বই ও বইমেলা



আন্দালিব রাশদী
অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

“বই মৃত। পঞ্চদশ শতকের প্রযুক্তিতে পৌরসভার আবর্জনার গাড়িতে তুলে দিন।”
একুশের বইমেলা সামনে রেখে এমন ভয়ঙ্কর কথা শুনলে কাগজ-ছাপা বইয়ের ভক্ত পাঠক মেজাজ তো খারাপ করবেনই। অমন কথা যিনি বলবেন প্রথম ছাপাখানার কারিগর গুটেনবার্গের (Gutenberg) বিদেহী আত্মা রেগেমেগে তার ঘাড়ও মটকে দিতে পারে।

ইউহানেস গুটেনবার্গ (১৩৯৮-৩ ফেব্রুয়ারি ১৪৬৮)

“বই মৃত—এ কথা বলা বন্ধ করুন। বই আগের চেয়েও বেশি জীবিত।”
আমরা বই বলতে যা বুঝি তার দিন কি শেষ? ডিজিটাল বিপ্লব কি ছাপাখানার যুগের অবসান ঘটাচ্ছে? এমন কি যখন ১৯৩৯ সালে যখন প্যাঙ্গুইন পেপারব্যাক প্রথম প্রকাশিত হলো, অনেকেই ভবিষ্যৎবাণী করেছেন প্রকাশনা শিল্পের বারোটা বেজে গেছে। যখন হোম ভিডিও এলো, শুনেছি সিনেমার দিন শেষ। এমন কি ছাপাখানা আবিষ্কারের পর ক্যাথলিসিজমের বিদায়ঘণ্টা বাজার আশঙ্কাও করাও হয়েছে।

যখন কাদামাটি কিংবা ধাতব প্লেটে বই লেখা হতো সেই লেখকরাও শুরুতে ভাবেননি প্যাপিরাস এসে ভারী ভারী এক একটা বই হঠিয়ে দিয়ে কম পরিসরে বই হিসেবে বছরের পর বছর টিকে থাকবে।

বহনযোগ্য ধাতব টাইপ ব্যবহার করে ১৪৫৫ সালে একালের প্রথম বই গুটেনবার্গ বাইবেল প্রকাশিত হয়। টাইপ তৈরির জন্য জন্য যে মণ্ড তৈরি করা হয় তাতে শিসা, টিন ও এন্টিমনি ব্যবহার করা হয়।

গুটেনবার্গ যন্ত্র আবিষ্কারের ৬০০ বছর আগেও চীনে দু একটি করে বই ছাপা হয়েছে কিন্তু বেশি সংখ্যায় ছাপার সূচনা গুটেনবার্গ যন্ত্রের মাধ্যমে।

প্রাচীন মিশরে প্যাপিরাসে লিখিত চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রথম বই

জার্মানির গুটেনবার্গ বিপ্লব রেনেসাঁ, রিফর্মেশন, দ্য এজ অব এলাইটেনমেন্ট ও সাইন্টিফিক রেভ্যুলুশন-এর পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। তারপর ৫৪০ বছর কেটে যায়। মুদ্রণশিল্পের অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে। তারপরও বই কিন্তু কাগজ, ছাপাখানা, বাঁধাই—এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। 

১৯৯৫ সালে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, দেখা যায়, পড়া যায়, সযত্নে রেখে দেওয়া যায় এমন একটি বই বিক্রি হলো। বইয়ের লেখক ডগলাস হফসতাদার (Douglas Hofstadter), বইয়ের নাম Fluid Concepts of Creative Analogies : Computer Models of the Fundamental Mechanisms of Though—গুটেনবার্গ প্রযুক্তি বাস্তব হুমকির মুখে পড়ল।

গুটেনবার্গের মতোই একটানা লেগে থেকে যিনি এ কাজটি করলেন তিনি জেফ বেজোস নামের আমেরিকান এক যুবক, জন্ম ১২ জানুয়ারি ১৯৬৪। তিনিই আমাজন ডট কম-এর প্রতিষ্ঠাতা।

১৯৯৭ সালে, মাত্র দু বছরের মাথায় আমাজন দাবি করে বসল যে এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইয়ের দোকান। খান্দানি বইয়ের দোকানগুলো চটে গেল। বার্নস অ্যান্ড নোবেল মিথ্যাচারের অভিযোগ এনে আমাজনের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিল ১৯৯৭-র মে মাসে। তাদের দাবি এটা আদৌ কোনো বইয়ের দোকান নয়, বরং জেফকে বলা যায় বইয়ের দালাল। ১৯৯৮-তে ওয়ালমার্ট মামলা করল, আমাজন তাদের ব্যবসায়ের গোপন সূত্র চুরি করেছে।

জেফ বেজোস

জেফ বেজোসের তখন এমনিতে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। মামলার কারণে নয়, ক্ষতি সামলে উঠতে পারছেন না। এরই মধ্যে টাইম ম্যাগাজিন আর্থিক দৈন্যদশায় ডুবে থাকা মানুষটিকে ১৯৯৯ সালে ‘পার্সন অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করল।

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বইয়ের দোকানের মালিকরা স্থানীয় ট্যাক্স অফিসের স্বীকৃতিটুকু কেবল পেয়েছেন আর টাইম ম্যাগাজিন আমাজনের মালিক হিসেবে তাকে ‘বছরের সেরা ব্যক্তি’ নির্বাচন করেছে।


দ্য গার্ডিয়ানের সমীক্ষায় (২০০৮) পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দশটি বইয়ের দোকান হচ্ছে:
১০. হ্যাচার্ড (১৯৯৭-তে প্রতিষ্ঠিত, লন্ডনের পিকডিলিতে)
৯. কিবুনসিয়া (জাপানের কিয়োটোতে)
৮. এল পেনডুলো (মেক্সিকো সিটি)
৭. পোসাডা (ব্রাসেলস)
৬. স্কার্থিন বুকস (ক্রমফোর্ড)
৫. বোর্ডারস্ (গ্লাসগো)
৪. হেডকোয়ার্টার্স কমিক বুকস্টোর (লস অ্যাঞ্জেলেস)
৩. লিব্রারিয়া (লন্ডন)
২. এল অ্যাটেনিও (বুয়েনস আইরেস)
১. বোয়েখান্দেল সেলেক্সিজ ডোমিনিকানেন (মাসট্রিখট)


কানাডার টরোন্টোর এই বইয়ের দোকানটির নামই পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বইয়ের দোকান

গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস-এর তালিকায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইয়ের দোকান নিউ ইয়র্ক সিটির ফিফথ অ্যাভিনিউ-র বার্নস অ্যান্ড নোবেল কলেজ বুকস্টোর। ফ্লোরস্পেসের হিসেবে ধরলে এটিই সর্ববৃহৎ। বার্নস অ্যান্ড নোবল বইয়ের দোকানের ৭৬৯টি ক্যাম্পাস শাখা।

কিন্তু শেলফ স্পেস বিবেচনা করলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইয়ের দোকান যুক্তরাষ্ট্রের পোর্টল্যান্ডের পলওয়েল’স বুকস। টরোন্টোর একটি বইয়ের দোকানের নামই ছিল ওয়ার্ল্ডস বিগেস্ট বুকস্টোর। তিনতলা ভবনের তিনটি তলাতেই মোট ২০ কিলোমিটার শেলফ জুড়ে কেবল বই আর বই। ১৯৮০-তে প্রতিষ্ঠিত এই বইয়ের দোকানটি ২০১৪ সালে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ভবনটি গুঁড়িয়ে ফেলা হয়। এখানে চারটি রেস্তোরাঁ নির্মিত হয়।

বার্নস অ্যান্ড নোবল বইয়ের দোকানের আছে ৭৬৯টি ক্যাম্পাস শাখা

আমাজনের ধাক্কা পৃথিবীর সব বড় বড় বইয়ের দোকানে লেগেছে। ২০০১ সালে আমাজন প্রথম লাভের মুখ দেখে। এখন আমাজনের কর্মচারীর সংখ্যা ১ লক্ষ ৫৫ হাজার। আর জেফ বেজোস পৃথিবীর পঞ্চম শ্রেষ্ঠ ধনী, সম্পদের পরিমাণ ৭০.৪ বিলিয়ন ডলার। তিনি ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকাটিও অনেক খরিদ্দারকে টেক্কা মেনে কিনে নিয়েছেন। তিনি বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছেন সনাতন প্রকাশনা জগতকে। ই-বই ছাপা-বইকে মার দেবেই। ছাপা বই সাড়ে পাঁচশত বছর রাজত্ব করেছে, আর কত?


কেন ই-বইয়ের জন্য পক্ষপাত বেড়েই যাবে, আমরা যারা প্রযুক্তির সড়কে পা রাখতে পারব না পিছিয়েই পড়ব, তার কিছু কারণ জানলে বরং ভালো
১. ই-বুক হচ্ছে গ্রিন বুক (লিবিয়ার মুয়ামের গাদ্দাফির গ্রিন বুক নয়)—পরিবেশ বান্ধব বই। বইয়ের কাগজ উৎপাদনের জন্য একটি গাছও কাটতে হবে না।
২. বাসায় বই রাখার কোনো জায়গা না থাকলেও সমস্যা নেই। ই-বুক নিজের জায়গা করে নেবে।
৩. ঘরে বসে তাৎক্ষণিক ই-বুকের সরবরাহ নেওয়া যাবে। বইপত্র আমদানি-রফতানির আইন কানুন ও প্রক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে নাকচ করা যাবে।
৪. বইয়ের জন্য গাড়ি ভাড়া দিয়ে এ দোকানে ও দোকানে এ লাইব্রেরিতে ও লাইব্রেরিতে ছুটোছুটি করতে হবে না।
৫. ফটোকপি করা স্ক্যান করা এসব ঝামেলা পোহাতে হবে না।
৬. ই-বুক গুদামজাত করার জন্য গুদামঘর লাগে না, বড় দোকান লাগে না। ব্যবহারের জন্য বিশাল লাইব্রেরি লাগে না। ল্যাপটপ কি রিডিং ডিভাইসে হাজার বই সঞ্চিত রাখা যায়।
৭. বাসে ট্রেনে প্লেনে স্টিমারে কোর্ট কাচারিতে যে কোনো জায়গায় পড়া সম্ভব।
৮. অতি সহজে বহন করা যায়। শত মেট্রিক টন ওজনের বইও ই-বুক হিসেবে অনায়াসে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়, এক দেশ থেকে অন্যদেশে নিয়ে যাওয়া যায়।
৯. ই-বুক পরিবহনে রোদ-বৃষ্টিতে নষ্ট হবার কোনো আশঙ্কা থাকে না।
১০. ই-বুক বাজারজাত করার সময় মেগা স্টোরের যে কোনো পণ্যের মতো বোনাস দেওয়া যায়। মূল্যমানের ওপর পয়েন্ট দেওয়া যায়। পয়েন্ট ঠিক টাকার মতোই আরো বই কিনতে সুযোগ করে দেয়।
১১. ই-বুক লিঙ্ক ধরিয়ে দিয়ে জ্ঞানের আরো জানালা খুলে দেয়।
১২. ই-বুকে পাতা উল্টে উল্টে খোঁজার দরকার হয় না, সার্চ দিয়েই নির্দিষ্ট বিষয় বের করা যায়।
১৩. ই-বুক পাঠাতে, আনাতে প্যাকেজিং করাতে হয় না, শিপিং খরচও নেই।
১৪. কাগজে ছাপা অবস্থায় পড়তে চাইলে কোনো সমস্যা নেই, কেবল প্রিন্টার থাকলেই হলো। ই-বুক থেকে কমান্ড দিয়ে মুদ্রিত পাতা পাওয়া সম্ভব।
১৫. ই-বুক আরামে পড়ার জন্য ফন্ট সাইজ ছোট-বড় সোজা-ইটালিক যেমন ইচ্ছে করা যায়।
১৬. ই-বুকের বিপণন ও বিতরণ অত্যন্ত সহজ। শুধু দরকার ব্যবহারকারীর ভালো নেটওয়ার্ক।
১৭. ই-বুক বৈষম্য দূর করে। কসমোপলিটান সিটিতে হোক কি অজপাড়া গাঁয়ে—ই-বুকে সবার প্রবেশাধিকার সমান।
১৮. কম্পিউটারের সামনে যেহেতু আপনাকে অনেকক্ষণ থাকতেই হচ্ছে, আর একটি উইন্ডো খুলে একই সঙ্গে আপনার প্রিয় লেখকের বইটিও পড়তে পারেন।
১৯. খেতে খেতে শুয়ে শুয়ে যে কোনো সময় যে কোনো অবস্থায় ই-বুক পড়তে পারেন।
২০. ভুলবশত মূল্যবান বইটি কোথাও হারিয়ে ফেলার কিংবা লোপাট হতে দেবার সুযোগও নেই।
২১. আইপ্যাড, আইফোন থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকম ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট ব্যবহার করে বই পড়া যায়।
২২. বইয়ের প্যাসেজ সার্চ করা, স্কিমিং করা ই-বুকে খুব সহজ হয়ে গেছে। হাইলাইট করা ও আংশিক অনুবাদ করাও সহজ ব্যাপার।
২৩. বাধ্যতামূলক মিটিং, কনফারেন্স বিরক্তিকর বক্তৃতা—এসব এড়াতে ই-বুক শ্রেষ্ঠ সহায়ক। চেয়ারটা দখল করে অমনি পড়তে বসে যান।
২৪. ই-বুক পড়ার জন্য সন্ধ্যা কিংবা রাতের ভূমিকা নেই। অন্ধকারেও বিষয়ভিত্তিক পাঠ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব।
২৫. একহাতে নিয়ে পড়া চালিয়ে যেতে পারেন।
২৬. পৃষ্ঠা ভেঙে রাখার কোনো দরকার হবে না।
২৭. ডিকশনারি কেনার দরকার নেই। কম্পিউটারে কিংবা রিডিং ডিভাইসে ডিকশনারি থাকছেই।
২৮. ই-বুক যদি কষ্ট করে না পড়তে চান তাহলে অডিও অপশনে গিয়ে শুনুন, অন্যকেউ পড়ে শোনাবে; ভিডিও দেখতে পারেন।
২৯. চব্বিশ ঘণ্টার যে কোনো সময় ই-বুক কিনতে পারেন; যে কোনো দিন, যে কোনো মাস, যে কোনো বছর—কোনো ছুটি নেই ই-বুক শপে।
৩০. ই-বুকের দাম ছাপা বইয়ের সিকিভাগেরই কম।
৩১. একবার আগুন ধরিয়ে দিতে পারলে ছাপা বইয়ের পুরো লাইব্রেরিই ভষ্মীভূত করে ফেলা সম্ভব। ই-লাইব্রেরি আগুন আগুন আতঙ্কে নেই।
৩২. উঁইপোকার সাধ্য নেই ই-বুকে কামড় বসায়।
৩৩. বই বহন করে কোমর ব্যথার দিন ফুরোবে।


বইমেলা
১৪৫৫ সালে জোহানেস গুটেনবার্গ উদ্ভাবিত ছাপাখানায় মুদ্রিত হলো পৃথিবীর প্রথম বই। তার পরপরই স্থানীয় বই বিক্রেতারা ফ্রাঙ্কফুর্টের পাশেই একটি উপশহরে আয়োজন করলেন পৃথিবীর প্রথম বইমেলা। এই মেলাতে পাণ্ডুলিপি বেচাকেনাও চলেছে। সপ্তদশ শতক পর্যন্ত এই মেলা নিয়মিতই চলেছে। তখন এটাই ছিল ইউরোপের, বরং বলা যায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইমেলা। পরে মহাসমারোহে লিপজিগ বইমেলা চালু হলে ফ্রাঙ্কফুর্ট মার খেয়ে যায়। রাজনীতি ও সংস্কৃতির কেন্দ্র তখন লিপজিগ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিধ্বস্ত ও দ্বিখণ্ডিত জার্মানির পশ্চিমাংশে ১৯৪৯ সালে ফ্রাঙ্কফুর্টের সেইন্ট পল চার্চে আবার বইমেলা শুরু হয়। এর উদ্যোক্তা প্রকাশক ও বই বিক্রেতারাই। ক বছরের মধ্যেই ফ্রাঙ্কফুর্ট হারানো গৌরব ফিরে পায়—আকারে বৈচিত্র্যে ও আর্থিক লেনদেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইমেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য হালে জনসমাগমের হিসেবে শীর্ষে অবস্থান করছে ইতালির তুরিন আন্তর্জাতিক বইমেলা।

ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা চার্চের বাইরে ফ্রাঙ্কফুর্ট ট্রেড গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রতিবছর অক্টোবরে ৫ দিনের এই মেলায় প্রথম তিনদিন কেবল বাণিজ্যিক দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। মেলার স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে রয়েছেন প্রকাশক, লেখক, সম্পাদক, লেখক ও প্রকাশনের এজেন্ট, বই ব্যবসায়ী, লাইব্রেরিয়ান, শিক্ষাবিদ, চিত্রশিল্পী, অনুবাদক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, মুদ্রণকারী, বাণিজ্য সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান, সফটওয়ার ও মাল্টি মিডিয়া সরবরাহকারী, ইলেক্ট্রনিক রিডিং ডিভাইস সরবরাহকারী এবং অবশ্যই বৃহত্তর পাঠক গোষ্ঠী।

১৯৭৬ থেকে প্রতিবছর একটি দেশকে গেস্ট অব অনার হিসেবে মেলায় আমন্ত্রণ জানানো হয়, সে দেশের সাহিত্য হয় মেলার থিম। ২০১৭-র বইমেলায় ফ্রান্স ছিল গেস্ট অব অনার এবং ফরাসি সাহিত্য এর থিম। ২০১৬-তে গেস্ট অব অনারে ছিল ফ্ল্যান্ডার্স ও নেদারল্যান্ডস আর থিম ফ্লেমিশ ও ডাচ সাহিত্য। ২০১৮-তে গেস্ট অব অনার জর্জিয়া, ২০১৯ সালে নরওয়ে। এ বছরের মেলায় অতিথি দেশ কানাডা।

ফ্রাঙ্কফুর্ট ও তুরিন আন্তর্জাতিক বইমেলা ছাড়া প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাইপেই, কলকাতা, নয়াদিল্লি, জেরুজালেম, ডাবলিন, প্যারিস, বোলোনা, ব্যাঙ্কক, লন্ডন, বোগোটা, বুয়েলস আইরেস, আবুধাবি, জেনেভা, প্রাগ, উয়ারশ সওল, নিউ ইয়র্ক, কেপটাউন, টোকিও, বেইজিং, মস্কো, কলম্বো, বার্সেলোনা, ইস্তাম্বুল ও শারজাহ বইমেলা। ঢাকার মাসব্যাপী একুশে বইমেলা তো রয়েছেই।

আগামী দিনের বইমেলা কেমন হবে ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলা এর মধ্যেই তার একটি বার্তা দিয়ে দিয়েছে। ২০১১-র বইমেলায় ৪৭ শতাংশ প্রদর্শক তাদের মুদ্রিত পণ্যের সাথে ডিজিটাল পণ্যের প্রদর্শনীও করেছে। প্রদর্শকদের মধ্যে ৭ শতাংশ কেবল ডিজিটাল সামগ্রীরই প্রদর্শনী করেছে। আর এই হার ক্রমেই বেড়ে আসছে। পঞ্চাশ বছর পর ২০৭০ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় কেবলমাত্র ছাপা-বই প্রদর্শকের অনুপাত যদি ৭-এ নেমে আসে আমরা অবাক হব না।

ইত্যাদি
২০০৯-২০১০ অর্থ বছরে আমেরিকার বেস্ট সেলার ফিকশন লেখক জেমস প্যাটারসন তখনকার ডলার-টাকা বিনিময় হার অনুযায়ী কামিয়েছেন ৫০১ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা। দিনের কামাই ১ কোটি ৩৭ লক্ষ ৫১ হাজার টাকা। ১৬ কোটি মানুষের এই বাংলাদেশের সকল ফিকশন লেখক মিলে এক বছরে জেমস প্যাটারসনের এক দিনের ধারে কাছেও পৌঁছতে পারেননি—এটা বেশ জোর দিয়েই বলা যায়।

হ্যারি পটার সিরিজের জন্য এক বছরে জে কে রাউলিং কামিয়েছেন ৫০০ মিলিয়ন ডলার। চোরাবাজারের ডলারের দর অনুযায়ী প্রতিদিন ৬ কোটি ৫৭ লক্ষ টাকা; জেমস প্যাটারসনের পাঁচগুণ। তিন বছরে এক মুদ্রণের ৫০০ বই বেচতে আমাদের শ্রেষ্ঠ প্রকাশকরাও হিমশিম খেয়ে যান।

এমন ঘটনা ইউরোপেও ঘটে। ১৭১৬ সালে কপটিক থেকে ল্যাটিনে ভাষান্তরিত নিউ টেস্টামেন্টের ৫০০ কপির মুদ্রণের শেষ বইটি বিক্রি হয়েছে ১৯০৭ সালে। ১৯১ বছরে ৫০০ কপি বইয়ের সদগতি হওয়া একটি বিশ্বরেকর্ড। এটি পড়তে পড়তে মনে হয়েছে ওদের বইয়ের গুদামে উঁই নেই?

আমেরিকান স্কুল জরিপে পাওয়া একটি তথ্য : বাইরের বই পড়ে না এ সংখ্যাটিই বেশি। কিন্তু তাদের পাঁচ ভাগের এক ভাগ বই পড়ে না, যারা পড়ে না তাদের ভয়ে। বইয়ের পাঠক জানতে পারলে ছাত্রটিকে অন্যান্যদের বুলির শিকার হতে হয়। এটা বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে।

সেরা ৩০ লেখক
সাহিত্যিকদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছেন ড্যানিয়েল বার্ট তাদের একশো জনের একটি তালিকা করেছেন। বিশ্বজুড়ে অনূদিত হয় তাদের রচনাবলী। সেই তালিকার প্রথম ৩০ জন—১. উইলিয়াম শেকসপিয়ার (১৫৬৪-১৬১৬) ২. দান্তে অ্যালিঘেরি (১২৬৫-১৩২১) ৩. হোমার (খ্রিস্টজন্মের ৭৫০ বছর আগে জন্মেছেন বলে অনুমান) ৪. লেভ তলস্তয় (১৮২৮-১৯১০) ৫. জিওফ্রে চসার (১৩৪০-১৪০০) ৬. চার্লস ডিকেন্স (১৮১২-১৮৭০) ৭. জেমস জয়েস (১৮৮২-১৯৪১) ৮. জন মিল্টন (১৬০৮-১৬৭৪) ৯. ভার্জিল (খ্রিস্টপূর্ব ৭০-১৯ অব্দ) ১০. ইউহান উলফগ্যাঙ্গ ফন গ্যায়টে (১৭৪৯-১৮৩২) ১১. মিগুয়েল সার্ভেন্টিস (১৫৪৭-১৮৩২) ১২. মুরাকামি শিকিবু (৯৭৮-১০৩০) ১৩. সোপোক্লেস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৬-৪০৬ অব্দ) ১৪. উইলিয়াম ফকনার (১৮৯৭-১৯৬২) ১৫. ফিউদর দস্তয়েভস্কি (১৮২১-১৮৮১) ১৬. টি এস এলিয়ট (১৮৮৮-১৯৬৫) ১৭. মার্শেল প্রুস্ত (১৮৭১-১৯২২) ১৮. জেইন অস্টিন (১৭৭৫-১৮১৭) ১৯. জর্জ এলিয়ট (১৮১৪-১৮৮০) ২০. উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস (১৮৬৫-১৯৩৯) ২১. আলেক্সান্ডার পুশকিন (১৭৯৯-১৮৩৭) ২২. ইউরিপিডেস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০-৪০৬ অব্দ) ২৩. জন ডান (১৫৭২-১৬৩১) ২৪. হারমান মেলভিল (১৮১৯-১৮৯১) ২৫. জন কিটস (১৭৯৫-১৮২১) ২৬. ওভিদ (খ্রিস্টপূর্ব ৪৩-১৭ অব্দ) ২৭. তু ফু (৭১২-৭৭০) ২৮. উইলিয়াম ব্ল্যাক (১৭৫৭-১৮২৭) ২৯. অ্যাস্কিলাস (খ্রিস্টপূর্ব ৫২৫-৪৫৬ অব্দ) ৩০. গুস্তাব ফ্লবেয়র (১৮২১-১৮৮০)।

ড্যানিয়েল বার্ট প্রভাব বিস্তারকারী ১০০ জন সাহিত্যিকের তালিকা করেছেন। তালিকায় অন্তর্ভুক্তি ও অবস্থান নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ‘ইংলিশ বায়াস’ স্পষ্ট; ইংরেজি সাহিত্যের কম গুরুত্বপূর্ণ লেখকও জায়গা করে নিতে পেরেছেন। এই তালিকায় অ-ইংরেজ লেখকদের মধ্যে আরো রয়েছেন—ফ্রানৎজ কাফকা, মলিয়ের, থোমাস মান, হেনরিস ইবসেন, আন্তন শেখভ, ভ্লাদিমির নবোকভ, বালজাক, স্তাদাল, ফ্রান্সেস্কো পেত্রার্ক, আলবেয়ার কামু, ভোলতেয়ার, মার্কেজ, বোর্হেস প্রমুখ।

বই নিয়ে আরো কথা
বই হচ্ছে একটি আয়না। একটি গাধা যখন এই আয়নার দিকে তাকাবে সে একটি ঘোড়া দেখবে এটা আশা করা উচিত নয়। গ্রন্থ-সভ্যতার সূচনা থেকে এ পর্যন্ত বহুবার লাইব্রেরিতে আগুন দেওয়া হয়েছে। যে কোনো একনায়ক ও স্বৈরাচারী শাসক ও তার সৈন্যবাহিনীর আক্রোশের শিকার হয় বইপত্র। বইয়ের অগ্ন্যুৎসব অবশ্যই অপরাধ। তবে জোসেফ ব্রডস্কি বলেছেন, আগুন দিয়ে বই পোড়ানোর চেয়েও বড় অপরাধ আছে। সেগুলোর একটি হচ্ছে—বই না পড়া।

   

ফেরদৌস আরার প্রবন্ধের আলপথ বেয়ে পাঠক চলে যান জ্ঞানের সমুদ্রদর্শনে



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘লেখকের প্রচুর অধ্যয়ন, পাঠগভীরতা, নিবিড় অনুসন্ধিৎসা, ঘোরলাগা শব্দপুঞ্জে, ভাষার শিল্পিত সুষমায় লেখাগুলি প্রাণ পেয়েছে। তাই গ্রন্থের তথ্যসমৃদ্ধ বারোটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য শুধু নয়, নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, জানার তাগাদা তৈরি করবে—বোধে, তৃষ্ণায়, জীবনজিজ্ঞাসায়। নিজের কথাই বলি, ফেরদৌস আরা আলীমের চোখ দিয়ে পড়তে পড়তে আমি নিজে প্রায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আফরোজা বুলবুল কিংবা প্রতিভা মোদক (‘যে জীবন শিল্পের, যে শিল্প জীবনের’), করুণা বন্দোপাধ্যায়, রবিশংকর বলকে (‘চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর’) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে আস্বাদ করি সময়-পরিক্রমায় লেখক ফেরদৌস আরা আলীমের কলমের ক্ষুরধার ক্রমমুগ্ধকর সৌন্দর্য।’

শনিবার (৪ মে নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক গলিতে অবস্থিত মাসিক নারীকণ্ঠ পত্রিকা-আয়োজিত ‘বই আলোচনা’-অনুষ্ঠানে ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আলপথে শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের মূল আলোচকের আলোচনায় তহুরীন সবুর ডালিয়া এসব কথা বলেন। বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনায় আরও অংশ নেন নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা জিনাত আজম, সালমা রহমান ও মাধুরী ব্যানার্জী।

নারীকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আহমেদ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শাহরিয়ার ফারজানা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতারী ইসলাম বলেন, ‘নানা বিষয়ে ফেরদৌস আরা আলীমের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সহজভাবে তিনি আমাদের সমাজবাস্তবতার যে-চিত্র আঁকেন তা মনের গভীরে সাড়া জাগায়। তার লেখা পড়ে এটুকু বলতে পারি যে, তার লেখা আমাদের জন্য গবেষণা ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান আকর।’

প্রবন্ধের আলপথে বইয়ের প্রকাশক, কবি ও খড়িমাটি-সম্পাদক মনিরুল মনির বলেন, ‘নারীমুক্তি বিষয়ে এ-বইয়ে দুটি তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে আরও কাজ করার জন্য গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রকাশিত বই নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘বড় কিছু হওয়ার কথা ভেবে লিখিনি, মনের আনন্দেই গোপনে গল্প-কবিতা লিখেছি। এমন একসময়ে আমরা লিখতাম, লেখা প্রকাশ করতে খুব লজ্জাবোধ করতাম। অবশ্য লিখতে গিয়ে তেমন কঠিন বাধা আমাকে ডিঙোতে হয়নি। একালের চেয়ে আমাদের সময়টা ছিল অনেক সুন্দর ও ভালো। মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল সমাজে। গণ্ডগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে চড়ে ঢাকা গিয়েছি একা-একা, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। মা-বাবারাও নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকাল মেয়েরা পদে-পদে বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের কলুষিত সমাজব্যবস্থা ও নষ্ট রাজনীতি।’ সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রশংসার ভূমিকা কম নয়। একজন লেখক তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য পেলে অনুপ্রাণিত হন যা তাকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি জোগায়।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা ও সদস্য রোকসানা বন্যা, মহুয়া চৌধুরী, রেহানা আকতার, সাহানা আখতার বীথি, কানিজ ফাতেমা লিমা, বিচিত্রা সেন, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, চম্পা চক্রবর্ত্তী, প্রচার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জয়, কবি মেরুন হরিয়াল ও কবি মুয়িন পারভেজ প্রমুখ।

;

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

;

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;