মাক্সিম গোর্কির অকালবোধন



সাখাওয়াত টিপু
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

কথাসাহিত্যিক, তাত্ত্বিক ও কবি মাক্সিম গোর্কি ১৫০ বছর বেঁচে আছেন, এটা একটা আজব ঘটনা। যদিও তিনি ইহকাল গত করেছেন ১৯৩৬ সালের ১৮ জুন। মৃত্যুর পর এই বেঁচে থাকাকে আমরা বললাম মাক্সিম গোর্কির অকালবোধন। তিনি কেন বেঁচে আছেন? কিভাবে আছেন? সেই চিন্তারাজ্যে প্রবেশের আগে আমরা দুটো কথা বলে নিতে চাই। তাতে হয়তো আলোচনার কিঞ্চিত সুবিধে হতে পারে। কড়ে কড়ে হিসেব করলে লিখিত রুশ ভাষার বয়স সহস্রাধিক বছর। প্রাচীন রুশ ইতিহাসের দিকে তাকালে সেই অর্থ অল্পস্বল্প বোঝা যাবে। রুশ লিখিত ভাষার বর্ণ আর ভাষার বিকাশ ঘটে গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের হাতেই। বিশেষত বাইবেলের অনুবাদ কর্মের ভেতরই রুশ ভাষার গঠন বা স্ট্রাকচার সৃষ্টি হয়। আমরা বলছি না, রোমান কিংবা গ্রিক ভাষার মতোই রুশ ভাষা এক পদার্থ। রুশ সম্পূর্ণ আলাদা ভাষা। আমরা দেখাচ্ছি ভাষার প্রভাবক কোথায়। দেখা যায়, রুশ ভাষার বর্ণমালা রোমান আর গ্রিক বর্ণমালারই মিশ্রিত ভাষা। তাই কোনো কোনো রুশ বর্ণ রোমান বর্ণ হতে খানিক তফাৎ। কোনো কোনো বর্ণ অবিকল গ্রিক বর্ণেরই মতো। ইয়ুরোপীয় ইতিহাসবেত্তাগণ এটাকে কনস্তান্তিনপোলীয় বা বাইজেন্টাইন বলেন। বাংলায় আমরা যাকে বলি ‘বিজাতীয়’! মানে অপর জাতির প্রভাব। এমন কথা বলার পেছনে ছোট্ট চিন্তা কাজ করেছে। তাত্ত্বিকভাবে দেখলে ভাষার বর্ণের সঙ্গে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ভাব প্রভাবক হয়ে ওঠে। তার একটি অর্থ বা ভাবগত মানসকাঠামো, আর অন্যটি সাংস্কৃতিক উৎপাদন-কাঠামো। আর বাইবেলের প্রভাব কিভাবে রুশ সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছিল, সেটা পরখ করা। সেটা কেমন?

দশম শতাব্দীর বহুদেবত্ববাদী সামন্ত রাজা ভ্লাদিমিরের রাশিয়া খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ থেকে লিয়েভ তলস্তোয়ের সাহিত্যনাগাদ রুশসমাজের বাইবেলীয় সহজ ও নৈতিক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যাবে অনায়সে। মনে রাখা দরকার—তলস্তোয় মিশনারি লেখক নন, আধুনিক এক কথাশিল্পী। লিয়েভ তলস্তোয়ের ‘হোয়াট ইজ আর্ট’ বা ‘শিল্পের আদল কী’ বইয়েও সেই চিন্তা দৃশ্যমান আছে। ধর্মশাসিত সাহিত্য আদতে ‘মঙ্গল’ আর ‘অমঙ্গল’ দিক-দর্শনে চিহ্নিত। সেই ক্ষেত্রে ইয়ুরোপের অপরাপর রোমান ক্যাথলিক চার্চ-প্রভাবিত দেশগুলোর সাহিত্য থেকে রুশ সাহিত্য একরাশ ভিন্ন প্রকৃতির। কেননা গ্রিক অর্থোডক্স চার্চ আর রুশ সমাজের লৌকিক সংস্কৃতি মিলে ইয়ুরোপখণ্ডে নতুন ভাষা আর সাহিত্য জন্ম নিয়েছিল রাশিয়ায়। রুশ প্রাচীন ভাষা-সাহিত্যের এটা একটা সরলরেখা। আমরা চিন্তার অন্য বিন্দুতে পৌঁছাতে চাই। সেই বিন্দু কোথায়?

রুশ সাহিত্য উদ্ভবের প্রধান শর্ত ছিল রাষ্ট্র গঠন আর লিপির প্রচলন দিয়েই। বিশেষত নদী-বাণিজ্যকে আমলে নিয়ে ৯১১ আর ৯৪৪ ইসায়ি সনে গ্রিসের সঙ্গে রুশীয়দের চুক্তিকে বলা হতো ‘লোতোপিস্’ বা ‘বর্ষপঞ্জি’। এসব চুক্তি গ্রিক আর রুশ ভাষায় লিখিত হতো। প্রাচীন এসব সাহিত্যের কথা সমসাময়িক আরবের সাহিত্যিক ইবনে খালদুন আর ইবনে আল নাদিমের লেখায়ও উল্লেখ আছে। মজার ব্যাপার হলো—১৯১৫ ইসায়ি সনে মাক্সিম গোর্কি দেশে ফেরার পর একই শিরোনামে ‘লোতোপিস্’ নামে নতুন পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটি পরে দু-বছরের মাথায় বন্ধ হয়ে যায়। সেই তর্কে আমরা পরে আসছি। তবে রুশ ভাষার সাথে বাংলার অদ্ভুত মিল—ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামোর ভেতর দিয়ে দুটো ভাষার লিখিত রূপ প্রতিষ্ঠিত হয়। বেমিলটা এখানেই—খোদ রাষ্ট্র গঠনকে আমলে নিয়ে রুশ ভাষার জন্ম। আর বাংলা জনসংস্কৃতি থেকে উঠে আসা ভাষা। আমাদের ভাষা আন্দোলন ছিল—আত্মনিয়ন্ত্রণ আর প্রতিষ্ঠিত ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। আমাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায় মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়েই। ভাষা আন্দোলন সেখানে ছিল অনুপ্রেরণা আর দিকনির্দেশক মাত্র। ফলে আমরা যখন রুশ সাহিত্য নিয়ে আলোচনা পাড়ছি, তাতে ‘রাষ্ট্র’ নামক পদ আর পদার্থকে মাথায় রাখলে আলোচনার সুবিধে হয়। আলোচনা সুবিধার্থে কয় বাক্যে রুশ সাহিত্যের ইতিহাসে চোখ বোলাব আমরা।

রুশ সাহিত্যের রত্নভাণ্ডার বিশাল। খোদ মাক্সিম গোর্কির রচনাখণ্ড ৩০ খানার বেশি। আমাদের আলোচনা, পরিমাণের তুলনায় ধূলিকণা মাত্র! প্রাচীন যুগের রুশ সাহিত্য প্রায় ৩০০ বছরের। ১০০০ থেকে ১৩০০ সালনাগাদ বর্ষপঞ্জি, সন্তদের জীবনকাহিনী, উপদেশ বাণী, লৌকিক ধর্মোপদেশ, পাদ্রীদের জয়গান আর রূপকথার নৈতিক বিষয়াদিই প্রাচীন রুশ সাহিত্যে প্রধান প্রবণতা। কোনো কোনো রুশ তাত্ত্বিক এসময়ের সাহিত্যকে ‘মৌলিক সাহিত্য’ রূপে আখ্যা দিয়েছেন। রুশ সাহিত্যের মধ্যযুগ ৪০০ বছরের। চতুর্দশ শতাব্দীতে রুশ সামন্তপ্রথার ভাঙন ধরে। রাশিয়ানদের এটা মূলত মোগল আর তাতারবিরোধী সংগ্রামের যুগ। ফলে রুশের সাধারণ জনগণ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। এটা রুশীয় বীরগাথা কাহিনীর কাল। বলা চলে ব্যক্তির জীবনকাহিনীর কাল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে রুশ রাজ্যের পত্তন ঘটে। ফলে প্রাচীন লৌকিক আর বীরগাথা সাহিত্যের সাথে যুক্ত হয় ভ্রমণকাহিনীও। ষষ্ঠ আর সপ্তদশ শতকে রুশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমাপ্তি ঘটে। সাহিত্যও যুগোপযোগী হতে থাকে আস্তে আস্তে। রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির বিকাশের ফলে যে অস্থিরতা দেখা দেয়—তাতে সাহিত্যে নতুন অর্গল খোলে। অন্তর্গতভাবে সাহিত্যে আত্মজীবনীর পালাবদল ঘটে। আত্মজীবনী থেকে সাহিত্যে রূপান্তর ঘটে ব্যক্তি মানুষের পার্থিব জীবন। ফলে রুশ সাহিত্যে নানা নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত হয় নানান ছান্দসিকের কবিতা, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, নাটক আর প্রহসন।

অষ্টাদশ শতাব্দী রুশ ধ্রুপদী সাহিত্যের সংস্কার যুগ। রাজা পিয়োতরের সমাজ সংস্কারের ফলে রুশ সংবাদপত্র আর প্রবন্ধ সাহিত্য নতুন আকার পায়। এই সময় সাহিত্যে দুটো জিনিসের বিস্তার ঘটে। একটি রুশ সাহিত্য বাসনাবাদ [রোমান্টিসিজম] আরেকটি জ্ঞানবাদী বাস্তবতা [দ্য রিয়েলিটি অব নলেজ]। রোমান্টিকতা নিয়ে দুটো কথা বলা দরকার। রোমান্টিকতা দুটো ভাবের ভর মাত্র। ব্যক্তির আবেগ আর কল্পনার মিলন। বাংলায় আমরা ‘রোমান্টিসিজম’ কথাকে বললাম ‘বাসনাবাদ’। কেন? ভাষাশাস্ত্র বলছে, বাসনা মানে বাস না করা। মানে যেখানে সে বস্তুগতভাবে বাস করে না, বাস করে ভাবগতভাবে। মানে কল্পনার আশ্রয়ে। তাই বললাম বাসনাবাদ। কথামালা আলেকজান্দ্র রাদিশশোভ, ইভান ক্রিলোভসহ অপরাপর সাহিত্যিকদের দুয়েকছত্র পাঠ করলে তার হদিশ মিলবে। কোনো কোনো রুশ সাহিত্য তাত্ত্বিক এটাকে বলছেন ‘সেন্টিমেন্টালিজম’ বা ‘জাগরণবাদী’ যুগ। কারণ সংবাদপত্রের সাথে প্রকাশিত হতে থাকে নানা সাহিত্য সাময়িকী। নানা বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তারও বিকাশ ঘটতে থাকে এসময়। ফলে আমরা একটু অন্যভাবে দেখব। তো দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের ভাষায় বললে বলতে হয় ‘এনলাইটেনমেন্ট’। বাংলায় আমরা ‘এনলাইটেনমেন্ট’ শব্দটিকে বললাম ‘প্রভাতফেরি’। মানে প্রভাতের আলোর দিশারি। তাতে একটা সুবিধে হয়—ভাষা আন্দোলনের সঙ্গেও বাংলার নবজাগরণ মিলিয়ে দেখতে পারি আমরা। এক অর্থে ভাষার জাতীয় জাগরণ বটে। এটা নিছক তাত্ত্বিক প্রস্তাবনা মাত্র! ভবিষ্যত যেহেতু সামনেই। তাই টুকলাম হালকা ইশারায়।

২.
রুশ সাহিত্য আধুনিক যুগে প্রবেশ করে ঊনবিংশ শতকেই। আধুনিক সাহিত্যের এই ধারা প্রধান দুটো ভাগ হয়ে যায়। একদল প্রকৃতিবাদী ধারা, আরেকদল বাসনাবাদকে ভেঙে বাস্তববাদের দিকে ধাবিত হন। প্রকৃতিবাদীদের মধ্যে ভিসসারিন বেলিনস্কি, ইভান তুর্গোনেভ, আলেসাই কলোৎসভ উল্লেখযোগ্য। এরা পশ্চিমাধাঁচের কলাকৈবল্যবাদের দিকে ধাবিত হন। তারা খানিকটা পশ্চিমা উদারনৈতিক গণতন্ত্রী ভাবাপন্ন লেখক। উল্লেখ করার মতো বিষয়—তুর্গোনেভের দুঃসাহসী রচনা ‘শিকারীর রোচনামচা’র কথা। ভূমিদাস প্রথাবিরোধী এই রচনা তৎকালীন সরকার বাজেয়াপ্ত করতে বাধ্য হন। মূলত নিত্যঘটনার অন্তঃসার শূন্য স্বপ্নবিলাস আর জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষার অবাস্তব বাসনাকে বিদ্রুপ করা হয়েছে প্রকৃতিবাদী সাহিত্যধারায়। দ্বিতীয় ধারাটির প্রধান প্রবক্তা আলেক্সান্দর পুশকিন, লিয়েভ লেরমেন্তভ, নিকোলাই গোগল। পুশকিনকে তো রুশ জাতীয়তাবাদের নায়কই বলা হয়। রুশ দেশের জাতীয় কবি তিনিই। পুশকিন কবিতায় প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘আমার নাম জেনে তোমার কাম কী’। ‘আমি’ এবং ‘নাম জানা’র ভেতর দিয়ে জাতিত্বের প্রশ্নটি সামনে এনেছিলেন পুশকিন। আর মিখাইল লেরমেন্তভের ‘আমাদের কালের নায়ক’ উপন্যাসে দেখা যায়, নায়ক পিচুরিন খোড়া বদখৎ প্রকারের। রিষ্ট-পুষ্ট নায়কের বিপরীতে তিনি রুশীয় সমাজের ভেতরকার অন্য এক দুস্থ নায়ককে হাজির করেছেন। উপন্যাসে তিনি নাদুস-নুদুস নায়কের ধারাকে পাল্টে দেন।

বলা হয়ে থাকে, নিকোলাই গোগলের ‘ওভারকোট’ গল্পের পকেট থেকেই আধুনিক কথাসাহিত্যের জন্ম। কথাটা কোথাও ইভান তুর্গেনেভ কিংবা কোথাও ফিয়োদর দস্তোয়ভস্কির নামে চালু। ‘ওভারকোট’ গল্পে দেখা যায়, নায়ক আকাকি আকাকিয়োভিচ একজন নিম্নপদস্থ সরকারি কেরানি। আকাকি নিঃসঙ্গ মানুষ। তদুপরি একজন দৈন্য, বিরস, হতাশ আর অভাবী মানুষ। একই সঙ্গে তিনি প্রতিবাদহীন ও ভঙ্গুর প্রকৃতির মানুষ। অভাবী আকাকির ওভারকোট কেনাটাই জীবনের একটা বড় ঘটনা। আর ওভারকোট হারানোর ভেতর দিয়েই সে মরে ভূত হয়ে যায়। ক্লিষ্ট এক মানুষের স্বপ্ন দিয়ে শুরু, আর শেষ হয় অস্তিত্ব বিলীনের ভেতর দিয়েই। আসলে আকাকি আধুনিক সমাজের এক রহস্য! এমন কোনো চরিত্র ছিল কি ছিল না সে নিয়েই বিস্তর তর্ক আছে। আকাকির ওভারকোট বস্তুত তৎকালীন অন্তঃসারশূন্য রুশ সমাজ ব্যবস্থার প্রতীক! গোগল সম্পর্কে বন্ধু-পুশকিন বলেছিলেন, ‘হাসাতে হাসাতে তিনি চোখে অশ্রু নিয়ে আসতেন।’

ঊনবিংশ শতাব্দীর দুজন রুশ কিংবদন্তী লেখক ও তাত্ত্বিক ফিয়োদর দস্তয়োভস্কি আর লিয়েভ তলস্তোয়। দুটো কথা বলা দরকার। গোর্কি সাহিত্যের ওপর আন্তন শেকভের যে প্রভাব, দস্তয়োভস্কি আর তলস্তয়ের প্রভাব অনেক কম। তিনজনেরই সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য ভাগ্যাহত মানুষ। তবে তফাৎ ছিল কিছুটা। কারণ বাইবেলীয় নৈতিকতা থেকে গোর্কি খানিকটা সাহিত্যকে দূরে রেখেছেন। শেষ জীবনেও তলস্তোয় আর গোর্কির সম্পর্ক শিথিল ছিল। গোর্কি মিলিয়েছেন রূপকথা, লৌকিক সাহিত্যের সঙ্গে আধুনিক দুনিয়ার ভুখানাঙ্গা মানুষের জীবন। তবে সত্য এই—হাল-নাগাদ বাংলাভাষায় সবচে বহুল পঠিত আর আলোচিত রুশ লেখক দুজন। ফিয়োদর দস্তয়োভস্কি আর লিয়েভ তলস্তোয়। ফলে আমরা আলোচনায় ওদিকে গেলাম না। সাহিত্যমহলে দুজনের চেয়ে খানিক কম আলোচিত লেখক মাক্সিম গোর্কি। কেন? মিখাইল গর্ভাচেভের অর্থহীন অর্থনৈতিক সংস্কার গ্লাসনাস্তো আর পেরোস্ত্রোইকার ফল? নাকি গোলকায়নের যুগে বিশ্বপুঁজিবাদের উদারনৈতিক সংস্কৃতির যুগে গোর্কির সাহিত্য খাপ খাচ্ছে না আর? প্রশ্নগুলোর উত্তর জটিল নয়। ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে। কার্ল মার্কসের তত্ত্ব বিচারে দেখা যাবে—এহেন অর্থনৈতিক সংস্কারকে বলা চলে ‘বুর্জোয়া সমাজের দ্বন্দ্বমূলক উন্নয়ন।’ দ্বন্দ্ব কোথায়? আরেকটু এগিয়ে বলি—উদারনৈতিকতার ভেতর দিয়ে পুঁজিবাদ পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া ছাড়া অন্য উপায় আছে, বৈকি! একদম নাই। বস্তুত বৈষম্যমূলক ভোগের স্বাধীনতা মানুষের মুক্তি দিতে পারে না। উন্নয়ন আছে তো, মানবতা নাই। শাসক আছে তো গণতন্ত্র নাই। বণ্টন আছে তো সাম্য নাই। খোদ মিখাইল গর্বাচেভই দু দশকের মাথায় ভুলের জন্য নিজের চুল ছিঁড়ছেন! তিনি বলেছেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন সবচে বড় ভুল।’ তাহলে আমরা কোথায় যাব?

৩.
বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যের নায়ক মাক্সিম গোর্কি। জুলিয়ান পঞ্জিকা মতে ম্যাক্সিম গোর্কির জন্ম ১৮৬৮ সালের ১৬ মার্চ। অবশ্য গেগরিয়ান মতে সেটা ১২ দিন পর ২৮ মার্চ। ভলগার তীরবর্তী নিজনি নোভগরদ্ শহরের পিতার আদিবাসেই তার জন্মস্থান। আদি নাম তার আলেক্সেই মাক্সিমভিচ পেশকভ। বাংলায় যার অর্থ পেশকভ বংশের মাক্সিমের ছেলে আলেক্সেই। প্রশ্ন হলো—‘আলেক্সেই মাক্সিমভিচ পেশকভ’ কিভাবে ‘মাক্সিম গোর্কি’ হয়ে উঠলেন? ছদ্মনামের পেছনে এক টুকরো ইতিহাস আছে। সেটা কী? জর্জিয়ায় ১৮৮৯ সালে পুলিশি নজনদারিতে পড়েন মাক্সিম। তখন ‘আত্মবিকাশ’ নামে বামপন্থী গোপন দলে নাম লেখান তিনি। কাজ দুটোই—জ্ঞানদান আর দলীয় প্রচারকার্য সাধন। জর্জিয়ার রাজধানী তিতলিসে বামপন্থী শ্রমিকদের সঙ্গেও আত্মীয়তা হয় সে সময়। রাস্তায় কাজ করার সময় জেলখাটা কয়েদি আলেক্সান্দর কালিজনির সঙ্গে পরিচয় তার। সেই কয়েদি গোর্কির মানবেতর জীবন, দুঃখ-দুদর্শার কথা শুনে বললেন, কাহিনীগুলো লিখতে। শ্রমিক সমর্থিত ‘ককেশাস্’ পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ছাপা হয় ‘মাকার চুদ্রা’। তাতেই নিজের আদিনাম নাম পাল্টিয়ে রাখলেন মাক্সিম গোর্কি। বাংলা ‘গোর্কি’ শব্দের অর্থ ‘তেতো’ বা ‘তিক্ত’। মানে তিক্ততায় ভরা জীবন। তবে পরিণত ‘মাক্সিম গোর্কি’ আর ছন্নছাড়া ‘আলেক্সেই মাক্সিমভিচ পেশকভ’ এক জিনিস নয়। অভাব, অন্নহীন, বখে যাওয়া কিশোর আর উচ্ছন্ন পরিবারিক জীবনের কষ্টিপাথর ঘষে নাম নিয়েছিলেন মাক্সিম গোর্কি। সেটা কিভাবে?

গোর্কির দরিদ্র পিতা মাক্সিম সাভভাতেভিচ্ পেশকভই ছিলেন ভোলগা স্টিমশিপ কোম্পানির ছুতোরমিস্ত্রি। মা ভার্ভারা ভাসিলিয়েভ্না পেশকভা মালিক ভাসিলি কাশিরিনের কন্যা। বিয়ের পর গোর্কির পিতার পেশাগত পদোন্নতি হয়। কিন্তু ১৮৭১ সালে জুলাই মাসে পুত্র জন্মের তিন কি চার বছরের মাথায় ওলাওঠা রোগে পিতা পেশকভ গত হন। গোর্কির দুরাবস্থার শুরু সেখান থেকেই। মা সন্তানকে নিয়ে ওঠেন বাপের বাড়িতে। অবক্ষয়ী রাশিয়ায় তখন যৌথ পারিবারিক প্রথা ভেঙে পড়েছে। ফলে পারিবারিক সম্পত্তি নিয়েও তিক্ত হয়ে ওঠে সবার জীবন। নানার বিত্তবান পরিবারটিও অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নানা ভাসিলি কাশিরিন গোর্কিকে একদম দেখতে পারতেন না। শুধু শুধু পেটাতেন! কিন্তু তার নানী আকুলিনা কাশিরিনা ছিলেন খুব দরদী। হস্তশিল্পের কারিগর হিসেবে খুব নামডাক তার। নাতিকে ছড়া, লোক কাহিনী আর রূপকথার গল্প শোনাতেন। মূলত গোর্কির সাহিত্যের ভ্রুণ জন্মায় নানীর হাতেই। মায়ের নৈতরঙ্গ জীবন আর সন্তানের প্রতি উদাসীনতা গোর্কির ছেলেবেলা তিক্ততায় পর্যবসিত হয়। মা চলে যান নিজের চেয়ে ১০ বছরের ছোট এক পরপুরুষের কাছে। সেটাও সুখ আনেনি তার। তিনি মারা যান ১৮৭৯ সালে।

গোর্কি প্রাথমিক বিদ্যাপীঠে কদিন গিয়েছিলেন, সেটা না যাওয়ার মতোই। বাড়িতে পড়াশোনার পরিবেশ না থাকায় তিনি হয়ে ওঠেন ডানপিটে ভবঘুরে এক কিশোর। খেতে দিত না নানামশাই। ফলে বোহেমিয়ান জীবন ছাড়া তার অন্য উপায় ছিল না। গোর্কি নানার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছিলেন নানীর হার-মাদুলি চুরির দায়েই। নানার সাফ সাফ কথা—‘তুই আমার বাড়ি থেকে হার-মাদুলি চুরি করিস, তোর পথ তুই দেখ।’ অন্নাভাব তাকে পথে নামিয়েছিল। প্রথমদিকে নানালোকের ফায়-ফরমাস খেটে পেট চালাতেন। পরে কাজ নেন খাবার হোটেলে। কত বিচিত্র পেশা তার—মুচির দোকান, রেলস্টেশনের দাড়োয়ান, শিক্ষানবিশি ড্রাফটম্যান, রাস্তার দিনমজুরি, মাছের আড়ত থেকে বাগানের মালির কাজ পর্যন্ত করতে হয়েছে তাকে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের কোনো কোনো ঘটনা একই রকমের। তৎকালীন এক রাজনীতিকের বাসার পিস্তল চুরির দায়ে পুলিশি তদন্তের শিকার হয়েছিলেন নজরুল। সঙ্গে কমরেড মুজফ্ফর আহমদ থাকায় সে কিস্তিতে রেহায় পান তিনি। যদিও চুরির ব্যাপার ছিল একদম ভুয়া! গোর্কির বেলায় সেটা উল্টো! চুরির দায়ে বঞ্চনা আর সাজা ভোগ করেছেন। গোর্কির জীবনী পড়লে মনে হতে পারে—বোহেমিয়ান চালচুলোহীন এক মহানায়ক কিভাবে বিক্ষুব্ধ সময় পার করছেন। যিনি জীবনপাথরে বীজ ফেলে অমূল্য শস্য ফলিয়েছেন। বীজ রোপণ করেছেন ভবিষ্যতের।

মাক্সিম গোর্কি নব্বইয়ে দশকে চষে বেড়ান পুরো রাশিয়া। ১৮৮৪ সালে কাজান শহরে যান ১৬ বছর বয়সে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গিয়ে ব্যর্থ হন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবে। স্বপ্ন চুরমার হওয়া তরুণ দুঃখ-কষ্ট, গ্লানি-হতাশা আর মর্মযাতনায় দুবার আত্মহত্যা করতে গিয়েও ব্যর্থ হন। আরো নিষ্ঠুর ব্যাপার—‘আত্মহত্যা পাপ’ এমন দায়ে তাকে একবার শাস্তিস্বরূপ পাঠানো হয়েছিল গির্জার ফাদারের কাছে। পাপ মোচনের ভেতর দিয়ে যদি তার কিছু ইহলৌকিক নৈতিক শিক্ষা হয়। সেখানে এক কাণ্ড করে বসলেন তিনি। গির্জার ফাদারকে প্রশ্ন করে বসলেন—‘তোমরা বলছো এখানে ঈশ্বর আছে, কই তাকে তো দেখলাম না এখানে।’ অদ্ভুত আচরণের জন্য তাকে সেখান থেকেও বহিষ্কার করা হয়। এটা তার ঊনিশ বছর বয়সের ঘটনা।

গোর্কির জীবন নজরুলের জীবন নয়, দুজনের অন্তর্সলিলা রূপ একই নদীর মতো বয়ে গেছে। দুজনই জানতেন সাহিত্য আর লড়াইয়ের জন্য বেপোরোয়া জীবনে কোথায় ছুটতে হয়, কোথায় থামতে হয় আর কোথায় দাঁড়াতে হয়। বিক্ষুব্ধ জীবন আর হাড়-খাটুনির কৈশোরে দুজনেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে মজে ছিলেন বইয়ে বইয়ে। কপালে স্কুল না জুটলেও বই হয় চিরসঙ্গী। নজরুলের মতো প্রথম জীবনে তার ব্যর্থতার শেষ নাই। তবে চরিত্রগত দুজনেরই অদ্ভুত অনেক মিল—পেশাগত জীবন, অপ্রাতিষ্ঠানিক স্বশিক্ষিত, জেলখাটা, শাসকের কোপানলে পরা, বই নিষিদ্ধ হওয়া, সম্পাদিত পত্রিকা নিষিদ্ধ হওয়া, বৈবাহিক জীবন থেকে রাজনৈতিক মতাদর্শগতভাবে প্রায় একই অর্গলের ভিন্ন ভিন্ন রূপ! ফলে আমরা বলতে পারি—গোর্কিও নজরুলের মতো আমাদের পরম বন্ধু। আমাদের সাহিত্যেরও অংশ। কেননা রুশ ভাষা ভেদ করে গোর্কির সাহিত্য আর চিন্তার বাংলা তর্জমা আমাদের সাহিত্যে নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে।

৪.
অভিজ্ঞতার পোড়খাওয়া অস্থির এক পান্থজনের আঁকাবাঁকা পদ দেখলাম এতক্ষণ। এই পদ ধূসর নয়, রক্তাক্ত টগবগে এক মানুষের। যিনি দেখিয়েছেন আস্তাকুঁড়ে থেকে বন্ধুর পথ মাড়িয়ে কিভাবে সৃষ্টিশীলতার অমোঘ সূর্যকে ছুঁতে হয়। আর শুধু নিজেকে জাগিয়ে নয়, অন্যের মানসালোক কিভাবে জাগাতে হয়—সেই কাণ্ডটিও। কল্পনা করুন—নবযুগের গোর্কির ‘বুড়ি ইজেরগিল’ রূপকথার কাহিনী। যেখানে দাংকো নিজের হৃদপিণ্ড তুলে আনছেন। আর তার স্ফটিকালোয় পথ দেখাচ্ছেন সর্বসাধারণকে। খুবই সুন্দর হৃৎপিণ্ডের আলো, খুবই প্রতীকী আলো। যেন বাতলে দিচ্ছেন অভীষ্ট ভবিষ্যতের পথ। তাহলে প্রশ্ন জাগে—মাক্সিম গোর্কির সাহিত্য কি পদার্থ? রুশতাত্ত্বিকদের মধ্যে দুধরনের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। একদল মনে করেন, সাহিত্যে রুশ বাস্তববাদের জনক মাক্সিম গোর্কি। আরেকদল মনে করেন তিনি ‘রিয়েলিটি অব সোশালিজম’ বা ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা’র লেখক তিনি। তর্কটা মূলত সাধারণ বুদ্ধিজীবী আর আমলাতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবীদের। এ কথা মানতেই হবে, কানা গলিতে না ঢুকেই তৎকালীন সমাজ-রাষ্ট্র ব্যবস্থার বাস্তবতারই কথাচিত্র এঁকেছেন তিনি। আর যুক্ত করেছিলেন মতাদর্শিক লড়াইয়ের তাত্ত্বিক ভিত। তবে কুটতর্কে জড়াব না আমরা। বলব—শ্রেণী সচেতন বাস্তববাদের ইহজাগতিক গুণবিচারী একজন সফল কথা সাহিত্যিক তিনি।


বার্তা২৪.কম-এর শিল্প-সাহিত্য বিভাগে লেখা পাঠানোর ঠিকানা
[email protected]


বালকবেলায় গোর্কিকে কবি বলে জানতাম। কোথাও জানি পড়েছিলাম ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতার বই ‘পেস্নিয়া অ সোকলে’ বা ‘বাজপাখির গান’। আর প্রথম জীবনে আমি পড়ি ‘পেসনিয়া অ বুলেভিয়েস্তানিকে’ বা ‘ঝ’ড়ো পাখির গান’। যা মনে এখনো গেঁথে আছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় অনুবাদ করেছিলেন সেই বিখ্যাত কবিতা। পরে জেনেছি—১৯০১ সালে রচিত এই কবিতা তাকে অন্য উপাধি দিয়েছিল। কবিতাটি প্রকাশের পর সেন্সর বিভাগের মুখোমুখি হন তিনি। সেন্সর বিভাগের কর্মচারিরা তার নাম দেন ‘ঝ’ড়ো পাখি’। সেই বছরই জারবিরোধী বিপ্লবী কর্মকাণ্ড আর শ্রমিক সংশ্রবের জন্য গ্রেফতার হন তিনি। এমনকি জেলখানার কয়েদি হিসেবেও তাকে ডাকা হতো ‘ঝ’ড়ো পাখি’ নামে। আলেক্সান্দর পুশকিনের কবিতা যেমন গীতিময় আর ছন্দোবদ্ধ, গোর্কির কবিতা সেরকম নয়। তার গদ্যাবদ্ধ কবিতাকে কেউ কেউ গল্প বলে ঠাউরিয়েছেন! শেষ বয়সে আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও মুক্তছন্দে এমন গদ্য কবিতা লিখেছেন। গোর্কির কবিতাটি কেন এত জনপ্রিয় হয়েছিল? উত্তর একটাই—দুষ্টশাসক জারতন্ত্র যে ক্রমে ক্রমে তলিয়ে যাচ্ছিল তার আলোকচ্ছটা কবিতার ভাবে স্পষ্ট করে তুলেছিল। কবিতায় প্রতীক ‘পাখি’ রুশদেশের ভবিষ্যত বিপ্লবেরই ইঙ্গিত বহন করছিল। ঝড়-ঝঞ্ঝা, বজ্র-বিদ্যুৎ মাড়িয়েই ভয়শূন্য পাখিটি বয়ে আনছে আনন্দের বার্তা। সেই অর্থে তিনি একজন ভবিষ্যতদ্রষ্টাও বটেন। সেটা কেমন—

এখুনি ঝড় উঠবে। ঝড় উঠতে দেরি নেই।
তবু সেই দুঃসাহসী ঝ’ড়ো পাখি বিদ্যুতের ভিড়ে,
গর্জমান উত্তাল
সমুদ্রের ওপর দিয়ে দীপ্ত পাখসাটে উড়ে চলে।
তার চিৎকারে
পুলকিত প্রতিধ্বনি ওঠে,
চূড়ান্ত জয়ের ভবিষ্যবাণীর মতো
সমস্ত ভীষণতা নিয়ে ভেঙে পড়ুক,
ঝড় ভেঙে পড়ুক।

[ঝ’ড়ো পাখির গান/ ১৯০১]

৫.
মাক্সিম গোর্কিকে ‘চেল্কাশ্’ গল্পটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। গল্পের নায়ক ‘চেল্কাশ্’ একজন চোরা কারবারি। সে অর্থের দাস নয়, মুক্ত মনের মানুষ। বস্তুত পুঁজিবাদী এই উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও এমন সূত্রের ওপর টিকে আছে। কেন? গোর্কি দেখিয়েছেন, চেল্কাশ্ সমাজ ব্যবস্থার শিকার। চোরাকারবারি করা ছাড়া তার অন্যকিছু করে টিকে থাকার মওকা ছিল না। সমাজ তাকে অন্ধকার পথে যেতে বাধ্য করেছে। মানে তার ইচ্ছার স্বাধীনতা হরণ করেছে। কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যয়ের অনুরূপ বিখ্যাত গল্প আছে, নাম ‘কালোবাজারে প্রেমের দর’। অর্থাভাব নিয়ে নায়কের সঙ্গে নায়িকার সংসার কলহ লেগে থাকত প্রতিনিয়ত। বান্ধবীর সংসারের চাকচিক্যের জীবন দেখিয়ে নায়কের জীবন অতীষ্ট করত নায়িকা-স্ত্রী। নায়ক একদিন আবিষ্কার করেন তার বৌয়ের বান্ধবী-স্বামীর চাকচিক্য। সে পাতি-বুর্জোয়া বান্ধবী স্বামীর অর্থবিত্ত আর বৈভব জীবনের প্রধান কারণ চোরাকারবারি। এক সময় সে বুর্জোয়া শ্রেণিতে উন্নীতও হয়।

‘অন্ধকার মানুষ’কে নিয়ে ১৮৯৫ সালে ‘চেল্কাশ্’ গল্প প্রকাশিত হলে সংবাদপত্রে কাজের প্রস্তাব পান গোর্কি। এখানেই নতুন জীবনের শুরু তার। সে সময় ‘সামারাস্কায়া গাজিয়েতা’ পত্রিকায় তার সহকর্মী ছিলেন একাতেরিনা ভোজলিনা। মেধাবী আর ধনীর মেয়ে একাতারিনা। বছর পেরুনো প্রেমের পর ১৮৯৬ সালে পরিণয়ে আবদ্ধ হন। তাদের সংসার টিকে ছিল মাত্র ৮ বছর। যদিও তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি কখনো। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই গোর্কি প্রেমে পড়েন বিদুষী ভাষাতাত্ত্বিক ও অভিনেত্রী মারিয়া আন্দ্রেইয়েভার। ‘না দইনয়ে’ বা ‘নিচের মহল’ নাটকের রিহের্সাল থেকে। মারিয়া মস্কো আর্ট থিয়েটারের কর্মকর্তা ছিলেন। এই সম্পর্ক টিকে ছিল ১৭ বছর। ১৯২০ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়। গোর্কির নাটুকে জীবন এসময়ে দুটো ঘটনা ঘটে। একটি—বলশেভিক পার্টিতে যোগ দান। অবশ্য গোর্কি পার্টিতে যোগ দেন ১৯০৫ সালে। আর অন্যটি—নাটক মঞ্চস্থ করতে শিকার হন পুলিশি হয়রানির। বলশেভিক পার্টির সভ্য মারিয়া সেসময় অনেক সহযোগিতা করেন তাকে।

আন্তন চেখভের শিষ্য গোর্কির তিনটি নাটক খুবই বিখ্যাত। পাতি-বুর্জোয়া, নিচের মহল আর ফোমা গার্দায়েভ। প্রথম নাটক ‘পাতি-বুর্জোয়া’য় দেখা যায়—পাতি বুর্জোয়া সমাজের সাথে নিচুতলার মানুষের দ্বন্দ্ব। দেখা মেলে কিভাবে একটি সমাজে নিচুতলার মানুষ আরো কত নিচে নামে। আর সুবিধাবাদকে কাজে লাগিয়ে পাতি-বুর্জোয়া সমাজ কতটা উচ্চে উঠতে চায়। সমাজে ভেদাভেদের সংস্কৃতি কিভাবে রূপান্তর ঘটে তার নৈবেদ্য রূপও আছে এতে। নাটকে বিধবা ইলিয়েনার উক্তিটি স্বর্তব্য—‘থিয়েটারে গুরুগম্ভীর দৃশ্যের পরে সব সময়েই হালকা কিছু দেখায়... আসল জীবনে সেটা আরো বেশি দরকার...’। জীবন নিয়ে কেমন বিদ্রুপে ঠাসা এক উক্তি! এটি প্রথম যখন মঞ্চস্থ হয় সমাজের উপরতলার মানুষ দর্শকের সারিতে ভিড় করে। স্তানিস্লাভস্কি ও দেনচাংকোর মতো তাত্ত্বিকেরা এতে অভিনয় করেন। ‘নিচের মহল’ নাটকের কাহিনী ছিল ভাড়াটে বস্তিবাড়ির মানুষের সমাবেশ। বস্তির মানুষের দারিদ্র্যের কষাঘাত, মৃত্যু, গালিগালাজ, মাতলামি, বিশ্বাসঘাতকতা আর কলহভরা জীবনই যেন বেঁচে থাকার সারকথা! জীবন এখানে তুচ্ছ, মূল্যহীন! নাটকে নিষ্পেষিত আর আশাভঙ্গের নিরাভরণ মানুষকে সচেতন করাই ছিল গোর্কিও উদ্দেশ্য। গোর্কি নাটক দিয়ে শুধু সমাজের বাস্তব দশাকে দেখাতে চাননি, চেয়েছেন সমাজ অধ্যুষিত নিরন্ন-হাভাতে, বঞ্চিত-লাঞ্ছিত মানুষের অধিকার বোধ জাগিয়ে তুলতে। বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ায় গোর্কিরা নিরঙ্কুশভাবে সফল হয়েছিলেন।

‘সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা’ প্রবন্ধে মাক্সিম গোর্কি বলেছেন, ‘সর্বহারা সংঘবদ্ধভাবে কেবল একটা প্রত্যক্ষ কায়িক শক্তি, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়, চাষীদের ক্ষেত্রে সেই একই ব্যাপার।’ মজার ব্যাপার হলো—গোর্কির ‘সর্বহারা’ হচ্ছেন অধিকার বঞ্চিত ‘সাধারণ জনগণ’। তিনি মানস শক্তিকেও এড়িয়ে যাননি। তিনি শ্রমশিবির বিচ্যুত বুদ্ধিজীবীদের কথাও বলেছেন। বস্তুত সাধারণ্যের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন এই বুদ্ধিজীবী সমাজ। ফলে সমাজের অধঃপতন টের পেতেন তিনি। তিনি বলছেন, ‘সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের গুরুতর সমস্যা হলো বুদ্ধিজীবীদের প্রাণ প্রাচুর্যের ক্ষয়। সেই ক্ষয়ের কারণ ক্ষুধা ও মোহভঙ্গ, এক ধরনের ঔদাসীন্য যা বুদ্ধিজীবীদের দমিয়ে দিতে থাকে।’ এই ক্ষয় বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায়ও ছিল। ফলে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের সাথে তার সম্পর্কের ওঠানামা ছিল। সে সময় অনেকে গোর্কির এই বক্তব্যকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। বলশেভিক গোর্কিকে বানানো হয়েছিল মেনশেভিক পার্টির চিন্তক। চিন্তার মৃদু পার্থক্যের কারণে লেনিন তাকে দূরে ঠেলে দেননি। এমনকি—বক্তব্যটি দিয়েছিলেন লেনিন শাসিত শিক্ষা অধিদপ্তরের অনুষ্ঠানে।

বুদ্ধিজীবীদের প্রশ্নে আমাদেরও নতুন করে ভাববার সময় এসেছে। আমরা অতীত থেকে শিখব। গোর্কি অধিক রাজনৈতিক সংগ্রামকে টিকিয়ে রাখবার প্রশ্নে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’কে। প্রশ্ন হচ্ছে—সাংস্কৃতিক বিপ্লব কী? গোর্কি বলছেন, ‘সব রকম শক্তিকে সুসংহত করে, তাদের সঙ্গে শ্রমিক ও কৃষক বুদ্ধিজীবীদের নবীন শক্তির সংযোগ সাধন করে সংস্কৃতি-কর্মীদের মন দিতে হবে নিজেদের কাজ গোছানোর দিকে।’ একবিংশ শতাব্দীর নব্বই দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের পর সবচে আলোচিত বই বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিক আলাঁ বাদিয়ুর ‘দি কমিউনিস্ট হাইপেথিসিস’ বা ‘কমিউনিস্ট রূপকল্প’। ফরাসি দার্শনিক বাদিয়ু দেখিয়েছেন, ‘কেন সাংস্কৃতিক বিপ্লব, বিপ্লবের আদি-অন্ত উৎস’। বাদিয়ু বলছেন, সংস্কৃতির রূপান্তর মানুষকে বদলে দেয়। সবচে বড় বদল ঘটায় মানুষের অভিজ্ঞতাকে। আর সাংস্কৃতিক রূপান্তর একই সঙ্গে মানুষের পূর্বতন অবস্থার ঐতিহাসিক বদল ঘটায়। ফলে অতীত ইতিহাস থেকে বাস্তব রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্থান ঘটাতে পারে। সেই প্রশ্নের সুরাহা হয় রূপান্তরের ভেতর দিয়েই। বাদিয়ু আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন—‘ক্ষমতার জন্য লড়াই’ আর ‘ক্ষমতাসীনদের লড়াই’ এক জিনিস নয়। সাংস্কৃতিক মুক্তির প্রশ্নে অবশ্যই ‘ক্ষমতাসীনদের লড়াই’কে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নাকচ করতে হবে। বুর্জোয়া সমাজ কাঠামোর প্রশ্নে—এটাই আমাদের সাংস্কৃতিক লড়াই।

৬.
বাংলাভাষায় অনূদিত গোর্কির সবচে আলোচিত ও পঠিত বই ‘মা’। বইটি তিনি রাশিয়ায় বসে লিখেননি। লিখেছেন মার্কিন প্রদেশে। প্রথম ছাপা হয়েছিল ইংরেজি অনুবাদে। প্রকাশিত হয় ১৯০৬ সালে। তারপর জার্মান ও রুশ ভাষায়। বলে রাখা ভালো, জার্মান ভাষায় প্রকাশের আগে লেনিন মা পাণ্ডুলিপি পড়েছিলেন। মা সম্পর্কে রুশ বিপ্লবের নায়ক ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের মত—‘বহু মজলুম বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন অচেতন-স্বতঃস্ফূর্তভাবে, এবার মা পড়ে তাদের মহা-উপকার হবে। এটি কালোপযোগী বই।’ বেশিরভাগ পশ্চিমা তাত্ত্বিক মার্কসবাদী ভাবাদর্শে লেখা মা উপন্যাসকে ‘মেকানিক্যালটাইপ’ বা ‘যান্ত্রিককলা’ বলে তুচ্ছজ্ঞান করেন! কিন্তু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে সেটি ঘটেনি। পশ্চিমা বামপন্থী তাত্ত্বিক গেওর্গে লুকাচও বলেছেন, ‘প্রথম বিপ্লবের সমকালে সাংবাদিকের কার্যাবলী থেকে উঠে আসে মা।’ দেখা যাচ্ছে—উপন্যাসের ভাষার প্রতিবেদনধর্মীতা নিয়ে লুকাচের অভিযোগ। অভিযোগ কিঞ্চিত বেঠিক মনে হয়। কারণ গোর্কি তার সমকালীন ঘটনার প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে চেয়েছেন। এমনকি—সমকালীন ঘটনা থেকে বিচ্যুত হতে চাননি। কারণ তিনি মুক্তি রূপক আকারে দেখেননি। দেখেছেন বাস্তবতার অলিখিত দলিলরূপে। শ্রেণী এখানে মুখ্য হলেও মায়ের সঙ্গে পাভেল করচাগিনের যে সম্পর্ক সেটা শুধু রক্তের নয়, সাংস্কৃতিক লড়াইয়েরও গতিমুখ বৈকি। কেন?

১৯০৫ সালের ঘটনা। জাপানিদের কাছে পরাজয়ের পর রাশিয়ায় ঘটে এক রক্তাক্ত ঐতিহাসিক ঘটনা। যাকে রুশের ‘প্রথম বিপ্লব’ বলা হয়। ঘটনার শুরু ‘রক্তাক্ত রোববার’ দিয়েই। ভোটাধিকারের দাবিতে লাখ লাখ শ্রমিক-কৃষক-জনগণ যাচ্ছিল নিকোলাই জারের সাম্রাজ্যের কেন্দ্র পিতেসবার্গের দিকে। কোনো কারণ ছাড়াই গুলি করে শত শত শ্রমিককে হত্যা করেছিল জারবাহিনী। ঐতিহাসিক আরেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই—বলশেভিক পার্টির উন্মেষও রক্তাক্ত রোববারের মধ্যদিয়ে। রক্তাক্ত সেই ঘটনায় নানা বিবৃতি আর লেখা প্রচার করলেন গোর্কি। গরাদে ঢোকানো হলো তাকে। পরে মুক্তি পেয়ে দেশ ছাড়তে হলো তাকে। ১৯০৬ সালে তিনি মার্কিন দেশে পালিয়ে যান। দীর্ঘ শ্রমিক জীবনের অভিজ্ঞতা আর বাস্তবের রক্তাক্ত লড়াইকে ‘মা’ উপন্যাসে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিলেন গোর্কি। নন্দনতাত্ত্বিক শিল্পগুণ নিয়ে তর্ক হতে পারে। পৃথিবীর ইতিহাসে অসংখ্য উপন্যাস লেখা হয়েছে মা নিয়ে। কিন্তু অনেক মায়ের মধ্যে সার্বজনীন সর্বহারার মা হচ্ছেন মাক্সিম গোর্কির ‘মা’। শুধু তাই নয়—এপিক থিয়েটার তত্ত্বের কিংবদন্তী নাট্যকার বার্টল্ড ব্রেখট মা উপন্যাসের নাট্যরূপ মঞ্চস্থ করেছিলেন ১৯৩২ সালে। কোনো কোনো তাত্ত্বিক বলেছেন, অ্যাবসার্ট থিয়েটার তত্ত্বের ভ্রুণও ওতে আছে। ফারাক শুধু জার্মান আর ফ্রান্স! একটা কথা টুকে রাখি—মা উপন্যাসের পর গোর্কি ‘সন্তান’ নামে আরেকটি উপন্যাস লেখার কথা ছিল, সেটা পেরে ওঠেননি আর।

সাহিত্যিক হিসেবে গোর্কি ছিলেন সমন্বয়বাদী ধারার। সমন্বয় শব্দটি আমরা শাব্দিক অর্থে ব্যবহার করিনি। তাত্ত্বিকভাবে বললাম, অব্যয়ের অধিক অন্বয়। মানে চিন্তার সমবায়ী সাংস্কৃতিক রূপান্তর। বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতিকে মুক্ত পাটাতনে নিয়ে আসা। তাই বন্ধু লেনিনের সহায়তায় প্রকাশ করেন পত্রিকা ‘লোপোতিস’ বা ‘বর্ষপঞ্জি’। ১৯১৫ সালে প্রকাশিত পত্রিকা টিকেছিল দুবছর। বলে নেওয়া ভালো—বলশেভিক আর মেনশেভিক ভাবাপন্ন মতাদর্শের লেখা ছাপা হতো পত্রিকায়। তাতে মনোদ্বৈরথও সৃষ্টি হয় হালকা। শেষ নাগাদ শারীরিক অসুস্থার কারণে লেনিন তাকে চিকিৎসার জন্য জার্মানিও পাঠিয়েছিলেন। বলে নেওয়া ভালো—অনেক সাহিত্যিক, কবি আর বুদ্ধিজীবী ছিলেন হয়তো, কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে গোর্কির মতো প্রভাবশালী লেখক রুশ দেশে জন্মায়নি আর! সাহিত্যিক প্রভাব এতটাই যে—পরলোক গোর্কির মরদেহ কাঁধে বহন করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রনায়ক জোসেফ স্তালিন। হালনাগাদ ইতিহাসে আমাদের এখনো জানা নাই, কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান তার দেশের একজন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকের কফিন বহন করেছেন এভাবে। শেষ প্রণতির সময় সেই শ্রেষ্ঠ সম্মানটুকুও অর্জন করেছিলেন মাক্সিম গোর্কি।

মানতেই হবে—মাক্সিম গোর্কি আধুনিক একজন কথাশিল্পী। খেটে-খাওয়া মানুষের চিন্তার রূপকার। কিন্তু প্রশ্ন জাগে—আধুনিক সাহিত্য কী পদার্থ? আধুনিকতার মৌলিক কোনো সংজ্ঞা নেই। কিছু সাহিত্যিক প্রবণতা দিয়েই সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়। রাষ্ট্রের দিক থেকে—রাষ্ট্রীয় পুঁজির উলম্ব বিকাশ, আইন কাঠামোর বিকাশ, কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে যন্ত্রশিল্পের বিপ্লব, অর্থনৈতিক অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের উন্মেষ, গির্জা থেকে জ্ঞানকাণ্ডকে মানবিক বাস্তবকাণ্ডে নিয়ে আসা, লৌকিক বস্তুগত জীবন, বিজ্ঞান আর তথ্য প্রযুক্তির নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি, ব্যক্তি-মানসের ইন্দ্রিয়ানুভূতিকেই জাগানো বা প্রতীকী করাসহ ইতিআদি। কিন্তু সংকট কিংবা প্রশ্ন অন্যখানে। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তির চরম বিকাশ ব্যক্তিকে কোথায় নিয়ে যায়? দর্শন বলছে, একচেটিয়া পুঁজি আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক। একক ব্যক্তির বিকাশ থেকেই ভোগবাদের শুরু। ভোগ নিছক বস্তু হজম নয়, আরামদায়কও বটে! কিন্তু একক ভোগ ব্যক্তিকে সমাজের অপরাপর সামষ্টিক চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আর ব্যক্তি উৎপাদনের ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। একক ব্যক্তি আর্দশের মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু সামষ্টিক আদর্শের কখনো মৃত্যু হয় না। যেমন আমরা মাক্সিম গোর্কির অকালবোধন করলাম। ঘুমন্ত গোর্কিকে মৃদু স্বরে জাগিয়ে তুললাম। আমরা গোর্কির স্বপ্নাদর্শের সঙ্গে অনুশীলন যোগ করলাম। সেই স্বর বাংলায় একদিন তরঙ্গ পাবে। সেটা নিশ্চিত।


তত্ত্ব ও তথ্য তালাশ
১. রুশ সাহিত্যের ইতিহাস: অরুণ সোম, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ভারত
২. শ্রেষ্ঠ মাক্সিম গোর্কি: সংকলন ও সম্পাদনা—হায়াৎ মামুদ, অবসর প্রকাশনী, ঢাকা
৩. রচনাসপ্তক: নিকোলাই গোগল, সম্পাদনা অরুণ সোম, রাদুগা প্রকাশন, মস্কো
৪. মা: মাক্সিম গোর্কি, ভাষান্তর : পুষ্পময়ী বসু, সম্পাদনা হায়াৎ মামুদ, অবসর প্রকাশনী, ঢাকা
৫. কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা: মুজফফর আহমদ, মুক্তধারা সংস্করণ [পুর্নমুদ্রণ], ঢাকা
৬. On literature: Maxim Gorky, Foreign Languages publishing house, Moscow
৭. A history of Russian literature [ From beginning to 1900] : D. S. Mirsky, edited by Fransic J. Whitfield, Northwestern university press, USA
৮. Romantic Literature [From 1790 to 1830]: edited by Geoff Word, Bloomsbury, London
৯. Philosophy of Dictionary: Voltaire, edited & translated by Theodore Besterman, Penguin classics, England.
১০. A contribution to the critique of Political economy: Karl Marx, edited by Maurice Dobb, Progress Publisher, Moscow
১১. The Communist Hypothesis: Alain Badiou, translated by David Macey and Steve Corcoran, Verso, London

   

ফেরদৌস আরার প্রবন্ধের আলপথ বেয়ে পাঠক চলে যান জ্ঞানের সমুদ্রদর্শনে



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘লেখকের প্রচুর অধ্যয়ন, পাঠগভীরতা, নিবিড় অনুসন্ধিৎসা, ঘোরলাগা শব্দপুঞ্জে, ভাষার শিল্পিত সুষমায় লেখাগুলি প্রাণ পেয়েছে। তাই গ্রন্থের তথ্যসমৃদ্ধ বারোটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য শুধু নয়, নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, জানার তাগাদা তৈরি করবে—বোধে, তৃষ্ণায়, জীবনজিজ্ঞাসায়। নিজের কথাই বলি, ফেরদৌস আরা আলীমের চোখ দিয়ে পড়তে পড়তে আমি নিজে প্রায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আফরোজা বুলবুল কিংবা প্রতিভা মোদক (‘যে জীবন শিল্পের, যে শিল্প জীবনের’), করুণা বন্দোপাধ্যায়, রবিশংকর বলকে (‘চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর’) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে আস্বাদ করি সময়-পরিক্রমায় লেখক ফেরদৌস আরা আলীমের কলমের ক্ষুরধার ক্রমমুগ্ধকর সৌন্দর্য।’

শনিবার (৪ মে নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক গলিতে অবস্থিত মাসিক নারীকণ্ঠ পত্রিকা-আয়োজিত ‘বই আলোচনা’-অনুষ্ঠানে ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আলপথে শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের মূল আলোচকের আলোচনায় তহুরীন সবুর ডালিয়া এসব কথা বলেন। বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনায় আরও অংশ নেন নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা জিনাত আজম, সালমা রহমান ও মাধুরী ব্যানার্জী।

নারীকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আহমেদ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শাহরিয়ার ফারজানা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতারী ইসলাম বলেন, ‘নানা বিষয়ে ফেরদৌস আরা আলীমের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সহজভাবে তিনি আমাদের সমাজবাস্তবতার যে-চিত্র আঁকেন তা মনের গভীরে সাড়া জাগায়। তার লেখা পড়ে এটুকু বলতে পারি যে, তার লেখা আমাদের জন্য গবেষণা ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান আকর।’

প্রবন্ধের আলপথে বইয়ের প্রকাশক, কবি ও খড়িমাটি-সম্পাদক মনিরুল মনির বলেন, ‘নারীমুক্তি বিষয়ে এ-বইয়ে দুটি তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে আরও কাজ করার জন্য গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রকাশিত বই নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘বড় কিছু হওয়ার কথা ভেবে লিখিনি, মনের আনন্দেই গোপনে গল্প-কবিতা লিখেছি। এমন একসময়ে আমরা লিখতাম, লেখা প্রকাশ করতে খুব লজ্জাবোধ করতাম। অবশ্য লিখতে গিয়ে তেমন কঠিন বাধা আমাকে ডিঙোতে হয়নি। একালের চেয়ে আমাদের সময়টা ছিল অনেক সুন্দর ও ভালো। মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল সমাজে। গণ্ডগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে চড়ে ঢাকা গিয়েছি একা-একা, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। মা-বাবারাও নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকাল মেয়েরা পদে-পদে বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের কলুষিত সমাজব্যবস্থা ও নষ্ট রাজনীতি।’ সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রশংসার ভূমিকা কম নয়। একজন লেখক তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য পেলে অনুপ্রাণিত হন যা তাকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি জোগায়।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা ও সদস্য রোকসানা বন্যা, মহুয়া চৌধুরী, রেহানা আকতার, সাহানা আখতার বীথি, কানিজ ফাতেমা লিমা, বিচিত্রা সেন, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, চম্পা চক্রবর্ত্তী, প্রচার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জয়, কবি মেরুন হরিয়াল ও কবি মুয়িন পারভেজ প্রমুখ।

;

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

;

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;