সাধারণ মৃত্যুর জীবনচক্র



মেহেদী ধ্রুব
অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

কে যায়? কারা যায়? ওটা কিসের ঘ্রাণ? কালো মুখোশের? যাই, একটু দেখে আসি, হ্যাঁ, ওই তো কালো মুখোশেরা যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে? এই জগতে কাকে নিয়ে আসবে? অন্ধকার নেমে এলে ওরা বের হয়, আলো ফোটার আগেই বাতাসে মিলিয়ে যায়; এই জায়গায় মুখোশদের সাথে আমাদের হুবুহু মিল; এই যে গাঢ় হচ্ছে অন্ধকার, এই যে ওরা বের হয়ে হচ্ছে, আমিও তবে বের হই; আহ্, কী শান্তি! এসো হে অন্ধকার, এসো, এসো; আজ আমি তন্নতন্ন করে খুঁজব, আমি আমার ঠল্লইটা খুঁজে পাচ্ছি না, গুলাইটাও খুঁজে পাচ্ছি না, কোথায় যে রেখেছিলাম; মরে যাবার এই এক অসুবিধা, কিছুই মনে থাকে না; অহ্, আপনারা ‘ঠল্লই’ চিনেন তো? ‘গুলাই’ দেখেছেন তো? বাঁশ দিয়ে ঠল্লই বানানো হয়, এটাকে বাঁশের বন্দুকও বলা যায়; ঠল্লইয়ের এক ছিদ্রে দাতই ফল বা পিছন্দি ফল বা বাজনা ফল ঢুকিয়ে কাঠি দিয়ে জোরে ঠেলা দিলেই অন্য ছিদ্র দিয়ে বুলেটের মতো বেরিয়ে যায়, আর গুলাইয়ের কথা কী বলব, এটা আপনারা কম বেশি দেখেছেন, আজ সারারাত এগুলো খুঁজব।

এই ডিসেম্বরে আমার মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু একদিন আমি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েছিলাম, সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পরে কী যে হলো, আমি হয়ে গেলাম নেতা, পত্রিকায় আমার নাম, টিভিতে আমার নিউজ, টকশোতে আমি, সেসব দেখে আমি ভীষণ মজা পেতাম, তখন কত মহল থেকে যে আমার সাথে যোগাযোগ করা হতো, এই দল, সেই দল, আমিও কী এক নেশায় পড়ে গেলাম, সারাক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে থাকতাম; কী করব, কী করব করে অস্থির হয়ে কত কী যে করেছি, কত কী যে খেয়েছি; এক সময় আমি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেলাম; কী বিস্ময়কর জীবন! লাস্ট যাকে খতম করার অর্ডার পাই, সে ছিল বিগ ফিশ, কিন্তু বিগ ফিশকে খতম করার পরে যে আমার খেইলও খতম হয়ে যাবে কে জানত।

আমি যেদিন মারা যাই সেদিন সেইফ হোমেই ছিলাম, একটার পর একটা সিগারেট টানছিলাম আর ক্রাইম-থ্রিলার দেখছিলাম, কিন্তু মিড নাইটের দিকে কে বা কারা আমার দরজায় নক করে, আমি দরজা খুলি না, তারপর দরজায় সে কী লাত্থি, আমি কে কে বলে চিৎকার করি, মেশিনটা রেডি করি, লাইট অন করি, ততক্ষণে রুমে ঢুকে গেল ওরা, দেখি কালো কালো মুখোশ, কয়েক মিনিট ধস্তাধস্তির পরে ওরা আমার হাত-মুখ-চোখ বেঁধে ফেলে, তারপর একটা কারে তোলে, সম্ভবত মাইক্রোবাস হবে, অনেকক্ষণ চলে মাইক্রোবাস, আমার দম বন্ধ হয়ে আসে, কোথা থেকে যেন আজানের সুর কানে আসে; হঠাৎ মাইক্রোবাস থেমে যায়, আমি বুঝতে পারি কিছু একটা হতে যাচ্ছে; আব্বা-আম্মার কথা খুব মনে পড়ছে, বোনগুলোর কথাও; আব্বা কি এখনো ইটের ভাটায় কাজ করে? অথচ সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর আমার কথা-বার্তা, চাল-চলন বদলে গেল, বাড়ির সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম; কত কথা যে মনে পড়ে; তখন একজন ধমক দিয়ে বলে ‘বাঁচতে চাইলে দৌড়া’, আমি দৌড় দেই না, ওদের পায়ে পড়তে যাই, কিন্তু কিছুই খুঁজে পাই না; আবারো বলে, ‘দৌড় দিবি নাকি গুলি করব?’ আমার দিনমজুর আব্বা বলতেন জান বাঁচানো ফরজ, আমি ফরজ আদায় করার জন্য দৌড়াই, আর...; একবার মাত্র ‘মাগো’ বলে চিৎকার দিতে পারি।

এখন আমি টাউন হলের দেয়ালের ফাটলে থাকি, এই কয়দিনে মাত্র একজনের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে, যে লোকের সাথে পরিচয় হয়েছে সে লোক সারারাত সিন্দুক খোঁজে; যাই, লোকটার সাথে একটু কথা বলে আসি, ফেরার সময় আব্বার হাতে বানানো ঠল্লই-গুলাইও খুঁজে দেখা যাবে, যাই :
: কেমন আছেন? কী করছেন?
: ভালা নাই, তুমি কেমন আছো?
: ভালো আছি, কী করেন?
: কী আর করুম, তুমি আমার সিন্দুকটা দেখছোনি?
: না, সিন্দুক দেখিনি তো, আপনি আমার ঠল্লই-গুলাই দেখছেন?
: সিন্দুক দেখছো নাতো কী দেখছো মিয়া? আবার ঠল্লই-মল্লইয়ের কথা জিগাও।
: আস্তে কথা বলেন, এখানে বাহাদুরি চলে না, এখানে সবাই সমান, আপনি মেজাজ ঠান্ডা করেন আগে।
: ধুর মিয়া, মেজাজ মারাইতে আইসো না, যাও, ঠল্লই না মল্লই খুঁইজ্জা বেড়াইতাছো হেইডা খুঁজো গিয়া, এইখানে বাল পাকনাকি কইরো না।
: আশ্চর্য, আপনার সমস্যা কী? আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন?
: কীভাবে কথা কইতাম তোমার লগে? সিন্দুক দেখছো নাকি কও।
: বললাম তো দেখিনি, আপনি আপনার মেজাজ ঠিক করেন আগে।
: আচ্ছা, ঠিক করুম নে, যাও চোখ্যের সামনে থেইকা মিয়া।

বেকুব একটা, ধমকের লগে লগে কেমনে চইল্যা গেল; অবশ্য আরেকটা লোকের সাথে আমার পরিচয় হইছে, ওরেও বইল্যা রাখছি, সিন্দুক পাইলে যেন খবর দেয়, ওর সাথে পরিচয় করায়া দিমু নে, তার আগে অবশ্য আমার পরিচয়টা দেওয়া দরকার, মরার পরে আমি থাকি একটা আন্ধার টয়লেটে, ওই দিকে কেউ যায় না; আর গেলেও লাভ নাই, আমি কাউরে ডরাই না, কোনোকালে কাউরে ডরাই নাই, এই অক্টোবরে আমার মৃত্যু হইলেও কত জনরে যে মারছি নিজেও জানি না; ওহ্, যা কইতেছিলাম আমি যেইদিন মারা যাই সেইদিন জনগণের মইধ্যে যাকাতের কাপড় বিলি করতেছিলাম, শালার কপাল এত খারাপ, আধা ঘণ্টার মইধ্যেই ফুটুস, যদিও আমার পাশে ছিল গানম্যান, পুলিশ-টুলিশেরও অভাব ছিল না, সকাল বেলা ডক স্কোয়াডও পরীক্ষা কইরা গেছে, সবি ঠিক ছিল, কোত্থে যে এত মানুষ আইলো, বাঁশের বেড়া ভাইঙ্গা হুমড়ি খায়া পড়ল, মারামারি লাইজ্ঞা গেল, এই সুযোগে ফুটুস, এক্কেবারে কপাল বরাবর, মানুষের পায়ের তলায় পইড়া একুইশ জন মানুষ মইরা গেল, কিন্তু এই কাজটা কে করাইল? নিজের লোকেরা? নাকি বিরোধীরা? নাকি জঙ্গি-টঙ্গিরা? আজও কোনো কূল-কিনারা করতে পারল না কেউ, শুনছি মামলা চলতাছে, বন্দুক যুদ্ধে কয়েকজন মইরাও গেছে, কিন্তু রহস্য আর উদঘাটন হইল না, এইসব কথা মনে হইলে কইলজ্যাটা ফালা ফালা হইয়া যায়, এই হাতের ইশারায় কত শ্রমিক-কৃষক, ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিক, কবি-সাহিত্যিক, কত ফেউ-টেউ শেষ কইরা দিলাম, গত মে মাসেও ঘাঘু মালটারে খায়া দিছি, আমার চেয়ারের দিকে লোভ হইছিল শালার, তুই বেটা এইটা সেইটা কইরা কোটি কোটি টেকা কামাই করছোস, আরো কর, না করছে ক্যাডা; তুই লোভ করলি ক্যায়া শালা? তাই দিছি ভইরা; কিন্তু এর পরে আমি নিজেই কিনা নাই হইয়া গেলাম; উফ, আর ভাল্লাগতাছে না, যাই, সিন্দুকটা খুইজ্জা দেখি, আর ওই লোকটার সাথে আলাপও কইরা আসি—
: এইভাবে উল্টা হইয়া গাছে ঝুইল্লা আছেন যে, কী ব্যাপার?
: কে কথা বলে? কে আপনি?
: আমারে চিনতে পারতাছেন না? উল্টা হইয়া ঝুইল্লা আছেন তো, তাই চিনতে পারতাছেন না, একটু সোজা হন, চিনতে পারবেন, আমার সিন্দুকটা দেখছেন?
: এই সোজা হলাম, ওহ আপনি? সিন্দুক খুঁজছেন নাকি?
: হ, আমার সিন্দুকটা দেখছেন?
: সবখানেই তো সিন্দুক, কেউ দেখতে পায়, কেউ পায় না, আপনি আগে দেখতে পেতেন, এখন পান না।
: আপনের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারি না, তা আপনি এইভাবে উল্টা হইয়া ঝুইল্লা ছিলেন ক্যান?
: আমার জিনিসগুলো খুঁজে পাচ্ছি না, কোথায় রেখেছি তা মনে করার চেষ্টা করছিলাম।
: তা তো বুঝলাম, কিন্তু আপনের ঝুইল্লা থাকার কারণ কী? উল্টা হইয়া ঝুইল্লা কী খুঁজতাছেন?
: সব উল্টো মানুষ, উল্টো মানুষকে বোঝার জন্যই উল্টো হয়েই ঝুলে ছিলাম, আর উল্টো হয়ে জিনিস খোঁজা যায় না, স্মরণ করা যায়।
: আপনে কী খুঁজেন? ওইগুলা খুঁজার সময় আমার সিন্দুকটাও একটু দেইখেন।
: আমি খুঁজি চেয়ার, সাইন পেন, বই; কোথায় যে রেখেছি কিছুই মনে পড়ে না।
: এইগুলা কি খুঁজার জিনিস হইল? আমার সিন্দুকটা দেখছেন?
: বললাম তো আপনার সিন্দুক আপনার আশেপাশেই আছে।
: ধুর মিয়া, পাগলামি ছাড়েন, আজাইরা কথা, আপনি ঝুইল্লা থাকেন, বালের বই না চেয়ার খুঁজতাছেন, ওইটা খুঁজতে থাকেন, আমি গেলাম।

আহ্, কী শান্তি, লোকটা তবে চলে গেছে, ওহ্, আমি যেন কোন বইটা খুঁজছি? Das Kapital? না, না, আমি এই বই খুঁজতে যাব কেন? আমি যেটা লিখেছি সেটা খুঁজছি, সেটার নাম কি ‘মাইক্রো ব্যাংক’? এমন কিছুই হবে, আমি নিশ্চিত ‘মাইক্রো’ শব্দটা ছিল; এই বইটা আমি নিজেই লিখেছি, যদিও বাকিগুলো নিজে লিখিনি, কাকে দিয়ে যেন লিখিয়েছি, অবশ্য মোটা অংকের অর্থ নিয়েছে লোকটা, আমার বইয়ের কোন লাইনটা যেন বিখ্যাত হয়েছে? Dream is not that which you see while sleeping, it is something that does not let you sleep, এটা? না, না, এই স্বপ্ন-টপ্ন না; আমার কোটেশনে poverty, poor এই শব্দগুলো ছিল; থাক, কষ্ট করে আর মনে করতে চাচ্ছি না, আমি বরং সাইন পেন ও চেয়ার খুঁজতে বের হই, যদিও রাস্তাঘাট তেমন চিনি না, এই অগাস্টে আমার মৃত্যু হয়েছে; অবশ্য আমিও কম কী, এই জুনে একটা ফেউকে যমের ঘরে পাঠিয়েছি, কিন্তু কাজটা আমার করতে হয়নি, বেটা আমার বিরুদ্ধে নিউজ করে, আমার বইয়ের আসল লেখক কে, দেশি-বিদেশি কোন কোন সংস্থার সাথে আমার যোগাযোগ আছে, আমি কার হয়ে কাজ করি; কে কার এজেন্ট, ঋণ খেলাপি, রিজার্ভ চুরি, শেয়ার বাজার, অর্থ পাচার, এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে, কিন্তু আমার এই সুখ-স্বাছন্দ্য, এই ভালোমানুষি, এই জনপ্রিয়তাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারি না; তাই বেটাকে উচিত শিক্ষা দিয়েছি; কিন্তু আমিও টিকতে পারিনি; ওই দিনের ব্যাপারটা আজও বুঝতে পারি না; লেট নাইট পার্টি শেষ করে বাসায় ফিরছি; রাস্তায় লোকজন নেই, পাঁচ নম্বর রোডের মোড়ে আমার গাড়ি থেমে গেল, একটা মাইক্রোবাস রাস্তার মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছে, আমার ড্রাইভার একটা হর্ন দিয়েছে কী দেয়নি, অমনি দৌড়ে এলো ওরা, আমি শুধু কালো কালো মুখোশ দেখতে পেয়েছি, সে কী কোপ, আমার ঘাড় থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত...;

উফ, আর মনে করতে চাই না, আর ভালো লাগছে না, এই ম্যানহোলে থাকতে থাকতে মনটা কেমন হয়ে যাচ্ছে; যাই, বাহির থেকে ঘুরে আসি; দেখি জিনিসগুলো খুঁজে পাই কিনা; ফেরার পথে পুরনো জাদুঘরে যে লোকটা থাকে তার সাথে আলাপ করে আসব নে; লোকটা সারাদিন লেখালেখি করে; যাই, দেখি আসি একটু—
: কেমন আছেন আপনি?
: ওহ্, আপনি, আমি ভালো আছি, আপনি?
: ভালো আছি, কিন্তু জিনিসগুলো খুঁজে পাচ্ছি না, বইয়ের নামটাও মনে করতে পারছি না।
: আমিও লিখতে পারছি না, সাদা মেঘের সাক্ষাৎ পাচ্ছি না, কালো মেঘে লিস্ট করে লাভ নেই, কারো চোখে পড়ে না।
: কেন চোখে পড়ে না? কেন?
: খুব সোজা, কালো কালোকে খেয়ে ফেলে, তাই কেউ দেখতে পায় না, আপনারা সাদা মেঘে যা দেখেন তা কালো মেঘের তুলনায় এক আনাও না।
: কী বলেন, সাংঘাতিক ব্যাপার, আচ্ছা আর বিরক্ত না করি, আপনি সাদা মেঘ খুঁজতে থাকেন, আমি তবে চলি।

এই লোকটা সারাদিন উল্টো হয়ে ঝুলে থাকে, সাইন পেন খুঁজে, চেয়ার খুঁজে, কী এক বই খুঁজে, কিন্তু বইয়ের নাম জানে না; পাগল ছাগল সব, অবশ্য এই লোকটা জানে না যে, এখানে আমার বউও থাকে; আমরা বউ-জামাই ভালোই আছি; অহ্, আমাদের পরিচয় তো দেওয়া হয়নি; এই জুনে আমাদের মৃত্যু হয়েছে, যদিও অন্য একজনের মৃত্যুর সাথে আমি জড়িত ছিলাম; অবশ্য আমি নিজে কিছুই করিনি, ওপর থেকে আমাকে মোটা অংক দিয়ে বলে, ‘আমরা যেইভাবে বলি সেইভাবে শুধু রিপোর্টটা করবেন।’ আমিও বুদ্ধি-পরামর্শ দেই আর রিপোর্ট করি অনেক দিন; থাক, এসব আর মনে করে লাভ নেই; যা বলছিলাম, সেদিন গভীর রাতে...; না, আর মনে করতে চাই না, বউ পারলে বাকিটুকু তুমি বলো, দেখি সাদা মেঘের সন্ধান পাই কিনা।
: তুমি যে কিনা, এসব রক্তারক্তির কথা বলতে আমারও ভালো লাগে না।
: আরে বলো, তুমি আমার চেয়ে সাহসী, আমি তো মুরগি কাটা দেখলেও ভয় পেতাম।
: কী যে বলো, তোমার চেয়ে সাহসী কে ছিল শুনি?
: আমি যাচ্ছি কিন্তু।
: আচ্ছা যাও।

আমার জামাই বড্ড ছেলে মানুষ, উন্মাদও বলতে পারেন; যে কথা বলছিলাম, সেদিন রাতে কী হয়েছিল ঠিকঠাক বলতে পারব না; শুধু এটুকু মনে পড়ে, আমার চোখের সামনে আমার জামাইকে জবাই করে ফেলে; সে কী রক্ত, রক্তের সমুদ্র, ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করে ল্যাপটপ কোথায়; ওই ল্যাপটপেই ছিল মুখোশ আর ছায়াদের লিস্ট, তারপর আমার গলায়ও; উফ, কালো কালো মুখোশ, আর বলতে পারব না, কিন্তু আমাদের চার বছরের বাবুটা কোথায়? যাই, একটু খুঁজে আসি, ফেরার পথে ওই মহিলার বাবুর গল্প শুনে আসব, ওই মহিলার বাবুও নাকি হারিয়ে গেছে, যাই তবে।
: আপা, কেমন আছেন? আপনার বাবুকে খুঁজে পেয়েছেন?
: খুঁজে পাইলে তো দেখতেনই, আপনে পাইছেন সাদা মেঘ? আপনার বাবুরে পাইছেন?
: মেঘ খুঁজে পেলে কি আপনার কাছে এসেছি, এতক্ষণে লিস্ট করতে বসে যেতাম।
: এইসব বাদ দিয়া ভালো করে বাবুরে খুঁজেন, এইসব মেঘটেক খুঁজে লাভ নাই।
: এই কারণেই আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না, আপনি থাকেন, আমি গেলাম।
: এত গরম দেখায়েন না, বাবুরে খুঁজতাছি, আপনার বাবুরে পাইলে জানাব নে।
: তার আর দরকার নেই, আপনি নিজেরটাকে খুঁজেন, যত্তসব।

এই মহিলার কথার ধরন ভালো না, একটু যে আলাপ করব সেই সুযোগ নাই, খালি সাদা মেঘ খুঁজে; বাবুরে খুঁজলেও তো পারে, আমার বাবুটা যে কোথায় আছে, এই এপ্রিলে আমরা জামাই-বউ মারা যাই, সেই দিনের কথা মনে হলে... না, আমি বলতে পারব না, কলিজা ফেটে যায়; এই যে জামাই, পারলে আপনি বলেন।
: বউ, তুমিই কও, আমি বস্তাগুলা খুঁইজা পাইতাছি না।
: সারাদিন বস্তা খুঁজার দরকার নাই।
: তাইলে কী তোমার গহনার বাক্স খুঁজতাম?
: সব খুঁজবা, আমার গহনার বাক্স খুঁজবা, তোমার বস্তা খুঁজবা, আমাদের বাবুরেও খুঁজবা।

আমার বউ পাগল কিসিমের হইলেও দিলটা সাচ্চা, সে যেহেতু কইতাছে তাইলে ওই দিনের ঘটনাটা কই; তার আগে আমাদের পরিচয়টা দিয়া লই; আমি তরুণ চেয়ারম্যান, প্রথম ইলেকশনেই বিপুল ভোটে পাস করছি, আর আমার বউ হেড মাস্টারনি; আমাদের কথা শোনার আগে আমি যে কাজটা করছি তার কথা একটু কই; এই কথাটা কেউ জানে না, আমার বাড়িতে যে মেয়েটা কাজ করত, একদিন...; থাক, কইয়া কী লাভ, জীবনে ইট-বালু-টিন-চাইল-গম কম খাই নাই; যা কইতেছিলাম, ওইদিন রাতের বেলা আমার দরজায় আইসা কে জানি ফিসফিস কইরা কয়, ‘চেয়ারম্যান সাব, ও চেয়ারম্যান সাব, দরজাটা খুলেন, কথা আছে, দরজাটা খুলেন।’ বউ না করে, কিন্তু আমি যন্ত্রটা হাতে নিয়া দরজাটা খুলি; সাথে সাথে আমারে জাপ্টায়া ধরে, খালি কালা কালা মুখোশ; ওরা ঘরের চালে, ঘরের ভিতরে, আমগোর গায়ে, বিছানায় কেরোসিন ঢাইল্যা দেয়, তারপর...
: বউ, আর পারতেছি না, বাকিটুকু তুমি কও।

এই জামাই নিয়া আর পারতেছি না, তারপর আমাদের হাত-পাও-মুখ বেঁধে আগুন লাগায়া দেয়, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে, আমরা পুড়ে কয়লা হয়ে যাই; পরে মামলা হয়, কিন্তু সবচেয়ে বড় পত্রিকায় খবর আসতে থাকে, এটা নাকি দুর্ঘটনা।

এখন আমরা চুঙ্গির ভিতরে থাকি, অন্ধকার হলে বাবুরে খুঁজি, আগুন লাগার সময় বাবুর কথা মনে ছিল না, কোথায় যে আছে বাবুটা; অবশ্য এখানেও একটা মেয়ে আছে, ওকে দেখলে মনটা ভালো হয়ে যায়, মেয়েটা সারাদিন ‘বাবু, বাবু’ করে, যাই, ওকে দেখে আসি।
: এই যে, এই মেয়ে, কী করতেছো?
: আপনে, এই অসময়ে, একটু পরেই তো আজান দিয়া দিব, রাইত তো বেশি নাই।
: তুমি চিন্তা করো না, এখনো কিছুটা সময় বাকি আছে, তুমি কী করছিলা?
: জানেন কী হইছে; এইদিক দিয়া একটা বাবু গেছে, আপনে যুদি দেখতাইন, সাদা ফকফকা, তুলতুলা।
: কী বলো, আমার বাবু নাতো?
: না, আপনের বাবু আইবো কইথ্যে; মনে হইছে এইটা আমার বাবু।
: কী বলো, তোমার বাবু হবে কেমনে? তোমার তো বিয়েই হয় নাই, বিয়ে না হলে বাবু হয় না।
: হ, মইরা গিয়া কী যে বিপদে পড়ছি, বাবুর সখ আর মিটল না।
: সবই কপাল, বুঝছো; আচ্ছা বাদ দেও, এখন তোমার কথা বলো, তুমি না তোমার কথা বলতে চাইছিলা।
: কিন্তু আইজকা তো সময় নাই, এট্টু পরেই তো আজান দিয়া দিব।
: তুমি তাড়াতাড়ি বলবা, এখনো সময় বাকি আছে।
: আইচ্ছা, তাইলে হুনেন, ছুডু কইরা কইতাছি।

চেয়ারম্যান সাবের লগে কাম করতে গিয়া আব্বা গেছে মইরা, ইটের ভাটায় পুইড়া কয়লা হইয়া গেছে; ছুডু ভাইডাও শহরে যাওনের এক বছরের মইধ্যে উধাও হইয়া গেছে; বাজারের মাইনষে কয়, পত্রিকায়, টিভিতে নাকি ভাইরে দেখাইছে; সোনার টুকরার ভাই আমার কী জানি করছে, এর কয়দিন পর থেইকা ভাইডার কুনু খবর পাই নাই; আব্বা কত কষ্ট কইরা বাজার থেইকা চান্দা তুইল্লা ভাইডারে এঞ্জিনেয়ার বানানোর লাইগ্যা...; বা, আর কইতে পারতাম না গো; কইল্যাডা পুইড়া যা; আব্বা মরার পরে আমরা তিন বোইন রোগা মারে লইয়া ভরা গাঙে পইড়া গেলাম, আমি সবার বড়, ছুডু বোইনগুলা খালি কান্দে, ঘরে খাওন-পানি কিচ্ছু নাই, না খায়া মইরা যাবার অবস্থা, তহন চেয়ারম্যান সাব আমারে তার বাড়িতে কামের ব্যবস্থা কইরা দিল, সুখে-শান্তিতে যাইতাছিল, চেয়ারম্যান সাব ও তার বউ আমারে ভাত-কাপড়ের কষ্ট দেয় নাই কুনুদিন; তাগোর একটা বাবু, চাইর বছর বয়স, হেরে নিয়াই আমার সময় চইল্লা যাইত, একদিন চেয়ারম্যান সাবের বউ বাসায় নাই, হেড মাস্টারনি আছিল তো, টেডিং করতে নাকি বাপের বাড়ি গেছিল মনে নাই; ম্যাডাম আমারে সব বোঝায়া দিয়া গেছে, আমি ঘরদোর পরিষ্কার করি, রান্নাবান্না করি, বাবুরে গোসল করাই, খাওয়াই, চেয়ারম্যান সাবও তাড়াতাড়ি বাড়িতে আইয়ে; কুনু অসুবিধা হয় না, আমি এটা-সেটা করে দেই, চা বানায়া দেই, লোকজন আইলে সমাদর করি, চেয়ারম্যান সাব আমারে কয় মাংস ভুনা কর, আমি বাটা মরিচ দিয়া ঝাল ঝাল কইরা মাংস ভুনা করি, কী যে মজা, জীবনে এত মাংস খাই নাই, কিন্তু শরমের কথা কী কইতাম, আর এখন তো আমার লাজ-সরম কিচ্ছু নাই, ওইদিন রাতের বেলা বাবু ঘুমাইয়া গেলে চেয়ারম্যান সাব আমারে কয় ‘আমার মাথা ব্যথা করতাছে, একটু টিইপ্পা দে;’ চেয়ারম্যান সাবেরে আমি পিরের মতো মানি, উনি কত কী কিইন্না দেয় আমারে, পরে ওনার মাথা টিইপ্পা দেই, পরে, চেয়ারম্যান সাব...;
: এই মেয়ে তোমার গল্প বন্ধ করো, ভালো লাগতাছে না আমার।
: ক্যান? কী হইছে? আর শুনবেন না? আপনেই তো শুনতে চাইলেন।
: না, আজ আর না, আজান দিয়ে দিবে, আমি এখন যাই।

বুঝলাম না কিচ্ছু, বেডি এত চেইত্তা গেল ক্যান, নিজেই হুনতে চাইলো আবার নিজেই ছ্যাং ছ্যাং শুরু করল; তয় আমিও হার মানুইন্না ছেড়ি না, আজ আমি কইয়ামই, আজান দেয়ার আগ পর্যন্ত কইয়াম; পরে, হুনেন, কী হইল, দুই তিনের মইধ্যে আমি যেন চেয়ারম্যান বাড়ির ম্যাডাম হইয়া গেলাম, ম্যাডাম যেইদিন বাসায় ফিইরা আইলো তার আগের রাইতে চেয়ারম্যান সাব আমারে কইলো, ‘কন্ডম দিয়া মজা পাই নারে, তোর মাসিক হইব কবে?’ আমি কই, ‘স্যার, কয়েকদিনের মইধ্যে হইব।’ আমার স্পষ্ট মনে আছে উনি বিরাট খুশি হইয়া কইছিলেন, ‘যা শালা, তাইলে তো সেইফ পিরিয়ড’, পরে কন্ডম ছাড়াই সব হইল, কিন্তু দুই মাস যাবত আমার মাসিক বন্ধ থাকলে একদিন সুযোগ বুইজ্জা চেয়াম্যান সাবেরে কথাটা কই, উনি কন, হাসপাতালে নিয়া যাইব, কিন্তু আমি হাসপাতালে যাইতাম ক্যায়া, আমি কান্দাকাটি করি, উনি আমার পায়ে পড়ে, কয় ‘আমারে বাঁচা, পুরা দেশের মানুষ জাইন্না যাইব’; কিন্তু গরিবের মাইয়া হইলেও আমার জেদ কম না, আমি মানতে চাই না, আমার পেটে বাচ্চা, তারে আমি খুন করতে পারি না, আমি কই ম্যাডামরে কইয়া দিমু, পরে আমার জীবনে আইলো ওইদিন; ম্যাডাম বাসায় আছিল না; খালি এইটুকুন মনে পড়ে, কালা মুখোশ, কালা, বাতরুম রক্তে জ্বলিতলি হইয়া গেল, আষাঢ় মাসের গাঙের মতো হইয়া গেল, আমার পনেরো বছরের শরীলডা হাজার হাজার টুকরো হইয়া গেল, হেই টুকরাগুলো টয়লেটে ফালায়া পানির পর পানি দিলো, পানির ধাক্কাতে এক সময় আমার ছুডু শরীরডা নাই হইয়া গেল; আরো মনে করতে পারি, কে জানি আমার নাকেমুখে বালিশ দিয়া চাপা দিয়া ধরছিল।

ওই যে আজান দিয়া দিল; কিছুক্ষণের মইধ্যে ফকফকা হইয়া যাইব সব; কিন্তু যাইবার আগে কইয়া যাই, যতটুকুন মনে পড়ে, জানুয়ারি নাকি ফেব্রুয়ারিতে আমার মৃত্যু হইছে; অহন আমি একটা ভাঙা কব্বরে থাকি, হেই কব্বরে হুইয়াও শব্দ পাই; ওই যে শব্দ হইতাছে; ক্যাডা যায়? কারা যায়? কিসের গন্ধ আইতাছে? কালা কালা মুখোশের নাকি? দেহি তো এট্টু, হ, ওই তো কালা কালা মুখোশ যাইতাছে, ওরা কারে ধইরা লইয়া যাইতাছে? আমার বাবুরে? নাকি ছুডু ভাইডারে লইয়া যাইতেছে?

   

ফেরদৌস আরার প্রবন্ধের আলপথ বেয়ে পাঠক চলে যান জ্ঞানের সমুদ্রদর্শনে



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘লেখকের প্রচুর অধ্যয়ন, পাঠগভীরতা, নিবিড় অনুসন্ধিৎসা, ঘোরলাগা শব্দপুঞ্জে, ভাষার শিল্পিত সুষমায় লেখাগুলি প্রাণ পেয়েছে। তাই গ্রন্থের তথ্যসমৃদ্ধ বারোটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য শুধু নয়, নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, জানার তাগাদা তৈরি করবে—বোধে, তৃষ্ণায়, জীবনজিজ্ঞাসায়। নিজের কথাই বলি, ফেরদৌস আরা আলীমের চোখ দিয়ে পড়তে পড়তে আমি নিজে প্রায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আফরোজা বুলবুল কিংবা প্রতিভা মোদক (‘যে জীবন শিল্পের, যে শিল্প জীবনের’), করুণা বন্দোপাধ্যায়, রবিশংকর বলকে (‘চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর’) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে আস্বাদ করি সময়-পরিক্রমায় লেখক ফেরদৌস আরা আলীমের কলমের ক্ষুরধার ক্রমমুগ্ধকর সৌন্দর্য।’

শনিবার (৪ মে নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক গলিতে অবস্থিত মাসিক নারীকণ্ঠ পত্রিকা-আয়োজিত ‘বই আলোচনা’-অনুষ্ঠানে ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আলপথে শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের মূল আলোচকের আলোচনায় তহুরীন সবুর ডালিয়া এসব কথা বলেন। বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনায় আরও অংশ নেন নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা জিনাত আজম, সালমা রহমান ও মাধুরী ব্যানার্জী।

নারীকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আহমেদ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শাহরিয়ার ফারজানা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতারী ইসলাম বলেন, ‘নানা বিষয়ে ফেরদৌস আরা আলীমের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সহজভাবে তিনি আমাদের সমাজবাস্তবতার যে-চিত্র আঁকেন তা মনের গভীরে সাড়া জাগায়। তার লেখা পড়ে এটুকু বলতে পারি যে, তার লেখা আমাদের জন্য গবেষণা ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান আকর।’

প্রবন্ধের আলপথে বইয়ের প্রকাশক, কবি ও খড়িমাটি-সম্পাদক মনিরুল মনির বলেন, ‘নারীমুক্তি বিষয়ে এ-বইয়ে দুটি তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে আরও কাজ করার জন্য গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রকাশিত বই নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘বড় কিছু হওয়ার কথা ভেবে লিখিনি, মনের আনন্দেই গোপনে গল্প-কবিতা লিখেছি। এমন একসময়ে আমরা লিখতাম, লেখা প্রকাশ করতে খুব লজ্জাবোধ করতাম। অবশ্য লিখতে গিয়ে তেমন কঠিন বাধা আমাকে ডিঙোতে হয়নি। একালের চেয়ে আমাদের সময়টা ছিল অনেক সুন্দর ও ভালো। মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল সমাজে। গণ্ডগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে চড়ে ঢাকা গিয়েছি একা-একা, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। মা-বাবারাও নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকাল মেয়েরা পদে-পদে বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের কলুষিত সমাজব্যবস্থা ও নষ্ট রাজনীতি।’ সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রশংসার ভূমিকা কম নয়। একজন লেখক তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য পেলে অনুপ্রাণিত হন যা তাকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি জোগায়।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা ও সদস্য রোকসানা বন্যা, মহুয়া চৌধুরী, রেহানা আকতার, সাহানা আখতার বীথি, কানিজ ফাতেমা লিমা, বিচিত্রা সেন, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, চম্পা চক্রবর্ত্তী, প্রচার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জয়, কবি মেরুন হরিয়াল ও কবি মুয়িন পারভেজ প্রমুখ।

;

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

;

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;