বঙ্গবন্ধু : এক সূর্যবংশীর কথা



চন্দন চৌধুরী

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বন্ধুবান্ধবরা বলে, “তোমার জীবনী লেখো।” সহকর্মীরা বলে, “রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাগুলি লিখে রাখো, কাজে লাগবে।” আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, “বসেই তো আছো, লেখো তোমার জীবনের কাহিনী।” বললাম, লিখতে যে পারি না; আর এমন কী করেছি যে লেখা যায়!’ - বঙ্গবন্ধু

‘একদিন সন্ধ্যায় বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিয়ে জমাদার সাহেব চলে গেলেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট্ট কোঠায় বসে বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছি...। আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণু—আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরো একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’ - বঙ্গবন্ধু

১৯৬৬-৬৯ সালে কারাবন্দি অবস্থায় নিজের জীবনের ঘটনাগুলি চারটি খাতায় লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই লেখাগুলো নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। কিন্তু সেই খাতাগুলো পাওয়া গেল অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন জীবনের ১৯৫৫ সালের ঘটনা পর্যন্ত। জেলে বসে লেখা জীবনের অনন্য দিনগুলোর দলিল এনে রেখেছিলেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে। বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘর লাগোয়া ছিল ড্রেসিরুম। এতে একটি আলমিরা। তার এক কোণে রাখা ছিল খাতাগুলো। গুছিয়ে রেখেছিলেন স্ত্রী বেগম ফজিলাতুননেছা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মতো ২৬ মার্চ রাতেও হানাদার বাহিনী বাড়িটিতে হানা দেয়, ভাঙচুর ও লুটপাট করে। দখলে নেয় বাড়িটা। খাতাগুলো তখন বাড়িতেই ছিল। আলমিরাতে এগুলোর সঙ্গে ছিল বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা, ডায়েরি, ভ্রমণ কাহিনী ও বেগম ফজিলাতুননেছার হিসাবের খাতাও। বাড়ি তো লুটপাট হলো। কিন্তু এই খাতাগুলো নেবে কে? যুদ্ধের দিনে সের দরে বেচলেও যে লাভ হবে না! আর তাই বুঝি আসল রত্নগুলো ফেলে গেল মাথামোটা লুটেরার দল। যুদ্ধের মাঝেও খাতাগুলো থেকে গেল অক্ষত।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে ৩২ নম্বর বাড়িটাও আরেকদফা খুন হয়। রক্তেভেজা বাড়িটিকে সিল করে দেয় সরকার। তারপর কয়েকটি বছর ঘুমিয়ে কাটায় বাড়িটি। ১৯৮১ সালের ১৭ মে প্রবাস থেকে ফেরেন বঙ্গবন্ধুর বেঁচে যাওয়া মেয়ে শেখ হাসিনা। কিন্তু তাঁকেও ঢুকতে দেওয়া হলো না বাড়িতে। প্রায় একমাস পর ১২ জুন বাড়িটিতে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়। নিজের বাড়িটা তখন খাঁ খাঁ করছিল। শেখ হাসিনা খুঁজে দেখেন সবকিছু। পেয়ে যান বাবার লেখা স্মৃতিকথা, ডায়েরি ও চীন ভ্রমণের খাতাগুলো। কিন্তু আত্মজীবনীর খাতাগুলো কোথাও দেখতে পান না। তবে কি এগুলো খুনীদের হাতে চলে গেছে! কিছু ফুলস্কেপ কাগজ পেয়ে যান। টাইপ করা। কাগজগুলোর কিছু ইতোমধ্যেই পোকার অধিকারে চলে গেছে। অনেকগুলোরই অর্ধেকের বেশি নেই। দু’ একটা শব্দ পড়ে বোঝা যাচ্ছিল এগুলোতে টাইপ করা ছিল আত্মজীবনীটি! কিন্তু এগুলোর মর্মার্থ উদ্ধার করা যাবে না। শেখ হাসিনা অনেক খুঁজলেন। কিন্তু খোঁজ পেলেন না সেই চার খাতার।

প্রকাশিত হয় বঙ্গবন্ধুর লেখা স্মৃতিকথা, নয়া চীন ভ্রমণ ও ডায়েরি। এর মাঝে আমেরিকার জর্জ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এনায়েতুর রহিম বঙ্গবন্ধুর ওপর গবেষণা করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। তখন বঙ্গবন্ধুর জীবন, স্মৃতিকথা ও ডায়েরি নিয়েও কাজ করেন। এগুলোকে বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদের কাজটিও শুরু করেন তিনি। তবে তার মৃত্যুতে সাময়িকভাবে থেমে যায় কাজটি। পরে এটি এগিয়ে নিয়ে যান প্রফেসর সালাহউদ্দীন আহমদ ও শামসুল হুদা হারুন। সঙ্গে অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান, বেবী মওদুদ ও শেখ হাসিনা সম্পাদনার কাজগুলো করেন।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। মারা যান তার দলের ২৪ জন। এই দুঃখের মাঝে উঁকি দিলো তাঁর বাবার হস্তাক্ষর। সেই চারখান খাতা! এত বছর তবে কোথায় জীবিত ছিল এগুলো! এনে দিলেন শেখ হাসিনারই এক ফুফাত ভাই। এই খাতাগুলো পাওয়া গিয়েছিল বাংলার বাণী সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণির অফিসের ড্রয়ারে। শেখ হাসিনা ধারণা করেন সম্ভবত আত্মজীবনীটি কম্পোজ করার জন্য দিয়েছিলেন তাঁর বাবা। হতে পারে ছাপানোর জন্যই কম্পোজ করতে দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৫ আগস্টের দুঃখজনক ঘটনায় থমকে গিয়েছিল সবকিছুই। খাতাগুলো হাতে পেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা কাঁদলেন। এ যে তাঁদের বাবার লেখা। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুভব করলেন প্রিয় বাবাকে। খাতাগুলোর পাতা হলুদ, জীর্ণ ও নরম হয়ে গেছে। অনেক জায়গার লেখাগুলো ঝাপসা। একটা খাতার মাঝখানের কয়েকটা পাতা নষ্ট, পাঠোদ্ধার কঠিন। তাই শেখ হাসিনা একটা বুদ্ধি করলেন। তিনি আর বেবী মওদুদ পালা করে রিডিং পড়তেন, কম্পোজ করতেন আরেক জন। এসময় কোনো কোনো লেখা বোঝার জন্য তাঁরা ম্যাগনিফাইং গ্লাসও ব্যবহার করেছেন। এসব কাজে সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নেন শেখ রেহানা। অতঃপর প্রকাশনী সংস্থা ইউপিএল প্রকাশ করল এই অসামান্য বইটি। যা সমকালীন বাংলা আত্মজীবনী সাহিত্যে সবচেয়ে আলোচিত বই।

এই আত্মজীবনীতে উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর বংশ পরিচয়, শৈশব, স্কুল ও কলেজের শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথা। সেখান থেকে তুলে ধরা কয়েকটি গল্পের সঙ্গে যোগ করা হলো কবিদের কাব্যস্বর :

জন্মেছিলেন টিনের ঘরে!
টুঙ্গিপাড়ার শেখ বংশের এক সময় বেশ নাম ডাক ছিল। এই বংশের গোড়াপত্তন করেছিলেন শেখ বোরহানউদ্দিন নামে এক ধার্মিক ব্যক্তি। মুঘল আমলে এই বংশের লোকজন বেশ শানশওকতের সঙ্গেই ছিলেন। কারণ সেই প্রমাণ এখনো মেলে। মুঘল আমলের দালানগুলোর ভগ্নদশা এখনো টুঙ্গিপাড়ায় আছে। বাড়ির চার ভিটে চারটি দালান। যেহেতু সেগুলো বাসের অযোগ্য হয়ে গিয়েছিল তাই তাদের বংশধরেরা এ বাড়ির চারপাশে টিনের ঘর তুলে বসবাস করতে শুরু করেন। এই টিনের ঘরেই জন্মেছিলেন মহানায়ক বঙ্গবন্ধু। টুঙ্গিপাড়া নিয়ে তাই লেখালেখিরও অভাব নেই:

“ঘুম পাড়ানি বনকা পিসি ঢ্যাপের মোয়া খেও
আমার বাড়ি টুঙ্গিপাড়া একটু বসে যেও।
শালুক দেব ইছন বিছন নেইকো শীতল পাটি,
দস্যুসেনা ঘর লুটেছে করছে খাঁ খাঁ গাঁটি।

ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকড়ি কুতুর কুতুর ছা,
টুঙ্গিপাড়া শেখের বড়ি উইড়া সেথায় যা।”
[রাখাল রাজার জন্যে/ খালেক বিন জয়েন উদ্দীন]

রাজনীতির সংস্পর্শে এলেন যেভাবে
সেটা ১৯৩৮ সালের কথা। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। তাঁরা গোপালগঞ্জে এলেন। সভা হলো। সব কিছু হলো শান্তিপূর্ণভাবে। হক সাহেব গেলেন পাবলিক হল দেখতে আর সোহরাওয়ার্দী সাহেব মিশন স্কুল। শেখ মুজিবুর তখন মিশন স্কুলের ছাত্র। তাই তাঁকে সম্বর্ধনা দিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী স্কুল পরিদর্শন করে হাঁটতে হাঁটতে লঞ্চের দিকে চললেন। শেখ মুজিবও চললেন সঙ্গে সঙ্গে। তিনি বঙ্গবন্ধুকে কাছে ডেকে বললেন, ‘তোমাদের এখানে মুসলিম লীগ করা হয় নাই?’ শেখ মুজিব বললেন, ‘কোনো প্রতিষ্ঠান নাই। মুসলিম ছাত্রলীগও নাই।’ একথা শুনে সোহরাওয়ার্দী আর কিছুই বললেন না। পকেট থেকে নোটবুক বের করে লিখে নিলেন শেখ মুজিবুরের নাম ও ঠিকানা। তারপরের ঘটনা শুধু ইতিহাস। আর তাই তিনি বঙ্গবন্ধু। আর তাঁকে ছাড়া আজ যেন ইতিহাসও হয় না, হয় না জাতির পরিচয়ও :

“এই ইতিহাস ভুলে যাব আজ, আমি কি তেমন সন্তান?
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;
তাঁরই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলার পথ চলি—
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস, পায়ে উর্বর পলি।”
[আমার পরিচয়/ সৈয়দ শামসুল হক]

কিংবা—
“বাঙালি কি বাঙালি হয় শাড়ি, ধুতি, লুঙ্গি ছাড়া?
থাকে না তার বর্গ কিছুই না থাকলে টুঙ্গিপাড়া।
সুর অসুরে হয় ইতিহাস, নেই কিছু এ দু’জীব ছাড়া
বাংলাদেশের ইতিহাসে দেবতা নেই মুজিব ছাড়া।”
[বঙ্গবন্ধু : আদিগন্ত যে সূর্য / অজয় দাশ]

চোখের অপারেশন করতে যাওয়ার সময় পালাতে চেয়েছেন খোকাবাবু
চশমা ছাড়া বঙ্গবন্ধুকে দেখেছেন, সেটা খুবই কম। অধিকাংশ ছবিতেই দেখা যায় তিনি চশমা পরে আছেন। কিন্তু এই চশমা পরার পেছনেও আছে এক কাহিনী। চোখের অপারেশনের জন্য তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল কলকাতা মেডিকেল কলেজে। ডাক্তাররা তাঁর চক্ষু অপারেশনের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন দেরি করলে অন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নির্ধারণ করা হয়, অপারেশন করা হবে ভোর ন’টায়। শেখ মুজিবুরের বয়স তখন ষোল। তবুও তিনি ভয়ে কাত। করলেন কী, চেষ্টা করলেন পালানোর। কিন্তু ধরা পড়ে গেলেন। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো অপারেশন থিয়েটারে। দুই চোখ অপারেশন হলো দশ দিনে। এবং ভালো হয়ে গেলেন তিনি। তবে শর্ত ছিল, কিছুদিন লেখাপড়া বন্ধ রাখতে হবে, পরতে হবে চশমা। সেই থেকে, মানে ১৯৩৬ সাল থেকেই চশমা পরছেন বঙ্গবন্ধু। সেই চশমা নিয়ে হলো কবিতা :

“আমাদের ঘরে চশমাপরা এক ভদ্রলোকের ছবি। মোটা ফ্রেমে চশমায় তাকে ঠিক কবি কবি লাগে। বাবাকে জিজ্ঞেস করলে বলেন—‘তিনি সাত কোটি জনতার কবি। তাঁর হাতের স্পর্শ আছে আমাদের পতাকায়।’ সেদিন স্কুলে যাওয়া-আসার পথে ছবিটিকে দেখি আর ভাবি ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করা যায় কী করে! একদিন আমি যখন ভাবছিলাম ছবিটিই আমাকে দেখে বলে—‘শোনো, সারা জীবনে আমি একটিই কবিতা লিখেছি—বাংলাদেশ।’ সেদিন থেকে স্কুল যাবার পথে প্রতিদিন আমি তাঁর চশমার গ্লাস পরিষ্কার করে দিই, তিনিও হেসে পরে নেন।”
[বালকের চশমাপরা বন্ধু/ চন্দন চৌধুরী]

পিতা পুত্রের ফুটবল খেলা
শেখ মুজিব ও তাঁর বাবা দুজনেই ভালো খেলোয়াড় ছিলেন। বাবা ছিলেন অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি। আর শেখ মুজিবুর মিশন স্কুলের ক্যাপ্টেন। তাঁদের দুজনের টিমে যখন খেলা হতো তখন জনসাধারণ খুব উপভোগ করত। হবেই না কেন? এমন ঘটনা তো খুবই বিরল। সেই বিরল ঘটনার কথা শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন এভাবে :
‘১৯৪০ সালে আব্বার টিমকে আমার স্কুল টিম প্রায় সকল খেলায় পরাজিত করল। অফিসার্স ক্লাবের টাকার অভাব ছিল না। খেলোয়াড়দের বাইরে থেকে আনত। সবই নামকরা খেলোয়াড়। বৎসরের শেষ খেলায় আব্বার টিমের সঙ্গে আমার টিমের পাঁচ দিন ড্র হয়। আমরা তো ছাত্র; এগারজনই রোজ খেলতাম, আর অফিসার্স ক্লাব নতুন নতুন প্লেয়ার আনত। আমরা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আব্বা বললেন, “কাল সকালেই খেলতে হবে। বাইরের খেলোয়াড়দের আর রাখা যাবে না, অনেক খরচ।” আমি বললাম, “আগামীকাল সকালে আমরা খেলতে পারব না, আমাদের পরীক্ষা।” গোপালগঞ্জ ফুটবল ক্লাবের সেক্রেটারি একবার আমার আব্বার কাছে আর একবার আমার কাছে কয়েকবার হাঁটাহাঁটি করে বললেন, “তোমাদের বাপ ব্যাটার ব্যাপার, আমি বাবা আর হাঁটতে পারি না।’

সে খেলায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু হেরে গিয়েছিলেন বাবার দলের সঙ্গে। পুত্র হয়ে পিতার কাছে হারাটা লজ্জার কিছুও ছিল না। পরে সেই পুত্রই হয়ে গেলেন জাতির পিতা:

“হঠাৎ জানতে চাইলেম
‘খোকা’
লোকটির বসবাস কোথা!

প্রথম জন
দ্বিতীয় জন
শেষ জন
এক বাক্যে উচ্চারণ করলেন,

লোকটির বসবাস
বাঙালির হৃদয়পুরে।

জাতির জনকের ডাক নাম ‘খোকা’।”
[হৃদপুরে/ মাকিদ হায়দার]

মনে ছিল এক কবির বাস
বঙ্গবন্ধু ছিলেন সৌন্দর্যের পূজারী। আর তাই দেখা যায় শৈশব থেকেই তিনি তাজমহল দেখার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। আর এটা দেখার জন্য একটা সুযোগও বের করে ফেলেছিলেন। তরুণ মুজিব যখন তাজমহল দেখলেন তখন তার প্রকাশ ছিল এরকম : “সূর্য যখন অস্ত গেল, সোনালি রঙ আকাশ থেকে ছুটে আসছে। মনে হলো, তাজের যেন আরেকটা নতুন রূপ। সন্ধ্যার একটু পরেই চাঁদ দেখা দিলো। চাঁদ অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে আসছে আর সাথে সাথে তাজ যেন ঘোমটা ফেলে নতুন রূপ ধারণ করেছে। কী অপূর্ব দেখতে! আজও একুশ বৎসর পরে লিখতে বসে তাজের রূপকে আমি ভুলি নাই, আর ভুলতেও পারি না।”
[অসমাপ্ত আত্মজীবনী/ শেখ মুজিবুর রহমান]

শুধু কি তাই! একবার আব্বাসউদ্দিনের সঙ্গে নৌকায় এক জায়গায় যাচ্ছিলেন। নৌকায় গান গাইছিলেন আব্বাসউদ্দিন। সেই গান শুনে শেখ মুজিবুর লিখেছিলেন, ‘পথে পথে গান চলল। নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালী গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে।’

একজন কবি না হলে কি তিনি এমন সুন্দর করে লিখতে পারতেন। তাঁর অন্তরে ছিল এক কবি। আর তাই বুঝি ৭ মার্চের সেই মহান কবিতা তিনি লিখেছিলেন সাত কোটি বাঙালিকে সামনে রেখে : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।...’

বিচিত্র ঘটনার অসংখ্য রঙ আমরা পাই এই মহানায়কের জীবন থেকে। তাঁর লেখায়, ছবিতে, ইতিহাসে...আমাদের মনের স্বপ্নের বুননে।

লেখক : কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রকাশক-বেহুলাবাংলা

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;