উত্তর-উপনিবেশবাদ ও বাংলাদেশের সাহিত্য : একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা



মাসুদুজ্জামান
অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

  • Font increase
  • Font Decrease

১. উত্তর-উপনিবেশবাদ ও বাংলাদেশ
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ। পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের মতো দীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা শাসিত হওয়ার পর একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয় ঘটে এর। ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে অন্যান্য অনেককিছুর মতো সাহিত্য যে বৈশিষ্ট্য অর্জন করে, স্বাধীনতার পর তা অনেকটাই বদলে যায়। একটি সদ্যস্বাধীন দেশের সাহিত্য উপনিবেশের চিহ্ন যেমন তার শরীরে ধারণ করতে বাধ্য হয়, তেমনি উত্তর-ঔপনিবেশিক পরিবেশ পরিস্থিতির দ্বারাও প্রভাবিত হয়। সেজন্যেই দেখা যায়, আধুনিক কালের উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলির সাহিত্যে তার নিজস্ব এমন কিছু লক্ষণ ফুটে ওঠে, যেসব লক্ষণ অন্যান্য রাষ্ট্রের সাহিত্য থেকে আলাদা। বাংলাদেশের সাহিত্যের ওই সব বৈশিষ্ট্য কমবেশি লক্ষ করা যাবে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের সাহিত্য বলে আমরা যে সাহিত্যের উল্লেখ করে থাকি, তা অনেকটাই রাজনীতিস্পৃষ্ট। তবে সরলরেখায় নয়, উত্তর-ঔপনিবেশিক বাংলাদেশের রাজনীতি যেমন আঁকাবাকা পথে অগ্রসর হয়েছে, বাংলাদেশের সাহিত্যের গতিপ্রকৃতিও তেমনি বিসর্পিল। উপনিবেশ-উত্তর সাহিত্যের এই লক্ষণগুলি সনাক্ত করতে হলে বাংলাদেশের রাজনীতির একটা রূপরেখা তুলে ধরা জরুরি বলে মনে করি।

একথা আমাদের আজ আর অজানা নেই যে দু-দুটো উপনিবেশের অধীন ছিল বাংলাদেশ; প্রথমে ব্রিটিশদের, পরে পাকিস্তানিদের। দীর্ঘদিন ধরে উপনিবেশের অধীনে থাকলে যেমন হয় বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই ঘটেছে। স্বাধীনতার পর অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক এবং জীবনযাপনের নানা ক্ষেত্রে যেমন নৈরাজ্য ও বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে, তেমনি এসব নৈরাজ্য কাটিয়ে এ-দেশকে আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে হচ্ছে। লড়তে হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক আত্মস্বাতন্ত্র্য এবং উন্নত জীবনমান অর্জনের জন্যে। এ সংগ্রাম যে খুব সহজে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে, তা বলা যাবে না। কোনো কোনো সময়ে বিরোধের মাত্রাটি বেশ জটিল ও সংঘাতময় ছিল। তবে এতসব জটিলতার মধ্যেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অর্জন করেছে অভূতপূর্ব সাফল্য। আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের ভবিষ্যতবাণী হিসেবে ‘মধ্য-আয়ে’র দেশে পরিণত হবে আর তার পরের ধাপেই পৌঁছে যাবে উন্নত দশেরে সারিতে।

তবে এখন বিশ্বব্যাপী কোভিদ-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত সমস্ত পৃথিবী। বাংলাদেশেও এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে জীবনযাত্রা যেমন থমকে গেছে, তেমনি এর প্রভাবও অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। এ থেকে মুক্তি কিভাবে ঘটবে, সাম্প্রতিক দুর্যোগ কেটে গেলেই কেবল সেটা বোঝা যাবে। তবে আমাদের জীবনযাপন যে বদলে যাবে, অর্থনীতি যে নতুন রূপ পাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তো, এটা তো ভবিষ্যতের ব্যাপার। আমি না হয়, স্বাধীনতার পর আমাদের সাহিত্য কীরকম চেহারা পেয়েছে তাই নিয়ে কথা বলি।

২. উত্তর-উপনিবেশবাদী বাংলাদেশ ও মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব
আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা জানেন, উপনিবেশের অধীনে থাকার সময়ই কখনো কখনো রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে সংঘাতের বীজ প্রোথিত হয়ে যায়। ঔপনিবেশিক শাসকদের সঙ্গে সংগ্রাম করবার সময় সেই শাসকদের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করলেও স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক চরিত্র কী দাঁড়াবে, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম করবার সময় যদি সেই শাসকগোষ্ঠীকে কেউ মিত্র মনে করে সমর্থন করে থাকে, তাহলে স্বাধীনতা অর্জনের পর মুক্তস্বাধীন ওই জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হতে বাধ্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ঠিক এই ব্যাপারটিই লক্ষ করেছি আমরা।

স্বাধীনতার সময় যারা ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকদের সমর্থন করেছে, বা যারা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল, তারা স্বাধীনতার পর মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নৈরাজ্য তৈরি করে। এটা অবশ্য একদিনে করা হয়নি, ধীরে ধীরে করা হয়েছে। এই গোষ্ঠী মতাদর্শিকভাবে পূর্বের অবস্থানে স্থির থেকে একদিকে যেমন রাজনৈতিকভাবে নিজেদের সুসংহত করেছে, অন্যদিকে তেমনি সমভাবাপন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজেদের প্রভাববলয় বাড়িয়ে নিয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে যে-দল (বা দলগুলি) নেতৃত্ব দিয়েছিল, তাদের নানা ভুলের সুযোগও তারা নিয়েছে। অবস্থা তখন এমন দাঁড়িয়েছিল যে, স্বাধীনতা-বিরোধী ওই গোষ্ঠী অনেক দিন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে পেরেছে, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে। বিভ্রান্তিকর মতাদর্শের জাল বিস্তার করে তারা তরুণ-সমাজকে ভুল পথে চালিত করতে পেরেছে।

ফলে স্বাধীনতার পর স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শাসনকাঠামো কী হওয়া বাঞ্ছনীয়, তার সাংস্কৃতিক চারিত্র্য কী হওয়া জরুরি—এসব প্রশ্নে দেখা দিয়েছে দ্বিধাবিভক্তি। এরকম একটা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সাহিত্য যে একধরনের ঘূর্ণাবর্তে পড়ে জটিল হয়ে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক। বাস্তবে হয়েছেও তাই। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, বাংলাদেশের লেখকেরা এই ধরনের বিভ্রান্তিকর মতাদর্শের চোরাবালিতে পা দেননি। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, বেশিরভাগ লেখকই—তাঁরা যে-দেশেরই হোন না কেন, যে-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসুন না কেন—সত্যনিষ্ঠ হয়ে থাকেন। নিঃসন্দেহে দেশ, সমাজ ও মানুষের প্রতি তাদের একধরনের কমিটমেন্ট থাকে।

৩. বৈদেশিক নির্ভরতা, আমলাতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র ও বাংলাদেশ
আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে সমকালীন বাংলাদেশ নানা জটিল ও বিচিত্র পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছিল। আর্থসামাজিকভাবে সবাই একমত যে, দেশটি একশ্রেণীর লুটেরা পেশাজীবীর স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছিল। আমলাতন্ত্র, সামরিকতন্ত্রের কবলে পড়ে দেশটির অর্থনীতি প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। বিভিন্ন ট্রান্সন্যাশনাল কোম্পানি এবং যেসব ধনী দেশ তাদের মুনাফার সবচেয়ে বড় অংশ ভোগ করে, বাংলাদেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলি ছিল তাদের আগ্রাসী থাবার নিচে। আমাদের সনাতন চাষাবাদ পদ্ধতি, স্বাস্থ্য ইত্যাদিকে তারা তাদের পেস্টিসাইড বা জন্ময়িন্ত্রণের নানা উপকরণ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করেছে। সংস্কারের নামে বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা সার্বক্ষণিকভাবে চাপের মধ্যে রেখেছে এই দেশটিকে। আমাদের নিজস্ব গণমাধ্যমের দুর্বলতার সুযোগে বিদেশি স্যাটেলাইট টিভির চোরাস্রোতের টানে বিপন্ন হয়ে পড়েছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। এভাবে একদিকে বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা, সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ, অন্যদিকে দেশীয় ক্ষমতাবান লুটেরা শ্রেণির শাসনশোষণ বাংলাদেশকে সবদিক থেকে বিপর্যস্ত করে ফেলে।

সামাজিক অস্থিরতা, সাংস্কৃতিক টানাপোড়েন এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থার পাশপাশি রাজনীতিতেও দেখা গেছে চরম নৈরাজ্য। উপনিবেশ-উত্তর রাষ্ট্রগুলির শাসনব্যবস্থায় একধরনের প্রহসনের পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। এরকম পরিস্থিতিতে ঔপনিবেশিক শক্তির কবল থেকে তারা মুক্তি পেয়ে হঠাৎ করেই প্রবেশ করে আধুনিক ইউরোপীয় উদারনৈতিক রাষ্ট্রব্যবস্থায়, যার মূলমন্ত্র হচ্ছে গণতন্ত্র। কিন্তু এই গণতন্ত্রকে হজম করার বা জারিত করে নেওয়ার প্রস্তুতি ও শক্তি তার থাকে না। ফলে গণতন্ত্র পদে পদে বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই ঘটেছে। পাকিস্তানি শাসনের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশ গণতন্ত্র, সামাজিক সাম্য, মানবিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতার উদার ক্ষেত্রে প্রবেশ করবে এটাই ছিল প্রত্যাশিত। আমাদের পূর্বসূরিরা সেই পথেই এগোচ্ছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম অসংশোধিত সংবিধানে তার প্রমাণ মিলবে। কিন্তু তারপর? সামরিকতন্ত্রের কবলে পড়ে ছিন্নভিন্ন হলো গণতন্ত্র। পুনরুত্থান ঘটলো ধর্মের, স্বৈরতন্ত্রের, সাম্প্রদায়িকতার। জনরোষের ফুৎকারে সামরিক শাসকগোষ্ঠী বিতাড়িত হলেও অসাম্প্রদায়িকতা ও সামাজিক সাম্যের প্রতিষ্ঠা ঘটতে বিলম্ব হলো। সাংবিধানিকভাবে গণতন্ত্র এলেও মানবিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিস্থাপিত হলো না। তবে সাংবিধানিকভাবে ধর্মকে এখন প্রত্যক্ষভাবে ব্যবহার করা হয় না। ফলে, বাংলাদেশের আধুনিক উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা এখনও মসৃণ নয়। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী—যারা আমাদের ঋণ দেয়—তারা বিরূপ হবে বলে এ-পথে অগ্রসর হওয়াটাকে নিরাপদ মনে করা হয় না। আশার কথা, বাংলাদেশ এই বিদেশ-নির্ভরতা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছে। তবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো ও শাসনকাঠামোর প্রায় প্রতিটি স্তরে ধর্মের যে প্রচ্ছন্ন ব্যবহার ঘটেছে, সেটা অস্বীকার করবার উপায় নেই। বিপুল জনসংখ্যার কারণে বাঙালিরা আবার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ এখনো দারিদ্রসীমার নিচে। যদিও গত দেড় দশকে দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। ফলে, জনজীবনেও স্বস্তি নেই। সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন আর দুর্নীতিতে বাংলাদেশ জর্জরিত। সাম্প্রদায়িকতামুক্ত রাষ্ট্রের স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেছে। এই অবস্থা থেকে বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তি দিতে হলে জনকল্যাণমুখী পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঋদ্ধ, সেই পথেই এগুচ্ছে। উন্নয়নের দৃশ্যমান ছোঁয়া লেগেছে। উন্নয়নের অনেকগুলি মেগাপ্রজেক্ট নিয়ে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আরো গতি পেয়েছে। বর্তমান সরকার যে উন্নয়নের সরকার, সেকথা বলাই যায়। সার্বিকভাবে এরকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সাহিত্য যে নানা দিক থেকে বহুবর্ণিল হয়ে উঠবে তা বলাই বাহুল্য।

৪. স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের সাহিত্য
স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশের সাহিত্য অনেকটা সরলরেখার অগ্রসর হচ্ছিল। নিরুদ্বিগ্ন নাগরিক জীবন কিংবা নিস্তরঙ্গ সরল গ্রামীণ জীবনই তাতে উপজীব্য হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সাহিত্য হয়ে উঠেছে জটিল, বহুমাত্রিক, সর্বোপরি বৈশ্বিক নানা অনুষঙ্গে বিজড়িত। কী প্রসঙ্গ, কী প্রকরণ—সবদিক থেকেই স্বাধীনতাপূর্ব সাহিত্যের সঙ্গে ঘটে গেছে স্বাধীনতা-পরবর্তী সাহিত্যের পার্থক্য। উল্লিখিত আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের প্রায় সবটাই উঠে এসেছে আমাদের কথাসাহিত্যে, কবিতায় কিংবা নাটকে। বাংলাদেশের সাহিত্যের গভীরে প্রবেশ করলেই এর মূল প্রবণতাগুলি সনাক্ত করা যাবে। এই লেখাটি সেই লক্ষ্যেই, অর্থাৎ স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি কী দাঁড়িয়েছে তারই সংক্ষিপ্ত রূপরেখা বলা যেতে পারে।

স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধ। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জায়মান হয়ে ওঠে একটি জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের ত্যাগ-তিতিক্ষা আর সংগ্রামের মূল ঘটনাটি যে সাহিত্যে প্রাধান্য পাবে, সেকথা বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় না। মুক্তিযুদ্ধের বীজ অবশ্য স্বাধীনতার ঠিক পরে নয় অনেক আগেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রে বাংলাদেশের সাহিত্যে প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল। আইয়ুবি আমলে তা বাংলাদেশের সাহিত্যে অনুসূক্ষ্মভাবে অন্তঃশীল ছিল। ঊনসত্তরে এসে এই প্রবণতাটি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়ে গেলে প্রায় সব লেখকেরই—অবশ্য যারা তখন লেখালেখি করতে পেরেছেন—মুক্তিযুদ্ধ তাদের রচনার প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার পরে মুক্ত স্বদেশে তাই অনেককেই দেখা গেল এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে গল্প, উপন্যাস বা কবিতা রচনা করতে।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কালজয়ী উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’তে উপজীব্য হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার উজ্জ্বল পটভূমি—উন্মাতাল ঊনসত্তর। বন্দী সময়ের তমসাচ্ছন্ন পরিবেশে মানুষ যে কিভাবে মুক্তির প্রত্যাশী হয়ে উঠতে পারে, ইলিয়াস তারই এপিক রূপায়ণ ঘটালেন এই উপন্যাসে। আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাতে’ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী যে-নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল, পাওয়া গেল তারই আত্মজৈবনিক রূপ। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বেশি সফল উপন্যাস লিখলেন শওকত ওসমান—‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’, ‘দুই সৈনিক’, ‘নেকড়ে অরণ্য’ এবং ‘জলাঙ্গী’। এই ধরনের উপন্যাস রচনায় সৈয়দ শামসুল হকের সাফল্যও কম নয়। তার ‘নীল দংশন’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’, ‘অন্তর্গত’, ‘এক যুবকের ছায়াপথ’ ইত্যাদি উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে উপজীব্য করা হয়েছে। উপনিবেশ-উত্তর বাংলাদেশে জাতিরাষ্ট্রের রূপরেখাটি সৈয়দ হকের উপন্যাসে সাফল্যের সঙ্গেই উৎকীর্ণ হয়েছে বলতে পারি।

মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে গত দু-তিন দশকে আরো যেসব উপন্যাস লেখা হয়েছে সেগুলি হচ্ছে রশীদ করীমের ‘আমার যত গ্লানি’, রাবেয়া খাতুনের ‘ফেরারী সূর্য’, আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’, রশীদ হায়দারের ‘খাঁচায়’ ও ‘অন্ধ কথামালা’, সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের ‘জীবনভর’, শওকত আলীর ‘যাত্রা’, সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’, মিরজা আবদুল হাইয়ের ‘ফিরে চলো’, হুমায়ুন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’, হারুন হাবীবের ‘প্রিয়যোদ্ধা, প্রিয়তম’, রিজিয়া রহমানের ‘একটি ফুলের জন্য’, শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ ও ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ ইত্যাদি।

ছোটগল্প বাংলাদেশের সাহিত্যের একটি সমৃদ্ধ শাখা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা হয়েছে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প। শওকত ওসমানের ‘বারুদের গন্ধ লোবানের ধোঁয়া’, ‘দুই ব্রিগেডিয়ার’, শহীদ আখন্দের ‘ভিতরের মানুষ’, বশীর আল হেলালের ‘সেবিকা’, রশীদ হায়দারের ‘এ কোন ঠিকানা’, হাসান আজিজুল হকের ‘ঘরগেরস্থি ও ফেরা’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোঁয়ারি’, সেলিনা হোসেনের ‘ঘৃণা’ ইত্যাদি গল্পেও মুক্তিযুদ্ধকালীন অবরুদ্ধ ও সংগ্রামমুখর বাংলাদেশের ছবি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় ও ভঙ্গিতে উপস্থিাপিত হয়েছে।

বাংলাদেশের কবিতাতেও লক্ষ করা যাবে মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিক বিস্ময়কর প্রকাশ। বাঙালি জাতির সত্তাতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের ইতিবৃত্তটি কবিতাতেই সবচেয়ে সফলভাবে ধরা পড়েছে। আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, সিকান্দার আবু জাফর, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দের মতো কবিরা তো বটেই, স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বে ষাটের দশকের শেষ দিকে যেসব কবির আবির্ভাব ঘটলো—হুমায়ুন কবির, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, হুমায়ুন আজাদ, আবুল হাসান, মাহবুব সাদিক, সাযযাদ কাদির প্রমুখের কবিতা মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ নিয়ে রচিত হতে থাকল। তবে স্বাধীনতার পর সত্তর দশকে যেসব কবির আবির্ভাব ঘটল, সব কবির কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ যেন পেল বহুমাত্রকি রূপ। যেসব কবির রচনায় মুক্তিযুদ্ধ নানাভাবে উপজীব্য হয়েছে তাদের কয়েকজন হচ্ছেন মাশুক চৌধুরী, আবিদ আজাদ, দাউদ হায়দার, মাসুদুজ্জামান, শিহাব সরকার, মাহবুব হাসান, মুজিবুল হক কবির, ফারুক মাহমুদ, জাহিদ হায়দার, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লা, কামাল চৌধুরী। তবে গতশতকের আশির দশক থেকে শুরু করে এই শতকের দ্বিতীয় দশকে পৌঁছে দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের কবিতা পূর্বতন কবিদের হাতে তো বটেই তরুণতরদের হাতে আরো নানামাত্রায় নানা অনুষঙ্গে উদ্ভাসিত। এই সময়ে যেসব তরুণ কবি বাংলাদেশের কবিতাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে চলেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন : ফরিদ কবির, খালেদ হোসাইন, আবু হাসান শাহরিয়ার, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, মাসুদ খান, খন্দকার আশরাফ হোসেন, মুজিব ইরম, সাজ্জাদ শরিফ, তসলিমা নাসরিন, সৈয়দ তারিক, টোকন ঠাকুর, মজনু শাহ, কামরুজ্জামান কামু, বায়তুল্লাহ কাদেরী, সরকার আমিন, মুজিব ইরম, ইমতিয়াজ মাহমুদ, জাহানার পারভীন, নওশাদ জামিল, পিয়াস মজিদ, বিজয় আহমেদ, মোস্তাক আহমাদ দীন, শামীম রেজা, ওবায়েদ আকাশ, আলতাফ শাহনেওয়াজ, রুহুল মাহফুজ জয়, তানিম কবির, হাসান রোবায়েত, মোস্তফা হামেদী, অরবিন্দ চক্রবর্তী, হিজল জোবায়ের, সৌম্য সালেক, তিথি আফরোজ, অনুপমা অপরাজিতা, রিমঝিম আহমেদ, রোজেন হাসান, নাহিদ ধ্রুব, সালেহীন শিপ্রা, নুসরাত নুসিন প্রমুখ।

তবে উপন্যাস ও কবিতার তুলনায়, অনেকের ধারণা, নাটকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। আসলে আজ বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটারের যে ব্যাপক চর্চা দেখা যাচ্ছে, কলকাতা থেকে প্রত্যাগত মুক্তিযোদ্ধারাই আমাদের নাট্যান্দোলনে সেই ধারণারই বাস্তব রূপায়ন ঘটিয়েছেন বলা যায়। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট নাট্যকার ও নাট্যকর্মী মামুনুর রশিদ বলেছেন, ‘যুদ্ধকালীন অবস্থায় অনেক নাট্যকর্মীর সুযোগ ঘটে কোলকাতার নাটক, নাট্যসংগঠন, নাট্যকার, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও কুশলীদের সাথে পরিচিত হবার।... বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত যেসব ছাত্র-ছাত্রীরা যুদ্ধে গিয়েছিল তারাও ফিরে এসে দ্রুত সংগঠিত করতে লাগল নাটককে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলিতে, ডাকসুতে, সর্বত্র একটা সাড়া পড়ে গেল।’ লক্ষ করলে দেখা যাবে, মুক্তিযুদ্ধের নাটকগুলির বেশিরভাগই আবেগনির্ভর, মননঋদ্ধ নয়। তবু এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে বেশকিছু কালোত্তীর্ণ নাটক। এসব নাটকের মধ্যে মমতাজউদ্দীন আহমদের ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’, ‘এবারে সংগ্রাম’ ও ‘বিবাহ ও কি চাহ শঙ্খচিল’, জিয়া হায়দারের ‘সাদা গোলাপে আগুন ও পঙ্কজ বিভাস’, সাঈদ আহমদের ‘প্রতিদিন একদিন’, রণেশ দাশগুপ্তের ‘ফেরী আসছে’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ উল্লেখযোগ্য। সেলিম আল দীন, মামুনুর রশিদ, আবদুল্লাহ আল মামুন প্রমুখ নাট্যকারও মুক্তিযুদ্ধকে তাদের নাটকে উপজীব্য করেছেন বিভিন্ন সময়ে। বাংলাদেশের গ্রুপথিয়েটার আন্দোলনকে তাই বলা যায় মুক্তিযুদ্ধেরই প্রত্যক্ষ অবদান।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাহিত্যের আর একটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা লক্ষ করা যায় মধ্যবিত্তের জীবনযাপনের নানামাত্রিক উপস্থাপনে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া স্বাধীন দেশে মধ্যবিত্তের বিকাশ নানা কারণে রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় তার প্রকাশ হয়ে উঠেছে বহুমুখী ও জটিল। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিমানসের আত্মযন্ত্রণা, আত্মরতি, রিরংসা, হতাশা ও ভোগবাদের চূড়ান্ত প্রতিফলন লক্ষ করা যাবে এই সময়ের বাংলাদেশের সাহিত্যে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বিপর্যয়ের সংবেদনশীল অভিব্যক্তি হিসেবে এই বিষয়টি কথাসাহিত্যিকদেরতো বটেই কবিদেরও আন্দোলিত করেছে।

হুমায়ূন আহমদের ‘নন্দিত নরকে’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘খেলারাম খেলে যা’, সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের ‘একজন’, রশীদ করীমের ‘প্রেম একটি লাল গোলাপ’ ও ‘সাধারণ লোকের কাহিনী’, রিজিয়া রহমানের ‘রক্তের অক্ষর’, শওকত আলীর ‘অপেক্ষা’, বশীর আল হেলালের ‘কালো ইলিশ’, হাসনাত আবদুল হাইয়ের ‘আমার আততায়ী’, সেলিনা হোসেনের ‘মগ্নচৈতন্যে শিস’ ও ‘পদশব্দ’, রাজিয়া খানের ‘চিত্রকাব্য’, শামসুর রাহমানের ‘অক্টোপাস’ ও ‘নিয়ত মন্তাজ’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘স্তব্ধতার অনুবাদ’ ইত্যাদি উপন্যাসে রিরংসায় আক্রান্ত আত্মকেন্দ্রিক ভঙ্গুর জীবন, বিচ্ছিন্নতা, হতাশা, বিনষ্টি, লুণ্ঠন, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংকটের সামগ্রিক চিত্র উপজীব্য হয়েছে। সিরাজুল ইসলামের উপন্যাসগুলি কথাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

ঝর্না রহমান, আহমাদ মোস্তফা কামাল, প্রশান্ত মৃধা, শাহীন আখতার, মোহিত কামাল, জাকির তালুকদার, স্বকৃত নোমান, মাহবুব আজীজ, খালিদ মারুফ, রাসেল রায়হান, মোস্তফা কামাল, মাসরুর আরেফিন, মাহবুব ময়ূখ রিশাদ, অদিতি ফাল্গুনী, পাপড়ি রহমান, হাবিব আনিসুর রহমান, আবুল কাসেম, তাশরিক-ই-হাবিব, হামিম কামাল, ইশরাত তানিয়া, নাসিমা আনিস, বর্ণালী সাহা, মোজাফ্ফর হোসেন, নিলুফা আক্তার, রিমঝিম আহমেদ এঁরাও সাম্প্রতিক কালে এই সময়ের উল্লেখযোগ্য ঔপন্যাসিক হিসেবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন। ভিন্নধারার ঔপন্যাসিক হিসেবে সাদাত হোসাইন, আবদুল্লাহ আল ইমরান, কিঙ্কর আহসানও পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।

এই সময়ের ছোটগল্পেও বিচিত্রভাবে সমকালীন জীবনের উপস্থিতি লক্ষ করা যাবে। বাংলাদেশের ছোটগল্পেও মূর্ত হয়েছে মধ্যবিত্তের জটিল ভঙ্গুর, আত্মকেন্দ্রিক কুণ্ডলায়িত জীবন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, কায়েস আহমেদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, রাহাত খান, রশীদ হায়দার, সিরাজুল ইসলাম, মঈনুল আহসান সাবের, সৈয়দ ইকবাল, নাসরীন জাহান, আবু সাঈদ জুবেরী, ইমতিয়ার শামীম, সেলিম মোরশেদ, পারভেজ হোসেন, আকিমুন রহমান, শাহনাজ মুন্নী, মামুন হুসাইন, শাহাদুজ্জামান, মোস্তফা কামাল, তাপস রায়, আশান উজ জামান, কিযী তাহ্নীন, আনিফ রুবেদ, প্রমুখের গল্পে এই জীবনের বহুমাত্রিক রূপ খুঁজে পাওয়া যাবে সহজেই।

অবশ্য শুধু কথাসাহিত্য নয়, এই সময়ের কবিতাতেও লক্ষ করা যাবে মধ্যবিত্তের জীবনযাপন ও মানসিকতার সার্বিক প্রতিচ্ছবি। শামসুর রাহমান এজন্যেই লিখতে পেরেছেন ‘আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি’, ‘শূন্যতায় তুমি শোকসভা’, ‘প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে’, ‘মাতাল ঋত্বিক’, ‘নায়কের ছায়া’, ‘এক ফোঁটা কেমন অনল’, হাসান হাফিজুর রহমান ‘শোকার্ত তরবারি’, ‘ভবিতব্যের বাণিজ্যতরী’, সৈয়দ শামসুল হক ‘অপর পুরুষ’, ‘রজ্জুপথে চলেছি’, ‘এক আশ্চর্য সংগমের স্মৃতি’, শহীদ কাদরী ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’, ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ‘তৃতীয় তরঙ্গে’, ‘কোলাহলের পর’, ফজল শাহাবুদ্দীন ‘আততায়ী সূর্যাস্ত’, ‘অন্তরীক্ষে অরণ্য’, ‘আলোহীন অন্ধকারহীন’, নির্মলেন্দু গুণ ‘না প্রেমিক না বিপ্লবী’ ও ‘দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী’, আবুল হাসান ‘যে তুমি হরণ করো’ ও ‘পৃথক পালঙ্ক’, মহাদেব সাহা ‘এই গৃহ এই সন্ন্যাস’, ‘কী সুন্দর অন্ধ’, ‘একা হয়ে যাও’, সিকদার আমিনুল হক ‘বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকারে’, ‘এক রাত্রি এক ঋতু’, ‘কাফকার জামা’ ইত্যাদি কাব্যগ্রস্থ।

বাংলাদেশের সাহিত্যের আর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এইসময়ে যে গ্রামজীবন ও আঞ্চলিক জীবনের ছবি আমাদের সাহিত্যে পাওয়া যায় পূর্বের তুলনায় তা অনেকটাই আলাদা। আগে লেখকেরা গ্রামকেন্দ্রিক প্রবহমান জীবনকে দেখেছেন অনেকটাই অনড় অচল নিস্তরঙ্গ হিসেবে। কিন্তু স্বাধীনতার পর এই গ্রামজীবনে যে চাঞ্চল্য দেখা গেল—স্বার্থান্বেষীদের হানাহানি, দ্বন্দ্ব আর রাজনৈতিক অস্থিরতার স্পর্শ লাগে, বাংলাদেশের লেখকেরা, বিশেষ করে কথাসাহিত্যিকেরা সেই ছবি চমৎকারভাবে তুলে এনেছেন তাদের লেখায়। সেইসঙ্গে ভুলে যাননি সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের চিত্রটি আঁকতে। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছে যে-বিষয়টি তা হলো নিম্নবর্গের মানুষদের প্রতি সহমর্মিতা। গ্রামীণ কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, ফতোয়াবাজি, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদিকে তারা উপজীব্য করছেনে তাদের লেখায়। সাধারণ ব্রাত্যজীবনকে পরম মমতার সঙ্গে উপন্যাসের বিষয় করে তুলেছেন। এ সংক্রান্ত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হচ্ছে সৈয়দ শামসুল হকের ‘দূরত্ব’, ‘মহাশূন্যে পরান মাস্টার’, ‘আয়না বিবির পালা’, হাসনাত আবদুল হাইয়ের ‘তিমি’, সেলিনা হোসেনের ‘জলোচ্ছ্বাস’, ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’, আবুবকর সিদ্দিকের ‘জলরাক্ষস’, ‘খরাদাহ’, হরিপদ দত্তর ‘ঈশানে অগ্নিদাহ’, ‘অন্ধকূপে জন্মোৎসব’, বশীর আল-হেলালের ‘শেষ পানপাত্র’, মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘জন্মজাতি’ ও ‘মৈনপাহাড়’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘ভূমিপুত্র’, ‘নূরজাহান’, ইমতিয়ার শামীদের ‘অন্ধ মেয়েটি জ্যোৎস্না দেখার পর’ ইত্যাদি। বাংলাদেশে ছোটগল্পেও গ্রামীণ জীবনের নানা টানাপোড়েনের ছবি পাওয়া যায়। হাসান আজিজুল হক (‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘নামহীন গোত্রহীন’), শওকত আলী (‘লেলিহান সাধ’, ‘শুন হে লখিন্দর’), আবদুস শাকুর (‘ক্রাইসিস’, ‘সরস গল্প’), সেলিনা হোসেন (‘খোল করতাল’) এবং সাম্প্রতিককলের একঝাঁক তরুণ গল্পকার গ্রামজীবনকেই প্রধানত তাদের গল্পের কেন্দ্রবিন্দু করে তুলেছেন।

স্বাধীনতার পরে নতুন আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে আমাদের উপন্যাসে আরো বেশ কিছু অভিনব অথচ অনিবার্য বিষয় যুক্ত হয়। এর একটি হচ্ছে বেসরকারি সংস্থাগুলির (এনজিও) কর্মতৎপরতা গ্রামগুলিকে আন্দোলিত করার সঙ্গে সঙ্গে এই বিষয়টি আমাদের কথাসাহিত্যেও প্রতিফলিত হতে থাকে। প্রধানত নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতেই এজিওকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডকে উপন্যাসে তুলে এনেছেন আমাদের লেখকেরা। এ প্রসঙ্গে ইমতিয়ার শামীমের ‘ডানা কাটা হিমের ভেতর’ উপন্যাসের কথা উল্লেখ করা যায় বিশেষভাবে। শুধু এনজিও নয়, বিশ্বায়নের প্রভাবে আমাদের জনপদ ও জনজীবন যে আমূল বদলে যাচ্ছে, তাও তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। এ বিষয়টি উপজীব্য হয়েছে ইমতিয়ার শামীমের ‘গ্রামায়নের ইতিকথা’ উপন্যাসে। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পটভূমিতে ‘দ্যা নর্থ এন্ড’ নামে চমৎকার একটি উপন্যাস লিখেছেন বর্ণালী সাহা।

তবে এসব বিষয়কে ছাপিয়ে সাম্প্রতিকালে অন্য যে বিষয়টি কথাসাহিত্যিকদের, বিশেষ করে নারী লেখকদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে তা হচ্ছে নারী। নারীর জীবনযাপন, স্বপ্নকল্পনা, আশাআকাঙ্ক্ষা, পুরুষের আধিপত্য, নির্যাতন, নিপীড়নকেই নানা দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের লেখায় উপজীব্য করেছেন। সেলিনা হোসেনের ‘দ্বিপান্বিতা’, ‘মোহিনীর বিয়ে’, রাজিয়া খানের ‘হে মহাজীবন’, নাসরীন জাহানের ‘উরুক্কু’, ঝর্ণা রহমানের ‘অন্য এক অন্ধকার’, ‘ঘুম-মাছ ও একটুকরো নারী’, শাহীন আখতারের ‘পালাবার পথ নেই’, ‘বোনের সঙ্গে অমরলোকে’ শীর্ষক উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থে পাওয়া যাবে এই বহুমাত্রিক বিচিত্র জীবনের ছবি। তবে সেলিনা হোসেনের আগ্রহ যেখানে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নারীর অধস্তন অবস্থাকে নিরীক্ষণ করা, নাগরিক ও গ্রামীণ জীবনের জটিলতার মধ্যদিয়ে আবার চলতে থাকে শাহীন আখতারের উপন্যাস ও গল্পের চরিত্রগুলি। উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামো ও সামাজিক পরিস্থিতিতে নারীর জীবন যে কিভাবে বদলে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে তার জীবনদৃষ্টি, উল্লিখিত নারী লেখকদের রচনা সেই দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে পুরুষ লেখকেরাও যে নারীবিষয়ের প্রতি সহমর্মী হয়ে উঠতে পারেন, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে শক্তিশালী গল্পকার হাসান আজিজুল হকের ‘মা মেয়ের সংসার’-এ টুকরো টুকরো মর্মভেদী কাহিনী আর ‘আগুনপাখি’, ‘সাবিত্রী উপখ্যানে’র আখ্যানে।

মুক্তিযুদ্ধ, মধ্যবিত্তের জীবনযাপন বা নারীর অধস্তন অবস্থা আমাদের সাহিত্যের একটি বড় অংশ জুড়ে থাকলেও রাজনীতিই হচ্ছে বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রধান প্রবণতা। এই বিষয়টির প্রতি আমাদের লেখকদের ঝোঁক যে দুর্মর, সেকথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যদিয়ে উপনিবেশের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বিশ্বায়নের খপ্পরে পড়ার আশঙ্কা থেকেই লেখকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে এই ঝোঁক। বৈশ্বিক রাজনীতির পাশাপাশি আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রটিও নানা মতাদর্শিক বিভ্রান্তি, সংঘাত ও হানাহানিতে পূর্ণ। একাত্তরে যেসব প্রসঙ্গের প্রায় মীমাংসা হয়ে গিয়েছিল, পাকিস্তানের প্রতি সহমর্মী রাজনীতিবিদ ও ভ্রান্ত বুদ্ধিজীবীরা আবার সেইসব প্রসঙ্গকেই রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন। ফলে, এদেশে সামরিক শাসনের আবির্ভাব ঘটেছে, পুনর্বাসিত হয়েছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। কিন্তু লেখকেরা, আগেই যেমন বলেছি, সত্যনিষ্ঠ হওয়ার ফলে ইতিহাসকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। এরই প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, কবিতা ও নাটক। সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ প্রতিরোধকে তারা তাদের লেখার বিষয়বস্তু করে তুলেছেন।

স্বাধীনতা পূর্বকাল ও পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতন ও প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কাহিনী যেসব উপন্যাসে নানা আঙ্গিকে ধরা পড়েছে সেগুলি হচ্ছে শওকত ওসমানের ‘পতঙ্গ পিঞ্জর’, ‘আর্তনাদ’, সেলিনা হোসেনের ‘যাপিত জীবন’, ‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’, শওকত আলীর ত্রয়ী উপন্যাস ‘দক্ষিণায়নের দিন’, ‘কুলায় কালস্রোত’, ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’, ‘ওয়ারিশ’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’, ‘খোয়াবনামা’, প্রশান্ত মৃধার ‘মৃত্যুর আগে মাটি’ শীর্ষক উপন্যাস। এসব উপন্যাসের বিষয়বস্তু দেশভাগ পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতা, স্বাধীকার আন্দোলন, মতাদর্শিক ঘাতপ্রতিঘাত থেকে শুরু করে ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মধ্যদিয়ে এই সময় কেউ কেউ বাংলাদেশের মর্মমূলকে ছুঁতে চেয়েছেন। শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসে পাওয়া যাবে তারই চমৎকার ভাষ্য।

বাংলাদেশের নাটকে প্রধানত সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উপজীব্য হয়েছে এই রাজনৈতিক প্রসঙ্গ। এসব নাটকে প্রাধান্য পেয়েছে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের চেতনা। রাজনৈতিক ও সামাজিক অসঙ্গতি, শোষক ও শোষিতের শ্রেণিদ্বন্দ্ব নাট্যকারদের আকৃষ্ট করেছে। এসব নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মামুনুর রশীদের ‘ওরা কদম আলী’, ‘ওরা আছে বলেই’, ‘ইবলিশ’, ‘এখানে নোঙর’, ‘গিনিপিগ’, আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘শপথ’, ‘সেনাপতি’, ‘এখনো ক্রীতদাস’, ‘সুবচন নির্বাসনে’, ‘এখন দুঃসময়’, ‘চারিদিকে যুদ্ধ’ ইত্যাদি। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পুনরাবিষ্কারের মধ্যদিয়েও আমাদের নাট্যকারগণ সমকালীন রাজনৈতিক চেতনাকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। ব্রতী হয়েছেন বাঙালি জাতিসত্তার উৎস ও অস্তিত্ব সন্ধানে। এই ধারায় রচিত উল্লেখযোগ্য নাটক হচ্ছে সৈয়দ শামসুল হকের ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, সাঈদ আহমদের ‘শেষ নবাব’, সেলিম আল দীনের ‘শকুন্তলা’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘কেরামতমঙ্গল’ প্রভৃতি। প্রতিবাদী নাটকের ধারাতেই বাংলাদেশে বেশকিছু নাট্যাঙ্গিকের সূত্রপাত ঘটে। এই আঙ্গিকগুলি হচ্ছে পথনাটক, গ্রামথিয়েটার, মুক্তনাটক ইত্যাদি।

তবে কথাসাহিত্য ও নাটকের তুলনায় রাজনৈতিক প্রসঙ্গ সবচেয়ে প্রবলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশের কবিতায়। শামসুর রাহমানের উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ থেকে শুরু করে রফিক আজাদের ভাত দে হারামজাদা পর্যন্ত কবিতাগুলি পাঠকের একান্ত অভিনিবেশের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। পঁচাত্তরের পটভূমিতে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ লেখেন, ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন’। এছাড়া হাসান হাফিজুর রহমানের ‘আমার ভেতরের বাঘ’, শামসুর রাহমানের ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’, ‘অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই’, ‘ধুলায় গড়ায় শিরস্ত্রাণ’, ‘দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে’, ‘বুকে তার বাংলাদেশের হৃদয়’, আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘অগ্নি ও জলের কবিতা’, নির্মলেন্দু গুণের ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘তার আগে চাই সমাজতন্ত্র’, ‘পৃথিবীজোড়া গান’, ‘দূর হ দুঃশাসন’, ‘ইসক্রা’, রফিক আজাদের ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’, ‘অঙ্গীকারের কবিতা’, মহাদেব সাহার ‘ফুল কই শুধু অস্ত্রের উল্লাস’, ‘কোথা সে বিদ্রোহ’, ‘যদুবংশ ধ্বংসের আগে’, মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘আমরা তামাটে জাতি’, ‘জাতিসত্তার কবিতা’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থে বাংলাদেশের রাজনীতির ব্যক্তিক শৈল্পিক প্রকাশ ঘটেছে নানা মাত্রায়।

৫. দীর্ঘ সময়, বহুমুখী প্রকাশ
১৯৭২ থেকে ২০২০ সাল—এক দীর্ঘ সময়। স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ এইসময় নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে অগ্রসর হয়েছে। রাজনীতির ক্ষেত্রটি হয়ে উঠেছে জটিল ও সংক্ষুব্ধ, বাঁক নিয়েছে কয়েকবার। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা ও মতাদর্শিক সংঘাত; বাদ-প্রতিবাদ। পুনরুত্থান ঘটেছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির; তাদের সহযোগিতায় রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে অতিডানপন্থী শক্তি। সামাজিক সাম্য, অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রকৃত চর্চার জায়গা থেকে সরে আসবার ফলে বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ চিহ্নিত হয়েছে মৌলবাদী দেশ হিসেবে। এখন আবার অবশ্য বাংলাদেশ ফিরে যাচ্ছে তার রাষ্ট্রিক উৎসে, মুক্তিযুদ্ধের মতাদর্শিক জায়গায়। এই লেখার সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমাদের সাহিত্যে উল্লিখিত ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়টি কিভাবে রূপায়িত হয়েছে, তুলে ধরা সহজ হয়নি। তবু চেষ্টা করেছি এই সময়ে রচিত বাংলাদেশের সাহিত্যের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরার। কিন্তু এর মাধ্যমে যে বাংলাদেশের সাহিত্যের সামগ্রিক পরিচয় তুলে ধরা যায়নি, লেখাটির উপসংহারে পৌঁছে তা বিলক্ষণ মনে হচ্ছে।

বাংলাদেশের সাহিত্যের মনোযোগী পাঠকমাত্রেই লক্ষ করবেন, এদেশের সাহিত্য নানা সময়ে নানা বাঁক নিয়েছে। স্বাধীনতার পর যে ধরনের উদ্দীপনামূলক লেখা আমরা কবি ও কথাসাহিত্যিকদের কাছ থেকে পেয়েছি, শাহবাগের গণজাগরণের পর তা আবার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের রূপ নেয়। কবিতার ক্ষেত্রে আমরা দেখছি আত্মস্বীকারোক্তিমূলক এবং রাজনৈতিকভাবে ঝাঁঝালো কবিতার পরিবর্তে এখন লেখা হচ্ছে ‘অন্তর্মুখী ব্যক্তিক’ কবিতা, অন্তর্লীনতার হার্দ্র কারুণ্যে যে কবিতা স্নাত। এখন আবার দেখা যাচ্ছে আশির দশকের বিমূর্ত কবিতার পরিবর্তে সহজ কবিতার প্রতি কবিদের ঝোঁক। আবার শাহবাগের গণজাগরণে প্রভাবে লেখা হয়েছে প্রতিবাদমূলক ঝাঁঝালো কবিতা, ছড়া, গল্প ও উপন্যাস। তরুণ কবিদের মধ্যে দেখা গেছে রূপকল্প নির্মাণে, প্রতীক ব্যবহারে, ভাষাভঙ্গিকে অভিনব করে তুলবার প্রবণতা। কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রেও নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তরুণ লেখকেরা। জাদুবাস্তবতা তাদের অনেকটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছে। গত দুই দশকে নগরজীবন ও গ্রামকে কেন্দ্র করে কখনো আত্মজৈবনিক, কখনো যাদুবাস্তবতা, কখনো নিরীক্ষাধর্মী গদ্যে তারা গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। নাটকেও পাওয়া যাবে নানা বৈচিত্র্যের সন্ধান।

সবমিলিয়ে বলা যায়, এই সময়ের সাহিত্য সরাসরি বক্তব্য প্রকাশের স্তর থেকে সরে এসে হয়ে উঠছে অস্তিত্ব-নিরস্তিত্বের ব্যক্তিক গাথা। লেখকেরা প্রথাগত ভাষা ও ভঙ্গিতে সরাসরি ঘটনার বর্ণনায় আর আগের মতো আগ্রহী নন, তারা ব্যক্তিঅস্তিত্বের গভীরে কিংবা অন্তর্লোকে নিমজ্জিত হয়ে উপলব্ধি করতে চান তার যাপনের প্রকৃত স্বরূপ। বাংলাদেশের সাহিত্য এভাবেই হয়ে উঠেছে মানবীয় অন্তর্লোকের উদ্ভাষণ, মনোবাস্তবতার যাপিত দলিল। সহজ ছন্দোবদ্ধ কবিতার দিকে যেন আবার ফিরছেন কবিরা। কেউ কেউ একে হাল আমলের ফ্যাশনদুরস্ত শব্দ উত্তর-আধুনিক বলে চিহ্নিত করতে চাইছেন। কিন্তু উত্তর-আধুনিকতার স্বরূপ যে কী তা এখনো সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি, হবেও না হয়তো। কারণ, উত্তর-আধুনিকতা নিজেই নির্দিষ্ট কোনো ছকে নিজেকে আটকে রাখতে চায় না, সেটাই তার বৈশিষ্ট্য। তাহলে কিভাবে ব্যাখ্যা করব একে? আসলে সাহিত্যকে বোধহয় এখন আর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে নয়, উপলব্ধি করে জারিত করার সময় এসে গেছে। নির্দিষ্ট দেশকালের মধ্যে তার শিকড় চাড়িয়ে দিয়েও যে বাংলাদেশের সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠেছে, বুঝে নিতে হবে সেটাই। তবে মতাদর্শিকভাবে বিভ্রান্তি তৈরি করে যারা জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে ইতিহাস ও ঐতিহ্যচ্যুত করে ভুল পথে চালিত করতে চেয়েছিল, তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। ফলে, সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ লেখক সর্বমানবিক অসাম্প্রদায়িক প্রেক্ষাপটেই তাদের সাহিত্য রচনা করছেন। সবধরনের বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হয়ে গণতান্ত্রিক, উদারনৈতিক, ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিক রাষ্ট্রের স্বপ্নের কথাই কবি, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও লেখকেরা বলে চলেছেন।

ঢাকা, ২৪ মার্চ ২০২০

   

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;

তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা



ড. মিল্টন বিশ্বাস
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  • Font increase
  • Font Decrease

‌‌আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ।
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে।'

আজ ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী। দুর্যোগময় পৃথিবীতে তাঁর জন্মদিন ভিন্নতর তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিত্যসঙ্গী, বাঙালির আত্মপরিচয়ের অন্যতম স্তম্ভ। তাঁকে কেন্দ্র করে কেবল পাকিস্তানি সরকারের বিতর্কিত ভূমিকা নয় ১৯৭১ এর আগে থেকেই বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত হয়েছে তাঁর মাধ্যমে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহানপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এর অন্যতম অনুঘটক। তাঁর দীর্ঘ কারাজীবনের সঙ্গী ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’। লেখাবাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের ভক্ত বঙ্গবন্ধুই আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’কে সংবিধানভুক্ত করেন। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি পূর্ব বাংলার শিল্পীগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তাঁকে দেওয়া এক সংবর্ধনার ভাষণে রবীন্দ্রনাথের কথা এভাবেই বলেছিলেন তিনি- Go to anywhere in the world and tell them that you have come from the country of Tagore, they will respect you.

বিশ্বকবির দেশ বাংলাদেশ। বিশ্বকবির ভাষাপ্রেম এদেশের মানুষকে ভাষা সংরক্ষণের সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তাঁর কবিতা ও গান একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর সঙ্গে বাংলা ও বাঙালির হৃদয়ের সম্পর্ক এবং সংকট-মুহূর্তে তাঁর সাহিত্য-সংগীতের দ্বারা উজ্জীবিত হওয়া সাধারণ একটি ঘটনা। মনে রাখতে হবে পাকিস্তানিদের চেয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য রবীন্দ্রনাথকে বারবারই সামনে এনেছেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন- ‘সাত কোটি বাঙালিকে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি- ‘কবিগুরু, তোমার উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখে যাও তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ জীবদ্দশায় কবিগুরু দেখেছেন যুদ্ধ-বিপর্যস্ত পৃথিবীতে মহাবিপর্যয়ের ত্রাস। মারণব্যাধির মহামারি, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তরে মানবসভ্যতার পরাজয়ের ভয়ঙ্কর ও বিব্রতকর চিত্র। তবু তিনি মানুষকে আশ্বাস দিয়েছেন, উজ্জীবিত করেছেন ‘দুঃসময়’ (কল্পনা)-এর মতো আরো অনেক কবিতা-গানে।

লিখেছেন-দিক-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা-/তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,/এখনি, অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা।’ (দুঃসময়) রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগে-পরে বিশেষত ১৮১৭ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত একশ বছরে সাতবারের কলেরা মহামারিতে ভারতবর্ষে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। ১৮৯৬ সালের প্লেগ মহামারি, ১৮৯৭ সালের বড় ভূমিকম্প অথবা ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুতে বিপুল সংখ্যক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ভূমিকম্পে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কয়েকটি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দুর্যোগের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সংক্রামক ব্যাধি, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়মনীতি বিশ্বকবির মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।

২.
‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থের ‘সমবায়ে ম্যালেরিয়া-নিবারণ’ (ভাদ্র, ১৩৩০) এবং ‘ম্যালেরিয়া’ (জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩১) প্রবন্ধ ছাড়াও সমাজ ও রাষ্ট্রের নানান প্রসঙ্গে তিনি মানবজীবন থেকে ব্যাধি নিবারণের কথা বারবার বলে গেছেন। একটি উদ্ধৃতি- ‘একটা কথা মনে রাখতে হবে, দুর্গতির কারণ সব দেশেই আছে। কিন্তু মানুষের মনুষ্যত্ব কী। না, সেই দুর্গতির কারণকে অনিবার্য বলে মনে না করে, যখন যাতে কষ্ট পাচ্ছি চেষ্টা-দ্বারা তাকে দূর করতে পারি, এ অভিমান মনে রাখা। আমরা এতদিন পর্যন্ত বলেছি, ম্যালেরিয়া দেশব্যাপী, তার সঙ্গে কী করে লড়াই করব, লক্ষ লক্ষ মশা রয়েছে তাদের তাড়াব কী করে, গভর্মেণ্ট আছে সে কিছু করবে না... আমরা কী করব! সে কথা বললে চলবে না। যখন আমরা মরছি, লক্ষ লক্ষ মরছি... কত লক্ষ না মরেও মরে রয়েছে...যে করেই হোক এর যদি প্রতিকার না করতে পারি আমাদের কিছুতেই পরিত্রাণ নেই। ম্যালেরিয়া অন্য ব্যাধির আকর। ম্যালেরিয়া থেকে যক্ষ্মা অজীর্ণ প্রভৃতি নানারকম ব্যামো সৃষ্টি হয়। একটা বড়ো দ্বার খোলা পেলে যমদূতেরা হুড়্ হুড়্ করে ঢুকে পড়ে, কী করে পারব তাদের সঙ্গে লড়াই করতে। গোড়াতে দরজা বন্ধ করা চাই, তবে যদি বাঙালি জাতিকে আমরা বাঁচাতে পারি।’ আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে সম্মিলিতভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ব্যাধি বিস্তার রোধ করার উপায় বলেছিলেন কবি।

আরো এক জায়গায় তিনি লিখেছেন- ‘আমরা অনেকে জানি ম্যালেরিয়া কিরকম গোপনে ধীরে ধীরে মানুষকে জীবন্মৃত করে রাখে। এ দেশে অনেক জিনিস হয় না; অনেক জিনিস আরম্ভ করি, শেষ হতে চায় না; অনেক কাজেই দুর্বলতা দেখতে পাই...পরীক্ষা করলে দেখা যায় ম্যালেরিয়া শরীরের মধ্য থেকে তেজ কেড়ে নিয়েছে। চেষ্টা করবার ইচ্ছাও হয় না।’ অর্থাৎ রোগের প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর ছিল স্পষ্ট ধারণা। তাছাড়া তখন বিশ্বভারতীর একটা ব্যবস্থা ছিল- শান্তিনিকেতনের চারিদিকে যে-সমস্ত পল্লিবসতি দেখা যেত সেগুলিকে তিনি নীরোগ রাখার জন্য বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন।

৩.
বিশ্বকবি লিখেছেন- ‘সন্ত্রাসের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।/সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ/মুক্তো করো ভয়/আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।’ বিভিন্ন সংকটে ও দুর্যোগে আমরা ‘ম্রিয়মাণ’ কিন্তু ভয়-মুক্ত হওয়ার জন্য যাঁর কাছে মানসিক শক্তি পেতে পারি তিনি আমাদের জীবনে আবির্ভূত সংকট নিবারণের বাঞ্চিত সঙ্গী। তিনি নিজেও আশি বছর বয়স পর্যন্ত নিজের স্ত্রী, সন্তান ও নিকটাত্মীয়দের মৃত্যুর করালগ্রাসে হারিয়ে যেতে দেখেছেন; তবে বিচ্ছেদ ও একাকিত্বের গভীর বেদনাকে অন্তরে ধারণ করে নিজের শক্তিতে জয়ী হয়েছেন। তাঁর দু কন্যা মাধুরীলতা ও রেণুকা দেবীর হয়েছিল যক্ষ্মাতে মৃত্যু এবং ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছিল কলেরায়। অন্য কন্যা মীরাদেবীর পুত্র নীতীন্দ্রনাথের অকাল প্রয়াণও তাঁকে মর্মদাহিক বেদনায় দিশেহারা করেছিল।

তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পিতৃস্মৃতি’তে লিখেছেন- ‘ভাগ্যের উত্থান-পতন, দুঃখ কিংবা ক্লেশ কোনো কিছুই অবশ্য বাবার চিত্তের প্রশান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারত না। মহর্ষির মতই তিনিও সর্বাবস্থায় অবিচলিত থাকতেন। বেদনা যতই পীড়াদায়ক হোক না কেন, তা তাঁর ভিতরের শান্তিকে নষ্ট করতে পারত না। সবচেয়ে দুঃখের দুর্ভাগ্যকে সইবার মত এক অতিমানবিক শক্তি ছিল তাঁর।’

এর কারণ হলো তিনি ছিলেন বিশ্বের তাবৎ মানুষের ঐক্যবদ্ধতায় বিশ্বাসী। তিনি ভেবেছেন- ‘মানুষের মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ নেই, সমস্ত মানুষ এক। মানুষের সমাজে একজনের পাপের ফলভোগ সকলকেই ভাগ করে নিতে হয়; কারণ, অতীতে ভবিষ্যতে, দূরে দূরান্তে, হৃদয়ে হৃদয়ে, মানুষ যে পরস্পর গাঁথা হয়ে আছে।...যে পাপের ভার এতদিন নানা স্থানে নানা জনে জমাইয়া তুলিতেছিল, তাহারই আঘাতে রুদ্র আজ জাগ্রত হইয়াছেন-দেবতার ও মানবতার অপমান তিনি সহ্য করিতে পারিতেছেন না।’

রুদ্রের রোষেই আজ করোনা মহামারিতে এত মৃত্যু, এত ঝড়-ঝঞ্ঝা; এই মৃত্যু মানবেরই পাপের প্রায়শ্চিত্ত। তাই নতুন বন্দরে নোঙর করতে হলে সে মৃত্যুকেও বরণ করতে হবে; সে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে অকম্পিত বুকে বলতে হবে- ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।/তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,/বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।/...নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ।’

২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে একদিকে যুদ্ধের মৃত্যুভীতি অন্যদিকে উষ্ণ প্রকৃতির অসহনীয়তার পর সতেজ ও অবিনশ্বরতায় প্রাণের নিত্যধারা প্রবহমান। এই কঠিন ও সহজ সময়ে আনন্দ-বেদনা, মিলন-বিরহ, আগমন-বিদায় আর পুনরাগমন-পুনর্মিলনের খণ্ডাংশের যাপিত-জীবনে এসেছে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী- যা উজ্জ্বলতর মুহূর্তগুলোর একটি। আর দুর্যোগ, দুর্বিপাকে তাঁকে স্মরণ করেই আমাদের শান্তি ও আনন্দ লাভ সম্ভব।

৪.
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের সংকটে মৃত্যু, যন্ত্রণা ও দুঃখ-কষ্টে আমরা যেমন রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করছি তেমনি যারা মানবতার সেবায় নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছেন কিংবা মানুষের ধর্ম পালন করছেন তাদেরও সম্মান জানাচ্ছি বিশ্বকবির ভাবনা দিয়েই। রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘যা আমাদের ত্যাগের দিকে, তপস্যার দিকে নিয়ে যায় তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম।’ ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন-‘মানুষ বিষয়বুদ্ধি নিয়ে নিজের সিদ্ধি অন্বেষণ করে। সেখানে ব্যক্তিগত জীবনযাত্রানির্বাহে তার জ্ঞান, তার কর্ম, তার রচনাশক্তি একান্ত ব্যাপৃত।

সেখানে সে জীবরূপে বাঁচতে চায়। তাঁর আরো এবটি দিক আছে যেখানে ব্যক্তিগত বৈষয়িকতার বাইরে। সেখানে জীবনযাত্রার আদর্শে লাভ-ক্ষতির বিচার করে না বরং অনিশ্চিত কালের উদ্দেশে আত্মত্যাগ করতে চায়। সেখানে স্বার্থের প্রবর্তনা নেই। আপন স্বতন্ত্র জীবনের চেয়ে যে বড়ো জীবন সেই জীবনে মানুষ বাঁচতে চায়।’ রবীন্দ্রভাষ্য মতে, আত্মত্যাগী মানুষই মনুষ্যত্বের দিশারি। তারাই এই বিশ্বজগতকে সংকট থেকে রক্ষা করতে পারে। মহামারির সংকটে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

৫.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের প্রারম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলেন আধুনিক সভ্যতার দান হলো ইউরোপের অন্তরের সম্পদ। কিন্তু পৃথিবীর সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ দেখে ৮০ বছর বয়সে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে যায় তাঁর। ‘তবু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’ সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করে গেছেন তিনি। ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে আশা করেছিলেন- ‘মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে।

আর-একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান মনে করি। এই কথা আজ বলে যাব, প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে; নিশ্চিত এ সত্য প্রমাণিত হবে...। ‘অপরাজিত মানুষে’র জয় আর ‘প্রবলপ্রতাপশালীর ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা’র অবসান যে সত্য হবে সে কথা মৃত্যুর ঠিক আগে বলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রত্যাশা করেছিলেন ‘মানব-অভ্যুদয়ে’র মধ্য দিয়ে নতুন জীবনের। লিখেছেন- ‘অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত/ধূলিতলে হয়ে যাবে ভগ্ন।/ নবজীবনের আশ্বাসে।/ জয় হবে মানব-অভ্যুদয়।’

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় মানবপীড়নের মহামারি দেখেছিলেন। দেখেছিলেন মানুষে মানুষে যে সম্বন্ধ সবচেয়ে মূল্যবান এবং যাকে যথার্থ সভ্যতা বলা যেতে পারে তার কৃপণতা ভারতীয়দের উন্নতির পথ সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে দিয়েছিল। দেখেছিলেন পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর বর্বরতা জাগ্রত হয়ে উঠে মানবাত্মাকে অপমানে নিঃস্ব করে দেবার ঘটনাও। তিনি নিভৃতে সাহিত্যের রসসম্ভোগের উপকরণের বেষ্টন থেকে বেরিয়ে এসে ভারতবর্ষের জনসাধারণের নিদারুণ দারিদ্র্য সচক্ষে দেখেছেন। অন্ন-বস্ত্র-পানীয়- শিক্ষা-আরোগ্য প্রভৃতি মানুষের শরীরমনের পক্ষে যা-কিছু অত্যাবশ্যক তার নিরতিশয় অভাব দেখে তিনি আধুনিক-শাসনচালিত ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি রুষ্ট হয়েছেন।

জনসাধারণের প্রতি ব্রিটিশদের অপরিসীম অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদাসীন্য ছিল বলেই বাংলায় সংক্রমিত কলেরা ও ম্যালেরিয়া মহামারিতে তাঁর ভূমিকা ও দিক-নির্দেশনা পূর্বে উল্লিখিত ‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থে যথার্থভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরের সময়টিও ছিল মানবসভ্যতার এক সন্ধিক্ষণ। সেসময় মানবসভ্যতার পরিবর্তনের রূপ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন কবি। সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের পতন চেয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধনতন্ত্র গণতন্ত্রের সঙ্গেই পথ ধরে চলেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে কবির শঙ্কিত মন বারবারই বিশ্বের মানুষকে সচেতন করার জন্য উদগীব হয়েছে। এজন্যই ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ ও আত্মতৃপ্তির পরিধি থেকে মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন- ‘মানুষ আপন উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিসীমাকে পেরিয়ে বৃহৎমানুষ হয়ে উঠছে, তার সমস্ত শ্রেষ্ঠ সাধনা এই বৃহৎমানুষের সাধনা। এই বৃহৎমানুষ অন্তরের মানুষ। বাইরে আছে নানা দেশের নানা সমাজের নানা জাত, অন্তরে আছে এক মানব। ইতিহাসে দেখা যায়, মানুষের আত্মোপলব্ধি বাহির থেকে অন্তরের দিকে আপনিই গিয়েছে, যে অন্তরের দিকে তার বিশ্বজনীনতা, যেখানে বস্তুর বেড়া পেরিয়ে সে পৌঁচেছে বিশ্বমানসলোকে।’

সংকীর্ণ মানসিকতা দিয়ে পৃথিবীর মঙ্গল করা যায় না। জীবনকে সার্থক করার জন্য প্রয়োজন বিশ্বজনীন কর্মপ্রয়াস। সকল মানুষের মধ্যে ঐক্যসূত্র গাথাই হলো বিশ্বজনীনতা। মানুষ ব্যক্তিগত সীমাকে অতিক্রম করতে পারলেই তার বিশ্বমানব সত্তা চিহ্নিত হয়। ব্যক্তিগত মানুষ নয়, সে বিশ্বগত মানুষের একাত্ম। দেশকালগত সংকীর্ণ পার্থক্যের দিকে মনোযোগ না দিয়ে মানব সভ্যতার সমস্যাকে সমগ্র মানবের সত্য বলে জানতে হবে। চেষ্টা করতে হবে তা থেকে উদ্ধারের।

কবির মতে, ‘মানুষ আপনাকে জেনেছে অমৃতের সন্তান, বুঝেছে যে, তার দৃষ্টি, তার সৃষ্টি, তার চরিত্র, মৃত্যুকে পেরিয়ে। মৃত্যুর মধ্যে গিয়ে যাঁরা অমৃতকে প্রমাণ করেছেন তাঁদের দানেই দেশ রচিত। সব মানুষকে নিয়ে; সব মানুষকে অতিক্রম করে, সীমাবদ্ধ কালকে পার হয়ে এক-মানুষ বিরাজিত।’ এই যে দেশকালপাত্র ছাড়িয়ে মানুষের বিদ্যা, মানুষের সাধনা সত্য হয়ে ওঠা এখানেই মানবধর্মের সারকথা নিহিত। ‘মানুষ এক দিকে মৃত্যুর অধিকারে, আর-এক দিকে অমৃতে; এক দিকে সে ব্যক্তিগত সীমায়, আর-এক দিকে বিশ্বগত বিরাটে। এই দুয়ের কোনোটাকেই উপেক্ষা করা চলে না।’ তবে প্রবৃত্তিতাড়িত মানুষ কখনও বিশ্বজীবনের জন্য কিছু করতে পারে না। এজন্য দরকার আত্মত্যাগী মানুষ যার আত্মগৌরব নেই।

৬.
মূলত জলবায়ুর উষ্ণতা কিংবা যুদ্ধের মহামারিতে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট ও সভ্যতার বিপর্যয় মোকাবেলা করার জন্য আমরা বিশ্বকবির জন্মদিনে তাঁর রচনা থেকেই আতঙ্ক ও কষ্ট দূর করার রসদ পাচ্ছি। তিনি যেন এসব সংকটে ঠেলে ভাঙনের পথে এসেছেন পৃথিবীকে রক্ষা করতে। কারণ মৃত্যুভীতিতেও আমরা মনে করি তাঁর কথাই সত্য- ‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’… ‘আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।’

মারণঘাতি ভাইরাসের মধ্যে তাঁর প্রকাশ সূর্যের মতো কুহেলিকা উদঘাটন করছে। ভয়কে জয় করার জন্য রিক্ত, ব্যর্থ, শূন্য মানুষকে বিস্ময়ে তিনিই উজ্জীবিত করছেন আজও। ২৫ বৈশাখে লেখা তাঁর নিজের কবিতাতেও সেই অভিব্যক্তি- ‘তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন/সূর্যের মতন।/ রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন।/ ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,/ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময়।’ অসীমের চিরবিস্ময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজকের পৃথিবীতেও স্মরণীয়।

লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email: [email protected]

;

ফেরদৌস আরার প্রবন্ধের আলপথ বেয়ে পাঠক চলে যান জ্ঞানের সমুদ্রদর্শনে



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘লেখকের প্রচুর অধ্যয়ন, পাঠগভীরতা, নিবিড় অনুসন্ধিৎসা, ঘোরলাগা শব্দপুঞ্জে, ভাষার শিল্পিত সুষমায় লেখাগুলি প্রাণ পেয়েছে। তাই গ্রন্থের তথ্যসমৃদ্ধ বারোটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য শুধু নয়, নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, জানার তাগাদা তৈরি করবে—বোধে, তৃষ্ণায়, জীবনজিজ্ঞাসায়। নিজের কথাই বলি, ফেরদৌস আরা আলীমের চোখ দিয়ে পড়তে পড়তে আমি নিজে প্রায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আফরোজা বুলবুল কিংবা প্রতিভা মোদক (‘যে জীবন শিল্পের, যে শিল্প জীবনের’), করুণা বন্দোপাধ্যায়, রবিশংকর বলকে (‘চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর’) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে আস্বাদ করি সময়-পরিক্রমায় লেখক ফেরদৌস আরা আলীমের কলমের ক্ষুরধার ক্রমমুগ্ধকর সৌন্দর্য।’

শনিবার (৪ মে নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক গলিতে অবস্থিত মাসিক নারীকণ্ঠ পত্রিকা-আয়োজিত ‘বই আলোচনা’-অনুষ্ঠানে ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আলপথে শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের মূল আলোচকের আলোচনায় তহুরীন সবুর ডালিয়া এসব কথা বলেন। বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনায় আরও অংশ নেন নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা জিনাত আজম, সালমা রহমান ও মাধুরী ব্যানার্জী।

নারীকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আহমেদ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শাহরিয়ার ফারজানা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতারী ইসলাম বলেন, ‘নানা বিষয়ে ফেরদৌস আরা আলীমের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সহজভাবে তিনি আমাদের সমাজবাস্তবতার যে-চিত্র আঁকেন তা মনের গভীরে সাড়া জাগায়। তার লেখা পড়ে এটুকু বলতে পারি যে, তার লেখা আমাদের জন্য গবেষণা ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান আকর।’

প্রবন্ধের আলপথে বইয়ের প্রকাশক, কবি ও খড়িমাটি-সম্পাদক মনিরুল মনির বলেন, ‘নারীমুক্তি বিষয়ে এ-বইয়ে দুটি তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে আরও কাজ করার জন্য গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রকাশিত বই নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘বড় কিছু হওয়ার কথা ভেবে লিখিনি, মনের আনন্দেই গোপনে গল্প-কবিতা লিখেছি। এমন একসময়ে আমরা লিখতাম, লেখা প্রকাশ করতে খুব লজ্জাবোধ করতাম। অবশ্য লিখতে গিয়ে তেমন কঠিন বাধা আমাকে ডিঙোতে হয়নি। একালের চেয়ে আমাদের সময়টা ছিল অনেক সুন্দর ও ভালো। মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল সমাজে। গণ্ডগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে চড়ে ঢাকা গিয়েছি একা-একা, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। মা-বাবারাও নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকাল মেয়েরা পদে-পদে বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের কলুষিত সমাজব্যবস্থা ও নষ্ট রাজনীতি।’ সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রশংসার ভূমিকা কম নয়। একজন লেখক তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য পেলে অনুপ্রাণিত হন যা তাকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি জোগায়।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা ও সদস্য রোকসানা বন্যা, মহুয়া চৌধুরী, রেহানা আকতার, সাহানা আখতার বীথি, কানিজ ফাতেমা লিমা, বিচিত্রা সেন, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, চম্পা চক্রবর্ত্তী, প্রচার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জয়, কবি মেরুন হরিয়াল ও কবি মুয়িন পারভেজ প্রমুখ।

;

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

;