সাভানায় শরণার্থীদের করোনাক্রান্ত ঈদ



মঈনুস সুলতান
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

ঈদ উপলক্ষে পারিবারিক পরিসরে আমি রান্নাবান্না করছি প্রায় দুই যুগের মতো, কিন্তু এ শিল্পে আমার কামিয়াবি হাসিল হয়েছে স্বল্প, খাবার পরিবেশন করতে গিয়ে বিব্রত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে প্রচুর। হাল ছাড়িনি, কিন্তু আজ ভোরবিহানে সেমাই রান্না করতে গিয়ে যে হালত হয়েছে, তাকে সফলতা বলার কোনো কায়দা নেই। আজকের এ করোনাক্রান্ত ঈদে আমি সাভানা শহরের আরো দুয়েকজন সমমনা মানুষের সঙ্গে মিলেঝুলে—পৃথিবীর হরেক দেশ থেকে নানাবিধ যুদ্ধ কিংবা সামাজিক সংঘাতে বাস্তুচ্যুত হয়ে এখানে এসে রিসেটেল্ড হওয়া কয়েকটি রেফিউজি পরিবারকে খাবার পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। আমার স্পেসিফিক দায়িত্ব হচ্ছে ফিস কাবাব ও সেমাই প্রস্তুত করা। টুনা মাছের কাবাবগুলো আকৃতিতে বটবৃক্ষের ঝরা-পাতার মতো দেখালেও তা স্বাদে হয়েছে উমদা। এ নিয়ে হীনমন্যতার কোনো কারণ নেই, তবে বিপত্তি ঘটেছে সেমাইকে জর্দায় রূপান্তরিত করতে গিয়ে। তা চটকে হান্ডির তলায় এমন চেরা-চ্যাপ্টা লেগে সেঁটে আছে যে, চিমটা দিয়ে টেনেও তা বর্তনে উপস্থাপন করার কোনো কুদরত থাকেনি। বিপদগ্রস্ত হয়ে টেলিফোনে কন্যা কাজরিকে মুশকিল আসান করতে এত্তেলা দিই। পরিস্থিতি যে কতটা খতরনাক—তা বোঝানোর জন্য টেক্সট্ ম্যাসেজের সাথে যুক্ত করি, হান্ডির তলদেশের ফটোগ্রাফ। মেয়ে আমোদ পেয়ে জবাবে জানায়—জকড়িমকড়ি লাগা সেমাইগুলোকে দেখাচ্ছে আরবি হরফে ক্যালিওগ্রাফি করে লেখা ঈদ মোবারকের মতো। আমি বিলা হয়ে সেলফোন সরিয়ে রাখি।

যুক্তরাষ্ট্রে ভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যুর হার লাখের দিকে আগাচ্ছে। বিষয়টিকে আমলে না এনে মূলত রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের সক্রিয় উৎসাহে হরেক রাজ্যের গভর্নররা লকডাউন তুলে নিয়েছেন। আমাদের রাজ্য জর্জিয়ার গভর্নর আরেক কাঠি সরস, তিনি মৃত্যুর হারকে ডেটা মেনিপুলেশনের মারপ্যাঁচে কম করে দেখিয়ে চেষ্টা করছেন—মুভি থিয়েটার, স্টেডিয়াম, সমুদ্রসৈকত ও স্কুলগুলো খুলে দিতে। দোকানপাট বেশ কিছু খুলে গেছে বটে, তবে আমার মতো যে সব নাগরিক—হয় বয়সের ভারে পরিশ্রান্ত অথবা নানাবিধ রোগেশোকে আক্রান্ত, স্বাস্থ্য বিভাগের তরফ থেকে তাদের গ্রোসারি শপ ইত্যাদিতে যেতে জোরেশোরে নিষেধ করা হচ্ছে। তো এ পরিস্থিতিতে চাইলেই আমি কোনো দোকানে গিয়ে সেমাইয়ের বিকল্প অন্য কোনো মিষ্টান্ন কিনে আনতে পারি না। কাজরি পরবর্তী টেক্সটে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়। আমি অপেক্ষা করি, দেখা যাক কী হয়...।

ড্রাইভওয়েতে এসে থামে ফেডএক্স-এর মালামাল সরবরাহ করা গাড়ি। মাস্ক পরা ড্রাইভার একটি গিফট প্যাকেট সিঁড়িতে রেখে ফিরে যান। বুঝতে পারি, কাজরির কাছ থেকে এসেছে ঈদের উপহার। অ্যালকোহল রাব দিয়ে ঘঁষামাজা করে সাবধানে বাক্সটি খুলি। বেরিয়ে আসে গোলাপজলের সুন্দর একটি শিশি। চটজলদি তা সাবানজলে চুবিয়ে গামছা দিয়ে মুছে-টুছে অপেন করি। পুরো আঙিনা ভরে ওঠে পুষ্পের চনমনে খোশবুতে। কাজরির কাছ থেকে টেক্সট্ আসে ফের। জানতে পারি, সে জখমি সেমাইয়ের বিকল্প রাইস পুডিং নিয়ে আসছে। আমি জলদি করে খাবারের কৌটা ও তার ঈদোপহারের প্যাকেট ড্রাইভওয়েতে এনে রাখি। আমাদের মেয়ে কাছেই বসবাস করছে, তার কোনো কোনো বান্ধবী করোনার ব্যাপক বিস্তারে এক্সপোজড্ হয়েছে, তাই আমরা আজকাল সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। আমাদের হাটবাজার করতে সে সহায়তা যোগাচ্ছে, তবে দৈহিকভাবে কাছে আসছে না, আমরা বাতচিত করছি কেতাবি কায়দায় ছয় ফুট দূরত্ব বহাল রেখে।

সড়কের পাশে গাড়ি পার্ক করে কাজরি ড্রাইভওয়েতে এনে রাখে রাইস পুডিংয়ের সওদা। ঈদোপহারের প্যাকেট খুলে সাবানজলে ভিজে নেতানো ফ্লোরাল হেয়ার ক্লিপের দিকে নজর দিয়ে সে চোখ কুঁচকে তাকায়। আমি উপহারটি বিশদভাবে ধোয়াপাকলা করে জীবাণুমুক্ত করার জন্য ‘স্যারি’ বলি। ‘নো প্রবলেম, বাপি, ইটস্ আ কুল ঈদ গিফট... ইট উইল ড্রাই সুন..।’ সে খাবারের প্যাকেট হাতে নিয়ে গাড়ির দিকে হেঁটে যেতে যেতে ঘাড় ফিরিয়ে বলে, ‘ঈদ মোবারক।’ আমি মনে মনে হিসাব কষি, আর কতদিন আমাদের পারিবারিক পরিসরে জারি থাকবে সামাজিক দূরত্ব?

বেলা পনে-এগারটা হতে চলল, মিসেস নিয়ামা ইবরিম এখনো এসে পৌঁছেননি, তাঁর দশটা পনেরতে এসে পৌঁছার কথা, তাই বিরক্ত লাগে। ওয়েস্ট আফ্রিকার ঘানা থেকে অনেক বছর আগে অভিবাসী হয়ে এসে এদেশে সেটেল্ড হওয়া মিসেস ইবরিম হাইস্কুলের ক্যাফেটেরিয়াতে কুক হিসাবে কাজ করেন। পার্টি-পর্বে তিনি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে প্রস্তুত করে দেন আফ্রিকান ডিশ। রান্নার হাতটি তাঁর চমৎকার, তবে সময় মতো কোথাও এসে পৌঁছানোর স্বভাবটি এখনো আয়ত্ত করে উঠতে পারেননি। আজকের ঈদ-খাবারের আয়োজনে তিনি ওয়েস্ট আফ্রিকান কেতার জলোপ রাইস রান্না করে নিয়ে আসছেন। তিনি এসে না পৌঁছানো অব্দি কিছু করা যাবে না।

আমি ড্রাইভওয়েতে আগুপিছু পায়চারি করতে করতে মিসেস নিয়ামা ইবরিমের বিষয়টা নিয়ে ভাবি। সাভানা শহরকে বিষয়বস্তু করে কিছু একটা লেখার প্রয়াশে আমি মাস কয়েক আগে তাঁকে অনানুষ্ঠানিকভাবে ইন্টারভিউ করি। তাঁর জীবনের কিছু ঘটনা নোটবুকে ইন ডিটেইলস্ টুকে রেখেছিলাম। আমার স্টাডিতে খুঁজলে হয়তো খাতাটি পাওয়া যাবে। বাগিচার বড়সড় গাছটিতে ফুটেছে গোলাপি বর্ণের অজস্র পাউডার পাফ ফুল। একটি মকিং বার্ড পাতায় ডানা ঘষে সুরেলা কণ্ঠে ছড়াচ্ছে সুইট টিউন। নোটবুকে টুকে রাখা কিছু কিছু তথ্য ফিরে আসে আমার করোটিতে। সেপ্টেম্বর এলেভেনের ঘটনাটি ঘটার মাস খানেক আগে নববধূ হিসাবে সাভানা শহরে এসেছিলেন মিসেস ইবরিম। তাঁর স্বামী ডক্টর আবদু ইবরিম জর্জিয়া সাদার্ন ইউনিভারসিটিতে পোস্ট ডক্টরেল ফেলো হিসাবে কাজ করছিলেন। বিয়ের পর ভিসার প্রতীক্ষায় প্রায় তিন বছর নিয়ামা ইবরিম বাস করেছিলেন ঘানার রাজধানী আক্রায় তাঁর পিতা-মাতার বসতবাড়িতে। এখানে এসেই হাল ধরেছিলেন সংসারের। ঈদের পর দিন ছিল তাঁদের বিবাহবার্ষিকী।

ততদিনে যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে গেছে সেপ্টেম্বর এলেভেনের ট্র্যাজিডি। এর প্রতিক্রিয়ায় কোনো কোনো জায়গায় ভিন্ন গাত্রবর্ণের আমেরিকান মুসলমানদের হেরাস করার বিচ্ছিন্ন কিছু ব্যাপার ঘটতে শুরু হয়েছে। ঈদের আগে চানরাতে সাভানার শহরের ইসলামিক সেন্টার নামক ছোট্ট মসজিদটিকে কে বা কারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। তো স্ত্রী নিয়ামাকে ঘরে একা রেখে ডক্টর ইবরিম মসজিদ প্রাঙ্গণে গিয়ে অন্যান্য মুসলমানদের সাথে হাত লাগান জ্বলাপোড়া ছাই ইত্যাদি পয়পরিষ্কারের কাজে। ড্রাইভওয়েতে খাটানো হয় চাঁদোয়া, তার তলায় বিছানার চাদর বিছিয়ে অন্যান্যদের সঙ্গে ডক্টর ইবরিম পুলিশ প্রহরায় আদায় করেন ঈদের নামাজ। তারপর তিনি ঘরে না ফিরে ঈদের বাহারে ধড়াচূড়া ও টুপি পরে চলে যান শৌখিন শপিং সেন্টারে। ওখানে বিবাহবার্ষিকীর রাতে নববধূর জন্য একটি ব্যক্তিগত উপহার কিনে নিয়ে হেঁটে হেঁটে চেষ্টা করছিলেন ট্যাক্সি পাওয়ার। ছুটন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে ফায়ার করা গুলির আঘাতে তিনি নিহত হন।

মিসেস নিয়ামা ইবরিমের গাড়ি ঠিক এগারটা বাইশে এসে ড্রাইভওয়েতে থামে। ফুলের মোটিফ আঁকা বাহারে হেজাব পরে এসেছেন তিনি। নিজেই টেনে নামান কার্ডবোর্ডের ভারী বাক্সটি। আমাকে ঈদ মোবারক বলে হাতের ইশারায় ব্যাকসিটে রাখা গান ভায়োলেন্স বিরোধী প্লেকার্ডটি দেখিয়ে ড্রাইভিং সিটে ফিরে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেন। আমি তাঁর অপস্রিয়মাণ টেইল লাইটের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। তাঁর দিনযাপন সম্পর্কে আমি তেমন কিছু জানি না। এক যুগের নববধূটি হালফিল প্রৌঢ়ত্ব অতিক্রম করে পড়েছেন বয়সের ভাটিতে। ঘানায় আর ফিরে যাননি নিয়ামা, সাভানাতেই থিতু হয়েছেন। কোনো পুরুষ পার্টনার জুটেছে কী—না জেনে বলা মুশকিল। তবে বিদেশ বিভূঁইয়ে নিহত ডক্টর ইবরিমের স্মৃতিকে তিনি জিইয়ে রেখেছেন। প্রতি ঈদে মৃত স্বামীর প্রিয় খাবার—টমেটো সচে সব্জি মেশানো জলোফ রাইস প্রচুর পরিমাণে রান্না করে মসজিদে এনে বিতরণ করেন মুসল্লিদের মধ্যে। তারপর ডক্টর ইবরিমের গুলিবিদ্ধ ফটোগ্রাফ সাঁটা একটি প্লেকার্ড নিয়ে গিয়ে দাঁড়ান বন্দুকের দোকানের সামনে, নীরবে প্রতিবাদ করেন, নিরপরাধ মানুষকে অস্ত্রাঘাতে হত্যা করার বিরুদ্ধে। সাভানা শহরে সয়ংক্রিয় অস্ত্র বিক্রি হয় প্রচুর। গান ভায়োলেন্সে প্রতিবছর মৃত্যু হয় অনেক মানুষের। মাঝেসাজে এখানে আয়োজিত হয় বন্দুক সংক্রান্ত ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, এ সব অ্যাক্টিভিটির পয়লা কাতারে প্লেকার্ড হাতে দেখা যায় বিধবা নিয়ামা ইবরিমকে।

সাভানা শহরটি সরকারি উদ্যোগে খুলে দেওয়ার তোড়জোড় চলছে, কিন্তু মুসল্লিদের ব্যাপক অংশ বয়স্ক বিধায় মসজিদে এবার ঈদের জামাত হয়নি। তাই ডক্টর ইবরিমের ইয়াদগারিতে প্রস্তুত জলোফ রাইস নাইমা রেফিউজিদের সেবার জন্য ডোনেট করে দিলেন। ক্যাটারিং সার্ভিসে কাজ করা মহিলা ইনি, স্টাইরোফোমের বক্সে জলোপ রাইস এর সঙ্গে প্লাস্টিকের চামচ, কাঁটা ও ন্যাপকিন দিয়ে সমস্ত কিছু পেশাদারি যত্নে পুরে দিয়েছেন পলিথিনের আলাদা আলাদা ব্যাগে। আমি গ্লাভস্ পরে তাতে ফিস কাবাব ও রাইস পুডিং রাখতে যাই। খাবার বিতরণে দেরি হয়ে যাচ্ছে, বড্ড অস্থির লাগে। জোসেফ মরগ্যানকে রিং করবো কিনা—ভাবি। সুহৃদ মরগ্যান আমাকে লিফট দিয়ে খাবার বিতরণে সহায়তা করার কথা দিয়েছেন। তিনি এখনো এসে পৌঁছাননি কেন? বেজায় টেনশন লাগে। আমার কব্জিতে ইনজুরির জন্য আমি ড্রাইভ করতে পারছি না। নিয়মিত পেইন কিলার নিতে হচ্ছে। প্বার্শ-প্রতিক্রিয়ায় আমার মধ্যে ধৈর্যটা কমে গেছে, সাথে সাথে বেড়েছে টেলিফোনে বেফজুল কথাবার্তা বলার প্রবণতা।

সারোকিন সেকেজির কাছ থেকে টেক্সট্ আসে। ইরানের নারী সারোকিন মরগ্যান সাহেবের সংসার করছেন অনেক দিন ধরে। বছর তিনেক হলো এ বয়স্ক নারী মারাত্মক রকমের বাত ও অন্যান্য ব্যাধিতে পঙ্গু প্রায়। চলাফেরা করেন চাকাওয়ালা ওয়াকার ঠেলে ঠেলে, তবে এখনো প্রতি ঈদে খরিদ করেন কয়েক জোড়া হাইহিল স্যান্ডেল। তাঁদের ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের বাড়ির একটি স্বতন্ত্র কামরা জুড়ে রাখা আছে শতাধিক হাইহিলের কালেকশন। টেক্সটে সারোকিন আমাকে টেলিফোন করার পার্মিশন চেয়েছেন। এ মহিলার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হলে ইনি অনুমতি ছাড়াই আমার ডান হাতে চুমো খেয়ে খোশআমদেদ জানান। তো এ মুহূর্তে রিং করার জন্য এত আদব-কায়দা করছেন কেন? তাঁর অনুরাগ-ঋদ্ধ স্বামী মরগ্যান সাহেবের তো আমার বাড়িতে এসে পৌঁছানোর কথা? তিনি আসেননি কেন? মেজাজ খাট্টা হয়ে ওঠে।

রোদের তাপ বাড়ছে, আমি বাগানের ছাতাটি খুলে দিয়ে তার নিচে গিয়ে বসি। মরগ্যান সাহেবের প্রচুর বয়স হলেও তিনি শারীরিকভাবে সক্ষম আছেন। আমাদের ত্রাণ তৎপরতায় তিনি সাহায্য করছেন বিগতভাবে। পেশায় মানুষটি প্রকৌশলী, আর্লি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে কয়েক বছর কন্সট্রাকশন ওয়ার্কের কন্টাকটারিও করেছেন। রেজা শাহ পাহলবির রাজত্বের শেষ দিকে ইনি ইরানে যান নগর নির্মাণে সহায়তা করতে। তখন বিবাহিত হয়েছিলেন সারোকিনের সঙ্গে। ফার্সি বলেন ভালোই। ধর্মে মুসলমান নন, তবে কলেমা জানেন, হাফিজ ও শেখ সাদির কিছু গজল ও কসিদা মুখস্থ করে রেখেছেন। মরগ্যান সাহেবের বিত্ত প্রচুর, পার্সিয়ান গালিচা সংগ্রহ করে চিত্ত বিনোদন করে থাকেন। তাঁর বসতবাড়ির ড্রয়িংরুমটিকে কার্পেটের দোকানের মতো দেখায়।

আমার বিরক্তি বাড়ে। টেক্সটের জবাব না দিয়ে সারোকিনকে সরাসরি রিং করি। তিনি প্রচুর সময় নিয়ে আমাকে ঈদ মোবারক জানিয়ে বলেন, কাজরির জন্য নিজ হাতে তৈরি করেছেন পার্সিয়ান রাইস ও শিসকাবাব প্রভৃতি। মহিলা কেবলই কথা বলছেন, থামেন না, ঠিক বুঝতে পারি না, তাঁর স্বামী মরগ্যান কোথায় গুম হলেন? গরমের মৌসুমে ঈদ হলে কী ধরনের আতর ইস্তেমাল করতে হয়—তার বিশদ বর্ণনা দিয়ে অতঃপর সারোকিন জানান, স্বামীকে তিনি একটু আগে পাঠিয়েছেন শপিং মলে খেলনা কিনতে। গেল রাতে মরগ্যান টেলিফোনে জানতে চেয়েছিলেন রেফিউজিদের নির্দ্দিষ্ট কোনো চাহিদা আছে কিনা। আমি জবাব দিয়েছিলাম, পাঁচটি পরিবারে আছে ছোট ছোট শিশু। আমরা সপ্তাহ খানেক আগে তাদের অ্যাপার্টমেন্টে ফুড ব্যাংক থেকে জোগাড় করা খাবার-দাবার পৌঁছে দিয়েছি বটে, কিন্তু ঈদে শিশুদের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা করতে পারিনি। মরগ্যানের সেলফোনে চার্জ ছিল না, তাই তাঁর হয়ে সারোকিন অ্যাপোলজি চান। বুঝতে পারি শিশুদের জন্য কিছু কেনা যায়নি—এ তথ্যের প্রতিক্রিয়ায় সারোকিন মরগ্যানকে শপিংমলে পাঠিয়েছেন খেলনা কিনতে। বয়সের নিরিখে মরগ্যান সাহেব আমার মতো হাই-রিস্ক ক্যাটাগরিতে পড়েন। খোদা-না-খাস্তা তাঁর কিছু হলে জগত-সংসারে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হব সবচেয়ে বেশি।

আমাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। ড্রাইভওয়েতে এসে থামে মরগ্যানের গাড়ি। কাচের হেড-শিল্ডের সাথে পলিথিনের স্বচ্ছ সুরক্ষা গাউন পরে এসেছেন। সাথে করে খেলনা ছাড়াও তিনি নিয়ে এসেছেন প্রতিটি রেফিউজি পরিবারদের জন্য দুই রকমের কাবাব ও ফলমূলে পূর্ণ আলাদা আলাদা শপিংব্যাগ। কাজরির জন্য পার্সিয়ান রাইসের ডিশের ওপর সেলোফোনে মোড়া ফুলের তোড়াসহ আস্ত একটি বাস্কেট নামিয়ে দিয়ে আমাকে গাড়িতে উঠতে ইশারা দেন। আমরা কথাবার্তা তেমন বলি না, তবে মরগ্যানের অনুরোধে আমি টেলিফোন স্ক্রিনে তাঁর লেখা একটি ফেসবুক পোস্টিং পড়ি।

পোস্টিংয়ে তিনি নগরীর চেনা মুখ—রাজ্যসভার এক আইনপ্রণেতা সম্পর্কে নাম উল্লেখ না করে আলোচনা করেছেন। রিপাবলিকান এ রাজনীতিবিদ করোনা সংক্রমণের প্রথম থেকে তার মিডিয়া চ্যানেলে প্রচার করে আসছেন যে, ভাইরাসের বিস্তৃতি হচ্ছে আদতে বিদেশ থেকে আগত অভিবাসী—বিশেষ করে চীনাদের আমেরিকার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র বিশেষ। তিনি সামাজিক দূরত্ব যে ভ্রান্ত একটি আইডিয়া—তা নিয়ে তৈরি করেছেন প্রচার ভিডিও। সামাজিক দূরত্বের নীতিমালাকে অগ্রাহ্য করে নিজ মালিকানাধীন কন্সট্রাকশন কোম্পানিতে শ্রমিকদের মাস্ক ও ডিসইনফেকশন লোশন ইত্যাদি সরবরাহ না করে কাজে বাধ্য করেছেন। আইনসভায় ইনি কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান-আমেরিকানদের শহরতলীতে ভাইরাস টেস্টিং সেন্টার স্থাপন করার বিরোধিতা করেন। দরিদ্র কর্মচারীদের বেকার ভাতা বাতিলের প্রস্তাবও উত্থাপন করেছেন। আইনপ্রণেতা মরগ্যান সাহেবের প্রতিবেশি হিসাবে একই পাড়ায় বাস করছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সামাজিক দূরত্ব বহাল রেখে তার পরিবারকে আইসোলেশনে নিয়ে রক্ষা করছেন। এক দিকে ভাইরাস টেস্টিংয়ের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিরোধিতা করছেন, অন্য দিকে ইনি তার নিরাপত্তারক্ষী ও ব্যক্তিগত স্টাফদের প্রতি সপ্তাহে টেস্ট করাচ্ছেন। আমি পোস্টিং পড়া শেষ করে চোখ তুলে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাই। ড্রাইভ করতে করতে তিনি মুখোশটি সামান্য নামিয়ে এ আইনপ্রণেতা সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘ফার্সিতে এ ধরনের আচরণকে বলা হয় মুনাফিকি।’ লবজটির সঙ্গে আমি পরিচিত, ফেসবুকে আইনপ্রণেতার নাম উল্লেখ না করে আলোচনা করে ফায়দা কী—ঠিক বুঝতে পারি না। পাশাপাশি বসেও আমরা দুজনে কমবেশি মুখে মাস্ক বজায় রাখছি। এ হালতে গুছিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা মুশকিল। ভাবি পরে একসময় টেলিফোন করে এ ব্যাপারে ফলোআপ করতে হবে।

যাত্রাপথে ট্র্যাফিক নেই একেবারে, তবে আমরা কথাবার্তা বলছি না, তাই দীর্ঘ মনে হয়। আমরা এ মুহূর্তে রওয়ানা হয়েছি সাভানা শহর থেকে খানিকটা দূরে আইল অব হোপ নামে ব্রিজে সংযুক্ত একটি আইল্যান্ডের দিকে। ওখানকার বিশাল একটি ম্যানসনে একাকী বাস করছেন ইরাকের অভিবাসী চিত্রকর আহাদ কালাব। ছবি আঁকার হাত তাঁর দুর্দান্ত। এ দেশে সেটেল্ড হয়ে চিত্রকলা বিক্রি করে দিন গোজরান করছিলেন। সংক্রমণের সংবাদ চাউর হওয়ার সপ্তাহ দিন আগে ইনি অত্যন্ত বিত্তশালী একজন মানুষের বিরাট একটি ম্যানসনের বলরুমে দেয়াল-জোড়া ফ্রেস্কো আঁকার কমিশন পান। বিত্তবান বাস করেন লস এঞ্জেলসে। বছরে একবার ক্রিসমাসের সময় ফিরে এসে বলরুমে আয়োজন করেন নিউইয়ার্স পার্টি। তারপর পুরো বছর ম্যানসনটি খালি পড়ে থাকে। আহাদ কালাবের গাড়ি-টাড়ি নেই। প্রতিদিন সাভানা থেকে আইল অব হোপে গিয়ে ছবি আঁকার কাজ করাটা মুশকিল। তাই তাকে ম্যানসনের বাগিচায় এক কামরায় গেস্ট-কটেজে থাকতে দেওয়া হয়। মাত্র কয়েকদিন কাজ করার পর কালাবের শরীরে ফুটে ওঠে করোনার আলামত। জ্বর, কাশি ও মাথা ধরা। তাঁর হেল্থ ইনস্যুরেন্স নেই, সিম্পটনও মাইল্ড, তাই তিনি গেস্ট-কটেজে নিজেকে আইসোলেটেড করে রাখছেন।

নগরীর এখানে ওখানে আহাদ কালাবের প্রদর্শনী হয়েছে কয়েকবার। তাঁর সঙ্গে একবার অন্তরঙ্গভাবে বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তাও বলেছি। কথা দিয়েছিলাম, তাঁকে নিয়ে লিখব, লিখতেও বসেছিলাম, কিন্তু শেষ করতে পারিনি। ধর্ম বিশ্বাসে কালাব ইয়াজিদি। যতটা জেনেছি, ইয়াজিদি হচ্ছে দজলা-ফোরাত অঞ্চলের অতি প্রাচীন একটি একেশ্বরবাদী ধর্মমত। এদের সাথে কারবালায় নবী (দঃ)-এর দৌহিত্রের সঙ্গে নির্মম আচরণ করা মোয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদের কোনো সম্পর্ক নেই। এদের উপাসনা পদ্ধতির সঙ্গে সুফি তরিকার রীতি-রিচ্যুয়েলের মিল আছে। এরা কথা বলেন কারমানজি ভাষায়, অনেকেই দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে আরবি জবানটাও জানেন। পালন করেন ঈদ ও শবেবরাত।

আহাদ কালাব ইরাকের নিনেভ অঞ্চলের শেখান শহরের মানুষ। সম্প্রতি ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধারা অত্র এলাকা দখল করে নিলে প্রায় চল্লিশ হাজার ইয়াজিদি হয়ে পড়ে বাস্তুহারা। এদের ‘কুফফার’ ফতোয়া দিয়ে ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধারা হত্যা করে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ। একই সাথে তাদের হাতে মালে গনিমত হিসাবে বন্দী হন প্রায় ৭০০০ জন নারী। এদের কাউকে কাউকে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করা হয়। অনুগতদের নিকাহ প্রথার মাধ্যমে উপপত্নি হিসাবে যোদ্ধা পুরুষদের সংসার করার অনুমতি দেওয়া হয়। যারা ধর্মান্তরিত হতে আপত্তি জানায়, তাদের কাউকে কাউকে সেক্স-স্লেভ হিসাবে বিক্রি করে দেওয়া হয় সিরিয়ার হিউম্যান ট্র্যাফিকারদের কাছে।

আহাদ কালাব ও তাঁর স্ত্রী জাবিলা কালাব আরো হাজার খানেক ইয়াজিদির সঙ্গে বন্দী হয়েছিলেন ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধাদের হাতে। তাদের মাউন্ট শিনজারের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় কুর্দি গেরিলাদের আক্রমণে কিছু বন্দীকে পেছনে ফেলে ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধারা উঠে যায় পর্বতের দুর্গম হাইড আউটে। আহাদ কালাব কুর্দি গেরিলাদের সহায়তায় লেবাননে পালিয়ে এসে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অতঃপর রেফিউজি কেটাগরিতে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হওয়ার সুযোগ পান।

ইসলামি স্টেটের সঙ্গে কুর্দিদের যুদ্ধজনিত গোলযোগে আহাদ কালাব বিচ্ছিন্ন হন তাঁর স্ত্রী জাবিলা কালাবের সঙ্গে। অনেক চেষ্টা করেও জাবিলার অদৃষ্টে কী ঘটেছে—কোনো খোঁজ পাননি তিনি। কিছু দিন আগে সাভানা শহরে হয়ে গেছে তাঁর একটি একক প্রদর্শনী। তাঁর আঁকা অনেকগুলো চিত্রে আবছাভাবে ফুটে উঠেছে জাবিলার মুখচ্ছবি। পত্রিকায় ভালো রিভিউ হয়েছে, কিছু চিত্রকলা বিক্রিও হয়েছে। অন্তরঙ্গ আলাপে জানতে চেয়েছিলাম তাঁর প্রতিক্রিয়া। চোখের জল মুছে বলেছিলেন, ‘আই আর্নড সাম মানি বাই সেলিং দ্য পেইনটিংস্, বাট...ইউ নো...ডিডন্ট গেট ব্যাক মাই লাভ।’

যে ম্যানসনের গেস্ট-কটেজে এ মুহূর্তে আইসোলেশনে আছেন কালাব, ওখানে স্থলপথে যেতে পড়ে একটি ট্রেইলার পার্ক, যেখানে ক্যারিবিয়ান ক্রুজে গিয়ে যে কয়েকজন মানুষ সংক্রমিত হয়েছিলেন কোভিড-১৯-এ, তাঁরা আইসোলেশনে বাস করছেন। অন্য উপায় হচ্ছে, নোনা জলবাহী লেগুনে নৌকা বেয়ে গিয়ে ওঠা ম্যানসনের পেছন দিকে জেটিতে। মরগ্যান আইল অব হোপের বোট ডক করার জেটির দিকে ড্রাইভ করতে করতে কালাবের সঙ্গে সেলফোনে কথা বলে নেন। গাড়িটি পার্ক করে খাবারের ব্যাগ হাতে আমরা জেটিতে আসি। ওখানে বাঁধা নানা আকারের অনেকগুলো বোট। খানিক খুঁজে আমরা চারজন বসার উপযোগী একটি ছোট্ট নৌকা লকেট করি। মরগ্যান কালাবের দেওয়া কোড ব্যবহার করে খুলে ফেলেন লক। লেগুনের জলে ভাসছে ম্যালার্ড জাতীয় হাঁস। চতুর্দিক এমন সুনশান হয়ে আছে যে, ইঞ্জিন স্টার্ট করতে ইচ্ছা হয় না। মরগ্যান ঢিমেতালে বৈঠা ফেলেন। যেতে যেতে দেখি দুপাশে নলখাগড়ার মতো দীর্ঘ ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছে শ্বেতশুভ্র সারস।

জেটিতে বোট ভিড়িয়ে আমরা সিঁড়ি দিয়ে উঠি। বাগান পেরিয়ে ম্যানসনটির চকমিলান আকার-আয়তন দেখে আমার চোখ দুটি ছানাবড়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। জেটির লাগোয়া বোট-হাউসে নোঙর করে রাখা একটি শৌখিন ত্রিমারান বোট, পাশেই ঢেউয়ে মৃদু মৃদু দুলছে বর্ণাঢ্য সিপ্লেন। দেখতে পাই, সেলফোন কানে লাগিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন কালাব। আমরা বোট-হাউসের বারান্দায় খাবারের ব্যাগটি রাখি। বেশ দূরে দাঁড়িয়ে তিনি হাত নেড়ে সেলফোনে ঈদ মোবারক বলেন। মরগ্যান লাউড স্পিকার অন করেন। জানতে পারি, তিনি সুস্থ হয়ে উঠছেন, চলাফেরা করতে পারেন, তবে সারাক্ষণ বড় দুর্বল লাগে। যে বলরুমের দেয়ালে তিনি ফ্রেস্কো আঁকতে শুরু করেছিলেন—তা আকারে এত বড় যে, পার্টি-পর্বে ওখানে শত খানেক গেস্ট এন্টারটেন করা যায়। বিশাল পরিসরের ফ্রেস্কোটি শেষ করতে সময় লাগবে। অসুবিধা কিছু নেই। ম্যানসনের কেয়ার টেকার তাঁকে প্রায়োজনে আরো মাস-দেড়মাস গেস্ট-কটেজে থাকার অনুমতি দিয়েছেন। ডিপ ফ্রিজে খাবার-দাবারও আছে যথেষ্ট। আমাদের দেখতে পেয়ে কালাব এত খুশি হয়েছেন যে, ইশারায় আলিঙ্গনের ভঙ্গি করে গেয়ে ওঠেন ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের পালা-পার্বণে গীত একটি জনপ্রিয় গানের দুটি কলি।

আইল অব হোপ থেকে সাভানা শহরে ফিরে ডাউন টাউনের দিকে ড্রাইভ করতে গিয়ে কী ভেবে মরগ্যান ঢুকে পড়েন একটি গলিতে। দুটি ব্লক পেরিয়ে আমরা চলে আসি ছোট্ট একটি শপিং কমপ্লেক্সের কাছে। মারণাস্ত্র বিক্রির দোকান ‘গান স্মিত’র সামনের পেভমেন্ট তিনি গাড়িটি দাঁড় করান। বন্দুকের দোকানে ক্রেতাদের ভিড়। সামাজিক দূরত্বের প্রয়োজনে একসাথে মাত্র দুজন ক্রেতাকে দোকানে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। বাকিরা সারি দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছেন তাদের পালা আসার। খানিক দূরে পার্কিংলটে মারণাস্ত্র ব্যবহার বিরোধী প্লেকার্ড হাতে একাকী দাঁড়িয়ে মাস্কে মুখ ঢাকা হেজাব পরা মিসেস নিয়ামা ইবরিম। আমরা তাঁর সমর্থনে নিরাপদ দূরে দাঁড়িয়ে রুমাল নাড়ি। কয়েকজন বন্দুক খরিদ করনেওয়ালা যুবক ঘাড় ফিরিয়ে আমাদের দিকে তাকান। দুজন আঙুল নিচু করে অশ্লীলভাবে ইশারা করেন। গাড়িতে ফিরতে ফিরতে ভাবি অত্র এলাকায় যেভাবে মারণাস্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে—আমার জীবদ্দশায় কি এ প্রবণতার অবসান ঘটবে?

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হয় জর্জিয়া সাদার্ন ইউনিভারসিটির পেছন দিককার দরিদ্র জনগোষ্ঠী অধ্যুসিত পল্লীতে। ওখানে বাস করছেন কেম্বোডিয়া থেকে অভিবাসী হয়ে আগত বয়োবৃদ্ধ চাম দম্পতি। সপ্তাখানেক আগে মিসেস লেবু-কে চাম তাঁর পক্ষাঘাতে স্থবির স্বামী মি. ফাটেল সান চামকে ঘরে একা রেখে উবার চড়ে গ্রোসারি শপিংয়ে গিয়েছিলেন। বাজার সওদা নিয়ে দোকান থেকে বেরোতেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ছবি আঁকা টিশার্ট পরা এক শ্বেতাঙ্গ মুণ্ডিত মস্তক যুবক ‘এক্সকিউজ মি...’ বলে তাঁকে থামায়। তারপর কেশে তাঁর শরীরে থুতু ফেলে চিৎকার করে বলে, ‘ইউ ফাকেন চায়নিজ, ইউ ব্রট করোনা ভাইরাস হিয়ার...গো ব্যাক টু ইয়োর আগলি হোম।’ আমি নিরীহ এ বৃদ্ধার হেরাসমেন্টের কাহিনী বর্ণনা করে স্থানীয় পত্রিকায় চিঠি লিখেছিলাম, পত্রটি ছাপেনি। মরগ্যান সাহেব পত্রিকার অ্যাডভাইজারি বোর্ডে আছেন, আমি তাঁকে গতকাল বিষয়টি অবহিত করি। তিনি ড্রাইভ করতে করতে ঘটনাটি ফের ব্যাখ্যা করতে বলেন। বিরক্ত হয়ে আমি বলি, মহিলা প্রথমত চায়নিজ নন। আর চায়নিজরা যে আমেরিকাতে ভাইরাস পাঠিয়েছে, তারও কোনো প্রমাণ নেই। গবেষকরা নিউইয়র্কে আক্রান্তদের শরীর থেকে নেওয়া জীবাণু পরীক্ষা করে বলছেন এগুলো এসেছে ইউরোপ থেকে। তো ভাইরাসের বিষয়-আশয় যাই হোক চাম পরিবার অভিবাসী হয়ে এদেশে এসেছে মূলত আমেরিকার যুদ্ধনীতির কারণে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের জামানায় যুক্তরাষ্ট্রের কার্পেট বম্বিংয়ে কেম্বেডিয়ার কমপঙচনঙ এলাকায় অবস্থিত তাঁদের পুরো গ্রামটি জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল। এ কারণে বাস্তুহারা হয়ে পুরো এগারো বছর চাম পরিবার কাটান থাইল্যান্ডের শরণার্থী ক্যাম্পে। তারপর কপালগুণে রেফিউজি ক্যাটাগরিতে অভিবাসী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকেন।

মরগ্যান এবার জানতে চান, ‘ডু ইউ নো এনিথিং আবাউট দিস কাপোলস্ কালচারেল ব্যাকগ্রাউন্ড? সম্পাদক ঠিক বুঝতে পারেননি চাম শব্দটি, কেম্বোডিয়ার মানুষজনকে খেমার বলে না? আমি জবাব দিই, কেম্বোডিয়ার মূলধারার মানুষজনের নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি হচ্ছে খেমার। এরা বৌদ্ধ, অনুশীলন করে তারাবাদা সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস। চামরা মুসলমান, সংখ্যালঘু, এরা খেমার মুসলিম বলেও পরিচিত।’

মরগ্যানের পরবর্তী প্রশ্ন হয়, ‘দেশে এসে অভিবাসী হওয়ার আগে এঁনারা কী ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন? ডু ইউ হ্যাভ অ্যানি আইডিয়া?’ কেন জানি আমার বিরক্তি আরেক দফা বাড়ে, তবে জবাব দেই, ‘মিসেস লেবু-কে চাম তারুণ্যে ছিলেন নৃত্যশিল্পী। নমপেনের রাজদরবারে তিনি একবার নৃত্য উপস্থাপন করেছিলেন। তাঁর স্বামী মি. ফাটেল সান চাম ছিলেন হাইস্কুলের শিক্ষক। এঁরা খেমার ভাষায় কথা বলেন বটে, তবে এঁদের নিজস্ব ভাষার নাম হচ্ছে খা-খা। এ ভাষার লিখনশৈলী আজকাল আর কেউ ব্যবহার করে না, ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ফাটেল সান চাম হচ্ছেন খা-খা ভাষার একজন বিশেষজ্ঞ।’ মরগ্যান এবার আসল কথায় এসে বলেন, ‘আমাদের ছোট্ট শহরের নাগরিক বৈচিত্রে এরা যুক্ত করছেন নতুন একটি এলিমেন্ট। সম্পাদক এদের সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে চান। চিঠি নয়, তুমি এঁদের নিয়ে একটি ফিচার-স্টোরি করতে পারবে কি? ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড...দু-তিনটি ছবি লাগবে কিন্তু।’ গাড়ি এসে থামে চাম দম্পতির ঘরের সামনে। ইঞ্জিন অফ করে দিয়ে মরগ্যান প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকান, আমি জবাব দিই, ‘আই উইল থিংক আবাউট দিস...আজ থাক, এ নিয়ে পরে কথা বলব। ও-কে।’

ঘরের বারান্দায় চুপচাপ বসে আছেন মিসেস লেবু-কে চাম। আমি হাত নাড়ি, তিনি চোখ তুলে তাকান, কিন্তু কিছু বলেন না। আঙিনায় ঘাস ও আগাছা বেড়ে জংলা হয়ে ওঠছে। ট্র্যাশ বিনের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা বর্জ বোঝাই আবর্জনার একাধিক ব্যাগ। মিসেস লেবু-কে চাম উঠে দাঁড়ান, তিনি কোমর সিধে করতে প্রচুর সময় নেন, টিপয় থেকে তুলে চশমাটিও চোখে লাগান। আমি কুঁজো ভঙ্গিতে এক-পা, দু-পা করে এগিয়ে আসা বৃদ্ধার দিকে তাকাই। মাস তিনকে আগে আমি একবার তাঁদের খোঁজ নিতে এ বাড়িতে এসেছিলাম। তখন মিসেস লেবু-কে চাম আমাকে তাঁদের ফ্যামিলি অ্যালবামটি দেখিয়ে ছিলেন, ওখানে আমি সটিন-রেশম ও ব্রোকেডে ঝলমলে নৃত্যের ট্র্যাডিশন্যাল পোশাক পরা যে তরুণীর ফটোগ্রাফ দেখেছি, তার সঙ্গে আমার দিকে এগিয়ে আসা কুঁচকানো ত্বক কুঁজো বৃদ্ধার কোনো মিল দেখতে পাই না।

মিসেস লেবু-কে চাম আমার কাছে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দেন। সচেতন হই যে, এ মুহূর্তে সামাজিক দূরত্ব বহাল রাখা সম্ভব হবে না। দ্বিধা ঝেড়ে আমি তাঁর হাত স্পর্শ করি। মৃদু হেসে জানতে চান, কী ধরনের খাবার নিয়ে এসেছি? কাবাবে হাড়গোড় কিছু নেই জানতে পেরে খুশি হন, বলেন, ‘মাই হাজবেন্ড লাভ মিট, কিন্তু চামরা মৎস্যজীবী, অনেকে বাস করে নদী বা দারিয়ার কিনারায়, ঈদে আমরা নারকেলের দুধ দিয়ে চিংড়ি মাছ রান্না করি।’ মরগ্যান এগিয়ে এসে মাথা ঝুঁকিয়ে বাঁও করে পরিচিত হন। তিনি আবর্জনার ব্যাগগুলো তুলে ট্র্যাশ বিনে রাখার অনুমতি চান। মিসেস লেবু-কে মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিয়ে তাঁর কোমরের দিকে ইঙ্গিত করেন। বুঝতে পারি, এ বৃদ্ধাও বাত-ব্যাধির আরেক ভিকটিম। আমি খাবারের ব্যাগটি নিয়ে সিঁড়ির উপর রাখি। মিসেস লেবু-কে আফসোস করে বলেন, ‘গ্রোসারিতে চিংড়ি মাছ ছিল প্রচুর, কিন্তু যে ব্যাগের দাম মাস খানেক আগে ছিল নয় ডলার, তা বেড়ে হয়েছে সাতাইশ ডলার, এত দাম দিয়ে কিছু কেনা যায় নাকি?’ অতঃপর তিনি জানান যে, তাঁরা অপেক্ষা করে আছেন সরকারের পাঠানো স্টিমুলাস চেকটি পাওয়ার। করোনা সংক্রমণজনিত মন্দায় অর্থনীতিকে জিইয়ে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস নাগরিকদের জন-প্রতি ১,২০০ ডলারের চেক পাঠানোর অনুমোদন দিয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের অব্যবস্থাপনায় অনেকে চেক পেয়েছেন, অনেকে পাননি। অনেক বছরের পুরানো অভিবাসী চাম দম্পতি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। চেক পাওয়ার হক তাঁদের আছে। চেক আমি নিজেও পাইনি, আমার জানাশোনা আরো অনেকেও পাননি। পরিস্থিতি যেভাবে চূড়ান্ত অব্যবস্থাপনার দিকে আগাচ্ছে, কী বলব, বৃদ্ধাকে কোনো ভরসা দিতে পারি না। খিন্ন মনে বিদায় নিয়ে ফিরে আসি গাড়িতে।

মরগ্যান ডিসইনফেকশনের শিশিটি বাড়িয়ে দেন। আমি লোশন দিয়ে হাত পরিষ্কার করে গাড়িতে উঠি। তিনি স্টার্ট দিতে দিতে বলেন, ‘লেটস্ কাম ব্যাক টু দিস হাউস টুমরো। আমি পর্টেবল লনমোয়ার নিয়ে আসব। তুমি বৃদ্ধাকে রিং করে পার্মিশন নিয়ে রাখো। আমি তাঁর অঙিনার আগাছাময় ঘাসগুলো কেটে দিতে চাই।’

মাথায় একটি আইডিয়া খেলে যায়। চাম দম্পতির ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখা আছে খা-খা ভাষায় লেখা তালপাতার কয়েকটি পুঁথিপত্র। মিসেস লেবু-কের নৃত্যের পোশাক পরা যুবতী বয়সের একটি ছবির কপির সাথে তালপাতার পুঁথিপত্রের দুটি ছবি তুলে নিতে পারলে—স্থানীয় পত্রিকার জন্য অনায়াসে একটি ফিচার দাঁড় করানো যায়। আমি সম্ভাবনা নিয়ে ভাবি, কিন্তু ভেতর থেকে সায় পাই না। ত্রাণকাজের হিল্লা ধরে আমার একটি লেখার প্রয়োজনে এ দম্পতির ব্যক্তিগত সম্পদকে ব্যবহার করব, কাজটা কি নৈতিকভাবে সঠিক হবে?

আমরা যে রেফিউজি পরিবারদের খাবার দিতে যাচ্ছি, তাঁরা বাস করছেন শহর থেকে সামান্য দূরে—সস্তা হাউজিং ফেসিলিটিতে। মরগ্যান অই দিকে টার্ন নেন। সিগনালের লাল বাতিতে থামতেই মি. ইদ্রিসা বেনী ইসামের কাছ থেকে টেলিফোন আসে। তাঁরা অপেক্ষা করছেন। মরোক্ক থেকে অনেক বছর আগে অভিবাসী হয়ে এদেশে আসা মি. ইদ্রিসার ছেলে আবদেল বেনী ইসামের মৃত্যু হয়েছে সম্প্রতি কারাগারে, সম্ভবত করোনাক্রান্ত হয়ে। মরগ্যান ড্রাইভ করতে করতে মি. ইদ্রিসা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান। মরোক্কর তানজিয়ার্স অঞ্চলের মানুষ ইনি। রাজবন্দী হয়ে সাত বছর কাটিয়েছেন ওই দেশের একটি কুখ্যাত কারাগারে। তারপর রাজা পঞ্চম মোহাম্মদের সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পেয়ে কিভাবে যেন ইমিগ্রেশন নিয়ে এদেশে আসেন। এক সময়ে ফুটপাতে দোকান সাজিয়ে সাভানা নগরীতে আগত পর্যটকদের কাছে বিক্রি করতেন—মরোক্কর কুটিরশিল্পজাত পণ্য। বয়সের কারণে আজকাল আর দোকানটি ম্যানেজ করতে পারেন না। গেল ঈদেও মসজিদ-ভিত্তিক পার্টিতে তিনি নিয়ে এসেছিলেন সবচেয়ে মজাদার কুসকুস। এবারকার দুর্বিপাকে খাবারের অনটনে ভুগছেন মি. ইদ্রিসার পরিবার। তাঁরা স্টিমুলাস চেকও পাননি। তাঁর ছেলে আবদেল বেনী ইসাম কাজ করত একটি শপিংমলে। ওখানকার একটি দোকানের কিছু সৌখিন পণ্য খোয়া গেলে সিসি টিভির সূত্র ধরে গ্রেফতার হয় আবদেলসহ আরো দুটি শ্বেতাঙ্গ তরুণ। মামলায় লইয়ারের আইনি মারপ্যাঁচে শ্বেতাঙ্গ ছেলে দুটি ছাড়া পায়। কিন্তু লইয়ার জোগাড় করার মতো আর্থিক সঙ্গতি মি. ইদ্রিসার ছিল না। তাই, সম্ভবত মিথ্যা মামলায় তাঁর সন্তান আবদেল চার বছর মেয়াদের সাজা পায়। কারাগার থেকে টেলিফোন করে সে জ্বর-কফ-কাশি ও শ্বাসকষ্টে ভোগার সংবাদ তাঁর পিতাকে জানায়। কারাগারে এ সময় আরো অনেক কয়েদির শরীরে ফুটে উঠেছিল এ ধরনের রোগলক্ষণ। বেশ কয়েক জন কয়েদির মৃত্যু হয় অবশেষে। টেস্টিংয়ের কোনো ব্যবস্থা ছিল না, তাই নিশ্চিত করে বলার কোনো উপায় নেই যে, এরা মারা গেছেন করোনা সংক্রমণে। আবদেলের মৃত্যুর আগে মি. ইদ্রিসা সন্তানের সঙ্গে দেখা করার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু কারাগারের ভিজিট আওয়ার বাতিল করা হয়েছিল। অতঃপর মি. ইদ্রিসা কারা-কতৃপক্ষের অনুমতি চেয়েছিলেন, যাতে ছেলেকে টেলিফোনে তওবা পড়াতে পারেন। তাঁকে এ ধর্মীয় অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়।

আমরা এসে পৌঁছি সস্তা হাউজিং ফেসিলিটিতে। পেভমেন্টের পাশে একটি বেঞ্চে চুপচাপ বসে আছেন মি. ইদ্রিসা। আমাদের সালামের আলেক দেন তিনি, হাসেন, হাত নাড়েন, কিন্তু কিছু বলেন না। লাঠি হাতে অন্যমনস্ক হালতে বসা মরোক্কান কেতার অজানুলম্বিত সফেদ পোশাকপরা মানুষটিকে চিন্তামগ্ন সুফি-দরবেশের মতো দেখায়। আমরা খাবারের প্যাকেটগুলো পাশের আরেকটি বেঞ্চে রাখি। তিনি হাত তুলে আমাদের আশ্বস্ত করে বলেন, রেফিউজিদের অ্যাপার্টমেন্টগুলোর দোরগোড়ায় খাবার পৌঁছে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। সোমালিয়ার শরণার্থী আহমদ গুদ একটু পর এসে অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে খাবার ক্যারি করে পৌঁছে দেবে।

একটু দোনামোনা করে অবশেষে বলেই ফেলি, ‘মি. ইদ্রিসা, আই অ্যাম সো স্যারি...সিনসিয়ার কনডোলেন্সসেস্ ফর ইয়োর সন’স ডেথ।’ বোবাদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তিনি আমাকে তাঁর ছেলের মাগফেরাতের জন্য মোনাজাত করতে বলেন। আমি তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিই—ঘরে ফিরে প্রার্থনা করব। মরগ্যান এগিয়ে এসে বিনীতভাবে বলেন, ‘আমি ধর্মে মুসলমান নই, তবে ইসলাম ধর্মের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। আপনি যদি অনুমতি দেন, আমি আপনার ছেলের জন্য প্রার্থনা করতে চাই।’ ঘাড় হেলিয়ে মি. ইদ্রিসা সম্মতি দেন। মি. মরগ্যান দুহাত তুলে প্রার্থনা করেন, আমি ও ইদ্রিসা আমিন বলে দোয়ায় শরিক হই।

সোমালিয়া থেকে আগত দীর্ঘদেহী নওজোয়ান আহমদ গুদ এসে আমাদের ঈদ মোবারক বলে। ছেলেটি শহরের একটি বারবার সেলুনে চুল কাটার কাজ করত। প্রায় দুইমাস লকডাউনের পর শহরের সেলুন ইত্যাদি খুলেছে। জানতে চাই, ‘হাউ ইজ ইয়োর জব গোয়িং? কাজে গিয়েছিলে কি?’ নেতিবাচকভাবে হাত উল্টিয়ে আহমদ জানায়, গেল কয়েকদিন ধরে সেলুন খুলেছে, তবে এখনো কাস্টমাররা সেলুনে আসতে সাহস পাচ্ছে না। সে প্রতিদিন একবার করে সেলুনে হাজিরা দিচ্ছে, কিন্তু চুল কাটার লোকজন না আসলে মাথাওয়ারি পারিশ্রমিক পাওয়ার কোনো উপায় নেই। আমি দূরত্ব বজায় রেখে খেলনাগুলো খাবারের সাথে কোন কোন অ্যাপর্টমেন্টে পৌঁছে দিতে হবে তা বুঝিয়ে বলি। আহমদ একটি ঝুড়িতে প্যাকেটগুলো তুলছে। আমি এক পা সামনে গিয়ে জানতে চাই, ‘হাউ ইজ ইয়োর ফাদার মি. মোহাম্মদ গুদ?’ সে ‘আই উইল আনসার ইউ ইন আ মিনিট,’ বলে ইশারায় জানায় প্যাকেটগুলো গুছিয়ে নিয়ে সে আমাকে জবাব দিচ্ছে। আমি এ সুযোগে সংক্ষিপ্তভাবে মরগ্যানকে তার বাবা মোহাম্মদ গুদের করোনাক্রান্ত হয়ে সেরে ওঠার ঘটনাটি জানাই। ডাক্তাররা প্রায় আশি বছরের এ বৃদ্ধের রিকভার করার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। পুরো চার সপ্তাহ যুঁজে যেন জাদুবলে তিনি রিকভার করেন। হাসপাতাল থেকে তাঁর রিলিজের দিন নার্স ও ডাক্তাররা জড়ো হয়ে হাততালি দিয়ে তাঁর সুস্থ হওয়ার বিষয়টি সেলিব্রেট করে। ঘটনাটি আমিও প্রত্যক্ষ করি স্যোশাল মিডিয়ায়। ঝুড়িতে প্যাকেটগুলো গুছিয়ে আহমদ গুদ বলে, ‘মাই ফাদার সেন্ড ইউ আ ম্যাসেজ মি. সুলতান। তুমি যে খাবার দিয়ে গিয়েছিলে, শুকনা বিস্কিটগুলো বাবার পছন্দ হয়নি। তিনি খেতে চাচ্ছেন এক পেয়ালা দুধ।’ আমি দুধ পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিই। আহমদ গুদ আতরের ছোট্ট একটি শিশি বের করে তাতে তুলা গুঁজতে গুঁজতে বলে, ‘বাবা তোমাদের জন্য সামান্য আতর পাঠিয়েছেন।’ সচেতন হয়ে উঠি যে, আহমদ গুদের হাত থেকে আতর নিলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামাজিক দূরত্বের নীতিমালা, আমি ও মরগ্যান পরস্পরের দিকে তাকাই, কিছু বলি না, অতঃপর খোশবুদার তুলা নাকে দিতে দিতে ভাবি—ঈদের দিন না হয় সামাজিক দূরত্বের সামান্য ব্যতিক্রমই হলো।

   

দুই দেশের রং মিলেছে এক দেয়ালে



মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রঙের শহর, হাসির শহর ব্যাংকক। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা শহর ব্যাংকক। ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্র সিয়ামেই রয়েছে ব্যাংকক র্আট এন্ড কালচারাল সেন্টার (বিএসিসি)। বাংলাদেশ থেকে যারা ব্যাংককে বেড়াতে যান, তারা যদি এমবিকে মলের পাশ দিয়ে স্কাই ওয়াক হয়ে তৃতীয় তলায় প্রবেশ করেন তাহলে হাতের ডানে চোখ ফেললেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের রঙের খেলা আর জীবনযাত্রার চিত্র।

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে গত ২৬ র্মাচ থেকে ব্যাংককের র্আট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও থাই চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘ড্রীম অব কালারস’ বা ‘রঙের স্বপ্ন’ র্শীষক চিত্র প্রর্দশনী। ‘কানেক্টিং টু ল্যান্ডস এন্ড টুপিপলস’ স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তেই এই আয়োজন।


তৃতীয় তলার করিডোর ধরে হাঁটতেই চোখে পড়বে শিল্পী মুস্তাফিজুল হকের নিহঙ্গ। ওয়াসি পেপারের ওপর জাপানি ধরনের চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ তিনি। ক্যানভাসের ওপর আর্কিলিকের চিত্রকর্ম ‘হর্স’ মনযোগ আকর্ষন করছিল দর্শনার্থীদের। তার চিত্রকর্মের বড় বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তা এবং বিষয়ের গভীর উপস্থিতি।

নগরের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী কামাল উদ্দিনের জুড়ি নেই। তবে এখানে ব্যক্তির পোর্ট্রেট নয় বরং পেস্টেলে তবলার রং ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।

আবার থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলার শিক্ষক খাজোনসাক মাহাকুন্নাওয়ানের তুলিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নগরের জীবন। রিকশার সঙ্গে যাত্রীদের ছুটে চলা। সময়কে যেন পাশ কাটিয়ে ছুটে চলছে তার চিত্রকর্ম।


ঢাকার গ্যালারি চিত্রকের ১৮ জন শিল্পী এবং থামাসাত ইউনিভার্সিটির ফাইন অ্যান্ড এপ্লাইড আর্টস বিভাগের ৪ জন শিল্পীর যৌথ অংশগ্রহণে চলছে এই আয়োজন। চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। গত ২৬ মার্চ চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহা. আব্দুল হাই।

চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে তিনি বলেন, দুটি দেশের ভূমি আর মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এনেছে এই আয়োজন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে যে যোগাযোগ সেটা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং আত্মার যোগাযোগ। শুধু দেশকে চেনায় না, বরং সেখানকার জীবনযাত্রার ধারণা দেয়, মানুষকে কাছে নিয়ে আসে।


ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাসের এই চিত্রপ্রদর্শনীতে রফিকুন্নবী, আব্দুস সাকুর শাহ, সৈয়দ আবুল বার্ক আলভি, শেখ আফজাল, মাহফুজুর রহমান, সুমনা হক, মুনিরুজ্জামান, জহির উদ্দিন, কনক চাপা চাকমা, বিপাশা হায়াত, মোহাম্মদ ইউনুস, সুলেখা চৌধুরী, রেজাউন নবী, কামাল উদ্দিন, পারভীন জামান, সুমন ওয়াহিদ, মোস্তাফিজুল হক, আহমেদ সামসুদ্দোহার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে।

এছাড়াও থাইল্যান্ডের চিত্রশিল্পী খাওজনসাক মাহাকুন্নাওয়ান, ওয়ারাপান সামপাও, জিরাতচায়া ওয়ানচান, প্রারুনরপ প্রিউসোপির চিত্রকর্মও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।

ব্যাংকক আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে সকাল থেকেই বিভিন্ন বয়সী শিল্প প্রিয় মানুষের আনাগোনা থাকে। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা।

;

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;