“সাহিত্যকে আমি দুই বাংলায় ভাগ করতে আগ্রহী নই” - রাশিদা সুলতানা



সাক্ষাৎকার: ইশরাত তানিয়া
অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

গল্পকার ও গদ্যকার ইশরাত তানিয়া সম্পাদিত সাক্ষাৎকারগ্রন্থ ‘আলাপের অ্যাম্ফিথিয়েটারে’ স্থান পেয়েছে বাংলা কথাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ দশজন নারী লেখকের সাক্ষাৎকার। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং ত্রিপুরার স্বতন্ত্র নারীস্বরকে দুইমলাটে চিহ্নিত করার এই প্রয়াস লক্ষণীয়। বিশেষ করে সাক্ষাৎকার প্রদানকারী প্রত্যেকেই নিজ নিজ কাজের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র। কথাও বলেছেন ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে, উত্তর দিয়েছেন নারীবাদ, রাজনীতি, সমাজ-রাষ্ট্র, লেখালেখির দায় এবং প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি বহুবিদ গভীর ও অত্যাবশ্যকীয় প্রশ্নের। সাক্ষাৎকার দিয়েছেন নাসরীন জাহান, পাপড়ি রহমান, আনোয়ারা সৈয়দ হক, সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃপ্তি সান্ত্রা, ঝুমুর পাণ্ডে, রাশিদা সুলতানা, মঞ্জু দাসসহ বাংলার চারটি ভূখণ্ডের প্রতিনিধিত্বশীল সব নাম।

সমসাময়িক বাংলার নারী লেখকদের শক্তিমত্তা ও বহুবিচিত্রতার সাক্ষ্যদলিল—ব্যতিক্রমী এই সংকলনটির গুরুত্ব বিবেচনায় এখানকার দুটি আংশিক ও একটি পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার অনলাইন ভার্সনে প্রকাশ করছে বার্তা২৪। এতে নারী লেখকদের ভাবনাবলয়ের পরিচয় পাওয়ার সঙ্গে তাদের কাজ সম্পর্কে আরো সিরিয়াস এবং নতুন পাঠকদের বিস্তারিতভাবে জানার আগ্রহ তৈরি হবে। এখন থেকে প্রকাশিত কোনো গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের ‘অনলাইন কনটেন্ট শেয়ারিং প্লাটফর্ম’ হিসেবেও কাজ করবে বার্তা। আজ থাকছে কথাসাহিত্যিক রাশিদা সুলতানার সাক্ষাৎকার।


রাশিদা সুলতানা

রাশিদা সুলতানার জন্ম ১৯৭৩ সালে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বাবার কর্মসূত্রে আশৈশব তিনি বড় হন ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স করেন। পরে ‘জাপান ডেভলপমেন্ট স্কলারশিপে’ জাপানের রিৎসুমেইকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স করেন। তাঁর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ চারটি : ‘অপনা মাঁসেঁ হরিণা বৈরী’ (২০০৪), ‘আঁধি’ (২০০৭), ‘পরালালনীল’ (২০০৯), এবং ‘পাখসাট’ (২০১২)। কাব্যগ্রন্থ একটি : ‘জীবনযাপন দখিন হাওয়া’ (২০০৮)। উপন্যাস একটি : ‘সাদা বিড়ালেরা’ (২০১৩)। তাঁর নির্বাচিত গল্প সঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ সালে। রাশিদা ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাশ করে সহকারী পুলিশ সুপার হিসাবে তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ডেপুটি পুলিশ কমিশনার হিসাবে বাংলাদেশ মেট্রোপলিটান পুলিশে কাজ করেছেন। রাশিদা ২০১০ থেকে জাতিসংঘে চাকরি করছেন। প্রায় ৪ বছর তিনি জাতিসংঘ শান্তি মিশনে রিজিওনাল প্রশাসক হিসেবে কাজ করেছেন। রাশিদা বর্তমানে জাতিসংঘের দারফুর শান্তি মিশনে সুদানে কর্মরত।


ইশরাত তানিয়া: লেখালেখির ব্যাপারে জানতে চাই। শুরুটা কিভাবে হলো? কেমন করে লেখক হয়ে ওঠা?
রাশিদা সুলতানা: শৈশব কৈশোরে কখনো ভাবি নাই আমি লেখক হব। ৯৮ সালের দিকে মাঝেমধ্যে চেষ্টা করতাম কবিতা লিখতে। ছন্দহীন গদ্য কবিতা। আবেগে টইটুম্বুর অথচ কোনো ইঙ্গিত, দ্ব্যর্থবোধকতাহীন কবিতা। কিন্তু গল্প উপন্যাস লিখব বা লিখতে পারব তা কখনোই ভাবি নাই। আত্মবিশ্বাসও কখনো ছিল না। আমার কৈশোর, তারুণ্য, যৌবন পুরোটাই কেটেছে বইয়ের ভেতর নাক, মুখ, আত্মা সব ডুবিয়ে। সময় পেলেই গল্প উপন্যাস পড়তাম। অথবা সদ্য পড়া গল্প উপন্যাসের চরিত্রদের নিয়ে ভাবনায় ডুবে সময় কাটাতাম। কত দুপুর বিকাল রাত্রি নিজেকে মৈত্রেয়ী দেবী ভেবেছি আর মির্চা এলিয়াদের সাথে অনন্তকাল ধরে গল্প করে গেছি। কিন্তু কখনো এ কথা ভাবার সাহস হয় নাই আমিও কোনোদিন লেখক হব। আমার মনে হতো শুধুমাত্র ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষেরাই গল্প উপন্যাস লিখতে পারে।
হঠাৎ করেই ২০০০ সালের শেষ দিকে আমার প্রথম গল্প লিখি। তখন আমি বিষণ্ণতায় ভুগতাম। সেসময় আমি সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে গাজীপুরে চাকরি করি। গাজীপুর কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে বিকেলে লেকের পাড় ধরে হাঁটছি। চরম বিষণ্ণ আমি সন্ধ্যা নেমে এলে রুমে ফিরে আসি। হঠাৎ করেই মাথায় একটা গল্পের আইডিয়া আসে। তখনও আমি গল্প লেখার কৃৎকৌশল ভালোভাবে জানি না। প্রথমপুরুষে আমার প্রথম গল্প ‘প্রত্যাখ্যাতা প্রতিশ্রুতা’ প্রায় একটানে লিখে ফেলি। তারপর তিন চারদিন ধরে সম্পাদনা করি। লেখার পর আমি নিশ্চিত ছিলাম না এটা ভালো গল্প হয়েছে কিনা।
২০০১-এর জানুয়ারিতে গল্পটা দৈনিক প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকীতে ছাপা হয়। গল্পটা ছাপা হবার পর লেখক, সম্পাদক, নানা জনের কাছ থেকে গল্পটার প্রশংসা শুনি। সেসময় দৈনিক প্রথম আলো অফিসে প্রায়ই যেতাম। দিনে দিনে কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্র পরিচালক, বুদ্ধিজীবী প্রচুর বন্ধু এবং শুভ্যার্থী তৈরি হয়। প্রথম গল্পের প্রশংসা শুনে আমার মধ্যে আরো গল্প লেখার সাহস এবং আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। ২০০০ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত বছরে তিন চারটা গল্প দৈনিক প্রথম আলোর সাহিত্য পাতায় ছাপা হতো। প্রথম আলোর পাঠকপ্রিয়তার কারণে লেখক, বুদ্ধিজীবী অনেকেই পড়েন এবং তাঁরা অনেকেই আমার লেখার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। মূলত লেখক, বুদ্ধিজীবী বন্ধুদের উৎসাহ এবং পাঠকের প্রশংসার কারণেই লেখালেখিতে আমি সিরিয়াস হয়ে উঠি।
আমার লেখক হয়ে ওঠার শুরুর দিকে যেসব কবি, লেখক, চলচ্চিত্র পরিচালক, বুদ্ধিজীবীরা আমাকে অনুপ্রেরণা এবং সমর্থন দিয়েছেন তাঁরা হচ্ছেন: ব্রাত্য রাইসু, সাজ্জাদ শরিফ, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, সলিমুল্লাহ খান, এবাদুর রহমান, আনিসুল হক, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, মানস চৌধুরী, সুমন রহমান, মাতিয়ার রাফায়েল এবং সাখাওয়াত টিপু।
আমার গল্পের পাঠকের ভালোবাসাই আমাকে লেখার প্রতি দায়বদ্ধ করেছে।

ইশরাত তানিয়া: লেখার বাহ্যিক ও অন্তর্গত দিক জানতে চাই। টানা লিখে ফেলেন? লেখার মধ্যে বিরতি আসে? দীর্ঘ উপন্যাস লেখার ব্যাপারেও আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
রাশিদা সুলতানা: কোনো গল্পের প্লট হঠাৎ করেই আমার মাথায় আসে। যখনই কোনো গল্পের আইডিয়া আমার মনে আসে আমি তৎক্ষণাৎ নোট লিখে রাখি। গল্পটা আমার মাথার মধ্যে থাকে। দিনে দিনে গল্পের প্লট, চরিত্র, কাঠামো সব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তখন টানা লিখে ফেলি। লেখার সময় মূল পরিকল্পনা থেকে দূরে সরে যাই। সম্পাদনা করি আরো কয়েকদিন। অনেক সময় যেভাবে গল্পটা পরিকল্পনা করি তার থেকে ভিন্ন একটা গল্প হয়ে ওঠে। কোনো কোনো গল্প টানা লিখেছি। কয়েকটা গল্প আবার মাঝখানে বিরতি দিয়ে লিখেছি। আমার গল্প পাখসাট, বিচারকাণ্ড, স্বপ্নমঙ্গল—এই গল্পগুলো মাঝখানে বিরতি দিয়ে লিখেছি। যেহেতু গল্পটা সবসময়ই আমার মাথার মধ্যে থাকছে এবং যখন যা কিছু পরিকল্পনা করছি গল্পটা নিয়ে সব লিখে রাখছি, ফলে লেখার মাঝখানে বিরতি হলেও লেখার ছন্দ, গতি ফিরে পেতে বেগ পেতে হয় না।
আমার পক্ষে উপন্যাস টানা লেখা সম্ভব হয় না। বিরতি দিয়েই লিখতে হয়। ফুলটাইম চাকরি, ঘরের কাজ, পরিবারের দায়িত্ব এগুলো বাধা হয়ে দাঁড়ায়। টানা কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস সময় বের করা সম্ভব হয় না। কিন্তু উপন্যাসটা সবসময় আমার মাথার মধ্যে থাকে। কাহিনী, চরিত্র, প্লট সবই আমার মাথার মধ্যে থাকে। উপন্যাসের শুরুর দিকে যেভাবে লেখার পরিকল্পনা করি সেভাবে শেষ হয় না। লেখার সময় অনেক পরিবর্তন হয়। লেখার সময় নতুন আরো গল্প, ইমেজ এবং চরিত্র আসে।
সাদা বিড়ালেরা উপন্যাসটা লেখার সময় একটা মেয়ে বারবার জাপানে তার ফ্ল্যাটে ব্যালকনিতে ফিরে যেতে চাইবে। বিদেশের একটা ব্যালকনি যেখানে তার কোনো অধিকার এবং মালিকানা নাই তার প্রতি অমোঘ আকর্ষণ—এটাই প্রাথমিক আইডিয়া ছিল। শুরুতে সন্দিহান ছিলাম এমন অবিশ্বাস্য একটা গল্প বিশ্বাসযোগ্যভাবে বলতে পারব কিনা। উপন্যাসটি লেখা শুরু করার পর কোজু, অংকুজ এইসব চরিত্ররা আর বিভিন্ন ইমেজ আমার কাছে স্পষ্ট হয়।
কোজু, অংকুজকে তৈরি করেছি নীতুর মতোই নিঃসঙ্গ। তাদের ব্যক্তিত্ব এমনভাবে তৈরি না হলে একাকীত্ব, হাহাকার কোনোভাবেই ফুটে উঠত না। আমার মনে রাখতে হয় গল্প উপন্যাসের চরিত্ররা রক্তমাংসের মানুষের মতোই এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকে। পাঠকেরা তাদের ব্যক্তিত্ব, অন্তর্গত সংঘাতের অংশীদার হয়ে ওঠে।

ইশরাত তানিয়া: উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে বিষয়, কাঠামো, চরিত্রনির্মাণ, ভাষার বিশেষ গঠন এবং প্রকাশভঙ্গি—কোনটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়?
রাশিদা সুলতানা: গল্প উপন্যাস উভয় ক্ষেত্রেই এই সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়-কাঠামো-চরিত্রনির্মাণ-ভাষা-প্রকাশভঙ্গি এসবের ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। এদের উপযুক্ত মেলবন্ধনে একটা সফল গল্প উপন্যাস লেখা হয়।

ইশরাত তানিয়া: চরিত্ররা কি আপনার আশপাশ থেকে আসে নাকি অন্য কোনো উৎস আছে?
রাশিদা সুলতানা: চরিত্ররা তৈরি হয় কল্পনা এবং অভিজ্ঞতার মিশেলে। নিজের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, বন্ধু-সহকর্মীদের অভিজ্ঞতা, সংবাদপত্রে পড়া কোনো খবর থেকে আবার কখনো পুরোপুরি কল্পনা থেকে চরিত্র তৈরি হয়। গল্প বা উপন্যাসের কাঠামোতে একশভাগ মিশে যায় এমন চরিত্র তৈরি করতে হয়।

ইশরাত তানিয়া: সাদা বিড়ালেরা উপন্যাসিকায় জাপানী যুবক কোজুর মতো বাংলাদেশি এক মেয়ে নীতুর ব্যালকনি-আকুলতা একই সুরে বাঁধা পড়েছে। তাদের মনোজগতের আবহাওয়া এবং প্রতিকূল বাস্তবতা মিলিয়ে উপন্যাসটিকে বিশ্বজাগতিক বলা যায়। কেমন করে এই উপন্যাস লিখলেন?
রাশিদা সুলতানা: ২০০৪ সালে আমি জাপানে যাই মাস্টার্স করতে। আড়াই বছর ওখানে থাকি। জীবনে প্রথম পরিবার-সামাজিকতা-কোলাহলের বাইরে থাকি। নিজের সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটাই। বাংলাদেশে ফেরার পর হঠাৎই এক মনে হলো একটা গল্প লিখি—একটা মেয়ে বারবার জাপানে তার প্রিয় ব্যালকনিতে ফিরে যাবার জন্য তীব্র টান অনুভব করছে। বিদেশে এমন একটা ফ্ল্যাট এবং ব্যালকনির জন্য তার আকর্ষণ যেখানে তার কোনো মালিকানা বা অধিকার নেই। অথচ ওই ব্যালকনির জন্য তার বুকভর্তি ভালোবাসা;—এধরনের একটা গল্প লিখতে চেয়েছিলাম কবিতার মতো দ্ব্যর্থবোধক এবং ইঙ্গিতময়।
এর আগে আমি হুয়ান রুলফোর গল্প পড়েছি। তাঁর উপন্যাস পেদ্রো পারামো পড়েছি। বোর্হেসের গল্প পড়েছি। শুরুতে আমি ভেবেছি কবিতা এবং গল্পের ফিউশনে মেটাফর ব্যবহার করে ভিন্ন ধরনের একটা গল্প লিখব। প্রায় পাঁচ হাজার শব্দের গল্প লিখেও ফেলি। আমার দুজন বন্ধুকে টেলিফোনে গল্পটার কথা বলি। তারা গল্পের কাহিনী শুনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। ঢাকার বাইরে থাকেন এমন একজন প্রিয় কথাসাহিত্যিক বন্ধু এবং বড়ভাইকে টেলিফোনে গল্পটার কথা বলি এবং কিছু অংশ পড়ে শোনাই। তিনি আমাকে বলেন, পাঁচ হাজার শব্দে গল্পটা শেষ করবেন না। একে আপনি আরো বড় গল্প, উপন্যাসিকা বা উপন্যাস হিসাবে লেখেন, দারুণ ব্যাপার হবে। আমারও তখন মনে হয় আরো লিখতে পারি। এটা দারুণ একটা উপন্যাস হবে। সেসময় আমার অবসরের পুরোটা সময়ই এই কাহিনী নিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতাম। দিনে দিনেই নানা ইমেজ এবং চরিত্ররা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শুরুর দিকে আমি সন্দিহান ছিলাম এমন অবিশ্বাস্য একটা গল্পকে বিশ্বাসযোগ্য করে লিখতে পারব কিনা এবং আমার মানসিক প্রস্তুতি ছিল লেখাশেষে আমার যদি মনঃপুত না হয় এটা আমি কোথাও ছাপতে দিব না বা ছুড়ে ফেলে দিব।
উপন্যাসটা লিখতে নানা ইমেজ, ম্যাজিক রিয়ালিজম, মেঘের ভিতর থেকে বিড়াল এসে প্রোটাগনিস্টের ব্যালকনিতে হানা দেয়—এরকম অবাস্তবতাকে বাস্তবতা আলিঙ্গন করে নেয়। এসব আসে লেখার অনিবার্য অস্তিত্ব হিসাবেই। ইমেজ ব্যবহারের কারণে জাপানের প্রকৃতি, দশতলা এক্সেলশিয়র নামের দালান, ব্যালকনি, তার ঠিক নিচে জঙ্গলে ছাওয়া সবুজ জলের পুকুর—এরা প্রায় সবাই উপন্যাসের চরিত্র হয়ে ওঠে। এইসব ইমেজ তৈরি করা আমার জন্য সহজ ছিল। কারণ বাস্তবে এদের মাঝেই আমার নৈঃশব্দ্যের দিনরাত্রি আমি কাটিয়েছি।

ইশরাত তানিয়া: ভিকারুননিসা নুন কলেজ, জাপানে রিৎসুমেইকান বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা দারফুরে কাজ করার প্রসঙ্গ সাদা বিড়ালেরায় এসেছে। একে কি আত্মজৈবনিক উপন্যাস বলবেন?
রাশিদা সুলতানা: ‘সাদা বিড়ালেরা’য় রিৎসুমেইকান বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আছে, দারফুরে আন্তর্জাতিক এনজিওতে কাজ করার প্রসঙ্গ আছে। কিন্তু তারপরেও এটা আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস না। জাপানে আমি দশতলা বিল্ডিংয়ের যে এপার্টমেন্টে থাকতাম ওই বিল্ডিংয়ের নাম ছিল ‘এক্সেলশিয়র শিগা’। আমি যে স্টুডিও এপার্টমেন্টে থাকতাম সেটিও ৪১২ নাম্বার রুম ছিল। আর আমার ব্যালকনির ঠিক নিচেই ছিল সাদা বিড়ালেরার মতো সবুজ জলের একটা পুকুর। চারপাশে জঙ্গলে ছাওয়া। অদূরে একটা লেক। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে দূরে সেতা শহরের ক্ষুদে ঘরবাড়ি দেখা যেত আর দিগন্তরেখায় দেখতে পেতাম সাদা মেঘ, কুয়াশার মুকুট পরে দাঁড়িয়ে থাকা নীল পাহাড়। তাছাড়া সাদা বিড়ালেরার প্রোটাগনিস্ট নীতুর মতো আমিও একজন ডিভোর্সি নারী।
নৈঃশব্দ্যের যে সৌন্দর্য ও ভয়াবহতার বর্ণনা এ উপন্যাসে আছে তাও আমি খুব ভালোভাবে চিনি। এত সাদৃশ্য থাকার পরও একে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বলা যাবে না। এই উপন্যাসে নীতুর অভিজ্ঞতার সাথে আমার বহু অভিজ্ঞতার মিল আছে যেমন অমিলও প্রচুর আছে। আমি কখনোই পরিবার, বন্ধুত্ব সবকিছু ছেড়ে যাবার মানুষ না। আমি বাবা-মা, ভাই-বোন, সন্তান-আপনজনদের সাথে জড়িয়ে, লেপ্টে থাকা একজন মানুষ। উপন্যাসটি আমার অভিজ্ঞতার সাথে কল্পনা মিশিয়ে লিখেছি।

ইশরাত তানিয়া: নিরীক্ষামূলক লেখাকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
রাশিদা সুলতানা: নিরীক্ষা আমার প্রিয়। হারুকি মুরাকামি নিরীক্ষামূলক উপন্যাস লিখে সাহিত্য দুনিয়াতে তোলপাড় তুলেছেন। সালমান রুশদি, বোর্হেস, কাফকা, অক্টাভিও পাজ, মার্কেস—আমার প্রিয় বহু লেখকই আঙ্গিক, ভাষা এবং প্রকরণ নিয়ে নিরীক্ষামূলক সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গল্পের আঙ্গিক নিয়ে নিরীক্ষা করেছেন। পরবর্তীকালে ভাষা এবং প্রকরণ নিয়ে আরো লেখকেরা সফল নিরীক্ষা করেছেন।

ইশরাত তানিয়া: নারীবাদ কি দর্শন হিসাবে আপনাকে প্রভাবিত করে? আপনার লেখায় কি নারীবাদ সরাসরি এসেছে?
রাশিদা সুলতানা: অবশ্যই করে। আমি নারীবাদী। নারীবাদ একটি সচেতন রাজনৈতিক অবস্থান। নারীবাদ চায় নারীর স্বাধীন ইচ্ছার জয় হোক। বহু ধরনের নারীবাদ আছে। একজন হিজাবি নারীও একশভাগ নারীবাদী হতে পারেন। একজন নারীবাদী শ্রেণী বৈষম্যসহ সবধরনের বৈষম্যের অবসান চান বলে আমি মনে করি। গল্প উপন্যাস লেখার সময় বৈষম্যের, বৈপরীত্যের জায়গাগুলো আমি তুলে ধরি। প্রচলিত অর্থে যে নারীবাদকে আমরা চিনি সেই অর্থে আমার চরিত্ররা নারীবাদী না। সাহিত্যিক হচ্ছেন ঈশ্বরের মতো। তিনি ফেরেশতা, দানব, খুনী, ধর্ষক—সবার চরিত্র একই পরিমাণ দরদ দিয়ে লিখবেন। আমার গল্প উপন্যাস একজন নারী লেখকের গল্প এবং উপন্যাস। আমার স্বতঃস্ফূর্ত নারীত্ব দিয়ে আমি লিখি। কিন্তু নারীবাদের পাটাতনে বসে নয়।

ইশরাত তানিয়া: বোর্হেসের ওপর কাফকার বিশেষ প্রভাব পড়েছিল। আপনার লেখায় কারো প্রভাব আছে কি?
রাশিদা সুলতানা: আমার লেখায় আমার প্রিয় লেখকদের প্রভাব তো আছেই। আমি মনে করি সব সফল লেখকরাই তাদের প্রিয় লেখকদের দ্বারা প্রভাবিত। আমি কোনো প্রতিষ্ঠানে সাহিত্যের কোনো কোর্স করিনি বা ডিগ্রি নিইনি। প্রিয় লেখকদের গল্প উপন্যাস পড়েই আমি লিখতে শিখেছি। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যেসব প্রিয় লেখকদের লেখা পড়েছি সবাই আমাকে প্রভাবিত করেছেন। মার্কেস, বোর্হেস, কাফকা, মুরাকামি, সালমান, শহীদুল জহির, জগদীশ গুপ্ত, হার্টা মুলার, অরুন্ধতী রায়, অক্টাভিও পাজ—উনাদের কাছ থেকে কৃৎকৌশল, ম্যাজিক রিয়ালিজমের ব্যবহার, অবিশ্বাস্য গল্প সত্যের মতো করে বলতে পারা—বহু কিছু শিখেছি।

ইশরাত তানিয়া: একজন লেখকের পাঠকের কাছে পৌঁছানো কতটা জরুরি? কমলকুমার মজুমদার, অমিয়ভূষণ মজুমদার, শহীদুল জহিরের কথা যদি বলি, তাঁরা সেভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারেননি। হয়তো চানওনি। আবার শরৎচন্দ্র, সুনীল, হুমায়ূন পৌঁছে গেছেন। এ প্রসঙ্গে আপনার মতামত জানতে চাইছি।
রাশিদা সুলতানা: আমার মনে হয় না পাঠকপ্রিয় হবার জন্য কোনো শক্তিশালী লেখক লিখে থাকেন। লেখকের দায়বদ্ধতা শিল্পের কাছে। আমার কাছে বিবেচ্য আমি নিজে আমার লেখা গল্প বা উপন্যাসটি নিয়ে সন্তুষ্ট কিনা। নিজের শিল্প-সাহিত্যবোধ অনুযায়ী একটি ভালো গল্প বা উপন্যাস লেখা—এটাই সুলেখকের একমাত্র বিবেচ্য। কমলকুমার মজুমদার, অমিয়ভূষণ মজুমদার, শহীদুল জহিরেরা কালোত্তীর্ণ লেখক। বাংলা ভাষার প্রায় সব লেখকদেরই তাঁরা প্রিয় লেখক। অন্যদিকে প্রচুর পাঠকপ্রিয়তা পেলেও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হুমায়ূন আহমেদ বোদ্ধা পাঠক কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কবি, কথাসাহিত্যিকদের প্রিয় লেখক নন। আবার সুলেখক হবার পরও জাপানী ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামি অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক।

ইশরাত তানিয়া: এখন কি উপন্যাস লিখছেন? নতুন উপন্যাস লেখার ব্যাপারে কিছু ভাবছেন?
রাশিদা সুলতানা: আমি এখন একটা উপন্যাস লিখছি। প্রথম ড্রাফট লেখা শেষ করেছি।

ইশরাত তানিয়া: সেই লেখাটি কি লিখতে পেরেছেন যা লেখার জন্য দীর্ঘদিনের অপেক্ষা?
রাশিদা সুলতানা: আমার বেশ কিছু গল্প এবং সাদা বিড়ালেরা উপন্যাসটি লেখার সময় মনে হয়েছিল সেটিই আমার আরাধ্য লেখা। একমাত্র ওই লেখাগুলো আর্টফর্মে লিখতে পারা আমার তখনকার স্বপ্ন ছিল। পাখসাঁট, বিধুহীন, পরালালনীল, দাম্পত্য, বিচারকাণ্ড এবং আরো গল্প আর উপন্যাস লেখার সময়ই মনে হয়েছে এই লেখাটি হতে যাচ্ছে আমার দীর্ঘদিনের অপেক্ষার লেখা। বর্তমানে যে উপন্যাসটি লিখছি তা নিয়েও আমার যত্ন, অপেক্ষা আর নিবেদনের শেষ নাই। আমি যেই আবেগ, আকাঙ্ক্ষা নিয়ে লিখি পাঠকের হয়তো তেমন মনে হবে না। তাঁদের মনে হতে পারে এসব একেবারেই সাদামাটা লেখা।

ইশরাত তানিয়া: সাহিত্য যদি হয় একটা শিল্পমাধ্যম, একজন লেখককে কখন সফল বলা যায়?
রাশিদা সুলতানা: সাহিত্য যখন শিল্পোত্তীর্ণ হয় তখনই কবি-লেখক সফল হন। আর গল্প, কবিতা, উপন্যাসে লেখকের চিন্তা, ইঙ্গিত, অনুভূতি লেখকের নিজের এবং পাঠকের শিল্পবোধকে আন্দোলিত করার ক্ষমতা থাকতে হবে।

ইশরাত তানিয়া: শিল্পের অন্য কোনো মাধ্যম, ধরুন চিত্রকলা বা সঙ্গীত এসব কি আপনার লেখাকে কোনোভাবে প্রভাবিত করে?
রাশিদা সুলতানা: চিত্রকলা আমাকে প্রভাবিত করে। পিকাসোর ডিকন্সট্রাকশন, সালভাদর দালির কল্পকাহিনী, মার্ক শাগার্ল আর ভ্যানগগের রঙের ব্যবহার, ইমেজ এসব আমাকে প্রভাবিত এবং প্ররোচিত করে।


“পাঠক যেটুকু মনে রাখে তার জন্য দু’ চারখানা ভালো লেখাই যথেষ্ট”
- সঙ্গীতা বন্দোপাধ্যায়


ইশরাত তানিয়া: সাহিত্যে আবেগ, নীতিবোধের প্রকাশ আপনার কাছে কেমন মনে হয়? অতিসচেতনতা বা অসচেতনতা কি সাহিত্যের শিল্পগুণ ক্ষুণ্ণ করে?
রাশিদা সুলতানা: সাহিত্যে আবেগের প্রকাশ তো থাকবেই। কিন্তু তা পরিমিত এবং শিল্পিত হতে হবে। সমাজে প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ভূমিকা এবং দায়িত্ব আছে। বাবা, মা, স্কুলশিক্ষক, ধর্মযাজক নীতিবোধের শিক্ষা দিবেন। কিন্তু সাহিত্যের নৈতিকতার প্রতি দায়বদ্ধতা নাই। সাহিত্যের কাজ প্রচলিত মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করা। যুগ যুগ ধরে শিল্পী, সাহিত্যিকেরা তা করে আসছেন এবং সমাজকে বদলেছেন।
অসচেতনতা সাহিত্যের শিল্পগুণ অবশ্যই ক্ষুণ্ণ করে কিন্তু অতিসতর্কতায় সাহিত্যের শিল্পগুণ ক্ষুণ্ণ হবার কোনো কারণ নাই। সাহিত্যিকের নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ, সতর্ক সম্পাদনা কোনো গল্প-উপন্যাসকে অসামান্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে।

ইশরাত তানিয়া: উত্তর-আধুনিক গল্পগুলো কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন?
রাশিদা সুলতানা: সামাজিক বাস্তবতার পাটাতনে লেখা বহু গল্প বা উপন্যাস আমার যেমন প্রিয়, তেমনি উত্তর-আধুনিক গল্প উপন্যাসও আমার প্রিয়। গড অব স্মল থিংস—এই উত্তরাধুনিক উপন্যাসটি আমার অতিপ্রিয় উপন্যাস। এ উপন্যাসটি কাটাকুটি করে আমি বহুবার পড়েছি উপন্যাস লেখা শিখতে।

ইশরাত তানিয়া: সমগ্র বাংলা সাহিত্যে আপনার প্রিয় লেখক কারা? তাঁদের কোন দিকগুলো টানে?
রাশিদা সুলতানা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার অতিপ্রিয় লেখক। আমার স্কুলজীবন কেটেছে তাঁর সব গল্প পড়ে। ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথ অতুলনীয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, কমলকুমার মজুমদার, প্রেমেন্দ্র মিত্র, জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত আলী, মহাশ্বেতা দেবী, হাসান আজিজুল হক, মাহমুদুল হক, রাহাত খান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির, মঈনুল আহসান সাবের, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, ইচক দুয়েন্দে, কাজল শাহনেওয়াজ—তাঁরা সবাই আমার প্রিয়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই সময়, প্রথম আলো উপন্যাসদুটি ভালো লেগেছে। অমিয়ভূষণ মজুমদার পড়ার ইচ্ছা থাকলেও পড়া হয়নি। নাসরিন জাহানের উড়ুক্কু, শাহীন আখতারের উপন্যাস সখী রঙ্গমালা, শাহাদুজ্জামানের গল্প সংকলন পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ আর হুমায়ূন আহমেদ, সুমন রহমান, শিবব্রত বর্মণ এবং সাগুফতা শারমীন তানিয়ার বেশ কিছু গল্প ভালো লেগেছে। মাহবুব মোর্শেদের কয়েকটা গল্পও ভালো লেগেছে।
অমিয়ভূষণ মজুমদারসহ গুরুত্বপূর্ণ লেখকের বহু লেখা আমার পড়া হয়নি। আমার দুর্ভাগ্য! যাদের লেখা উল্লেখ করেছি তাঁরা সবাই বাঙালির যন্ত্রণা এবং অভীপ্সাকে, তাঁদের সময়টাকে আর্টের ফর্মে তুলে ধরেছেন সুনিপুণ দক্ষতায়।

ইশরাত তানিয়া: বাংলাদেশ আর পশ্চিমবাংলার মধ্যে বাংলা সাহিত্যের তুলনা করলে আপনার দৃষ্টিতে সম্ভাবনার কোন পাল্লাটি কোন দিকে হেলে পড়ছে? এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন শুনতে চাই।
রাশিদা সুলতানা: বাংলার প্রকৃতি, সংস্কৃতি, সুর, গানের মধ্যে বড় হওয়া সব মানুষের মধ্যেই যে কোনো মহৎ কিছু করার সম্ভাবনা আছে। সাহিত্যকে আমি দুই বাংলায় ভাগ করতে ও দেখতে আগ্রহী নই। বাংলা ভাষার সাহিত্যের সকল রূপ আর সম্ভাবনার অবাধ অংশগ্রহণ ও প্রকাশ আমি দেখতে চাই।

ইশরাত তানিয়া: ইলিয়াস, জহির আর হাসান আজিজুলের পর একটি শূন্যতার কথা বলেন অনেকে। এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আপনার মতামত জানতে চাই।
রাশিদা সুলতানা: আমি কোনো শূন্যতা দেখতে পাই না। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ অসামান্য এক উপন্যাস। ইচক দুয়েন্দের লালঘর উপন্যাসিকা, তাঁর গল্প সংকলন, কাজল শাহনেওয়াজ, শাহাদুজ্জামান, সুমন রহমান, সাগুফতা শারমীন তানিয়াসহ অনেকেই ভালো লিখছেন।

ইশরাত তানিয়া: বাংলা সাহিত্যের বাইরে কোন লেখকের লেখায় আকৃষ্ট হন?
রাশিদা সুলতানা: বাংলা সাহিত্যের বাইরে বহু লেখকের লেখায় আকৃষ্ট হই। যেমন তলস্তয়, আন্তন চেখভ, মোপাসা, ফ্রানৎস কাফকা, মার্কেস, বোর্হেস, হুয়ান রুলফো, অক্টাভিও পাজ, মারিয়া ভার্গাস য়োসা, সালমান রুশদী, অরুন্ধতী রায়, অরবিন্দ আদিগা, হার্টা মুলার, গুন্টার গ্রাস, সিঙ্গার, ইতালো কালভিনো, হারুকি মুরাকামি, জিয়া হায়দার খান, সাদাত হাসান মান্টো, ভৈকম মুহাম্মদ বশীর—এঁরা সবাই আমার বহু দিনরাত্রি আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

ইশরাত তানিয়া: একজন নারীর লেখক হতে চাওয়াটা কতটা চ্যালেঞ্জিং? সমস্যাগুলোর সমাধানই বা কী?
রাশিদা সুলতানা: লেখক সমাজ পিতৃতান্ত্রিক সমাজেরই অংশ। পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাধারী এবং পুরুষতান্ত্রিক দানব লেখক আমি কম দেখিনি। শিল্প-সাহিত্যচর্চা তাদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা এবং চর্চা একবিন্দু কমায়নি। নারী লেখকের মধ্যেও পুরুষতন্ত্রের আজ্ঞাবাহী বহুজনকে দেখেছি। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ একজন নারীর লেখক হতে যাওয়ার জন্য মোটেও কোনো চ্যালেঞ্জ না। নিজের ভিতর লেখক হওয়ার টান থাকলে নারী-পুরুষ যে কেউ লেখক হয়ে উঠতে পারে। পুরুষতান্ত্রিকতা কেন, পৃথিবীর কোনো প্রতিরোধ-প্রতিবন্ধকতাই তার লেখালেখি থামাতে পারে না। পুরুষতান্ত্রিক গালাগাল হজম করা নারী লেখক আরো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং শানিত হয়ে ওঠে।

ইশরাত তানিয়া: এবার অন্য একটি প্রসঙ্গে আসি। প্রকাশনা শিল্প—সাহিত্যচর্চা ও বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অথচ লেখক-প্রকাশকের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিষয় খুব প্রকট হয়ে উঠেছে। আপনার অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষণ কী বলে?
রাশিদা সুলতানা: বাংলাদেশের প্রকাশকদের বেশিরভাগের মধ্যেই পেশাদার মনোভাবের অভাব আছে। লেখকদের ঠকানোর মানসিকতা এদের অনেকের মধ্যেই আছে। প্রকাশকদের সাথে আমার অভিজ্ঞতা সুখকর না। এরা কেউ কেউ সরকার দলের অনুগত লেখক, আমলা, ক্ষমতাধরদের বাড়তি সুবিধা দেয়। অন্যদিকে ক্ষমতাহীন লেখকদের নানা ধরনের ভোগান্তির মুখোমুখি করে। দু চারজন পেশাদার ভালো প্রকাশক আছেন। এর বাইরে বেশিরভাগ প্রকাশক লেখকের সাথে নানা ধরনের প্রতারণা করে থাকেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতে আমি দেখি না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায়ও জানা নেই।

ইশরাত তানিয়া: লিটলম্যাগাজিন একটি আন্দোলনের নাম। লিটলম্যাগের লড়াই ও টিকে থাকা প্রসঙ্গে আপনার চিন্তা ভাবনা শোনা যাক।
রাশিদা সুলতানা: বাংলা সাহিত্যে লিটলম্যাগাজিন আন্দোলনের ইতিবাচক অবদান আছে। আশির দশকের লিটলম্যাগাজিন আন্দোলনের হাত ধরে বেড়ে ওঠা কবি লেখকরা বাংলা কবিতা, গল্প-উপন্যাসকে ভিন্ন ধারায় এবং উচ্চতায় নিয়ে গেছে। লিটলম্যাগ আন্দোলনে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার দর্শন শুধুমাত্র বড় দৈনিকে লেখা ছাপাব না-তে সীমাবদ্ধ ছিল না। জীবন যাপনে তাঁদের প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা ছিল। যেসব কবি লেখকরা শুরুর দিকে লিটলম্যাগ আন্দোলনের সাথে জড়িত থেকে পরবর্তীতে এ আন্দোলন ছেড়ে গেছেন, তাঁদের কেউ কেউও বাংলা কবিতা, গল্পকে সুষমামণ্ডিত করেছেন। আমি নিজে কখনোই লিটলম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলাম না। দৈনিক প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকীতে একসময় নিয়মিত আমার লেখা ছাপা হতো। কিন্তু আমার বন্ধু, গুরুস্থানীয় অনেকেই এককালে লিটলম্যাগ আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন যাঁদের মূল্যবান মতামত, পরামর্শ আমার লেখক হয়ে বেড়ে ওঠায় সাহায্য করেছে।

ইশরাত তানিয়া: ছোটবেলাটা কেমন ছিল? এখন সে ব্যাপারে শোনা যাক।
রাশিদা সুলতানা: ছোটবেলায় আমি খুব চঞ্চল প্রকৃতির ছিলাম। অনেক সাহসী আর অঘটনঘটনপটিয়সীও ছিলাম। মা বাবাকে হাজারটা প্রশ্ন করে ক্লান্ত করে ফেলতাম। সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে মা অত প্রশ্রয় দিত না। বাবার কাছে বেশি প্রশ্রয় পেতাম। আমার শৈশবে বাবা একবার গ্রামের বাড়ি যাবার সময় আমি গোঁ ধরি বাবার সাথে যাব। ঢাকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ট্রেনে যাবার সময় পুরোটা পথ বাবাকে আমি হাজারটা প্রশ্ন করি। এই গ্রামের নাম কী, ওই গ্রামের নাম কী, অনেক দূরের গ্রামের নাম কী, ওই বাজারের নাম কী, এই ক্ষেতে কিসের চাষ হয়, ওই পাখির নাম কী? পুরোটা পথ আমার বাবা ধৈর্য ধরে আমাকে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেছেন। যেহেতু বাবার কাছে প্রশ্রয় পেতাম—আমার যাবতীয় জ্ঞানতৃষ্ণা উপচে পড়ত বাবাকে কাছে পেলে। আমার বাবাও ক্লান্তিহীন আমার সকল জিজ্ঞাসার উত্তর দিয়ে যেতেন। আমার অন্তহীন প্রশ্নে কখনো বিরক্ত হতেন না। যেহেতু আমি সাহসী ছিলাম স্পষ্টভাবে যে কাউকে যে কোনো কথা রাখঢাক ছাড়া বলতে পারতাম। বাবা, মা, চাচা সবার কাছে খুব স্পষ্টভাবে যে কোনো কিছু চাইতে পারতাম। এত সাহস আমার বড় বোন এবং ছোট বোনদের ছিল না। যাই হোক আমার দুঃসাহসের কারণে রাখঢাক ছাড়া যে কোনো কথা বলে ফেলার কারণে আমার মা চাইত না আমি দুপুরে বা বিকালে পড়শিদের বাসায় যাই। আম্মা আমাকে নিয়ে সবসময় শংকায় থাকতেন কখন কোথায় গিয়ে কী বলি, কী ধরি, কী ভাঙি।
শৈশবে আমার মধুর স্মৃতি হচ্ছে বাবার কাছ থেকে গল্প শোনা। বাবা অফিস থেকে ফিরে খাওয়াদাওয়া শেষে বিছানায় শুয়ে আমাকে গল্প শোনাতেন। রূপকথার গল্প বা ঠাকুরমার ঝুলির গল্প না, বাবা গ্যালিভার-লিলিপুটদের কাহিনী বলতেন। কাসাবিয়াংকার কাহিনী বলতেন—আমার চেনা পৃথিবীর বাইরের নানা গল্প। এত আকর্ষণীয়ভাবে এইসব অচেনা পৃথিবীর গল্প বলতেন—আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম। বাবা বুঝতে পারতেন আমার এডভেঞ্চার ভালো লাগে। এডভেঞ্চারের জায়গাগুলো বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বলতেন। গ্যালিভার-লিলিপুটদের কাহিনীতে আমি এমনভাবে হারিয়ে যেতাম, আমার বাবাকে বারবার অনুরোধ করতাম এই একই গল্প বলে শোনাতে। প্রতিদিন একই রকম আকর্ষণীয়ভাবে বাবা আমাকে গল্প শোনাত।
মা অবসর পেলে ঠাকুরমার ঝুলি এবং নানা দেশের রূপকথার বই থেকে গল্প পড়ে শোনাত। এভাবে গল্প বলে বলে আমার বাবা-মা আমাকে বাসায় আটকে রাখতে চেষ্টা করত। আমার অন্য ভাই বোনেরা শৈশবে বাবা মায়ের বাধ্যগত ছিল যা আমি ছিলাম না। যখন নিজে পড়তে শিখেছি সেসময় শিশু, কিশোর পত্রিকা, বেগম, রোববার, বিচিত্রা এসব ম্যাগাজিন-পত্রিকা হকার দিয়ে যেত। আমার মা বই পড়ত। আমাদের জন্য আসত শিশু আর কিশোর পত্রিকা, বাবা রাশান অনুবাদ বই, আর পত্রিকা আসত। শিশু, কিশোর পত্রিকার ঈদসংখ্যা, উপন্যাস আর রূপকথার কাহিনী দিয়ে বইপড়া শুরু। জন্মদিনের ক্যামেরা, নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়, লালঘোড়া আমি উপন্যাসগুলো পড়ার পর এই চরিত্রদের নিয়ে, তাদের দুঃখ, তাদের এডভেঞ্চার দিনরাত্রি আমার ভাবনাজুড়ে থাকত। হাইস্কুলে ওঠার পর পাঠ্যক্রমের বইয়ের চেয়ে অনেক বেশি করে গল্প-উপন্যাস পড়তাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় সব ছোটগল্প হাইস্কুলে পড়াকালীন পড়া হয়ে গেছে। আমি গল্প-উপন্যাসের কাহিনীতে চরিত্রদের নিয়ে আচ্ছন্ন থাকতাম।


“বেশি সতর্কতা, অসতর্কতা লেখার শিল্পগুণ নষ্ট করে”
- নাসরীন জাহান


আমাদের সময় ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল না। ফলে বইপড়া, টিভি কার্টুন, সিরিয়াল দেখা ছাড়া বিনোদনও আর ছিল না। ক্লাস সেভেন এইটের পর থেকে বাইরে মাঠে গিয়ে খেলাধুলা করা বা পাড়ার ছেলেদের সাথে মেলামেশায় বাধা ছিল। অবাধ্য প্রকৃতির ছিলাম বলে আর স্কুলে রেজাল্ট খারাপ হতো বলে আমার মা আমাকে তাঁর চোখের ওপর রাখতে চাইত। বইয়ের গল্প-কাহিনীর ভিতরে আমি বাঁচতাম। দারুণ আনন্দ নিয়ে বাঁচতাম ওইসব গল্প-উপন্যাসের চরিত্র হয়ে বইয়ের চরিত্রদের কাহিনীকে কল্পনায় আরো এগিয়ে নিয়ে যেতাম। কোনো কোনো গল্প-উপন্যাসের কাহিনী দীর্ঘদিন, এমনকি বছরের পর বছর আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখত। সেসময় আমি একবারের জন্যেও স্বপ্ন দেখি নাই আমি লেখক হব। রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, মানিক বন্দোপাধ্যায়, সেবার কিশোর ক্লাসিক, তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা পড়ি। রোববার, বিচিত্রার ঈদসংখ্যার সুবাদে শওকত আলি, রাহাত খান, সৈয়দ শামসুল হক পড়ি। রাশান উপন্যাস ম্যাক্সিম গোর্কির মা পড়ি, আন্তন চেখভের গল্প পড়ি। অলেকজান্ডার বেলায়েভের ইকথিয়ান্তরকে নিয়ে কত ভাবনা ডালপালা মেলত সেসময়। শুক্রবারে বাবা বিটিভির মুভি অব দ্য উইকের সিনেমাগুলো দেখত। বাবার সাথেসাথে আমরা ভাই বোনেরাও মুভি অব দ্য উইকের জন্য অপেক্ষা করতাম। আমার প্রিয় কার্টুন ছবি থান্ডার ক্যাটস, স্মারফস, হেইডির জন্য অপেক্ষা করতাম। থান্ডার ক্যাটস নিয়ে এমন উন্মাদনা ছিল স্কুলে পড়ার সময় রাতে ঘুমের মাঝে স্বপ্নে দেখেছি আমি থান্ডার ক্যাটস দলের হয়ে চিতারার মতো যুদ্ধ করছি। থান্ডার ক্যাটসের চিতারা, এক্স ফাইলস সিরিয়ালের ডোনা স্কালি আমার জেনারেশনের মেয়েদের যোদ্ধা হয়ে ওঠার, নারীর ক্ষমতায়নের স্বপ্ন দেখিয়েছে বা যাদের তেমন স্বপ্ন ছিল তাদের স্বপ্নকে পোক্ত করেছে। আমার মা আশৈশব স্বপ্ন দেখাত আমরা মাস্টার্স, পিএইচডি করব। এমনকি বিভিন্ন নোবেল বিজয়ীদের সংবাদ, সাক্ষাৎকার পড়ার জন্য বলত আমাদের মধ্যে স্বপ্ন বুনে দেয়ার জন্য। আরেকটা ব্যাপার যা আমাকে আজকের আমি হয়ে ওঠাতে ভূমিকা রেখেছে তা হচ্ছে আমার বাবা-মা, নানী-দাদী সবাই পরোপকারী মানুষ ছিলেন। নানা-দাদাকে পাইনি, বাবা-মা, নানী-দাদী বহু অসহায় মানুষদের সাহায্য করেছেন।

ইশরাত তানিয়া: বাবা-মা, ভাই-বোন মানে আপনার পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই। লেখার জন্য পারিবারিক এবং পরবর্তীতে সাংসারিক জীবন কি অনুকূলে ছিল?
রাশিদা সুলতানা: আমরা পাঁচ ভাই-বোন। চার বোন আর আমাদের একটিমাত্র ভাই। আমরা ভাই বোনেরা একই ধরনের বই পড়ে, একই ধরনের স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়েছি। বাবা-মা সবসময় চাইতেন আমরা উচ্চতর পড়াশোনা করি। এর আগে বলেছি আমার মা প্রতি বছর কারা নোবেল পুরস্কার পেলেন সে সংবাদটাও আমাদের পড়তে দিতেন। ব্যাপারটা যে আমরা যে নোবেলজয়ী হয়ে উঠব সেজন্য না। বাবা-মা দুজনেই সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন আমরা যেন সৎ, ভালো মানুষ আর প্রজ্ঞাবান হয়ে উঠি। আর বড় স্বপ্ন দেখি। আমার এই ৪৭ বছর বয়সেও যখন আমি জাতিসংঘে চাকরি করছি, ফুলটাইম লেখালেখি করি, আমার মা প্রায় নিয়মিত অনুরোধ করেন আমি যেন পার্টটাইম পিএইচডি ছাত্রী হিসেবে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। কারণ আমার বর্তমান চাকরি না ছেড়ে আমি ফুলটাইম পিএইচডি ছাত্রী হতে পারব না। কিন্তু আমার যেহেতু আরো উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা আছে পিএইচডি শুরু করার সাহস আমার হয় না। কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহির আমাকে স্নেহ করতেন। জাপান থেকে স্কলারশিপে মাস্টার্স শেষ করে দেশে ফেরার পর তাঁকে বলেছিলাম, “স্যার পিএইচডিতে ভর্তি হব ভাবছি।” তিনি বলেছিলেন, “তুমি ভালো গল্প লিখো। পিএইচডিতে ভর্তি হলে তোমার লেখালেখির জন্য সময় পাবা না বেশ কয়েক বছর।”
আমার সাহিত্যচর্চায় আমার পরিবার সবসময় উৎসাহ দিয়েছে। কয়েকটা গল্পের বিষয়, কাহিনী নিয়ে বাবা-মা দুয়েকবার তাঁদের অস্বস্তির কথা বলেছেন। তখন সবচে বেশি সমর্থন পেয়েছি আমার ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে। সে আমার বাবা-মাকে বুঝিয়েছে, “তোমাদের মেয়ে এমন শক্তিশালী গল্পকার, তাঁর গল্পের বিষয়বস্তু নিয়ে প্রশ্ন করো না।” আমার প্রাক্তন স্বামীর সাথে সতের বছর বিবাহিত জীবন কাটানোর পর আমাদের ডিভোর্স হয়। তিনি আমার লেখালেখিতে সবসময় সমর্থন দিয়েছেন। আর অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছি আমার দুই সন্তানের কাছ থেকে।

ইশরাত তানিয়া: শুদ্ধতম অনুভূতির নাম প্রেম। আপনার চেতনায় প্রেমকে কী রূপে দেখেন? ঈশ্বরপ্রেম বলুন কিংবা নর-নারীর প্রেম বলুন। সৃষ্টিশীল মানুষের বোধে এর প্রভাব কতটুকু? মানে সৃষ্টিশীলতাকে ট্রিগার করে কি?
রাশিদা সুলতানা: প্রেমের মধ্যে ইথারায়িত হয়ে থাকার চেয়ে মধুর অভিজ্ঞতা আর কী হতে পারে? একটা মানুষের শক্তিমত্তা, অনুপ্রেরণা আর যাবতীয় অর্জনের উৎস হতে পারে প্রেম। মানুষে মানুষে প্রেম, প্রকৃতি প্রেম—সবই শিল্প-সাহিত্যে অন্তহীন প্রেরণা যোগায়। নিকষ আঁধার পৃথিবীর ওপর থোকা থোকা নক্ষত্র। হঠাৎ টুপটুপ করে নক্ষত্র ঝরে পড়ছে। আর তার ধুন্দুমার আলোর নাচন— প্রেম এমনই।

ইশরাত তানিয়া: প্রাসঙ্গিকভাবে যে প্রশ্নটি চলে আসছে—প্রেমে পড়েছেন? প্রেমের প্রথম প্রকাশ জানতে চাইছি। কেমন ছিল সে অনুভূতি?
রাশিদা সুলতানা: হ্যাঁ, পড়েছি। আমার প্রেম প্রাকৃতিক কাণ্ডের মতো কিছু একটা। ঝড়-ঝাপটা টাইপের। প্রেমের প্রথম প্রকাশও ঝড়ের মতোই ছিল। ওরকম প্রেমের উত্তেজনায় প্রতিদিন নিজেকে আবিষ্কার করার আনন্দের তুলনা হয় না। প্রতিদিনই একেবারে নতুন, নতুন মনে হয়েছে আমার প্রেম। আর এইসব জাদুর রঙ রোজ রোজ আমাকে সজীব করে তুলেছে।

ইশরাত তানিয়া: ‘দেশ’ ধারণাটিকে অন্তর্গতবোধে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করেন।
রাশিদা সুলতানা: ‘দেশ’ ধারণাটিকে ভৌগোলিক সীমারেখায় আমি দেখি না। বাংলাদেশের বাইরে যেখানে বাংলাদেশি আছে সেখানেই একেক টুকরা বাংলাদেশ আছে, আর আমার এই ‘দেশ’ ধারণায় আমার স্বপ্ন, শৈশবস্মৃতি, বাবা, মা, সন্তান, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, এই আমি হয়ে ওঠা, স্বপ্নভঙ্গ, দানবীয় পুরুষতন্ত্র, মানুষের শঠতা, পাশবিক নিষ্ঠুরতাসহ বহু কিছু অন্তর্ভুক্ত। আমার আনন্দ-যন্ত্রণা-অভীপ্সা থেকে আমার ‘দেশ’ ধারণাকে আলাদা করার উপায় নাই।

ইশরাত তানিয়া: উপমহাদেশের একটি বড় সমস্যা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নানা সঙ্কট। কিভাবে দেখেন বিষয়টি? আপনার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘রাহুর আরোহী’ গল্পে প্রসঙ্গটি এসেছে।
রাশিদা সুলতানা: এই উপমহাদেশে ধর্মের নামে, জাতীয়তার নামে ঘৃণা ছড়ানো হয়। ভিন্ন ধর্মের, গোত্রের, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী নির্যাতন-নির্মূল করার তত্ত্বকে মহৎ হিসাবে প্রচার করা হয়। উপমহাদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর নেমে আসা নির্যাতন, বৈষম্য, তাঁদের অসহায়ত্ব আমাকে ব্যথিত করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীরাও ধর্ম ব্যবসায়ীদের মতো বছরের পর বছর ধরে ঘৃণার চাষাবাদ করেছেন, করে আসছেন। আমার ‘রাহুর আরোহী’ গল্পে ১৯৭১-এ রাজাকারেরা হিন্দু কিশোর বিশ্বকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। ওই গল্পটিতে হিন্দু-মুসলমান সবার প্রতি পাকিস্তানিদের এবং রাজাকারদের নিষ্ঠুরতার বয়ান আছে।

ইশরাত তানিয়া: অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক চেতনা শিল্পের সুষমায় ঠাঁই পায়। যে কোনো (দর্শনজাত মার্কসিস্ট, অ্যান্টিমার্কসিস্ট) উপন্যাস হলে সমস্যা আছে কি?
রাশিদা সুলতানা: অরুন্ধতী রায়, অরবিন্দ আদিগা, মানিক বন্দোপাধ্যায়সহ বহু সফল ঔপন্যাসিকের উপন্যাসে, দর্শনজাত বহু গুরুত্বপূর্ণ গল্প-উপন্যাসে রাজনৈতিক চেতনা আছে। রাজনৈতিক চেতনায় সমৃদ্ধ গল্প-উপন্যাসকে শিল্প করে তুলতে পারে শক্তিমান লেখকরাই। সবাই পারে না।

ইশরাত তানিয়া: জাতিসংঘ শান্তিমিশনে সেক্টর অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে কাজ করেছেন। দারফুরে বা পূর্ব তিমুরে কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাই।
রাশিদা সুলতানা: দারফুর এবং পূর্ব তিমুরে কাজের অভিজ্ঞতা এককথায় অসাধারণ। কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু সব প্রতিকূলতাই আমার সক্ষমতাকে একেক ধাপ উপরে নিয়ে গেছে। পূর্ব তিমুরে সংঘাত এবং যুদ্ধপরবর্তী পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনে সহায়তা, নির্বাচনকালীন সংঘাত প্রতিরোধ, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, কারা ব্যবস্থা এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার, সক্ষমতা তৈরি করা, রাজনৈতিক এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে নারীর ক্ষমতায়ন, নারী নির্যাতন এবং বিভিন্ন সংঘাত প্রতিরোধ করেছে জাতিসংঘ শান্তি মিশনটি।
আমি এবং আমাদের মিশন সাপোর্ট ডিভিশান টিম মিশনে কর্মরত পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা পুলিশ, মিলিটারি, আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা এবং পূর্ব তিমুরের সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক এবং লজিস্টিক সার্ভিস এবং সাপোর্ট দিয়েছি। দারফুরেও একই ধরনের কাজ করেছি। মিশনের কেন্দ্রীয় সেক্টরের প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে শান্তি মিশনে কর্মরত সবার, আইডিপি ক্যাম্পের অসহায় মানুষদের, সুদান সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে প্রশাসনিক এবং লজিস্টিকস সংক্রান্ত সার্ভিস এবং সাপোর্ট দিয়েছি। দারফুরে পানির অভাবে আইডিপি ক্যাম্পের লাখ লাখ মানুষ সীমাহীন কষ্ট করেছে, দূর-দূরান্ত থেকে পানি আনতে গিয়ে বহু নারী ধর্ষিত হয়েছে। আমরা নলকূপ বসিয়ে তাদের পানির ব্যবস্থা করে দিয়েছি।
দারফুরে সব ধরনের সংঘাত, নির্যাতন বন্ধের জন্য এই মিশন কাজ করে যাচ্ছে। লাখ লাখ ঘরহারা লোকের, আইডিপি ক্যাম্পে থাকা মানুষের নিরাপত্তা দিতে সচেষ্ট থেকেছি। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ রোধে পুলিশ এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। চরম বিপন্ন মানুষেরা যেন বিভিন্ন দাতা সংস্থার সব ধরনের সাহায্য পায়—অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। জাতিসংঘ শান্তি মিশনের এই মহৎ যজ্ঞের আমি অংশীদার এই ভাবনা আমাকে আত্মসন্তুষ্টি দেয়। নানা দেশের নানা মানুষ, সংস্কৃতি আর বন্ধুত্বের উদযাপন—দারুণ অভিজ্ঞতা।
পূর্ব তিমুরে কাজ করার সময় কিউবার একদল ডাক্তার এবং পর্তুগিজ একদল স্কুল শিক্ষকদের সাথে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব। এঁরা পূর্ব তিমুর সরকারের সাথে কাজ করত। তাঁদের সাথে উপচে পড়া উৎসব-আনন্দে মেতেছি দিনের পর দিন। কিউবানদের, পর্তুগিজদের এবং আরো নানাদেশি বন্ধু-সহকর্মীদের উচ্ছল আনন্দ, নৃত্য দেখে কখনো মনে হয়েছে এঁরা বোধহয় পাখির গানে বা কলকাকলিতেও দলবেঁধে সবাই নেচে ওঠে। সামান্য উপলক্ষেই উৎসব-উদযাপনে মেতে ওঠে। দারফুর আর পূর্ব তিমুরে সব ধরনের মানুষের বন্ধুত্বে, উষ্ণতায় আপ্লুত হয়েছি। পূর্ব তিমুরে বন্ধুদের সাথে দলবেঁধে সমুদ্রে সাঁতার কেটেছি। স্নরকেলিং এবং স্কুবা ডাইভিং করেছি। জলের তলের অসীম সৌন্দর্য মন-প্রাণ-আত্মা খুলে দিয়ে উপভোগ করেছি। সমুদ্রে চন্দ্রাস্ত, সূর্যাস্ত দেখেছি, ভোররাতে কমলা চাঁদ টুক করে সমুদ্রে ডুবে যেতে দেখেছি। এসব অভিজ্ঞতা আমার উপন্যাসে রসদ যুগিয়েছে।

ইশরাত তানিয়া: প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিশ্বরাজনীতি কি আপনার লেখাকে প্রভাবিত করে? দারফুর বা পূর্ব তিমুরের সঙ্কট কি আপনার লেখায় এসেছে?
রাশিদা সুলতানা: পূর্ব তিমুর বা দারফুরের সঙ্কট আমার লেখায় আসে নাই। তবে এইসব সংকটের নানারূপ প্রভাব আমার অভিজ্ঞতায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এই সংকটের সাথে আমার লেখালেখির সাংঘর্ষিক কিছু নাই। বরং আমার রাজনৈতিক চেতনাকে শানিত করেছে।

ইশরাত তানিয়া: ইলেকট্রিক মিডিয়া আর স্যোশাল মিডিয়ার সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের ফলে সাহিত্য চেতনা ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসছে? আপনি কি একমত?
রাশিদা সুলতানা: হ্যাঁ আমিও তাই মনে করি। বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে তাই মনে হয়। পৃথিবীর বহু দেশে স্কুল কলেজে পাঠ্যক্রমে সাহিত্য এমনভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় যে সাহিত্যপ্রেমীর সংখ্যা কমে না। বাংলাদেশে এর একেবারে বিপরীত চিত্র। শিক্ষক-ছাত্র-নীতিনির্ধারক সবারই সাহিত্যে বিরাগ।

ইশরাত তানিয়া: সাম্প্রতিক রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে সাহিত্য কি ঘুরে দাঁড়ানোর মতো শক্তি যোগান দিতে পারে?
রাশিদা সুলতানা: যে কোনো সংকটে সাহিত্য ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি যোগান দিতে পারে। সাহিত্যের ক্ষমতা অসীম।

   

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরীকে এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসাকে রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪-এ ভূষিত করেছে।

অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানাকে নজরুল পুরস্কার ২০২৪-এ ভূষিত করেছে।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;

চতুর ঘুঘু



শরীফুল আলম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

নেশাখোরের মত কখনো কখনো খিলখিল করে হাসি
প্রথমত দহন উষ্ণতায় ,
তারপর সুবিশাল শূন্যতায় ,
কখনো কখনো ছুঁয়ে ফেলি সাজানো প্রতিমা
জীবনের দাবী ,
তবে আপাতত গন্তব্য বলে কিছু নেই আমার
কবিতার অবয়ব এখনো যেটুকু আছে
তাকে আমি রঙ্গের উৎসবই বলি
কিম্বা যেটুকু আছে তা জীবনের দাবী ।

ক্রমাগত অন্তর্গত দ্বন্দে
অবাধ্য ভাষা এখন প্রাচীর তোলে
প্রসারিত মৃত্যুর কথা বলে ,
আমি তার গল্পের শেষটা জানার চেষ্টা করি
রাতের গহ্বর থেকে তোলে আনি মৃত্যুর পরোয়ানা ,
কিন্তু অস্পষ্টতা কিছু থেকেই যায়
আবার নিজে নিজেই বলি
আমার জলভূমিতে আবার কিসের নিঃসঙ্গতা ?

স্বপ্নবাসর ? সে এক চতুর ঘুঘু
আমি তার ক্ষণিকের হটকারীতা বুঝতে পারি
এমনকি চোখ বুজে
আমি ভুলে যাই তার সন্ধ্যার ঘায়েল
যেন দেখেও দেখিনা
বিনা মোহে সারারাত অহেতুক তার অহংকার
নিরর্থক বাজি ধরে সে
অর্কিড নিরালায় আমিও একা থাকি
ভাঙ্গা চোরা রাত জেগে থাকে আমার পাশে
মনে হয় চোখ দিয়ে ছুঁয়ে দেখি তার ঢাকাঢাকি
ফিরতি নজরে সেও আমায় দেখে
আমার মিষ্টি কবিতার মতই
আমিও থমকে যাই পাখীর ডাকে
দূর দরিয়ায় তখন উলুধ্বনি শংখ বাজে ,
ইচ্ছে হয় নাগরদোলায় আবার গিয়ে দুলি
আর জানই তো কবিরাই প্রেমে পড়ে
কবিরাও চুমু খায়
সুন্দরী পেলে তাঁরাও শুয়ে পরে।

*************************
শরীফুল আলম ।
২১এপ্রিল । ২০২৪ইং
নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।

;

শিশু সুভাষচন্দ্রের চেতনায় স্বদেশপ্রেমের উন্মেষ যেভাবে



উৎপল আইচ
-নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ছবি: সংগৃহীত

-নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে আমরা প্রায় সকলেই বৃহত্তর ভারতবর্ষের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক বলে মানি এবং শ্রদ্ধা করি। তাঁর তুলনাহীন দেশপ্রেমের সামগ্রিক পর্যালোচনা শুধু একটা নাতিদীর্ঘ রচনার পরিসরে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। তাই বালক-কিশোর সুভাষচন্দ্রের জীবনে দেশাত্মবোধের অঙ্কুরোদয় আর তার উন্মেষই এই রচনার উপজীব্য থাকলো।

১৯০২ সালের জানুয়ারি মাসে ৫ বছর বয়স থেকে ১৯০৮ সালের ডিসেম্বর মাস অবধি, অর্থাৎ প্রায় ১২ বছর বয়স অবধি, দীর্ঘ ৭ বছর, সুভাষচন্দ্র ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত কটকের প্রটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান স্কুলে পড়াশুনা করেন। বিলিতি আদর্শে নিয়ন্ত্রিত এই স্কুলের বেশির ভাগ ছাত্রই ছিল ইউরোপীয় কিংবা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। যদিও এই স্কুলে খুব ভালো ইংরেজি শেখানো হতো, আসল প্রচেষ্টা ছিল ছাত্রদের মনেপ্রাণে ইংরেজ করে গড়ে তোলার। তাই বাইবেলের উপর খুব জোর দেওয়া হত। তাছাড়া গ্রেটবৃটেনের ইতিহাস ও ভূগোল, ল্যাটিন ইত্যাদি শেখানো হতো। সেই স্কুলে সংস্কৃত বা অন্য কোন ভারতীয় ভাষা শেখাবার প্রশ্নই উঠে না। তবে পড়াশুনার সাথে সাথে স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিয়মানুবর্তিতা এবং ভদ্র-ব্যবহারকে শিক্ষার বড় অঙ্গ বলে মনে করতেন।

এই স্কুলে প্রবেশের কয়েক বছর পরই বালক সুভাষচন্দ্র বঙ্গভঙ্গ-জনিত দেশের রাজনৈতিক নবজাগরণের ব্যাপারটা বুঝতে শিখেছিলেন। প্রথম দিকে না বুঝতে পারলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটাও অনুভব করতে পারলেন যে তাঁদের বাড়ির বা তাঁদের সমাজের জীবন আর স্কুলের জীবন একদম ভিন্ন ধরণের। সুভাষচন্দ্র এও জানলেন যে ভারতীয়রা পরীক্ষায় সর্বোচ্চ স্থানাধিকারী হলেও শুধুমাত্র ভারতীয় বলে স্কলারশিপ-পরীক্ষা দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তাছাড়া, ইউরোপীয় এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছেলেরাই ভলান্টিয়ার কোর-এ যোগ দিতে পারে, বন্দুক ব্যবহার করা শিখতে পারে যা ভারতীয় ছাত্রদের জন্য নিষিদ্ধ।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ‘অ্যান ইন্ডিয়ান পিলগ্রিম’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এইসব ছোটোখাটো ব্যাপার থেকেই আমাদের চোখ খুলতে শুরু হল, বুঝলাম যে এক বিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় হিসাবে আমরা কতটা আলাদা’ (“Small incidents like these began to open our eyes to the fact that as Indians we were a class apart, though we belonged to the same institution.”) । সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীর শুরুতেই লিখেছেন যে তাঁর মন স্পর্শকাতর এবং তিনি একজন অন্তর্মুখী ব্যক্তি। (“I was and still remain an introvert.”) সুভাষচন্দ্র সেই আত্মজীবনী অসুস্থ অবস্থায় ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে দশদিনে অস্ট্রিয়ার ব্যাডগাসটেন-এ অবস্থানকালে লিখেছিলেন। তিনি সেখানে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য গিয়েছিলেন।

আত্মজীবনীতে তিনি আরও লিখেছেন, “সব কিছু বিচার করে আমি এখন একজন ভারতীয় বালক বা বালিকাকে এরকম স্কুলে পাঠাবো না। সে নিশ্চিত সুসমন্বয়ের অভাবে এবং তজ্জনিত অশান্তিতে ভুগবে, বিশেষতঃ সে যদি স্পর্শকাতর স্বভাবের হয়। (“Considering everything, I should not send an Indian boy or girl to such a school now. The child will certainly suffer from a sense of mal-adaptation and from consequent unhappiness, especially if he or she is of a sensitive nature.”)

১৯০৯ সালের জানুয়ারি মাসে সুভাষচন্দ্র কটকের র‍্যাভেন্-শ কলেজিয়েট স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে (এখনকার হিসাবে সপ্তম শ্রেণিতে) ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি চার বছর পড়াশুনা করে ১৯১৩ সালের মার্চ মাসে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। সুভাষচন্দ্র বসু যখন র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন তখন সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রী বেণীমাধব দাস। সুভাষচন্দ্রের বয়স তখন ১২ বছর। কিশোর সুভাষ তার আগে এক বর্ণও বাঙলা পড়েননি। এদিকে তাঁর সহপাঠীরা সবাই বাঙলায় পারদর্শী ছিল। কিন্তু চরম অধ্যবসায়ী সুভাষ এক বছরের মধ্যেই বাঙলাটা রপ্ত করে ফেলেন। সংস্কৃতের ব্যাপারও একই কথা বলা যায়। এই নতুন স্কুলে তাঁর বন্ধুও জুটে যায় যেটা প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান স্কুলে হয়নি।

সুভাষচন্দ্র ছিলেন নিরহংকারী এবং প্রচারবিমুখ মহাপুরুষ, তাই অনেক কথা বিস্তারিতভাবে আত্মজীবনীতে লেখেননি বা হয়তো আত্মপ্রশংসা হবে মনে করে এড়িয়ে গেছেন। র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে তাঁর বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী ছিলেন শ্রী চারুচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি সুভাষচন্দ্রদের প্রতিবেশীও ছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য যে চারুচন্দ্র তাঁর স্মৃতি রোমন্থন করে শ্রী সুবোধচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়ে “সুভাষচন্দ্রের ছাত্রজীবন” নামে একটা বই লিখে গেছেন। তাঁর কাছ থেকে আরো অনেক তথ্য জানা যায়। এছাড়া অন্যান্য সূত্র থেকেও কিছু নতুন তথ্য জানা যায় এবং কিছু তথ্যের সমর্থন মেলে।

প্রথম ভর্তি হবার দিন সুভাষচন্দ্র কোট-প্যান্ট পরে র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে গিয়ে দেখতে পান যে সমস্ত শিক্ষক এবং অন্যান্য সব ছাত্ররা দেশীয় পোশাক পরে আছেন। তার পরদিন থেকে তিনিও ধুতি-পাজ্ঞাবি পরে স্কুলে যেতে শুরু করেন। সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে ক্ষুদিরাম বসুর নাম উল্লেখ না করে লিখেছেন যে ১৯০৮ সালে যখন প্রথম বোমা নিক্ষেপ করা হয় তখন চারদিকে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল এবং তাঁদের মধ্যেও সাময়িক উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে এও লিখেছেন যে সেসময় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে, স্বদেশি জিনিস ব্যবহারের পক্ষে মিছিল ও আন্দোলন চলছিল এবং তাঁরা কিছুটা সেদিকে ঝুঁকেছিলেন, কিন্তু বাড়ির নিষেধ থাকায় রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। তবে তাঁরা বিপ্লবীদের ছবি কেটে কেটে পড়ার ঘরে টাঙিয়ে রাখতেন। এক আত্মীয় পুলিশ অফিসার দেখে ফেলায় সেগুলোও পরে অপসৃত হয়েছিল এবং এতে তাঁদের মন খারাপ হয়েছিল।

আমরা “সুভাষচন্দ্রের ছাত্রজীবন” গ্রন্থ থেকে জানতে পারি যে, ১৯১১ সালের ১১ আগস্ট তারিখে র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র (বর্তমান নবম শ্রেণি) সুভাষচন্দ্র নিজ উদ্যোগে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির তৃতীয় বাৎসরিক স্মরণ দিবস উপযুক্ত ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালন করেছিলেন স্কুলে এবং র‍্যাভেন্শ কলেজ ও স্কুল হোস্টেলে। সুভাষচন্দ্রের প্রস্তাব মত সব ছাত্ররা উপবাস করে এই পূণ্য দিনটি অতিবাহিত করেছিল সেদিন। অবশ্য এর পরিণতি ভালো হলোনা; ডিভিশনাল কমিশনারের কাছে খবর পৌঁছে যায় আর ফলস্বরূপ ম্যাজিষ্ট্রেট এই বিষয়ে তদন্ত করে প্রধান শিক্ষক শ্রীবেণীমাধব দাসকে কটক থেকে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে বদলি করে দেয়।

র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই সুভাষচন্দ্র শিক্ষক শ্রীবেণীমাধব দাসের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্বের জন্য। তিনি প্রধান শিক্ষককে মনেপ্রাণে শ্রদ্ধা করতে শুরু করেন। যেহেতু বেণীমাধববাবু দ্বিতীয় শ্রেণির নীচে কোন ক্লাস নিতেন না তাই অধীর আগ্রহে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠার জন্য অপেক্ষায় থেকে যখন সেই সুযোগ সুভাষচন্দ্র পেলেন তখন তাঁর সে ভাগ্যও দীর্ঘস্থায়ী হলো না। তবে এই কয়েক মাসের মধ্যেই শ্রী বেণীমাধব দাস ছাত্র সুভাষের মধ্যে একটা নৈতিক মূল্যবোধ জাগিয়ে দিয়ে গেলেন।

এই বিচ্ছেদ সুভাষের জন্য খুব বেদনার হয়েছিল কিন্তু তাঁর সাথে বেণী মাধবাবুর চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রইল। সুভাষচন্দ্র আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, প্রকৃতিকে কিভাবে ভালবাসতে হয়, প্রকৃতির প্রভাবকে জীবনে কিভাবে গ্রহণ করতে হয় তা মাস্টারমশাই শ্রী বেণীমাধব দাসই তাঁকে শিখিয়েছিলেন। প্রকৃতি তো দেশমাতৃকারই অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ। কিন্তু মাস্টারমশাই যে তাঁকে স্বদেশপ্রেম শিখিয়েছেন তা অবশ্য স্পষ্ট করে সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেননি। হয়ত ১৯৩৮ সালে ছাপা বইতে তেমন কিছু কথা লিখে বেণীমাধব বাবুকে ইংরেজ-পুলিশের কুনজরে পড়তে দিতে চাননি।

বেণী মাধববাবুর বদলির কিছুদিন পর থেকেই সুভাষচন্দ্র বয়ঃসন্ধিজনিত কিছু মানসিক অশান্তিতে ভুগছিলেন। সৌভাগ্যবশতঃ ঠিক এই সময়ই তিনি কটক শহরে নবাগত এক আত্মীয়ের বাসায় অপ্রত্যাশিতভাবে স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলী পেয়ে যান এবং তা অতি উৎসাহে পড়ে ফেলেন। সুভাষচন্দ্র বুঝতে পারেন যে এই জিনিষই তিনি এতদিন ধরে খুঁজছিলেন এবং এগুলোর মধ্যেই তিনি তাঁর মানসিক অশান্তির সমাধান খুঁজে পেলেন। স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের আদর্শই সুভাষচন্দ্র হৃদয়ঙ্গম করে নিলেন, যার মূল কথাটা হল, “আত্মনঃ মোক্ষার্থম জগৎহিতায় চ” অর্থাৎ ‘মানবজাতির সেবা এবং আত্মার মুক্তি’।

মানবজাতির সেবা বলতে স্বামী বিবেকানন্দ স্বদেশের সেবাও বুঝিয়েছেন। স্বামীজীর প্রধান শিষ্যা এবং জীবনীকার ভগিনী নিবেদিতা আমাদের জানিয়েছেন যে, মাতৃভূমিই ছিল স্বামী বিবেকানন্দের আরাধ্যা দেবী। আত্মজীবনীতে সুভাষচন্দ্র আরও লিখেছেনঃ ‘একটি বক্তৃতায় স্বামীজী বলেছেন, “সদর্পে বল মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী, আমার ভাই।”

নেতাজী সুভাষচন্দ্র লিখেছেন যে তাঁর বয়স যখন ১৫ ছুঁই ছুঁই, ঠিক তখন বিবেকানন্দ তাঁর জীবনে প্রবেশ করলেন; বিবেকানন্দের প্রভাব তাঁর জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিল এবং তিনি স্বামী বিবেকানন্দের পথই বেছে নিলেন। বিবেকানন্দের সাথে সাথে তাঁর গুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রতিও সুভাষচন্দ্র আকৃষ্ট হলেন এবং কটকে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভক্তবৃন্দের একটা সংগঠন গড়ে তুললেন। সেই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল অধ্যাত্মচর্চা করা আর দুঃস্থের সেবা করা। স্কুল ছাড়ার সময় যত এগিয়ে আসছিল, সুভাষের মধ্যে ধর্মভাব আর মানবসেবা করার প্রবণতা ততই বেড়ে যাচ্ছিল। লেখাপড়ায় আর মন বসছিল না।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শিশু সুভাষ (দণ্ডায়মান, ডান থেকে প্রথম)

এরপর ১৯১২ সালের অক্টোবর মাসে মহাসপ্তমীর দিন কৃষ্ণনগর থেকে মাস্টারমশাই শ্রী বেণীমাধব দাসের পরিচয়পত্র নিয়ে হাজির হলেন সুভাষেরই সমবয়সী একই (ফার্স্ট) ক্লাসের ছাত্র শ্রী হেমন্তকুমার সরকার। হেমন্ত কলকাতার একটা রাজনৈতিক দলের সভ্য ছিলেন যাদেরও আদর্শ ছিল আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং দেশসেবা। সেই প্রথম সুভাষ ও তাঁর কটকের বন্ধুরা প্রথমবারের মত কলকাতার রাজনৈতিক প্রেরণার আস্বাদন পেলেন। হেমন্তের কাছে তাদের দলের নানাবিধ কাজের বর্ণনা শুনে সুভাষচন্দ্র মুগ্ধ হলেন।

হেমন্ত একদিন সুভাষের দলের ছেলেদের দেশের প্রতি তাদের কর্তব্য সম্বন্ধে অনুপ্রাণিত করে একটা আবেগময় বক্তৃতাও দিলেন। এইসঙ্গে সুভাষচন্দ্রের সাথে তাঁর নিবিড় সখ্যতাও গড়ে উঠল। চারদিন কটকে থেকে বিজয়া দশমীর সন্ধ্যায় হেমন্তকুমার পুরী চলে গেলেন এবং কলকাতায় ফিরে গিয়ে তাঁর দলের প্রধানকে সব জানালেন। সেই দলনেতা চিঠির মাধ্যমে কটকের এই দলটার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন এবং কয়েক বছর এই যোগাযোগ ছিল।

হেমন্তকুমার পরে তাঁকে লেখা সুভাষের বেশ কিছু চিঠি প্রকাশ করেন যার থেকে সুভাষচন্দ্র বসুর কৈশোরের এবং যৌবনের অনেক কথা জানা যায়। তিনি তাঁর বিখ্যাত “সুভাষের সঙ্গে বারো বছর (১৯১২ – ১৯২৪)” বইতে জানান যে, সুভাষের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময়ই তাঁদের মধ্যে স্থির হয়েছিল যে পাশ করে তাঁরা চাকরি করবেন না এবং সুভাষ আই-সি-এস আর হেমন্ত আই-ই-এস-এ ঢুকে সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে চাকরি-মোহগ্রস্ত বাঙালীর সামনে আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন।

১৯১৩ সালের ১ মার্চ সুভাষচন্দ্র আর হেমন্তদের ম্যাট্রিক পরীক্ষা শুরু হয়। দুজনেই তাঁদের এই নূতন বন্ধুত্বের আর নতুন জীবনের আলোড়নে পড়াশুনায় তেমন মন দিতে পারেন নি। সুভাষচন্দ্র তো তারও আগে থেকেই পড়াশুনায় অমনোযোগী হয়ে গিয়েছিলেন। তৎসত্ত্বেও সুভাষ ৭০০-র মধ্যে ৬০৯ নম্বর পেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। পরীক্ষার পর আগের পরিকল্পনা মত সুভাষচন্দ্র কিছুদিনের জন্য হেমন্তের কাছে কৃষ্ণনগরে যান।

কলকাতার দলের কয়েকজন সদস্যও সেখানে আসেন এবং তাঁরা সদলবলে পলাশী, মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি ঐতিহাসিক স্থানগুলি দেখতে বের হন। পলাশীতে তাঁরা দেখতে পান যে সেই আম্রকানন আর নেই আর লর্ড কার্জনের আদেশে বিজয় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। হেমন্ত নবীনচন্দ্র সেনের “পলাশীর যুদ্ধ” আবৃত্তি করতে করতে যখন নবাব সিরাজদৌল্লার সেনাপতি মোহনলালের মুখনিঃসৃত অংশে আসেন তখন সুভাষচন্দ্র আর চোখের জল চেপে রাখতে পারেন না। তাঁর দলের সেই ভ্রমণ সাতদিনে সমাপ্ত হয়েছিল।

এরপর সুভাষচন্দ্র কলকাতায় এসে তাঁর বড় দাদাদের মত প্রেসিডেন্সি কলেজে আই এ ক্লাসে ভর্তি হলেন ১৯১৩ সালের জুলাই মাসে। তখন তাঁর বয়স সাড়ে ষোল। ভর্তি হওয়ার সাথে সাথেই তিন মাসের গ্রীষ্মের বন্ধ হয়ে যায়। সেই তিন মাসে তিনি কলকাতার সেই দলটাকে খুঁজে বার করলেন আর পছন্দমত কিছু নতুন বন্ধুও জুটিয়ে ফেললেন। কটকের পরিবেশ আর কলকাতার পরিবেশে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

অবশ্য এর প্রায় বছর দেড়েক আগে স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার সমাপ্ত হয়েছে। বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছে তবে তার জন্য বঙ্গ প্রদেশকে (বাংলা প্রেসিডেন্সিকে) অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। হিন্দী-উড়িয়া-অসমীয়া-ভাষী অঞ্চলগুলোকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে আর ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। তবে এই স্বদেশী আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামকে এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং এজন্য সশস্ত্র বিপ্লব আন্দোলনের তৎপরতাও বৃদ্ধি পেয়েছিল।

সুভাষের আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে এসময় সুভাষচন্দ্র শ্রীঅরবিন্দের লেখা ও চিঠিপত্র পড়ে তাঁর প্রতিও আকৃষ্ট হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের কিছু ছাত্রদের মধ্যেও এই বিপ্লবী চিন্তাধারা সক্রিয় ছিল। কিন্তু সুভাষচন্দ্র কলকাতায় এসেছিলেন মানবসেবা আর আধ্যাত্মিক উন্নতির সঙ্কল্প নিয়ে, যদিও তাঁর মধ্যে বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতি ছিল এবং স্বদেশচিন্তা তাঁকে গভীরভাবে আলোড়িত করত। আত্মজীবনীতে সুভাষচন্দ্র লিখে গেছেন, ‘কলেজ-জীবনে প্রবেশ করবার সময় জীবন সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা জন্মে গিয়েছিল। বুঝেছিলাম যে জীবনের একটা উদ্দেশ্য আছে এবং এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য নিয়মিত শরীর ও মনের অনুশীলনের প্রয়োজন।’

এসময় তাঁর সাথে কয়েক মাস আগে প্রয়াত বিখ্যাত কবি, নাট্যকার, গীতিকার, স্বদেশী-সংগীতস্রষ্টা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপ কুমার রায়ের বন্ধুত্ব হয়। দিলীপ কুমার রায় সুভাষচন্দ্রের সমবয়সী ছিলেন এবং সেবছরই প্রেসিডেন্সি কলেজে আই-এস-সি ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁরা কাছাকাছিই থাকতেন। সুভাষ একদিন দিলীপকুমারের বাড়ীতে এসে দিলীপকুমারকে তাঁর উদ্যোগে কলেজে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিতর্কসভায় যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানান। সেই প্রথম পরিচয়ের বর্ণনা খুবই সুন্দর।

সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন যে, আমাদের দেশে তর্ক-বিতর্কের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে কারণ স্বাধীনতার জন্য বড় বড় বক্তার, বাক-যোদ্ধার খুব প্রয়োজন। শ্রী দিলীপকুমার রায় তাঁর “আমার বন্ধু সুভাষ” বইতে লিখেছেন যে তিনি বলেছিলেন, রামকৃষ্ণ তো বলে গেছেন তর্ক দিয়ে সত্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। সুভাষচন্দ্র উত্তরে বলেছিলেন, “তিনি কি বলেছিলেন তাতে আমাদের দরকার কি? ... আমাদের গড়ে তুলতে হবে ভবিষ্যৎকে। কেন, আপনার বাবা কি বলেননিঃ ‘চোখের সামনে ধরিয়া রাখিয়া অতীতের সেই মহা আদর্শ, জাগিব নূতন ভাবের রাজ্যে রচিব প্রেমের ভারতবর্ষ?” দিলীপকুমার আশ্চর্য হয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘তাঁর কবিতা আপনার মনে আছে?’ উত্তরে সুভাষের দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তিনি বলেছিলেন, “অন্তরে গাঁথা আছে।”

সুভাষের দলের সকলেই ব্রহ্মচর্যের ব্রত নিয়েছিলেন। দলের প্রধান লক্ষ্য ছিল ধর্ম আর জাতীয়তাবাদের সমন্বয় ঘটানো – শুধু চিন্তায় নয় কাজের মাধ্যমে। তাঁর দলের ছেলেরা নতুন নতুন ভাবধারার সন্ধানে দর্শন, ইতিহাস, জাতীয়তাবাদের উপর বই খুঁজে খুঁজে পড়তেন এবং নিজেদের মধ্যে তা আলোচনা করতেন। তাছাড়া নতুন সদস্য সংগ্রহ করতেন এবং নামকরা লোকদের সাথে আলাপ পরিচয় করতেন। এছাড়া সাধু-সন্তদের সন্ধানে থাকা এবং ছুটির সময় তীর্থস্থানে তাঁদের সন্ধান করাও একটা কাজ ছিল। ১৯১৩ সালে বড়দিনের ছুটিতে তাঁরা দলবেঁধে গিয়ে কলকাতা থেকে ৫০ মাইল দূরে শান্তিপুরে কিছুদিন গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী হয়ে বাস করেছিলেন। ১৯১৪ সালে তাঁরা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সাথেও দেখা করতে গিয়েছিলেন। বেলুড় রামকৃষ্ণ মঠ ও অন্যান্য জায়গায় প্রায়ই যেতেন। দক্ষিণ কলকাতার অনাথ ভাণ্ডার দরিদ্র সেবা প্রতিষ্ঠানের জন্য রবিবার বাড়ি বাড়ি ঘুরে অর্থ ও চালডালও সংগ্রহ করেছেন।

সেসময় কলেজে অধ্যাপকদের পড়ানো সুভাষচন্দ্রের একঘেয়ে লাগতো। এই একঘেয়েমি কাটানোর জন্য জনহিতকর কাজে মেতে থাকতেন। বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা, বন্যা বা দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য টাকা তোলা, সহপাঠীদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়া–এই ধরণের কাজ তাঁর ভালো লাগত। প্রথম বছরের কলেজের ছুটিতে কটক গিয়ে কাছের একটা গ্রামে কলেরা হওয়ায় সে গ্রামে রোগীর শুশ্রূষা করতেও যান। সেই এক সপ্তাহে তিনি দেশের দারিদ্র্য, মৃত্যুর তাণ্ডবলীলা আর নিরক্ষরতার অভিশাপ প্রত্যক্ষ করেন। কলকাতায় ফিরে এসে ষাট মাইল দূরে কৃষ্ণনগরে এক উদাসী পাঞ্জাবী শিখ তরুণ সাধুর সন্ধান পেয়ে হেমন্তকে নিয়ে পায়ই তাঁর কাছে যেতে শুরু করেন। সেই সন্ন্যাসীকে দেখে সুভাষের মনে দীক্ষা নেবার ইচ্ছা জাগে।

১৯১৪ সালের গরমের ছুটির সময় সুভাষচন্দ্র প্রায় দুমাস গুরু খুঁজতে উত্তর ভারতের প্রায় সবকটা তীর্থস্থান ঘুরে বেড়ান। বাড়িতে শুধু একটা পোস্টকার্ড পাঠিয়ে জানিয়েছিলেন মাত্র। এই তীর্থভ্রমণের সময় হিন্দু সমাজব্যবস্থার মূল গলদগুলি তাঁর কাছে ধরা পড়ে। অবশ্য অনেক প্রকৃত ধার্মিক সন্ন্যাসীরও দর্শন পান। সেখান থেকে ফিরে এসে কিছুদিনের মধ্যেই সুভাষচন্দ্র টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হন। সেবার তাঁর ৬৩ দিন জ্বর ছিল। জ্বর সেরে গেলে সুভাষচন্দ্র স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে কার্সিয়াং গিয়ে এক মাস থেকে আসেন। এরপর ১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসে হেমন্ত ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হন এবং সুভাষ কৃষ্ণনগরে গিয়ে বন্ধুর সেবা করেন। এসব গোলযোগে পড়াশুনার ব্যাঘাত হওয়ায় ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ফল ভাল হলনা। তবুও ১৯১৫ সালে তিনি ফার্স্ট ডিভিশনে আই এ পাশ করেছিলেন এবং দর্শনে অনার্স নিয়ে একই কলেজে বি এ ভর্তি হলেন।

কৈশোরে সুভাষচন্দ্র বসু

১৯১৬ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাস সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনে একটা তাৎপর্যপূর্ণ সময়। তখন তাঁর বয়স ১৯ বছর। ঘটনাটা সবার জানা। অনেকেই এই সম্বন্ধে বিস্তারিত লিখেছেন। তাই খুব সংক্ষেপে সেই ঘটনাটার বিবরণ দিয়ে এই লেখাটা শেষ করব। প্রেসিডেন্সি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন এডওয়ার্ড ফারলে ওটেন। এই ইংরাজ অধ্যাপক ছিলেন I.E.S. (ইন্ডিয়ান এডুকেশান সার্ভিসের সদস্য) এবং বর্ণবিদ্বেষী। তিনি ১৯১৫ সালে ইডেন হিন্দু হোস্টেলে আমন্ত্রিত হয়ে ভাষণ দেন এবং সেই বক্তৃতায় ভারতীয়দের সম্বন্ধে খারাপ মন্তব্য করেন। অসন্তুষ্ট হলেও তাঁকে সভাপতি করে ডেকে আনা হয়েছে বলে ছাত্রেরা সেদিন কোন গোলযোগ করেনি। কিন্তু ১০ জানুয়ারি ১৯১৬ তারিখে তিনি কয়েকজন ছাত্রকে কলেজের বারান্দায় ধাক্কা দেন।

ছেলেরা যেহেতু থার্ড ইয়ার অর্থাৎ বি এ ফার্স্ট ইয়ারের ছিল এবং সুভাষচন্দ্র সেই ক্লাসের প্রতিনিধি ছিলেন, তিনি অধ্যক্ষ মিঃ এইচ আর জেমসের কাছে গিয়ে প্রতিবাদ জানান। অধ্যক্ষ মিঃ জেমস জানান, যেহেতু অধ্যাপক ওটেন ইন্ডিয়ান এডুকেশান সার্ভিসের সদস্য তাই তিনি অধ্যাপক ওটেনকে শাসন করতে পারবেন না। পরদিন ছাত্ররা ধর্মঘট শুরু করে এবং ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিন কর্তৃপক্ষ ওটেনকে চাপ দিলে ওটেন ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলেন। কিন্তু প্রায় একমাস পর ওটেন একই কাজ করে ফেলেন।

যদিও সেবারের ছাত্রটি আই এ ফার্স্ট ইয়ারের ছিল, সুভাষচন্দ্র ছাত্র-প্রতিনিধিদের মিটিংয়ে জানান, এই অধ্যাপককে এভাবে শোধরানো যাবে না এবং তাকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে। ছাত্র-প্রতিনিধিদের সভায় তাঁর এই প্রস্তাব অনুমোদিত হয় এবং পরদিন, ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯১৬, মিঃ ওটেন কলেজের করিডোরে প্রহৃত হন। এই ঘটনার জন্য সুভাষচন্দ্র এবং শ্রী অনঙ্গ মোহন দাম কলেজ ও ইউনিভারসিটি থেকে বহিষ্কৃত হন। যদিও সুভাষচন্দ্র নিজে মিঃ ওটেনকে প্রহার করেননি, তিনি নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে চুপ করে থাকেন। সত্যি বলে দায়িত্ব এড়িয়ে বহিষ্কার এড়াতে রাজি হন না।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ছোটবেলায় প্রথমে তিনি ইংরেজি শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেছেন এবং ইংরেজদের সঙ্গে মিশেছেন। তারপর তিনি নিজের দেশের সংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচিত হন। যখন তিনি স্কুলে পড়েন তখন বিভিন্ন প্রদেশের ছেলেদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। মুসলমানদের সম্বন্ধে উদারতার জন্য তাঁর ছেলেবেলার অভিজ্ঞতাই বহুল পরিমাণে দায়ী। তাঁদের কটকের বাড়ী ছিল মুসলমান এলাকায় এবং প্রতিবেশীরা বেশীরভাগই ছিল মুসলমান। তাঁর বাবাকে সবাই খুব শ্রদ্ধা করতেন।

তাঁরাও মুসলমানদের উৎসব অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। তাঁদের বাড়ীর কাজের লোকেরা অনেকেই মুসলমান ছিলেন এবং তাঁরাও সুভাষচন্দ্রদের খুব অনুরক্ত ছিলেন। স্কুলে মুসলমান শিক্ষক আর ছাত্রদের সাথেও তাঁদের খুব সৌহার্দ্য ছিল। মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করা ছাড়া কোন ব্যাপারেই তিনি কোন প্রভেদ দেখতেন না। এই জন্যই আজাদ হিন্দ ফৌজে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিষ্টান-সব ধর্মাবলম্বীরা এক হয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পেরেছিল।

বাল্যকাল আর কৈশোর ছিল সুভাষচন্দ্রের প্রস্তুতির সময়। যে দেশপ্রেম তাঁর পরবর্তী জীবনে প্রস্ফুটিত হয়েছে, তার ব্যাপকতা, গভীরতা, বিস্তীর্ণটা ইত্যাদি বুঝতে হলে তাঁর বাল্যকাল আর কৈশোরকে ভাল করে জানতেই হবে। যারাই নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনী অধ্যয়ন করেছেন তাঁরাই একমত হবেন যে তিনি এই উপমহাদেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক।

পূর্বেই বলেছি, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মধ্যে কোন প্রাদেশিক, ধার্মিক বা জাতপাতের সঙ্কীর্ণতা ছিল না। তিনি মনে করতেন, ধর্ম যার যার নিজস্ব ব্যাপার। তিনি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে দেশের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন এবং তাঁর এই দেশপ্রেম কৈশোরেই অঙ্কুরিত হয়েছিল। এমনকি তিনি যে আই.সি.এস পাস করে তা থেকে পদত্যাগ করবেন তাও সেই কৈশোরেই স্থির করে ফেলেছিলেন। বালক-কিশোর সুভাষচন্দ্রই পরে নেতাজী হয়ে আমাদের দেশকে ইংরেজের হাত থেকে স্বাধীন করেছিলেন।

সেসময়কার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এ্যাটলি নিজমুখে একথা স্বীকার করে গেছেন। শুধু দুঃখের কথা এই যে কিছু স্বার্থান্বেষী নেতার জন্য যে অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন নেতাজী দেখেছিলেন, তা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। আজ এত বছর পর নেতাজীর আকাঙ্ক্ষিত বৃহত্তর ভারতের প্রয়োজনীয়তা কিছুটা হলেও আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। নেতাজীর জীবনযাপন, চিন্তাভাবনা, কার্যকলাপ সব একটি মাত্র আবেগ দ্বারাই সঞ্চালিত হয়েছে এবং তা হচ্ছে দেশপ্রেম।

অহিংসার পূজারি গান্ধীজী পর্যন্ত তাঁকে “Patriot of Patriots” আখ্যা দিতে বাধ্য হয়েছেন। নেতাজীর দেশপ্রেম নেলসন ম্যান্ডেলা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আরও অনেককে অনুপ্রাণিত করেছে। আজও ভারতবাসী এবং বাঙালী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর তুলনাহীন দেশপ্রেম থেকে অনুপ্রাণিত হন। যতদিন মানবজাতি থাকবে এবং দেশপ্রেম আলোচিত হবে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জনক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নাম পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হবে। জয়তু নেতাজী।।

লেখক: সাবেক কুটনীতিক ও ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু, নয়াদিল্লি; ভারত। ইমেল: [email protected]

;