙ্গবন্ধু। যতক্ষণ তিনি লাহোরে না পৌঁছেছেন, ততক্ষণ সম্মেলন শুরুই হয়নি। বঙ্গবন্ধুর জন্য সম্মেলন একদিন স্থগিত ছিল। ’৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বর, জাতির পিতা জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মহত্ত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু আত্মমর্যাদাবান নেতা, তার প্রতি বিশ্ব নেতাদের গভীর শ্রদ্ধা। আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিমালয়সম উচ্চতায় আসীন ছিলেন তিনি। যেখানে গিয়েছেন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন। স্বাধীনতার পর অল্প সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণ ও দক্ষ কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় বিশ্বের অধিকাংশ দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ অব নেশনস, ওআইসি, ন্যামসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে।
বঙ্গবন্ধুর সমগ্র চিন্তাজুড়েই ছিল দেশ ও দেশের মানুষ। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তিনি অর্থনৈতিক মুক্তির কাজ শুরু করেন। স্বাধীনতার পর দেশ ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত। গোলাঘরে চাল, ব্যাংকে টাকা ও বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না। রাস্তা-ঘাট ধ্বংস করে দিয়েছিল হানাদার বাহিনী। ভৈরব ব্রিজ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে। প্লেন, রেল ছিল না। পুরো যোগাযোগ ব্যবস্থা তছনছ। মাত্র ৩ বছর ৭ মাস উদয়াস্ত পরিশ্রম করে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশটাকে আমরা স্বাভাবিক করি। ভৈরব ব্রিজ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ যেদিন উদ্বোধন করা হয় সেদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলাম। রাষ্ট্রের যত প্রতিষ্ঠান তার সবকটির ভিত্তি স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু। এতসব কিছুর পর যখন দেশটাকে স্বাভাবিক করে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন, ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। অথচ তখন গোলাঘরে চাল, ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রা এবং দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছিল।
সুদৃঢ় নীতি, আদর্শ ও সংকল্পবোধ নিয়ে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ গঠনে অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে খুনিচক্র তাকে দেশের অভ্যন্তরে সপরিবারে হত্যা করে। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করেই খুনিচক্র ক্ষান্ত হয়নি। একই বছরের ৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে-বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যারা বারবার নেতৃত্ব দিয়েছেন-জাতীয় চার নেতাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব শূন্যতা তৈরি করা। কিন্তু ঘাতকচক্রের ষড়যন্ত্র আমরা সফল হতে দেইনি। আওয়ামী লীগের রক্তে ভেজা পতাকা দলীয় ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাতে তুলে দিয়ে সেদিন আমরা ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলাম। আজ তা প্রমাণিত। জাতির পিতা অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে ভিত্তিভূমি তৈরি করে দিয়ে গেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর চেতনা ধারণ করে, শোককে শক্তিতে পরিণত করেছেন। নিষ্ঠা, সততা ও সাহসের সঙ্গে সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তিনি বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছেন এবং দেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে জাতিকে সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
তোফায়েল আহমেদ : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ-সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদত বার্ষিকী আজ।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি জাতি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে দিবসটি পালন করবে। দিবসটি উপলক্ষে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
সর্বশেষ খবর দ্য ডেইলি স্টার বাংলার গুগল নিউজ চ্যানেলে।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে আছে-সূর্য উদয় ক্ষণে বঙ্গবন্ধু ভবন এবং কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশে সংগঠনের সকল স্তরের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্মৃতি-বিজড়িত ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ।
বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন, মাজার জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ, মোনাজাত ও মিলাদ মাহফিল এবং টুঙ্গীপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং আলোচনা সভা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।
পৃথিবীর এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং তার ছেলে আরিফ ও সুকান্তবাবু, মেয়ে বেবি, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন।
এ সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান।
মূলত, ৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকেই বাংলাদেশে এক বিপরীত ধারার যাত্রা শুরু হয়। বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করে সামরিক শাসনের অনাচারী ইতিহাস রচিত হতে থাকে।
সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর গোটা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাষ্প।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নোবেল জয়ী পশ্চিম জার্মানির নেতা উইলি ব্রানডিট বলেন, মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক নীরদ সি চৌধুরী বাঙালিদের 'বিশ্বাসঘাতক' হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছে।
দ্য টাইমস অব লন্ডন এর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ করা হয় 'সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ, তাকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই।
একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়েছে, 'বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।'
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনিদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে।
পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে অনুমোদন করে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সুদীর্ঘ একুশ বছর পর ক্ষমতায় এলে ১৯৯৬ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তিন প্রধান আসামী বরখাস্ত লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
একই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী (পিএ) এ এফ এম মোহিতুল ইসলাম পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সংঘটিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় থানায় একটি এফআইআর করেন।
১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর খুনিদের বিচারের হাতে ন্যস্ত করতে পার্লামেন্টে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে এবং একই বছরের ১২ মার্চ ৬ আসামির উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়।
১৯৯৭ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত বিচারক বিব্রত হওয়াসহ স্বাধীনতা-বিরোধী চক্রের নানা বাধার কারণে ৮বার বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়।
এভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায়ে বিচারক কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
অন্যদিকে, ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৪ দিনের শুনানি শেষে বিভক্ত রায় দেন। বিচারক এম রুহুল আমিন অভিযুক্ত ১৫ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বজায় রাখেন।
কিন্তু অপর বিচারক এ বি এম খায়রুল হক অভিযুক্ত ১৫ জনকেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেন।
পরবর্তীতে ২০০১ সালের অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বিচার কাজ বন্ধ থাকে।
দীর্ঘ ৬ বছর পর ২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের মুখ্য আইনজীবী বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুপ্রিম কোর্টে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দেন এবং ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের ৩ সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের শুনানি শেষে ৫ আসামিকে নিয়মিত আপিল করার অনুমতিদানের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন।
২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর ২৯ দিনের শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন। ওইদিন (১৯ নভেম্বর) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ৫ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামির দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করা হয়।
২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়।
২০২০ সালের ১২ এপ্রিল ভারতে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর আরও একজন খুনি আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার ৪৫ বছর, নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ডের মামলার ২৫ বছর এবং উচ্চ আদালতের রায়ে ৫ আসামির ফাঁসি কার্যকরের প্রায় ১০ বছর পর গ্রেপ্তার হয় খুনি মাজেদ।
যখন নতুন রাষ্ট্র রূপে স্বাধীন বাংলাদেশ কেবল তার যাত্রা শুরু করেছে, তখন তার সামনে ছিল পাহাড়প্রমাণ সমস্যা। যার সঙ্গে যুক্ত হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক সংঘাত ও অস্থিতিশীলতা। এমতাবস্থা সপরিবারে বঙ্গবন্ধু এক গভীর ষড়যন্ত্রেও অংশ। পরবর্তীতে জাতীয় চারনেতার হত্যাকা- হত্যার রাজনীতির নতুন ক্ষত সৃষ্টি করে এবং এসব নৃশংস হত্যাকা- সংঘাতের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়।
পিছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর ব্রিটেন ও ভারত হয়ে স্বপ্নের বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। দীর্ঘ আন্দোলনের সফলতায় যে স্বপ্নের বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে, তা পুনর্গঠনের প্রত্যয়ে তিনি তখন দীপ্ত। যুদ্ধের ফলে বিধ্বস্ত সোনার বাংলা গড়ার প্রতীতে তিনি শুরু করেন জীবনের আরেক অধ্যায়।
অনেকে ভেবেছিলেন বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার ভার নেবেন না। কারণ, তিনি তখন আর দলীয় নেতা নন, সমগ্র বাংলাদেশের আপামর মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু বাঙালির স্বার্থে ও বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তিনি সরকারপ্রধান হন। ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সরকার ঘোষণা করে ‘বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশ ১৯৭২’। ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত এই অধ্যাদেশ বলে অভিযুক্ত করা হয়েছিল ৩৭ হাজার ৪৭১ জনকে। মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল ২ হাজার ৮৪৮ জনের। দ-প্রাপ্ত হয় মাত্র ৭৫২ জন দালাল তথা পাকিস্তানি দোসর। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।
একই সময়ে বঙ্গবন্ধু মনোযোগ দেন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক শাসনকাঠামো বিনির্মাণের কাজে। শিল্পকারখানা জাতীয়করণ করে তিনি শিল্প-উৎপাদনের ৮৫ ভাগ সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। এদিকে, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে আশানুরূপ বৃষ্টিপাত না হওয়ায় খরা ও মন্দা দেখা দেয়, যা ছিল যুদ্ধে প্রায়-ধ্বংস দেশের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় স্বরূপ। খরাজনিত দুর্ভিক্ষের কারণে সৃষ্টি হয় নানামুখী সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা, যা মোকাবেলা করার কঠিন চ্যালেঞ্জ সরকারকে নিতে হয়। প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রীয় অর্থের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সরকার দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। যদিও তখন যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবে কিছু অসন্তোষ ধূমায়িত হয়, যার নেতৃত্ব দেয় অতি-ডান ও অতি-বাম উগ্রবাদী দলগুলো।
সিভিল ও মিলিটারি প্রশাসনে একই সময়ে পুঞ্জিভূত হতে থাকে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও ¯œায়ুগত লড়াই, যার একদিকে ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ আর বিপক্ষে পাকিস্তান প্রত্যাগতরা। উল্লেখ্য, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তৎকালে কর্মরত বাঙালি সৈনিকের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৫০ হাজার। যাদের মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার আটক ছিল পাকিস্তানে। বাংলাদেশে যে ১৪-১৫ হাজার সৈন্য ছিল, তাদের অনেকেই যুদ্ধে আহত-নিহত হন আর বাদবাকী অধিকাংশই ছিল যুদ্ধাহত, পঙ্গু ও রণক্লান্ত। তাদের পক্ষে এসব ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর প্রাধান্য ঠেকানো ও অপতৎপরতা সামাল দেওয়া সম্ভব হয় নি। ফলে প্রশাসনের সর্বস্তরে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের দাপট বাড়তে থাকে, যারা সরকারকে নানাভাবে বিব্রত ও স্যাবোটাজ করতে থাকে।
এমতাবস্থায় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ নতুন দেশের নতুন সরকারের অধীনে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিক ধারা দৃঢ় ও অব্যাহত রাখার জন্য নির্বাচন ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে নির্বাচন শতভাগ বিতর্কহীন হতে পারে নি। বিরোধী দলগুলোও হটকারিতা ও নানা সমালোচনায় মুখর হয় নির্বাচন প্রসঙ্গে। যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে বিপুল বিজয় পাবে, তা ছিল খুবই স্বাভাবিক। অন্যদিকে, বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচন না করায় আশানুরূপ ফল লাভে ব্যর্থ হয়। নির্বাচনে পরাজিত দলগুলো তখন চরমভাবে সমালোচনা ও আন্দোলনমুখর হয় এবং অতিউগ্র কিছু দল নাশকতামূলক কার্যক্রম শুরু করে। ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ‘জাতীয় রক্ষীবাহিনী’ নামে একটি নতুন সশস্ত্র সংস্থা গঠন করে, যার কার্যকলাপ নিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে বির্তক সৃষ্টি হয়। তদুপরি, অপরাপর বাহিনীগুলোর সঙ্গে এই নতুন বাহিনীর দূরত্ব ও মতপার্থক্যও দেখা দেয়।
এতকিছুর পরেও দেশকে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় পরিচালনার জন্য সরকার সচেষ্ট হয়। সংবিধান প্রণয়ন ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যুদ্ধের ক্ষত নিয়েই সংসদীয় ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা অব্যাহত রাখে। এমন কৃতিত্ব যুদ্ধ-পরবর্তী দেশগুলোর জন্য দৃষ্টান্ত স্বরূপ। যদিও দেশে তখন বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ভঙ্গুর, প্রশাসন, সিভিল সোসাইটি ও রাজনীতিতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং আইন-শৃঙ্খলা নাজুক। নানা রকমের অন্তর্দ্বন্দ্ব পেরিয়ে সরকার শাসনের ধারা অব্যাহত রাখতে সচেষ্ট হয়। যদিও সরকার দলের ছাত্র সংগঠনের ভাঙনের ফলে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর গঠিত হয় নতুন দল জাসদ, যারা তীব্রভাবে বিরোধিতার রাজনীতি শুরু করে। সরকার এসব সামাল দিয়েও দেশের জন্য নানা রকমের নীতি ও কর্মসূচি নিয়ে চলতে থাকে। যার মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ড. কুদরাত-ই-খুদার শিক্ষা কমিশন অন্যতম। সরকার ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি করে, বিরোধীরা যার তীব্র সমালোচনায় মুখর হয়। সরকার-বিরোধী আন্দোলন ক্রমশ বেগবান হয়ে দুনীতি, স্বজনপ্রীতি সম্পর্কে সরব হয় এবং দেশব্যাপী আন্দোলনের সূচনা ঘটায়। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষিত হয়। এর ফলে মৌলিক অধিকারসমূহ স্থগিত হয়। এর ২৭ দিন পর ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আনা হয়। ৭ জুন দেশে একক জাতীয় দল হিসাবে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা ‘বাকশাল’ গঠন করা হয়, যাতে রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, সৈনিক, আমলা ইত্যাদি বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিদের নেওয়া হয়, যার নাম দেওয়া হয় ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’।
গবেষকরা মনে করেন, প্রতিকূল অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সামাল দিতে বঙ্গবন্ধু ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর সূচনা করেছিলেন। এতে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। দ্রব্যমূল্য ও অর্থনীতিতে কিছুটা স্থিতিশীলতা দেখা দেয়। এদিকে ১ সেপ্টেম্বর ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ তথা ‘বাকশাল ব্যবস্থায়’ নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু হত্যার এই নির্মম ঘটনার চার মাস পর ৩ নভেম্বর নিরস্ত্র অবস্থায় জেলে নিহত হন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চার জাতীয় নেতা: সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান। স্বাধীনতার সংগ্রামের সঙ্গে তাঁদের প্রত্যেকের নাম ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিল। দীর্ঘ ২৫ বছর বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাগ্রত করার সাধনায় নিয়োজিত থাকার পর তাঁরা স্বাধীনতার নয় মাস জাতির মুক্তির লক্ষ্যে জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে নেতৃত্ব প্রদানকারীদের হত্যার মাধ্যমে এটা “বোঝা গেল যে, হত্যাকারীদের ক্রোধ কেবল বঙ্গবন্ধু-পরিবারের মধ্যে সীমিত ছিল না। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ ও সে আদর্শের সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলোও ছিল তাদের আক্রোশের লক্ষ্য” বলে মনে করেন বদরুল আলম খান তার সংঘাতময় বাংলাদেশ: অতীত থেকে বর্তমান, (ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন, ২০১৫, পৃ. ২১৯) গ্রন্থে।
ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।
সরকার প্রধানসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়করা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আপোষহীন ও মানবতাবাদী নেতৃত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মহান স্বপ্নদ্রষ্টা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
বিভিন্ন সময়ে রাজধানীর ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মতি যাদুঘর পরিদর্শনকালে বিশ্বনেতারা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন জনগণের নেতা এবং তাদের সেবায় তিনি সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন।
তারা ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনে রক্ষিত পরিদর্শক মন্তব্য বইয়ে এই মূল্যায়ন তুলে ধরেন।
"বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ একটি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিল এবং সোনার বাংলার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানের মত ঘটনা মানব সভ্যতার ইতিহাসে খুবই বিরল। মহান একজন মানবতাবাদী হিসেবে তিনি সকল মানুষের জন্য সমতা, সুযোগ ও মর্যাদার মহান প্রবক্তা।"
নগরীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু ভবনের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন শেষে মন্তব্য লেখার জন্য রক্ষিত বইয়ে এ মন্তব্য করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
এতে তিনি আরো বলেন, "বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে সম্মানিত মনে করছি। ভারতের জনগণের পক্ষে আমি একজন মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। আমি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্থায়ী সম্পর্কের যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।"
মোদি ২০১৫ সালের ৬ জুন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি শ্রী রামনাথ কোবিন্দ বলেন, "আমি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের মহান আত্মত্যাগ দেখে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত এবং তিনি তাঁর দেশের মানুষের সেবা করেছেন। আমি বঙ্গমাতাসহ পরিবারের সকল সদস্য যারা অকালে নিহত হয়েছেন, তাদের প্রতিও শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।"
কোবিন্দ বলেন, বঙ্গবন্ধুর দেখানো আদর্শ ও মূল্যবোধ বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের পরবর্তী প্রজন্মকে পথ দেখাবে। বাংলাদেশের প্রিয় জাতির পিতার জীবন ও কর্মের সাক্ষ্য দেওয়া ভবন পরিদর্শন করে নিজেকে সম্মানিত মনে করছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণাদায়ী নেতা।
ভারতের সাবেক এই রাষ্ট্রপতি ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন।
তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালী ইয়োলড্রিম ২০১৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন। এ সময় মন্তব্য বইয়ে তিনি লেখেন, বাংলাদেশের মহান স্থপতি এবং বাঙ্গালী রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিধন্য বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন আমার জন্য খুবই সম্মানের বিষয়। বঙ্গবন্ধু কতিপয় ষড়যন্ত্রকারী সামরিক অফিসারদের হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় ৪০ বছর পার হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান এখনও ২০ শতকের একজন অন্যতম নেতা হিসেবে স্মরণীয় ও বরণীয়।
তিনি বলেন, "তুরস্কের জনগণ এবং মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের পক্ষ থেকে আমি একজন মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। বাংলাদেশ সফরকালে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করে আমি ব্যক্তিগতভাবে যা প্রত্যক্ষ করেছি, তা আমার হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। আমি বিশেষ করে উল্লেখ করতে চাই যে আমরা বাংলাদেশের স্থপতি প্রয়াত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে একই উষ্ণ ভাবাবেগে ডুবে আছি এবং তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।"
মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহীম মোহামেদ সলিহ বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারা জীবনের সংগ্রাম বাংলাদেশকে তাঁর চূড়ান্ত লক্ষ্য স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের পথকে তৈরি করেছে। তিনি গণতন্ত্র ও আত্মনিয়ন্ত্রন অধিকার লাভের ক্ষেত্রে আইকন হিসেবে সর্বদা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এবং তাঁর আদর্শ বাংলাদেশ ও বিশ্বে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। তিনি ২০২১ সালের ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালী জাতির অধিকার ও মর্যাদা আদায়ে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম গভীর তাৎপর্যপূর্ণ স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন জনগণের নেতা এবং তাদের সেবায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাঁকে দেওয়া বঙ্গবন্ধু খেতাবে দেশের মানুষের প্রতি এই দেশপ্রেমিক নেতার গভীর ভালোবাসা প্রতিফলিত হয়।
এতে তিনি আরো বলেন, 'আমাদের দুই দেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্রতী এই মহান স্বপ্নদ্রষ্টা ও বিশ্ব রাষ্ট্রনায়ককে আমি অভিবাদন জানাই।'
তিনি ২০১৩ সালের ৪ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন।
জার্মানীর প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিয়ান উলফ বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেন, এই স্মৃতি জাদুঘর আমাদের একজন মহান রাষ্ট্রনায়ককে স্মরণ করিয়ে দেয়, যিনি তার জনগণের অধিকার ও মর্যাদার জন্য লড়াই করেছেন এবং অতিদ্রুত স্বাধীনতা ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন।
তিনি বলেন, 'আমি বাঙ্গালী জাতির স্থপতি এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আমার অশেষ শ্রদ্ধা জানাই।'
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সম্মোহনী এবং অসীম সাহসী নেতৃত্বে মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর জনগণকে নেতৃত্ব দান করেছিলেন।
তিনি বলেন, 'আমি একজন মহান দূরদর্শী এবং রাষ্ট্রনায়কের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি যিনি স্বাধীন, উন্নত এবং গর্বিত বাংলাদেশের দৃঢ় ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।'
ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি সোনিয়া গান্ধী বলেন, 'দূরদৃষ্টি সম্পন্ন একজন নেতা এবং রাষ্ট্র নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই। তিনি স্বাধীনতার জন্য প্রতিকূলতা ও বিরূপ পরিস্থিতি উপেক্ষা করে অটল সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছেন।'
সোনিয়া বলেন, 'বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক এবং সমতার ভিত্তিতে মর্যাদা বৃদ্ধির মাধ্যমে তার জনগণকে ক্ষমতাবান করতে চেয়েছিলেন। স্বাধানীতার পরপরই বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি। তাঁর আত্মত্যাগ সব সময় সম্মানিত হবে, পরবর্তী প্রজম্ম এ আত্মত্যাগকে সম্মান করবে এবং এ সম্মান অব্যাহত থাকবে। আমি তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।'
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্ধ্যোপাধ্যায় বলেন, এই উপমহাদেশের প্রতিটি মুক্তিকামী, মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষের মনে বঙ্গবন্ধু এক জলন্ত অনুপ্রেরণা। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্থপতি এবং পিতা।
মমতা বলেন, বাংলা ভাষাকে বিশ্বের মঞ্চে অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বে মর্যাদা এনে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সেই বিরল নেতা, যার প্রতি ধর্মমত নির্বিশেষে সকল মানুষ প্রণাম জানিয়ে ধন্য হয়। তার স্মৃতির প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।
শান্তিতে নোবেল জয়ী কৈলাশ সত্যার্থি বলেন, আমার আবেগ ও অনুভূতি জানানোর ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। এই স্থানটি সত্যিকারভাবেই একটি তীর্থভূমি, প্রার্থনার একটি পবিত্র স্থান, যারা মানুষের মর্যাদা, স্বাধীনতা, ন্যায় বিচার ও কল্যাণে বিশ্বাস করে।
২০২৩ সালের ১৩ জানুয়ারী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন শান্তিতে এই নোবেল বিজয়ী।
কৈলাশ সত্যার্থি বলেন, এই স্থানটি ভৌগলিক সীমা ও সময় অতিক্রম করেছে, কারণ বঙ্গবন্ধু নিজের সত্ত্বাকে সার্বজনীন ও অমর করে রেখে গেছেন।
তিনি বলেন, আমি প্রার্থনা করি, এখানে যে ধরণের সহিংসতা, নিষ্ঠুরতা এবং বর্বরতা হয়েছে, তার পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং কোথাও যেন এ ধরণের ঘটনা না ঘটে। পৃথিবী যেন মানবিক ও সভ্য হয়, যেখানে একটি বন্দুকের গুলিও যেন তৈরি না হয় ও তার ব্যবহার যাতে না হয়।
কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত জ্যাং স্যাং মিন ২০২৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে তিনি পরিদর্শক বইয়ে মন্তব্য করেন, বঙ্গবন্ধু তাঁর মাতৃভূমি বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য সারাজীবন যে লড়াই সংগ্রাম করেছেন তার প্রতি তিনি গভীর শ্রদ্ধা জানান। তিনি শান্তির পায়রার মতো তাঁর দেশের মানুষের স্বাধীনতাকে ভালবাসতেন, যার মূল্য সার্বজনীন। তাঁর (বঙ্গবন্ধু) স্বাধীনতার সংগ্রাম ভবিষ্যতের জন্যও অব্যাহত থাকবে।
কোলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সিদ্ধার্থ রায় চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধুকে প্রণাম। ভারতের মাটিতে থেকেও আমরা 'জয় বাংলা' ধ্বনিতে উদ্বেলিত হয়েছি। ৭ মার্চের আপনার কবিতা বাঙালী হিসেবে আমাকে, আমাদের আজও দোলা দেয়। বাঙালী জাতিকে যেন কেউ দাবায়ে রাখতে না পারে-এই আর্শিবাদ প্রার্থনা করি।
তিনি ২০২৩ সালের ১০ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর সামরিক সরকার বাড়িটিতে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়নি (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান)।
১৯৮১ সালের ১৭ মে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পরেও তাঁকে বাড়িটিতে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। পরে একই বছরের ১০ জুন তিনি বাড়িতে প্রবেশ করার অনুমতি পান।
১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট এ বাড়িটিকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করেন।