জুঁই



তানিম কবির
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

দশ বছর আগের চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত স্থানে আমি পৌঁছাই ঠিকই, তবে তা কোনোভাবেই এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নয় যে, সত্যিই জুঁইও সেখানে, এমনকি আমার আগে থেকেই উপস্থিত থাকবে। আর, আবারও সত্যিই ওকে আমি দেখতে পাব। বরং এরকম যে হতে পারে, অন্তত পাঁচ বছর ধরে সেই সম্ভাবনাটাকে নাকচ করতে করতেই আমি বড় হচ্ছিলাম। ফলে বিমানবন্দর রেলস্টেশনের ওভারব্রিজের নির্ধারিত কোনায় ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল আমার বড় হতে থাকা।

জুঁইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ২০০৫ সালে। হঠাৎই একদম হুট করে। তখন কত বয়স আমার, সবেমাত্র কলেজে যাই, সতের, বা তারও কম? অবশ্য জুঁই বয়সে আমার বড় ছিল, তিন বছরের। ফোনে পরিচয়। লং ডিস্টেন্স রিলেশনশিপ। হুট করে একগাদা মোবাইলফোন কোম্পানি এসে পাড়া-মহল্লার ছাদেই, কলেজ যাবার রাস্তার মোড়েই ঘটতে পারত প্রেমগুলোকে বেশ একটা জাতীয় মানের রাত জেগে কথা বলা প্রেমে রূপান্তর করে দিল তো? বলতে গেলে পরিবর্তিত বা নবগঠিত ওই সংস্কৃতির প্রথম জেনারেশনের প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলাম আমরা। ডিজুস টু ডিজুস দুই টাকায় সারারাত কথা বলার একটা অফার ছাড়ে গ্রামীণফোন। মূলত ওই সময়ই একটা ফালতু নাম্বার পাজলিং থেকে জুঁইয়ের সঙ্গে আমার প্রেম হয়ে যায়।

আমরা তখন সারারাত জেগে ফোনে কথা বলতাম। এমনও হয়েছে, ভোর হয়ে গেছে জন্য এখন আর সারাক্ষণ ফোনে ‘লাইনে’ থাকতে পারব না ভেবে শেষরাত থেকেই আমাদের কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেছে। এতই রাতজাগা প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলাম আমরা। সত্যি বলতে, আমাদের তুলনা ছিল না। আমার, এবং জুঁইয়েরও, পরিচিত এমন একজন কেউ ছিল না, যে অন্তত আমাদের সিকি পরিমাণ প্রেমও ওইসময় করতে পারত। আমরা জানতাম যে, আমরাই সেরা।

তবে আমরা কেউ কাউকে দেখিনি কখনো। শুধু কথা বলে প্রেম করি। একদিন তাই ভয় হলো, মনে হলো, আমাকে দেখে যদি ওর পছন্দ না হয়। কিংবা আমারই যদি পছন্দ না হয় ওকে! কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে জিভ কামড়ে আমি অনুতপ্ত হই। ছিঃ এ আমি কী ভাবছি। জুঁই দেখতে যেমনই হোক না কেন, ও তো জুঁই। আমি ওকে কখনোই ছেড়ে যেতে পারি না, কারণ সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের একবার দেখা তো হোক? দুজনেই রাজি। আমি আমার আশঙ্কার বিষয়ে ওকে বললাম, ‘আমি তো দেখতে অতো ভালো না, তোমার যদি পছন্দ না হয়!’ তুড়ি মেরে আশঙ্কাটাকে উড়িয়ে দেয় জুঁই। উল্টো ওকে এরকম অগভীর আর চেহারা দেখে প্রেমে পড়া টাইপ থার্ডক্লাস ভাবার কারণে রাগ করে ওই রাতে আর কথাই বলল না আমার সাথে।

এমনিতে কথা না হওয়া রাত, ওই সময় আমার জন্য ভয়াবহ যন্ত্রণার বিষয় ছিল। কিন্তু ওকে ‘চেহারা দেখে প্রেমে পড়া’দের কাতারে ফেলবার শাস্তি হিসেবে পাওয়া ওই কথা না বলা রাতটা আমার জন্য বলতে গেলে স্বর্গসম ছিল। বরং আমি চাইছিলাম, এ রাগ আরো দীর্ঘ, আরো গাঢ় হোক। কেননা তাতেই আমার নিরাপত্তার বোধটা আরো বলিষ্ঠ হয়।

পরদিন গর্ব করে ক্লাসের বন্ধুদের, জুঁইয়ের এমন উদার মন-মানসিকতার গল্প শোনাতে গিয়ে এক ব্যাখ্যাতীত বিবমিষায় আক্রান্ত হই। গল্প শুনে মোস্তফা বলে, “দেখ গিয়ে পাতিলের কালির মতো কালো আর কঙ্কালসাড় হাড়গোরসর্বস্ব এক পেত্নী হবে সে। তার তো একটা পেনিস হলেই হয়। ফলে নিজের উদারতার বাড়াবাড়ি প্রদর্শন করে সে আসলে তাকে দেখার পর তোর উদারতাটাকে কনফার্ম করতে চাইছে।” উপস্থিত বাকিরা হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল। এত বিশ্রী লাগল দৃশ্যটা যে আমি উঠে এলাম। বেরিয়ে বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসছি যখন, জানালা দিয়ে শুনতে পেলাম জিকু বলছে, “এ জীবনে আমি জুঁই নামের কাউকে সুন্দরী হতে দেখিনি। সবগুলোকেই দেখেছি দুঃস্বপ্নের মতো ভয়ঙ্কর হতে।” আর এতেও অন্যরা সশব্দে হেসে উঠল। আমি দৌড়ে পালালাম। জুঁইকে এমন বাজারী আলোচনার বিষয় করে দেওয়ায় খুব রাগ হলো নিজের ওপর। দোষটা তো আমারই।

কিন্তু যা হলো, সে রাতেই ভয়ঙ্করদর্শন এক জুঁইকে স্বপ্ন দেখলাম। ড্রাকুলা মার্কা দাঁত, নোংরা চুল আর আশি বছরের কোনো ডাইনি বুড়ির এক বিকট প্রতিকৃতি। এটাই ছিল স্বপ্নের জুঁই, আমি থরোথরো ভয়ে যার খসখসে হাত ধরে পার্কে হেঁটে বেড়াচ্ছি। লাফ দিয়ে ঘুম ভাঙে আমার। মনে পড়ে, মাইগ্রেনের ব্যথার জন্য জুঁই রাত দুটোর দিকেই শুয়ে পড়েছিল। এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হলো, ভোরের স্বপ্ন কি সত্যি হয়? মুহূর্তেই আবার মনে হলো, এ কথা ভাবছি কেন! তার মানে সত্যি হলে, অর্থাৎ জুঁই দেখতে সত্যিই ওরকম হলে আমার তবে আপত্তি? এই তবে ভেতরকার আমি! নিজের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা সবচেয়ে গোড়ার দিকের আমার স্বরূপ তবে এই! প্রতিটা রক্ত কণিকায় আত্মধিক্কারের তীব্র আলোড়ন আমাকে পাগল করে ছাড়ল। নিজেকে শাস্তি দিতে ছুরি দিয়ে আমি হাত কাটতে লাগলাম। কিন্তু কিছুই টের পেলাম না। কেননা, কী করে আমার এত সাহস হয় যে, এমনকি ভয়ঙ্কর দেখতে হলেও জুঁইকে আমি ফিরিয়ে দেবার কথা ভাবি!

ঢাকায় গেলাম। আমাদের দেখা হলো। একটা ভোরের ট্রেন আমাকে বিমানবন্দর স্টেশনে নামিয়ে দিল। আর তরতর সিঁড়ি ভেঙে আমি উঠে গেলাম ওভারব্রিজে। কেননা ওখানে নির্ধারিত একটা কোনে দাঁড়িয়ে জুঁই দাঁত মাজছে। এটাই ওকে চিনবার কোড। সারারাত আমরা ‘লাইনে’ই ছিলাম। আমি ট্রেন থেকে আর জুঁই ওর বাসা থেকে। ভোর পাঁচটায় ফোন রেখে ও চেঞ্জ করল। আর আবার কথা বলতে বলতে বেরিয়ে পড়ল বাসা থেকে। ও যখন সিএনজিতে উঠল, আমার ট্রেন তখন ঘোড়াশাল ব্রিজ পার হচ্ছে। কিন্তু ওভারব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে এ কাকে আমি দাঁত মাজতে দেখছি! পরী বললেও ভুল হবে। পরীর চেয়েও পরী দেখতে ও। হা হয়ে গেলাম। ঠোঁটের কোণে মোস্তফা জিকুদের জন্য একটা তাচ্ছিল্যের হাসি না চাইতেও ফুটে উঠল। আর নিজের জন্য হলো করুণা। এই তো, ট্রেন থেকে নামার ঠিক আগেও বাথরুমে ঢুকে নিজের চেহারার মুখোমুখি হলাম। একে কি চেহারা বলা যায় কিনা কে বলবে! আর এই বেহেশতী হুর, বলা চলে, বিভ্রান্ত হয়ে আমার মতো এক চামারের জন্য এখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। একবার ভাবলাম, আমাকে চিনতে পারার তো কোনো কোড নেই, পালিয়ে যাব নাকি! কিন্তু হতবিহ্বল দাঁড়িয়ে পড়া আমার কাছে এসে জুঁই-ই প্রথম কথাটা বলল, “দাঁত মাজবে?”

একবারের জন্য মনে হলো, যাক! আমি দেখতে অন্তত আমারই মতো তাহলে। নয়তো জুঁই আমাকে চিনতে পারল কিভাবে? ওভারব্রিজে আরো তো মানুষজন ছিল। আমার বয়সীই আরো দুয়েকজন ছিল, নিজের চোখে দেখা। নিশ্চয়ই এমন হয়নি যে, সেকেন্ড কিংবা থার্ড অফারে ও সত্যিকারের আমাকে খুঁজে পেয়েছে! সেরকম হলে আমার দেখা আমার বয়সীগুলোর কারো মুখে ঠিকই টুথপেস্টের ফেনা লেগে থাকত। যেমন আমি ওর মাজতে থাকা ফেনাসুদ্ধই ব্রাশটা নিজের মুখে পুরে নিলাম। ও বলল, “ওয়াক থু!” পরবর্তী এক বছর নিয়মিত আমি কোলগেট টুথপেস্টটাই ব্যবহার করতাম, ওর মুখের ফেনার স্মৃতি জাগিয়ে রাখার জন্য।

ও বলল, “জেগে থাকতে সমস্যা হবে না? সারারাত তো একটুও ঘুমাওনি।” কী জানি, ভাবিনি এ বিষয়ে। সাধারণ অর্থে তো সমস্যা একটু হবারই কথা। কিন্তু সঙ্গে জুঁই থাকা সত্ত্বেও এটা নিশ্চয়ই ভালো দেখাবে না যে, পাশেই নাক ডেকে আমি ঘুমাচ্ছি! জুঁই বলল, “চলো কোথাও গিয়ে দু-মুহূর্ত একটু ঘুমাই।” স্বপ্নের মতো লাগল কথাটা। বিশেষত ‘দু-মুহূর্ত’ ঘুমানোর ব্যাপারটা। অবশ্য ওর মধ্যে আগে থেকেই ব্যাপারটা ছিল, খানিকটা কবি কবি ভাব! এই তো সেদিন আকাশে একটু মেঘ করল বলে মেসেজ পাঠিয়েছিল ‘আজকে আমার মেঘলা দিন, আজকে আমার একলা দিন।’ বুঝলাম ওই ঔদাসীন্যই এখানে দু-মুহূর্তের ঘুম হিসেবে হাজির হয়েছে। বললাম, “আমার তো চেনা কেউ নেই ঢাকায়। কোথায় ঘুমাব? আর তুমিই বা কোথাও আমাকে নিয়ে ঘুমাতে যাবে কী করে!” দু-মুহূর্ত ভেবে ও বলল, “চলো আমরা একটা ইয়োলো ক্যাব ভাড়া করে ফেলি, তারপর ক্যাবের ভেতর ঘুমাই।” আইডিয়া খারাপ না। নয়টা দশটার দিকে জেগে উঠে ফ্রেশ একটা দিন শুরু করা যাবে। ভাবলাম আমি।

অচেনা ঢাকা শহরের ব্যস্ততম এলাকাগুলোয়, কখনো জ্যামে আটকে, কখনো ফাঁকা রাস্তার দ্রুতটানে, টানা সাতদিন এক নাগাড়ে হালচষে ক্লান্ত মহিষের মতো গায়ের জোরে আমি ঘুমালাম। ঠিকই সেই ওর পাশে বসে! কিন্তু ফাঁকে ফাঁকে সেই ঘুমও ভাঙল। চোখ খুলে, কিছুই বুঝে উঠতে না পারা দৃষ্টিতে ক্যাবের জানালা দিয়ে আড়াআড়িভাবে কত যে সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। একবার দেখলাম আজাদ প্রোডাক্টসের সাইনবোর্ড। এরা কী কারণে যেন বিখ্যাত? ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। দেখলাম তোতা পাখি কাঁধে নিয়ে একটা লোক হেঁটে যাচ্ছে। ক্যাবল লাইনের জঞ্জালে কাকেদের পুরনো হাগু। জুঁইও ঘুমাচ্ছে আমার পাশে। আমাদের দূরে কোথাও পৌঁছে দিতে বলা হয়েছে। পৌঁছে ড্রাইভার আমাদের ডেকে দেবে। দূরে কোথাও পৌঁছাতে সত্যিই অনেক দেরি হয় আমাদের।

শহরের প্রায় আরেকটা কোনো প্রান্তে, নাকি শহর ছাড়িয়ে, কোথায়, তা আমার মনে নেই। এরমধ্যে আমরা প্রায় তিন ঘণ্টার কাছাকাছি সময় ধরে ঘুমিয়েছি। ভাবলে এখনো অবাক লাগে, এর আগে যে আমার কোনো যোগ্যতাই ছিল না, কোনো একটা এমনকি মাঝারি মানের সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বসেও কথা বলবার, সেখানে পরীরও পরীর মতো একটা মেয়ের পাশে আধশোয়া হয়ে, বিশ্রীভাবে হা করে আমি ঘুমাতে পারলাম কী করে। কিন্তু আজ বুঝি, ক্লান্তিই সেই মহান মনোযোগের যথার্থ দাবিদার, যার দাবি না মেটালে আদতে আর কোনো দাবিই মেটানো সম্ভব হয় না। ‘আজকে বুঝি’র ভারিক্কি চালটার ব্যাপারে একটু ব্যাখা দেওয়া প্রয়োজন, জানানো প্রয়োজন, সেদিনের সেই বেকার ও নির্ভার লোকটা, আমার মধ্যে কোথাও আজ আর বেঁচে নেই। পারিবারিক দারিদ্র্য আর বাস্তবতার অনিবার্য ঘাঁয়ে লোকটার গলিত অবয়বটিও এখন বাষ্পাতীত। গত চার বছর ধরে একটা পত্রিকা অফিসে কম্পোজিটরের চাকরি করি আমি। টোলারবাগে সরকারি কোয়ার্টারগুলোর একটায় ছোট একটা রুম ভাড়া করে থাকি। সে যাই হোক, নিজের দরিদ্রতার বর্ণনা দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। মোটকথা আগের মতো নিশ্চিন্ত নির্ভার জীবনটা আর নেই।

আমরা যেখানে গেলাম, দেখতে অনেকটা গ্রামের মতো। ব্যস্ততম দালানগুলোর ফাঁক ফোকর দিয়েও পেছনের ধানক্ষেত উঁকি দিচ্ছে। আমরা একটা ধানক্ষেতের মধ্যদিয়ে ঢুকে মুহূর্তের মধ্যেই আরো অসংখ্য ধানক্ষেত পার হতে থাকি। সিনেমার দৃশ্যের মতো জুঁই আমাকে টেনে নিয়ে যায়। যেন এক গোপন সংকেত মান্য করে করে একটা আঁল থেকে পরবর্তী দুটো আঁলের একটাকে বাছাই করতে করতে এগোয় ও। যেন একেবারে শেষে, সবচেয়ে অবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনাটা ঘটবে। আর হলোও তাই, একমাঠ সমান ঝকঝকে মেঝের একটা ধানের কলে গিয়ে আমরা উঠলাম। এখানে ওখানে টুকরো টুকরো মেঘের মতো শুকোতে দেওয়া ধান।

জুঁই জানাল, সেদ্ধ ধানের গন্ধ ওর খুব পছন্দ। আমার মনে হলো, এ পছন্দের কথা তো ফোনে কখনো বলেনি আগে! কিন্তু আবার ভাবলাম, হয়তো সব পছন্দের কথা ফোনে বলতে হয় না। জুঁই যেমন কবি স্বভাবের, এমন আলাদা কোনো সিদ্ধান্তও যদি সত্যিই ওর থেকে থাকে, মোটেই অবাক হব না।

সারাটাদিন আমরা সেদ্ধ ধানের গন্ধ শুঁকে শুঁকে কাটিয়ে দিলাম। আর যা মনে পড়ে, ধানের কলের পাশেই একটা পুকুর ছিল, আর কবুতরের বিষ্ঠায় ভরে থাকা একটা ঘাট। কবুতরগুলোকে ধানের কলের সবটা জুড়েই সহাস্যে চলাফেরা করতে দেখা যাচ্ছিল। দুপুরে ধানের কলের ম্যানেজার তার অফিসরুমে ডেকে নিয়ে আমাদের ডিমের সালুন দিয়ে ভাত খাওয়াল। তারপর বিস্তীর্ণ মেঝের ছায়া ঢাকা একটা অংশে গিয়ে বসবার পর জুঁই বলল, দুপুরের পর নাকি কবুতর এমনভাবে ডাকে, যাতে করে মানুষের ঘুম পায়। ও বলার কারণেই কিনা কে জানে, কবুতরগুলোর নিরবচ্ছিন্ন বাক্ক্-বাকুম্ম শব্দে সত্যিই একটা ধান ভাঙানোর হাত-মেশিনের কাছে গিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। একদমই ঘুমিয়ে পড়বার মুহূর্তে মেশিনটাকে আমি সাব্যস্ত করলাম ‘ঘুরন্ত কোলবালিশ’ বলে।

যখন উঠলাম, পরিপূর্ণ বিকেল। টের পেলাম এবং স্বচক্ষেও দেখলাম যে, আমার মাথার নিচে জুঁইয়ের কোল। ঈষদুষ্ণ, খুব পুরনো নয় একটা রঙের গন্ধভরা ওর কোলটাকে আমার এক টুকরো মাতৃগর্ভের মতো লাগল।

কিন্তু এবার ফিরতে হবে। সন্ধ্যার পর আমার ট্রেন। দুটো বাসে চড়ে আমাদের ফিরতে হলো। প্রথম ফাঁকা বাসটার একদম পেছনের কোনায় বসে জীবনে প্রথম কাউকে ঠোঁটচুমু খেলাম। সমস্ত শরীর, পরিস্থিতির তুলনায় অপর্যাপ্ত পুষ্টির কারণে ঠাঁ ঠাঁ করে কাঁপল। জীবনে প্রথম যখন কারো জিভ চাটছি, নুন ছিটানো কাঁচা ঝিনুকের স্বাদে আলোড়িত হচ্ছে মগজ। ফলে চুমুর স্মৃতি ফিরিয়ে আনতেও পরবর্তীতে নুন ছিটানো কাঁচা ঝিনুক খেতে হয়, তবে, ব্যাপারটা চূড়ান্ত রকমের হতাশাজনক, অর্থাৎ চুমুর স্মৃতির তাতে কানাকড়িও ফিরে আসে না। মনে পড়ছে ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ বইয়ে মার্গারেটকেসহ বা ছাড়া সুনীলের কাঁচা ঝিনুক খাওয়ার বর্ণনা। আমরা আরো পাগল হয়ে উঠি এবং একপর্যায়ে অন্য যাত্রীদের আপত্তি সাপেক্ষে অসামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে মাঝপথে আমাদের বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় বাসের প্রয়োজন পড়ে মূলত এ কারণে। নেমে দেখি সূর্য ডুবছে। তারপর হাইওয়ের অল্প দূরে একটা গির্জা পেয়ে ওটায় ঢুকে পড়ি। আর দুজনে মিলে অসহ্য সব চুমু খাই।

যখন ট্রেন ছাড়ল, আমার জানালা ঘেঁষে প্লাটফর্ম ধরে হাঁটতে হাঁটতে কথাটা ও বলল। “যদি আর খোঁজ না থাকে, ঠিক দশ বছর পর এই তারিখে এই স্টেশনের ওভারব্রিজে থেকো, বিকেল পাঁচটায়।” সত্যি বলতে, তখন পর্যন্ত বাক্যটাকে যে আবার আমাকে সাজিয়ে মনে করতে হবে কখনো, বুঝতেই পারিনি। উল্টো বোকার মতো হাসি হাসি মুখে হাত নাড়তে থাকি। বলতে গেলে, তার কিছুক্ষণ পর থেকেই দশ বছরের জন্য ও হারিয়ে গেল। ট্রেন যখন টঙ্গী স্টেশন পার হচ্ছে তখনই ফেরার কিছু পেল কিনা জানতে ওকে কল দেই, আর নাম্বার বন্ধ পাই।

অবশ্য তাতেই যে আমি বুঝে ফেলি, অন্তত দশ বছরের জন্য ও হারিয়ে গেছে, তা নয়। প্রথমত ভাবি, হয়তো ফোনের চার্জ শেষ। আর সেটা স্বাভাবিকও ছিল, কারণ সারারাত কথা বলার পর দিনে আর ফোন চার্জে দেওয়ার সুযোগ হয়নি। এ ধারণা আরো মজবুত হয়, যখন ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমার নিজের ফোনটাও বন্ধ হয়ে গেল।

এরপর ট্রেনের মধ্যে, জানালায় মাথা এলিয়ে সারাটা পথ আমি একটা খামচে থাকা ঘুমের সঙ্গে লেপ্টে রইলাম। পরবর্তী দুয়েকদিনেও যখন ফোনটা আর অন হলো না, তখন, জানালার পাশে প্লাটফর্মে হাঁটতে হাঁটতে ওর বলা, প্রায় ভুলে যাওয়া কথাটা মনে পড়ল। যেন অনেক ঘুমের নিচে চাপা পড়ে ছিল কথাটা। কিন্তু তাই বলে এরকম ছেলেমানুষি একটা কথাকে ও সত্যিই বাস্তবায়িত করতে চাইবে, এটাই বা মেনে নিই কী করে! তার মানে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? আমি আর কিছুই ভাবতে পারলাম না।

মোস্তফা বলল, ওর আসলে আমাকে পছন্দই হয়নি, সরাসরি কথাটা বলতে না পেরে এখন ফোন অফ রেখে বুঝিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তাহলে বাসের মধ্যে, হাইওয়ের পাশের গির্জায় আমাদের যে মুহূর্তগুলি, ওগুলোর কী ব্যাখ্যা? জিকু বলল, ঢাকায় ওরকম পার্টি নাকি অনেক আছে। মূলত বেশ্যা, মাঝেমাঝে একটু রিলেশনশিপের ওম লাগে, এরকম আরো অনেকের কথাই নাকি সে জানে। ঘুষি মেরে আমি জিকুর নাক ফাটিয়ে দিলাম। বুঝতে পারিনি, এতটা রক্তারক্তি হবে। সবাই ওকে ধারেকাছের কোনো একটা ফার্মেসিতে নিয়ে গেল। আমি আগ বাড়িয়ে ওর বাসায় চলে গেলাম, বাসায় গিয়ে ওর মাকে বলে আসলাম, “এটা কী করে সম্ভব যে, আপনার ছেলে ঢাকার অনেক বেশ্যাদের সম্পর্কে হুবহু অনেক কিছুই জানে!” বলেই বেরিয়ে এসে রিকশা ভাড়া করে শহরের বাইরের একটা মাঠে নিয়ে নিজেকে শুইয়ে দিলাম।

আসলে ওই সময়টায়, পরবর্তী একটা বছর পর্যন্ত, কখন কোথায় আমি জেগে ছিলাম বা ঘুমাচ্ছিলাম, তার কোনো হিসেব আমার কাছে ছিল না। আমাদের প্রেম ছিল মাস কয়েকের, তাই সবাই ভেবেছিল, পরবর্তী মাস কয়েকেই ব্যাপারটা চুকে যাবে। কিন্তু আমি সবার সংঘবদ্ধ ধারণাকে বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন করে এক জুঁইয়ের ব্যাপারেই নিজেকে আরো আরো পাগল করে তুললাম। আর উঠতে বসতে, কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারলাম না এজন্য যে, একজন অন্তত কোনো বন্ধুবান্ধব অথবা পরিচিত কারো ফোন নাম্বারও কখনো আমি চাইনি জুঁইয়ের কাছে! আমি শুধু জানতাম ও ঢাকায় মাটিকাটা নামের একটা জায়গায় থাকে। মা-বাবা আর একটা বোনসহ ও থাকে, ও বলেছিল।

কোন একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে যেন পড়ত। আশ্চর্য যে, ইউনিভার্সিটির নামটাও কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি। জুঁইয়ের সম্পর্কে আমার বাহ্যিক জানাশোনা যে এত কম, আমি নিশ্চিত, ও হারিয়ে যাওয়ার আগেই কখনো যদি এটা আমি টের পেতাম, তখনও এ নিয়ে আমাকে লজ্জিত হতে হতো।

ছয় মাস পর আবারও একটা রাতের ট্রেনে চেপে আমি ঢাকায় চলে যাই। আগেরই মতো খুব ভোরে বিমানবন্দর রেলস্টেশনে নেমে, দৌড়ে গিয়ে ওভারব্রিজে উঠে আগেরবারের মতো ওকে আর কোথাও না পেয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে আমি কাঁদতে থাকি। চারপাশে লোক জমে যায়। জিজ্ঞেস করে, আমার সমস্যা কী। আমি কিছুই না বলে দৌড়ে পালাই, আর স্টেশনের বাইরে গিয়ে একটা ইয়োলো ক্যাব দাঁড় করিয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করি, এখান থেকে এখন রওনা দিলে তিনঘণ্টা পর ঢাকার অন্য কোন কোন প্রান্তে গিয়ে পৌঁছানো সম্ভব? ড্রাইভার ক্যাবের গতি বাড়িয়ে দেয়। দিনভর মাটিকাটা এলাকায় ঘুরে বেড়াই। বিকেলে খেতে বসে মাটিকাটারই একটা খাবার হোটেলের ক্যাবিনে ঘুমিয়ে পড়ি। কেউ ডিস্টার্ব করে না। যখন জেগে উঠি, রাত হয়ে গেছে। বের হয়ে সিএনজি নিয়ে আবার স্টেশন এবং সেখান থেকে আবার ট্রেন।


বার্তা২৪.কম-এর শিল্প-সাহিত্য বিভাগে লেখা পাঠানোর ঠিকানা
[email protected]


প্রথম এক বছরের মধ্যে কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। সবচেয়ে বড় কথা, এক পর্যায়ে বুঝতে পারলাম যে, ব্যাপারটা আমার দ্বারা কিছুতেই সম্ভব নয় ঘটানো। আর তাতেও নিজের ওপর বিরক্তি বাড়ে। আমি তো জানতাম, কখনো জুঁই না থাকলে, আমিও আর বাঁচব না। কিন্তু সত্যিই যখন নেই, মরতে গিয়েও মরতে পারা যাচ্ছে না। এ সময় মোস্তফার একটা একদমই হাসিচ্ছলে বলা কথাকে আমি আকড়ে ধরি। ও বলেছিল, “আরে মরবিই যদি, দশ বছর পর ওইদিন ওভারব্রিজে যাবে কে, আমি? গিয়ে বলব, বহু আগে, অন্তত নয় বছর আগেই তুই মরে ভূত?” তাই তো। দশ বছর পর তো ও থাকবে। একই তারিখ, বিকেল পাঁচটায়। কিন্তু এত দীর্ঘ অপেক্ষার ভার নিয়ে কিভাবে একজন মানুষ তার স্বাভাবিক জীবন যাপন চালিয়ে যেতে পারে, যে জীবনের প্রতিটা ফাঁক ফোকরেই আসলে ওই এক অপেক্ষাই নাক গলিয়ে থাকে!

এত আয়োজন সত্ত্বেও পরবর্তী একবছরে জুঁইকে আমি পুরোপুরি ভুলে যাই। এই ভুলতে পারার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রাখে, বাবার মৃত্যু। আর সেই সূত্রে হঠাৎই আমার একটু তাড়াহুড়ো করে বড় হয়ে যাওয়া। এরমধ্যে নতুন আরেকটা প্রেমও হয় আমার। একই শহরের, সংস্কৃতিকর্মী টাইপের একটা মেয়ের সঙ্গে। বাংলা বর্ষবরণ, রবীন্দ্র-নজরুল জন্মজয়ন্তীর মতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোয় একক ও দলীয়ভাবে গান গাইত। নাম, শোভা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মেয়ে। বাবার চাকরির সুবাদে আমাদের শহরে থাকত। সত্যি বলতে, এ প্রেমটাও খুব জমে যায়। আর একপর্যায়ে তো এমনও মনে হয় যে, কোথাকার কোন জুঁইয়ের জন্য কিনা মরতে বসেছিলাম!

শোভা একদিন জানতে চাইল, এখনো আমি জুঁইকে মনে রেখেছি কিনা। চমকে উঠি প্রশ্ন শুনে। আর জানতে চেয়েছিলাম বিষয়টা ও জানল কিভাবে। বলল, এ ব্যাপারে জানে না, এমন লোক নাকি খুব কমই আছে। ব্যাপারটাকে একটা ফালতু প্রসঙ্গ হিসেবে আখ্যায়িত করে আমি শোভার হাত ধরি। ওকেসহ রিকশায় শহর ঘুরে বেড়াই। সন্ধ্যার পর চুমুও খাই। এভাবে বছর খানেকের মধ্যে আমরাই আমাদের সবচেয়ে মেইনস্ট্রিম প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে উঠি। ফলে দীর্ঘস্থায়ীভাবে চাপা পড়ে যায় একদিনের জুঁই।

বছর খানেকের শোভাও অবশ্য অনিবার্যভাবেই একদিন নিজের বিয়ের কথা জানিয়ে যায়। আর খুব অনুরোধ করে, এ ব্যাপারে আমি যেন কোনো পাগলামি না করি। আসলে সব মিলে আমি খানিকটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, তাই শোভার এমন প্রতারণার জবাবে আমি প্রায় কিছুই করলাম না। শুধু মাসখানেকের জন্য দূরসম্পর্কের এক খালার বাড়িতে, অন্য আরেকটা শহরে গিয়ে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকলাম।

তারপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমভাবে ছিলাম। লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে গত চার বছর ধরে ঢাকায়। এরমধ্যে জুঁইয়ের কথা খুব একটা আর মনে পড়েনি। আবার একেবারেই যে পড়েনি, তাও নয়। কিন্তু আমি ধরে নিয়েছিলাম, জুঁইয়ের ব্যাপারে জিকুর করা মন্তব্যটাই হয়তো ঠিক। মনে হয়েছে, হয়তো এমন হয়ে থাকবে, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে, প্রেম করিয়ে মফস্বল থেকে কাউকে ঢাকায় নিয়ে আনতে পারা না-পারা বিষয়ে ধরা কোনো বাজির অংশ ছিলাম আমি। অবশ্য সেসব নিয়েও আলাদা কোনো দুঃখের অনুভূতি এতদিনের ব্যবধানে আমার মধ্যে আর অবশিষ্ট ছিল না।

তবে একদমই অভ্যেসবশত এ দশ বছরের পুরোটা সময় জুড়েই ওর নাম্বারে আমি মাঝেমাঝেই ডায়াল করে গেছি। কিন্তু তা কোনোভাবেই ওকে ফিরে পেতে চেয়ে নয়, বা এমনকি আবার কোনো যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা হোক, সেই আকাঙ্ক্ষা থেকেও নয়। আগাগোড়াই অভ্যেসবশত। এমনও হয়েছে, দিনের পর দিন আমি ওই নাম্বারে ডায়াল করেছি, অন্তত এই ব্যাপারেও সতর্ক না থেকে যে, মূলত এ নাম্বারটা কার। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এরমধ্যে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম দশ বছর পর, কোন মাসের ঠিক কত তারিখে আবার আমাদের দেখা হবার কথা! মোটকথা এটা একটা পরিত্যাক্ত প্রসঙ্গ হিসেবে জীবনের কোনো এক কোনে পড়ে ছিল।

তবু চুক্তি অনুযায়ী দশ বছর পরের নির্ধারিত দিনে আমি যে ওভারব্রিজে এসে হাজির হতে পারি, এটা সম্ভব হয় শুধু এ কারণে যে, ঠিক একদিন আগেই লন্ডন থেকে ফোন করে মোস্তফা আমাকে, কালকে ওভারব্রিজে যাচ্ছি কিনা জিজ্ঞেস করে। ওকে অবশ্য বিশ্বাস করানো যায়নি, নিজে আমি তারিখটার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু বেশ অবাকই হতে হলো, এতদিন ধরে তারিখটা ওর মনে রেখে দেওয়ার ঘটনায়। এমনকি তারপরও বিকেল পাঁচটায় বিমানবন্দর স্টেশনের ওভারব্রিজে আমি যাব কিনা, সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম না। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাখ্যাতীত একধরনের কৌতূহল আমাকে গ্রাস করে ফেলল। বিকেল তিনটার দিকে জরুরি ছুটি নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ি। আর জ্যামেধরা শহরের এক মাথা থেকে রওনা দিয়ে আরেক মাথার বিমানবন্দর স্টেশনে পৌঁছাতে সোয়া পাঁচটা বেজে যায়। ওভারব্রিজে উঠে, দশ বছর আগেকার সেদিনের মতোই জুঁইকে আমি দেখতে পাই আবার। ওই যে বললাম, হঠাৎই থমকে দাঁড়ায় আমার বড় হতে থাকা? আসলেই ব্যাপারটা তাই। জুঁই এগিয়ে এসে বলল, “এখন বোধহয় এ শহরেই থাকো?” আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। ওকে ঘিরে সেই আবেগ, সেই উত্তেজনা তো আর নেই, উল্টো দশ বছর পর ওর এমন উপস্থিতি খানিকটা ভূতুড়েই ঠেকল।

যতটা সম্ভব স্বাভাবিকভাবে আমি বললাম, “তুমি তো একটুও বদলাওনি! ঊনিশ বছরের তুমিই রয়ে গেছো।” ও হাসল, বলল, “আমি তো একই রকম থেকে যাই!” আমিও হাসলাম, কবি স্বভাবটা আর গেল না ওর। ওকে বলি, “আমি জানি, তুমি কারো সঙ্গে বাজি ধরেছিলে।”

“যেমন?” জানতে চায় ও। সব ওকে খুলে বলি, ওর জন্য আমার প্রথম এক বছরের পাগলপ্রায় দশার কথা, ছয় মাস পর ঢাকায় এসে ওকে খুঁজে বেড়ানোর কথা, ওকে নিয়ে জিকুর মন্তব্য, আর এক পর্যায়ে ওই মন্তব্যেই নিজের বিশ্বাস স্থাপনের কথা। সব শুনে বিস্ময়করভাবে ও কাঁদতে শুরু করল। বুঝলাম আমার করুণ দশা শুনেই এ কান্না। সুতরাং ঔদার্যে আমি হৈ হৈ করে উঠি, “আরে! কাঁদছো কেন? ওসব ফিলিংস এখন তো আর নেই। কত আগের কথা সেসব!” আর এও জানাই যে, মোস্তফা ফোন না করলে আমার যে আজকে আসাই হতো না।

“বরং এবার বলো, কী ধরনের বাজি ছিল সেটা, এখন কোথায় আছো, বিয়ে করেছো?” জানতে চাই আমি। হতভম্ব মুখে ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। একবার নিজেকেই শুনিয়ে বলে, “তার মানে”... তার মানে? কী তার মানে? “তারমানে তুমি আমাকে আর ভালোবাসো না? চাও না এখন আর?” সত্যি না রসিকতা বোঝার চেষ্টা করি। বুঝতে না পেরে বলি, “মানে এটা কী ধরনের রসিকতা হচ্ছে, তুমি নিশ্চয়ই বলবে না যে, সত্যিই তুমি আমার সঙ্গে সম্পর্কের পরবর্তী অধ্যায় কাটাতে এখানে এসে হাজির হয়েছো? দশ বছর পর!” জুঁই কাঁদল, সে কান্না থামাতেও পারল। বলল, “আমি তো সত্যিই তোমার কাছেই এসেছি। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে না?” দিশেহারা হয়ে আমি ওর দুই বাহু ধরে ঝাঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় ছিলে এতদিন!”

“নিয়ে যাবে না তোমার সঙ্গে?” বারবার একই কথা জানতে চায় ও। আমার মধ্যে কী হলো, বলে বোঝানো যাবে না। হঠাৎ করে না চাইতেই, আরো ভালোভাবে বললে, চাওয়া যে যেতে পারে, সেই ধারণারও অনেক দূরে থেকেই সব পেয়ে যাওয়ার যে আনন্দ আর উত্তেজনা, আমার মধ্যে তার সবটা এসে ভর করল। একেবারে পাগল হয়ে গেলাম আমি। প্রকাশ্যে, ব্যস্ত স্টেশনে চড় থাপ্পড় দিতে দিতে ওকে আমি চুমু খেতে লাগলাম।

সে রাতেই বিয়ে করতে আমরা কাজী অফিসে যাই। কিন্তু রেজিস্ট্রি খাতায় পিতা-মাতার নাম, স্থায়ী ঠিকানা ইত্যাদি লিখবার প্রসঙ্গ যখন আসলো, জুঁই বলল ও এসব তথ্য দিতে চায় না। কেন, জানতে চাই না। কাজীকে বলে দুটো ফেইক নাম আর একটা ফেইক স্থায়ী ঠিকানা সেখানে বসানোর ব্যবস্থা হয়। আর জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা পাসপোর্ট কোনোটাই ওর না থাকায় সে ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে ভালো অংকের ঘুষ দিতে হয় কাজীকে। ঢাকায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মেসে থাকাকালে বন্ধুত্ব হওয়া রুমমেটদের ডেকে এনে কাউকে উকিলবাপ, কাউকে সাক্ষী ইত্যাদি বানিয়ে আমাদের বিয়ে হয়। হুট করে ভয়াবহ রকমের সুখী হয়ে, সুখানুভূতির ব্যাপারটাই আমার অবশ হয়ে গেল। সবকিছু যে এতটা স্বপ্নের মতো আসলেই হয়ে উঠতে পারে কারো জীবনে, বহু বইপত্র পড়েও আগে এ ব্যাপারে জানতে পারিনি। অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল সবকিছু।

কিন্তু জগত্ সংসারের কিছু কমন প্রশ্ন এসে আমার মাথায়ও গুঁতো দিল, যেমন, জুঁই এ দশ বছর কোথায় ছিল, কিভাবে, কাদের সঙ্গে ছিল, এরকম নানা প্রশ্ন। কিন্তু আবার নিজেই সিদ্ধান্ত নিলাম, যতদিন না নিজে থেকে ও কিছু বলবে, আমিও এ ব্যাপারে কিছুই ওকে জিজ্ঞেস করব না।

করলামও না। এমনকি, ওভারব্রিজে এসে দাঁড়ানোর আগেই ও কোন এলাকা থেকে বেরিয়ে এসেছে, ওর ওই মা-বাবা আর বোন তারা কোথায় থাকে এখন, বিয়ের খবরটা তাদের দেওয়া উচিত কিনা, কিংবা কেনই বা রেজিস্ট্রি খাতায় বাবা মায়ের ফেইক নাম দিতে হলো, এসব কোনো ব্যাপারেই কিছুই ওকে জিজ্ঞেস করলাম না। যেন ও যদি একটা ধূমকেতুও হয়ে থাকে, আর ওর কাজ যদি হয় দশ বছর পর পর পৃথিবীতে এসে দুয়েক মাস আমার সঙ্গে সময় কাটিয়ে যাওয়া, তাতেও আমার কোনো আপত্তি নেই। আর কী অবাক, কত কিছু নিয়েই আমাদের কথা হলো, কতখানেই আমরা বেড়াতে গেলাম, কিন্তু কোনোভাবেই নিজে থেকে জুঁই ওর নিজের অতীত, বা শেষ দশ বছরের জীবন যাপন সম্পর্কে কিছুই বলল না। নিজের কাছেই একদিন অস্বাভাবিক লাগল বিষয়টা, তার কারণ হয়তো এই যে, ততদিনে বিয়ের প্রায় দুই মাস পেরিয়ে গেছে।

“আবার কবে উধাও হচ্ছো?” আপাত অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে, কিন্তু এ প্রশ্নে ওর চেহারার স্বল্পতম পরিবর্তনটুকুও আমাকে বুঝে নিতে হবে, আগে থেকেই ঠিক করে রাখা এমন পরিকল্পনায়, ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় প্রতিবিম্বিত ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করি। ও হাসে, নিঃশব্দে। প্রতিবিম্বিত চেহারার ব্যাপারে অসচেতন বলেই কি? “বললে না?” আবারও জানতে চাই। এবার ও সশব্দে হাসে। যেন খুব ছেলেমানুষি কোনো প্রশ্ন। বলল, “কেন, যে কোনো মুহূর্তেই তো!”

“হুঁম, আমারও তাই ধারণা।” বলি আমি। জুঁই বলল, “আচ্ছা তুমি কি আমার অতীত, এ দশ বছর কোথায় ছিলাম, এসব জানতে চাচ্ছো? ভাবছো খুব অন্ধকার কোনো জগতে আমি ছিলাম কিনা?” এবার আমিই লজ্জিত হই। বলি, “অন্ধকার জগতের কথা ভাবিনি।” কিছু ভাবল ও। আর বলল, “ধরো অন্ধকার জগতেই যদি ছিলাম, ভালোবাসবে না আর, অপেক্ষা করবে না?” আমার আশঙ্কার অ্যাঙ্গেলগুলো ও বুঝে ফেলছে, আর তাই খানিকটা ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে ফেরানোর মতো করে আমি বলি, “বাদ দাও এসব। যেখানে ইচ্ছে সেখানে ছিলে, এখন আমার সঙ্গে আছো, এটাই যথেষ্ট।” মজা করতে চেয়েই মূলত, যোগ করি, “আবার হারিয়ে গেলে কোথায় খুঁজব?” ও হেসে বলল, “কেন, বিমানবন্দর স্টেশনের ওভারব্রিজ!” আর এ জবাবে দুজনেরই খুব হাসি তামাশা পায়।

তবু ও আবার চলে যাবে এ আশঙ্কাটাকে আমি তাড়াতে পারি না। করুণ চোখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওর দিকে তাকিয়ে থাকি, ও চোখ নামিয়ে নেয় না, আবার কিছু জিজ্ঞেসও করে না। এভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকার একপর্যায়ে আমি টের পাই ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ঠিক আর স্বাভাবিক নয়। নিজেদের মধ্যে গল্প করারও কোনো বিষয় আমরা খুঁজে পাই না। জুঁই যেহেতু ওর অতীত বা গত দশ বছরের জীবনের ব্যাপারে একেবারেই মুখ খোলে না। ফলে ও যা বলে ওঠে মাঝেমাঝে, তাও এই গত চার মাসের বিবাহিত জীবন আর দশবছর আগে ফোনে বলা আমাদের কথাবার্তা এবং ওই দফার শেষদিনের বেড়াতে যাওয়ার স্মৃতিচারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।

এমনকি ওর থুতনিতে বছর কয়েকের পুরনো একটা কাটা দাগ দেখেও এটা জানার উপায় থাকে না, কিভাবে এমনটা হয়েছিল বা ও যখন শাকিরার ওয়াকা ওয়াকা গানটা গুনগুন করে কখনো, জিজ্ঞেস করা হয় না ওই বছরের বিশ্বকাপের সময় কোথায় ও ছিল। আমি বলি, “গানটা খুব ভালো ছিল, ওই বিশ্বকাপের সময়ই আমি ঢাকায় চলে আসি।” ও উৎসাহিত হয়, বলে, “বিশ্বকাপ চলার সময়, নাকি শেষ হয়ে যাওয়ার পর?” বলি, “চলার সময়। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচের দিন।” জুঁই হাসে, ইনফর্মড হওয়ার ভদ্র ও মাপা হাসি। কিন্তু নিজের বিশ্বকাপের ব্যাপারে নীরব থাকে।

সে রাতে শাকিরাকে স্বপ্ন দেখি। সেদ্ধ ধানের স্যাম্পল নিয়ে শাকিরা আমার অফিসে আসে। আর নিজেকে দশ বছর আগের ওই ধানের কলের বর্তমান ম্যানেজার দাবি করে ওয়াকা ওয়াকা বলতে বলতে একটা দুইটা করে ধান ছিটাতে থাকে। রেগে গিয়ে বলি, ‘ফাইজলামি করো! আমি জানি তুমি কে।’ শাকিরা হাসে। বলে, “সবাই যা জানে তুমিও তাই জানো কেন?” আমি দাবি করি, “সবাই যা জানে আমি তা জানি না, আমি অন্যকিছু জানি।” জিজ্ঞেস করে, “কী জানো তুমি?” বলি, “তুমি শোভা, দুই পয়সার রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী”, এবং আমি ইংরেজিতেও বলি, “ইউ আর নট শাকিরা।” ঘুষি দিয়ে আমি নকল শাকিরার নাক ভেঙে দিই। আর স্বপ্নের মধ্যেই একটা রিকশা ঠিক করে আমি শোভাদের বাসায় গিয়ে শোভার মাকে বলি, “এটা কী করে সম্ভব যে দুই পয়সার দলীয়সংগীত শিল্পী নিজেকে শাকিরা বলে দাবি করে!”

পরদিন জুঁই আমাকে জিজ্ঞেস করে, “শোভা কে গো?” আমি ভালো করে ওর দিকে তাকাই। বলি, “তুমি এ দশ বছর কলকাতায় ছিলে?” চমকে ওঠে ও। কিন্তু আবার হাসে, বলে, “আমার তো পাসপোর্টই নেই।”
“সে তো আমাকে ওরকম জানানো হয়েছে বলে নেই, বাস্তবে থাকতে পারে না?” ঠান্ডা মাথায় বলার ভঙ্গিতে বলি। মুহূর্তেই কালো মেঘের মতো হয়ে যায় ও, নাটকীয়ভাবে পানি বেরোয় ওর চোখ দিয়ে। “তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না” কাঁদতে কাঁদতে বলে। আমি বোঝাতে পারি না, এখানে বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের কিছু নেই। বিশ্বাস কিংবা এমনকি অবিশ্বাস করতে গেলেও ন্যূনতম ইনফর্মেশন থাকা লাগে, অর্থাৎ ব্যাপারটিকে তো থাকতে হবে, যেটাকে বিশ্বাস করব, অথবা করব না। “তোমার তো কোনো ব্যাপারই নেই!”

তারপর নিয়ম করে প্রায় প্রতিরাতে আমি শোভাকে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। হঠাৎ শোভাকে স্বপ্ন দেখতে শুরু করার কোনো ব্যাখ্যা আমি নিজেকে দিতে পারলাম না। শুধু টের পেলাম, জেগে ওঠার পরও ওই রেশ থেকে যায়। জুঁইয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা পুরোপুরি ফর্মাল হয়ে ওঠে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কথাই আর হয় না আমাদের। বরং, জুঁইয়ের চলে যাওয়ার আশঙ্কাটাকেই কেমন যেন সম্ভাবনার মতো লাগতে শুরু করে। মনে হয়, ও এখনো যাচ্ছে না কেন? দশ বছরের জন্য ওর কি কোথাও যাওয়ার নেই আর! যেন এবার আমি শোভার ব্যাপারে একান্তে কিছু ভাববার অবসর চাই। শোভার চলে যাওয়ায় না-জাগা বিরহটাকে জাগিয়ে দেখতে চাই ওটা কেমন। যেন আমি নিশ্চিত হতে চাই, যে কখনো ফিরে আসবে বলেনি, তার চলে যাওয়া বা তার না থাকাই বেশি দামি ছিল কিনা।

অল্প সময়ের মধ্যেই এই চাওয়া এত তীব্র হলো, আর সেইসূত্রে আমার বদলে যেতে থাকাও এত স্পষ্ট হলো যে, আমি নিশ্চিত, ঘাবড়ে গিয়ে জুঁই এখন ওর অতীত এবং গত দশ বছরের সব ঘটনা আমাকে খুলে বলতে রাজি। কিংবা যে কোনো কারণেই হোক, রাজি। বিভিন্নভাবে সে এটা বোঝায় আমাকে। বোঝায় যে, আগ বাড়িয়ে প্রসঙ্গটা ও একা একা তুলতে পারবে না সত্যি, তবে আমি যদি তুলি, ও বলবে। কিন্তু কী অদ্ভুত, প্রেম বলি, থাকা বলি, কী নাটকীয়তা, বা নিদেনপক্ষে স্বাভাবিক কৌতূহল, কোনো অ্যাঙ্গেল থেকেই প্রসঙ্গটা আমি আর তুলতে পারি না। যেন এবার উল্টো আমিই হারিয়ে গেছি ওর থেকে, আর তা, কোথায় আবার আমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে, না বলেই।

অসুস্থ ‘তিলোত্তমা’র কাছে কী সেবা চান আপনি!



প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত, প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

ছবি: সংগৃহীত, প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

জুলাই ১৩, ২০২৪ সালের ভোর পাঁচটায় শুরু হয়েছিল এক তুমুল বৃষ্টি। রাজধানী ঢাকার বেশিরভাগ মানুষ তখনও গভীর ঘুমে।

এ সময়টা ঘোর বর্ষাকাল। সে কারণে ভারী বৃষ্টিপাত হতেই পারে। তাই, অ্যালার্ম শুনেও আরেকটু ঘুমিয়ে নিই বলে যারা কিছুটা দেরিতে উঠে অফিসে যাবেন বলে আটটার দিকে পথে নেমেছেন, তাদের চক্ষু সেদিন চড়কগাছ‍!

সকাল ৯টা পর্যন্ত বৃষ্টি থামেনি। একটানা চার ঘণ্টার মুষলধারার পতনে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার ২৬ থেকে ৩০টি বড় রাস্তা একসঙ্গে ডুবে গেছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, এই ‘ডোবা’ সেই ডোবা নয়! রাস্তায় ১-২ ঘণ্টা জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকার পর অনেক গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকে পড়ায় অচল হয়ে যানজট অসহনীয় করে তুলেছিল সেদিন। সংবাদে টেলিভিশনের ভিডিওচিত্র দেখেও তাই-ই মনে হচ্ছিল।

সে এক অতি ভয়ঙ্কর অবস্থা সারাদিন জুড়ে। যেখানে চোখ যায়, সেখানেই মনে হয়, প্লাবন বয়ে যাচ্ছে। নটরডেম কলেজের পাশের রাস্তায় পার্কিং করা কারের শুধু ছাদটা দেখা যাচ্ছে। মালিক গাড়িতে উঠতে গিয়ে হতবাক হয়ে পড়েছেন।

নিউমার্কেটের প্রধান গলিতে বুকসমান পানি। দোকানকার মালিকেরা যারা বাসা থেকে ডুবন্ত নিউমার্কেটের ছবি দেখে দৌড়ে এস মাল সরানোর চেষ্টা করেছিলেন, তারা অনেকে এসে দেখেন দোকানের তালা ঘোলা-ময়লা পানিতে ডুবে অচেনা হয়ে গেছে। মালপত্র ভিজে গছে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে পর্যন্ত সেই মালামাল সরাতে পারেননি।

কোথায় নেবেন! বেরুনোর সব রাস্তায় থৈ থৈ পানি! ভ্যান, যানবাহন কিছুই ঢোকানো যাবে না! এখানে জলের যানবাহন নেই। কলের গাড়ি জমানো বৃষ্টির বুকসমান জলে চলার পথ খুঁজে পায়নি কোথাও।

গ্রীন রোডে অনেকগুলো প্রাইভেট হাসপাতাল। সেখানে আগত রোগীদের অবস্থা খুবই করুণভাবে চিত্রিত হয়ে সংবাদে ঠাঁই নিয়েছে সেদিন। ডুবন্ত রিকশাভ্যানে নারী রোগীকে শুইয়ে নিয়ে ঠেলে চলছেন রোগীর আত্মীয়-স্বজনেরা। পাশের ভবনের কৌতূহলী মানুষ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে ‘আহারে’ বলে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। ভাগ্যিস! শুক্রবার হওয়ায় সেদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা ছিল না।

এদিন পথে যারই নেমেছেন, তারাই দুর্ভোগে পড়ে গিয়েছেন। বাইকারদের অনেকের ইঞ্জিনে পানি ঢুকে স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেছে। পেটের ধান্ধায় যারা ব্যাটারিরিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাদের বাহন অচল হয়ে যাওয়ায় সেগুলো ঠেলে অন্যখানে সরিয়ে নেওয়ার কোনো উপায় ছিল না।

চিৎকার করে কেউ কেউ বলছিলেন- ‘আমাদের ট্যাক্স, ভ্যাট আদায়ের সময় যারা নিয়ম দেখায়, যারা জরিমানা আদায় করে তারা এখন ঘরে বসে টিভিতে আমাদের কষ্ট দেখে তামাশা করছে! এই তিলোত্তমা নগরে নাগরিক সুবিধা কি সামান্য বৃষ্টির পানিতে ডুবে থাকবে’!

কথা হলো- এই ‘তিলোত্তমা’ কী দেবে তোমায় আমায়! তার কি-বা দেবার আছে! রাজধানী ঢাকাকে বিশেষণ দিয়ে রূপসীর টোলপড়া গালের তিলের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এর সৌন্দর্যের মোহে কবি-সাহিত্যকরা কত শত ছড়া-কবিতা লিখেন দিনরাত।

কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর কত মূল্যবান প্রসাধনী কিনে সাজানোর চেষ্টা করেন এর দেহকে। এর একই অঙ্গে উত্তর-দক্ষিণে কত বাহারি আলো শোভা পায়‍ কিন্তু দিনশেষে এত মেকাপ ‘রিমুভ’ করে ঘুমুতে যাওয়া উপায় নেই তার। এজন্য সে নিজেই নিজের সহ্যগুণ হারিয়ে ‘ভালনেরাবল’ বা ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। কিন্তু সেদিকে কারো কোনো নজর নেই।

তবুও প্রতিদিন নতুন নতুন ফেসপাউডার, কাজল, ভারী ভারী গহনা পরানো হচ্ছে। তিলোত্তমার বুক চিরে এত ভারী গহনা পরানোর ফলে এর বুক দুরু দুরু করছে। কানের গহনা কখন কান ছিঁড়ে পড়বে, তার নিরাপত্তা নেই। এর প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় এখন বন্ধ হয়ে গেছে! এসব কথা আক্ষেপ করে বলছিলন এক প্রবীণ ঢাকাবাসী। তাঁর কাছে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হওয়ার কথা হঠাৎ আঁতকে উঠে জিজ্ঞাসা করলাম- সেটা কেমন!

মানুষের প্রাকৃতিক পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হয়ে গেলে যদি দ্রুত চিকিৎসা করানো না যায়, তাহলে তার মৃত্যু অনিবার্য! তবে ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার পঞ্চন্দ্রিয় বন্ধ হলো কীভাবে! তিনি জানালেন, ধরুন, এর বাতাসের মান বছরের ১০ মাসই অস্বাস্থ্যকর থাকে। পথে হাঁটতে গেলে নাক, চোখ দিয়ে গরম পানি ঝরে। এখন বর্ষাকাল তাই বায়ুতে একটা স্বস্তি। এর মুখ খোলা। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, যা দিয়ে প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষ, ছাত্র, বেকার, ভাসমান মানুষ ঢুকছে। কেউ একবার ঢুকলে আর বের হতে চায় না।

তবে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো- এর নিচের ইন্দ্রিয় দুটো বর্ষাকালে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে পড়ে। যেমন- ধরুন, ভূগর্ভস্থ সুয়্যারেজ লাইন ও নর্দমাগুলোর কথা। এই দুটি ‘তিলোত্তমা’র অতি গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয়। জুলাই ১৩, ২০২৪ তারিখ চার ঘণ্টার বৃষ্টির পানি যদি বাধাহীনভাবে সব নর্দমা দিয়ে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়তো, তাহলে কি এই ভয়ঙ্কর জলজট হতো!

কিন্তু ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার অতি গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয় সদৃশ নর্দমাগুলোর মুখ বন্ধ হয়ে পড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান এর নর্দমাগুলোর ভেতরে পাইপ বসিয়ে এর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার উন্নয়ন কাজে এত বেশি প্রতিষ্ঠান জড়িত, তা গুনে শেষ করা যাবে না। তাদের মধ্যে কাজের সমন্বয় নেই। কে কখন কাটলো, কে ঢেকে রাখলো, আর কে নর্দমাগুলোর ভেতরে পাইপ বসিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিলো, তা ঠিকমতো হিসাব রাখার মতো সময় সুযোগ নেই কর্পোরেশনগুলোর।

সুতরাং একটু বৃষ্টি হলেই প্লাষ্টিক, মাটি, কাপড়ের টুকরো, কিচেন গার্বেজ ইত্যাদি দিয়ে এর নিচের ইন্দ্রিয় বা ময়লা নিষ্কাশনের নর্দমা বর্ষাকালে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে পড়ে; যার নেতিবাচক প্রভাব এসে পড়ে রাজপথে, অলিতে-গলিতে, বাড়িতে, মার্কেটে। নগরের সব জায়গার সব কার্যক্রম হঠাৎ থৈ থৈ পানিতে সয়লাব হয়ে যায়।

এজন্য কর্পোরেশনগুলোর সার্বক্ষণিক ওয়াচটিম ও মটিভেশন কর্মসূচি থাকা দরকার। একেকটি সার্বক্ষণিক ওয়াচটিমের এক-দুইজন সদস্য একেকটি এলাকার ১০টি করে নর্দমার প্রবাহ পরিষ্কার আছে কিনা তা নজরদারিতে রাখলে এই জলাবদ্ধতা সহজেই নিরাময় করা যাবে!

জাপানের ট্রাফিক যেমন অফিসে বসেই রাস্তার চলন্ত গাড়ি ওয়াচ করে মাসিক বেতন বিলের সঙ্গে জরিমানার বিল কেটে ধরিয়ে দেয় তদ্রুপ আমাদের সিটি কর্পোরেশনের নর্দমা ওয়াচ টিমের দৈনন্দিন কার্যকলাপ সিসি ক্যামেরা ও ড্রোন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করে জরিমানার বিধান করা যেতে পারে।

‘তিলোত্তমা’ ঢাকার নির্মাণ কাজ সারাবছর জুড়ে চলে। কখনো শেষ হয় না। নির্মাতারা রাস্তার পার্শ্বে বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী, নুড়িপাথর বর্জ্য ফেলে স্তূপ করে রাখে। একটু বৃষ্টি হলে সেগুলো গড়িয়ে কাছাকাছির ড্রেন বন্ধ করে দেয়। বিভিন্ন পার্ক, পথঘাটের খোলা রেস্টুরেন্টে হরদম পলিথিন প্যাকেটে খাদ্যসামগ্রী বিক্রি হয়। ফুটপাতের দোকান, দর্জিপাড়া ইত্যাদি থেকে প্লাষ্টিক ব্যাগ ও বেশি শক্ত বর্জ্য নর্দমার মধ্যে ফেলা হয়ে থাকে। ওয়াচটিমের মাধ্যমে সেগুলো নিয়মিত সরিয়ে ড্রেনের ময়লা পানির গতিপ্রবাহ দেখে প্রতিদিন রিপোর্ট নেওয়ার নিয়ম থাকা উচিত।
হয়ত অনেক নিয়ম-কানুন হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ‘তিলোত্তমা’র রাস্তায় যেখানে-সেখানে কাগজ, পলিথিন, ইটের টুকরা, আবর্জনার ছড়াছড়ি দেখে এসব কাজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাইতো মনে হয়, মাত্র একবেলা বৃষ্টির পানিতে কেন এই বন্যা! গেল অর্থবছরে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে সাতশ পঞ্চাশ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে বলে একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম হয়েছে। তবু কেন নগর জুড়ে ভয়াবহ জলাব্ধতার দুর্ভোগ কিছুদিন পর পর ঘাড়ে চাপে! এর দায়ভার কার!

‘তিলোত্তমা’ ঢাকা যানজট, জলজট ইত্যাদিতে নিজেই পঙ্গু হয়ে অসাড় হয়ে পড়েছে। বুয়েটের আবাসিকের মতো জায়গায় নগর পরিকল্পনাবিদদের কোয়ার্টারের নিচতলাবাসী এবার জলজটকে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। তারা কেউ কেউ পাম্প দিয়ে ঘরের পানি সেচে বাইরে ফেলার চেষ্টা করেছেন। কেউ সারারাত ঘুমাতে পারেননি। তাদের জন্যও উন্নত নাগরিক সেবা সে রাতে শূন্যের কোটায় নেমে গিয়েছিল।

‘তিলোত্তমা’ ঢাকায় প্রায় প্রতিবছর এই জায়গায় বার বার কাটাছেঁড়া করায় অতি উন্নয়নের ভারে সে ন্যুজ্ব হয়ে পড়েছে। যেমনটি ঘটেছিল পপ তারকা মাইকেল জ্যাকসনের বেলায়। তাঁর দেহের বিভিন্ন অঙ্গে এত বেশি প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়েছিল যে, তিনি একসময় চরম হতাশ হয়ে ওষুধ গ্রহণ ছেড়ে দিয়ে একা একা বাঁচার জন্য নিঃসঙ্গ থাকতে চেয়েছেন। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি তার। এখন থেকে আমাদের ‘তিলোত্তমা’ ঢাকার অঙ্গে আর কাটাছেঁড়া না করাটাই উত্তম।

অসুস্থ ‘তিলোত্তমা’র ওপর একসঙ্গে অনেক ব্যাধি ভর করেছে। এ অবস্থায় তার কাছে আর কী নতুন সেবা চাওয়ার আছে আমাদের! তাই, ‘তিলোত্তমা’র ওপর আর শল্য চিকিৎসা না চাপিয়ে উল্লিখিত টোটকা দাওয়াই দিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর আছে বলে মনে হয় না!

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। E-mail: [email protected]

;

সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ

ছবি: সাহিত্য পত্রিকা 'কথার কাগজ'র আত্মপ্রকাশ

  • Font increase
  • Font Decrease

শ্রাবণ সংখ্যা আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে শিল্প ও সাহিত্যের ছোট পত্রিকা 'কথার কাগজ'-এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো।

শুক্রবার (১২ জুলাই) বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে 'কথার কাগজ' শ্রাবণ সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করা হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শাহানারা স্বপ্না, কথাসাহিত্যিক ফরিদুল ইসলাম নির্ঝর, স্টুডেন্ট ওয়েজ প্রকাশনীর প্রকাশক মাশফিক তন্ময়, কথার কাগজের প্রধান সম্পাদক কেতন শেখ, নির্বাহী সম্পাদক অয়ন আব্দুল্লাহ প্রমুখ। পত্রিকাটির বার্ষিক শ্রাবণ, কার্তিক ও ফাল্গুন তিনটি সংখ্যায় প্রকাশ হবে।

মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে কথার কাগজের প্রধান সম্পাদক কেতন শেখ বলেন, 'করোনাকালীন ২০২০ সালে কথার কাগজের জন্ম। সে সময় কয়েকজন প্রবাসী আর দেশি লেখক অনলাইনে ব্লগের মাধ্যমে কথার কাগজের লেখালেখি শুরু করি। তরুণ সাহি- ত্যিকদের সঙ্গে প্রবীণ সাহিত্যিকদের লেখালেখির একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়ায় কথার কাগজ।

প্রকাশক মাশফিক তন্ময় বলেন, 'এক সময় সাহিত্য আন্দোলনের প্রধান বাহন ছিল ছোট পত্রিকা বা লিটলম্যাগ। কিন্তু নানা সংকটে লিটলম্যাগের কলেবর ছোট হয়ে গেছে। প্রকাশকরা অনেকেই অর্থসংকটে তাদের প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে অনলাইনের এই যুগে ছাপা কাগজে কথার কাগজের যাত্রা তরুণ লেখকদের অনুপ্রেরণা জোগাবে।'

শাহানারা স্বপ্না বলেন, 'আশা করি, পত্রিকাটি অনেক দূর এগিয়ে যাবে। শ্রাবণ সংখ্যার প্রথম দর্শনে মনে হচ্ছে এটি পাঠকদের সাহিত্যের খোরাক জোগাবে।'

ফরিদুল ইসলাম নির্ঝর বলেন, 'মানুষের ভাষার প্রতি টান থাকলে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে কাজ করা যায়, এর উদাহরণ কথার কাগজ। সম্পাদকম- গুলীর তিনজনই দেশের বাইরে থেকে এর যাত্রা শুরু করেন। আজকে দেশে এসেই তারা পত্রিকাটির ছাপা সংস্করণের মোড়ক উন্মোচন করলেন।'

সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, 'আমাদের তরুণরা বিদেশ চলে যাচ্ছে, আর ফিরছে না। তবে কথার কাগজের সঙ্গে জড়িতরা বিদেশ থেকে সাহিত্য আর দেশের টানে ফিরে এসেছেন। অনলাইনের যুগে যখন অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এ অবস্থায় তারা কথার কাগজের প্রিন্ট ভার্সন নিয়ে এসেছেন। এটি অনেক ভালো লাগার।' নতুন পত্রিকাটি টিকিয়ে রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

;

লেখক শেখ হাসিনা কোটিপতি হওয়ার পথে!



আবদুল হামিদ মাহবুব
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখালেখির হাত খুব ভালো। তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হননি তখনই তার একাধিক বই প্রকাশ হয়েছে। সম্ভবত তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই ‘ওরা টোকাই কেন’। ঢাকার আগামী প্রকাশনী থেকে বইখানা বের হয়েছিল। ওই প্রকাশনী থেকে আমারও দু’খানা ছড়ার বই প্রকাশ হয়। ১৯৯১ সালে আমার ‘ডিমের ভিতর হাতি’ যখন প্রকাশ হচ্ছিলো তখন আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনি ভাই শেখ হাসিনার ‘ওরা টোকাই কেন’ এককপি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন।

বইখানা প্রথম না দ্বিতীয় সংস্করণের ছিলো সেটা মনে নেই। ওই বই কয়েকটি নিবন্ধের সংকলন। অধিকাংশ নিবন্ধেই শেখ হাসিনা তাঁর ভিতরের যন্ত্রণার কথা লিখেছিলেন। লিখেছিলেন দেশ ও রাজনীতি নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কিছু কিছু ইঙ্গিত। পড়েছিলাম তো অনেক আগে। তারপরও লেখাগুলোর অনেক বিষয় মনে রয়ে গেছে। প্রতিটি নিবন্ধ পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমার পারিবারিক ছোট লাইব্রেরিতে বইখানা গোছিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু আজ যখন ওই বই খোঁজতে লাগলাম, পেলাম না। অনুমান হচ্ছে আমার বইচোর কোন বন্ধু হয়তো এই বইখানা মেরে দিয়েছেন। অথবা বন্যা অতঙ্কে কয়েকেবার বাসার বইগুলো টানাটানি করার কারণে কোথাও হয়ত খুইয়ে ফেলেছি। তবে আমার ধারণা এই বইয়ের ক্ষেত্রে প্রথমটি ঘটেছে।

প্রধানমন্ত্রীর অনেক বইয়ের মতো ‘ওরা টোকাই কেন’ নিশ্চয়ই বহুল প্রচারিত হয়েছিল, বেরিয়েছিল অনেক অনেক সংস্করণ। আর বই সমূহের রয়্যারিটিও তিনি হাজার হাজার টাকা পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এমন প্রাপ্তি ঘটে থাকলে, আমি একজন লেখক হিসাবে অবশ্যই পুলকিত হই। আমি দেখেছি সেই ১৯৯১ সালের পর থেকে আগামী প্রকাশনীর প্রকাশনা ব্যবসারও অনেক উন্নতি হয়েছে। ব্যবসার উন্নতি ঘটার অর্থ প্রকাশকের উন্নতি ঘটা। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনি ভাইয়ের আর্থিক অবস্থা অনেক অনেক ভালো হয়েছে।

পূর্বে দেখতাম একুশের বইমেলায় আগামী প্রকাশনী ছোট্ট স্টল নিত। এখন প্যাভিলিয়ন নেয়। লাখ লাখ টাকা খরচ করে প্যাভিলিয়নের অঙ্গসজ্জা করা হয়। নিশ্চয় বইয়ের ব্যবসা ভালো হয়। সেকারণেই বইমেলার প্যাভিলিয়ন তৈরিতে বিনিয়োগও বেশি করেন। প্রতিবছরই আগামী প্রকাশনীর কোন না কোন বই কেনার জন্য পাঠকের লাইন পড়ে। পাঠক যখন যে কোন লেখকের বই কেনে, সেটা দেখে আমি একজন লেখক হিসাবে আনন্দিত হই। বইয়ের ব্যবসার উন্নতি হোক। প্রকাশকরা ভালো লাভ করুন, আমি মনে প্রাণে সেটা চাই।

অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, প্রকাশকের লাভ হলে আমার মতো মফস্বলের লেখকরা কি লাভমান হই? অবশ্যই যৌক্তিক প্রশ্ন। এর জবাব খুব সংক্ষিপ্ত। প্রকাশকরা যখন বই প্রকাশ করে লাভের মুখ দেখবেন, তখন তারা নতুন নতুন বই প্রকাশে আগ্রহী হবেন। নতুবা আমাদের মতো লেখকদের প্রকাশককে উল্টো টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করিয়ে নিতে হবে। এবং আমরা অনেকেই সেটা করছিও।

অনেকে আবার এও বলেন ডিজিটালের এই যুগে এখন আর কেউ বই কিনে পড়ে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে টুকটাক পড়েই তাদের পড়া শেষ করেন। সেই কারণে লেখকরা গাঁটের টাকা খরচ করে বই প্রকাশ করলেও সেগুলো বিক্রি হয় না। আমি এই অপবাদটা মানতে নারাজ। কারণ আমি দেখেছি কেবল ফেব্রুয়ারি মাসেই বইমেলা চলাকালে শত শত কোটি টাকার বই বিক্রি হয়। আর যারা পড়ুয়া, তারা সারা বছরই খোঁজে খোঁজে রকমারি, প্রথমা, আগামী, শ্রাবণ, ইউপিএলসহ বিভিন্ন আনলাইন বই বিক্রয় প্রতিষ্ঠান থেকে বই আনান।

আমি মফস্বলের একটি শহরে থাকি। আমাদেরে শহরে বইয়ের দোকান আছে অনেক। সেগুলোতে স্কুল কলেজের পাঠ্য ও গাইড বই ছাড়া অন্য বই খুব কমই দেখা যায়। সৃজনশীল বলুন আর মননশীল বলুন, সেইরকম বইয়ের দোকান খুব একটা নাই। আমাদের শহরে প্রকাশনা ব্যবসার সাথে ‘কোরাস’ নামে একটি দোকান চালান বই পাগল এক যুবক মুজাহিদ আহমদ। তাঁর কোরাসেই আমাদের মত পাঠকের উপযোগী কিছু কিছু বই আসে। কিন্তু সবসময় কোরাসও আমাদের মতো পাঠকদের চাহিদার যোগান দিতে পারে না। তারপরও মন্দের ভালো হিসাবে দোকানটি টিকে আছে, টিকে থাক্।

আমাকে প্রায়ই অর্ডার করে ‘রকমারি’ থেকে বই আনাতে হয়। আমার আনানো বই ছাড়িয়ে আনার জন্য আমি নিজে প্রায়ই কুরিয়ার অফিসে যাই। আমি যেদিনই কুরিয়ার অফিসে গিয়েছি, দেখেছি কেবল আমার বই নয়, আমার মতো আরও অন্তত বিশ থেকে পঁচিশ জনের বইয়ের প্যাকেট এসেছে। কুরিয়ার অফিসের লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি, প্রতিদিনই এভাবে কিছু না কিছু বই নানাজনের নামে আসে। আর আমার নিজের চোখে দেখাটাকেওতো বিশ্বাস করতে হবে। মানুষ যদি বই নাই পড়বে তবে কেনো রকমারি কিংবা অনলাইনের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে এতো এতো বইয়ের প্যাকেট আসবে? আমি বলবো বইয়ের পাঠক মোটেই কমেনি বরংচ বেড়েছে।

শুরু করেছিলাম আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বইয়ের প্রসঙ্গ দিয়ে। বই প্রসঙ্গেই বলতে গিয়ে অন্য প্রসঙ্গও এসে গেল। আমাদের শহরের সেই যে ‘কোরাসে’র কথা বলেছি; ক’দিন আগে এক দুপুরবেলা কোরাসে গিয়ে বই দেখছি। এসময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুইজন প্রধান শিক্ষক কোরাসে এসে ঢুকলেন। তাদের দু’জনের হাতেই বেশ বড় সাইজের চারখানা করে বই। ওই দুই প্রধান শিক্ষক আমার পূর্ব পরিচিত। তাদের হাতে বই দেখে আমি উৎফুল্ল হলাম। কি বই? কোথা থেকে আনলেন? এমন প্রশ্ন করে বইগুলো দেখতে চাইলাম। দু’জনই ক্ষোভ প্রকাশ করে আমার সামনে টেবিলের উপর ধাম্ ধাম্ করে বইগুলো রাখলেন। একজন বললেন, ‘‘আমাদের বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের পড়ার জন্য এই বইগুলো নগদ চব্বিশ’ টাকা দিয়ে কিনে এনেছি। বলুন ছাত্ররা এই বই পড়তে পারবে? তারা কি কিছু বুঝবে?’’ অন্য প্রধান শিক্ষকের চেহারায় তখনও বিরক্তি রয়ে গেছে। তিনি বললেন, ‘বইগুলো দেখুন, আপনি লেখক মানুষ, আপনিও কিছু বলুন।’

আমি তাদের আনা বইয়ের দিকে মনোযোগ দিলাম। দেখি চার চার আটখানা বই, দুটি বিষয় নিয়ে করা হয়েছে। প্রচ্ছদে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ছবি। বইগুলোর লেখক আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটি বইয়ের নাম ‘সকলের তরে সকলে আমরা’। এই বইয়ে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ ও ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত যে ভাষণগুলো দিয়েছেন সেগুলোর বাংলা ও ইংরেজি সংকলন। অপর বইয়ের নাম ‘আহ্বান’। এই বই করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত জাতির উদ্দেশে যেসব ভাষণ দিয়েছেন সেগুলো সংকলিত করে।

দু’খানা বইয়ের-ই কাগজ, ছাপা, বাঁধাই খুবই উন্নত মানের। প্রতি কপি বইয়ের মূল্য ছয়শত টাকা। প্রত্যেকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরির জন্য প্রতিটি বইয়ের দুই কপি করে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস বিক্রি করেছে। প্রধান শিক্ষকরা এই বইগুলো কিনে নিতে বাধ্য। চারখানা বইয়ের জন্য প্রধান শিক্ষকদের দুই হাজার চারশত টাকা করে অফিসের সংশ্লিষ্ট ক্লার্কের কাছে পরিশোধ করতে হয়েছে। বুঝতে পারি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে বলেই এই দুই প্রধান শিক্ষক ক্ষুব্ধ। আমি শিক্ষকদের অনুমতি নিয়েই একটি বিদ্যালয়ের জন্য আনা চারখানা বইয়ের ছবি উঠিয়ে নিলাম। এই সময় কোরাসের কর্ণধার মুজাহিদ আহমদ বললো, ‘ভাই, আমি এমন একখান বই প্রকাশের অনুমতি পেলে কোটিপতি হয়ে যেতাম।’

আমি ওই দুই প্রধান শিক্ষককে উদ্দেশ্য করে বললাম; ‘প্রধানমন্ত্রীর বই প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছে, এটাতো আনন্দের বিষয়। কিন্তু আমারও প্রশ্ন হচ্ছে বইগুলো কি প্রাথমিকের ছাত্রছাত্রীদের জন্য উপযোগি? আর প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রিয় এইসব ভাষণ বই আকারে করাটা তো সরকারি খরচেই হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, উচ্চ বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলোতে দিতে হলে বিনামূল্যে দেওয়ার কথা। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সংকলন টাকার বিনিময়ে কিনতে হবে কেনো?’

তখন একজন বললেন; ‘ভাই, এই বই রাষ্ট্রিয় ভাবে হয়নি। ব্যবসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আশপাশের এক দু’জন প্রকাশনীর মাধ্যমে প্রকাশ করে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তারা কোটি কোটি টাকা কামাই করে নিচ্ছেন।’ উনার কথায় আমি বইয়ের প্রথম দিকের পাতা উল্টালাম। ঠিকইতো প্রকাশক ‘জিনিয়াস পাবলিকেশন্স’-এর মো. হাবিবুর রহমান। দু’খানা বইয়েরই গ্রন্থনা ও সম্পাদনা মো. নজরুল ইসলাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার (সচিব)। খেয়াল করে দেখলাম বই দু’খানার কপিরাইট শেখ হাসিনা। বুঝতে পারি যে এই বইগুলোর যে রয়্যালিটি আসবে সেটা আমাদের প্রধানমন্ত্রীই পাবেন।

এখন একটা হিসাব করে দেখি। বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৬শ ২০টি। এই বই যখন প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে বাধ্যতামূলক কিনতেই হবে, তা হলে ৪ কপি করে বই বিক্রি হবে উল্লেখিত বিদ্যালয়গুলোতে ২ লাখ ৬২ হাজার ৪শ ৮০ কপি। এই বইয়ের মূল্য থেকে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের হাতে টাকা আসবে ১৫ কোটি ৭৪ লাখ ৮৮হাজার। বইয়ের কপিরাইট অনুযায়ী শতকরা ১৫ ভাগ রয়্যালিটি নিলেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী পাবেন ২ কোটি ৩৬ লাখ ২৩ হাজার ২শ টাকা। হিসাবে কিন্তু আমার মাথা ঘুরে গেছে। বই থেকে এমন অঙ্কের রয়্যারিটি এদেশে আগে কেউ পেয়েছেন কি না আমি জানি না।

আর এটাতো আমি কেবল প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিক্রির হিসাব দিলাম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরির জন্য যখন বাধ্যতামুলক করা হয়েছে, তবে তো উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও এই বইগুলো এভাবেই বিক্রি হবে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্ত করলে আরো কতো কতো হাজার বেড়ে যাবে। আমি হিসাব বাড়ালে অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারি।

আমার ঘরেও একজন প্রধান শিক্ষক আছেন। লেখাটার পূর্ণতার জন্য তার কাছে কিছু তথ্য জানতে চেয়েছিলাম। তিনি খ্যাক্ করে উঠে বললেন, ‘স্কুল আমি চালাই। আমার স্কুলের জন্য কখন কি ভাবে কি কিনবো না কিনবো সেটা তোমাকে বলবো কেনো?’ দেখলাম ঘাটাতে গেলে আবার কি থেকে কি হয়ে যায়। তাই কথা না বাড়িয়ে লেখা শেষ করার দিকেই মনোযোগ রাখলাম।

আমরা যারা লেখক আমাদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, প্রকাশকরা লেখকদের ঠকান। তারা ঠিক মতো লেখকের পাওনা রয়্যালিটি পরিশোধ করেন না। তাই বলে কি প্রধানমন্ত্রীকে ‘জিনিয়াস পাবলিকেশন্স’-এর মো. হাবিবুর রহমান ঠকানোর সাহস করবেন? নিশ্চয় না। এই ভরসাতেই বলতেই পারি বই বিক্রির অর্থে আমাদের লেখক শেখ হাসিনা কোটিপতি হবার পথে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, ছড়াকার

ইমেইল: [email protected]

;

দশ টাকার শোক



মনি হায়দার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রায় পনেরো মিনিট ধরে মানিব্যাগটা উল্টেপাল্টে দ্যাখে রজব আলী।

মানিব্যাগটা খুব পছন্দ হয়েছে তার। বিশেষ করে মানিব্যাগটার বাদামি রংটা। ব্যাগটা চামড়ার তৈরি। রজব আলী নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শোকে। বোঝা যায় না কোন্ পশুর চামড়ায় মানিব্যাগটা তৈরি হয়েছে। মানিব্যাগটার ভেতরে অনেকগুলো ছোট ছোট কুঠরি। রজব আলী কল্পনায় দেখতে পায়- মানিব্যাগটার ভিতরে রাখা টাকায় ভেতরের কুঠুরিগুলো ভরে উঠেছে।

ব্যাগটা প্যান্টের পকেটে নিয়ে যখন হাঁটবে পিছটা ফুলে যাবে, মুহূর্তেই শরীরের কোষে কোষে একটা অন্যরকম অহমিকা অনুভব করে সে।

ভাই, মানিব্যাগটার দাম কতো ? রজব আলী মানিব্যাগঅলাকে জিজ্ঞেস করে।

ব্যাগঅলা রজব আলীর উপর মনে মনে চটে উঠেছে। সেই কতোক্ষণ থেকে ব্যাগটা উল্পেপাল্টে দেখছে। কেনার কথা বলছে না। অথচ রজব আলীর দেখার মধ্যে দুটো ব্যাগ সে বিক্রি করেছে। ফুটপাতের জিনিস এতক্ষণ নাড়াচাড়া কেউ করে না। ব্যাগঅলা রাগ করে কিছু বলতেও পারে না। যদি কেনে ?

আপনি নেবেন ? রজব আলীর দাম জিজ্ঞাসায় ব্যাগঅলা পাল্ট প্রশ্ন ছোড়ে। কারণ রজব আলীকে দেখে তার মনে হয় না এই লোক মানিব্যাগ কিনবে।

রজব আলী একটি বহুজাতিক কোম্পানির অফিসের পিওন। পরনের পোশাকে ঐ বহুজাতিক কোম্পানির পরিচয় আছে। ব্যাগঅলার ধারণা এইসব লোকজন সাধারণত মানিব্যাগ-ট্যাগ কেনে না। তাদের সামান্য টাকা আয়, কোনোভাবে সেই পয়সায় মানিব্যাগ কেনার মানসিকতা বা প্রয়োজনীয়তাও থাকে না।
নেবো।

ইতোমধ্যে ব্যাগঅলার সামনে দামি প্যান্টশার্ট পরা একজন ভদ্রলোক এসেছে। সঙ্গে তন্বী তরুণী। তাদের আসায় চারপাশের আবহাওয়ায় বিদেশী সেন্টের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। ভদ্রলোকের কাছে রজব আলী অযাচিতভাবে হেরে যায়। বাস্তবতার কারণে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াতে হয় তাকে।

তন্বী তরুণী ও ভদ্রলোক মিলে কয়েকটা মানিব্যাগ দেখে। বাছাই করে। অবশেষে তন্বীয় কথানুযায়ী ভদ্রলোক তিনশো পঁচিশ টাকায় একটা মানিব্যাগ নিয়ে চলে গেলো। মাত্র তিন-চার মিনিটের মধ্যে তারা মানিব্যাগ দেখলো, দাম করলো, কিনলো এবং চলেও গেলো। অথচ রজব আলী বিশ-পঁচিশ মিনিচের মধ্যে মধ্যে দামটাও জানতে পারলো না ! তারা চলে যাওয়ার পর রজব আলী ব্যাগঅলার কাছে যায়।

বললেন না কতো দাম ?

রজব আলীর দিকে আড়চোখে তাকায়, মানিব্যাগ আপনার পছন্দ হয়েছে?

পছন্দ না হলে দাম জিজ্ঞেস করবো কেনো ?

একশো আশি টাকা।

একশো আশি টাকা। রজব আলী মুখ থেকে বিপন্ন শব্দগুলো বের হয়।

বিরক্তি প্রকাশ করে ব্যাগঅলা, অবাক হওয়ার কি আছে? আপনার সামনেই তো দেখলেন তিনশো পঁচিশ টাকায় একটা মানিব্যাগ বিক্রি করেছি। ঠিক আছে আপনি ঐ সোয়াশ টাকাই দেন।
সোয়াশ টাকা একটা মানিব্যাগের দাম ! রজব আলীর বিস্ময় কোনো বাঁধা মানে না।

ব্যাগঅলা বুঝতে পারে রজব আলী এতো টাকায় ব্যাগ কিনবে না। সবাইতো ঐ টাকাঅলা ভদ্রলোক নয়, বেশি দাম-দর না করেই তাদের হাকানো দামেই কিনবে। রজব আলীরা তো মানিব্যাগই কেনে না। সেখানে রজব আলী যে কিনতে এসেছে সেটাই অনেক। ব্যাগঅলা মানিব্যাগ বিক্রি করলেও তার পকেটে মানিব্যাগ থাকে না। নিজের সঙ্গে রজব আলীর সাদৃশ্য দেখতে পায় ব্যাগঅলা। একই কাতারের ঠেলা-গুতা খাওয়া মানুষ তারা। লোকটাকে ঠকিয়ে লাভ নেই। হয়তো অনেক আশা করে সারা জীবনে একবার একটা মানিব্যাগ কিনতে এসেছে।

আপনি সত্যিই কি মানিব্যাগটা কিনবেন ? নরম কণ্ঠে ব্যাগঅলা জানতে চায়।

কিনবো বলেই তো পছন্দ করেছি। দাম জানতে চাইছি।

তাহলে শোনেন ভাই, অনেক্ষণ ধরে আপনি মানিব্যাগটা দেখছেন, ফাইনাল কথা বলে দিচ্ছি, মানিব্যাগটা আপনি আশি টাকায় নিতে পারবেন। আশি টাকার এক টাকা কমেও বিক্রি করবো না।
রজব আলীর এই মুহূর্তে ব্যাগঅলাকে খুব কাছের মানুষ মনে হয়। কোথায় একশো আশি টাকা, সেখান থেকে একশত পঁচিশ এবং সবশেষে পুরো শতকই নেই; কেবল আশি টাকা। সে পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে মানিব্যাগটা পকেটে রাখে। মানিব্যাগটা পকেটে রাখার সঙ্গে সঙ্গে রজব আলী নিজেকে একজন দামি মানুষ ভাবে। তার পকেটেও অনেকের মতো মানিব্যাগ আছে।

দীর্ঘদিনের একটা আকাক্ষা, একটা স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো রজব আলীর। মানিব্যাগ কেনার একটা সিগারেট কেনে। সাধারণত সে সিগারেট টানে না। কিন্তু এই মুহূর্তে একটা সিগারেট টানার ইচ্ছে হলো তার। না, কেবল সিগারেটই নয়, একটা ঝাল দেওয়া পানও কিনলো এবং মুখে দিয়ে পরম আয়াসে চিবুতে লাগলো। সিগারেটটা ধরিয়ে পান চিবুতে চিবুতে রজব আলী একটা রিকশায় উঠলো। পর পর তিনটি কাজ সে করলো-যা সে খুবই কম করে। সিগারেট টানা, পান খাওয়া এবং রিকশায় করে বাসায় ফেরা। তার জীবনেএকটুকুই শ্রেষ্ঠ বিলাসিতা। রিকশা ছুটে চলেছে।

রজব আলীর মাথার কোষে, যেখানে স্বপ্ন বিলাসী বা ইচ্ছের রক্তকণিকা থাকে- সেখানে মানিব্যাগ কেনার শখ জাগলো প্রায় মাস তিনেক আগে। সে, অফিসের বড় সাহেবের ব্যক্তিগত পিওন। চা, চিনি, সিগারেট থেকে শুরু করে যা কিছু দরকার সবই আনে রজব আলী। দীর্ঘদিনের চাকরির কারণে সে বড় সাহেবের খুব বিশ্বস্ত ও অনুরাগী। অফিসে প্রতিদিন অনেক মেহমান আসে।

নানান কিসিমের মানুষের আনাগোনা বড় সাহেবের কাছে। এইসব মেহমান আসলেই বড় সাহেব বেল টিপে রুমের বাইরে হাতলবিহীন চেয়ারে অপেক্ষায় থাকা রজব আলীকে ডাকেন। রজব আলী ত্রস্ত খরগোশের মতো ভেতরে ঢোকে। কিন্তু ঢুকেই খরগোশের মতো মাথা উঁচু রাখতে পারে না। কোথাকার কোন এক অদৃশ্য অপরিমেয় শক্তি এসে তার মাথাটাকে নিচু করে দেয়।

তার দাঁড়ানো পর বড় সাহেব বড় অবহেলায়, নিপুণ নৈপুণ্যে, গাম্ভীর্যের কৌশলী পারম্পর্যে অবলীলায় প্যান্টের ডান দিক থেকে মোগল সম্রাটদের ক্ষমতায় মানিব্যাগটা বের করে টেবিলে রাখেন। মেহমানবৃন্দ গভীর অভিনিবেশে বড় সাহেবের কর্মকান্ড দেখতে থাকেন। মানিব্যাগটা টেবিলে রেখেই বড় সাহেব টেবিলের অন্যপ্রান্তে রাখা দামি সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে পরম আদরে রাখেন এবং তৎক্ষণাৎ লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট টানেন আয়েসের সঙ্গে।

সিগারেটে দু’-দিনটি টান দিয়ে দুই ঠোঁটের মাঝখানে আটকে রেখে মানিব্যাগটা তোলেন ডান হাতে। মানিব্যাগটা টাকার কারণে সবসময় পোয়াতি নারীর মতো ফুলে থাকে। বড় সাহেবের মানিব্যাগে টাকাগুলো অধস্তন, পরাধীনভাবে নিবিড় শুয়ে থাকতে পছন্দ করে। একহাজার, পাঁচশ, একশ, পঞ্চাশ টাকার অসংখ্য নোট সাজানো পাশাপাশি। দেখতে কতো ভালো লাগে ! রজব আলী দেখে। দেখেই তার আনন্দ।

বাম হাতে মানিব্যাগটা ধরে ডান হাতের দুই আঙ্গুলে বড় সাহেব বেশ কয়েকটা নোট বের করেন। একটা নোট রজব আলীর দিকে বাড়িয়ে দেন, শীগগির নাস্তা নিয়ে আয়।

রজব আলী বিনয়ের সঙ্গে টাকাটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। এবং নাস্তার আয়োজনে নিদারুণভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এইভাবেই রুটিন চলছিলো। হঠাৎ মাস তিনেক আগে রজব আলীর মাথায় এই প্রশ্নটা উঁকি দেয়- বড় সাহেবের গাড়ি বাড়ি টাকা মান-সম্মান ক্ষমতা আছে। রজব আলীর কিছুই নেই। কিন্তু একটা মানিব্যাগতো থাকতে পারে। আর যাই হোক বড় সাহেবের মতো মানিব্যাগ থেকে সেও টাকা বের করে বাস কন্ডাকটর, চালের দোকানদার, মাছঅলা, ডালঅলাদের দিতে পারবে।

এই ভাবনা, স্বপ্ন এবং কল্পনার পথ ধরে কয়েকমাস যাবৎ রজব আলী চেষ্টা করে আসছে একটা মানিব্যাগ কেনার। নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। বৌয়ের শরীর খারাপ- ডাক্তারের টাকা দেওয়া, ছেলেমেয়েদের স্কুলের বেতন, বই খাতা কেনা- যাবতীয় সাংসারিক কাজের চাপে মানিব্যাগ কেনা সম্ভব হয়নি। আজকে সে বেতন পেয়েছে। এবং সমস্ত চাপ উপেক্ষা করে রজব আলী মানিব্যাগটা কিনেই ফেললো। আসলে কখনো কখনো একটু-আধটু রিস্ক নিতেই হয়। নইলে ছোটখাট স্বাদ-আহ্লাদ পূরণ হবার নয়।

রিকশায় বসেই সে জামার বুক পকেট থেকে বেতনের বাকি টাকাগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে মানিব্যাগে। মানিব্যাগটার পেট ফুলে যায়। হাতে নিয়ে তার দারুণ ভালো লাগে। কিছুক্ষণ হাতে রাখার পর রজব আলী মানিব্যাগটাকে পিছনে প্যান্টের পকেটে রাখে। ঘাড় ঘুরিয়ে সে প্যান্টের পিছন দিকটা ফিরে ফিরে দ্যাখে- কতোটা ফুলে উঠলো ? তেমন না। যেভাবে বড় সাহেবের পিছন দিকটা ফুলে থাকে, সে রকম নয়। রজব আলীর মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

রিকশা বাসার কাছে আসলে সে ভাড়া মিটিয়ে নেমে যায়। তার মনের মধ্যে ছোট সুখের একটা ছোট পাখি ডানা মেলেছে। গানের সুর ভাজতে ভাজতে রজব আলী দেড় কামরার স্যাঁতস্যাঁতে বাসায় ঢোকে। সে ঢুকলো সংসারে, তাতে সংসারের কিছু যায় আসে না। সংসারটা তার কাছে সীমাহীন অন্ধগলির মোড়। যেখানে অভাব দারিদ্র ক্ষুধার চাহিদা কুমিরের হা মেলে থাকে, সেখানে তার মতো একজন রজব আলীর আসা না আসায় কিছুই যায় আসে না। রজব আলী স্ত্রী মকবুলা বেগম চতুর্থ সন্তান, যার বয়স মাত্র তিনমাস তাকে মাই খাওয়াচ্ছে।

অন্যান্যরা মেঝেতে জটলা পাকাচ্ছে একটা পুরোনো ক্যারামের গুটি নিয়ে। মকুবলা বেগম ঘাড় ফিরিয়ে রজব আলীকে একবার দেখে আবার মাই দিতে থাকে। রজব আলী কি করবে ভেবে পায় না। সাধারণত বেতন নিয়ে বাসায় ফিরলে তরিতরকারি, চাল, ডাল, লবণ, তেল, সাবান, দুই এক প্যাকেট সস্তা বিস্কুট সঙ্গে নিয়ে আসে রজব আলী। আজকে একবারে অন্যরকম একটা জিনিস এসেছে- যার প্রতি তার নিজের মমতা অনেক। সংসারে অন্যদের প্রতিক্রিয়া কি হবে বুঝতে পারছে না।

শুনছো ? রজব আলী স্ত্রীকে ডাকছে।

কনিষ্ঠতম সন্তানের মুখ থেকে মাই সরাতে সরাতে সাড়া দেয় মকবুলা বেগম, কি ?

একটা জিনিস এনেছি।

মকবুলা বেগম সরাসরি তাকায় রজব আলীর দিকে, কি এনেছো ?

অদ্ভুত একটা হাসি রজব আলীল ঠোঁটে, একটা মানিব্যাগ।

দ্রুত ব্যাগটা বের করে মকবুলা বেগমের হাতে দেয় রজব আলী। ব্যাগটা হাতে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত স্থানুর মতো বসে থাকে মকবুলা বেগম। একবার কোটরের চোখ দিয়ে তাকায় রজব আলীর দিকে। দৃষ্টি ফিরিয়েই ব্যাগটা অবহেলায় রেখে দেয় সে, মানিব্যাগ ফুটাতে কে বলেছে তোমাকে! বেতন পেয়েছো আজ না ?

বেতন পেলে আর মাথা ঠিক থাকে না। মকবুলা বেগমের লং প্লে রেকর্ড বাজা আরম্ভ হলো, বাসায় কিছু নাই। অফিসে যাবার সময় বললাম, ফিরে আসার সময় ছোট বাচ্চাটার জন্য এক কৌটা দুধ এনো। বড় ছেলেটার খাতা পেন্সিল নেই- নিয়ে এসো। তার কোনো খবর নেই। উনি নিয়ে এলেন মানিব্যাগ। ছেলেমেয়ে বৌয়ের মুখে তিন বেলা ভাত জোটাতে পারে না, উনি মানিব্যাগ কিনে ভদ্দরলোক হয়েছেন! কানার আবার স্বপ্ন দেখার শখ!

রজব আলীর মন শরীর স্বপ্ন আকাক্ষাগুলো শাঁখের করাতে কাটছে এখন। হায়, সংসারের জন্য ব্যক্তিগত দুই-একটা স্বপ্নও কি পূরণ করা যাবে না ! সকাল থেকে রাত পর্যন্ততো সংসারের সুখের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। সামান্য একটা মানিব্যাগের জন্য স্ত্রী এমনভাবে শ্লেষের কথা বলে-একেক সময় মনে হয় রজব আলী আত্মহত্যা করে। পারে না।

স্ত্রীর শান দেওয়া কথার বান থেকে আপাতত রক্ষা পাবার জন্য না খেয়ে বাইরে চলে আসে রজব আলী। এভাবেই সে অক্ষমতার জ্বালা, বেদনা ও ক্ষরণকে তাড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে। রাস্তায় দোকানে এখানে সেখানে ঘন্টাখানেক ঘোরাঘুরি করে আবার মকবুলা বেগমের সংসারেই ফিরে আসে। পরের দিন রজব আলী যথারীতি অফিসে।

অফিসের লোকজনের কাছে মানিব্যাগটা দেখায়। কেউ দেখে, কেউ আগ্রহবোধ করে না।

বল তো বারেক, অফিসের আরেকজন পিওনকে ডেকে জিজ্ঞেস করে রজব আলী- মানিব্যাগটা কেমন হয়েছে ?

বারেক মানিব্যাগটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে- ভালো। খুব ভালো হয়েছে। কতো টাকায় কিনেছো ?
প্রচ্ছন্ন গর্ব রজব আলীর, তুই বল।

আমি কেমনে বলবো ?
অনুমানে।
বারেক কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলে, ত্রিশ-চল্লিশ টাকা।

তোর বাপের মাথা! ধমকে ওঠে রজব আলী। এ রকম একটা মানিব্যাগ জীবনে চোখে দেখেছিস ? কেমন রং এটার ! ভেতরে কতোগুলো ঘর আছে জানিস ! একহাজার, পাঁচশ, একশো, পঞ্চাশ টাকার নোট রাখার আলাদা আলাদা জায়গা আছে। তাছাড়া এই ব্যাগটা বিদেশী। দেশী না।

তোমার মানিব্যাগের যতো দামই থাক, তুমি বাপ তুলে কথা বলবে ? বারেকের আত্মসম্মানে সামান্য ঘা লাগে।

বলবো না, হাজার বার বলবো। এতো শখ করে একশ টাকা দিয়ে একটা মানিব্যাগ কিনলাম। আর তুই কিনা বলিস মাত্র ত্রিশ-চল্লিশ টাকায় কিনেছি ! জানিস, এই রকম মানিব্যাগ আছে আমাদের বড় সাহেবের।

হতেই পারে। আমার তো মানিব্যাগ নেই। কখনো ছিলোও না। তাই দাম জানি না। কিন্ত তুমি একটা একশো টাকা মানিব্যাগে জন্য বাবা তুলে কথা বলতে পারো না-

বারেক যখন মানিব্যাগ সংক্রান্ত তর্কে হেরে যাচ্ছিলো, তখনই বড় সাহেব অফিসে ঢোকেন সঙ্গে কয়েকজন বন্ধু মেহমান নিয়ে। বারেক চট্ করে সরে যায়। রজব আলী দ্রুত দরজা খুলে দাঁড়ায়। বড় সাহেব সঙ্গীদের নিয়ে রুমে ঢোকেন। রজব আলীকে চা আনতে বলেন বড় সাহেব। শুরু হয় রজব আলীর দৌড়।

কয়েকদিন পর বড় সাহেব অফিসে কয়েকজন ক্লায়েন্টের সামনে বসে রজব আলীকে ডাকেন, রজব আলী?

জ্বী স্যার ?
তোমার হয়েছে কি ?

রজব আলী ভেবে পায় না তার কোথায় কখন কি হয়েছে ? ডানে বামে উপরে নিচে তাকায় সে, কই স্যার-কিছু হয় নাইতো।
তোমার হাতে মানিব্যাগ কেনো ?

এই কথার কি জবাব দেবে রজব আলী? হঠাৎ মগজের কোষ কোনো কাজ করে না। সে বুঝে উঠতে পারে না- তার হাতে মানিব্যাগ থাকলে বড় সাহেবের অসুবিধা কি ? কক্ষের সবাই রজব আলীর দিকে চেয়ে আছে। এক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। হঠাৎ রজব আলী উপলব্ধি করতে পারে- মানিব্যাগটা থাকার কথা প্যান্টের পকেটে। হাতে নয়। এবং তার আরো মনে পড়লো মানিব্যাগটা কেনার পর থেকে, বিশেষ করে অফিস করার সময় মানিব্যাগটা কারণে-অকারণে তার হাতেই থাকে। কেন থাকে ?

সে কি সবাইকে তার সদ্য কেনা মানিব্যাগটি দেখিয়ে তৃপ্তি পেতে চায় ? যা প্রকারান্তরে অক্ষম অথর্ব মানুষের করুণ মনোবিকৃতি ? নিশ্চয়ই তার অবস্থা দেখে বড় সাহেব, তার পরিষদবর্গ, অফিসের লোকজন হাসছে। রজব আলী নিমিষে নিজেকে বায়ুশূন্য ফাটা একটা পরিত্যাক্ত বেলুন হিসাবে নিজেকে আবিষ্কার করে। লজ্জায় বালুর সঙ্গে সে মিশে যেতে চাইছে। কিন্তু মানুষের পক্ষে মুশকিল হচ্ছে- সে ইচ্ছে করলেই বালু বা বায়ুর সঙ্গে মিশে যেতে পারে না। মানুষ হিসাবে তাকে অনড় ও অবিচল থাকতে হয়।

বড় সাহেবের মুখে অদ্ভুত হাসি- রজব ?

জ্বী স্যার ?
মানিব্যাগটা কবে কিনেছো ?

রজব আলী জবাব দেয় না। দিতে পারে না। ভেতরের কে একজন যেন রজব আলীকে থামিয়ে দিয়েছে। যে রজব আলীর ওষ্ঠ জিহ্বা কণ্ঠ ভেতরের ক্ষুধিত শক্তিকে পাথর বানিয়ে জমাট করে রেখেছে। প্রাণপণে চেষ্টা করছে কথা বলতে। পারছে না। সে মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে। কথা বলছো না কেন ? বড় সাহেবের কণ্ঠে এখন কর্তৃত্ব ও অপমানের সুর।

ঢোক গিলে জবাব দেয় রজব আলী- কয়েক দিন আগে।

কতো টাকায় ?

একশ টাকা।

তাই নাকি ! দেখি, বড় সাহেব হাত বাড়ান।

রজব আলী সারা জীবনের সমস্ত অভিশাপ নিজের মাথায় ঢালে-কেন সে মানিব্যাগ কিনতে গেলো ? কিনলোই যদি তাহলে পকেটে না রেখে হাতে রাখার প্রয়োজন হলো কেন ? দেখাতে চেয়েছিলো বড় সাহেবকে ? বড় সাহেবের মানিব্যাগ থাকলে পারলে তার থাকবে না কেন ? প্রতিযোগিতা ? কি অসম প্রতিযোগিতা ? কি ভয়ংকর গ্লানিকর পরাজয় !

কই দাও, বড় সাহেবের হাতটা তখনো বাড়ানো। নিন।

রজব আলী ব্যাগটা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়।

কোথায় যাও? তোমার মানিব্যাগ নিয়ে যাও-

আর যেতে পারে না সে কক্ষের বাইরে। কক্ষের ভিতরে রজব আলীর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বড় সাহেব মানিব্যাগটাকে উল্টেপাল্টে দেখেন। কক্ষের অন্যান্য সবাই বড় সাহেবের হাতের ব্যাগটাকে তীর্যক চোখে দেখছে। কেউ কেউ হাসছে। সে হাসির ভেতরে লুকিয়ে আছে তীক্ষ্ন কাঁটা। কাঁটায় বিষ। যা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পান করছে রজব আলী। এছাড়া তার উপায়ও নেই।

রজব আলী !

বড় সাহেবের ডাকে চোখ তুলে তাকায় সে, স্যার!

নাও তোমার মানিব্যাগ। ব্যাগটা ভালোই কিনেছো।

হাত বাড়িয়ে ব্যাগটি নিয়ে রজব আলী দরজা খুলে নিমিষে বাইরে চলে আসে। দরজা দ্বিতীয়বার বন্ধ করতে পারে না, তার আগেই বড় সাহেব এবং অন্যান্যদের হাসির ছুরি তীব্র অপমানে রজব আলীর কান এবং মর্মের মূলে আঘাত হানে। মনে হচ্ছে তাদের হাসির হলকা তাকে শান দেয়া ছুরির মতো কাটছে। আর রজব আলী নিজের রক্তে ভেসে যাচ্ছে।

রজব আলী মানিব্যাগ আর হাতে রাখে না। প্যান্টের পকেটেই রাখে। মাস শেষে মানিব্যাগের ছোট্ট খোপে খুচরো কয়েকটা মাত্র টাকা দেখতে পায় রজব আলী। মানিব্যাগে টাকা নেই, একটা পরিত্যাক্ত রুমালের মতো মনে হয় মানিব্যাগটাকে। এবং রজব আলী বুঝতে পারে- বড় সাহেবের মতো মানুষদের সঙ্গে রজব আলীরা কোনদিন, কোনোকালে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারবে না।

মাস শেষ, রজব আলীর মানিব্যাগের টাকাও শেষ। অথচ বড় সাহেবের মানিব্যাগে মাসের প্রথম দিকে যতো টাকা ছিলো বা থাকে, এখনো সে রকমই আছে। কমে না। বরং বাড়ে। তাহাদের টাকা বাড়তেই থাকে। বাড়বে আমৃতকাল।

দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে রজব আলী।

দীর্ঘনিঃশ্বাস এবং পুঞ্জিভূত ক্ষোভ নিয়ে নিত্যদিনের স্বাভাবিক জীবনযাপন চালিয়ে যাচ্ছে রজব আলী। প্রতিদিনের জীবনাচারের সঙ্গে রজব আলী বেশ মানিয়ে নিয়েছে। মানিব্যাগটা তার সঙ্গে থাকছে প্রতিদিনকার মতো- যেমন তার পকেটে থাকছে একটি রুমাল, একটি চিরুনি।

মাসের প্রথম দিকে মানিব্যাগটা ভরা থাকে, মাঝখানের দিকে কমতে কমতে টাকা অর্ধেকেরও কমে এসে পৌঁছে এবং এই কমার গতিটা বলবৎ থাকে গাণিতিক হারে।

মাসের শেষের দিকে রজব আলী মানিব্যাগ বহন করার আর কোন যুক্তি খুঁজে পায় না। কারণ ব্যাগের তলায় পাঁচ-দশটা টাকা পড়ে থাকে বড় অযত্নে, বড় অবহেলায়। কখনো কখনো রজব আলীর মনে হয়- মানিব্যাগটা বোধহয় তাকেই উপহাস করছে। মাস খানেক পরে একদিন।

রজব আলী অফিস থেকে ফিরছে। মাস শেষের দিকে। বাসে প্রচুর ভিড়। বাসে ওঠা মানে জন্তুর খাঁচায় ওঠা। জীবন যে কতো অবাঞ্ছিত, বাসে উঠেই সেটা বুঝতে পারে রজব আলী।

বাস থেকে নেমেই হাত দেয় প্যান্টের পকেটে। পকেটটা খালি, বুকটা ধড়াস ধড়াস করে, মানিব্যাগটা নেই ! এতো সাবধানে থাকার পরও মানিব্যাগটা নিয়ে গেলো?

রজব আলী কয়েক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। মানিব্যাগটা পকেটমার নিয়ে গ্যাছে। রজব আলী মানিব্যাগটার জন্য ভাবছে না। ভাবছে মানিব্যাগের সর্বশেষ পুরোনো ময়লা দশটি টাকা...। ওই দশ টাকা থাকলে আরো দুই দিন বাস ভাড়া দিয়ে অফিসে আসা-যাওয়া করতে পারতাম।

;