এত নিশ্চিন্ত হইয়া মানুষ নিজের মৃত্যুরে খায় ক্যামনে



আশরাফ জুয়েল
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

বড় বড় ধর্মগাছগুলারে চিন্তার করাত দিয়া ফালাফালা কইরা, খড়ি বানাইয়া রেশনের মতো এথেন্সের ঘরে ঘরে ছিটাইয়া দিতাছেন, এই খড়ি নাকি সাধারণ খড়ির তুলনায় তেজী, সবকিছুই রাইন্ধা ফালাইতেছে। এবং যুবসমাজনামক আয়নার দুদিকেই আলকাতরা মাখাইতেছেন তিনি, ফলত গ্রিস নামক নৌকাখানা বেউলভাবে দুলতেছে, মাইনষের চৌক্ষের তারায় সাইনবোর্ড হইয়া ঝুলতেছে কিছু ভ্রান্ত জিজ্ঞাসা।

বাটিডার মইধ্যে ডুব দিয়া চুপ মাইরা আছিলাম, আল্লার কিরা, একফোঁটা হেমলকও খাই নাই আমি, কিন্তু যা চাইছিলাম, কাম হইয়া গ্যাছে। তিনি চোখ বন্ধ কইরা খায়ছিলেন, শেষ আরকটুকুও, বাটির ভিত্রে ডুবন্ত আমি, দেখছি, কী শান্তিতে একজন মানুষ খাইতেছেন নিজের মৃত্যুরে।

ইচ্ছা হইছিল, সুযোগ হয় নাই, তাঁরে জিজ্ঞেস করতে, ‘সত্য কী? বিশ্বাস কী? ধর্ম? রাজনীতি? বা ক্ষুধা?’ তাঁরে এও জিজ্ঞেস করতে বুকটা আঁকুপাঁকু করতেছিল, ‘শইলের বিরুদ্ধে আত্মার যুদ্ধটা কী? ক্যান?’ পারি নাই। তিনি যহন হেমলকের বাডিতে ঠোঁট ঠেকাইয়া নিশ্চিন্তে ঢোক গিলতেছিলেন, তাঁরে বিরক্ত করার ইচ্ছা চইলা গেছিল আমার, অবশ্য এ কথাটাও পুরাপুরি সত্য না, আসলে আমার হাত-পা-মাথা-বুক জইমা কাঠ হইয়া যাইতেছিল, স্থির হইয়া আসতেছিল চোখের তারা, চাইলেও নড়তে পারুম না, বুইঝা গেছিলাম। কিন্তু তিনি বোঝেন নাই, বিড়বিড় কইরা কইতেছিলেন, ‘শেষ পর্যন্ত আমাকে আমার ঠিকানায় পৌঁছে দিচ্ছে বলে এঁদের সকলকে আন্তরিক অভিবাদন।’

২।
ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলাম, জীবনে এত ভয় কখনোই পাইনি। গল্পটা বলি, সেদিন সন্ধ্যায়, হ্যাঁ, সন্ধ্যা হবারই কথা, সন্ধ্যা? আচ্ছা, এই শহরে বেলা কয়টা পর্যন্ত বিকাল? কখন থেকে সন্ধ্যা আরম্ভ? কখনই বা আরম্ভ হয় রাত? সেটা কয়টা পর্যন্ত চলে? সকাল? অবশ্য আমি এই সকাল বিকাল বা রাতের হিসাব রাখি নিয়ন আলো জ্বলে ওঠা এবং নেভানোর সময়কে ধরে নিয়ে। এই শহরের সকাল বিকেল, রাত, আসলে সব কিছুই নির্ভর করে বিভিন্নজনের দখলে থাকা কিছু সুইচের ওপর। ধুর, এসব আমার জানার বিষয় না। যে গল্পটা বলতে চেয়েছিলাম, গল্প তো নয়, ঘটনা, গত সপ্তাহেই ঘটেছে, আমার সাথেই। কী ভয়ানক ঘটনা! বিশ্বাস করার কথা না, না করারই কথা, অবশ্য বিশ্বাস না করলেও কিছু যায় আসে না। আসলে বিশ্বাসের সর্বোচ্চ সীমানা হলো সেখানে, যেখানে এসে মিথ্যে শেষ হয়ে যায়। সেদিন রাতে, রাতই বলছি কারণ নিয়নবাতিগুলো জ্বলেছে বহুক্ষণ—যাচ্ছিলাম বা আসছিলাম, হ্যাঁ যাচ্ছিলাম, না আসছিলাম, আচ্ছা যাওয়া বা আসাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ ঘটানাটা, শাহবাগে কিছুক্ষণ অর্থহীন দাঁড়িয়ে থাকার পর আমার কিছু একটা মনে হয়েছিল, কাঁটাবনের দিকে এগুতে চাইছিলাম, পা দুটো অনিচ্ছাকৃতে এগুচ্ছিল। আসলে সময়টা সন্ধে ছিল না, ঘড়ির হিসাবে রাত, অনেক রাত। কিন্তু গভীর রাতকে কেন আমার সন্ধ্যে মনে হয়েছিল?

‘আমি? ফুরকান।’

৩।
: ইউ ফাকডআপ পিপল, ডেমোক্রাসি ইজ ফাকিং ইয়োর অ্যাস অল দ্য টাইম...? ইয়েস, হেই ইয়োলা কালারড শার্ট ম্যান, ডোন্ট ইউ ফিল পেইন?

গুলশান এক থেকে দুইয়ের দিকে যাবার পথে অনিক টাওয়ার, রবি-র হেড অফিস এবং উল্টো দিকে বেঙ্গলের আর্টগ্যালারির ঠিক মাঝের আইল্যান্ডে একজন পাগল, প্রায় প্রতিদিন অফিসভাঙা টাইমে বক্তৃতা করে, বক্তৃতা তো নয় রীতিমতো চিৎকার। অদ্ভুত ভঙ্গিমায়, দুই হাত নাচিয়ে নাচিয়ে, মাঝেমাঝে সামনের জমায়েতের দিকে তাকিয়ে কথা বলে। সামনের ছোট্ট জমায়েতটা মাঝেমাঝে দেহ বাঁকিয়ে গলা কাঁপিয়ে স্লোগান তোলে। জমায়েতে সাকুল্যে জনা সাতেক, যাদের বয়স চার থেকে নয় দশ, সবাই পথশিশু। এই সরু কণ্ঠের স্লোগানকে ভূমিকম্প ভেবে গুলশানের বড় বড় দালানগুলো ভেতরে ভেতরে কেঁপে ওঠে, কেঁপে যে ওঠে তা বোঝা যায় দুইদিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কথা শুনতে থাকা মানুষগুলোকে দেখলে, সুড়সুড় করে তারা কেটে পড়ে সুবিধাজনক অন্ধকারে। ভীরু মানুষদের এই পালিয়ে যাওয়া দেখে আনন্দে ফেটে পড়ে ক্ষীণ দেহের দলটি। মানুষকে ভয় দেখানোর মতো আনন্দ আর কিছুতেই নেই, তা তারা বুঝে গেছে ইতোমধ্যে। এরকম সময়ে পাগলটি স্থির হয়, চোখ বন্ধ করে দুই হাত তুলে শান্ত হতে বলে তাঁর সম্মুখের সমাবেশটিকে।

৪।
শ্যাষ ঢোক গেলার সাথে সাথে গইলা গ্যালাম আমি, তিনিও ঢইলা পড়লেন। তিনি ভালো কইরাই জানতেন দাঁড়াইয়া থাকার মানে কী? ভালোই আছি, কিন্তু তিনি বেশিদিন থির থাকলেন না।

হঠাৎ হঠাৎ সূর্যের মতোন উদয় হন, কোনো অচেনা নগরীর আন্ধার ফুটপাতে একটানা কথা কইতে থাকেন তিনি। কে শুনল, কে শুনল না এতে তাঁর কিছুই যায় আসে না। তিনি কইতেই থাহেন নিজের মতো কইরা। তাঁর চোখ হইয়া আমি মানুষ দেহি, মানুষ দেহা আমার শখ হইয়া দাঁড়াইছে। পশুদের আলাদা আলাদা চেহারা, আলাদা আলাদা আচরণ আলাদা আলাদা হিংস্রতা, মানুষের শারীরিক গঠন একই রকম, কিন্তু আদতেও ভিন্ন ভিন্ন হিংস্রতা নিয়া নিজেদের প্রতিদিন একটু একটু কইরা হত্যা করে এরা।

মাঝেসাঝে গাছেদের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে হাজির থাকি, আবার উড়তে উড়তে মাঝেমইধ্যে চইলা যাই, পাখিদের এসাইল্যামে। তিনিও কই থিকা জানি চইলা আসেন। চুপ কইরা দূরে খাড়াইয়া থাকেন। আমি তখন বিস্কুটগুঁড়া, আমি তখন ক্ষুধার্ত পাখিদের ঠোঁটে ঠোঁটে, আমি তখন নিঃশ্বাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইড।

‘জীবনকে পরীক্ষার মুখোমুখি ফেলবে, বারবার।’ ভাইবা ভাইবা ব্যাকুল হইয়া যাই, এই লাইগাই কি তিনি নিজেরে সঁইপা দিছিলেন মৃত্যুর ডেরায়? অথচ বাঁইচা আছেন তিনিই, এথেন্সের সেই নৌকা শুকনা মাটিতে ভাস্তাছে।

৫।
জাদুঘরের ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি, বিপরীতে সাবেক পিজি, রাস্তা ফাঁকা, রাত পৌনে একটা। হাঁটতে হাঁটতে বাম দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বুকে দুধ না থাকা মায়ের মতো শুকিয়ে যাওয়া পুকুরটাকে দেখছিলাম। এই পুকুরে কাউকে কোনোদিন মাছ ধরতে দেখা যায়নি, অবশ্য এমন নয় যে, সারাক্ষণ পুকুরের পাশে বসে থেকেছি, তবে বসে থাকতে পারলে মন্দ হতো না, বদ্ধ পানির নিজস্ব একটা ভাষা আছে।

হঠাৎ কুত্তার কু কুউউ কুউউ চিৎকার পুকুরভাবনা থেকে তুলে এনে আমাকে ছিটকে ফেলে মাঝরাস্তায়, ফুটপাতে শুয়ে থাকা কুকুরের পেটে পা পড়ায় এই দৃশ্যের অবতারণা, দর্শকহীন ফুটপাতের এই দৃশ্য অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। একটা ট্রাক সজোরে চুমো দিল আমাকে। মাত্র কয়েক সেকেন্ড...

কুত্তাটা ছাড়া কেউই ছিল না আশপাশে, সে আমার দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া শরীরের দিকে তাকাচ্ছে, তাঁর শরীরে সামান্য পা পড়ার খেসারত আমাকে এভাবে দিতে হবে, বুঝতে পারেনি সেও। অবশ্য এ নিয়ে তাঁর মধ্যে কোনো অপরাধবোধ কাজ করছে না। তাঁরই বা দোষ কী? আমাকে মেরেছে ‘সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচ টন’।

দুইদিক থেকে পাঠকসমাবেশ রাস্তার যে অংশটুকুর গলা চেপে রেখেছে ঠিক সেইখানে ধোয়াকাপড়ের মতো পড়ে আছি, শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে আমার তেইশ বছরের অতীত, রক্তের প্রবাহটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে কোনদিকে যাবে, তবে রেডব্লাডসেলগুলোর শরীরে এখনো জীবন আছে।

শিক্ষিত কুত্তাটা রেডসেলগুলোকে চেটেপুটে খেয়ে আমাকে রেখে চলে গেল পরীবাগের দিকের সুনশান রাস্তা ধরে, বার দুয়েক পেছন ফিরে তাকাল, কে জানে কী চলছে তাঁর মনে।

‘আমি? ফুরকান।’

৬।
সেই একই জায়গা, গুলশান এক থেকে দুই নাম্বারের দিকে যাবার পথে—অনিক টাওয়ার, রবি-র হেড অফিস এবং উল্টো দিকে বেঙ্গলের আর্টগ্যালারির ঠিক মাঝের আইল্যান্ডে সেই পাগল, আজ তাঁর পরনে হালকা বাদামী কালারের একটা ফুলহাতা শার্ট, নিচে ব্লাক কালারের গ্যাবাডিন, পায়ে স্লিপার। সেই পরিচিত ভঙ্গি, আজ এখন পর্যন্ত তাঁর নিয়মিত অডিয়েন্স এসে পৌঁছায়নি। তাতে তার সামান্য অসুবিধা হচ্ছে না। আজও রাস্তার দুইদিকের ফুটপাতে জমে গেছে কাজ ভুলে যাওয়া কিছু মানুষ, পাগলটি মানুষের দৃষ্টিতে পাগল, হয়তো পাগলটির দৃষ্টিতে বাকি সবাই পাগল। আজও সেই পরিচিত ভঙ্গি;
‘আই অ্যাম চার্চিল, আই রিপিট, আই অ্যাম উইন্সোটোন চার্চিল, ডু ইউ নো মি?’ বোকাচোদার পাবলিক, আমারেও চেনে না। সরি, সরি, নো স্ল্যাং নো স্ল্যাং। লেটস স্টার্ট,’—এই বলে জোরে জোরে তালি দেয় সে, কিন্তু এ তালি দেওয়ার মধ্যে দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণের কোনো চেষ্টা পরিলক্ষিত হয় না। তিনি কথা বলা আরম্ভ করেন, ‘নো ওয়ান প্রিটেন্ডস দ্যাট ডেমোক্রাসি ইজ পারফেক্ট অর অল-ওয়াইজ। ইনডিড ইট হ্যাজ বিন সেইড দ্যাট ডেমোক্রেসি ইস দ্য ও’স্ট ফর্ম অফ গভর্নমেন্ট একসেপ্ট অল দোস আদার ফরম’স দ্যাট হ্যাভ বিন ট্রাইড ফর্ম ঠাইম ঠু ঠাইম...’

নির্ভুল ইংরেজিতে বক্তব্য চলল আরো কিছুক্ষণ। ততক্ষণে মানুষের পেটে ঘরে ফেরার সাইরেন বাজতে আরম্ভ করেছে। ইতোমধ্যে পাগলটির পোষা অডিয়েন্স এসে গেছে, আজ সংখ্যায় একটু বেশিই, জনা দশেক তো হবেই। ক্ষুধার্ত মানুষের কণ্ঠ থেকেই সর্বোচ্চ শব্দের চিৎকার বের হয়, কেন?

আবারও স্লোগান, আবারও ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের পলায়ন। পলায়নপর মানুষের এই চেহারাটা দেখতে খুব ভালো লাগে যুবকটির, যাকে সবাই পাগল বলে।

অবশ্য বক্তব্য শেষ হলেই প্রত্যেকের জন্য একশো টাকার একটা করে চকচকে নোট পথশিশুদের এখানে আসতে বাধ্য করে, যতবার বক্তব্য ততবার একশ টাকার কড়কড়ে একটা করে নোট।

৭।
নিজেরে বেকুব লাগতেছে। বুঝি নাই, কোন স্কুলে ভর্তি হইয়া গেছি! নিজেরে দুই মাড়ির ফাঁকের মাংস মনে হইতেছে, মনে হইতেছে নিজেই নিজেরে চাবাইতেছি অনবরত। আমি কি চাইছিলাম এমন জীবনস্কুলের প্রোডাক্ট হইতে! শইলে এই ‘মানুষ মানুষ’ গন্ধ আর সহ্য হইতেছে না।

শান্তি বলতে গাছেদের শেষকৃত্যানুষ্ঠান—যখন এক নিঃশব্দ প্রার্থনায় ঘুমাইয়া থাকে গাছেরা, যখন অন্যরে বাঁচাইতে নির্দ্বিধায় নিজেরে ঠেইলা দ্যায় করাতের দাঁতে, বার্নিশের পালিশে। আর শান্তি পাই আর যখন পাখিদের এস্যাইলামে গিয়া গুঁড়া বিস্কুট হইয়া তাদের ঠোঁটে ঠোঁটে ঘুরি।

স্বেচ্ছায় এই জীবন বাইছা নেই নাই আমি, কোনো অপশন কেউ দ্যায় নাই আমারে, আমি পাখি হইতে চাই নাকি গাছ? নাকি সামান্য ঘাসফুল নাকি নিমফল?

এও জিজ্ঞাসা করে নাই, আদৌ আমি এই দুইনাই আসতে চাইছিলাম নাকি? মাঠে নামাই দিয়া, খেলার নিয়মকানুন না শিখাইয়া খেলতে কইয়া, গোল দিতে না পারলে প্লেয়ারের দোষ ধরলে আমি কী করতাম?

কেউ আমার দিকে হেমলক আগাইয়া দিতাছে না ক্যান? এই প্রশ্ন করছিলাম বসরে। স্বভাবসুলভ গম্ভীর, কইছেন আমি য্যান গাছেদের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে বেশি বেশ উপস্থিত থাকি, বলছেন, যাদের কারণে অরণ্য কাঁন্তাছে হেগোর নামের লিস্টি বানাইতে।
‘সুন্দরবন?’
‘মৃত্যুর মতো মহান আর কী আছে?’ তিনি কইছিলেন।
‘রামপাল পাওয়ার প্ল্যান্ট?’
‘কাউকেই কিছু শেখাতে পারব না আমি, বরং তাঁদের মনে ভাবনার উদ্রেক ঘটাতে পারি মাত্র।’

৮।
ভেবেছিলাম মরে পড়ে আছি, কেউ না কেউ কিম্বা ফজর থেকে সদ্যমুক্ত ভোরে এ পথ দিয়ে রমনা পার্কে মর্নিংওয়াকে যাবার সময় কারো রিবোক কেডস বাঁচাতে যদি পুলিশকে খবর দেয়?
না তেমন কিছু লাগেনি, আমার ভাবনাকে অবাক করে দিয়ে, ছিন্নভিন্ন দেহটা আবার আমার শার্ট-প্যান্টের ভেতরে আশ্রয় নিল। ভীষণ সন্দেহ উড়িয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম, পারছি, পারছি!

চিৎকার করে উঠলাম, বেঁচে আছি, বেঁচে আছি, হুররে বেঁচে আছি তো!

মুখে, বুকে, পেটে, মাথায়, পাছায়, থাইয়ে, পায়ে সব, সব জায়গায় হাত দিয়ে দেখলাম, সবই আছে, আমি বেঁচে গেছি, তবে খুব তৃষ্ণা অনুভূত হচ্ছে। আশপাশে পানি নাই, যেটুকু আছে, জাদুঘরের পেছনের পুকুরটায়, কিন্তু গেইটে তো তালা!

হঠাৎ তৃষ্ণা অনুভূত হবার কারণ খুঁজতে গিয়ে মনে পড়ল, সেই কুকুরটার কথা, যে আমার রক্ত চেটে পরীবাগের দিকে চলে গেছিল।

এতই তৃষ্ণা, পানি পাই কোথায়? না কাউকে দেখাও যাচ্ছে না। দেখা গেলেই বা কী!

পানিতে বাঁধ দিয়ে রেখেছে ফারাক্কা, যা আসছে সব চুয়ানি। হঠাৎ ফারাক্কার কথা মনে আসতেই মহানন্দার কথা মনে পড়ে গেল, মহানন্দার কথা ভাবলেই আমার সকল তৃষ্ণা মুহূর্তেই নিঃশেষ হয়ে যাবার কথা, কিন্তু তা আর হলো না, কারণ ফারাক্কা অনেক আগেই তাঁকেও ডায়রিয়া রোগীর চামড়া বানিয়ে রেখেছে।

হঠাৎ দেখলাম পরীবাগের সন্দেহ ফুঁড়ে ধীর পায়ে সেই কুকুরটা এগিয়ে আসছে আমার দিকে, যে আমার রক্ত খেয়ে নিঃসংশয়ে চলে গেছিল।

তৃষ্ণায় ছটফট করছি, কিন্তু কেন আসছে কুকুরটা?

আমি? ফুরকান।

৯।
: ‘ইফ ইউ ডু নট টেক এন ইন্টারেস্ট ইন দ্য এফেয়ার্স অফ ইয়োর গভর্নোমেন্ট, দেন ইউ আরে ডুমড ঠু লাইভ আণ্ডার দ্য রুল অফ ফুলস।’
: ‘পোভার্টি ইস দ্য পারেন্ট ওফ রেভ্যুলেশন এন্ড ক্রাইম।’
: ‘দ্য প্রাইস অব অ্যাপ্যাথি টুওয়ার্ডস পাবলিক এফেয়ার্স ইস টু বি রুলড বাই এভিল মেন।’
: ‘দ্য ফারস্ট এসেনশিয়াল রেস্পনসিবিলিটি অফ দ্য স্টেট ইজ কন্ট্রোল অফ দ্য মার্কেটপ্লেস, দেয়ার মাস্ট বি সাম অফিসিয়াল চার্জড উইথ দ্য ডিউটি অব সিইং দ্যাট হোনেস্ট দ্যাট ডিলিং এন্ড গুড অর্ডার প্রিভেইল…’
: ‘দোস হু আর টু স্মার্ট টু এনগেইজ ইন পলিটিক্স আরে পানিশড বাই বিং গভর্নড বাই দোস হু আর ডাম্বার...’
: ‘ইভিল ব্রিংস মেন ঠুগেদার...’

গুলশান থানার হাজতখানায় এক অদ্ভুত দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। হুলুস্থুল ব্যাপার। থানা এখন দুই দলে বিভক্ত। এক দলে দশ জন অন্য দলে সেই পাগল, গতকাল যে নিজেকে চার্চিল দাবি করেছিল।

পাগলকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা চলছিলই। হাজতের গরাদের ভেতর সে একা। কখনো সে নিজেকে প্লেটো দাবি করছে, কখনো এরিস্টটল, চমৎকার ইংরেজিতে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে। হাজতের ঘরকে সে স্টেজ বানিয়েছে, একবার ডানে যাচ্ছে, একবার বামে—কখনো সে এরিস্টটল, কখনো প্লেটো।

থানার গরাদে এরিস্টটল বা প্লেটো ব্রাত্য, এরা একথা জানবে কিভাবে? প্রথম প্রথম কথাগুলো খুবই উপভোগ করছিল সবাই। পাগলটি তখন মহা উৎসাহে আবার নতুন করে আরম্ভ করছে। মাঝে মাঝে চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে, আবার কখনো চিৎকার। মনে হচ্ছে কোনো নাটকের মহড়া।

এক পর্যায়ে বিরক্তির উদ্রেক হলে খেঁকিয়ে উঠে ওসি, ‘এই পাগলা চুপ কর তো! এই বালটাকে কে ধইরা আনছে?’

পাগল হঠাৎ বলতে আরম্ভ করে—
‘মরুর দারুণ দুর্গ হতে; যুদ্ধ চলে ফিরে ফিরে;/ সন্তরি সমুদ্র-ঊর্মি দুর্গম দ্বীপের শূন্য তীরে/ শ্যামলের সিংহাসন প্রতিষ্ঠিলে অদম্য নিষ্ঠায়,/ দুস্তর শৈলের বক্ষে প্রস্তরের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়/ বিজয়-আখ্যানলিপি লিখি দিলে পল্লব-অক্ষরে/ ধূলিরে করিয়া মু্‌গ্ধ, চিহ্নহীন প্রান্তরে প্রান্তরে।’

‘দ্যাখো বালে আবার কবিতাও লেখছে, পাগলাচোদা... অই চোপ, কাম করতে দে... এই এই এই বালডার একটা ব্যবস্থা করত? শুয়োরের বাচ্চা...’

‘হা হা হা, ইটস আ পোয়েম অব টেগর... আপনাদের ঠাকুর, রবি... মনে নেই?’

‘চুপ করবি শালা... পাগলা।’

‘জয় বাংলা, জয়...’ মুষ্ঠিবদ্ধ করে শ্লোগান তুলল পাগল, কাজ হলো। কাজে মন দিল থানা, নিজ ভাবনায় মন দিল সেও, ‘কই আমি তো কাউকে পাগল বলি না, যে নিজে পাগল সে শুধু অন্যকে পাগল বলে। সত্যিকারের পাগল চেনা এতই সহজ?’

১০।
‘কিন্তু পৃথিবীর ফুসফুস, অ্যামাজন? অস্ট্রেলিয়ার আগুন? সবখানেই তো পুড়তাছে অরণ্য? এগিলার কী হইব?’ আমি হাহাকারের ঢোক গিইলা নিয়া কইলাম।

তিনি মেঘথমথম মুখে পুনরাবৃত্তি করলেন, ‘কাউকেই কিছু শেখাতে পারব না আমি, বরং তাঁদের মনে ভাবনার উদ্রেক ঘটাতে পারি মাত্র।’

‘বালের দুনিয়া ভাল্লাগে না, চ্যাট। রোজ রোজ নিজের রক্ত খাইতে খাইতে না একটু একটু কইরা না মইরা এক্কেরে গেলেই তো হয়? আর টানতে পারতাছি না। কই যামু, কার কাছে? কে আমারে দিব ছুটি। উস্তাদ তো হেমলক খাইয়া এমুন এক্ষান চড় মাইরা গেছিলেন সেই সময়রে!

রাগে দুঃখে নিজেরে কাইট্টা কুইট্টা দুইন্ন্যার মাইনষের মুখে ছিটাইয়া দিতে ইচ্ছা করে, এই শালারা করতাছে কী? আমার শইলেও মাইনষের মাংস, হালারা খাইব ভালা।’

আমিও অরণ্য আর পাখিদের ভালোবাইসা ফেলেছি, এগোর স্থায়ী কোনো ঠিকানা নাই, আমারও নাই। বাস্তুচ্যুত আমরা ভাসতে থাকি, এখানে সেখানে। ‘যাইতে আমারে হইবই, আর না। ম্যালা হইছে। কিন্তু যামুটা কই? যদিও আমার কুনু ঠিকানা নাই, তাই উচ্ছেদ হওনের ভয়ও নাই। অবশ্য গোটা দুনিয়াই ভাস্তাছে, আমি বাল কোন হোগার হোগা...’

১১।
যতটুকু পিপাসার্ত হলে একজন মানুষ মারা যায়, আমি প্রায় তার কাছাকাছি অবস্থায়, সদ্য লটারিরে পাওয়া জীবন, আর হারাতে চাই না। পানির খোঁজে দুই পা শাহবাগের দিকে এগোয় তো তিন পা দৌড়ায় কাঁটাবনের দিকে।

কুত্তাটা আমার একেবারেই নিকটে এসে দাঁড়ায়, আমাকে ইশারা করলে চিত হয়ে শুয়ে পড়ি আমি, সে ডান পা তুলে আমার মুখ বরাবর প্রস্রাব করতে থাকে, আমি চুক চুক করে তার প্রস্রাব খাই, জীবনের কাছে এসব প্রস্রাব ট্রস্রাব কিছু না, কুত্তাটা ঠিক ততখানি প্রস্রাব করে যতটুকু পরিমাণ রক্ত সে চেটেছিল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে পরীবাগের অন্ধকারে হারিয়ে যায়, এবার পেছন ফিরে তাকনোর কোনো তাগিদ তার মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না, সে ঋণ শোধ করল?

এ ঘটনার পরপরই আরো কয়েকটা ঘটনা ঘটল; আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের কাছে, সন্ধ্যায়, ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাত। মৃত ভেবে তারা আমাকে ফেলে চলে যায়, আমিও ভেবেছিলাম মরে গেছি, কিন্তু না ফিরে এসেছি। এরপরের ব্যাপারটা আরো ভয়ানক, আমার মাদ্রাসাপড়ুয়া ছোটভাইকে দেখে ফিরছিলাম, যাত্রাবাড়ী বাসস্ট্যান্ডের কাছেই—তিনজন পাগল আমার পথ আগলে ধরল, তাদের দুইজন দুই দিক থেকে ধরে রাখল আমাকে আর বাকিজন একটা ধারালো দা দিয়ে ইচ্ছেমত কুপালো, তারপর তাদের সুবিধামতো দিকে দৌড়ে চলে গেল। সবাই দেখল, এবং যার যার কাজে আবার মনোনিবেশ করল।

ঘাড়ের বাম দিকের কোপটা ছিল মারাত্মক, হাতটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল, বাম হাতকে বাঁচাতে ডান হাত এগিয়ে দিয়েছিলাম, তিনটা আঙুলের অর্ধকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল রাস্তায়। সেগুলোকে কুড়িয়ে এনে যত্ন করে যার যার জায়গায় বসিয়েছিলাম, না কোনো সমস্যা হয় নাই।

এর পরের ঘটনা? সেদিন অনেক রাত করে ঘুমিয়েছিলাম। মেসে কেউ ছিল না, দরজা নক করতে ঘুমের ঘোরেই খুলে দিয়েছিলাম। তারপর চোখ বেঁধে, সারারাত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আফতাবনগর আবাসিক এলাকা পেরিয়ে প্রজেক্টের কাশবনে নিয়ে ঠিসুম, ঠিসুম...। প্রতিবারই ওরা নিশ্চিত করে, কিন্তু মরে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছি আমি, এ ব্যাপারগুলো আমাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে, মনে হচ্ছে আমাকে কেউই মারতে পারবে না, আমি অমর।

কুত্তাটার কথা প্রায়শই মনে পড়ে আমার, সে যদি সে রাতে আমার মুখে প্রস্রাব না করত তাহলে এই অমরত্ব!

আমি? ফুরকান।

১২।
‘বাবা, তুমি? সময় নষ্ট হলো না তোমার? আমি চাই না আমার জন্য একমুহূর্ত সময়ও নষ্ট হোক তোমার? আমি আর তুমি তো একই বাবা, পার্থক্য শুধু এই এই গরাদটা, এক পাশে তুমি, তোমরা, ঐ যে অফিসারটা, ঐ যে ওরা, ওরা ওরা ওরা সবাই, আর এ পাশে শুধু আমি, আমি, আমি, তোমার রূপ ধরে আমি, উনার রূপে আমি, ওদের রূপে, সবার রূপে আমি, বাবা আসলে সবাই পাগল, আমি স্বীকার করি, তোমরা করো না।’

চৌধুরী ফয়সাল করিম খান, লোহার শিকের অন্যপ্রান্ত থেকে দেখলে তাঁকেও কয়েদির মতো লাগবে অনায়াসে। সাকসেসফুল ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, চেম্বার অব কমার্সের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট, পত্রিকার মালিক, টিভি চ্যানেল, দুইবারের এমপি...

তাঁর পেছনেই কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরও অনেকেই। ‘স্যার রাস্তায় দাঁড়িয়ে গণতন্ত্র, পলিটিক্স কী কী সব রাষ্টবিরোধী কথা বলছিল।’ ততক্ষণে তালা খুলে গেছে।

‘বাবা, আই ক্যান হোল্ড মাইসেলফ, তোমার কথা ভেবেই রেফেরেন্স দেইনি, আফটার অল তোমার রেপুইটেশনস। বাট এঁরা খুব ভালো ব্যবহার করেছে, সম্ভবত এঁরা আমার রক্তে তোমার ঘ্রাণ পেয়ে গিয়েছিল, অথচ আমার যুদ্ধ এই ঘ্রাণটার বিরুদ্ধেই।’

‘সরি স্যার’ হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়ায় যুবকটি, সেই অফিসারের দিকে।

‘ঠিক আছে, সরি, সরি।’

‘নো সরি, আই এম আ ব্লাডি শুয়োরের বাচ্চা, আপনিই তো বলছিলেন, যা বলেছেন, একদম ঠিক বলেছেন, বাবা ঠিক বলেছে না? বাবা যাও, বাবা, কান অন... আই এম এ সিম্পল প্রোডাক্ট, নাথিং এলস...’

নিয়মানুযায়ী সরকারি কাগজে স্বাক্ষর করে ছেলেকে নিয়ে বের হতে হতে পেছন ফিরে তাকালেন চৌধুরী ফয়সাল করিম খান, এই তাকানোর মধ্যে কী আছে সেটা হয়তো পরে অনুমান করতে পারবে সবাই।

থানা থেকে বের হয়ে ছেলেটি বাবার গাড়িবহরের তোয়াক্কা না করে হনহন করে ফুটপাত ধরে হাঁটতে আরম্ভ করে, কিছুদূর গিয়ে পেছন ফিরে চিৎকার করে বলল, ‘বাবা আমি বনানী কবরস্থানে যাচ্ছি, মার কোলে শুয়ে থাকব একটু... তুমি যাও, সরি, আমার জন্য তোমার অনেক সময় নষ্ট হয়েছে, যাও, আই অ্যাম জাস্ট আ প্রোডাক্ট, ম্যান!’

শেষ হয় না গল্পেরা...

সময়ে সবকিছু পরিবর্তিত হয়—পাগলটির জন্য পৃথিবী যখন আত্মহত্যার সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছে ঠিক তখনই হেমলকের বাটিতে ডুবে থাকা ছেলেটি পাখিদের এসাইলাম থেকে গাছেদের শেষকৃতানুষ্ঠান সেরে আত্মহত্যার মঞ্চে এসে মুক্তি দেয় পাগলটিকে, পাগলটি হয়ে যায় বারবার মৃত্যুকে লাত্থি মেরে ফিরে এসে অমর হতে যাওয়া ফুরকান, আর বারবার মৃত্যু থেকে ফিরে আসা ফুরকান অদম্য আগ্রহে ডুব দেয় সক্রেটিসের জন্য সদাপ্রস্তুত হেমলকের বাটিতে।

   

ফেরদৌস আরার প্রবন্ধের আলপথ বেয়ে পাঠক চলে যান জ্ঞানের সমুদ্রদর্শনে



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘লেখকের প্রচুর অধ্যয়ন, পাঠগভীরতা, নিবিড় অনুসন্ধিৎসা, ঘোরলাগা শব্দপুঞ্জে, ভাষার শিল্পিত সুষমায় লেখাগুলি প্রাণ পেয়েছে। তাই গ্রন্থের তথ্যসমৃদ্ধ বারোটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য শুধু নয়, নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, জানার তাগাদা তৈরি করবে—বোধে, তৃষ্ণায়, জীবনজিজ্ঞাসায়। নিজের কথাই বলি, ফেরদৌস আরা আলীমের চোখ দিয়ে পড়তে পড়তে আমি নিজে প্রায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আফরোজা বুলবুল কিংবা প্রতিভা মোদক (‘যে জীবন শিল্পের, যে শিল্প জীবনের’), করুণা বন্দোপাধ্যায়, রবিশংকর বলকে (‘চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর’) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে আস্বাদ করি সময়-পরিক্রমায় লেখক ফেরদৌস আরা আলীমের কলমের ক্ষুরধার ক্রমমুগ্ধকর সৌন্দর্য।’

শনিবার (৪ মে নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক গলিতে অবস্থিত মাসিক নারীকণ্ঠ পত্রিকা-আয়োজিত ‘বই আলোচনা’-অনুষ্ঠানে ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আলপথে শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের মূল আলোচকের আলোচনায় তহুরীন সবুর ডালিয়া এসব কথা বলেন। বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনায় আরও অংশ নেন নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা জিনাত আজম, সালমা রহমান ও মাধুরী ব্যানার্জী।

নারীকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আহমেদ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শাহরিয়ার ফারজানা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতারী ইসলাম বলেন, ‘নানা বিষয়ে ফেরদৌস আরা আলীমের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সহজভাবে তিনি আমাদের সমাজবাস্তবতার যে-চিত্র আঁকেন তা মনের গভীরে সাড়া জাগায়। তার লেখা পড়ে এটুকু বলতে পারি যে, তার লেখা আমাদের জন্য গবেষণা ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান আকর।’

প্রবন্ধের আলপথে বইয়ের প্রকাশক, কবি ও খড়িমাটি-সম্পাদক মনিরুল মনির বলেন, ‘নারীমুক্তি বিষয়ে এ-বইয়ে দুটি তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে আরও কাজ করার জন্য গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রকাশিত বই নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘বড় কিছু হওয়ার কথা ভেবে লিখিনি, মনের আনন্দেই গোপনে গল্প-কবিতা লিখেছি। এমন একসময়ে আমরা লিখতাম, লেখা প্রকাশ করতে খুব লজ্জাবোধ করতাম। অবশ্য লিখতে গিয়ে তেমন কঠিন বাধা আমাকে ডিঙোতে হয়নি। একালের চেয়ে আমাদের সময়টা ছিল অনেক সুন্দর ও ভালো। মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল সমাজে। গণ্ডগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে চড়ে ঢাকা গিয়েছি একা-একা, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। মা-বাবারাও নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকাল মেয়েরা পদে-পদে বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের কলুষিত সমাজব্যবস্থা ও নষ্ট রাজনীতি।’ সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রশংসার ভূমিকা কম নয়। একজন লেখক তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য পেলে অনুপ্রাণিত হন যা তাকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি জোগায়।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা ও সদস্য রোকসানা বন্যা, মহুয়া চৌধুরী, রেহানা আকতার, সাহানা আখতার বীথি, কানিজ ফাতেমা লিমা, বিচিত্রা সেন, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, চম্পা চক্রবর্ত্তী, প্রচার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জয়, কবি মেরুন হরিয়াল ও কবি মুয়িন পারভেজ প্রমুখ।

;

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

;

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;