জুতোর বাক্সে ভালোবাসা



সঞ্জয় দে

  • Font increase
  • Font Decrease

‘চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি, বেলা সত্যি’-র মতো সান ডিয়েগো শহরে একটা পেটে-ভাতে চাকরি জুগিয়ে ফেলেছি কয়েক মাস হলো; তবে এখন পর্যন্ত একটা চার চাকার যান কেনবার মতো পয়সা জুগিয়ে উঠতে পারিনি। ওদিকে এ-শহরে গাড়ি না থাকার মানে হচ্ছে হাত-পা গুটিয়ে বস্তাবন্দি হয়ে থাকা। ট্রাম-ট্রেন দূরে থাক, বাস টেম্পোরও কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে আমার কিন্তু সে-অর্থে তেমন কোনো ঝামেলা হচ্ছে না। হাউসমেট মিস্টার ব্রুস ওয়াং প্রতিদিন নিষ্ঠার সাথে আমাকে অফিস নেওয়া আর সপ্তাহান্তে কাছের এক ভিয়েতনামিজ দোকান ভিন হুং-এ নেবার কাজটি করে যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের স্ত্রী আর তিন কন্যা থাকে টরেন্টোতে। আকালের বাজারে আমাকে শেষ মুহূর্তে পেয়ে বাড়িতে এনে তুলেছেন ভাড়া শেয়ার করার জন্যে। সাথে কথা দিয়েছেন, আমার যাতায়াতের ব্যাপারটি দেখবেন বলে। ভদ্রলোক যুবাকালে বেইজিং-এর কলেজ থেকে পাশ করার পর পরই দীর্ঘদিনের প্রণয়িনীর গলায় মালা পরান; আর তার পরের বছরই ওয়াং পত্নীর কোল জুড়ে আসে প্রথম কন্যাসন্তান। চীনে তখন চলছে ‘এক সন্তান, সুখী পরিবার’ নীতি। এই নীতি কিন্তু মিসেস ওয়াংকে সুখী করতে পারেনি। পরের বছরই তার সাধ হয় আরেকটি সন্তানের। কিন্তু চীনে বাস করে তেমন ইচ্ছে ফলালে জেল জরিমানার সম্ভাবনা প্রবল। অগত্যা ওয়াং শুধুমাত্র স্ত্রীর ইচ্ছে চরিতার্থের জন্যে পাড়ি জমালেন কানাডায়। সেখানে একটি নয়, আরো দু দুটি সন্তানের জন্ম হলো। এরপর তাঁদের মাথায় এলো ভিন্ন এক খায়েশ। তিন তিনটে সন্তান তো হলো, এবারে একটি সামনে-পেছনে উঠোনওয়ালা বিশাল বাড়ি চাই। টরেন্টোতে ওয়াং যে টাকা কামান, ও দিয়ে ওই আক্রার বাজারে বিশাল বাড়ি কেনা সম্ভব নয়। এবারে ওয়াংপত্নী তার পশ্চাৎদেশে খেজুরের কাঁটা দিয়ে খুঁচিয়ে বলতে লাগলেন, ‘তুমি না হয় এবারে আমেরিকায় একটা চাকরির চেষ্টা করো। শুনেছি, আমেরিকায় নাকি মেলা টাকা; আমেরিকা মানেই বিশাল গাড়ি, বিশাল বাড়ি।’ বৌয়ের এই অভিলাষে ত্যাক্ত হয়ে ওয়াং একদিন সত্যি সত্যি চাকরি নিয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমান। তবে যে বৌয়ের ধাক্কায় তার এই আমেরিকা অবধি ছুটে আসা, সেই বৌকেই এখন পর্যন্ত এখানে আনতে পারেননি কী এক ভিসাপত্রের ঝামেলায়। মি. ওয়াং এখন খেয়ে না-খেয়ে টাকা জমাচ্ছেন; শুনছি, সামনের বসন্তে ওয়াংপত্নী বালবাচ্চা আর লোটা কম্বলসহ একেবারে ক্যানাডার পাট চুকিয়ে এখানে আসবেন। ততদিন পর্যন্ত এই ভাড়া ফ্ল্যাটের অতিরিক্ত গুমটিঘরটি নিশ্চিতভাবেই আমার নিবাস।

ওয়াংয়ের বাড়ির খুব কাছেই একটি কমিউনিটি লাইব্রেরি। সেখানে হেঁটেই যাওয়া যায়। আমি শনিবারের বিকেলগুলোতে সেখানে মাঝেসাঝে যাই। ঠিক বই পড়তে যাই, তেমন নয়। ওখানে বেশ কিছু ভালো ডিভিডির কালেকশন আছে। এইতো কিছুদিন আগে নিয়ে এলাম দ্যা সোভিয়েত স্টোরি আর দ্যা কোল্ড ওয়ার নামক দুটো ডকুমেন্টারির ডিভিডি। তো সেই লাইব্রেরিতেই একদিন একটি পোস্টার আমার নজরে আসে। করিডরের বাঁ-দিকের একটি দরজায় সাঁটা। সেখানে লেখা রয়েছে, নামমাত্র দক্ষিণার বিনিময়ে লাইব্রেরির একটি ঘরে নাচ শেখানো হবে। আগ্রহীরা সত্তর যোগাযোগ করুন। ভেবে দেখলাম, হাতে যেহেতু বেশ খানিকটা সময় আছে আর এটা যেহেতু হাঁটা পথের মাঝেই—নাচের ক্লাসে কয়েকদিন ঢুঁ মারলে মন্দ হয় না। ঢাকায় ধানমন্ডি লেকের ধারে রুশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে একসময় সালসা শিখেছিলাম। আমি হয়তো তাই পুরোপুরি আনাড়ি ছাত্র নই, হাতেখড়ি আছে আমার। তো সাহস করে একদিন পৌঁছে গেলাম নাচের ক্লাসে। শুরুতেই কিছুটা হতোদ্যম হতে হলো। ক্লাসের যারা ছাত্র ছাত্রী, তাঁদের প্রায় সকলেরই বয়স সত্তরের কোঠায়। অবসর জীবনের নিঃসঙ্গতা ঘোঁচাতে নাচের ক্লাসে মজেছেন। বুড়োরা ঝকমকে বাটিকের শার্ট আর বুড়িরা চড়া মেকআপ লাগিয়ে বাহুলগ্না হয়ে তুমুল ছন্দে নাচছেন। এতসব মানুষের মাঝে কেবল মাত্র দুজন রমণীর বয়স হয়তো ত্রিশের কোঠায়। চেহারা সুরতে মনে হলো দুজনেই হিস্পানিক। এঁদের একজনের গা দিয়ে ভুরভুর করে বেরোচ্ছে পেঁয়াজের গন্ধ। সে গন্ধ এতটাই প্রবল যে, তিনি আমাকে নাচের জন্যে জাপটে ধরলেও আমাকে পাশ কাটাতে হয়। সুতরাং রইল বাকি এক। এই যে একজন, ওর নাম ভেনেসা। আশপাশেই নাকি থাকে, আর কাজ করে একটি কোম্পানির কেরানি পদে। এ শহরে ভেনাসাও আমার মতোই নবাগত।  এতকাল ও ছিল ভেনচুরা কাউন্টি নামক শহরে। সেখানেই ওর পরিবার।

/uploads/files/ftwFm6xeBiG5wbihqODWF2ta782PpFUhCsRVBs9C.jpeg
নাচের ক্লাসে একই জনের সাথে বহুক্ষণ নাচা যায় না। কারণ, কিছুক্ষণ পর পরই নাচের মাস্টারের রব ভেসে ওঠে—‘জেন্টলম্যান রোটেট, রোটেট প্লিজ।’ মানে হলো, সঙ্গী বদল করে আর কাউকে ধরুন। একজনের সাথেই আঠার মতো লেগে থাকলে মন হয়তো নাচের ছন্দ থেকে পথ খুঁজে নেবে সঙ্গীর কোমরসন্ধিতে। যদিও এই রোটেশনের ব্যাপারটাতে আমার চরম অনীহা। আমি চেষ্টা করি, ঘুরে ফিরে ওই ভেনেসাতেই আটকে থাকতে। ওভাবেই ‘স্লো, স্লো, কুইক কুইক, স্লো’—এই রিদমের মাঝে সেরে নিই টুকটাক আলাপ। তৈরি হয় কিঞ্চিৎ ঘনিষ্ঠতা।

ভেনেসা একটি ছাই রঙের মাজদা গাড়ি চালায়। গাড়ির ছাদের ওপর মেছতা রোগীর মতো কালশিটে দাগ। আর সিটবেল্টের যে ধরন, ও থেকে অনুমান করা যায় গাড়িটি কম করে হলেও বিশ বছরের পুরনো। প্যাসেঞ্জার সিটের পায়ের কাছটায় কিছু দুমড়ানো মুচড়ানো কাগজের টুকরো। তা থেকে দু একটা উঁকি দেওয়া কাগজ জানান দেয়, তারা টেলিফোন কিংবা বিদ্যুতের বিল। মোটামুটি ভাগাড়ের মতো এই গাড়িটির সওয়ারি আজ আমি। গত সপ্তাহেই ভেনেসা আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ওর এই বাহনে চড়ে সান ডিয়েগোর হারবার এলাকায় যাবার। ঠিক বেড়াতে নয়। ওখানে ওর এক গাতক বন্ধুদল আসবে নানা বাদ্যযন্ত্রসহ। ভেনেসা ওখানে যাবে তাঁদেরকে কিছুটা সঙ্গ দিতে। আমাকে সে-কথা জানিয়ে সহযাত্রী হবার প্রস্তাব দিলে আমি এক কথায় লুফে নিই। ছুটির দিনে আমার তো আর করার মতো তেমন কিছু নেই! মি ওয়াং এই সময়টায় গম্ভীর মুখে চীনে সওদার দোকান থেকে আনা ফ্রি পত্রিকায় চীনে ভাষার পাজল মেলান। ও সময়ে তাঁর সাথে খেজুরে আলাপ করা যায় না। বাড়িতে বসে তাই অলস হাওয়া না খেয়ে যদি হারবারের  নোনা বাতাস খাওয়া যায়, তবে হয়তো মন্দ হয় না।

ভেনেসার পরনে আজ ফ্রি-কাট সাদা ধবধবে প্যান্ট, আর ঊর্ধ্বাঙ্গে সিল্কের টপস। হারবারে ঠিক এমনতর রক্ষণশীল পোশাকে খুব কম লোকেই যায়। এর পেছনে অবশ্য একটা ব্যাখ্যা আছে। কিছুদিন আগে কথায় কথায় জানিয়েছিল, ওর পরিবার কট্টর ক্যাথলিক। বড় ভাইটি স্থানীয় গির্জার প্যাস্টর। ক্যাথলিক মতে জন্মনিয়ন্ত্রণকে ‘না’ বলায় এখন পর্যন্ত পাঁচ পাঁচটি সন্তান তাঁর। তবে আর্থিক সঙ্গতি নাকি তেমন নয়। এ কথাগুলো ভেনেসার কাছ থেকে জেনেছি একদিন নাচের ক্লাসে ঢোকার আগে। সেদিন নিজের মায়ের সাথে করিডরে দাঁড়িয়ে বেশ চড়া গলায় বাৎচিত করছিল। টেলিফোন রাখার পর আমি কাছে গিয়ে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এনিথিং রং?’ তাতে করে ও হড়বড়িয়ে মায়ের ওপর ঝাল ঝরিয়ে যা বলল তার সারাংশ হলো এই—ভেনেসার মা-বাবা ক্যাটারিংয়ের ব্যবসা চালাত। সেই ব্যবসা লাটে ওঠায় ভেনেসা প্রতি মাসে মা-বাবাকে কিছু পয়সা পাঠায়। কিন্তু বুড়োবুড়ি সেগুলো নিজেদের পেছনে খরচ না করে সব ঢালে এই বড় ভাইয়ের পাঁচ সন্তানকে এটা-সেটা কিনে দেবার কাজে। ক্রোধে রাঙামুখী হয়ে ভেনেসা বলে, ‘দে আর জাস্ট এক্সপ্লয়েটিং মাই প্যারেন্ট’স ইমোশন। সঙ্গতি না থাকার পরও একের পর এক বাচ্চা নেওয়ায় ওদের সংসারে অভাব লেগেই আছে। সেসব জানিয়ে আমার মা-বাপের কাছে এসে যখন ঘ্যান-ঘ্যান করে, তখন তাঁরাও নাতি পুতির মুখের দিকে তাকিয়ে সব টাকা খরচ করে ফেলে। ওদিকে সেই টাকাটা কিন্তু আমার পাঠানো টাকা। বোঝো অবস্থাটা।’ তো সেইসব আলাপের মাঝেই উঠে আসে ওর পরিবারের কিছু গোঁড়ামির কথা। ওর মায়ের নাকি ফতোয়া আছে, নন-ক্যাথলিকদের সাথে বন্ধুত্ব করাটাও এক ধরনের পাপ। যদিও পরিহাসের ব্যাপার হলো, ভেনেসার ছোট বোন, যে কিনা এই মুহূর্তে থাকে সান ফ্রানসিস্কোতে, সে কিন্তু চুটিয়ে এক সৌদি যুবকের সাথে লিভ টুগেদার করছে। সে কথা জানলে হয়তো ওর মায়ের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হবার সম্ভাবনা আছে।

/uploads/files/pEy3FTXkOhpCyiJS9962bkBj1qmGCNawwOd72EFY.png
হারবারে পৌঁছে গাড়ি পার্ক করা নিয়ে বিরাট এক ঝামেলার মধ্যে পড়তে হয়। আজ তো শনিবার। রাজ্যের লোক যেন ভেঙে পড়েছে এখানে। পথের পাশের মিটার পার্কিংগুলো সব দখল। বেশ কয়েকবার ঘুরপাক খাবার পর নিতান্তই ভাগ্যবশে একটি জায়গা আমাদের মেলে। সেখানে স্যাত করে গাড়িটি পার্কিং করে ভেনেসা মিটারে পয়সা ভরতে যায়। আমি সেই ফাঁকে নেমে আশেপাশে নজর বুলাই। উল্টোদিকের ফুটপাথে দেখি, এক ভবঘুরে শপিং মলের কার্টে নিজেদের যাবতীয় সংসারটিকে ঠেলেঠুলে বসিয়ে পাশে বসে ঝিমুচ্ছেন। সামনে শিপিংবক্স থেকে কেটে নেওয়া এক টুকরো কাগজে লেখা, ‘মিথ্যে কেন বলব? বিয়ার খাবার জন্যেই কিছু পয়সা চাইছি।’ এর সামনে দিয়ে সে মুহূর্তে পাঁচ-দশটি ছোট কুকুরের দল নিয়ে হেঁটে যায় বাঁ-হাতে ফুল লতাপাতার উল্কি আঁকা এক যুবতী। দলের একেবারে শেষ কুকুরটির পেছনের পায়ে বাঁধা একটি হুইল। বাকিগুলো হাঁটছে কিছুটা খুঁড়িয়ে। মেয়েটি খুব সম্ভবত কোনো পঙ্গু কুকুর সেবা কেন্দ্রের স্বেচ্ছাসেবক। সবগুলো কুকুরের গলায় বাঁধা চেনের প্রান্তকে নিজের মুঠিতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে মেয়েটি ফুরফুরে মেজাজে সামনে এগিয়ে যায়।

মিটারে পয়সা ভরে ভেনেসা ফিরে আসে। আমরা হাঁটতে থাকি কংক্রিটে বাঁধানো পথ ধরে। খুব কাছেই এসে একটি রিকশা হার্ড ব্রেক করে। এ সেই বঙ্গদেশের রিকশা নয়। বরং ও ধরনের কিছু একটা। এঁদের অনুমতি আছে কেবল এই হারবারের আশপাশে লোকেদের নিয়ে ঘুরবার। রিক্সার পাদানির জায়গাটি থাকা টেপরেকর্ডার থেকে ভেসে আসছে আরবি গান। যানটি চালাচ্ছে ফ্যাশন দুরস্ত এক যুবা। জেল দিয়ে পেছনে ব্যাকব্রাশ করা চুল। হাতের কবজিতে বেঁধে রাখা কয়েকটি মালা। আমরা তো আর এখানে প্রমোদ ভ্রমণে আসিনি, তাই গাঁটের টাকা খরচ করে রিকশায় চড়বার মানে হয় না; আর ও জিনিসে তো এ জীবনে কম চড়িনি!

হারবারের ডান দিকে বিশাল এক যুদ্ধজাহাজ। নানা যুদ্ধ শেষ করে অবসর নিয়ে এটি এখন ডেরা বেঁধেছে এই হারবারের কোণে। কম পয়সায় খাটবার মতো লোক নিয়ে জাহাজ ভাঙা শিল্প এদেশে গড়ে ওঠেনি, ওদিকে দৈত্যের মতো এমন এক জাহাজকে ডুবিয়েও দেওয়া যায় না। তাই একসময় ঠিক হলো, জাহাজটিকে যদি এই হারবারে বেঁধে রেখে একটা জাদুঘর মতন করা যায়, তবে হয়তো জাহাজটি মরে গিয়েও বেঁচে যায়। সেটাই হলো পরে। লোকে এখন পয়সা খরচ করে ভেতরে গিয়ে দেখে আসে নাবিকদের থাকার স্থল আর যুদ্ধ বিমানের কংকালগুলো। এই জাহাজের পাশ দিয়ে হাঁটার সময়ে নিজেকে হস্তীর সম্মুখে পিপীলিকাসম মনে হয়। হয়তো সেসব নিয়েই ভাবছিলাম কয়েক মুহূর্ত। কোন সময়ে যে একজন চৈনিক ভদ্রলোক হাতে একখানা লিফলেট গুঁজে দিয়ে গেছে টের পাইনি। এখন সম্বিত ফিরে পেয়ে তাতে নজর বুলিয়ে যা বুঝলাম—এঁরা ফালুন গং নামক চীন দেশের এক সাধক সম্প্রদায়। তা চীনের বর্তমান কম্যুনিস্ট সরকার এঁদের ওপর ব্যাপক নাখোশ। সুযোগ পেলেই পাইকারি হারে ঢুকিয়ে দেয় জেলে। সেটুকুও হয়তো মেনে নেয়া যেত। কিন্তু ফালুন গং গ্রুপ জেল থেকে পলাতক কয়েক সদস্যের মাধ্যমে জেনেছে—জেলে অন্তরিন বাকি সদস্যদের শরীর থেকে অনেক সময়েই সরিয়ে ফেলা হয় কিডনির মতো মূল্যবান প্রত্যঙ্গ। আর সেজন্যেই এই দল চাচ্ছে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে ঘটনাটিকে বিশ্ববাসীর নজরে আনতে।

/uploads/files/1deJKH6VHifKemIs4JlwnP0l5VpioCwmSVuoZuAH.jpeg
ভেনেসা ততক্ষণে সরে গেছে কিছুটা ডান দিকের কোণে। সেখানে চার জনে মিলে বসিয়ে ফেলেছে গানের জমজমাট আসর। তাঁদের হাতে বেহালা, গিটার, একর্ডিয়ান আর চেলো। যিনি লিড গায়ক তার গায়ে একটি ছাই রঙের টি শার্ট। মাথায় প্রথাগত মেক্সিকান খড়ের টুপি। বিশাল সেই টুপির চাতালে ঢাকা পড়েছে মুখের একাংশ। পাশেই রাখা সাউন্ডবক্স থেকে ঝুলে থাকা মাইক্রোফোনটি আঁকড়ে ধরে ভদ্রলোক দুলে দুলে গান করেন; আর গানের মাঝে সকল দর্শকের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ভেনেসার দিকে তাকিয়ে হাসেন। সেই অর্থপূর্ণ হাসি দেখে আন্দাজ করি, এ-ই হয়তো ওর সেই গাতক বন্ধুদল।  দলের সামনে পেতে রাখা গিটারের শূন্য বাক্স। লোকে দু চার মিনিট গান শুনে সেখানে রেখে যাচ্ছে কয়েকটি কয়েন।

আমি স্প্যানিশ বুঝি না। ভেনেসা তাই তর্জমা করে গানের কয়েকটি লাইন আমাকে শোনায়—‘আই ডু নট নো হোয়াট টু ডু, আই ফেল ইন লাভ উইথ ইউ ইন এ ডে, এন্ড ডু নট নো হোয়াই, ইউ মেইড মাই লাইফ রিবর্ন।’ সে তো বুঝলাম, কিন্তু একদিনের মাঝেই হাবুডুবু প্রেমে পড়া কি আদৌ সম্ভব?—মুচকি হেসে ভেনেসাকে জিজ্ঞেস করি। আমার কথার জবাব দেবার মতো কোনো ব্যাগ্রতা ওর মাঝে ক্রিয়া করে না, বরং ওর দৃষ্টি ব্যস্ত থাকে লিড গায়কের সাথে অদৃশ্য তরঙ্গ স্থাপনে। আমি তাই ওকে কিছুটা স্পেস ছেড়ে দিয়ে বাঁ-পাশে আরো কিছুটা দূরে এক ভাস্কর্যের দিকে হেঁটে যাই। এটির সামনে প্রচুর মানুষের জটলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর জাহাজে করে নৌ সেনারা যখন নিউ ইয়র্কে ফিরে এলো, তখন তাঁরা যুদ্ধ জয়ের আনন্দে উদ্বেলিত, প্রজ্জ্বল; তাঁদেরকে এক নজর দেখতে আর ফুল ছুঁড়ে দিতে বন্দরে সমবেত হলো হাজারও নারী। সেই নৌ সেনাদের মাঝে একজন তেমনই এক যুবতীকে ঠেসে ধরে ওষ্ঠাধরে প্রগাঢ় চুম্বনের প্রলেপ এঁকে দিলো। সেই মুহূর্তটিকে ক্যামেরায় বন্দি করে নিল টাইমস ম্যাগাজিনের এক সাংবাদিক। পরে যুদ্ধ পরিসমাপ্তির যে আনন্দ, তার সমার্থক হয়ে গেল টাইমের কভার পেইজে ছাপা সেই ছবিটি। আরো পরে সেই ছবিটিকে সম্বল করেই গড়া হলো বিশাল ভাস্কর্য। নিয়ম হয়ে গেল, ভাস্কর্যটি কয়েক বছর করে আমেরিকার বিভিন্ন শহরে থাকবে। সেই ঘূর্ণনের সাথী হয়ে ভাস্কর্যটি এ-মুহূর্তে এ শহরের হারবারে। লোকে তাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে এর সামনে ছবি তোলার জন্যে। অনেকে আবার প্রেয়সীকে জাপটে ধরে সেই ভাস্কর্যের নাবিকের ভঙ্গিমাতেই ছবি তুলছে। পত্রবিহীন কোরাল গাছের তলে দাঁড়িয়ে যখন এসব তামাশা দেখছি, তখন হঠাৎ পেছন থেকে ভেনেসার কণ্ঠ শুনতে পাই—‘ইসনট ইট এ লাভলি স্ট্যাচু?’ আমি মাথা দোলাই। তারপর দূরের গানের দলের দিকে ইঙ্গিত করে বলি, ‘তুমি চাইলে ওদিকটায় আরো কিছু সময় কাটাতে পারো। আমি আছি এখানে।’ ‘দ্যাটস ওকে, চলো আমরা এই ট্রেইলে কিছুটা দূর হাঁটি। ওরা ওখানে বহুক্ষণ গান করবে। ফিরে আসার পথে না হয় আবার থামা যাবে।’

ডান পাশের এক ফিশ রেস্তোরাঁ থেকে তাজা মাছ ভাজার চনমনে গন্ধ ভেসে আসছে। তার সামনে খদ্দেরদের লাইন। আমরা সেটিকে পেরিয়ে আরো কিছুটা দূর হেঁটে গেলে এক কাকাতুয়া পাখিওয়ালা আমাকে হাত নেড়ে ডাকেন। তার আদরের পাখিটি নাকি আমার হাতে কিছুক্ষণের জন্যে বিশ্রাম নিতে চায়। অগত্যা সেই পাখিটিকে ডান কবজিতে আশ্রয় দিতে হলো। সেটি দেবার বিনিময়ে আমাকে খোয়াতে হলো জামার সবচেয়ে উপরের বোতামটি। সেয়ানা কাকাতুয়া কোন সময়ে যে ঠোকর দিয়ে বোতামখানি খেয়ে ফেলেছে টেরই পাইনি। দেখি, ভেনেসা খিক খিক করে হাসছে আমার দশা দেখে। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থায় পাখিটিকে মূল মালিকের হাওলায় ছেড়ে এসে পাশের এক দূর্বা ঘাসের জমিনে ধপ করে বসে পড়ি।

/uploads/files/rCFdf4gX5jRTfbo4jBLZ0i13EeFg9maFxDOyKxKV.jpeg
অনতিদূরে খাড়ির মাঝে বেঁধে রাখা কয়েকটি নৌকো। ঢেউয়ের আঘাতে তারা প্রবলভাবে দুলছে। আর তীরের কাছটায় নোটিশ টানিয়ে লেখা, ‘এখানে সাঁতার কাটা কিংবা মাছ ধরা নিষিদ্ধ।’ আমার থেকে একটু দূরে ঘাসের মাঝেই হঠাৎ মাথা ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে গেছে বিশাল আরবান ট্রি। তার তলে আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে সুতো টেনে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে দু যুবক-যুবতী। যেন আকাশের দিকে তুলি টেনে কিছু একটা আঁকার চেষ্টা। ভেনেসার নাকের অগ্রভাগে বিন্দু বিন্দু স্বেদ। সাগরের নীল জলের প্রতিফলন সেই বিন্দুতে সমাপতিত হয়ে সৃষ্টি করে উজ্জ্বল আলোকস্ফটিক। আমি ঘাসের ওপর শুয়ে ভেনেসার দিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘সো দিস সিঙ্গার গাই, ইজ হি জাস্ট এ ফ্রেন্ড অফ ইওরস?’ কামরাঙার কোয়ার মতো ঠোঁটটিকে উলটে কৌতুকপূর্ণ স্বরে ও জবাব দেয়, ‘কেন তুমি কি ভেবেছিলে ও আমার নাগর?’ এ বলে ভেনেসা খলখলিয়ে হেসে ওঠে। তারপর বহু দূরের অস্পষ্ট করোনাড দ্বীপের সেতুর দিকে তাকিয়ে সেই লিড গায়ক আর ওর জীবনের কিছু যোগবিন্দুকে আমার সামনে তুলে ধরে।

ভেনেসার পরিবার ওর খুব ছোটবেলায় মেক্সিকো থেকে আমেরিকায় চলে এলেও ও রয়ে গিয়েছিল দিদার কাছে গুয়াদেলরাহা শহরে। সেই শহরের হাইস্কুলে ওর সহপাঠী ছিল এই লিড গায়ক, আলবার্তো। বলা চলে, ও ছিল আলবার্তোর হাইস্কুল সুইটহার্ট। তবে এর মাঝেই জীবন অন্য দিকে মোড় নেয়। আলবার্তোর মায়ের তখন এক অদ্ভুত মানসিক রোগ ছিল। ছেলেকে সে সহ্য করতে পারত না। কারণে-অকারণে বেধড়ক পেটাত। মায়ের অত্যাচারে অতীষ্ট হয়ে হাইস্কুলের গণ্ডি পেরুবার আগেই একদিন আলবার্তো ঘর ছেড়ে ফেরারি হয়। ওদিকে ভেনেসা এর কয়েক বছর পর মা-বাপের কাছে আমেরিকায় চলে আসে। আলবার্তো ওর জীবন থেকে বেমালুম হারিয়ে যায়। ভেনেসার জীবনও নানা চোরাগলিতে ঘুরপাক খায় এতটা বছর। তারপর এই দু বছর আগে মেক্সিকোতে নিজ শহরে বেড়াতে গিয়ে ভেনেসা যায় গির্জার রবিবাসরীয় প্রার্থনায়। সেখানে গিয়ে দেখে, যুবা বয়েসী যাজকদের একজনকে বড্ড যেন চেনা চেনা লাগে।

আলবার্তোর মায়ের পরে পাকস্থলীর ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। কী করে যেন আলবার্তোর কানে ঠিকই পৌঁছে যায় মায়ের এই অন্তিম দশার কথা। যেই মায়ের কারণে তাঁকে ঘর ছাড়তে হয়েছিল, সেই মাকেই শেষ সময়টায় আলবার্তো প্রাণ সঁপে দিলো। কিন্তু ভদ্রমহিলা শেষতক বাঁচলেন না। জীবনের এই লুকোচুরি খেলায় শ্রান্ত হয়ে আলবার্তো শরণ নিল যীশুর। গুয়াদেলরাহার সেই সমুদ্রমুখী গির্জাতে সেভাবেই ভেনেসার সাথে আলবার্তোর পুনর্মিলন।

শৈশবের সেই কুসুম কুসুম রোমান্টিকতা এখন আর নেই। তার বদলে এখন দু জনের মাঝে যা আছে, সেটি নিখাদ বন্ধুত্বপূর্ণ মমতা। আর সেই মমতা এক সময় খুঁজে পায় সমধারা। আলবার্তো গির্জার অধীনে কাজ করছিল স্থানীয় দরিদ্র শিশুদের নিয়ে। ওদিকে প্রথম যৌবনে ঘটানো একটি গর্ভপাতের পর ভেনেসার আর কোনোদিন মা হয়ে ওঠা হয়নি। তাই পথশিশুদের নিয়ে কিছু একটা করার উদগ্র বাসনা তার মাঝেও ছিল। ভেনেসা আলবার্তোকে প্রস্তাব দেয়, এই শিশুদের জন্যে আমেরিকা থেকে কিছু অর্থ সাহায্য উত্তোলন করলে কেমন হয়? আলবার্তো তো এমনিতেই ওর সেই ভবঘুরে জীবনে গিটার বাজিয়ে পয়সা তুলত। এবারেও না হয় তেমন কিছু করুক ক’টা দিন আমেরিকায় এসে। তারপর যে টাকা পাওয়া যাবে তা নিয়ে ভেনেসা আলবার্তোর দলের সাথে পৌঁছে যাবে গুয়াদেলরাহায়। ওখানে বাচ্চাদের জন্যে খেলনা কেনা হবে। স্থানীয় এক জুতোর দোকানদার বলেছেন, বিনা মূল্যে তিনি কিছু জুতোর বাক্স দেবেন। তারপর সেই বাক্সে খেলনা ভরে বিলানো হবে শহরের প্রায় কয়েকশো দরিদ্র শিশুর মাঝে।

/uploads/files/E9MegAiKnkSqvFEYywFIyrMhu0yMzyRtZpHqAaP2.jpeg
ভেনেসার বয়ানটি শেষ হলে আমি আকাশে উড়তে থাকা বাহারি ঘুড়িগুলোর দিকে তাকাই। সেই মুহূর্তে একটি ঘুড়ি আরেকটির হাতে ধরাশায়ী হয়ে সুতো ছিঁড়ে উড়ে যাচ্ছে দূর সমুদ্রের দিকে। তবে সেটিকে কেউ তাড়া করছে না। বরং ঘাসের চাদরে শুয়ে থাকা ঘুড়ির মালিক বেশ আমোদ নিয়ে দৃশ্যটি দেখছেন। পাশেই রোদ চশমা পরে পা ভাঁজ করে বসে থাকা প্রেয়সী কিছুটা যেন সরে আসে তার দিকে। তারপর ভালোবাসা অনিবার্য পথ খুঁজে নেয় তাঁদের দ্বৈত ওষ্ঠাধরে।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;