জিপার



আন্দালিব রাশদী
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

জায়গাটা ঠিক ধানমন্ডিতে নয়, কিন্তু ধানমন্ডি দাবি করতে করতে একসময় সিটি কর্পোরেশন মেনে নিয়েছে, ঠিক আছে, পশ্চিম ধানমন্ডি। সাতমসজিদ রোডের পশ্চিমে, শঙ্কর প্লাজা ঘেঁষে সামনে কিছুটা এগিয়ে খুশবু রেস্তোরাঁ আর একাধিক বিরিয়ানি হাউস ডিঙ্গিয়ে বামদিকে অন্তত পঞ্চাশ গজ এগিয়ে আবার বামে। হোসেন আলী গার্লস স্কুল পেরিয়ে পশ্চিম ধানমন্ডি ইউসুফ হাইস্কুল লাগোয়া বাড়িটা পাকিস্তান আমলের। ভাইবোনদের গোলযোগের কারণে ডেপেলাপার এসেও ফিরে গেছে। পরিবারের মধ্যে এর বিরুদ্ধে ওর প্যাঁচ লাগিয়ে যে বোনটি সমস্যা জিইয়ে রাখত ক’দিন আগে একটি ভয়াবহ স্ট্রোক তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে, আর কথা এতটাই অস্পষ্ট হয়ে গেছে যে ভাইবোনেদের কেউই বুঝতে পারছে না, ফলে নিজেদের মধ্যকার বিরোধের তীব্রতা কমে এসেছে, সবাই ডেভেলাপার ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়েছে। আলাপ-আলোচনা—বিশেষ করে সাইনিং মানি কত হবে, অ্যাপার্টমেন্ট ভাগাভাগির অনুপাত ষাট চল্লিশ নাকি পঞ্চাশ পঞ্চাশ তাও অনেকটাই চূড়ান্ত হয়ে গেছে। হস্তান্তর দেরি হচ্ছে কারণ মন্টুর বিয়েটা ভাড়া বাড়িতে হোক এটা বাবা চাচ্ছেন না।

মন্টু দেড়মাসের ছুটিতে নিউজিল্যান্ড থেকে এসেছে। খুকুর ছবি দেখেই বলেছিল, দারুণ তো।

মন্টু গত দশবছরে সাতবার দেশে ফিরেছে, অনুপস্থিতির সময় তার নিচতলার রুমটা হাতছাড়া হয়ে গেলেও ফেরার তারিখ সাব্যস্ত হলে বাবা রুমটাতে ঝাড়পোছ করাতেন, বিয়ে সামনে রেখে এবার ভালোরকম চুনকামও করিয়ে দিয়েছেন।

মন্টুর বড়বোন ঝর্ণা আপু এবার সতর্ক—মন্টুকে পাত্রীর সাথে কথা বলতে দেবেন না। কথাবার্তা বললেই মন্টু সব গুলিয়ে ফেলবে যেমনটা করেছে আগেরবার, প্রায় দেড় বছর আগে। বাবার কলিগের মেয়ে মাফরুহাকে প্রায় সবাই পছন্দ করেছিল, মন্টুও নিজেও। গায়ে হলুদের ঠিক আগের দিন ঝর্ণা আপুকে বলল, আমি মিথ্যে দিয়ে জীবনটা শুরু করতে চাই না। মাফরুহাকে দশ মিনিটের জন্য হলেও আমার সাথে ওয়ান টু ওয়ান কথা বলার একটা স্কোপ করিয়ে দাও। আমি কথাটা বলি।

ঝর্ণা বলল, তুই আমাদের আয়োজনটা নষ্ট করে দিবি। একটা ভালো মেয়ে হাতছাড়া হয়ে যাবে।

মন্টু বলল, ভেবো না আমি খুব সামলে বলব।

ধানমন্ডির পুরনো ২৭ নম্বর, নতুন ১৬ নম্বর রোডে কফি ওয়ার্ল্ডে দুজনের মোলাকাত সাব্যস্ত হয়। দুজন এক টেবিলে বসবে, খানিকটা দূরে অন্য একটি টেবিলে মাফরুহার ছোট মামী ও ঝর্ণা বসে কফি খাবে, একটুখানি গপসপ করবে।

দুজনই পূর্ব পরিচিত। বিসিএস পরীক্ষা দেবার জন্য দুজন একই জায়গায় কোচিং করেছে এবং দুজনের কেউই প্রিলিমিনারি পর্বও ডিঙাতে পারেনি। দুজনের কেউই অন্য কোনো চাকরিরও চেষ্টা করেনি। মাফরুহার ছোট মামী আমেরিকায় মাইগ্রেট করবে, কাগজপত্র পাকাপাকি করছে আর ঝর্ণার স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ে, এখন স্টেজ টু-তে, নিজেই বলেছে পুরোপুরি সেরে যাবার নিশ্চয়তা না পেলে কোনো চাকরিতেই যাবে না বাসায় থাকবে, খাবে ঘুমাবে, তারপর মারা যাবে; ক্যান্সার আর জায়গা পেল না—একেবারে ব্রেস্টে ধরেছে!

ঝর্ণা ও মাফরুহার ছোট মামী কেবল কফিতে চুমুক দিয়েছে, মাফরুহা হঠাত্ চিত্কার করে মন্টুকে চিট, ফ্রড, ইমপোস্টার—এসব গাল দিতে শুরু করল এবং আরো বলল সাধু সেজে বিয়ের প্রস্তাব দেবার জন্য তাকে এখনই পুলিশে সোপর্দ করা উচিত।

মন্টু কিছু বলতে চাইছিল, মাফরুহা বলল, ইউ শাট আপ।

এমন খোলামেলা কাফেতে মন্টু মাফরুহার গায়ে হাত দিয়েছে এমন মনে করার কারণ নেই, কিন্তু কাফের লোকজন যেভাবে যেভাবে মন্টুর ওপর দৃষ্টি ফেলছে যে কারোরই মনে হবে তারা জীবনে প্রথম একজন ধর্ষণকারীকে এত কাছ থেকে দেখছে।

ওহ্ মাই গড, রেইপিস্ট।

মাফরুহা হাইহিলের খট খট শব্দ তুলে বলল, চললাম।

তার ছোট মামী দুশো টাকা দামের কাপোচিনোতে আর একটি কেবল চুমুক দিয়ে তার পেছন পেছন ছুটল।

ঝর্ণা মন্টুকে জিজ্ঞেস করল, কী রে কি ঘটল?

মন্টু বলল, আল্লাহ বড় বাঁচা বাঁচিয়ে দিয়েছেন। শি ইজ অ্যা ক্র্যাজি ওমেন। থ্যাঙ্ক ইউ আপু, ভাগ্যিস এই সিটিংটা অ্যারেঞ্জ করেছিলে, নতুবা আমার লাইফটা হেল হয়ে যেত।

কিন্তু এবার কী হবে?

মন্টু রাজি হলো পাত্রীর সাথে কথা বলে পরিস্থিতি জটিল করে তুলবে না, কিন্তু পাত্রীকে একটি ব্যক্তিগত চিঠি দেবে যা কেবল পাত্রীই দেখবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে খামবন্ধ সেই চিঠি পাত্রীর হাতে দেবার দায়িত্ব ঝর্ণাই নিল।

খুকুর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান থেকে মধ্যরাতে পাত্রপক্ষের যেসব বন্ধু ও স্বজন ফিরে এলো তাদের চোখেমুখে আনন্দ। গায়ে হলুদ দেবার সময় মেয়েটাকে একটু হলেও ছুঁয়ে দেখা যায়। যারা তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছে এবং হলুদ দেবার নাম করে আলতো করে ছুঁয়েছে, তাদের সবাই বলেছে, দারুণ দেখতে, এ ডাবল প্লাস। খুকুর গায়ে হলুদেই যে জাঁকালো অনুষ্ঠান করা হয়েছে পাত্রপক্ষ বৌভাতেও এত বড় আয়োজন করতে পারবে না। ধনী পরিবারের মেয়ে, তার উপর সুন্দরী। খুকুর গালে ও কপালে এক চিমটি হলুদের ছোঁয়া দিয়েছে মন্টুর সবচেয়ে বড় বোনের মেয়ে টুশি।

টুশি আগে পাশের কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছে, মামী কি সত্যিই এত সুন্দর!
একটু মেকআপ তো আছেই, কিন্তু গালটা এমন তুলতুলে করল কিভাবে?

যারা ভিডিও করেছে, ক্যামেরায় স্থিরচিত্র ধারণ করেছে, সেলফোনের ক্যামেরায় যারা খুকুকে টার্গেট করেছে সকলেই যার যার ছবির সংগ্রহ মন্টুর ডেস্কটপ কম্পিউটারে ডাউনলোড করে দিয়ে গেল। চলমান ছবি আর স্থির ছবি দেখে দেখে মন্টু বাকি রাতটা অবলীলায় পার করে দিতে পারবে। সকালের নাস্তা সেরে একটা ঠান্ডা ঘুম দেবে।

একজন পুরুষ মানুষের জন্য সুন্দরী স্ত্রীর অধিকারী হবার মতো গৌরবের আর কিছু নেই। রুমের দরজা বন্ধ করে কম্পিউটারের স্ক্রিনে খুকুকে দেখে মুগ্ধ হয় এবং একসময় স্বগতোক্তি করতে থাকে: তুমি কত সুন্দর!

মন্টু তার দেখা সুন্দরী তরুণীদের চেহারা মনে করতে থাকে। বন্ধু, আত্মীয়, পরিচিত, অপরিচিতজনের স্ত্রীদের কাল্পনিক ছবি একে একে খুকুর পাশে পেস্ট করে এবং বলে, ধারে কাছে আসার মতোও নয়, একজনও না।

জুম করে খুকুর মুখমণ্ডলের প্রতিটি অংশ বর্ধিত আকারে কম্পিউটারের পুরো পর্দায় দেখে খুঁত বের করতে চেষ্টা করে। সকাল নাগাদ নিশ্চিত হয় খুকুর বাম চোখ একটু ট্যারা। যারা খুকুর গালে ও কপালে হলুদ লাগিয়েছে তাদের কেউ এ কথাটি বলেনি।

একটুখানি ট্যারা চোখ, এক গালে টোল, একপাশে গেজ দাঁত এমনিতেই নারীর চেহারায় ভিন্নমাত্রা যোগ করে। আর সে নারী যদি দেখতে সুন্দর হয়, তার সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দেয়।

নির্ঘুম রাতটি পেরিয়ে যায়, সূর্য উঠি উঠি করছে—তার মনে হলো কোথায় সে খুকুর সৌন্দর্যে বুদ হয়ে থাকবে—তা না করে চেহারার খুঁত আছে কিনা তা বের করতে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে। মন্টুর ছিদ্রান্বেষী স্বভাবটা পুরনো। সামনাসামনি একজন সিনেমার নায়িকাকে দেখে এসে বাসায় বলেছে, চেহারা ঠিকই আছে, কিন্তু নাকের ভেতর একটা চুল দেখতে পেয়েছি।

কলিং বেলটা তখনই বাজল।

এত সকালে তো কারো আসার কথা নয়। গ্রামের আত্মীয়দের কেউ হতে পারে, বাবা হয়তো তাদের দাওয়াত দিয়েছেন—মন্টুর বিয়েতে তোরা আসিস কিন্তু।

দরজার কাছে গিয়ে অভ্যাসবশত বলে উঠল, কে?
ভাই আমি, দরজাটা খুলুন।

অবশ্যই নারীকন্ঠ। আশি কি নব্বই হাজার জনে নারীকণ্ঠী দু’একজন পুরুষেরও দেখা মেলে।

আবারও সেই কণ্ঠ শোনে। মন্টু নিশ্চিত, এটা অবশ্যই নারীকণ্ঠ। নারীকণ্ঠের কিছু তাত্ক্ষণিক সতর্কীকরণ প্রতিক্রিয়া রয়েছে: মন্টু তুমি খালি গায়ে পরনে লুঙ্গি, মন্টু তোমার বিছানা ভীষণ অগোছালো, মন্টু টেবিলের ওপর তোমার মোজা ও আন্ডারওয়্যার কেন? মন্টু কমোডে সিগারেটের বাট ও ছাই ভাসছে—এখনই ফ্ল্যাশ করো, লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট পরো, মোজা আন্ডারওয়্যার লুকোও, খালি গায়ে থেকো না, অশ্লীল দেখায়। পুরুষ কেউ হলে খালি গায়ে সমস্যা হতো না। যা কিছু করার তাড়াতাড়ি করো।

একটু কালক্ষেপণ করার জন্য মন্টু আবার জিজ্ঞেস করে, কে?
ভাই আমি, বলছি। খুলুন, আমি।
আমি! আমি আবার কে?
প্লিজ দরজাটা খুলুন।

কিছু কথা মন্টু বোকার মতোই বলে। এটা না বললেও চলত, তবুও বলল, একটু অপেক্ষা করুন, আমি খালি গায়ে, আগে শার্ট পরে নিই।

দরজার ওপাশ থেকে তাত্ক্ষণিক জবাব, আমি খুকু, আপনি যদি মন্টু হয়ে থাকেন, আপনাকে খালি গায়ে দেখলে অসুবিধা নেই।

তার মানে, সে যদি মন্টু না হয়, তাহলেই কেবল তার খালি গা ঢাকার ব্যাপার আসবে। কিন্তু মন্টু হলে তাকে যে কোনো অবস্থায় দেখার ওজিএল—ওপেন জেনারেল লাইসেন্স তাকে দেওয়া হচ্ছে। কাজেই একটু আগাম সে দেখতেই পারে।

দুই.
দরজায় অপেক্ষমাণ খুকু কে হতে পারে তা সে আঁচ করতে পারবে না মনে করার কারণ নেই।
মন্টু চারজন খুকুকে কমবেশি চেনে। দুজনকে ভালো করে। দুজনকে কম কম—একজনকে লাইভ দেখেছে, একজনকে ছবিতে। মেয়েহীন পরিবারের ছোটছেলে হুমায়ুন আজিজ মুস্তাকিমকে তার বাবা আদর করে ডাকত—খুকু। ফ্রক পরাত। ঘটিহাতা হাফ প্যান্ট পরত, মাথায় ফিতে বাঁধত, একবার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আবার তাকে শাড়িও পরানো হয়েছিল। তার চমত্কার দাড়ি গোঁফ গজিয়েছে, পৌরুষেয় অঙ্গও জেগে উঠেছে তবু সে খুকুই রয়ে গেছে। তার বন্ধুরা তো খুকু ছাড়া অন্য কোনো নামে কখনো ডাকেনি। তার নববিবাহিত স্ত্রী মাইশাও বলে, খুকু সিগারেটটা ছেড়ে দাও না প্লিজ। কিংবা খুকু তোমার তো হেভি পারফোর্মেন্স!

দ্বিতীয় খুকু তার ফ্রি প্রাইমারি স্কুলজীবনের সবচেয়ে মোটাসোটা ক্লাসমেট খুকুরাণী সমাদ্দার। তাদের ক্লাস টিচার বলেছেন সবাই নিরাপদ দূরত্বে থেকো—খুকু যদি কারো উপরে গড়িয়ে পড়ে সে কিন্তু চিড়ের মতো চ্যাপ্টা হয়ে যাবে।

খুকু তার একটা না একটা দোষ ধরে চড় থাপ্পর মারত, কান ধরে উঠবস করাত। মন্টুর হাতের লেখা খারাপ, এজন্য শাস্তি দিত; নিচু হয়ে তাকালে তার নাকে ভেতর সর্দি দেখা যায় কেন এই অপরাধেও খুকুর মার তার অবশ্যপ্রাপ্য হয়ে উঠত। তবে সে তার বিরুদ্ধে টিচারের কাছে বিচার দিতে পারে এই ভয়ে টিফিন টাইমে স্কুলের গেটে কুলিং ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আইস্ক্রিমওয়ালার কাছ থেকে মিল্ক আইস্ক্রিম কিনেও খাওয়াত। দু-চারটা চড় খেলেও আইস্ক্রিম পাবার পর মারটা পুষিয়ে যেত। খুকু অকারণে, কারণে কেন তাকে মারত, সে-ই ভালো জানে।

তৃতীয় খুকুর বাম চোখটা ট্যারা হতে পারে। সম্ভবত এই সেই খুকু।

চতুর্থ খুকুর নাম সচিবালয়ের খুকু। খবরের কাগজ তার ছবি ছেপেছে, শিরোনামে লিখেছে: মক্ষীরাণী খুকুর সাম্রাজ্য। মন্ত্রী, সচিব, চিফ ইঞ্জিনিয়ার, এমডি প্রায় সবাই তার উষ্ণ শরীরের ছোঁয়া পেয়েছিল। বিনিময়ে তার হাতে তুলে দিয়েছেন রাষ্ট্রের অনেক মেগাপ্রজেক্টের ওয়ার্ক অর্ডার। সেই খুকুর সাথে মন্টু কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয়। সেই খুকুর তালিকায় আঠার হাজার নাম ও ফোন নম্বর থাকতে পারে, তারা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মন্টু নামের কেউ নেই।

মন্টু দ্রুত লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট পরে, সাদা টি-শার্টে গা ঢাকে, কমোড চেক করে, আবার দরজার পাশে এসে দাঁড়ায়, পুরনো আমলের দরজায় স্পাইহোল না থাকায় দরজায় চোখ লাগিয়ে দেখে যে খোলা না খোলার সিদ্ধান্ত নেবে তার উপায় নেই। দরজা খুলতে দেরি হওয়ায় কলিং বেল আবার বেজে ওঠে।

খুলছি।
নারীকন্ঠ এবার ধমকে ওঠে। দরজা খুলতে কতক্ষণ লাগে?

ছিটকিনি খুলতেই প্রায় হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে সম্পূর্ণ বোরকাঢাকা এক নারী। চেহারা না দেখা পর্যন্ত তার বয়স ঊনিশ না ঊনআশি তা বলা সম্ভব নয়।

কে, কি, কেন—এসব প্রশ্ন উড়িয়ে দিয়ে খুকু বলল, আগে দরজা বন্ধ করুন। পাঁচ মিনিট বসে কথা বলে চলে যাব, আপনাকে অস্থির হতে হবে না। আমিই খুকু। গতকাল আমার গায়ে হলুদ হয়েছে। যদি সব ঠিকঠাক থাকে আগামীকাল আপনার সাথে আমার বিয়ে। অবশ্যই যদি সব ঠিকঠাক থাকে।

পরস্পরকে তুমি বলার মতো কথোপকথন তাদের হয়নি—এ নিয়ে মন্টু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নয়। বিয়ের রাতেই আপনি ও তুমির ফয়সালা হয়ে যাবে। বিয়ের রাতে মন্টুর মা আলেয়া বেগম তার বাবাকে তুমি সম্বোধন করেছিলেন, এতে নসরুল্লাহ সাহেব ঈষত্ ক্ষিপ্ত হন এবং বলেন, বয়সে আমি তোমার চেয়ে এগার বছরের বড় এটা মাথায় রেখে কথা বলো। অবশ্য দিন বদলে গেছে। একুশ বছরের বড় স্বামীকে স্ত্রী অবলীলায় তুমি বলতে থাকে।

বোরকার পর্দা পুরোটা সরাতে মন্টু থ হয়ে গেল। এত কাছে থেকে তো আগে দেখেনি। তরতাজা রক্তমাংসের এ সুন্দর তরুণী, রাতভর বিশ্লেষণ করে যে খুঁতটি বের করেছিল সেই বাম চোখটিকে আর ট্যারা মনে হচ্ছে না।

হঠাত্ মন্টু আনমনা হয়ে পড়ে—প্যান্ট পরেছে ঠিকই, কিন্তু জিপার কি টেনেছিল—মনে করতে পারছে না। তাড়াতাড়ি একটা পুরনো খবরের কাগজ কোলের উপর রাখে—এ জায়গাটা অন্তত ঢাকা পড়ুক।

একটু প্রকৃতিস্থ হবার পর মন্টুই বলল, কষ্ট করে আপনাকে এতদূর আসতে হলো। একটা ফোন করলেই হতো। সব যে ঠিকঠাক নেই সেটা তো বেশ অনুমান করতেই পারছি। আমি আসলে কোনো কিছু লুকোতে চাইনি। সে জন্যই সত্যটা চিঠিতে লিখেছি।

খুকু বলল, ঠিকই করেছেন।

মন্টু বলল, আমি বুঝতে পেরেছি পারিবারিক চাপে আপনাকে সম্মতি দিতে হয়েছে। আপনি এ নিয়ে ভাববেন না; রিজেক্ট করাটাই স্বাভাবিক। ঘটনা যাই হোক আমাকে বলতেই হবে, এটা আমার প্রথম বিয়ে না, দ্বিতীয় বিয়ে। লন্ডনে আসার পর যখন ইলল্যিগাল ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে ধরা পড়লাম, ডিপোর্ট করবেই, সে সময় এক ইমিগ্রেশন লইয়ার বললেন টাকা খরচ করতে পারলে ডিপোর্টেশন ঠেকিয়ে দিতে পারবেন। তখন আমার মায়ের বয়সের কাছাকাছি এক বিধবা গ্যাব্রিয়েলা আন্ডারউডকে বিয়ে করলাম। আমি পরের ১২০ দিন গ্যাব্রিয়েলার অ্যাপার্টমেন্টেই ছিলাম; উকিল আর গ্যাব্রিয়েলা মিলে বাকি কাজটা করেছে। অনেকগুলো কাগজে সই করতে হয়েছে। এর মধ্যে বিয়ের কাগজ রয়েছে। কাজেই আমার অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে গ্যাব্রিয়েলা আন্ডাউডকে আমি বিয়ে করিনি এবং তিনি আমার প্রথম স্ত্রী নন। তার অনুরোধে আমি তাকে গ্যাবি ডাকতাম।

একটু দম নিয়ে মন্টু বলল, গ্যাব্রিয়েলা যদি সবটাই টাকার জন্য করত তাহলে ভয়ঙ্কর অসুস্থ হবার পর আমাকে সস্তা হাসপাতালের বিছানায় রেখে পালিয়ে যেত। কিন্তু তার যতটা সম্ভব দেখাশোনা করেছেন। আমার কাগজপত্র বৈধ হবার পর ডিভোর্স করেছেন। আপনার দিক থেকে আমি বলব ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অসুবিধে নেই। আমি ঝর্ণা আপুকে বলে দিচ্ছি, সামলে নেবে। তাছাড়া আমাদের পক্ষে গেস্ট সংখ্যা খুব বেশি নয়। ফোনেই বলে দেওয়া যাবে।

এতক্ষণ শুনে খুকু বলল, আপনার কথা কি শেষ হয়েছে?

মন্টু বলল, হ্যাঁ মূল কথাটা, মানে যে কথাটা আমি লুকোতে চাইনি তা বলা হয়ে গেছে। তার মানে প্রকৃতপক্ষে আপনার সাথে আমার বিয়েটা কোনোভাবেই আমার প্রথম নয়, দ্বিতীয় বিয়ে। আপনি কিছুটা দেরিতে হলেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপনাকে আমার যথেষ্ট সুন্দরী মনে হয়েছে, আপনি অবশ্যই একজন ফ্রেশ হাজব্যান্ড, আগে যে ভাবেই হোক বিয়ে করেনি—এমন একজনের দাবি জানিয়ে আমাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। আমিও মিথ্যে দিয়ে জীবন শুরু করতে চাই না।

খুকু বলল, আপনার কথার রিপিটেশন হচ্ছে। আমি মহিলাদের মতো এক কথা বারবার বলা পছন্দ করি না।

মন্টু একটুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে বলল, সরি।

খুকু বলল, আপনি যে বিষয়গুলো বলেছেন আমি সাত বছর বয়সেই এসব শুনেছি। আমার সবচেয়ে বড়ভাই লন্ডনের হ্যাম্পস্টিড এলাকায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, আর একটু হলে ডিপার্টেড হতে যাচ্ছিল। তখন আইরিশ এক উকিল এক হাজার পাউন্ড চুক্তিতে অ্যানাবেল সুইনবার্গ নামের প্রায় পয়ষট্টি বছর বয়সী এক ইংলিশ ইহুদি নারীর সাথে আমার পচিঁশ বছর বয়সী ভাইয়ার বিয়ের আয়োজন করে। বিয়ের কাগজপত্র সই হয়। এগুলো ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে দাখিল করা হয়। কথা ছিল ছয়মাস পর কাগজে কলমে আমার ভাইকে ছেড়ে নতুন কোনো ক্লায়েন্টকে খুঁজবে।

যদিও আমার ভাইয়ার বলতে গেলে কোনো উপার্জনই ছিল না অ্যানাবেল প্রতিমাসে দেড়শ পাউন্ড করে একটা অ্যালাউন্স দিতে শুরু করল। তারপর একসময় তার রুমভাড়াই বাঁচিয়ে দেবার জন্য তার বাড়িতে তুলে আনল এবং তারা সত্যি সত্যিই স্বামী-স্ত্রীর জীবন যাপন শুরু করল। তার ভয় ছিল ইয়ং হবার কারণে কখন না আমার ভাই তাকে ডাম্প করে চলে যায়। ভাইয়া তা করেনি। আরো তিন বছর পর অ্যানাবেল সুইনবার্গ মারা গেলে ভাইয়া এতটাই কষ্ট পায় যে বাকি জীবন বিয়ে না করে থাকার প্রতীজ্ঞা করে বসে। মাত্র গত বছর তার প্রতীজ্ঞা ভেঙে একটি বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করেছে। আপনার ব্যাপারটা আমার কাছে কোনো বিষয়ই নয়। আমার কথাটা শোনার পর আপনার সিদ্ধান্ত যত দ্রুত আমাকে জানাবেন তত দ্রুত আমি বাড়ি ফিরে যেতে পারব। দেখতে পাচ্ছেন বোরকা পরে এসেছি। বোরকাটা বুয়ার। সে-ই বেরোতে সাহায্য করেছে। এখন সে আমার রুম ভেতর থেকে বন্ধ করে শুয়ে বা বসে আছে। আমার তিন টোকার সিগন্যাল শুনলে দরজা খুলবে, আমি ভেতরে চলে যাব, সে বোরকা নিয়ে বেরিয়ে আসবে।

বলুন, কী বলতে চাচ্ছেন?

গতকাল সকালে হলে নিশ্চিতভাবে বলতে পারতাম না। আজ পারছি কারণ মধ্যরাতে লুকোনো প্রেগন্যান্সি কিট দিয়ে ইউরিন টেস্ট করেছি। পজেটিভ। মানে আমি প্রেগন্যান্ট। আপনি প্রেগনেন্সির সাথে জড়িত কোনো প্রশ্ন যেমন কাজটা কে করল, তার সাথে কতদিনের সম্পর্ক এমন কিছু জিজ্ঞেস করতে পারবেন না। আপনাকে সিদ্ধান্তটা পাঁচমিনিটের মধ্যেই জানাতে হবে—আমার পেটের সন্তান আপনার নয় জেনেও আমাকে বিয়ে করবেন না করবেন না? আপনার উত্তরও আমি জানি। উত্তরটা না। তবুও আপনার নিজের মুখ থেকে শুনলে আমার সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে—কিংবা আমি যে সিদ্ধান্ত নেব সে জন্য কোনো গিল্ট ফিলিং থাকবে না।

তার কথাটা মন্টুর কানে কতটা ঢুকেছে সে-ই জানে। তা অনেকক্ষণ ধরে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি আসলেই অনেক সুন্দর।

খুকু বলল, ধ্যাত্ পিতলা আলাপ ছাড়েন। যা জিজ্ঞেস করেছিলাম তার জবাব দেন। সময় আছে আর সাড়ে তিন মিনিট। আপনি আমাকে তুমি বলতে শুরু করলেন নাকি? বয়সে বড় হলেই তুমি বলার অধিকার জন্মায় না। শুনুন আমার প্রেগন্যান্সি নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে পারবেন না, আমি বলেছি। কিন্তু আপনার মনে প্রশ্ন থাকলে আছে, থাকারই কথা। আপনার সিদ্ধান্তের সুবিধের জন্য আপনি জিজ্ঞেস করার আগেই কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিচ্ছি: প্রথমত: এই সন্তানটির বাবা যে আমি তাকে একটুও ভালোবাসি না—কাজেই তাকে বিয়ে করার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাহলে এমআর-এর নামে একটা গর্ভপাত করিয়ে নিলেই তো হয় সব ঝামেলা মিটে যাবে। আমি এমআর চাই না, আমি বেবিটাকে চাই। আপনাদের পক্ষ থেকে যখন আমাকে দেখতে আসে তখনও আমার একই অবস্থা। কিন্তু ভেতরের দিকটা তো দেখা যায় না। এটা জানলে যারা আমাকে সুন্দর বলেছে সবাই ছিঃ ছিঃ করতে থাকবে। আর একটা কথা শুনুন প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছি বলে আমি অথৈ সাগরে পড়েছি এটা যদি মনে করেন তবে ভুল করবেন। আমি যে অবস্থায় আছি সব জেনেশুনে একজন আমাকে বিয়ে করার জন্য একজন অপেক্ষায় আছে। শুধু আমার মুখের হা শুনতে চায়। বলতে পারেন তাহলে আমি তাকে এখনই বিয়ে করছি না কেন? এখানেও একটি বাস্তব সমস্যা আছে। তার ভালোবাসার কারণে আমি তাকে বিয়ে করতে রাজি কিন্তু আমার সন্তানটিকে ভরণপোষণ করার মতো সামর্থ্যও তার নেই। অথচ আমার বেবি আমার ফার্স্ট প্রায়োরিটি। এই বেবির বাবা কে সে প্রশ্ন আমার কাছে অবান্তর। আপাতত বাকি রইলেন আপনি। এখন পর্যন্ত আমার মনে হচ্ছে আমাদের দুজনের—মানে আমার আর আমার বেবির ভরণপোষণের সামর্থ্য আপনার আছে। আর ভালোবাসার কথা—কাছাকাছি থাকলে আমাদের জন্য আপনার ভালোবাসা সৃষ্টি হবে, আপনার জন্যও আমার হবে। আপনি রিজেক্ট করে দিলে সমস্যা মোটেও নেই, কারণ আমাকে যারা ভালোবাসতেই চেয়েছে তাদের কেউ না কেউ বেবিসহ আমার সাথে সংসার করতে রাজি হয়েও যেতে পারে, হয়তো সে আপনার চেয়েও যোগ্য পাত্র। এমন কাউকে যে পাবই সে আত্মবিশ্বাস আমার কোত্থেকে এলো—এটা জিজ্ঞেস করতে পারেন। আমার জবাবটা আত্মম্ভরী মনে হলেও সত্যটা তো বলতেই হবে—এটা সুন্দর হবার অ্যাডভান্টেজ। আমি জানি আমি আর দশটা মেয়ের চেয়ে দেখতে বেশি সুন্দর।

মন্টু মুখ খুলল, সাড়ে তিন মিনিটের পুরোটা তো আপনিই নিয়ে নিলেন। আমার জন্য কি তার তিরিশ সেকেন্ডও থাকবে না?

সময় দিয়ে লাভ নেই। উত্তর আমি জানি। তবুও আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। আমারও গিল্ট ফিলিংসটা যাতে না হয় সে জন্যই বোরকা পরে হাজির হয়েছি। আমার কথা শোনার জন্য ধন্যবাদ। চললাম। আপনি প্যান্টের জিপার টানুন।

মন্টুর যতটা বিব্রত হবার কথা হলো না। উঠে দাঁড়িয়ে খুকুর কাঁধে হাত রেখে প্রত্যয়ী কণ্ঠে তুমি সম্বোধন করেই বলল, তোমার সামনে আমার প্যান্টের জিপার খোলা কি বন্ধ তাতে কিছু এসে যায় না। কারণ আমি রাজি। আর জেনে রেখো ঐ বেবিটা আমারই। মানে তোমার আর আমার।

এবার খুকু আবেগবিহ্বল হলে বলল, মানে?

মন্টু বলল, বেবিটা হিসেবের একটু আগে হবে এই তো? চিন্তা নেই আমিই রটিয়ে দেব তোমার সাথে আমার আগে থেকেই ওরকম শোওয়াশুয়ির একটা সম্পর্ক ছিল।

মন্টু দু’হাত বাড়াতে খুকু তার হাতের বেস্টনির মধ্যে এসে বোতাম উলট-পালটের কারণে বুকের কাছের বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গায় মুখ রেখে কামড়াতে শুরু করল। মুখ তুলে বলল, তুমি মিথ্যে বলছো না তো?

মন্টু বলল, সেটা পরীক্ষা করার জন্য কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করার কী দরকার। তুমি থেকে যাও। তোমাকে আর বুয়ার বেশে ফেরার দরকার নেই।

খুকু বলল, না, কাল রাত থেকে তো তোমার সাথেই থাকব।

মন্টু খুকুকে রিকশায় তুলে দেয়। বলে, খুকু হ্যাভ অ্যা সেইফ জার্নি।

খুকুও মুখ ঘুরিয়ে আড় চোখের ইশারায় দেখায়, জিপার টানো মন্টু। বাইরে অন্য মানুষ।

পাদটীকা
মন্টু খুকুকে মিথ্যে কথা বলেছে। লন্ডনের গ্যাব্রিয়েলা অ্যান্ডারউড মোটেও বিধবা ছিল না, তার মায়ের বয়সীও নয়। গ্যাব্রিয়েলা তখন তারই সমবয়সী মোটামুটি সুন্দরী ইংলিশ তরুণী। কোনো উকিল তাকে যোগাড় করে দেয়নি। মায়ের বয়ফ্রেন্ডের হাত থেকে বাঁচার জন্য এসেক্স থেকে লন্ডনে চলে এসেছে। হাই, হ্যালো করতে করতে মন্টুর সাথে একটা মিষ্টি সম্পর্ক হয়েছে। মন্টুকে ধরে রাখার জন্য বিয়ের আয়োজন সে-ই করে। তারা একসাথে সাড়ে চার বছর স্বামী-স্ত্রীর জীবনও যাপন করে। গ্যাব্রিয়েলা যখন একটা বাচ্চার জন্য উতলা হয়ে উঠে মন্টু তাকে বলে তুমি যদি কনসিভ করতে না পারো সেটা কি আমার দোষ? তোমার প্রবলেম আছে, চেক করাও।

এবার গ্যাবি বলে চেক করানোর দরকার নেই। আমার মার বয়ফ্রেন্ড আমাকে প্রেগন্যান্ট বানিয়ে দিয়েছিল। আমার মা-ই অ্যাবর্ট করানোর ব্যবস্থা করে দেয়। আর তুমি বাস্টার্ড বলছো আমি কনসিভ করতে পারি না।

ভাঙন ধরে যায়। মাস তিনেকের মধ্যে গ্যাবিই মন্টুকে ডিভোর্স করে। মন্টু তার দুর্বলতা জানে বলেই যথেষ্ট আস্থার সাথে খুকুকে বলে, অবশ্যই তোমাকে বিয়ে করব।

মন্টু জিপার টানতে টানতে খুকুর দিকে আবার তাকায়। খুকুর রিকশা ততক্ষণে আরো এক ঝাঁক রিকশার মধ্যে হারিয়ে গেছে।

   

ফেরদৌস আরার প্রবন্ধের আলপথ বেয়ে পাঠক চলে যান জ্ঞানের সমুদ্রদর্শনে



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘লেখকের প্রচুর অধ্যয়ন, পাঠগভীরতা, নিবিড় অনুসন্ধিৎসা, ঘোরলাগা শব্দপুঞ্জে, ভাষার শিল্পিত সুষমায় লেখাগুলি প্রাণ পেয়েছে। তাই গ্রন্থের তথ্যসমৃদ্ধ বারোটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য শুধু নয়, নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, জানার তাগাদা তৈরি করবে—বোধে, তৃষ্ণায়, জীবনজিজ্ঞাসায়। নিজের কথাই বলি, ফেরদৌস আরা আলীমের চোখ দিয়ে পড়তে পড়তে আমি নিজে প্রায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আফরোজা বুলবুল কিংবা প্রতিভা মোদক (‘যে জীবন শিল্পের, যে শিল্প জীবনের’), করুণা বন্দোপাধ্যায়, রবিশংকর বলকে (‘চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর’) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে আস্বাদ করি সময়-পরিক্রমায় লেখক ফেরদৌস আরা আলীমের কলমের ক্ষুরধার ক্রমমুগ্ধকর সৌন্দর্য।’

শনিবার (৪ মে নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক গলিতে অবস্থিত মাসিক নারীকণ্ঠ পত্রিকা-আয়োজিত ‘বই আলোচনা’-অনুষ্ঠানে ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আলপথে শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের মূল আলোচকের আলোচনায় তহুরীন সবুর ডালিয়া এসব কথা বলেন। বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনায় আরও অংশ নেন নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা জিনাত আজম, সালমা রহমান ও মাধুরী ব্যানার্জী।

নারীকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আহমেদ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শাহরিয়ার ফারজানা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতারী ইসলাম বলেন, ‘নানা বিষয়ে ফেরদৌস আরা আলীমের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সহজভাবে তিনি আমাদের সমাজবাস্তবতার যে-চিত্র আঁকেন তা মনের গভীরে সাড়া জাগায়। তার লেখা পড়ে এটুকু বলতে পারি যে, তার লেখা আমাদের জন্য গবেষণা ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান আকর।’

প্রবন্ধের আলপথে বইয়ের প্রকাশক, কবি ও খড়িমাটি-সম্পাদক মনিরুল মনির বলেন, ‘নারীমুক্তি বিষয়ে এ-বইয়ে দুটি তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে আরও কাজ করার জন্য গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রকাশিত বই নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘বড় কিছু হওয়ার কথা ভেবে লিখিনি, মনের আনন্দেই গোপনে গল্প-কবিতা লিখেছি। এমন একসময়ে আমরা লিখতাম, লেখা প্রকাশ করতে খুব লজ্জাবোধ করতাম। অবশ্য লিখতে গিয়ে তেমন কঠিন বাধা আমাকে ডিঙোতে হয়নি। একালের চেয়ে আমাদের সময়টা ছিল অনেক সুন্দর ও ভালো। মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল সমাজে। গণ্ডগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে চড়ে ঢাকা গিয়েছি একা-একা, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। মা-বাবারাও নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকাল মেয়েরা পদে-পদে বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের কলুষিত সমাজব্যবস্থা ও নষ্ট রাজনীতি।’ সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রশংসার ভূমিকা কম নয়। একজন লেখক তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য পেলে অনুপ্রাণিত হন যা তাকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি জোগায়।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা ও সদস্য রোকসানা বন্যা, মহুয়া চৌধুরী, রেহানা আকতার, সাহানা আখতার বীথি, কানিজ ফাতেমা লিমা, বিচিত্রা সেন, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, চম্পা চক্রবর্ত্তী, প্রচার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জয়, কবি মেরুন হরিয়াল ও কবি মুয়িন পারভেজ প্রমুখ।

;

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

;

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;