স্বাধীনতার কারা শত্রু কারা মিত্র



জাফর ওয়াজেদ
অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

অলঙ্করণ: কাজী যুবাইর মাহমুদ

  • Font increase
  • Font Decrease

আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার আগে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে সাড়ে সাতকোটি বাঙালিকে স্বাধীনতার কঠিন অভিযাত্রায় সর্বাত্মক লড়াইয়ের ডাক দিয়েছিলেন। ঘোষণা করেছিলেন, “বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে (পাকিস্তানি) সেনাবাহিনীর দখলকারীদের মোকাবেলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।” এই ঘোষণার শুরুতেই উচ্চারণ করেছিলেন চূড়ান্ত ভাষ্যটি, “আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।” আমরা বাঙালিরা সেদিনই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম দখলদার পাক হানাদার বাহিনী ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে। তার আগে পঁচিশে মার্চ রাতেই হানাদার জান্তারা গণহত্যা চালায় দেশ জুড়েই। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি জাতি রুখে দিয়েছিল হানাদার বাহিনীকে। অর্থাৎ পাকিস্তানি বাহিনীর শেষ সেনাটিকেও বাধ্য করেছিল বাংলার মুক্তিবাহিনী আত্মসমর্পণে নত হতে। সহায়তায় পেয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর। দু দেশের সেনা ও মুক্তিবাহিনী মিলে গড়ে উঠেছিল মিত্রবাহিনী। যৌথ এ বাহিনী সম্মিলিতভাবে শেষ আঘাত হেনে পর্যুদস্ত করেছিল নাফরমান ও নরঘাতক হানাদার পাকিস্তানি সেনাদের।

হানাদারদের সহযোগিতায় বাঙালি নামধারী যে সব পদলেহীরা এগিয়ে গিয়েছিল, পুরো নয়মাস তারাও এদেশের মানুষের বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান শুধু নেয়নি, হত্যা, খুন-ধর্ষণ-লুট ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের কাজও করেছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগিতায় গড়ে তোলা হয় বিভিন্ন বাহিনী। সশস্ত্র সংগঠনও। শান্তি কমিটি, আলবদর, আল শামস, মুজাহিদ বাহিনী এবং রাজাকারের নামে জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, পিডিপি, কেএসপি, মুসলীম লীগের দুটি গ্রুপসহ ইসলামপন্থী নামধারী রাজনৈতিক সংগঠনগুলো সহায়ক শক্তি হিসেবে দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়। প্রত্যন্ত গ্রামেও তারা পথঘাট চিনিয়ে নিয়ে গেছে পাকিস্তানি হানাদারদের। মানুষ হত্যা, লুটপাট, তাণ্ডব, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ সবই চালিয়েছে তারা হানাদারদের সহযোগী হিসেবে। মুক্তিবাহিনীর সদস্য যত না সম্মুখ সমরে শহীদ হয়েছে, তার চেয়ে বেশি পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তায় রাজাকাররা নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। তাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধা মানেই দুষ্কৃতকারী, ভারতীয় চর। গ্রামকে গ্রাম এরা দিয়েছে উজার করে। বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায় এবং আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী-সমর্থকদের বাড়িঘরে লুট, অগ্নিসংযোগ শুধু নয়, লাইন করে সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে হত্যা করেছে বৃদ্ধ, যুবক, কিশোর-শিশুকে। পাশবিক অত্যাচার করে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে নারীদের। ধর্ষণের মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। হিটলারের ইহুদি জাতি নিধনের মতো এরা বাঙালি হত্যার নারকীয় তাণ্ডবে মেতেছিল এই বলে যে, তারা এদেশের মানুষ চায় না, চায় মাটি। তাই গ্রহণ করেছিল পোড়ামাটি নীতি।

এই রাজাকার, আল বদররা সহযোগিতা না করলে পাকিস্তানি হানাদাররা আরো আগেই দেশ ছেড়ে যেত বা আত্মসমর্পণ করত এবং এত প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হতো না। এই বিশ্বাসঘাতক নরাধমরা বাঙালি নামের কলঙ্ক অবশ্যই। এদের বীভৎসতার শিকার থেকে গবাদি পশু, হাঁস-মুরগী এমনকি পারিবারিক পাঠাগারও রেহাই পায়নি। ধর্মীয় গ্রন্থাদিও পুড়িয়েছে তারা। ধর্ম তাদের তখন একমাত্র বাঙালি নিধন। অর্থাৎ জল্লাদ, কসাই ইত্যাদিতে পরিগণিত হয়েছিল। মুক্তিবাহিনীর হাতে শেষ মরণ কামড় খাওয়ার আগে এই নরঘাতক দল দেশের সেরা সন্তান চিকিৎসক, শিক্ষক, শিল্পী, সাংবাদিকদের বাড়ি থেকে ধরে চোখ বেঁধে ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন শেষে রায়ের বাজার ও মিরপুরে হাত পা বাঁধা অবস্থায় বেয়নেটে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে। নয় মাসের প্রতিটি ঘটনাই ছিল লোমহর্ষক, হৃদয়বিদারক, মর্মঘাতী। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার দৃশ্য আজও ভাসে পেছনে তাকালে। যুদ্ধের ঊনপঞ্চাশ বছরের মাথায় সেই ভয়াবহতার কথা, দৃশ্য বারবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আজকের প্রজন্মও এই বর্বরদের ক্ষমা করেনি, করতে পারে না। তারা মনে করে ত্রিশ লাখ বাঙালির আত্মদান আর তিন লাখের বেশি মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত দেশে পরাজিত শক্তির অপতৎপরতা বন্ধ করা জরুরি।

১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি চিহ্নিত করতে পেরেছিল কে তার শত্রু, কে তার মিত্র। কিন্তু সেই শত্রুকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। আর তা হয়নি বলেই আজ এত বছর পরও সেই শত্রু নিধন প্রসঙ্গটি বাস্তব ও জরুরি হয়ে পড়েছে। আজকের প্রজন্মের কাছে বিষয়টি গুরুত্ববহ হবার কারণও তাই; পূর্বসূরিরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে যে দেশ হানাদার ও দখলদার মুক্ত করেছে, যে পতাকা এনেছে; সেসব ক্রমশ ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। দুর্ভাগ্য, কিংবা ব্যর্থতা আমাদেরই যে, নরঘাতকরা বসেছিল ক্ষমতার সিংহাসনে, এই বাংলাদেশে।

পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পাই, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমিও ছিলাম। নবম শ্রেণীর স্কুল ছাত্রটির চোখে মুখে তখন স্বাধীনতার স্পৃহা আর হানাদার বিতাড়ন দৃঢ় হয়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন ক্ষুধা আমাকে করতে পারেনি দমিত। বিচলিত করতে পারেনি রক্তগঙ্গা। হত্যাযজ্ঞ আতঙ্কিত করেনি, করেনি ধংসযজ্ঞ। মর্টার, কামানের গোলা পারেনি আমাকে ধ্বংস করতে। বরং ওইসব শব্দ ছিল আমার নিত্যসঙ্গী। প্রতি মুহূর্তে আমার আশপাশে মুক্তিযোদ্ধার জন্ম দেখেছি। এই মাটি, আমার চোখের সামনে শহীদের রক্তপ্রবাহে দ্বিমাত্রিক হয়ে গেছে। আবার সেই রক্তবিন্দু থেকেই বিদ্রোহী ও অগ্নিশিখার আবির্ভাব দেখেছি। বাঙালির বিদ্রোহ, ওই অগ্নিমূর্তি, এই স্পর্ধা, এই অস্ত্র, এই রক্তের মধ্যেই আমরা প্রতিফলিত হয়েছি। তারপর একদিন আমাদের রক্তপ্রবাহ স্থবির হয়ে দাঁড়ায়। পর্বতের মতো বলীয়ান ও শাক্তিধর এক পুরুষের জন্ম হয়—সেই আমার স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতার বৈভবে, তার আকুতি আর ক্রন্দনে, লাখো মুক্তিযোদ্ধার প্রতিচ্ছবি দৃশ্যমান হয়। স্বাধীনতা সেই স্পর্শ, সেই গৌরব অচঞ্চল মূর্তির মতো স্থাণুবৎ দাঁড় করিয়ে রাখে। এটা তো বাস্তব যে, বাঙালি জাতি স্বাধীনতা সম্পর্কে যত সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করেছে, ততটা অন্যেরা বোধহয় পায়নি। স্বাধীনতার ধারণাটি রবীন্দ্রনাথ যেভাবে আমাদের দিয়েছেন, আর কোনো মনীষী সেভাবে দেননি। রবীন্দ্রনাথের মতে, “স্বাধীনতা বাইরের বস্তু নহে। মনের ও আত্মার স্বাধীনতাই প্রকৃত স্বাধীনতা। স্বাধীনতাকে জীবনের আদর্শ হিসেবে যে গ্রহণ করিতে শিখিয়েছে এবং অপরের প্রতি উহা সম্প্রসারিত করিতে যে কুণ্ঠিত নয়, সেই প্রকৃত স্বাধীনতার উপাসক। ....স্বাধীনতা সম্বন্ধে অপরের প্রতি যাহার একান্ত অবিশ্বাস এবং সন্দেহ, স্বাধীনতার ওপর তাহার কিছুমাত্র নৈতিক দাবি থাকে না, সে পরাধীনই রহিয়া যায়। আমি তাই আমার দেশবাসীকে একথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই যে, স্বাধীনতার ওপর তাহাদের আকাঙ্ক্ষা তাহা কি বাইরের কোনো বস্তু বা অবস্থা বিশেষের ওপর নির্ভরশীল? তাহারা কি তাহাদের সমাজের ক্ষেত্রে শত রকমের অন্যায় ও অসঙ্গত বাধা হইতে বিমুক্ত এতটুকু স্থান ছাড়িয়া দিতে সম্মত আছেন, যাহার ভিতর তাহাদের সন্তান-সন্ততি মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ মর্যাদায় দিন দিন বড় হইয়া উঠিতে পারে?” রবীন্দ্রনাথ ‘স্বাধীনতার মূল্য’ প্রবন্ধে মানবতাবোধকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। একাত্তর সালে মানবিকতার জয় হয়েছিল। আর পরাজয় ঘটেছিল দানবিকতার।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ দৃশ্যত একাত্তরের মার্চ থেকে শুরু হলেও এর প্রেক্ষাপট অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। এটি ছিল দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি। এই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন এবং নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একাত্তরের ২৫-২৬ মার্চ রাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নেতা বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা দেওয়ার নেপথ্যে একটা রাজনৈতিক, কৌশলগত কারণ অবশ্যই ছিল। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি শুধু নয়, ১৪ কোটি পাকিস্তানিদেরও তিনি নির্বাচিত অবিসংবাদিত নেতা। যার অঙ্গুলি হেলনে ও নির্দেশে তখন বাংলাদেশ চলছিল। তিনি পালিয়ে বা আত্মগোপন করলে তো হানাদার পাকিস্তানি ও তার মিত্ররা সুযোগ পায় বিশ্বমানবতাকে তাদের পক্ষে নেওয়ার। এমনিতেই আজকার বৃহৎ পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা শুধু নয়, অস্ত্র ও অর্থ সাহায্যে পাকিস্তানকে বলীয়ান করছিল। বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি বিশ্বজনমতের সমর্থন লাভ করা সহজতর হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় যদিও বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। বন্দী মুজিব হয়ে ওঠেন দ্বিগুণ শক্তিশালী। তার নামেই পরিচালিত হয় যুদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার জন্য পাকিস্তানি সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগকে এককভাবে দায়ী করে রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা দিয়েছিল। ‘পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ’ সৃষ্টির পথ সুগম করার অভিযোগ এনে ইয়াহিয়া খানরা বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদণ্ড প্রদানে বদ্ধপরিকর ছিল। কিন্তু ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, সোভিয়েত রাশিয়াসহ বিশ্বজনমতের চাপে ও ভয়ে সেই দণ্ড কার্যকর করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হবার পরপরই বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। বাংলাদেশ এক ঘোষণায় স্বাধীন হয়ে গেছে বলে যারা ভাবেন ও বলেন, তারা আসলে এদেশকেই মেনে নিতে পারেন না বা ইতিহাসের বিরুদ্ধে, পরাজিত শক্তির পক্ষাবলম্বন করেন। বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে তার জাতিকে স্বাধীনতার জন্য তৈরি করেছিলেন। জাগিয়ে তুলেছিলেন জাতীয়তাবাদী সত্তা। জাতিসত্তাকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল তার অনন্য কৃতিত্ব। আর এই প্রক্রিয়া তো একদিনে বা হঠাৎ করে শুরু হয়নি। বাঙালির দীর্ঘদিনের আত্মানুসন্ধান, দীর্ঘদিনের আন্দোলন ও সংগ্রামের অমোঘ পরিণতি হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। ঊনসত্তর সালেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলাদেশ’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। এবং তা জাঁদরেল পাকিস্তানি সামরিক শাসক গোষ্ঠীর ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে। এদেশের রাজনীতিকে মধ্যযুগীয় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক আবর্ত থেকে উদ্ধার করে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ধারায় প্রবাহিত করার পেছনেও বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল অনন্য। বাঙালির সম্মিলিত ইচ্ছার ধারক বঙ্গবন্ধু বিশ্ন মানচিত্রে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, একটি স্বাধীন পতাকা এনে দিয়েছেন।

যে জাতিকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছেন, যে জাতিকে বিশ্বাস করতেন গভীরভাবে, ভালোবাসতেন, সুখ দুঃখের কথা অনুধাবন করতে পারতেন, সেই বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন পাকিস্তানি ভাবাদর্শে লালিত বিপথগামী বাঙালি সেনাদের হাতে নির্মমভাবে সপরিবারে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যে পাকিস্তানি ভাবধারার প্রতিক্রিয়াশীল চক্র দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়, তাদের হাতেই উত্থান ঘটে একাত্তরের পরাজিত শক্তির এবং সাম্প্রদায়িকতার। গর্ত থেকে, পলাতক জীবন থেকে একে একে সব বেরিয়ে আসে। তাদের তৎপরতা ছিল এমন যে, হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের ব্রতে তারা বলীয়ান। পাকিস্তান আমলের মতোই ধর্মরক্ষার লেভাসে তারা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সুফলগুলো একে একে নস্যাৎ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। অনেক ক্ষেত্রেই তারা কামিয়াব হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করার কাজ শুরু করে। মতলবি কুচকি এই পাপশক্তির স্বার্থে বারবার ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে আবহমান ‘আমরা বাংলার উত্তরাধিকার, বাঙালিত্বের সেক্যুলার সত্তা এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্তর্লীন মৌল সত্যকে।’ সর্বোপরি এদেরই শকুনি আঁচড়ে বিকৃত, খণ্ডিত করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত অন্যতম স্বর্ণকমল পবিত্র সংবিধান। বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতির ওপর পঁচাত্তর পরবর্তী যে আক্রমণ, তাতে এই ফিরে আসা ও আবির্ভূত ঘাতকদের ইচ্ছে ও আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ শুধু নয়, একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের কাজটিও চালানো হচ্ছে অদ্যাবধি। দেশকে পাকিস্তানি কায়দায় পশ্চাদপদ করার জন্য সর্বত্র ধর্মের জিগির তোলা হয়। ক্রমশ তা সমাজের নানা ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ে।

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির কেন স্বাধীনতা প্রয়োজন, কেন দেশভাগের ২৪ বছর পরও বাঙালি স্বাধিকারহীন, কী তার লক্ষ্য, অভিযাত্রা—সবই বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে তুলে ধরেছিলেন। বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি ফিরে এসে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু শত্রুরা থেমে ছিল না। পদে পদে বিড়ম্বনা তৈরি করেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে আরো বিপর্যস্ত করার জন্য নানামুখী তৎপরতা চালিয়েছে। অবস্থা থেকে উত্তরণে বঙ্গবন্ধু সার্বক্ষণিক সচেষ্ট ছিলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসার পরই তাকে হত্যা করা হয়।

যুদ্ধপরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের ১৯৫ জন কর্মকর্তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তিরানব্বই হাজার পাকিস্তানি সেনা ও সরকারি কর্মকর্তা রেসকোর্স ময়দানে ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করেছিল। অপরদিকে পাকিস্তানে আটকে পড়া চার লাখ বাঙালিকে দেশে ফিরিয়ে আনার কাজটিও গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। তাদের পরিবারের সদস্যরা বঙ্গবন্ধু সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগে অনশন কর্মসূচীও নেয়। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী এদেশীয় দোসরদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসেন। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই পর্যন্ত আটটি আদেশের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। বিচার কার্যক্রমও চলছিল। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ দালাল বিশেষ ট্রাইব্যুনালস আদেশে তিনটি সংশোধনী আনা হয়। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশ থেকে এ আইনের অধীনে ৩৭ হাজার ৪শ ৯১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। দ্রুত বিচারের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। যে সব মামলা দায়ের করা হয়েছিল তার মধ্যে ১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ২ হাজার ৮শ’ ৪৮টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছিল। অভিযুক্তদের মধ্যে ৭৫২ জন দোষী প্রমাণিত হয়েছিল। ২ হাজার ৯৬ জন ছাড়া পায়। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর দালাল আইনে আটক যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ মেলেনি তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছিল।

তখন দেশের পরিস্থিতি এমন যে, বাংলাদেশকে ঘিরে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র শুরু হয়। পাকিস্তান, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান থেকে তখনও সরে আসেনি। আর দেশের বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থীরা আঁটঘাট বেঁধে দেশ ও সরকারবিরোধী তৎপরতা চালায়। পরস্পরবিরোধী দাবিতে রাজপথ মুখরিত করে তোলে। কেউ চায় পাকিস্তানী সেনাদের বিচার। কেউ চায় পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনে যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি। কেউ চায় ঘাতক দালালের বিচার। আবার দালাল আইন প্রত্যাহার না করলে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলবেন বলে হুমকি দিয়ে অনশনে নেমেছিলেন স্বয়ং মওলানা ভাসানী। ১৯৭৩ সালে দালাল আইন বাতিলের জন্য ভাসানী ন্যাপ, আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগ, সর্বোপরি নবগঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এই দলগুলোর ছত্রছায়ায় তখন স্বাধীনতাবিরোধীরা আশ্রয় নিয়েছিল। স্বচক্ষে দেখা, তারা ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ ও মিছিল করত। ভাসানীর প্রাচ্যবার্তা, হক কথা, অলি আহাদের ইত্তেহাদ, চীনপন্থীদের নয়াযুগ এবং গণকণ্ঠ নামে জাসদ সমর্থিত সংবাদপত্রগুলো দালালদের পক্ষাবলম্বন করে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশকে মুসলিম বাংলা, বাংলাস্তান করার দাবিও তোলে। বামপন্থী বদরউদ্দিন উমরের পিতা ইতিহাসখ্যাত আবুল হাশিমও মুসলিম বাংলার পক্ষে কলম ধরেন। অবশ্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাকে তাদের পক্ষাবলম্বনে বাধ্য করেছিলেন। ভাসানী ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান যাদুমিয়া পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে দালাল আইনে গ্রেফতার হন এবং জেলে আটক থাকাবস্থায় বিচারের মুখোমুখি হন। মুসলিম লীগ, পিডিপি ইত্যাদি দলের আটক ব্যক্তিদের পরিবার ও সহকর্মীরা জাসদের পতাকার নিচে আশ্রয় নিয়ে দালাল আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তারা দালাল আইন বাতিল ও আটকদের মুক্তির দাবিতে তোপখানা রোডে সমাবেশ করত। এই দাবিতে সমাবেশ জেলা ও থানা পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। এসব সমাবেশ থেকে অভিযোগ তোলা হতো এখনকার মতোই যে, এই আইনের মাধ্যমে সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানি করছে। নিরীহ লোককে দালাল সাজিয়ে সাজা দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য বিভিন্ন স্থানে হাঙ্গামা চালানো হয়। এদের চাপেই সম্ভবত সরকার সাধারণ ক্ষমার পদক্ষেপ নেয়। তবে সাধারণ ক্ষমার প্রেসনোটে বলা হয়েছিল, “ধর্ষণ, খুন, খুনের চেষ্টা, ঘরবাড়ি অথবা জাহাজে অগ্নিসংযোগের দায়ে দণ্ডিত ও অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে ক্ষমা প্রদর্শন প্রযোজ্য হইবে না।” সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও দালাল আইনে আটক ১১ হাজারের বেশি ব্যক্তি এসব অপরাধের দায়ে কারাগারে আটক ছিল এবং তাদের বিচার কার্যক্রম অব্যাহত ছিল।


জাফর ওয়াজেদ
একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)

   

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;

তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা



ড. মিল্টন বিশ্বাস
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  • Font increase
  • Font Decrease

‌‌আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ।
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে।'

আজ ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী। দুর্যোগময় পৃথিবীতে তাঁর জন্মদিন ভিন্নতর তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিত্যসঙ্গী, বাঙালির আত্মপরিচয়ের অন্যতম স্তম্ভ। তাঁকে কেন্দ্র করে কেবল পাকিস্তানি সরকারের বিতর্কিত ভূমিকা নয় ১৯৭১ এর আগে থেকেই বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত হয়েছে তাঁর মাধ্যমে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহানপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এর অন্যতম অনুঘটক। তাঁর দীর্ঘ কারাজীবনের সঙ্গী ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’। লেখাবাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের ভক্ত বঙ্গবন্ধুই আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’কে সংবিধানভুক্ত করেন। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি পূর্ব বাংলার শিল্পীগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তাঁকে দেওয়া এক সংবর্ধনার ভাষণে রবীন্দ্রনাথের কথা এভাবেই বলেছিলেন তিনি- Go to anywhere in the world and tell them that you have come from the country of Tagore, they will respect you.

বিশ্বকবির দেশ বাংলাদেশ। বিশ্বকবির ভাষাপ্রেম এদেশের মানুষকে ভাষা সংরক্ষণের সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তাঁর কবিতা ও গান একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর সঙ্গে বাংলা ও বাঙালির হৃদয়ের সম্পর্ক এবং সংকট-মুহূর্তে তাঁর সাহিত্য-সংগীতের দ্বারা উজ্জীবিত হওয়া সাধারণ একটি ঘটনা। মনে রাখতে হবে পাকিস্তানিদের চেয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য রবীন্দ্রনাথকে বারবারই সামনে এনেছেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন- ‘সাত কোটি বাঙালিকে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি- ‘কবিগুরু, তোমার উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখে যাও তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ জীবদ্দশায় কবিগুরু দেখেছেন যুদ্ধ-বিপর্যস্ত পৃথিবীতে মহাবিপর্যয়ের ত্রাস। মারণব্যাধির মহামারি, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তরে মানবসভ্যতার পরাজয়ের ভয়ঙ্কর ও বিব্রতকর চিত্র। তবু তিনি মানুষকে আশ্বাস দিয়েছেন, উজ্জীবিত করেছেন ‘দুঃসময়’ (কল্পনা)-এর মতো আরো অনেক কবিতা-গানে।

লিখেছেন-দিক-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা-/তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,/এখনি, অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা।’ (দুঃসময়) রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগে-পরে বিশেষত ১৮১৭ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত একশ বছরে সাতবারের কলেরা মহামারিতে ভারতবর্ষে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। ১৮৯৬ সালের প্লেগ মহামারি, ১৮৯৭ সালের বড় ভূমিকম্প অথবা ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুতে বিপুল সংখ্যক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ভূমিকম্পে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কয়েকটি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দুর্যোগের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সংক্রামক ব্যাধি, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়মনীতি বিশ্বকবির মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।

২.
‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থের ‘সমবায়ে ম্যালেরিয়া-নিবারণ’ (ভাদ্র, ১৩৩০) এবং ‘ম্যালেরিয়া’ (জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩১) প্রবন্ধ ছাড়াও সমাজ ও রাষ্ট্রের নানান প্রসঙ্গে তিনি মানবজীবন থেকে ব্যাধি নিবারণের কথা বারবার বলে গেছেন। একটি উদ্ধৃতি- ‘একটা কথা মনে রাখতে হবে, দুর্গতির কারণ সব দেশেই আছে। কিন্তু মানুষের মনুষ্যত্ব কী। না, সেই দুর্গতির কারণকে অনিবার্য বলে মনে না করে, যখন যাতে কষ্ট পাচ্ছি চেষ্টা-দ্বারা তাকে দূর করতে পারি, এ অভিমান মনে রাখা। আমরা এতদিন পর্যন্ত বলেছি, ম্যালেরিয়া দেশব্যাপী, তার সঙ্গে কী করে লড়াই করব, লক্ষ লক্ষ মশা রয়েছে তাদের তাড়াব কী করে, গভর্মেণ্ট আছে সে কিছু করবে না... আমরা কী করব! সে কথা বললে চলবে না। যখন আমরা মরছি, লক্ষ লক্ষ মরছি... কত লক্ষ না মরেও মরে রয়েছে...যে করেই হোক এর যদি প্রতিকার না করতে পারি আমাদের কিছুতেই পরিত্রাণ নেই। ম্যালেরিয়া অন্য ব্যাধির আকর। ম্যালেরিয়া থেকে যক্ষ্মা অজীর্ণ প্রভৃতি নানারকম ব্যামো সৃষ্টি হয়। একটা বড়ো দ্বার খোলা পেলে যমদূতেরা হুড়্ হুড়্ করে ঢুকে পড়ে, কী করে পারব তাদের সঙ্গে লড়াই করতে। গোড়াতে দরজা বন্ধ করা চাই, তবে যদি বাঙালি জাতিকে আমরা বাঁচাতে পারি।’ আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে সম্মিলিতভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ব্যাধি বিস্তার রোধ করার উপায় বলেছিলেন কবি।

আরো এক জায়গায় তিনি লিখেছেন- ‘আমরা অনেকে জানি ম্যালেরিয়া কিরকম গোপনে ধীরে ধীরে মানুষকে জীবন্মৃত করে রাখে। এ দেশে অনেক জিনিস হয় না; অনেক জিনিস আরম্ভ করি, শেষ হতে চায় না; অনেক কাজেই দুর্বলতা দেখতে পাই...পরীক্ষা করলে দেখা যায় ম্যালেরিয়া শরীরের মধ্য থেকে তেজ কেড়ে নিয়েছে। চেষ্টা করবার ইচ্ছাও হয় না।’ অর্থাৎ রোগের প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর ছিল স্পষ্ট ধারণা। তাছাড়া তখন বিশ্বভারতীর একটা ব্যবস্থা ছিল- শান্তিনিকেতনের চারিদিকে যে-সমস্ত পল্লিবসতি দেখা যেত সেগুলিকে তিনি নীরোগ রাখার জন্য বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন।

৩.
বিশ্বকবি লিখেছেন- ‘সন্ত্রাসের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।/সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ/মুক্তো করো ভয়/আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।’ বিভিন্ন সংকটে ও দুর্যোগে আমরা ‘ম্রিয়মাণ’ কিন্তু ভয়-মুক্ত হওয়ার জন্য যাঁর কাছে মানসিক শক্তি পেতে পারি তিনি আমাদের জীবনে আবির্ভূত সংকট নিবারণের বাঞ্চিত সঙ্গী। তিনি নিজেও আশি বছর বয়স পর্যন্ত নিজের স্ত্রী, সন্তান ও নিকটাত্মীয়দের মৃত্যুর করালগ্রাসে হারিয়ে যেতে দেখেছেন; তবে বিচ্ছেদ ও একাকিত্বের গভীর বেদনাকে অন্তরে ধারণ করে নিজের শক্তিতে জয়ী হয়েছেন। তাঁর দু কন্যা মাধুরীলতা ও রেণুকা দেবীর হয়েছিল যক্ষ্মাতে মৃত্যু এবং ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছিল কলেরায়। অন্য কন্যা মীরাদেবীর পুত্র নীতীন্দ্রনাথের অকাল প্রয়াণও তাঁকে মর্মদাহিক বেদনায় দিশেহারা করেছিল।

তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পিতৃস্মৃতি’তে লিখেছেন- ‘ভাগ্যের উত্থান-পতন, দুঃখ কিংবা ক্লেশ কোনো কিছুই অবশ্য বাবার চিত্তের প্রশান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারত না। মহর্ষির মতই তিনিও সর্বাবস্থায় অবিচলিত থাকতেন। বেদনা যতই পীড়াদায়ক হোক না কেন, তা তাঁর ভিতরের শান্তিকে নষ্ট করতে পারত না। সবচেয়ে দুঃখের দুর্ভাগ্যকে সইবার মত এক অতিমানবিক শক্তি ছিল তাঁর।’

এর কারণ হলো তিনি ছিলেন বিশ্বের তাবৎ মানুষের ঐক্যবদ্ধতায় বিশ্বাসী। তিনি ভেবেছেন- ‘মানুষের মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ নেই, সমস্ত মানুষ এক। মানুষের সমাজে একজনের পাপের ফলভোগ সকলকেই ভাগ করে নিতে হয়; কারণ, অতীতে ভবিষ্যতে, দূরে দূরান্তে, হৃদয়ে হৃদয়ে, মানুষ যে পরস্পর গাঁথা হয়ে আছে।...যে পাপের ভার এতদিন নানা স্থানে নানা জনে জমাইয়া তুলিতেছিল, তাহারই আঘাতে রুদ্র আজ জাগ্রত হইয়াছেন-দেবতার ও মানবতার অপমান তিনি সহ্য করিতে পারিতেছেন না।’

রুদ্রের রোষেই আজ করোনা মহামারিতে এত মৃত্যু, এত ঝড়-ঝঞ্ঝা; এই মৃত্যু মানবেরই পাপের প্রায়শ্চিত্ত। তাই নতুন বন্দরে নোঙর করতে হলে সে মৃত্যুকেও বরণ করতে হবে; সে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে অকম্পিত বুকে বলতে হবে- ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।/তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,/বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।/...নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ।’

২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে একদিকে যুদ্ধের মৃত্যুভীতি অন্যদিকে উষ্ণ প্রকৃতির অসহনীয়তার পর সতেজ ও অবিনশ্বরতায় প্রাণের নিত্যধারা প্রবহমান। এই কঠিন ও সহজ সময়ে আনন্দ-বেদনা, মিলন-বিরহ, আগমন-বিদায় আর পুনরাগমন-পুনর্মিলনের খণ্ডাংশের যাপিত-জীবনে এসেছে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী- যা উজ্জ্বলতর মুহূর্তগুলোর একটি। আর দুর্যোগ, দুর্বিপাকে তাঁকে স্মরণ করেই আমাদের শান্তি ও আনন্দ লাভ সম্ভব।

৪.
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের সংকটে মৃত্যু, যন্ত্রণা ও দুঃখ-কষ্টে আমরা যেমন রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করছি তেমনি যারা মানবতার সেবায় নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছেন কিংবা মানুষের ধর্ম পালন করছেন তাদেরও সম্মান জানাচ্ছি বিশ্বকবির ভাবনা দিয়েই। রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘যা আমাদের ত্যাগের দিকে, তপস্যার দিকে নিয়ে যায় তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম।’ ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন-‘মানুষ বিষয়বুদ্ধি নিয়ে নিজের সিদ্ধি অন্বেষণ করে। সেখানে ব্যক্তিগত জীবনযাত্রানির্বাহে তার জ্ঞান, তার কর্ম, তার রচনাশক্তি একান্ত ব্যাপৃত।

সেখানে সে জীবরূপে বাঁচতে চায়। তাঁর আরো এবটি দিক আছে যেখানে ব্যক্তিগত বৈষয়িকতার বাইরে। সেখানে জীবনযাত্রার আদর্শে লাভ-ক্ষতির বিচার করে না বরং অনিশ্চিত কালের উদ্দেশে আত্মত্যাগ করতে চায়। সেখানে স্বার্থের প্রবর্তনা নেই। আপন স্বতন্ত্র জীবনের চেয়ে যে বড়ো জীবন সেই জীবনে মানুষ বাঁচতে চায়।’ রবীন্দ্রভাষ্য মতে, আত্মত্যাগী মানুষই মনুষ্যত্বের দিশারি। তারাই এই বিশ্বজগতকে সংকট থেকে রক্ষা করতে পারে। মহামারির সংকটে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

৫.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের প্রারম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলেন আধুনিক সভ্যতার দান হলো ইউরোপের অন্তরের সম্পদ। কিন্তু পৃথিবীর সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ দেখে ৮০ বছর বয়সে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে যায় তাঁর। ‘তবু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’ সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করে গেছেন তিনি। ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে আশা করেছিলেন- ‘মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে।

আর-একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান মনে করি। এই কথা আজ বলে যাব, প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে; নিশ্চিত এ সত্য প্রমাণিত হবে...। ‘অপরাজিত মানুষে’র জয় আর ‘প্রবলপ্রতাপশালীর ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা’র অবসান যে সত্য হবে সে কথা মৃত্যুর ঠিক আগে বলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রত্যাশা করেছিলেন ‘মানব-অভ্যুদয়ে’র মধ্য দিয়ে নতুন জীবনের। লিখেছেন- ‘অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত/ধূলিতলে হয়ে যাবে ভগ্ন।/ নবজীবনের আশ্বাসে।/ জয় হবে মানব-অভ্যুদয়।’

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় মানবপীড়নের মহামারি দেখেছিলেন। দেখেছিলেন মানুষে মানুষে যে সম্বন্ধ সবচেয়ে মূল্যবান এবং যাকে যথার্থ সভ্যতা বলা যেতে পারে তার কৃপণতা ভারতীয়দের উন্নতির পথ সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে দিয়েছিল। দেখেছিলেন পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর বর্বরতা জাগ্রত হয়ে উঠে মানবাত্মাকে অপমানে নিঃস্ব করে দেবার ঘটনাও। তিনি নিভৃতে সাহিত্যের রসসম্ভোগের উপকরণের বেষ্টন থেকে বেরিয়ে এসে ভারতবর্ষের জনসাধারণের নিদারুণ দারিদ্র্য সচক্ষে দেখেছেন। অন্ন-বস্ত্র-পানীয়- শিক্ষা-আরোগ্য প্রভৃতি মানুষের শরীরমনের পক্ষে যা-কিছু অত্যাবশ্যক তার নিরতিশয় অভাব দেখে তিনি আধুনিক-শাসনচালিত ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি রুষ্ট হয়েছেন।

জনসাধারণের প্রতি ব্রিটিশদের অপরিসীম অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদাসীন্য ছিল বলেই বাংলায় সংক্রমিত কলেরা ও ম্যালেরিয়া মহামারিতে তাঁর ভূমিকা ও দিক-নির্দেশনা পূর্বে উল্লিখিত ‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থে যথার্থভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরের সময়টিও ছিল মানবসভ্যতার এক সন্ধিক্ষণ। সেসময় মানবসভ্যতার পরিবর্তনের রূপ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন কবি। সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের পতন চেয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধনতন্ত্র গণতন্ত্রের সঙ্গেই পথ ধরে চলেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে কবির শঙ্কিত মন বারবারই বিশ্বের মানুষকে সচেতন করার জন্য উদগীব হয়েছে। এজন্যই ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ ও আত্মতৃপ্তির পরিধি থেকে মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন- ‘মানুষ আপন উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিসীমাকে পেরিয়ে বৃহৎমানুষ হয়ে উঠছে, তার সমস্ত শ্রেষ্ঠ সাধনা এই বৃহৎমানুষের সাধনা। এই বৃহৎমানুষ অন্তরের মানুষ। বাইরে আছে নানা দেশের নানা সমাজের নানা জাত, অন্তরে আছে এক মানব। ইতিহাসে দেখা যায়, মানুষের আত্মোপলব্ধি বাহির থেকে অন্তরের দিকে আপনিই গিয়েছে, যে অন্তরের দিকে তার বিশ্বজনীনতা, যেখানে বস্তুর বেড়া পেরিয়ে সে পৌঁচেছে বিশ্বমানসলোকে।’

সংকীর্ণ মানসিকতা দিয়ে পৃথিবীর মঙ্গল করা যায় না। জীবনকে সার্থক করার জন্য প্রয়োজন বিশ্বজনীন কর্মপ্রয়াস। সকল মানুষের মধ্যে ঐক্যসূত্র গাথাই হলো বিশ্বজনীনতা। মানুষ ব্যক্তিগত সীমাকে অতিক্রম করতে পারলেই তার বিশ্বমানব সত্তা চিহ্নিত হয়। ব্যক্তিগত মানুষ নয়, সে বিশ্বগত মানুষের একাত্ম। দেশকালগত সংকীর্ণ পার্থক্যের দিকে মনোযোগ না দিয়ে মানব সভ্যতার সমস্যাকে সমগ্র মানবের সত্য বলে জানতে হবে। চেষ্টা করতে হবে তা থেকে উদ্ধারের।

কবির মতে, ‘মানুষ আপনাকে জেনেছে অমৃতের সন্তান, বুঝেছে যে, তার দৃষ্টি, তার সৃষ্টি, তার চরিত্র, মৃত্যুকে পেরিয়ে। মৃত্যুর মধ্যে গিয়ে যাঁরা অমৃতকে প্রমাণ করেছেন তাঁদের দানেই দেশ রচিত। সব মানুষকে নিয়ে; সব মানুষকে অতিক্রম করে, সীমাবদ্ধ কালকে পার হয়ে এক-মানুষ বিরাজিত।’ এই যে দেশকালপাত্র ছাড়িয়ে মানুষের বিদ্যা, মানুষের সাধনা সত্য হয়ে ওঠা এখানেই মানবধর্মের সারকথা নিহিত। ‘মানুষ এক দিকে মৃত্যুর অধিকারে, আর-এক দিকে অমৃতে; এক দিকে সে ব্যক্তিগত সীমায়, আর-এক দিকে বিশ্বগত বিরাটে। এই দুয়ের কোনোটাকেই উপেক্ষা করা চলে না।’ তবে প্রবৃত্তিতাড়িত মানুষ কখনও বিশ্বজীবনের জন্য কিছু করতে পারে না। এজন্য দরকার আত্মত্যাগী মানুষ যার আত্মগৌরব নেই।

৬.
মূলত জলবায়ুর উষ্ণতা কিংবা যুদ্ধের মহামারিতে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট ও সভ্যতার বিপর্যয় মোকাবেলা করার জন্য আমরা বিশ্বকবির জন্মদিনে তাঁর রচনা থেকেই আতঙ্ক ও কষ্ট দূর করার রসদ পাচ্ছি। তিনি যেন এসব সংকটে ঠেলে ভাঙনের পথে এসেছেন পৃথিবীকে রক্ষা করতে। কারণ মৃত্যুভীতিতেও আমরা মনে করি তাঁর কথাই সত্য- ‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’… ‘আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।’

মারণঘাতি ভাইরাসের মধ্যে তাঁর প্রকাশ সূর্যের মতো কুহেলিকা উদঘাটন করছে। ভয়কে জয় করার জন্য রিক্ত, ব্যর্থ, শূন্য মানুষকে বিস্ময়ে তিনিই উজ্জীবিত করছেন আজও। ২৫ বৈশাখে লেখা তাঁর নিজের কবিতাতেও সেই অভিব্যক্তি- ‘তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন/সূর্যের মতন।/ রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন।/ ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,/ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময়।’ অসীমের চিরবিস্ময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজকের পৃথিবীতেও স্মরণীয়।

লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email: [email protected]

;

ফেরদৌস আরার প্রবন্ধের আলপথ বেয়ে পাঠক চলে যান জ্ঞানের সমুদ্রদর্শনে



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘লেখকের প্রচুর অধ্যয়ন, পাঠগভীরতা, নিবিড় অনুসন্ধিৎসা, ঘোরলাগা শব্দপুঞ্জে, ভাষার শিল্পিত সুষমায় লেখাগুলি প্রাণ পেয়েছে। তাই গ্রন্থের তথ্যসমৃদ্ধ বারোটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য শুধু নয়, নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, জানার তাগাদা তৈরি করবে—বোধে, তৃষ্ণায়, জীবনজিজ্ঞাসায়। নিজের কথাই বলি, ফেরদৌস আরা আলীমের চোখ দিয়ে পড়তে পড়তে আমি নিজে প্রায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আফরোজা বুলবুল কিংবা প্রতিভা মোদক (‘যে জীবন শিল্পের, যে শিল্প জীবনের’), করুণা বন্দোপাধ্যায়, রবিশংকর বলকে (‘চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর’) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে আস্বাদ করি সময়-পরিক্রমায় লেখক ফেরদৌস আরা আলীমের কলমের ক্ষুরধার ক্রমমুগ্ধকর সৌন্দর্য।’

শনিবার (৪ মে নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক গলিতে অবস্থিত মাসিক নারীকণ্ঠ পত্রিকা-আয়োজিত ‘বই আলোচনা’-অনুষ্ঠানে ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আলপথে শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের মূল আলোচকের আলোচনায় তহুরীন সবুর ডালিয়া এসব কথা বলেন। বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনায় আরও অংশ নেন নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা জিনাত আজম, সালমা রহমান ও মাধুরী ব্যানার্জী।

নারীকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আহমেদ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শাহরিয়ার ফারজানা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতারী ইসলাম বলেন, ‘নানা বিষয়ে ফেরদৌস আরা আলীমের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সহজভাবে তিনি আমাদের সমাজবাস্তবতার যে-চিত্র আঁকেন তা মনের গভীরে সাড়া জাগায়। তার লেখা পড়ে এটুকু বলতে পারি যে, তার লেখা আমাদের জন্য গবেষণা ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান আকর।’

প্রবন্ধের আলপথে বইয়ের প্রকাশক, কবি ও খড়িমাটি-সম্পাদক মনিরুল মনির বলেন, ‘নারীমুক্তি বিষয়ে এ-বইয়ে দুটি তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে আরও কাজ করার জন্য গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রকাশিত বই নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘বড় কিছু হওয়ার কথা ভেবে লিখিনি, মনের আনন্দেই গোপনে গল্প-কবিতা লিখেছি। এমন একসময়ে আমরা লিখতাম, লেখা প্রকাশ করতে খুব লজ্জাবোধ করতাম। অবশ্য লিখতে গিয়ে তেমন কঠিন বাধা আমাকে ডিঙোতে হয়নি। একালের চেয়ে আমাদের সময়টা ছিল অনেক সুন্দর ও ভালো। মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল সমাজে। গণ্ডগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে চড়ে ঢাকা গিয়েছি একা-একা, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। মা-বাবারাও নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকাল মেয়েরা পদে-পদে বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের কলুষিত সমাজব্যবস্থা ও নষ্ট রাজনীতি।’ সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রশংসার ভূমিকা কম নয়। একজন লেখক তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য পেলে অনুপ্রাণিত হন যা তাকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি জোগায়।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা ও সদস্য রোকসানা বন্যা, মহুয়া চৌধুরী, রেহানা আকতার, সাহানা আখতার বীথি, কানিজ ফাতেমা লিমা, বিচিত্রা সেন, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, চম্পা চক্রবর্ত্তী, প্রচার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জয়, কবি মেরুন হরিয়াল ও কবি মুয়িন পারভেজ প্রমুখ।

;

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

;