রবীন্দ্রনাথ, আপনিই পারেন
বাঙালির সামনে আজ সমূহ সংকট উপস্থিত। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সর্বোপরি আত্মপরিচয়ের সংকট যেন তার ক্রমশই প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছে। বাঙালির রাজনীতি আজ সন্ত্রাস আর দুর্বৃত্তায়নের অপর নাম। সামাজিক শৃঙ্খলা ও সংহতি দ্রুত অপস্রিয়মাণ। শিল্প ও সংস্কৃতি আত্মবিস্মরণ আর অনুকরণসর্বস্বতায় আকণ্ঠ আকীর্ণ। এর অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ, সে তার প্রকৃত পরিচয়টুকু পর্যন্ত যেন হারাতে বসেছে আজ। কিংবা হয়তোবা আত্মপরিচয়ের সংকটই তাকে ক্রমে ঠেলে দিচ্ছে অবধারিত পতন ও ধ্বংসের কিনারে।
বাঙালির সবচেয়ে বড় পরিচয় তার ভাষা ও সংস্কৃতি, প্রায় একক প্রচেষ্টায় যার ভিত্তি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, আপনি স্বয়ং। শুধু তা-ই নয়, তাকে জগৎসভায় পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছিলেন আপনি স্বদেশ ও স্বজনের প্রতি দুর্মর দায়বদ্ধতায়। আজ বাঙালির এই সংকটকালে পুনরায় ফিরে যেতে চাই তাই রবীন্দ্রনাথ আপনারই কাছে, কেননা আপনার হাতেই তো আমরা প্রথম বাঙালিত্বের দীক্ষা নিয়েছিলাম। আপনার জীবন ও কর্মের অনিঃশেষ ঐশ্বর্য আর অফুরান শক্তির ভেতর থেকেই আমরা আজ খুঁজে নিতে চাই আমাদের পরিত্রাণের প্রেরণা ও মুক্তির মন্ত্রণা।
প্রিয় রবীন্দ্রনাথ, আপনিই পারেন আমাদের অন্তর্গত হীনম্মন্যতা দূর করে বিশ্বসভায় পুনরায় বাঙালিত্বের গৌরবে মাথা তুলে দাঁড়াবার প্রেরণা যোগাতে। বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করে সেই কবে আপনি নোবেল পুরস্কার ছিনিয়ে এনেছিলেন আমাদের জন্য; বাঙালির নিজস্ব পোশাক পরিধান করে আপনি আবিশ্ব পরিভ্রমণ করেছেন প্রাচ্যদর্শন আর শান্তি ও সম্প্রীতির বাণী প্রচারের লক্ষ্যে। নিজের বাঙালি পরিচয়টুকু আপনি যে-রকম গর্বের সঙ্গে বিশ্বময় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শতবর্ষ আগে, সেই আত্মপরিচয়ের গৌরবটুকু আপনি আমাদের মধ্যে সঞ্চার করে দিন পুনরায়।
আপনিই পারেন রবীন্দ্রনাথ, সাহসের সঙ্গে সত্য উচ্চারণ ও অন্যায়ের প্রতিবাদে আমাদের উদ্বুদ্ধ করতে। আপনি যে-অপরিসীম সাহস ও শৌর্যের সঙ্গে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের সমালোচনা করে নাইটহুড প্রত্যাখ্যান করেছিলেন; বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের অন্তর্নিহিত স্ববিরোধ ও সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতার প্রতিবাদে এক পর্যায়ে তা বর্জন করেছিলেন; উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের তীব্র নিন্দা করেছিলেন যুগপৎ; জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে পশ্চিমা সভ্যতার নির্মমতা, কপটতা ও অমানবিকতার কড়া সমালোচনা করেছিলেন ‘সভ্যতার সংকট’ ভাষণে; আপনার সেই অতুলনীয় সৎসাহসটুকু আজকের শিরদাঁড়াহীন ভীরু বাঙালির মধ্যে প্রবাহিত করে দিন কবি।
আপনিই পারেন আমাদের নিজস্ব শেকড়টুকু চিনে নিয়ে তাকে জীবনের সাথে মিলিয়ে নেবার শিক্ষা দিতে। আপনি নিজে অভিজাত পরিবারের সন্তান ও নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও মাটি ও মানুষের কাছাকাছি থেকেছেন সর্বদা। গ্রামে গ্রামে ঘুরে সংগ্রহ করেছেন ছেলেভোলানো ছড়া, পল্লীকবি জসীম উদদীনকে দিয়ে লিখিয়েছেন গ্রামজীবনের গাথা, মুহম্মদ মনসুর উদ্দীনকে দিয়ে সংগ্রহ করিয়েছেন ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ আর নিজে হাসন রাজা, লালন ফকিরের রচনা ও দর্শনকে শ্লাঘার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। নিজস্ব ঐতিহ্যের প্রতি আপনার এই অকৃত্রিম অনুরাগ ও মাটিঘেঁষা কৃষ্টিকে ভালোবাসার এই অপার ক্ষমতাটুকু আপনি ঐতিহ্যবিমুখ, শেকড়বিস্মৃত বাঙালির চেতনায় বিকশিত করুন আরেকবার।
আপনিই পারেন আমাদের যাবতীয় কূপমণ্ডুকতা, অন্ধ সংস্কার, জাতিবিদ্বেষ, পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণা বিসর্জন দিয়ে মুক্তচিন্তা, যুক্তিবাদিতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, আধুনিকতা ও মানবতান্ত্রিক প্রগতিশীলতার দীক্ষা দিতে। আপনি নিজে কবি হয়েও বিজ্ঞানের অনুরাগী ছিলেন, এতটাই যে, আপনি আইনস্টাইনের সঙ্গে আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে আলোচনা করেছেন সমানে সমানে; বাঙালি বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন আপনার প্রিয়তম বান্ধব। নিজেও আপনি রচনা করেছেন ‘বিশ্ব পরিচয়’ এর মতো মূল্যবান বিজ্ঞানগ্রন্থ। আপনি ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন ‘বিসর্জন’, ‘অচলায়তন’, ‘রবিবার’ এর মতো সাহসী সব রচনায়। নারীস্বাধীনতার পক্ষে কলম ধরেছেন ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘যোগাযোগ’ ও আরো অনেক লেখায়। নিজের পুত্রকে বিধবা বিবাহ করায় উৎসাহ দিয়েছেন। জাতপ্রথা ও অস্পৃশ্যতার সরব প্রতিবাদ করেছেন ‘চণ্ডালিকা’ নৃত্যনাট্যে। বিহারের ভূমিকম্পকে ‘ঈশ্বরের অভিশাপ’ আখ্যা দেওয়ায় মহাত্মা গান্ধীর সমালোচনা করতে আপনি পিছপা হননি। হিটলার, মুসোলিনির ফ্যাসিবাদের সমালোচনা করেছেন, আবার সমালোচনা করেও আস্থা রেখেছেন সোভিয়েত রাশিয়ার সাম্যতন্ত্রে। শিলাইদহে মুসলিম প্রজাদের বসতে দিয়েছেন হিন্দু রায়তদের সঙ্গে একাসনে। আপনার এই অগ্রসর চিন্তা, আধুনিক মানসিকতা আর উদার, সংস্কারমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ভাবনার আলোকে অনগ্রসরতার অন্ধকারে ক্রমনিমজ্জমান আমাদেরকে উদ্ভাসিত করুন আরবার।
আপনিই পারেন আমাদের সব আলস্য আর নিষ্ক্রিয়তা দূর করে দিয়ে কর্মের স্পৃহা আর সৃষ্টির উদ্দীপনায় উজ্জীবিত করতে। আপনি নিজে কবি ও শিল্পী বলে গজদন্তমিনারবাসী হয়ে থাকেননি কখনো। সাগ্রহে হাত লাগিয়েছেন নানান সাংগঠনিক কাজে। পূর্ববাংলার শাহজাদপুর আর পতিসর গ্রামের কৃষকদের সাহায্যার্থে স্থাপন করেছেন এই অঞ্চলের প্রথম কৃষি ব্যাংক, শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘বিশ্বভারতী’র মতো অগ্রসর ও ব্যতিক্রমী বিশ্ববিদ্যালয়। তার পাশেই শ্রীনিকেতনে গ্রামোন্নয়নের বিবিধ কর্মযজ্ঞের আয়োজন করেছেন। চাঁদপুরের কালীমোহন ঘোষকে দিয়ে সমবায় প্রথা চালু করেছেন আপনার পৈতৃক জমিদারিতে। আপন পুত্র ও জামাতাকে কৃষি ও উদ্যানবিদ্যা শিখতে পাঠিয়েছেন সুদূর আমেরিকায়। পরিবেশচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে চালু করেছেন বৃক্ষরোপণ আর হলকর্ষণ উৎসব। ইন্দোনেশিয়া থেকে দেখে এসে বাটিকশিল্পের প্রচলন করেছেন শান্তিনিকেতনে, সেখানকার মেয়েদের জুজুৎসু শিখিয়েছেন আত্মরক্ষার উপায়স্বরূপ।
আপনার সেই অদম্য, অনিঃশেষ কর্মস্পৃহা আর প্রাণশক্তির যে-বিচিত্র ও বহুমুখী বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে জীবনভর, তার তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতরই হবে কেবল। তাই সে প্রচেষ্টায় আপাতত ক্ষান্তি দিয়ে শুধু এটুকুই বলি, নিছক দিনযাপনের আর প্রাণধারণের গ্লানিতে প্রায় জীবন্মৃত আমাদেরকে আপনি আপনার সঞ্জীবনী মন্ত্রে জাগিয়ে তুলুন রবীন্দ্রনাথ, আর একটিবার। নইলে যে এই অতলস্পর্শী পতনের পথ থেকে আমাদের ফিরে আসার কোনো পথই খোলা রইবে না আর।