পাতার ঘর



নাহার মনিকা
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

“বাগান বিক্রি করে দিব।”
“ওখানে তিহানকে নিয়ে যাব।”

রান্নাঘর থেকে শায়লা, আর শোবার ঘর থেকে আমি বেরিয়ে দুজনে মুখোমুখি হয়ে একযোগে কথা বলে বাক্যহারা হয়ে গেলাম!

শায়লা ওড়না মুখে চেপে কাঁদতে শুরু করল, যেন শব্দ না হয়, যেন তিহানের ঘুম ভেঙে না যায়। সে বাগান বিক্রির ঘোর বিরোধী।

তাহলে এখন কি উপায়? প্রবল মাথা নাড়ে সে, জানে না। সে শুধু ছেলেকে নিয়ে আব্বার বাগানে যেতে চায়।

এটা দুদিন আগে দুপুরের ঘটনা।

আমাদের গ্রামের বাড়ির পেছনে ফলফলাদির গাছ নিয়ে যে বাগানটা নোঙ্গর করা জাহাজের মতো নিঃশব্দ দাঁড়িয়ে আছে, আমার কখনো সেদিকটায় যাওয়ার আগ্রহ হয়নি। শায়লা আর তিহান মিলে সেই জাহাজটা সচল করে দিয়েছে। আমি এখন বাগানটাকে ভরসা করার মতো করে দেখছি।

লক-ডাউন উপেক্ষা করে অফিসে এসেছি। ইশতিয়াক স্যারও এসেছেন। স্টাফদের বেতন দেওয়ার আগে কিছু কাজ বাকি। ফাইলগুলো আমার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে চান।

আজকে প্রথমবারের মতো হেঁটে অফিসে এলাম। শেষ কবে এতটা পথ হেঁটেছি, মনে নেই। মাস্ক মুখে, ক্যাপ, সানগ্লাস, ব্যাকপ্যাক নিয়ে বাইরে বের হওয়ার আগে ভেবেছি একটা রিক্সা অন্তত পেয়ে যাব। কিন্তু রাস্তা ফাঁকা, রিক্সা তো দূর মানুষই হাতে গোনা। কিছুদূর হাঁটার পর অবশ্য শরীরের ম্যাজম্যাজে ভাব কেটে গেল। রিক্সায় যে রাস্তা চল্লিশ মিনিট লাগে, সে পথে আধঘণ্টা হেঁটে অফিসের দরজায় পৌঁছে গেলাম! দুপাশের বাড়িঘর, গাছপালা দেখতে দেখতে রাস্তার পাশের একসারি দেবদারু গাছের কচি মসৃণ পাতায় চোখ আটকে গেল! আব্বা আমাদের বাড়ির সামনে দেবদারু গাছ লাগিয়েছিল। বাড়ির পেছনে বাগানেও কি ছিল?

ইশতিয়াক স্যার আগেই পৌঁছে গেছেন। এমন নিশ্চুম অফিসেও আগে কোনোদিন আসিনি। স্বাভাবিক সময়ের সরগরম পরিবেশ মাথার ভেতর ঢুশ দিয়ে যাচ্ছে। ফোন, কম্প্যুটারের ঘড়ি এখন আর সেকেন্ডের কাঁটা দেখায় না। আমি পালস দেখার মতো ধীরে ধীরে সেকেন্ড গুনি মনে মনে। এক গোনার পর নাতিদীর্ঘ একটি শ্বাস, বুড়ো আঙুল কব্জির কাছের নীলচে শিরাতে তিনটে আঙ্গুলে অল্প চাপ দিয়ে ধরে রাখতে হবে। দুই, তিন...পাঁচ। তিহান এভাবে শিখেছে তার দাদুর কাছে। আমি শিখেছি তিহানের কাছে।

এগারটা চল্লিশে ইশতিয়াক স্যার জুতার মচ মচ শব্দ তুলে অফিস থেকে চলে যাওয়ার আগে আমাকে বলবেন—“ফাহমিদ সাহেব আর ঘণ্টাখানেক থাকেন।”

কিন্তু আমার থাকতে হবে আরো ঘণ্টা তিনেক, আমি জানি। ইশতিয়াক মাহমুদের একঘণ্টা মানে আমার তিন ঘণ্টা। আশিদিনে ভূ-প্রদক্ষিণের কাহিনীর মতো আমার সময় পৃথিবীর গতির মধ্যে হাপিশ হয়ে যায়।

এখন মাত্র দশটা বেজেছে, আমি একটা-দেড়টার আগে বের হচ্ছি না। শায়লা পাথুরিয়া যাওয়ার গাড়ি ভাড়া করতে চাইছে আগামীকাল। আসলে আমারও যেতে ইচ্ছে করছে। যে ইচ্ছে আব্বা বেঁচে থাকতে তেমন একটা করেনি।

দেবদারু গাছের কি বনসাই হয়? তিহানের মামাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। তার বনসাইয়ের শখ এখন নেশায় রূপ নিয়েছে। বাড়ির ছাদ থেকে শুরু করে আনাচে কানাচে রকমারি বনসাই। বনসাই জিনিসটা শায়লা অপছন্দ করে। শ্লেষের কণ্ঠে ভাইকে বলে—“মানুষকেও তাইলে বাইন্ধা বাইন্ধা ছোট করে রাখার ব্যবসা খুলতে পারো। এত বড় ঘরবাড়ি লাগবে না। মুরগির খোপের মতো খোপ বানায়া ঢুকায় দিয়ো। গাছেদের যে কষ্ট হয় সেইটা কি সে বোঝে?”

শায়লা নাকি শৈশব থেকেই এমন গাছ পাগল মেয়ে। বন জঙ্গলে গেলে মাথা ঠিক থাকে না। তিহানের মামা গাছ নিয়ে বোনের নানা কীর্তি বলে, উলটো বোনকে খ্যাপায়—“কপাল খারাপ তোর, এই দেশে তো আর জঙ্গল নাই, সব সাফ। বনসাই ভরসা।”

গতকালকে সকালে তিহানের জ্বর আসেনি। ইলিশ মাছের ডিম দিয়ে ভাত খেয়েছে বলে শায়লাও খুশি। আমার কাছে ওকে ঘুম পাড়াতে দিয়ে সে বাথরুমে গোসল সারতে ঢুকল।

তিহানকে বুকের ওপরে নিয়ে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছি, বড় হয়ে কী হতে চায়, এসব কুটুর কুটুর গল্পে এসে আমি বললাম—“তিহান, বাইশ বৎসর বয়েসের মধ্যে পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করতে হবে। তারপর তোমাকে বিয়ে করায় দিব।”

তিহানের ক্লান্ত কিন্তু তখনও উৎসাহী স্বর। বলে—“বাবা দাদুবাড়িতে বিয়ে করব? খুঁজতে হবে তো!” ছেলেটা দাদুকে ভুলতে পারে না। ওর শিশুমনের জন্য খুব তাজা স্মৃতি রেখে আব্বা না ফেরার দেশে চলে গেছে আজকে চারমাস।

আমার চোখে ঘুম নেমে আসছে, কিন্তু তবু সিরিয়াস কথা চালিয়ে যাই—“আমাদের দেশে পড়ালেখা করতে গেলে খালি খালি কতগুলি বছর নষ্ট হয়। ক্লাস ওয়ানে উঠতে প্লে-গ্রুপ, কেজি ওয়ান, কে টু কত হাবিজাবি! সিস্টেম লস। ছেলেমেয়েদের জীবন শুরু করতে ত্রিশ পয়ত্রিশ বছর বয়স হয়ে যায়। তুই একুশ বছরে পড়া শেষ করে বাইশ বছরে চাকরি পাবি। তারপর খুব ধুমধাম করে তোর বিয়ে দিব। বউ নিয়ে ব্যবিলন ঘুরতে যাবি।” হঠাৎ আমার ঘুমভাব চটে যায়। আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করি যে, এতক্ষণ ছোটবেলায় বলা আব্বার ছাড়া ছাড়া কথা ঘুরিয়ে বাড়িয়ে বলছিলাম!

“বাবা, শীত লাগে, বাবা পিঠে ব্যথা করে।” তিহানের সাত বছরের মসৃণ কপাল আগুন গরম, আবার জ্বর বেড়েছে। ও ঘুমিয়ে গিয়ে একটু পরে আবার ব্যথায় কঁকিয়ে জেগে ওঠে। শায়লা দৌড়ে এসে আমার কাছ থেকে প্রায় ছোঁ মেরে ওকে নিয়ে নিল। কম্বলে জড়িয়ে কোলে নিয়ে হাঁটে, আর নিজে গরমে ঘামতে থাকে। কালকে রাতে প্রায় সারারাত জেগে ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে। বেরিয়ে আসার আগে ওকে জাগাইনি।

ফাইলগুলো গুছিয়ে নিয়ে বাসায় বসে কাজ করব। কিন্তু পারব কি? তিহান ওর বিছানা থেকে প্রায় নামেই না বলতে গেল, অথচ পুরো বাসা জুড়েই সে। কোথায় বসে মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারব, ভাবছি। মনোসংযোগ করার দক্ষতা আমার আয়ত্তে ছিল, কিন্তু ইদানীং বড়শি ফসকে যাওয়া মাছের মতো চলে যাচ্ছে।

এখন আমার মন পরে আছে টিফিন বক্সের লাঞ্চে। আজকে অফিসে লাঞ্চ আনতে হলো। বাইরে দোকানপাট বন্ধ, খোলা থাকলেও খাওয়া চলবে না। মিষ্টিকুমড়া নিরামিষে কালোজিরা আর রসুনের ফোঁড়ন। শায়লা আগে রুটি দিয়ে দিত, কিন্তু আজকে ভাত নিয়েছি আমি। ফ্রিজ খুলে একটা বালুসাইও এনেছি। তিহানকে দেখতে এসে ওর মামা দু সপ্তাহ আগে এনেছিল। তখন আমরা ওর পাসপোর্ট করার কথা বলছিলাম। দেশে না। মুম্বাই, না কি ঠাকুর পুকুর যাব, এইসব। ওর মামা বলছিল একেবারে বাম্রুনগ্রাদ নিয়ে যেতে। ব্লাড টেস্টের পর শিশুরোগবিশেষজ্ঞ আরো কতগুলি টেস্টের সঙ্গে বায়োপসি করতে দিলেন, তখন থেকে আমরা অস্থির হয়ে আছি, কোথায় নিয়ে যাওয়া যায়। এখন ঘরবন্দী দিনে দেশের ডাক্তার হাসপাতালই ভরসা। তাই এসব আর বলে লাভ নেই, বলি না। কিন্তু বিরতিহীন ভাবছি, যাব। কিন্তু যাওয়ার জন্য রসদ চাই।

বাড়ির পেছনের বাগান বেচে দেয়ার কথা শুনে শায়লা কাঁদতে শুরু করল। আব্বা কোনো কোনো ভয়াবহ বিপদেও এই বাগান বিক্রির কথা ভাবেনি, সে শুনেছে সেসব গল্প। গাছগুলো তিহান আর তার দাদুর যৌথ স্মৃতি। হেন ফলের গাছ নেই যা আব্বা লাগায়নি। একটা ভালো জাতের পেয়ারা চারা আনতে আরেক জেলায় গেছে।

আমি ধমক দিলাম—“এই সময়ে কিছু বেচব বললেই কি বিক্রি করা যায়? গাহেক পাব?”
“তিহান ঐখানে গেলে ভালো হয়ে যাবে।”
“বেকুবের মতো কথা বলবা না”—একথা শায়লাকে বলি না। ওইই ঠিক এটা বিশ্বাস করতে মন চায়।

এসব কথা তখন এক কান দিয়ে শুনে অন্য কানে যাতায়াতের পথে যেটুকু অবশিষ্ট থেকেছে, তা-ই এখন তিহানকে শোনাই।

অথচ আমি যখন হাইস্কুলে, পরিষ্কার সাদা ড্রেস, জুতো মোজা পরে প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে আম্মা আঁচলে হাত মুছে কপালে চুমু খেয়ে বিদায় দেয়ার সময় আব্বা পেছনবাড়ির দরজা থেকে সুড়ুক করে হাজির হতো। তার কাদামাখা পা, হাতে মাটির দলা, দাড়িগোঁফেও আগাছা ঘাস লেগে আছে। আমার ধোপদুরস্ত কাপড় জামার পাশে আব্বা ছিল দূরের, অনাত্মীয়ের মতো। টিফিনের জন্য লুঙ্গির খুট খুলে আধময়লা টাকা দিলেও আমি বিরক্ত হতাম। হাতে ধরে আমার টিফিনের জন্য আনা গাছপাকা কোনো পেয়ারা বা আতাফল নেওয়ায় কোনো আগ্রহ ছিল না আমার।

আব্বা কি আমার মনের ভাব টের পেত? তার মুখের ওপর কড়া রৌদ্রে আচমকা মেঘের মতো একটা পাতলা ছায়া এসে নামত। বুঝতে পারলেও পাত্তা দিইনি।

আমার সঙ্গে আব্বার দূরত্বকে নিকট বানিয়ে নিয়েছিল শায়লা।

দু বছর আগে অফিসের ট্রেনিংয়ে সিঙ্গাপুর গেলাম। শায়লা বায়না ধরল পাথুরিয়ায় গিয়ে থাকবে। তিহানের স্কুল? সে নিজেই পড়াবে। দাদুর সঙ্গে নাতির প্রকৃতি পাঠ হবে। স্কুলে পিছিয়ে যাওয়ার ঘোরতর বিরোধী আমি, কিন্তু শায়লা শুনলে তো! একবছর না কি দেখতে দেখতে কেটে যাবে, এটা নাকি তিহানের জন্য বিরাট সুযোগ। অবশ্য ঢাকায় একা বাসায় মা ছেলে থাকার চেয়ে গ্রামের বাড়ি নিরাপদ, এই যুক্তি মেনে নিতেই হলো। ভাইয়ের বাসায় কিছু জিনিসপত্র রেখে তারা পাথুরিয়া গেল।

সেই একবছরে মুখচোরা লাজুক ছয় বছরের ছেলেটা দিন দিন দুরন্ত হয়েছে। শায়লা খুশিতে ডগমগ করতে করতে খবর দিত—আজকে তিহান নারকেল গাছ বেয়ে ওপরে উঠেছে। দাদুর সঙ্গে খেজুর গাছ থেকে রসের হাড়ি নামিয়েছে। পরেরদিন, সে ভাত খায়নি, বড় এক ফজলী আম একবসায় খেয়ে ঘুম দিয়েছে। সাঁতার শিখছে! দাদুর সঙ্গে মাছ ধরতে গেছে। নাতির জন্য খেলনা কাস্তে এনেছে দাদু, ক্ষেতে নিড়ানি দিচ্ছে। সফেদা ফল খেতে ভালোবাসে বলে গাছের সব ফল পেড়ে খাটের নিচে রেখে দিয়েছে। কাদামাটি মাখা তিহানের ছবি তুলে পাঠায় শায়লা। আমি রাগ করতে গিয়ে নিজেকে সংবরণ করি। আর মাত্র কয়েকটা মাস, তারপর পাথুরিয়া যাওয়া বন্ধ। পড়ালেখা বাদ দিয়ে যত্তসব হাবিজাবি শেখায় উৎসাহ।

এক বৎসরকাল দাদুবাড়িতে কাটিয়ে তিহান ফলের বাগান সমন্ধে রাজ্যের তথ্য নিয়ে ফিরেছে। ওর অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমার অনীহাপ্রসূত স্মৃতি জোড়াতালি দিতে গেল ধরা পড়ে যাই।

তিহান ডাইনে বাঁয়ে মাথা দোলায়, বলে—“হলো না বাবা, আরেকটু ঐদিকে, লম্বা কদবেলগাছের পাশে দাদুর যে মিস্রিদানা আম আছে না? তারও আরেকটু পরে মিষ্টি জামগাছ। ঐ জাম খেয়ে আমি আর দাদু জিভের রঙ বেগুনী করে ফেলতাম।”

আমার স্কুলজীবনে ঐ জামগাছটা কি ছিল?

“আর তুমি তো আমাদের পাতার ঘর দেখোই নাই। দাদু ঐ জামগাছের নিচে একটা সত্যি সত্যি সবুজ পাতার ঘর বানায় দিছিল আমাকে! আমরা ওখানে দুপুরে ঘুমাইছি। ঝি ঝি পোঁকা কানে তালা লাগায় ডাকত। দাদু আমাকে নারকেল পাতা দিয়ে কত কিছু বানায় দিত! ঘড়ি, আংটি, মুকুট। আর বলত—আমি হচ্ছি পাতা রাজকুমার, হি হি হি।”

ঐ ঘর আছে এখনো?

জাহান্নামে যাক বাগান। বিক্রির বাজারদর যাচাই করতে এখানে সেখানে ফোন করি। যত দ্রুত পারা যায় বিক্রি করতে হবে। তিহানের ডাক্তার চেম্বারে বসছে না। ফোন করলে ধরছেও না।

পিজি হাসপাতালে শায়লার ভাইয়ের বন্ধুর পরিচিত ডাক্তার আছে, তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালাচ্ছি।

এগারোটা পঁচিশ। অফিসের সময় কি নড়ছে না? অনেকদিন হলো হাতঘড়ি পরা ছেড়ে দিয়েছি। হাতঘড়ি তিহানের খুব পছন্দ। সিঙ্গাপুর থেকে ওর জন্য একটা ক্যাসিও ঘড়ি এনেছিলাম। মিনিটের পর সেকেন্ডগুলি লটারি খেলার স্লট মেশিনের বলের মতো সরসর করে নেমে যায়। আজকাল ঘড়িটা নিয়ে তিহান বিছানার ঠিক মাঝখানে বসে। চারপাশে অনেকগুলো হাবিজাবি খেলনা ছড়িয়ে রাখে, স্পাইডার ম্যান, লোগোর বাক্স। একেক সময় সে তার ঘড়ির ছোট নীল রঙ প্লাস্টিকের ডায়ালের দিকে পলক না ফেলে চেয়ে থাকে। তখন মনে হয় যে, সাত না। ওর বয়স অনন্তকাল। আগের মতো খেলার জন্য হুটোপুটি করে না। ফ্যানের বাতাসের সঙ্গে সখ্য করতে বাইরের বাতাস উড়ে এসে ঢোকে। বারান্দার গ্রিলে অহেতুক একটা ধূসর পাখি এসে বসে। গুরুক গুরুক ডাকে। তিহান চমকে একঝলক দেখে। তারপর আবার ঘড়ির ডায়ালে চোখ ফেরায়।

দুদিন হলো ঘড়িটায় সেকেন্ডের সংখ্যাগুলো ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। আগের মতো গড়গড়িয়ে জলপ্রপাতের মতো নামছে না। কোনোভাবে পানি ঢুকে গেছে কি? তিহানের ফুসফুসের মতো! ওর মিনিট থেকে সেকেন্ডের সংখ্যাগুলি নাই হচ্ছে?

তিহান কালকে রাতে কিছু খেতে চাইছিল না। শায়লা খাবার নিয়ে যতবার মুখের কাছে ধরছে, ততবার সে বাঁ হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছিল। ওর ছলছল চোখে বুকভর্তি বিতৃষ্ণা। অনেকক্ষণ ধৈর্য্য ধরে একসময় শায়লা আবারও ওড়নায় চোখ চেপে শোবার ঘরে ঢুকে গেল শায়লা।

কিছুসময় পরে শান্ত হয়ে ফিরল। ছেলের কাছে বসে বলল—“দাদুবাড়ি যাবি?”
তিহানের চোখ যেন চকচক করে উঠল!

“আমি ভাইয়াকে বলছি গাড়ি ভাড়া করতে। আমরা পাথুরিয়া যাচ্ছি।” তারপর স্যুটকেস নামিয়ে কাপড় গুছিয়েছে শায়লা।

এগারোটা পয়তাল্লিশ বাজল। ইশতিয়াক স্যার বেরিয়ে গেল। এবার আমি একহাতে টিফিনবক্স খুলি।

অন্যহাতে একটা করে অক্ষর টিপে বিক্রয় বিজ্ঞপ্তি টাইপ করতে থাকি “এক বিঘা জমিতে অতি যত্নে তৈরি ফলদায়িনী গাছভর্তি বাগান বিক্রি হবে। ”

ভাত খেতে ইচ্ছে করছে না। একপাশে সরিয়ে রেখে শুরুতেই বালুসাইতে কামড় দিলাম। চিনির সঙ্গে দাঁতের ফাঁকে বালু কড়মড় করে উঠল।

   

ফেরদৌস আরার প্রবন্ধের আলপথ বেয়ে পাঠক চলে যান জ্ঞানের সমুদ্রদর্শনে



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘লেখকের প্রচুর অধ্যয়ন, পাঠগভীরতা, নিবিড় অনুসন্ধিৎসা, ঘোরলাগা শব্দপুঞ্জে, ভাষার শিল্পিত সুষমায় লেখাগুলি প্রাণ পেয়েছে। তাই গ্রন্থের তথ্যসমৃদ্ধ বারোটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য শুধু নয়, নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, জানার তাগাদা তৈরি করবে—বোধে, তৃষ্ণায়, জীবনজিজ্ঞাসায়। নিজের কথাই বলি, ফেরদৌস আরা আলীমের চোখ দিয়ে পড়তে পড়তে আমি নিজে প্রায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আফরোজা বুলবুল কিংবা প্রতিভা মোদক (‘যে জীবন শিল্পের, যে শিল্প জীবনের’), করুণা বন্দোপাধ্যায়, রবিশংকর বলকে (‘চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর’) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে আস্বাদ করি সময়-পরিক্রমায় লেখক ফেরদৌস আরা আলীমের কলমের ক্ষুরধার ক্রমমুগ্ধকর সৌন্দর্য।’

শনিবার (৪ মে নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক গলিতে অবস্থিত মাসিক নারীকণ্ঠ পত্রিকা-আয়োজিত ‘বই আলোচনা’-অনুষ্ঠানে ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আলপথে শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের মূল আলোচকের আলোচনায় তহুরীন সবুর ডালিয়া এসব কথা বলেন। বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনায় আরও অংশ নেন নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা জিনাত আজম, সালমা রহমান ও মাধুরী ব্যানার্জী।

নারীকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আহমেদ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শাহরিয়ার ফারজানা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতারী ইসলাম বলেন, ‘নানা বিষয়ে ফেরদৌস আরা আলীমের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সহজভাবে তিনি আমাদের সমাজবাস্তবতার যে-চিত্র আঁকেন তা মনের গভীরে সাড়া জাগায়। তার লেখা পড়ে এটুকু বলতে পারি যে, তার লেখা আমাদের জন্য গবেষণা ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান আকর।’

প্রবন্ধের আলপথে বইয়ের প্রকাশক, কবি ও খড়িমাটি-সম্পাদক মনিরুল মনির বলেন, ‘নারীমুক্তি বিষয়ে এ-বইয়ে দুটি তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে আরও কাজ করার জন্য গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রকাশিত বই নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘বড় কিছু হওয়ার কথা ভেবে লিখিনি, মনের আনন্দেই গোপনে গল্প-কবিতা লিখেছি। এমন একসময়ে আমরা লিখতাম, লেখা প্রকাশ করতে খুব লজ্জাবোধ করতাম। অবশ্য লিখতে গিয়ে তেমন কঠিন বাধা আমাকে ডিঙোতে হয়নি। একালের চেয়ে আমাদের সময়টা ছিল অনেক সুন্দর ও ভালো। মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল সমাজে। গণ্ডগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে চড়ে ঢাকা গিয়েছি একা-একা, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। মা-বাবারাও নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকাল মেয়েরা পদে-পদে বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের কলুষিত সমাজব্যবস্থা ও নষ্ট রাজনীতি।’ সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রশংসার ভূমিকা কম নয়। একজন লেখক তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য পেলে অনুপ্রাণিত হন যা তাকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি জোগায়।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা ও সদস্য রোকসানা বন্যা, মহুয়া চৌধুরী, রেহানা আকতার, সাহানা আখতার বীথি, কানিজ ফাতেমা লিমা, বিচিত্রা সেন, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, চম্পা চক্রবর্ত্তী, প্রচার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জয়, কবি মেরুন হরিয়াল ও কবি মুয়িন পারভেজ প্রমুখ।

;

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

;

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;