নীলক্ষেতে কেন যাই



ফয়জুল ইসলাম
অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

নীলক্ষেতের আলোকোজ্জ্বল ফুটপাতে পুরনো বইপত্তরের দোকানে পড়ে আছে ফিরোজা রঙের কাভারের একটা বই। নিমাই ভট্টাচার্যের লেখা উপন্যাস ‘গোধূলিয়া’। নীলক্ষেতের ফুটপাতে এরকম অনেক পুরনো বইপত্তরই পড়ে থাকে। এটা কোনো নতুন ঘটনা নয়। তবে কোথাও কোনো বইয়ের দোকানে বা কারো বইয়ের শেলফে ‘গোধূলিয়া’ দেখলেই আমি চমকে উঠি আর তখন আমি বইটা স্পর্শ করতে চাই। আমার ভেতরে এ প্রবণতাটা বেশ আগের।

আমার সাংবাদিক ও অনুবাদক বন্ধু আব্দুল্লাহর জোরাজুরিতে মাঝেমাঝে আমি নীলক্ষেতের পুরনো বইয়ের বাজারে ঘুরে বেড়াই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে ঢাকাতে চাকরি করতে এসে আমার বন্ধু ইমতির মাধ্যমে আব্দুল্লাহর সাথে পরিচয় ঘটে। সেই থেকে আব্দুল্লাহ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আড্ডার প্রলোভন দেখিয়ে আজকের সন্ধ্যায়ও আব্দুল্লাহ আমাকে নীলক্ষেত নিয়ে এসেছে। অনেকক্ষণ ধরেই আমি আব্দুল্লাহর পিছেপিছে হেঁটে বেড়াচ্ছি। হাঁটতে হাঁটতে ফুটপাতে পুরনো বইপত্তরের ভেতরে আমি ‘গোধূলিয়া’ নামের উপন্যাসটা পড়ে থাকতে দেখি। আমি থমকে দাঁড়াই। ফুটপাতে পড়ে থাকা ফিরোজা কাভারের বইটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি আমি। ততক্ষণে পিলপিলে গিজগিজে ভিড় ঠেলে আব্দুল্লাহ সামনে এগিয়ে গেছে খানিকটা। আমি তাকে ডাকি না, ডাকার প্রয়োজনও মনে করি না কেননা ওকে জায়গা মতোই পাব। রবের পুরনো পত্রিকার দোকানে তার যাওয়ার কথা। ‘গোধূলিয়া’ নামের বইটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি বুঝতে পারি, পুরনো খবরের কাগজ, সয়াবিন তেলের বাতিল প্লাস্টিক ক্যান, স্পঞ্জের ছেঁড়া স্যান্ডেল ইত্যাদি জিনিসের সাথে ফেরিওয়ালার কাছে বইটা বেচে দিয়েছে কেউ। পুরনো বইপত্তরের দোকানদার তা কিনে নিয়ে ফেলে রেখেছে ফুটপাতে বিছিয়ে রাখা ময়লা নীল পলিথিনের ওপরে। ফুটপাতে ছড়ানোছিটানো বই আর পত্রপত্রিকার গাদা থেকে এবার হয়তো বইটা কিনে নিয়ে যাবে কোনো খদ্দের, হয়তোবা কেউ কিনবেই না।

নীলক্ষেতের পুরনো বইপত্তরের দোকানগুলোর উজ্জ্বল বাতির আলোতে আমি দেখতে পাই, ‘গোধূলিয়া’র স্পাইনের নিচের দিকে খানিকটা কাগজ ছিঁড়ে গেছে, বিবর্ণ ফিরোজা কাভারের ওপরে কয়েক জায়গাতে পড়ে আছে কালো দাগ—সরষের তেলেরই নিশ্চয়। আর কাভারের ওপরে ধুলোর আস্তর তো আছেই! ভেতরের পাতাগুলোর দুরাবস্থা বাইরে থেকে সহজেই অনুমান করা যায়। বইটা হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতে গেলেই হয়তো ঝুরঝুর করে ঝরে পড়বে কোনো কোনো পাতা—এমনই কাহিল। ভিড়ের একটা ফাঁক গলে কোমর ঝুঁকে নীল পলিথিনের ওপর থেকে আমি এবার বইটা তুলে নিই। বইটা হাতে নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে বুঝতে পারি যে নিমাই ভট্টাচার্যের ‘গোধূলিয়া’র এই সংস্করণটা নিউজপ্রিন্টে ছাপা হয়েছে। বইটার কাভারের বোর্ডের সাথে গাম দিয়ে লাগানো প্রথম সাদা পাতাটা ছেঁড়া। সাধারণত এখানে হাতবদলের সূত্রে বইয়ের বিভিন্ন মালিকের নাম লেখা থাকে। টাইটেল পেজেও পূর্বতন মালিকের বা মালিকদের নামেরও কোনো উল্লেখ নেই। নিউজপ্রিন্টের বিবর্ণ পাতাগুলোর ক’টা উল্টাই আমি। পাতায় পাতায় কাটুনিপোকার ধ্বংসের চিহ্ন—বিভিন্ন মাপের ফুটো সেখানে। পাতা উল্টাতে উল্টাতে ভেতরের একটা পাতায় একসময় আটকে যায় আমার চোখ। বিমূঢ় হয়ে আমি তাকিয়ে থাকি সেখানে। কোথা থেকে প্রমত্ত এক হাতিশুঁড়া উঠে এসে তখন আমার মাথার ভেতরে শুরু করে দেয় তাণ্ডবনাচন। আর আমার সমস্ত শরীর কেমন অবশ অবশ লাগতে শুরু করে। এ আমি কী দেখলাম? সেই পাতাটায় তিনটা লাইন লাল কালি দিয়ে দাগানো। পাতাটার বামের মার্জিনে ইংরেজিতে লেখা—দিস ইজ নট অলওয়েজ ট্রু। এ তো দীপ্তির হাতের লেখা! তারপর বইটার জরাজীর্ণ পাতাগুলো আমি দ্রুত উল্টে দেখি। বইটার আর কোনো পাতায় দীপ্তির হাতের লেখার কোনো চিহ্ন নেই। তবে বইটার ব্যাক কাভারে কলমের কালো কালিতে দীপ্তি এঁকে রেখেছে ছোট্ট একটা আয়তক্ষেত্র। তা ছাড়া ব্যাককভারের ভেতরের দিকের সাদা পাতায় পেন্সিলে আঁকা আছে একটা ছোট্ট ষড়ভুজ ফুলদানি, তার ভেতরে ক’টা ফুল। আমি মনে করতে পারি, একদা আমাদের ডিপার্টমেন্টের সেমিনার রুমে বসে আমি এই ফুলদানিটা এঁকেছিলাম। দীপ্তি তখন আমার সামনেই বসে ছিল।

আমার আর কোনো সন্দেহ থাকে না যে এটা সেইই ‘গোধূলিয়া’! ঠিক তের বছর আগে খুলনা শহরের মেয়ে দীপ্তিকে তার জন্মদিনে এই বইটা আমি উপহার দিয়েছিলাম। আমি আর দীপ্তি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। আমি ছিলাম ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। আর দীপ্তি পড়ত সমাজবিজ্ঞানে—আমার দুই ক্লাস নিচে। বলে রাখা ভালো যে আমি মাস্টার্স শেষ করে বের হওয়ার পরপরই দীপ্তির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে আমরা পরস্পরকে আর খুঁজিনি। আমার বন্ধু মিজানুর রহমানের কাছে শুনেছি, দীপ্তি এখন খুলনাতেই থাকে—খালিশপুরে। দীপ্তির জামাই খুলনা শহরের একটা বীমা কোম্পানির উর্দ্ধতন কর্মকর্তা। তাদের একটা কালো রঙের কার আছে। কারটা মিতসুবিশি কোম্পানির।
পুরনো বইয়ের দোকানদার ব্যাটা চরম বেয়াদব বলে আমার ধারণা হয়! অনেক সময় নিয়ে আমাকে বইটা নাড়াচাড়া করতে দেখে সে খেইখেই করে ওঠে, “কী? নিবেননি?”

“আরে ভাই দাঁড়ান না! বইটা একটু দেখতেছি!” আমার অসহিষ্ণু উত্তরের পর দোকানদার আরেক জন খদ্দেরের দিকে মনোযোগ দিয়ে ফেলে।

আমার দ্বিধা হয়—‘গোধূলিয়া’ কিনে নেব নাকি? নিয়েই বা কী করব? মগবাজার এলাকার পেয়ারাবাগ রেলগেট পার হলেই আমাদের ভাড়াবাসা। ট্রেনলাইনের ঠিক পাশেই বলে সাংঘাতিক ধুলো পড়ে বাসাটায়! সেক্ষেত্রে যত্ন করে বইটা পলিথিনের প্যাকেটে ভরে আলমারিতে তুলে রাখা যায়। এসব নিয়ে আমি কয়েক মুহূর্ত ভাবি। তার ভেতরেই দোকানদার আমাকে দ্বিতীয়বার তাগাদা দেয়, “লইলে লন, না লইলে সরি খাড়ান। কাস্টমার ব্যাকে বই দেহনের লাই লাইন দিছে! দেখছেননি?”
কথাটা ঠিক। ফুটপাতের আর সব পুরনো বইয়ের দোকানের মতোই এই দোকানটার সামনেও সম্ভাব্য ক্রেতাদের জটলা। বাম দিয়ে একজন, ডান দিয়ে একজন ঢুকতে চাচ্ছে আমাকে গুঁতিয়ে, আমার কাঁধের ওপর দিয়ে নিচে ছড়ানোছিটানো বইটইয়ের দিকে ঝুঁকে পড়তে চাচ্ছে আরেকজন। দোকানদারের সমস্যাটা বুঝতে পেরেও মেজাজ খিঁচড়ে যায় আমার। আমি বলি, “ঐ ব্যাটা! ভদ্রভাবে কথা কইতে পার না? দাম কও এখন। কত?”

“পঞ্চাশ টিহা।” নিস্পৃহ সুরে জবাব দেয় পুরনো বইয়ের দোকানদার।

“এই ফাটাফুটা বইয়ের দাম পঞ্চাশ টাকা হইতেই পারে না!” মিনমিন করে আমি প্রতিবাদ জানাই। আমি ভাবতে থাকি, আসলে কত দাম হতে পারে বইটার? তিরিশ? পঁচিশ? কুড়ি? আব্দুল্লাহ এসে তখন তর্জনী দিয়ে জোরে একটা খোঁচা মারে আমার পিঠে। সে বলে, “তুই এইহানে খাড়ায়া খাড়ায়া কী করোস? আমি তোরে খুঁজতে খুঁজতে পেরেশান হইতাছি!”

আমি কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই আমার হাতে ‘গোধূলিয়া’ দেখে সে জিজ্ঞাসা করে, “কিনবি নেকি?” আব্দুল্লাহ নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানগুলোর অনেক পুরনো কাস্টমার। এখানকার পুরনো বইয়ের দোকানদারেরা কমবেশি সবাই তাকে চেনে, সমীহও করে। আমার উত্তরের অপেক্ষা না-করেই বইটা হাতে নিয়ে সে দ্রুত কয়েকটা পাতা উল্টায় এবং নিমিষেই বইয়ের দূরাবস্থা মেপে নিয়ে দোকানদারের চোখের দিকে তাকিয়ে সে তার প্রত্যাশিত দাম জানায়, “দশ ট্যাকা।”

আঁইগুঁই করে দোকানদার, “আর পাঁচটা টিহা বাড়ায় দেন বাইসা!”

“এক পয়সাও বেশি হইব না।”

নীলক্ষেত এলাকার পুরনো খদ্দের আব্দুল্লাহর কথায় শেষপর্যন্ত দশ টাকাতেই ‘গোধূলিয়া’ ছেড়ে দেয় দোকানদার।

বইটা হাতে নিয়ে আব্দুল্লাহর সাথে রাতের নীলক্ষেতে ঘুরতে ঘুরতে আমার খুব খিদে পায়। কিন্তু নীলক্ষেতের কোনো রেস্টুরেন্টে একটা টেবিলও ফাঁকা নেই। কাজেই একটা রেস্টুরেন্টের সামনে রাস্তার ওপরেই দাঁড়িয়ে আমি আর আব্দুল্লাহ ডালপুরি খাই। ডালপুরি খেতে খেতে আমি আব্দুল্লাহকে মনে করিয়ে দিই, “খবরদার! আজকেও কিন্তু দেরি করায় দিবি না বল্লাম! সারা দিন অফিস করে খুব টায়ার্ড লাগতেছে। সেই তোপখানার পুরনো বইয়ের দোকানগুলা থেকে আমাকে হাঁটাচ্ছিস তুই! আর তা ছাড়া আজকে বাসার বাজারের ডেট। দেরি করে বাজার নিয়ে গেলে আমার বউ কিলায়ে মেরে ফেলবে আমাকে।”

আমার সমস্যা শুনে আব্দুল্লাহ বরাবরের মতোই মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “আরে না ব্যাটা! দেরি করুম না! দুইডা পত্রিকা খুঁইজাই যামুগা।”

রেস্টুরেন্টটার সামনে দাঁড়িয়ে চা’র অর্ডার দেয়ার পর দুটো সিট ফাঁকা হলে আমরা রেস্টুরেন্টের ভেতরে গিয়ে বসি। মনোযোগ দিয়ে নতুন-কেনা কোনো একটা ইংরেজি পত্রিকার পাতা দ্রুত উল্টায় আব্দুল্লাহ। তখন খুব উৎসাহ নিয়ে আমি তাকে বলি, “বইটা কেন কিনলাম জানিস?”

আমার দিকে না-তাকিয়ে ভাবলেশহীনভাবে আব্দুল্লাহ আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করে, “না-কইলে জানুম কী কইরা? আমি কি ব্যাটা গণক নেকি?”

“আরে শোন না! মেলা দিন আগে এই বইটা কিন্তু আসলে আমিই কিনছিলাম!”

পত্রিকা থেকে মুখ তুলে ভুরু কুঁচকে আব্দুল্লাহ আমার দিকে তাকায়। তারপর সে অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করে, “তুই কিনছিলি? তোর বই এইডা? তাইলে এইডা নীলক্ষেতে আইল কী কইরা?”

“একজনকে উপহার দিছিলাম।” আব্দুল্লাহর জেরার মুখে আমি একটু হড়বড় করি।

“ও আচ্ছা! তুই একজনরে বইডা উপহার দিছিলি আর হেইডা আইসা পড়ছে নীলক্ষেতের পুরনো বইয়ের দোকানে! হেয় বেইচা দিছে আর কী!”—এটুকু বলে আবারও পত্রিকায় ঢুকে যায় আব্দুল্লাহ।

“আরে শোন না শালা! বল দেখি কাকে বইটা দিছিলাম?” দীপ্তির কথা কাউকে বলার জন্য আমি তখন এমনই কাঙাল!

“ঝামেলা করিস না তো! থাম এহন। পত্রিকাডা ভালো কইরা চেক কইরা লই আগে! মেরুজ্যোতির উপরে একটা লিখা খুঁজতাছি।” তাঁতিয়ে ওঠে আব্দুল্লাহ।

আব্দুল্লাহর বিরক্তি পাত্তা না-দিয়ে আমি তাকে বলি, “দীপ্তিকে দিছিলাম।” একটু লাজুক হাসি আমার। অনেক দিন পর দীপ্তির কথা কাউকে বলা গেল তবে! দীপ্তিকে নিয়ে আজকাল আমি কারো সাথে আর আলাপ-আলোচনা করি না। দীপ্তির বিরুদ্ধে এখন আর আমার তেমন কোনো অনুযোগ অবশিষ্ট নেই।

“ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় যেই মাইয়াডার লগে তুই লাইন মারতি তার নাম দীপ্তি আছিল—তাই না? সেই একযুগ আগের কথা! এহনো পুইষা রাখছোস এইসব? এইগুলারে কী কয় জানোস তো? বালখিল্যতা! তোরে না ছুঁইড়া রাস্তায় ফালায়া দেওয়া দরকার! শালা পাবনাইয়া ভুত!” আমাকে গাল দিতে দিতে চোখমুখ কঠিন হয়ে যায় আব্দুল্লাহর। আর তাই দীপ্তিকে নিয়ে আর কোনো কথা তোলারই সাহস হয় না আমার। অপ্রিয় সত্য কথার তোপে তখন আমি একেবারে কেঁচো হয়ে যাই।

দীপ্তিকে নিয়ে আব্দুল্লাহর সাথে কথা বলতে ব্যর্থ হয়ে আমি ব্যাদানমুখে রবের বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। রবের দোকানে আব্দুল্লাহ ঘাঁটছে পুরনো সব ম্যাগাজিন—পিপলস্, ফেমিনা, কস্মোপলিটান, ভোগ, বিভিন্ন ইনফ্লাইট ম্যাগাজিন—এসব। সাংবাদিকতার পাশাপাশি জীবনধারণের জন্য আব্দুল্লাহ বিভিন্ন পাবলিকেশন হাউসে প্রুফ রিডিংয়ের কাজ করে এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ফিচার লিখে। আর তাই প্রতি দিন সন্ধ্যায় ফিচারের ম্যাটার খোঁজার জন্য নীলক্ষেতের পুরনো বইয়ের দোকানগুলোতে সে অক্লান্ত ঘুরপাক খায়, এ বই নাড়ে, ও পত্রিকা উল্টায়, দোকানদারদের সাথে ঘ্যানঘ্যান করে দাম কমানোর জন্য, আতকা ঝাড়ি লাগায় দোকানদারদেরকে—ঐ মিয়া! এইসব আনছডা কি? একটার ভিতরেও মাল নাই! এভাবে প্রতিদিন আব্দুল্লাহ এক থেকে দেড় ঘণ্টা নীলক্ষেতের পুরনো বইয়ের দোকানগুলোতে ব্যয় করে। আব্দুল্লাহর পাল্লায় পড়লে তাই মহাগ্যানজাম! ওর জন্য অকাজে নীলক্ষেতে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমি সবসময়েই অস্থির হয়ে উঠি। এ মুহূর্তটাও তেমন।

আর পত্রপত্রিকার শত শত পৃষ্ঠা নিমিষেই উল্টাতে উল্টাতে সে কখনো আমাকে আনমনে বলে, “এই আর দুইডা মিনিট খাড়া না!” কখনো সে আমাকে ধামকি মারে, “এত সকাল সকাল বাসায় গিয়া করবিডা কী শুনি? ভাবছোস, বউ তোর লিগা বইসা বইসা কানতাছে?” আবার আব্দুল্লাহ আমাকে তোয়াজও করে কখনো কখনো, “তোরে কাবাব খাওয়ামুনে! আরেকটু থাক না ব্যাটা!” সে জানে যে শিককাবাব আর নান আমার খুব পছন্দ। কিন্তু আজকে এক ঘণ্টার ওপরে চলতে থাকা আব্দুল্লাহর হুজ্জুতি একেবারে জানের ওপর দিয়ে উঠে যায় আমার। তবু সে আমাকে ছাড়বে না—পত্রপত্রিকা খোঁজাখুঁজি শেষ হলে সে আমার সাথে আড্ডা দেবেই দেবে। তার দাপটের মুখে আমিও ছুটতে পারি না। বিকালবেলায় আব্দুল্লাহ যখন অফিস থেকে আমার সাথ ধরেছে তখনই বুঝেছিলাম, এবার আমার শনি লেগেই গেল! অফিসে যাওয়ার সময় আমার স্ত্রী লতা বলেছিল, বাটার দোকান থেকে ওর জন্য একটা চার নম্বর মাপের স্যান্ডেল কিনে নিয়ে যেতে। লতার ঘরে পরার স্যান্ডেলটা তালিতুলি মারতে মারতে আর মেরামতের উপযুক্ত নয়। কিন্তু নীলক্ষেতে এসে আজ দেরিই হয়ে গেল অনেক। আর তার ওপর আজ বাজারের ডেট। ব্যাচেলার আব্দুল্লাহ সংসারের এসব দায়দায়িত্বের কিছুই বোঝে না।

অফিসে টিফিন নিয়ে যাওয়ার হট পটটা আমার বাম কাঁধে ঝুলছে। হট পটের স্ট্র্যাপে আমার বাম হাত আর ডান হাতে ‘গোধূলিয়া’। রবের পুরনো পত্রিকার দোকানের সামনে এভাবে আমি দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই! নীলক্ষেতের উত্তরদিকের পুরনো বইয়ের দোকানগুলোর এ দিকটা থেকে তাও আকাশটা একটু দেখা যায়! সেখানে দঙ্গল পাকিয়ে ছোটাছুটি করে বেড়ায় আষাঢ়মাসের থমথমে কালো মেঘ। আমার গায়ে এসে লাগে ঠান্ডা একটা হাওয়া। আষাঢ়ের চিটচিটে গরমে তখন স্বস্তি লাগে আমার। একটু পরেই হয়তো শুরু হয়ে যাবে দিক মুছে দেওয়া অঝোর বৃষ্টি। আমার মনে হয়, এখনই কি একটা পলিথিনের ব্যাগের ব্যবস্থা করে রাখব নাকি? না-হলে আমার ডানহাতে ধরে রাখা বইটা তো ভিজে নষ্ট হয়ে যাবে! তাই আমি রবের দোকান থেকে একটা পলিথিনের ব্যাগ চেয়ে নিয়ে তার ভেতরে বইটা ভরে ফেলি। দীপ্তির কাছে ‘গোধূলিয়া’ নামের বইটার কোনো মূল্য না থাকতে পারে; পুরনো খবরের কাগজ, বইপত্র আর শিসিবোতলের সাথে বইটা সে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে কোনো ফেরিওয়ালার ঝাঁকায়, কিন্তু এই বইটা আমার কাছে অনেক মূল্যবান! আমি চাই না, জরাজীর্ণ এই বইটা বৃষ্টির পানি লেগে আরো নষ্ট হয়ে যাক!

তখন দীপ্তির ওপরে আমার ভয়ানক মেজাজ খারাপ হয়। একদা ‘গোধূলিয়া’ নামের বইটা আমি তাকে তার জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলাম আর সে কিনা বইটা ফেরিওয়ালার ঝাঁকায় ঝেরে ফেলে দিল! এটা কেমন হৃদয়হীন আচরণ? এই দীপ্তিই একদা আমাকে বলেছিল, “নিমাইয়ের ‘গোধূলিয়া’ বইটা কিনে দেও না? কিপটামি করো কেন? খুব সুন্দর গল্প! জেবার কাছে শুনতে শুনতে পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি!” বিয়ের পরে নিশ্চয়ই কালে কালে দীপ্তির সংসারে জমা হয়েছে অনেক আসবাব, অনেক বই আর ঘর সাজানোর বিস্তর জিনিসপত্তর এবং সেই বিশাল রাজ্যে এই একটা হালকা বইয়ের স্থান হয়নি। অথচ এই বইটা আমার কাছে সবুজ মতিহার, প্যারিস রোডে গগনশিরিষের ছায়া, লাইব্রেরির সামনের লাল রঙের নিচু দেয়াল, দেয়ালের সাথে রোগাপটকা একটা কামিনী। এই বইটার সাথে আরো জড়িয়ে আছে মমতাজ উদ্দিন কলাভবন, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সেমিনার রুম, সেন্ট্রাল লাইব্রেরির নির্জন জার্নাল সেকশন, দীপ্তির মন্নুজান ছাত্রীবাস। এই বইটা দীপ্তির ডাবল বেণি, তার গ্রীবার কালো তিল, তার দীঘল আঙুল, বইখাতার ব্যাগ, নীল রঙের ফোল্ডিং ছাতা, গাঢ় বাদামি সানগ্লাস। এই বইটা আমার শের-ই-বাংলা হলে দীপ্তির অগুনতি টেলিফোন, হলের মেইনগেটে হঠাৎ সাদা শাড়ি-কালো পারের দীপ্তি। এই বইটা বিরহে আক্রান্ত অজস্র রাত।

দীপ্তিকে আমি বইটা কিনে দিয়েছিলাম, তাও আবার আমার বন্ধু মিলুর কাছ থেকে টাকা ধার করে। সে দিন দীপ্তির জন্মদিন। শহীদুল্লাহ কলাভবনে সকাল আটটা দশের ক্লাস শেষ করে একদৌড়ে দোতলা থেকে আমি নিচে নামি। কলাভবন থেকে যে রাস্তাটা সোজা প্যারিস রোডে গিয়ে মিশে যায় তার মাথার কালভার্টে বসেছিল দীপ্তি, তার সথে তার সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের কয়েকজন বন্ধু। সেদিন আমি আর দীপ্তি যার যার ক্লাস ফাঁকি দিয়েছিলাম। সেদিন আমরা প্রথম মতিহার ক্যাম্পাসে একসাথে সময় কাটিয়েছিলাম অনেকক্ষণ। প্যারিস রোড ধরে মতিহার হলের সামনে দিয়ে আমরা অনেকদূরের মেডিক্যাল সেন্টার পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলাম। মেডিক্যাল সেন্টার থেকে দীপ্তি ক’টা এন্টাসিড তুলেছিল। তারপর স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে থার্ড সায়েন্স বিল্ডিংয়ের নির্জন রাস্তাটা ধরে আমরা মমতাজ উদ্দিন কলাভবনের সামনে ফিরে এসেছিলাম।

আর সেদিন তুমি সাদা শাড়ি পরেছিলে। শাড়ির পার আর ব্লাউজটা ছিল ফিরোজা রঙের। তোমার চুলে ছিল সোনালি রঙের ক্লিপ আর পায়ে চটি। তার আগের দিন তোমার চাবির রিংটা নিয়ে খেলতে খেলতে ভুল করে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছিলাম আমি। তাই আবুর ক্যান্টিনে দুপুরের খানা খেয়ে আমাকে আমার শের-ই-বাংলা হলে যেতে হয়েছিল তোমার চাবির রিংটা ফেরত আনতে। সেই দুপুরে তুমি ভাদ্রের তীব্র গরম থেকে বাঁচার জন্য লাইব্রেরির জার্নাল সেকশনে ঢুকেছিলে এবং একটা টেবিলে পেডেস্টাল ফ্যানের পাশে বসেছিলে আমার অপেক্ষায়। মন্নুজান হলে তোমার রুমে আর তুমি ফিরে যাওনি। আমি আমার হল থেকে তোমার চাবির রিং নিয়ে ফিরে আসার পর আমাকে দেখে তুমি হেসেছিলে অনেক! ব্যাপার হলো, আমার দুপায়ে ছিল ভুল স্যান্ডেল—একটা খয়েরি রঙের, আরেকটা কালো। কালো স্যান্ডেলটা ছিল আমার রুমমেট জলিল ভাইয়ের।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেসব দিনগুলো কেবল ছুটে ছুটে পালায়, দূরে দাঁড়িয়ে থাকে তারা ভীষণ মুখ গোমড়া করে। কোনো এক সেগুনবনের ভেতর দিয়ে তবু তোমারই খোঁজে ঊর্ধ্বশ্বাসে আমি দৌড়ে মরি। খুঁজে পাওয়া যায় না তোমাকে কোথাও। হঠাৎ একটা মোটা সেগুনগাছের আড়াল থেকে যেন বের হয়ে এলে তুমি। তুমি হাসতে হাসতে শুয়ে পড়লে সেগুনমঞ্জরীতে ছাওয়া মাঠের ওপর। আর তখন মিহিদানা সেগুনমঞ্জরী শূন্য থেকে ঝরে পড়ছে তোমার শরীর লক্ষ্য করে। একটা মৃদু সুগন্ধের ভেতরে আলগোছে ডুবে যাচ্ছে সেই দিনটা। সেগুনের মস্তবড় ক’টা শুকনো পাতা ঝরে পড়েছে তোমার শরীরের ওপর। খয়েরি জালিকা ছাড়া সেখানে আর কিছুই নেই। তার ফাঁকে ফাঁকে জেগে আছে তোমার অস্পষ্ট মুখ। সেই দিনগুলোর কেবল পালাই পালাই। ও সোনা! একটু বসো। গুড়মুড়ি খাও? পানদোক্তা? কোরমাপোলাও? নাহ্! তারা কিছুতেই আর আমার পাশে বসতে পারবে না।

রবের পুরনো পত্রিকার দোকান থেকে বের হয়ে আব্দুল্লাহ তখন আমাকে গুঁতো দেয়। দীপ্তি বিষয়ক ভাবনা থেকে আমি বাস্তবে প্রত্যাবর্তন করি। দ্রুত বেগে পুরনো একটা ইংরেজি পত্রিকার পাতা উল্টাতে উল্টাতেই আব্দুল্লাহ আমাকে বলে, “আরেকটু খাড়া না ব্যাটা! রবে একটা পত্রিকা খুঁজতে গেছে। আইসা পড়ব অহনই।” কিন্তু আব্দুল্লাহর বিলম্বের কারণে আমি ততক্ষণে সত্যিই বিরক্ত হয়ে গেছি। তাই আমি লতার স্যান্ডেল কিনতে যাওয়ার জন্য বইয়ের মার্কেট থেকে বের হয়ে যাই। অগত্যা পুরনো বইপত্তর খোঁজা বাদ দিয়ে আমার পিছু নেয় বেজার আব্দুল্লাহ। নীলক্ষেতের পুরনো বইপত্রের দোকানগুলো ফেলে উত্তরদিকে সায়েন্স ল্যাবরেটরির দিকে আগালে বাটা’র একটা দোকান পড়ে। সেদিকে হাঁটা শুরু করতেই কোথা থেকে আছড়ে নামে বাতাসের একটা ঝটকা! পুরনো বইপত্তরের দোকানগুলোর টিনের চাল কেঁপে যায়, আওয়াজ ওঠে কড়কড়। দোকানদারেরা দুরদার করে তাদের দোকানের শাটার ফেলে দেয়। আর ফুটপাতের দোকানদাররা ব্যস্ত হয়ে পথের ওপরে অথবা কাঠের চরাটের ওপরে বিছিয়ে রাখা বইপত্তরগুলো গুছিয়ে নেয়; তারপর বইয়ের গাদা ঢেকে দেয় মোটা পলিথিনে। তখন নিরাপদ জায়গার খোঁজে আমি বলাকা সিনেমাহল লক্ষ্য করে হাঁটতে থাকি দ্রুত। কিছু ধুলো পাক দিয়ে উঠে এসে বেহুদা ঢুকে পড়ে আমার নাকের ভেতরে। অস্বস্তিতে আমি আমার মাথা ঝাঁকিয়ে উঠি। আব্দুল্লাহ আমাকে তাড়া দেয়, “পা চালা ব্যাটা! বৃষ্টি আইসা পড়ব অহনই। ভিজা যামু তো!” তার কথা শেষ হতে না হতেই ধুন্ধুমার বৃষ্টি নামে তপ্ত এই শহরে। পলিথিনের ব্যাগের ভেতরে রাখা বইটা বুকের কাছে আড়াল করে আমি দৌড়ে উঠি গিয়ে বলাকা সিনেমাহলের বারান্দায়। উপায় না-দেখে আমার পিছু পিছু দৌড়ে আব্দুল্লাহও তার পত্রিকাগুলো হাতে নিয়ে সিনেমাহলের বারান্দায় উঠে পড়ে।

বৃষ্টি আর থামে না কিছুতেই! আচ্ছা কুফা লাগল তো! বলাকা সিনেমাহলের বারান্দায় অনেক ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাদাম খেয়ে, কখনো সিগারেট টেনে আর আব্দুল্লাহর সাথে কথা বলে কতক্ষণ আর সময় পার করা যায়? সমকালীন রাজনীতি; মতিঝিলে আমার সদাগরি আপিসের ক্লান্তিকর চাকরিবৃত্তান্ত; আলু, পটল, টেম্পু আর বাড়িভাড়ার উর্দ্ধগতি—এসব নিয়ে কথা বলতে তখন আর ভালো লাগে না আমার। মাথার ভেতরে একটা চাপ ঘন হয়—রাত হয়ে যাচ্ছে। বাসায় ফিরতে হবে জলদি। বাচ্চারা না আবার ঘুমিয়ে পড়ে! আব্দুল্লাহ তো অবিবাহিত। তার বাসায় ফেরার কোনো তাড়া নেই। সে আমার বাসায় ফেরার চাপটা বুঝবে না—আমি সেটা জানি। তাই একসময় আমি সমর্পিত হই মৌনতায় আর ঘড়ি দেখতে থাকি ঘনঘন। ঘড়ি তো নয় যেন গরুর গাড়ি—এমনই ঢিলা! এভাবে সময় আর কাটে না আমার! আধাঘণ্টা পর বৃষ্টি কিছুটা থামে। কিন্তু রাতের আকাশে তখনও কাজলকালো মেঘ। কাজেই সহসাই আবার বৃষ্টি নামবে বলে আমরা আশঙ্কা করি। নীলক্ষেত থেকে মতিঝিল, মতিঝিল থেকে মালিবাগ মোড়, তারপর মালিবাগ মোড় থেকে মগবাজার—এভাবে প্রতিদিনের মতো ভেঙে ভেঙে বাসে আর টেম্পুতে করে পেয়ারাবাগের বাসায় ফেরাটা আর নিরাপদ মনে হয় না আমার কাছে। কোথায় কখন বৃষ্টির ভেতরে পড়ে যাব আর মাঝখান থেকে ভিজে যাবে ‘গোধূলিয়া’!

আর কতক্ষণ এভাবে বৃষ্টিতে আটকে থাকা যায়? তাই “শালা! বৃষ্টির গুষ্টি মারি!”—বলে গাল দিয়ে আব্দুল্লাহ রিকশা নিতে চায় শহীদবাগে তার মেসে ফিরবে বলে। আমি তার সাথে মালিবাগ মোড় পর্যন্ত যাব। তাই আমরা বলাকা সিনেমাহলের সামনে থেকে শেয়ারে রিকশা ভাড়া করি। বাটা’র দোকানে গিয়ে লতার জন্য আর স্যান্ডেল কেনা হয় না আমার। আমি ভাবি, মালিবাগ থেকে বাসায় ফেরার পথে মৌচাক মার্কেট থেকে লতার জন্য স্যান্ডেল কিনব। কিন্তু রিকশায় ওঠার পর পরই আবার জোর বৃষ্টি শুরু হয়। জলদি জলদি রিকশার হুড তুলে দেয় রিকশাওয়ালা। আর বৃষ্টির ছাঁট আটকাতে ছেঁড়াফাটা পলিথিনের পর্দায় আমরা নিজেদেরকে ঢাকার চেষ্টা করি। আমি যতটুকু না বৃষ্টি থেকে আমার নিজের শরীর আড়াল করি তার চাইতেও বেশি আড়াল করি বইটাকে।

তখন আমার মনে পড়ে কোনো আষাঢ়স্য এক দুপুরের কথা যখন মতিহারের সেকেন্ড সায়িন্স বিল্ডিংয়ে আমি আর দীপ্তি অবিরাম বৃষ্টিতে আটকে ছিলাম প্রায় ঘণ্টা দেড়েক ধরে। তাতে আমাদের কোনো অভিযোগ ছিল না। আমরা দুজন বৃষ্টি দেখতে দেখতে বিল্ডিংয়ের গেটের সিঁড়িতে বসে অনেক গল্প করেছিলাম। একসময় দীপ্তি তার তপ্ত শরীরে বৃষ্টির স্পর্শ নিতে চেয়েছিল। দীপ্তি তাই তার নীল ছাতাটা খুলে মন্নুজানহলের দিকে রওয়ানা দিয়েছিল আর আমি দীপ্তির শারীরিক ঘনিষ্ঠতার লোভে তার ছাতার ভেতরে ঢুকে পড়েছিলাম। এভাবে সে দিন আমরা দুজনেই ভিজেছিলাম স্বেচ্ছায়। আবুল হাসানের কবিতা ‘বৃষ্টিচিহ্নিত ভালোবাসা’ স্মরণ করে দীপ্তি তখন আমাকে বলেছিল: আজকে এক্বেবারে ডাউনট্রেনের মতো বৃষ্টি এসে থামল আমাদের ইস্টিশনে! বৃষ্টি এখন জলডাকাতের মতো করে সারাটা শহরে উৎপাত শুরু করে দিয়েছে, দেখলে তো তুমি! ঠিক আবুল হাসানের কবিতার মতো কোনো এক দিন আমরা দুজন আকাশের অন্ধকার বর্ষণের সানুনয় অনুরোধে পাশাপাশি শুয়ে থাকব সারা দিন, হ্যাঁ? আমি দীপ্তির ছাতার নিচে ভিজতে ভিজতে তার স্বপ্নের সাথে যোগ করেছিলাম, “তাহলে কিন্তু আমরা সে দিন আমাদের হৃদয়ে অক্ষরভরা উপন্যাস পড়ব। রাজি তো তুমি?” আমার কথা শুনে দীপ্তি কপট রাগে বলেছিল, “এই শুরু হলো তোমার ফাজলামি! তোমার মতো পাজি এত সুন্দর একটা কবিতার মর্ম বুঝবে কী করে!” এবং তারপর সে আমার বুকের খাঁচায় তার ডান কনুই দিয়ে একটা গুঁতা মেরেছিল। আমি জোরে হেসে উঠেছিলাম।

সেই মুহূর্তে রিকশায় বসে সমকালীন রাজনীতি নিয়ে আব্দুল্লাহর বগরবগর চলছে। তার ভেতরে আমি চুপ করে মতিহারের সেই বৃষ্টিচিহ্নিত দিনের কথা ভাবছি। এবং আমি বিষণ্ন হচ্ছি এই ভেবে যে বর্ষণের সানুনয় অনুরোধে আমার আর দীপ্তির কোনোদিনই পাশাপাশি শুয়ে থাকা হয়নি, আর হবেও না।

রিকশাটা মালিবাগ মোড়ে পৌঁছালে বৃষ্টি আগ্রাহ্য করেই আমাকে নেমে পড়ার পরিকল্পনা করতে হয়। আমার গন্তব্য ভিন্ন—পেয়ারাবাগ। মালিবাগ মোড় থেকে আমাকে পেয়ারাবাগ যাওয়ার টেম্পু ধরতে হবে। কাজেই রিকশা থেকে নেমে একদৌড়ে আমি আশ্রয় নিই একটা ওষুধের দোকানের শেডে। আব্দুল্লাহ তার শহীদবাগের মেসের দিকে রওয়ানা দেয়। বৃষ্টি পড়ছে তখনও। মগবাজারগামী বাস বা টেম্পু আসছে কমকম। যেগুলো আসছে নিমিষেই সেগুলো ভরে যাচ্ছে যাত্রী দিয়ে। গাদাগাদি মানুষের সাথে লাফালাফি করেও শেষপর্যন্ত আমি ভিড় ঠেলে টেম্পুতে উঠতে পারি না। এদিকে রাত প্রায় নয়টা বেজে যায়। কাজেই বৃষ্টি থামার জন্য আর অপেক্ষা না-করে পেয়ারাবাগ রেলগেট পর্যন্ত আমি রিকশা ভাড়া করি। বৃষ্টির কারণে রিকশা ভাড়া বাবদ আট টাকার জায়গাতে আমাকে পনের টাকা ফেলার জোগাড় হলো। তাতে করে আমি সংকুচিত হয়ে যাই।

আজকাল হিসাব করে টাকাপয়সা খরচ করাটা আমার জন্য খুবই জরুরি। এই জগতসংসারে আমি এখন আর একা নই। আমার সাথে জড়িয়ে আছে আমার স্ত্রী লতা আর আমাদের দুই সন্তান। ট্রেডিং ফার্মের মার্চেন্ডাইস অফিসার হিসাবে আমার বেতন গুনেগেঁথে ছয় হাজার টাকা মতো। বাড়িভাড়া, গ্যাস, পানি আর ইলেকট্রিসিটি—এসব মিলিয়ে খরচা হয় তিন হাজার দুশো টাকা। রইল বাকি কত? এতই কম টাকা রোজগার করি আমি! ভাগ্যি ভালো যে পেয়ারাবাগের মতো কমদামি একটা এলাকাতে বাসা খুঁজে পেয়েছিলাম! বিয়ে করার আগে আমি থাকতাম আরামবাগের একটা মেসে। একটা রুম শেয়ার করতাম আমি আর জামাল নামের একজন প্রফেশনাল প্রুফরিডার। লতার সাথে বিয়ের পরে আমার একটা পৃথক ঘরের প্রয়োজন পড়ে। তারপর থেকে আমি পেয়ারাবাগে থাকি। আমার মনে হয়, আসলে দীপ্তি ভালোই করেছে শেষপর্যন্ত আমার সাথে না-ঝুলে। এই দারিদ্র্যে কারই বা পোষায়? আমার সাথে থাকতে গিয়ে লতার কষ্ট বাড়ছে বলেই আমি নিশ্চিত। দুই ছেলেকে বড় করতে সংসারে আগের চাইতে টাকাপয়সা বেশি লাগছে আজকাল। তাই এখন টিউশনি করে লতা। পাশের বাসার ক্লাস ওয়ানের একটা মেয়ে তার কাছে পড়তে আসে সপ্তাহে পাঁচ দিন। প্রতি মাসে সে সাতশ টাকা সম্মানি পায়। এইতো আমাদের ঝুক্কুরঝুক্কুর সংসারের চেহারা!

পলিথিনের ব্যাগে মোড়া ‘গোধূলিয়া’ বাম বগলের নিচে আড়াল করে জোর বৃষ্টির ভেতরে একদৌড়ে আমি রিকশাতে উঠি। মৌচাক মার্কেটের সামনের ভাঙাচোরা রাস্তায় প্রবল ঝাঁকিতে আমার বাম কাঁধ থেকে হটপটটা বেকায়দাভাবে দুলতে শুরু করে। রিকশার পর্দাটা ফুটোফাটা। কাজেই পর্দার আড়ালে বসে বইটাকে আমি বগলের নিচে ভালো মতো আড়াল করতে চাই। বইটা বাঁচানো গেলেও তুমুল বৃষ্টিতে আমার জামা ভিজে যায়, জুতা ভিজে যায়, ভিজে যায় মোজা। আমি তো মাত্র একজোড়া জুতা দিয়ে অফিস করি! তখন আমার দুর্ভাবনা হয়। একরাতের মধ্যে ভিজে যাওয়া জুতাজোড়া শুকাবে না কিছুতেই। কালকে তবে অফিসে স্যান্ডেল পরেই যেতে হবে দেখা যায়! এসব ভাবতে ভাবতে পলিথিনের পর্দার নিচে বইটা ছাড়াও আমার বৃষ্টিসিক্ত শরীরটাকে আমি যথাসম্ভব আড়াল করতে চেষ্টা করি। বৃষ্টির কারণে আমার আর পেয়ারাবাগের বাজারে গিয়ে শাকসব্জি এবং ছোট মাছ কেনা হয় না, মৌচাক মার্কেট থেকেও স্যান্ডেলও কেনা হয় না লতার জন্য।

পেয়ারাবাগ রেলগেটে নেমে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাসায় ফেরার পর আমি কাপড় পাল্টাই। বইটাকে ভেজা পলিথিনের ব্যাগ থেকে বের করে আমি শোয়ার ঘরের টেবিলে রাখি। ভাগ্যিস! ভিজে যায়নি বইটা! তারপর আমি বাচ্চাদের সাথে একটু খেলি—বাচ্চাদের সাথে বিল্ডিংব্লক দিয়ে বহুতল ভবন বানাই। ওরা ঘুমিয়ে গেলে সারা দিনের কিছু বিষয় নিয়ে গল্প করতে করতে রাতের খাবার খাই আমি আর লতা। রাতের খাবার খেয়ে শোয়ার ঘরের টেবিলে বসে ‘গোধূলিয়া’র ময়লা কাভারটা আমি একটা ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে যত্ন করে মুছি। কাভারের ওপর থেকে তেলের দাগটা যায় না তবে ধুলোবালির দৃশ্য এবং অদৃশ্য আস্তর কিছুটা উঠে যায় তখন। তাতে করে চকচকে না-হলেও বইটার চেহারা পরিষ্কার হয় কিছুটা। কিন্তু জরাজীর্ণ বইটার ঢিলা হয়ে যাওয়া বাইন্ডিংটা আর কিভাবে ঠিকঠাক করা যাবে! দীর্ঘ অযত্নে বইটার বিবর্ণ নিউজপ্রিন্টের পাতাগুলো যে পোকায় কেটে গেছে তারও তো কিছু করা যাবে না! তাই আমি দুঃখিত হই। খুব সাবধানে বইটার ক্ষতিগ্রস্ত পাতাগুলো উল্টেপাল্টে দেখি আমি। ভেতরের একটা পাতায় লাল কালিতে লেখা দীপ্তির মন্তব্য আর ব্যাককাভারে তার আঁকা ছোট একটা আয়তক্ষেত্র ছাড়া সারা বইতে দীপ্তির ফেলে যাওয়া অন্য কোনো চি‎‎হ্নই নেই। বইটার ভাঁজে ভাঁজে তবু উজ্জ্বল হয়ে আছে বৃক্ষছায়ায় উৎফুল্ল মতিহার আর এক মৃতপ্রেমের অজস্র সব স্মৃতি।

বইটার কাভার নড়াচড়া করতে দেখে লতা আমাকে জিজ্ঞাসা করে, “নীলক্ষেত গেছিলা নেকি?”

মাথা নেড়ে আমি হ্যাঁ-সূচক উত্তর দেই।

লতা এবার বলে, “নতুন বই কিনতে পারতা! কার না কার বই! ঘেন্না লাগতেছে আমার!”

লতা খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মানুষ। পুরনো সব হাঁড়িপাতিল, কোক-পেপসির বোতল, এমনকি পুরনো জামাকাপড় পর্যন্ত সে বুয়াদেরকে বিলিয়ে দেয়। তাই তার মন্তব্যে আমি মোটেই বিস্মিত হই না। আমি উত্তর দেই, “সস্তায় পাইলাম আরকি! এই বইটা না হয় তুমি পইড়ো না!”

“আমি বাবা তোমার ঐ বই ধরতেছি না!”

লতার উপসংহার শুনে আমি হাসতে হাসতে বলি, “আচ্ছা। ধইরো না তুমি।”

কিন্তু লতাকে আমি আর ‘গোধূলিয়া’র ইতিহাস বলি না। আমার অতীত নিয়েও লতা অধিকারপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে বলে আমি আশঙ্কা করি। বইটা বন্ধ করে সন্তানদের পাশে বিছানায় শুয়ে আমি খবরের কাগজে মুখ লুকাই। আমার চারদিকে দাঁত বের করে ঘুরে বেড়ায় দীপ্তির বিবিধ কথোপকথনের শবদেহ, শূন্যতে ভেঙে পড়ে তার অজস্র সব ছবি! বড় বিষণ্ন লাগে আমার।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধতে বাঁধতে লতা আমাকে জিজ্ঞাসা করে, “আমার স্যান্ডেল?”

আমি উত্তর করি, “আর বইলো না! বৃষ্টি সব ম্যাসাকার করে দিছে। কালকে কিনে আনবনে।”

লতা কখনোই অভিযোগ করে না তেমন। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটে না। পুরনো একটা ‘সানন্দা’ নিয়ে সে বিছানায় শুয়ে পড়ে; পত্রিকা পড়তে পড়তে তার ক্লান্ত শরীরে নিমিষেই ঘনায় গভীর ঘুম। দরজা খুলে আমি আমাদের দু ঘরের ফ্লাটের লাগোয়া খোলাছাদে যাই। সেখানে বসে আমি সিগারেট টানি। আমি জীবন দিয়ে জানি যে অনুশোচনা, শোকসন্তাপ আর বিরহের তীব্রতা কমে যায় ধীরে ধীরে; কেবল কিছু দুর্দান্ত স্মৃতি পড়ে থাকে—প্রেমের, ঘৃণার; স্মৃতিরা অস্পষ্টও হয়। শুধু জেগে রয় মমতার অতল এক খনি যা দিয়ে দীপ্তি আমাকে স্পর্শ করেছিল একদা। দীপ্তির সে মমতার কথা অনেকদিন পর খুব মনে পড়তে থাকে আমার। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে এই পাঁচতলা বাসাটাকে কাঁপিয়ে দিয়ে একের পর এক রেলগাড়ি যায়-আসে—কোনোটা ডাউনট্রেন, কোনোটা আপট্রেন। আর সেই শব্দে আমি উদাস হই। আমার মনে পড়ে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের পেছন দিয়ে এভাবই সারাদিন রেলগাড়ি ছুটত। রাতগুলোতে রেলগাড়ির আওয়াজ শুনতে শুনতে আমরা বন্ধুরা আত্মীয়-পরিজনহীন ক্যাম্পাস ছেড়ে যার যার বাড়িতে ছুটে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করতাম। আরো মনে পড়ে, আমি দীপ্তির সাথে প্রায়ই চা খেতে যেতাম সেই ছোট্ট ট্রেনস্টেশনটায়। চা’র দোকানটার নামটা আমি এখন আর মনেও করতে পারি না।

আমি যেই সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি, সেই আপিস বাংলাদেশের বিভিন্ন গার্মেন্টস ফার্মে মেশিনারি আর ইকুইপমেন্ট সরবরাহ করে এবং সেই সাথে আফটার সেলস সার্ভিসও দিয়ে থাকে। সম্প্রতি আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে যে বাংলাদেশের একজন কাস্টমারের অর্ডারের প্রেক্ষিতে কোরিয়ার নামসুই কোম্পানি যে মেশিনগুলো সরবরাহ করেছে তার কয়েকটা স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়নি। তাই পরদিন অফিসে গিয়ে আমাদের কোম্পানির ডিরেক্টরের (অপারেশন) ডিক্টেশন নিয়ে নামসুইকে পাঠানোর জন্য আমি একটা চিঠি ড্রাফট করি। এসব মার্চেন্ডাইজিংয়ের কাজ আমার ভালো লাগে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ইংরেজি সাহিত্য পড়েছি বলে এখন আমাকে দুনিয়ার সব চিঠিপত্তর ইংরেজিতে ড্রাফটিং করতে হয়। যাহোক, চিঠি ড্রাফটিংয়ের পাশাপাশি আমি বিগত বোর্ড মিটিংয়ের মিনিটস লিখার কাজটাও শেষ করি। চিঠি আর মিনিটসটা কম্পিউটার অপারেটরকে টাইপ করতে দিয়ে ডেস্কে বসে আমি সিগারেট ধরাই। সেই মুহূর্তে ইন্টারকমে বস আমাকে খুঁজবে না। কাজেই আমার মনে হয়, মিলুকে ফোন করার কাজটা এখনই সেরে ফেলা যাক। টেলিফোন অপারেটর যথারীতি নাম্বার লাগাতে দেরি করে। মিলুকে ফোনে পেয়ে আমি সোজা ঘোষণা দেই, “মিলু! তোকে খুব দরকার।”

গার্মেন্টস কোম্পানির নব্যমালিক মিলু তখন ভাবলেশহীন কন্ঠে বলে ওঠে, “জলদি বলে ফেল। ব্যস্ততায় মারা যাচ্ছি!”

“শোন, গতকাল না একটা মজার ঘটনা ঘটছে! আব্দুল্লাহর সাথে নীলক্ষেত গেছিলাম। ঐখানে”... কিন্তু কথাটা শেষ করা হয় না। বিরক্তিতে ব্যস্ত মিলু হিসহিস করে, “পরে শুনবোনে তোর এইসব কথা। ফোন রাখ তো এখন! সন্ধ্যায় ফ্যাক্টরিতে আসিস।”

“তোর ফ্যাক্টরিতে যাব? মতিঝিল থেকে মিরপুর? অতদুর যাইতে পারব না বাবা!” কাতর হয়ে উঠি আমি।

“ওকে। শাহবাগ। আজিজ কো-অপারেটিভ। সন্ধ্যা সাতটায়।” এই বলে লাইন কেটে দেয় মিলু।

ছোটখাট একটা গার্মেন্টস কোম্পানি দাঁড় করাতে গিয়ে মিলু এখন এমনই ব্যস্ত! তার আর আড্ডা দেওয়ার সময় নেই। সেজন্য আমরা বন্ধুরা মিলুর ওপরে ভয়ানক ক্ষিপ্ত হয়ে আছি। শাহবাগের আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেটের দোতালায় একটা রেস্টুরেন্টে বসেও মিলুর ব্যস্ততার বহর কমে না। মোবাইল ফোনে একের পর এক এর-ওর সাথে সে কথা বলেই চলে। তখন মেজাজটা খাট্টা হয়ে যায় আমার। বিরক্তি নিয়ে আমি মিলুকে বলি, “মোবাইলটা অফ করে দেস না কেন?”

জামাল না জামিল—কার সাথে যেন কথা শেষ করে নিস্পৃহ গলায় মিলু বলে, “এইবার কও মামা, মামলাটা কী।”

সাথে সাথেই আমি স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠি, “বুঝলি, কালকে নীলক্ষেতে পুরানো একটা বই পাইছি।”

“ও আচ্ছা। কোন বইরে?” আমার দিকে না-তাকিয়েই পকেট থেকে ছোট একটা নোটবুক বের করে সেখানে কিছু একটা লিখতে শুরু করে মিলু।

“নিমাই ভট্টাটার্যের ‘গোধূলিয়া’। তুই বিশ্বাস করবি কিনা, ঠিক এই বইটাই দীপ্তিকে গিফট করছিলাম আমি। বইটার ভিতরে ওর হাতের লেখাও আছে। বইটার কথা তোর মনে আছে তো? আমি তো শালা তাজ্জব হয়ে গেলাম!” বলতে বলতে আমি ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে পড়ি।

দীপ্তিকে নিয়ে আরো কথা, আরো অনেক কথা বলা চাই তখন! দিনে দিনে কত কথার ভারই না জমেছে আমার ভেতরে—ছোট কথা, মেঝ কথা, বড় কথা! আমি জানি যে স্মৃতির ভেতরে নিমজ্জন কেবল শোকসন্তাপই বাড়ায়! কিন্তু দীপ্তিকে ঘিরে আমার স্মৃতি তো কেবল মৃতপ্রেমের স্মৃতিই নয়, সেই স্মৃতির সাথে আমার তারুণ্যের একটা বড় অংশ জড়িয়ে আছে যেখানে বৃক্ষরাজিতে ছাওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের একদল তরুণ সারাদিন আবুর ক্যান্টিন, আলির ক্যান্টিন আর মেইনগেটের উল্টোদিকের মন্টুর ক্যান্টিনে আড্ডা দেয়; গগনশিরিষের চিহ্ন ধরেধরে তারা হেঁটে বেড়ায় প্যারিস রোডের এমাথা থেকে ওমাথা; জুবেরি হাউসের সামনের পুকুরপারে বসে তারা লক্ষ করে মন্নুজানহল আর রোকেয়াহলের মেয়েদের চলাচল; তারপর তারা কাজলাগেটে চা খেয়ে রাত বাড়লে যার যার হলে ফিরে যায়। শের-ই-বাংলা হলের টেনিস গ্রাউন্ড, পূর্ব আর পশ্চিম হাউসের বিভিন্ন রুম অথবা শহীদ মিনারের বেদিতে আবার রাত্রিকালীন আড্ডা চলে তাদের। সবশেষে আমি আমার জন্য নির্ধারিত সিঙ্গেলরুমের বিছানায় শুয়ে বাতি নিভাই। আমার জানলা দিয়ে ঢুকে পড়া মহুয়াগাছের পাতারা আমার সাথে জেগে থাকে। চৈত্রমাসে মহুয়াফুলের তীব্র গন্ধ আমাকে উন্মাতাল করে দেয়। তখন আমি দীপ্তির অভাব বোধ করি। মাঝেমাঝে একা-ঘরে আমার ভীষণ ভুতের ভয় হয়। বালিশের নিচে মাথা লুকিয়ে আমি বিছানায় পড়ে থাকি। তা শুনে হাসতে হাসতে দীপ্তি আমাকে বলে, “তোমার সাথে ঝগড়া করে হলেও আমি কখনো আলাদা ঘরে শোব না। তাহলে চলবে?” দীপ্তির কথা শুনে আমার খুবই স্বস্তি লাগে তখন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি আর তখনকার নাম করা ক্রিকেট খেলোয়ার মিলু শের-ই-বাংলা হলে পাশাপাশি রুমে থাকতাম। ‘গোধূলিয়া’ সংক্রান্ত ব্যাপারটা তার ভোলার কথা নয়। কিন্তু সেই মুহূর্তে আজিজ কো-অপারেটিভ মার্কেটের দোতালার রেস্টুরেন্টে বসা মিলুর ভেতরে সেই বইটা নিয়ে এক ছটাকও উত্তেজনা নেই, কোনো আগ্রহ নেই। টেবিলে ঝুঁকে পড়ে গভীর উৎসাহ নিয়ে সে মোটেই আমাকে প্রশ্ন করছে না—‘তারপর? তারপর কী হলো?’ নোটবুক থেকে চোখ তুলে কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে বরং সে দ্রুত অর্ডার দিচ্ছে, “দুইটা চিকেন স্যান্ডউইচ আর দুইটা কফি। জলদি লাগাও।”

মিলুর নৈর্ব্যক্তিকতায় আমি আহত হই। অথচ এই মিলু আর আমি একদা রাতের পর রাত শের-ই-বাংলা হলের টেনিস গ্রাউন্ডে বসে বসে অথবা রাতের মতিহারে হাঁটাতে হাঁটতে অধরা মেয়েদেরকে নিয়ে কতই না আলোচনা করেছি! যেমন, এক দিন মেইনগেটে মন্টু ভাইয়ের চা’র দোকানে বসে গাঁজা খেতে খেতে হিন্দি মুভির ডাকসেটে নায়িকা রেখাতে মুগ্ধ হয়ে আমি মিলুকে বলেছিলাম, “দীপ্তি নামের ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েটা—খুলনা না কোথাকার—তার চোখ যদি রেখাজির চোখের মতো কথা না-বলে তাহলে আমি তাকে দেখতেও যাব না দোস্ত!” আর মিলু তখন তার প্রেমিকা রেহানার মন্নুজান হলের রুমমেট দীপ্তির রূপকীর্ত্তণে ব্যস্ত, “রেখার সাথে দীপ্তির চেহারার এত মিল! মেয়েটার চোখ রেখার মতো বড় বড়। আর মেয়েটা লম্বাও অনেক!” তারপর মিলু যে রসিকতা করেছিল, এতদিন পরে মিলুর সেই রসিকতাটাও মনে পড়ছে আমার। মিলু বলেছিল, “তোকে মোটেই ঝুঁকে দীপ্তিকে চুমা খেতে হবে না। ঝুঁকে চুমা খেতে গেলে তোর কোমরে আবার টান পড়তে পারে! দীপ্তির পিছে তুই লাইগা পড় ব্যাটা!” তারপর গাঁজার নেশায় ভীষণ এলোমেলো আমরা দুজন অকারণে বেদম হেসে উঠেছিলাম। মিলু হাসতে হাসতে জড়ানো কণ্ঠে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “আমি কোনো দিন শুনি নাই যে মাইনষের চোখ কথা কয়! চোখ দিয়ে আওয়াজ বাইর হয় নেকি দোস্ত? তোকে না গাঞ্জায় ধরছে!” মাতাল আমি কোনো মতেই গুছিয়ে মিলুর সেই প্রশ্নের উত্তর করতে পারিনি সেদিন এবং আমি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি করতে থাকি মেইনগেটের সাথের বিশাল মাঠটায়। আমার সাথে যোগ দেয় মিলুও। আর এখন সেই মিলুর কিনা দীপ্তিকে নিয়ে কথা বলার সময়ও নেই! আশ্চর্য! হারিয়ে যাওয়া রেহানাকে নিয়েও মিলুর কোনো দুঃখবোধ আছে বলেও আমার মনে হয় না!

সেই মুহূর্তে আজিজ কো-অপারেটিভের রেস্টুরেন্টে বসে ছোট একটা কাগজে কী জানি সব হিসাব করছে মিলু আর আমার দিকে না-তাকিয়েই সে আমাকে প্রশ্ন করছে, “কী একটা বইয়ের কথা যেন বলতেছিলি? শুনতেছি তো! বলে যা না!”

মিলুর ওপরে অভিমানের কারণে তখন আমার চুপ থাকার পণ। শালা, খুব ব্যস্ততা ফুটাচ্ছ না? পণ ভাঙি না আমি। কফিতে চুমুক দিয়ে আমি রেস্টুরেন্টে বসে থাকা অন্যান্য খদ্দেরদের চেহারা দেখতে থাকি খামোখাই। আমার নীরবতায় শেষ পর্যন্ত ক্ষুব্ধ হয় মিলু। সে বলে, “একটুতেই গায়ে ফোস্কা পড়ে গেল, না? কালকে ফার্স্ট হাফের ভিতরে ছাব্বিশ লাখ টাকা জোগাড় করা দরকার, জানিস? খালি তো অফিস কর, খাওদাও আর ঘুমাও! ব্যবসার চোদন তুমি কি বুঝবা!”

তবুও আমি চুপ। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে মাইক্রোবাসে উঠতে উঠতে মিলু আমাকে বলে, “চল আমার সাথে। বাইরে খাব। রাতে বাসায় পৌঁছায় দিবনে, যা!” কিন্তু ফুটপাত থেকে নড়ি না আমি; তাকে জানাই, “আজকে না, আরেক দিন যাবনে।”

“যাকগা। কালকে রাতে তোর বাসায় খাব। লতাকে বলিস কিন্তু!” একথা বলে চলে যায় ব্যস্ত মিলু।

তবে কি আমি এ্যালিফেন্ট রোডে ধ্রুব, ইমতি আর শওকতের ডেরায় যাব? ওখানে গিয়ে ‘গোধূলিয়া’ খুঁজে পাওয়ার গল্পটা বলব নাকি তাদেরকে? আমি নিশ্চিত যে ওখানে সাহিদ, কায়সার, মিজান, আব্দুল্লাহ, সুব্রত, আদিল অথবা মাসুদ—এদের কাউকে না কাউকে পাওয়া যাবেই। আর বিষ্ণু তো হারিয়েই গেছে কলকাতার ভিড়ে! ওকে আর কোনোদিন খুঁজে পাওয়া যাবে না। নাকি দীপ্তির ঘনিষ্ঠ বন্ধু সালমার মিরপুরের বাসায় যাব? সালমার সাথে দীপ্তির যোগাযোগ আছে বলে জানি। থাক! এই সবগুলো জায়গাই শাহবাগ থেকে অনেক দূরে। তার চাইতে পেয়ারাবাগে নিজের বাসাতেই ফিরে যাই। ঘামে শরীরটা কেমন চিটিরমিটির করছে!

শাহবাগ থেকে আমি মগবাজারের দিকে হাঁটছি মিন্টো রোড ধরে। মিন্টো রোডে জমে আছে রাত আর নির্জনতা। ময়লাগাদার শহরে এই পথটা গাছপালার মমতায় আজও কী সুন্দর সেজে আছে! মতিহারের প্যারিস রোডের কথা তোমার মনে আছে দীপ্তি? একবার তুমি অদ্ভুত একটা স্বপ্নের গল্প বলেছিলে। ঘন কুয়াশায় সাজানো প্যারিস রোড। এত কুয়াশা যে দু গজ দূরেও কাউকে দেখা যায় না! তুমি একাকি হেঁটে আসছো প্যারিস রোডের পশ্চিমদিক থেকে। ভিসির বাসার সামনে কুয়াশা ফুঁড়ে তখন নাকি তোমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলাম এই আমি! তুমি আমাকে বলেছিলে, তখন আমার সারাটা শরীর থেকে বের হচ্ছে সাদাসাদা কুয়াশা। কুয়াশার মোড়কের ভেতর আবৃত আমি তখন নাকি তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। তুমি অনেকক্ষণ ধরে চুমু খেয়েছিলে আমার ঠোঁটে। আর আমার ঠোঁট থেকে বিন্দু বিন্দু কুয়াশা ঢুকে পড়ছিল তোমার মুখে, নাকে, চোখে আর শরীরের সর্বত্র। অনেক দিন পরের এক সকালে তুমি এই স্বপ্নটার কথা আমাকে বলেছিলে। জনৈক সামরিকজান্তার সাথে ছাত্রদের সংঘর্ষের কারণে তিনমাস বন্ধের পর সেদিন ভোরে আমি পাবনা শহর থেকে রাজশাহী ফিরেছি। তুমি তার আগের দিনে ফিরেছো খুলনা থেকে। তোমার প্রতীক্ষাতে সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনের লাল দেয়ালের ওপর আমি শীতের রোদে বসেছিলাম চুপচাপ। দীর্ঘ অদর্শনের পর প্রথমদেখাতেই তুমি সেই স্বপ্নটার বর্ণনা দিয়েছিলে এবং স্বপ্ন কখনো সত্যি হয় না—এই ভেবে আমরা আশ্চর্য এক বিষাদে চুপ করে ছিলাম অনেকক্ষণ।

গতকাল তো বাজার করা হয়নি। একে তো আব্দুল্লাহ-বন্ধুর প্যাঁচে পড়েছিলাম, তারপর ‘গোধূলিয়া’, তারপর তুমুল বৃষ্টি, তারপর দীপ্তি—কেবলই দীপ্তির স্মৃতি। আজ সকালের খবর, মাত্র চারটা আলু আছে টুকরিতে আর ফ্রিজে রয়ে গেছে তিনটা ডিম। কাঁচা মরিচ? আছে, হাড় জিরজিরে ক’টা কাঁচা মরিচ পড়ে আছে বটে। লতার ধারণা মতো এতে করে কেবল ডিম আর আলুর ঝোলই রান্না করা সম্ভব হবে, আর কিছু নয়। “মসুরের ডাল তো খুবই পুষ্টিকর। আজকের মতো ডালভাতই চালায় দিও!”—লতাকে এটুকু বলে সকালে আমার অফিসযাত্রা হয়েছিল। সন্ধ্যাবেলায় অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় মালিবাগ মোড়ে টেম্পু থেকে নেমে আমি মৌচাক মার্কেটে গিয়ে লতার জন্য স্যান্ডেল কিনি। তারপর মৌচাক মার্কেট থেকে পেয়ারাবাগ অভিমুখে হাঁটতে হাঁটতে দীপ্তির স্মৃতির পাশাপাশি আমার এই কথাটাও মনে পড়ে যে বাসায় রান্না করার মতো তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই। তাই প্রচণ্ড বিরক্তি লাগলেও পেয়ারাবাগ মিউনিসিপাল মার্কেট থেকে আমি কিছু শাকসব্জি, ছোট মাছ আর পেঁয়াজ-মরিচ কিনে বাসায় ফিরি।

পেয়ারাবাগে আমাদের ভাড়াবাড়িতে দুটো ঘর—একটা শোয়ার ঘর এবং আরেকটা ঘর ব্যবহৃত হয় বসার ঘর হিসাবে। দ্বিতীয় ঘরটা আকারে একটু ছোট যেখানে একটা সিঙ্গেল খাট পাতা আছে আর সম্ভাব্য অতিথিদের বসার জন্য রাখা আছে দুটো বেতের মোড়া। বাসায় ফিরে দ্বিতীয় ঘরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে প্রতি দিনের মতো দ্বিতীয় দফায় খবরের কাগজ উল্টাই আমি। আমাদের ছোট ছেলে তপু তখন শোয়ার ঘরের অন্ধকারে মা’র কাছে ঘুমাচ্ছে। আর আমার পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে টেলিভিশনে কার্টুন দেখছে আমাদের তিন বছরের বয়সী বড় ছেলে অপু। খবরের কাগজ পড়তে পড়তে একসময় ‘গোধূলিয়া’র কথা মনে পড়ে আমার। উঠে গিয়ে শোয়ার ঘরের বাতি জ্বালিয়ে দেখি, আমার টেবিলের ওপরে বইটা নেই। কী ব্যাপার? সকালে অফিসে যাওয়ার আগে বইটা তো এখানেই ছিল! লতা অন্য কোথাও বইটা সরিয়ে রাখেনি তো! হতেই পারে! এমনটা ভেবে আমি শোয়ার ঘরের বাতি জ্বালিয়ে বইটা খুঁজতে শুরু করি। চেস্ট অব ড্রয়ার অথবা আলমারির মাথায় সাধারণত জিনিসপত্র রাখে লতা। চেস্ট অব ড্রয়ারের ওপরটায় চাবির রিং, মাটির ব্যাংক, ওষুধ, দুধের কৌটা রাখা আছে। এসবের সাথে আমার জরুরি কাগজপত্তরও আছে কিছু। সেখানে বইটা নেই। আলমারির মাথাতেও সংসারের জিনিসপাতি কম নেই! অনেক খোঁজাখুঁজির পরো সেখানে বইটা খুঁজে পাই না আমি।

আধোঘুমের ভেতর থেকে লতা তখন আমাকে জিজ্ঞাসা করে, “কী এত খুটুরখাটুর করতেছো?”

“একটা বই খুঁজে পাচ্ছি না—ঐ যে যেই বইটা সেইদিনকা নীলক্ষেতের পুরানো বইয়ের দোকান থেকে কিনলাম!”

“কোথায় রাখছিলে?”

“সকালে তো টেবিলেই ছিল!”

“অপু কিন্তু বিকালে তোমার টেবিলের উপরে উঠছিল! দেখো তো, ও আবার বইটা নিল কিনা!”

“সেকি!”—শোয়ার ঘর থেকে আমি পাশের ঘরে ছুটে যাই। কয়েকটা প্রশ্নের পরেই বইটার কথা অপু মনে করতে পারে। কার্টুন দেখা থামিয়ে বিছানার চাদরের একপ্রান্ত তুলে তিন বছরের অপু তখন সোজা ঢুকে যায় খাটের নিচে এবং বের করে আনে বইটা। তার হাত থেকে একরকম ছোঁ মেরেই বইটা নিয়ে নিই আমি। আমি দেখতে পাই, কাভারের সামনের বোর্ডটা ছিঁড়ে গিয়ে বোর্ডটা স্পাইনের সাথে ঝুলছে! আমি জলদি জলদি বইটার পাতা উল্টে দেখতে বসি। পাতা উল্টালে দেখা যায়, সেখান থেকে কয়েকটা পাতা গায়েব হয়ে গেছে কোথাও! এমন একটা অবস্থায় গম্ভীর কন্ঠে আমি অপুকে জিজ্ঞাসা করি, “অপু! তুমি আমার বই ধরছো কেন?”

তিন বছরের শিশু আমার প্রশ্ন বুঝতে পারে না বলেই মনে হয়। সে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে আগের মতোই।

আমি আবার পুত্রকে প্রশ্ন করি, “বইটা ছিঁড়লে কেন, বলো?” আমি খুবই অসহিষ্ণু তখন।

আধো গলায় অপু উত্তর দেয়, “না, আমি ছিঁড়ি নাইতো! ছবি আছে কিনা, দেখতেছিলাম। একটাও ছবি নাই বাবা!” বলতে বলতে অপু তার প্যান্টের পকেট থেকে একটা কাগজের গোল্লা বের করে আমার হাতে দেয়। গোল্লাটার ভাঁজ খুলে দেখি, ‘গোধূলিয়া’র চারটা ছেঁড়া পাতা সেখানে জড়ো করেছে অপু। আমি চরম বিরক্তি আর হতাশা নিয়ে আমার পুত্রের দিকে তাকিয়ে থাকি। কয়েক সেকেন্ড ধরে অপু আমার গুমোট মেজাজ লক্ষ করে তারপর তার খেলনা গাড়িটা হাতে নিয়ে একদৌড়ে সে পাশের ঘরে তার মা’র কাছে চলে যায়।

আর আমি ‘গোধূলিয়া’ খুলে ছেঁড়া পাতাগুলো কোনোরকমে খাঁজে খাঁজে মিলিয়ে স্কচটেপ মেরে দেই। হিসাব করে দেখি যে আরো দুটো পাতা বইটা থেকে ছিঁড়ে নিয়েছে অপু। পাতাগুলো অপু কোথায় ফেলেছে তা কে বলবে! কী আর করা! একজন শিশুর পক্ষে তো আর বইয়ের মর্ম বোঝার কথা নয়! তাছাড়া বাইন্ডিংটা মজবুত রাখার জন্য বোর্ডটার বাইরে আর ভেতরে দু দিকেই প্লাস্টিক গাম মেরে কাগজ সেঁটে দিই। তারপর অপুর নাগালের বাইরে রাখব বলে বইটাকে আমি চেস্ট অব ড্রয়ারের ওপরে তুলে রাখি। মেঝে থেকে পাঁচ ফুট মতো উচ্চতায় অপুর উঠতে পারার সম্ভাবনা কম বলেই আমার মনে হয়।

আমার খুব বিষণ্ন লাগে তখন। চুপচাপ খোলাছাদে বসে থাকি আর সিগারেট খাই আমি। আমার সাথে রাত্রি জাগে, জাগে অন্ধকার। আমার বিবিধ বঞ্চনার ভেতরেও তারা আমাকে কোনো দিন পরিত্যাগ করেনি। অনেক দিন পর আবারও আমার মনে হয়, পথের ধুলোরা আমাকে ডাকছে; রেললাইনের নুড়িপাথরেরা ডাকছে; আমাদের বাসার সামনের বাতিল ইট, কাঠ, লোহা আর প্লাস্টিকের পাইপের গাদা আমাকে ডাকছে। তারা বলছে: আইস সহোদর! সেই মুহূর্তে সামনে থাকলে দীপ্তি হয়তো আগের মতো করেই বলত, “তুমি এত ইমোশনাল! আমার খুব ভয় হয়!” না দীপ্তি! আমি এখন আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছি। নিশ্চয়ই আমি কোনোদিনও তোমাকে ‘গোধূলিয়া’ খুঁজে পাওয়ার গল্পটা বলব না।

নীলক্ষেতের ফুটপাতে পুরনো বইপত্তরের দোকানে নিমাই ভট্টাচার্যের ‘গোধূলিয়া’ পড়ে পাওয়ার পর প্রথম দু সপ্তাহ আমি ভয়ানকভাবে টালমাটাল হয়ে যাই। মতিহার ক্যাম্পাসে ফেলে আসা তারুণ্যের দিনগুলো, বন্ধুবান্ধব আর দীপ্তির কথা অনেক অনেকদিন পরে আমার খুব মনে পড়তে শুরু করে। এও সত্য যে সেই উন্মাতাল দিনগুলোতে আমি এখনো ফিরে যেতে চাই কিন্তু সেখানে ফিরে যাওয়ার কোনো পথ খুঁজে পাই না আমি। তবে মানুষের জীবনযাপন এত সর্বগ্রাসী আর এত মধুর যে আমার মনোযোগ থেকে সরতে সরতে ফিরোজা রঙের কাভারের ‘গোধূলিয়া’ একসময় অনেকদূরে মিলিয়ে যায়।

‘গোধূলিয়া’র কথা আবার আমার মনে পড়ে মাস তিনেক পরের একদিনে। আমি তখন মতিঝিলের সদাগরি আপিসের ডেস্কে বসে এক জন ক্লিয়ারিং এ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টের সাথে দাপ্তরিক কথা বলাতে ব্যস্ত। ‘গোধূলিয়া’র কথা মনে পড়াতে আমি তখন তখনই বাসায় গিয়ে বইটা একটু দেখে আসার তাড়া বোধ করি। কিন্তু ডিরেক্টরের কাছ থেকে ছুটি খসবে না মরে গেলেও। উপরন্তু, সে দিন ঘণ্টা দেড়েক অতিরিক্ত কাজ করতে হয় আমাকে। অফিস থেকে পেয়ারাবাগের বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে তাই সন্ধ্যা পার হয়ে যায়। আমি আর আড্ডায় যাই না কোথাও। আব্দুল্লাহ ফোন করেছিল দুপুরে, বিকালে মিজান আর মাসুদ। তাদেরকে বলেছি, আজ আর আড্ডা দিতে পারব না কেননা বাসায় জরুরি কাজ আছে একটা। বাসায় ফিরে হটপটটা খাবার টেবিলে নামিয়ে রেখেই আমি ছুটে যাই শোয়ার ঘরের চেস্ট অব ড্রয়ারের দিকে। আমি দেখি, অবাক হয়ে দেখি, বইটা সেখানে নেই! আমি আতঙ্কিত হই এই ভেবে যে চেয়ার লাগিয়ে চেস্ট অব ড্রয়ারের ওপর থেকে আমার ছেলে অপু ফের বইটা কব্জা করে ফেলেনি তো! আমার আশঙ্কা হয় এবার হয়তো ছোট্ট অপু ছিঁড়ে ফেলবে পুরো বইটাই!

চেস্ট অব ড্রয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে দিশেহারা অবস্থায় খাবি খেতে দেখে লতা জিজ্ঞাসা করে, “কী খুঁজতেছো কখন থেকে?”

আমি তাকে বইটার বিবরণ দেই। মনে করতে চেষ্টা করে লতা, “গোধূলিয়া...গোধূলিয়া...দাঁড়াও তো! চার-পাঁচ দিন আগে পুরানো খবরের কাগজগুলা সব বেচে দিছি। পুরানো বইটইও তো বেচলাম কিছু! ঐগুলার ভিতরেই চলে গেল নেকি বইটা!”

বাসার এদিক-ওদিক খুঁজে এসে লতা জানান দেয়, বইটা পাওয়া যায়নি কোথাও! লতা তখন অপরাধী হয়ে আমাকে সান্ত্বনা দিতে চায়, “পুরানো বইই তো! গেছে, যাক! নিউমার্কেট থেকে তোমার জন্যে নতুন একটা ‘গোধূলিয়া’ কিনে আনবনে!”

আমি কোনো কথা বলি না। বইটা বিক্রি করে দেওয়ার জন্য লতার বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ তৈরি হয় তলে তলে। একটু পরে লতা বইটার প্রসঙ্গ ভুলেও যায় এবং সে রুটিনমাফিক বাচ্চাদেরকে রাতের খানা খাওয়াতে বসে।

ক’বার ঘরের কোনাটোনা হাতড়েহুতড়ে বইটা খুঁজে না-পেয়ে থেমে যাই আমিও। আমি স্থির করি, নীলক্ষেতের পুরনো বইয়ের দোকানগুলোতে এবার আমি খুঁজে বেড়াব নিমাই ভট্টাচার্যের ‘গোধূলিয়া’ নামের বইটা যেই বইটা আজ থেকে তের বছর আগে আমি দীপ্তিকে উপহার দিয়েছিলাম। দীপ্তি অথবা লতার মতো করেই কেউ হয়তো কোনোদিন কোনো ফেরিওয়ালার কাছে আবারও সেই জরাজীর্ণ বইটা বিক্রি করে দিতে পারে। পারেই তো!

তারপর থেকে আমি ঘনঘন নীলক্ষেতে যাই।

   

শিশু সুভাষচন্দ্রের চেতনায় স্বদেশপ্রেমের উন্মেষ যেভাবে



উৎপল আইচ
-নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ছবি: সংগৃহীত

-নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে আমরা প্রায় সকলেই বৃহত্তর ভারতবর্ষের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক বলে মানি এবং শ্রদ্ধা করি। তাঁর তুলনাহীন দেশপ্রেমের সামগ্রিক পর্যালোচনা শুধু একটা নাতিদীর্ঘ রচনার পরিসরে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। তাই বালক-কিশোর সুভাষচন্দ্রের জীবনে দেশাত্মবোধের অঙ্কুরোদয় আর তার উন্মেষই এই রচনার উপজীব্য থাকলো।

১৯০২ সালের জানুয়ারি মাসে ৫ বছর বয়স থেকে ১৯০৮ সালের ডিসেম্বর মাস অবধি, অর্থাৎ প্রায় ১২ বছর বয়স অবধি, দীর্ঘ ৭ বছর, সুভাষচন্দ্র ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত কটকের প্রটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান স্কুলে পড়াশুনা করেন। বিলিতি আদর্শে নিয়ন্ত্রিত এই স্কুলের বেশির ভাগ ছাত্রই ছিল ইউরোপীয় কিংবা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। যদিও এই স্কুলে খুব ভালো ইংরেজি শেখানো হতো, আসল প্রচেষ্টা ছিল ছাত্রদের মনেপ্রাণে ইংরেজ করে গড়ে তোলার। তাই বাইবেলের উপর খুব জোর দেওয়া হত। তাছাড়া গ্রেটবৃটেনের ইতিহাস ও ভূগোল, ল্যাটিন ইত্যাদি শেখানো হতো। সেই স্কুলে সংস্কৃত বা অন্য কোন ভারতীয় ভাষা শেখাবার প্রশ্নই উঠে না। তবে পড়াশুনার সাথে সাথে স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিয়মানুবর্তিতা এবং ভদ্র-ব্যবহারকে শিক্ষার বড় অঙ্গ বলে মনে করতেন।

এই স্কুলে প্রবেশের কয়েক বছর পরই বালক সুভাষচন্দ্র বঙ্গভঙ্গ-জনিত দেশের রাজনৈতিক নবজাগরণের ব্যাপারটা বুঝতে শিখেছিলেন। প্রথম দিকে না বুঝতে পারলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটাও অনুভব করতে পারলেন যে তাঁদের বাড়ির বা তাঁদের সমাজের জীবন আর স্কুলের জীবন একদম ভিন্ন ধরণের। সুভাষচন্দ্র এও জানলেন যে ভারতীয়রা পরীক্ষায় সর্বোচ্চ স্থানাধিকারী হলেও শুধুমাত্র ভারতীয় বলে স্কলারশিপ-পরীক্ষা দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তাছাড়া, ইউরোপীয় এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছেলেরাই ভলান্টিয়ার কোর-এ যোগ দিতে পারে, বন্দুক ব্যবহার করা শিখতে পারে যা ভারতীয় ছাত্রদের জন্য নিষিদ্ধ।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ‘অ্যান ইন্ডিয়ান পিলগ্রিম’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এইসব ছোটোখাটো ব্যাপার থেকেই আমাদের চোখ খুলতে শুরু হল, বুঝলাম যে এক বিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় হিসাবে আমরা কতটা আলাদা’ (“Small incidents like these began to open our eyes to the fact that as Indians we were a class apart, though we belonged to the same institution.”) । সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীর শুরুতেই লিখেছেন যে তাঁর মন স্পর্শকাতর এবং তিনি একজন অন্তর্মুখী ব্যক্তি। (“I was and still remain an introvert.”) সুভাষচন্দ্র সেই আত্মজীবনী অসুস্থ অবস্থায় ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে দশদিনে অস্ট্রিয়ার ব্যাডগাসটেন-এ অবস্থানকালে লিখেছিলেন। তিনি সেখানে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য গিয়েছিলেন।

আত্মজীবনীতে তিনি আরও লিখেছেন, “সব কিছু বিচার করে আমি এখন একজন ভারতীয় বালক বা বালিকাকে এরকম স্কুলে পাঠাবো না। সে নিশ্চিত সুসমন্বয়ের অভাবে এবং তজ্জনিত অশান্তিতে ভুগবে, বিশেষতঃ সে যদি স্পর্শকাতর স্বভাবের হয়। (“Considering everything, I should not send an Indian boy or girl to such a school now. The child will certainly suffer from a sense of mal-adaptation and from consequent unhappiness, especially if he or she is of a sensitive nature.”)

১৯০৯ সালের জানুয়ারি মাসে সুভাষচন্দ্র কটকের র‍্যাভেন্-শ কলেজিয়েট স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে (এখনকার হিসাবে সপ্তম শ্রেণিতে) ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি চার বছর পড়াশুনা করে ১৯১৩ সালের মার্চ মাসে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। সুভাষচন্দ্র বসু যখন র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন তখন সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রী বেণীমাধব দাস। সুভাষচন্দ্রের বয়স তখন ১২ বছর। কিশোর সুভাষ তার আগে এক বর্ণও বাঙলা পড়েননি। এদিকে তাঁর সহপাঠীরা সবাই বাঙলায় পারদর্শী ছিল। কিন্তু চরম অধ্যবসায়ী সুভাষ এক বছরের মধ্যেই বাঙলাটা রপ্ত করে ফেলেন। সংস্কৃতের ব্যাপারও একই কথা বলা যায়। এই নতুন স্কুলে তাঁর বন্ধুও জুটে যায় যেটা প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান স্কুলে হয়নি।

সুভাষচন্দ্র ছিলেন নিরহংকারী এবং প্রচারবিমুখ মহাপুরুষ, তাই অনেক কথা বিস্তারিতভাবে আত্মজীবনীতে লেখেননি বা হয়তো আত্মপ্রশংসা হবে মনে করে এড়িয়ে গেছেন। র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে তাঁর বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী ছিলেন শ্রী চারুচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি সুভাষচন্দ্রদের প্রতিবেশীও ছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য যে চারুচন্দ্র তাঁর স্মৃতি রোমন্থন করে শ্রী সুবোধচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়ে “সুভাষচন্দ্রের ছাত্রজীবন” নামে একটা বই লিখে গেছেন। তাঁর কাছ থেকে আরো অনেক তথ্য জানা যায়। এছাড়া অন্যান্য সূত্র থেকেও কিছু নতুন তথ্য জানা যায় এবং কিছু তথ্যের সমর্থন মেলে।

প্রথম ভর্তি হবার দিন সুভাষচন্দ্র কোট-প্যান্ট পরে র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে গিয়ে দেখতে পান যে সমস্ত শিক্ষক এবং অন্যান্য সব ছাত্ররা দেশীয় পোশাক পরে আছেন। তার পরদিন থেকে তিনিও ধুতি-পাজ্ঞাবি পরে স্কুলে যেতে শুরু করেন। সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে ক্ষুদিরাম বসুর নাম উল্লেখ না করে লিখেছেন যে ১৯০৮ সালে যখন প্রথম বোমা নিক্ষেপ করা হয় তখন চারদিকে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল এবং তাঁদের মধ্যেও সাময়িক উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে এও লিখেছেন যে সেসময় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে, স্বদেশি জিনিস ব্যবহারের পক্ষে মিছিল ও আন্দোলন চলছিল এবং তাঁরা কিছুটা সেদিকে ঝুঁকেছিলেন, কিন্তু বাড়ির নিষেধ থাকায় রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। তবে তাঁরা বিপ্লবীদের ছবি কেটে কেটে পড়ার ঘরে টাঙিয়ে রাখতেন। এক আত্মীয় পুলিশ অফিসার দেখে ফেলায় সেগুলোও পরে অপসৃত হয়েছিল এবং এতে তাঁদের মন খারাপ হয়েছিল।

আমরা “সুভাষচন্দ্রের ছাত্রজীবন” গ্রন্থ থেকে জানতে পারি যে, ১৯১১ সালের ১১ আগস্ট তারিখে র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র (বর্তমান নবম শ্রেণি) সুভাষচন্দ্র নিজ উদ্যোগে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির তৃতীয় বাৎসরিক স্মরণ দিবস উপযুক্ত ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালন করেছিলেন স্কুলে এবং র‍্যাভেন্শ কলেজ ও স্কুল হোস্টেলে। সুভাষচন্দ্রের প্রস্তাব মত সব ছাত্ররা উপবাস করে এই পূণ্য দিনটি অতিবাহিত করেছিল সেদিন। অবশ্য এর পরিণতি ভালো হলোনা; ডিভিশনাল কমিশনারের কাছে খবর পৌঁছে যায় আর ফলস্বরূপ ম্যাজিষ্ট্রেট এই বিষয়ে তদন্ত করে প্রধান শিক্ষক শ্রীবেণীমাধব দাসকে কটক থেকে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে বদলি করে দেয়।

র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই সুভাষচন্দ্র শিক্ষক শ্রীবেণীমাধব দাসের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্বের জন্য। তিনি প্রধান শিক্ষককে মনেপ্রাণে শ্রদ্ধা করতে শুরু করেন। যেহেতু বেণীমাধববাবু দ্বিতীয় শ্রেণির নীচে কোন ক্লাস নিতেন না তাই অধীর আগ্রহে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠার জন্য অপেক্ষায় থেকে যখন সেই সুযোগ সুভাষচন্দ্র পেলেন তখন তাঁর সে ভাগ্যও দীর্ঘস্থায়ী হলো না। তবে এই কয়েক মাসের মধ্যেই শ্রী বেণীমাধব দাস ছাত্র সুভাষের মধ্যে একটা নৈতিক মূল্যবোধ জাগিয়ে দিয়ে গেলেন।

এই বিচ্ছেদ সুভাষের জন্য খুব বেদনার হয়েছিল কিন্তু তাঁর সাথে বেণী মাধবাবুর চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রইল। সুভাষচন্দ্র আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, প্রকৃতিকে কিভাবে ভালবাসতে হয়, প্রকৃতির প্রভাবকে জীবনে কিভাবে গ্রহণ করতে হয় তা মাস্টারমশাই শ্রী বেণীমাধব দাসই তাঁকে শিখিয়েছিলেন। প্রকৃতি তো দেশমাতৃকারই অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ। কিন্তু মাস্টারমশাই যে তাঁকে স্বদেশপ্রেম শিখিয়েছেন তা অবশ্য স্পষ্ট করে সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেননি। হয়ত ১৯৩৮ সালে ছাপা বইতে তেমন কিছু কথা লিখে বেণীমাধব বাবুকে ইংরেজ-পুলিশের কুনজরে পড়তে দিতে চাননি।

বেণী মাধববাবুর বদলির কিছুদিন পর থেকেই সুভাষচন্দ্র বয়ঃসন্ধিজনিত কিছু মানসিক অশান্তিতে ভুগছিলেন। সৌভাগ্যবশতঃ ঠিক এই সময়ই তিনি কটক শহরে নবাগত এক আত্মীয়ের বাসায় অপ্রত্যাশিতভাবে স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলী পেয়ে যান এবং তা অতি উৎসাহে পড়ে ফেলেন। সুভাষচন্দ্র বুঝতে পারেন যে এই জিনিষই তিনি এতদিন ধরে খুঁজছিলেন এবং এগুলোর মধ্যেই তিনি তাঁর মানসিক অশান্তির সমাধান খুঁজে পেলেন। স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের আদর্শই সুভাষচন্দ্র হৃদয়ঙ্গম করে নিলেন, যার মূল কথাটা হল, “আত্মনঃ মোক্ষার্থম জগৎহিতায় চ” অর্থাৎ ‘মানবজাতির সেবা এবং আত্মার মুক্তি’।

মানবজাতির সেবা বলতে স্বামী বিবেকানন্দ স্বদেশের সেবাও বুঝিয়েছেন। স্বামীজীর প্রধান শিষ্যা এবং জীবনীকার ভগিনী নিবেদিতা আমাদের জানিয়েছেন যে, মাতৃভূমিই ছিল স্বামী বিবেকানন্দের আরাধ্যা দেবী। আত্মজীবনীতে সুভাষচন্দ্র আরও লিখেছেনঃ ‘একটি বক্তৃতায় স্বামীজী বলেছেন, “সদর্পে বল মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী, আমার ভাই।”

নেতাজী সুভাষচন্দ্র লিখেছেন যে তাঁর বয়স যখন ১৫ ছুঁই ছুঁই, ঠিক তখন বিবেকানন্দ তাঁর জীবনে প্রবেশ করলেন; বিবেকানন্দের প্রভাব তাঁর জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিল এবং তিনি স্বামী বিবেকানন্দের পথই বেছে নিলেন। বিবেকানন্দের সাথে সাথে তাঁর গুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রতিও সুভাষচন্দ্র আকৃষ্ট হলেন এবং কটকে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভক্তবৃন্দের একটা সংগঠন গড়ে তুললেন। সেই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল অধ্যাত্মচর্চা করা আর দুঃস্থের সেবা করা। স্কুল ছাড়ার সময় যত এগিয়ে আসছিল, সুভাষের মধ্যে ধর্মভাব আর মানবসেবা করার প্রবণতা ততই বেড়ে যাচ্ছিল। লেখাপড়ায় আর মন বসছিল না।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শিশু সুভাষ (দণ্ডায়মান, ডান থেকে প্রথম)

এরপর ১৯১২ সালের অক্টোবর মাসে মহাসপ্তমীর দিন কৃষ্ণনগর থেকে মাস্টারমশাই শ্রী বেণীমাধব দাসের পরিচয়পত্র নিয়ে হাজির হলেন সুভাষেরই সমবয়সী একই (ফার্স্ট) ক্লাসের ছাত্র শ্রী হেমন্তকুমার সরকার। হেমন্ত কলকাতার একটা রাজনৈতিক দলের সভ্য ছিলেন যাদেরও আদর্শ ছিল আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং দেশসেবা। সেই প্রথম সুভাষ ও তাঁর কটকের বন্ধুরা প্রথমবারের মত কলকাতার রাজনৈতিক প্রেরণার আস্বাদন পেলেন। হেমন্তের কাছে তাদের দলের নানাবিধ কাজের বর্ণনা শুনে সুভাষচন্দ্র মুগ্ধ হলেন।

হেমন্ত একদিন সুভাষের দলের ছেলেদের দেশের প্রতি তাদের কর্তব্য সম্বন্ধে অনুপ্রাণিত করে একটা আবেগময় বক্তৃতাও দিলেন। এইসঙ্গে সুভাষচন্দ্রের সাথে তাঁর নিবিড় সখ্যতাও গড়ে উঠল। চারদিন কটকে থেকে বিজয়া দশমীর সন্ধ্যায় হেমন্তকুমার পুরী চলে গেলেন এবং কলকাতায় ফিরে গিয়ে তাঁর দলের প্রধানকে সব জানালেন। সেই দলনেতা চিঠির মাধ্যমে কটকের এই দলটার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন এবং কয়েক বছর এই যোগাযোগ ছিল।

হেমন্তকুমার পরে তাঁকে লেখা সুভাষের বেশ কিছু চিঠি প্রকাশ করেন যার থেকে সুভাষচন্দ্র বসুর কৈশোরের এবং যৌবনের অনেক কথা জানা যায়। তিনি তাঁর বিখ্যাত “সুভাষের সঙ্গে বারো বছর (১৯১২ – ১৯২৪)” বইতে জানান যে, সুভাষের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময়ই তাঁদের মধ্যে স্থির হয়েছিল যে পাশ করে তাঁরা চাকরি করবেন না এবং সুভাষ আই-সি-এস আর হেমন্ত আই-ই-এস-এ ঢুকে সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে চাকরি-মোহগ্রস্ত বাঙালীর সামনে আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন।

১৯১৩ সালের ১ মার্চ সুভাষচন্দ্র আর হেমন্তদের ম্যাট্রিক পরীক্ষা শুরু হয়। দুজনেই তাঁদের এই নূতন বন্ধুত্বের আর নতুন জীবনের আলোড়নে পড়াশুনায় তেমন মন দিতে পারেন নি। সুভাষচন্দ্র তো তারও আগে থেকেই পড়াশুনায় অমনোযোগী হয়ে গিয়েছিলেন। তৎসত্ত্বেও সুভাষ ৭০০-র মধ্যে ৬০৯ নম্বর পেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। পরীক্ষার পর আগের পরিকল্পনা মত সুভাষচন্দ্র কিছুদিনের জন্য হেমন্তের কাছে কৃষ্ণনগরে যান।

কলকাতার দলের কয়েকজন সদস্যও সেখানে আসেন এবং তাঁরা সদলবলে পলাশী, মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি ঐতিহাসিক স্থানগুলি দেখতে বের হন। পলাশীতে তাঁরা দেখতে পান যে সেই আম্রকানন আর নেই আর লর্ড কার্জনের আদেশে বিজয় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। হেমন্ত নবীনচন্দ্র সেনের “পলাশীর যুদ্ধ” আবৃত্তি করতে করতে যখন নবাব সিরাজদৌল্লার সেনাপতি মোহনলালের মুখনিঃসৃত অংশে আসেন তখন সুভাষচন্দ্র আর চোখের জল চেপে রাখতে পারেন না। তাঁর দলের সেই ভ্রমণ সাতদিনে সমাপ্ত হয়েছিল।

এরপর সুভাষচন্দ্র কলকাতায় এসে তাঁর বড় দাদাদের মত প্রেসিডেন্সি কলেজে আই এ ক্লাসে ভর্তি হলেন ১৯১৩ সালের জুলাই মাসে। তখন তাঁর বয়স সাড়ে ষোল। ভর্তি হওয়ার সাথে সাথেই তিন মাসের গ্রীষ্মের বন্ধ হয়ে যায়। সেই তিন মাসে তিনি কলকাতার সেই দলটাকে খুঁজে বার করলেন আর পছন্দমত কিছু নতুন বন্ধুও জুটিয়ে ফেললেন। কটকের পরিবেশ আর কলকাতার পরিবেশে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

অবশ্য এর প্রায় বছর দেড়েক আগে স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার সমাপ্ত হয়েছে। বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছে তবে তার জন্য বঙ্গ প্রদেশকে (বাংলা প্রেসিডেন্সিকে) অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। হিন্দী-উড়িয়া-অসমীয়া-ভাষী অঞ্চলগুলোকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে আর ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। তবে এই স্বদেশী আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামকে এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং এজন্য সশস্ত্র বিপ্লব আন্দোলনের তৎপরতাও বৃদ্ধি পেয়েছিল।

সুভাষের আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে এসময় সুভাষচন্দ্র শ্রীঅরবিন্দের লেখা ও চিঠিপত্র পড়ে তাঁর প্রতিও আকৃষ্ট হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের কিছু ছাত্রদের মধ্যেও এই বিপ্লবী চিন্তাধারা সক্রিয় ছিল। কিন্তু সুভাষচন্দ্র কলকাতায় এসেছিলেন মানবসেবা আর আধ্যাত্মিক উন্নতির সঙ্কল্প নিয়ে, যদিও তাঁর মধ্যে বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতি ছিল এবং স্বদেশচিন্তা তাঁকে গভীরভাবে আলোড়িত করত। আত্মজীবনীতে সুভাষচন্দ্র লিখে গেছেন, ‘কলেজ-জীবনে প্রবেশ করবার সময় জীবন সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা জন্মে গিয়েছিল। বুঝেছিলাম যে জীবনের একটা উদ্দেশ্য আছে এবং এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য নিয়মিত শরীর ও মনের অনুশীলনের প্রয়োজন।’

এসময় তাঁর সাথে কয়েক মাস আগে প্রয়াত বিখ্যাত কবি, নাট্যকার, গীতিকার, স্বদেশী-সংগীতস্রষ্টা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপ কুমার রায়ের বন্ধুত্ব হয়। দিলীপ কুমার রায় সুভাষচন্দ্রের সমবয়সী ছিলেন এবং সেবছরই প্রেসিডেন্সি কলেজে আই-এস-সি ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁরা কাছাকাছিই থাকতেন। সুভাষ একদিন দিলীপকুমারের বাড়ীতে এসে দিলীপকুমারকে তাঁর উদ্যোগে কলেজে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিতর্কসভায় যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানান। সেই প্রথম পরিচয়ের বর্ণনা খুবই সুন্দর।

সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন যে, আমাদের দেশে তর্ক-বিতর্কের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে কারণ স্বাধীনতার জন্য বড় বড় বক্তার, বাক-যোদ্ধার খুব প্রয়োজন। শ্রী দিলীপকুমার রায় তাঁর “আমার বন্ধু সুভাষ” বইতে লিখেছেন যে তিনি বলেছিলেন, রামকৃষ্ণ তো বলে গেছেন তর্ক দিয়ে সত্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। সুভাষচন্দ্র উত্তরে বলেছিলেন, “তিনি কি বলেছিলেন তাতে আমাদের দরকার কি? ... আমাদের গড়ে তুলতে হবে ভবিষ্যৎকে। কেন, আপনার বাবা কি বলেননিঃ ‘চোখের সামনে ধরিয়া রাখিয়া অতীতের সেই মহা আদর্শ, জাগিব নূতন ভাবের রাজ্যে রচিব প্রেমের ভারতবর্ষ?” দিলীপকুমার আশ্চর্য হয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘তাঁর কবিতা আপনার মনে আছে?’ উত্তরে সুভাষের দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তিনি বলেছিলেন, “অন্তরে গাঁথা আছে।”

সুভাষের দলের সকলেই ব্রহ্মচর্যের ব্রত নিয়েছিলেন। দলের প্রধান লক্ষ্য ছিল ধর্ম আর জাতীয়তাবাদের সমন্বয় ঘটানো – শুধু চিন্তায় নয় কাজের মাধ্যমে। তাঁর দলের ছেলেরা নতুন নতুন ভাবধারার সন্ধানে দর্শন, ইতিহাস, জাতীয়তাবাদের উপর বই খুঁজে খুঁজে পড়তেন এবং নিজেদের মধ্যে তা আলোচনা করতেন। তাছাড়া নতুন সদস্য সংগ্রহ করতেন এবং নামকরা লোকদের সাথে আলাপ পরিচয় করতেন। এছাড়া সাধু-সন্তদের সন্ধানে থাকা এবং ছুটির সময় তীর্থস্থানে তাঁদের সন্ধান করাও একটা কাজ ছিল। ১৯১৩ সালে বড়দিনের ছুটিতে তাঁরা দলবেঁধে গিয়ে কলকাতা থেকে ৫০ মাইল দূরে শান্তিপুরে কিছুদিন গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী হয়ে বাস করেছিলেন। ১৯১৪ সালে তাঁরা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সাথেও দেখা করতে গিয়েছিলেন। বেলুড় রামকৃষ্ণ মঠ ও অন্যান্য জায়গায় প্রায়ই যেতেন। দক্ষিণ কলকাতার অনাথ ভাণ্ডার দরিদ্র সেবা প্রতিষ্ঠানের জন্য রবিবার বাড়ি বাড়ি ঘুরে অর্থ ও চালডালও সংগ্রহ করেছেন।

সেসময় কলেজে অধ্যাপকদের পড়ানো সুভাষচন্দ্রের একঘেয়ে লাগতো। এই একঘেয়েমি কাটানোর জন্য জনহিতকর কাজে মেতে থাকতেন। বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা, বন্যা বা দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য টাকা তোলা, সহপাঠীদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়া–এই ধরণের কাজ তাঁর ভালো লাগত। প্রথম বছরের কলেজের ছুটিতে কটক গিয়ে কাছের একটা গ্রামে কলেরা হওয়ায় সে গ্রামে রোগীর শুশ্রূষা করতেও যান। সেই এক সপ্তাহে তিনি দেশের দারিদ্র্য, মৃত্যুর তাণ্ডবলীলা আর নিরক্ষরতার অভিশাপ প্রত্যক্ষ করেন। কলকাতায় ফিরে এসে ষাট মাইল দূরে কৃষ্ণনগরে এক উদাসী পাঞ্জাবী শিখ তরুণ সাধুর সন্ধান পেয়ে হেমন্তকে নিয়ে পায়ই তাঁর কাছে যেতে শুরু করেন। সেই সন্ন্যাসীকে দেখে সুভাষের মনে দীক্ষা নেবার ইচ্ছা জাগে।

১৯১৪ সালের গরমের ছুটির সময় সুভাষচন্দ্র প্রায় দুমাস গুরু খুঁজতে উত্তর ভারতের প্রায় সবকটা তীর্থস্থান ঘুরে বেড়ান। বাড়িতে শুধু একটা পোস্টকার্ড পাঠিয়ে জানিয়েছিলেন মাত্র। এই তীর্থভ্রমণের সময় হিন্দু সমাজব্যবস্থার মূল গলদগুলি তাঁর কাছে ধরা পড়ে। অবশ্য অনেক প্রকৃত ধার্মিক সন্ন্যাসীরও দর্শন পান। সেখান থেকে ফিরে এসে কিছুদিনের মধ্যেই সুভাষচন্দ্র টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হন। সেবার তাঁর ৬৩ দিন জ্বর ছিল। জ্বর সেরে গেলে সুভাষচন্দ্র স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে কার্সিয়াং গিয়ে এক মাস থেকে আসেন। এরপর ১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসে হেমন্ত ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হন এবং সুভাষ কৃষ্ণনগরে গিয়ে বন্ধুর সেবা করেন। এসব গোলযোগে পড়াশুনার ব্যাঘাত হওয়ায় ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ফল ভাল হলনা। তবুও ১৯১৫ সালে তিনি ফার্স্ট ডিভিশনে আই এ পাশ করেছিলেন এবং দর্শনে অনার্স নিয়ে একই কলেজে বি এ ভর্তি হলেন।

কৈশোরে সুভাষচন্দ্র বসু

১৯১৬ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাস সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনে একটা তাৎপর্যপূর্ণ সময়। তখন তাঁর বয়স ১৯ বছর। ঘটনাটা সবার জানা। অনেকেই এই সম্বন্ধে বিস্তারিত লিখেছেন। তাই খুব সংক্ষেপে সেই ঘটনাটার বিবরণ দিয়ে এই লেখাটা শেষ করব। প্রেসিডেন্সি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন এডওয়ার্ড ফারলে ওটেন। এই ইংরাজ অধ্যাপক ছিলেন I.E.S. (ইন্ডিয়ান এডুকেশান সার্ভিসের সদস্য) এবং বর্ণবিদ্বেষী। তিনি ১৯১৫ সালে ইডেন হিন্দু হোস্টেলে আমন্ত্রিত হয়ে ভাষণ দেন এবং সেই বক্তৃতায় ভারতীয়দের সম্বন্ধে খারাপ মন্তব্য করেন। অসন্তুষ্ট হলেও তাঁকে সভাপতি করে ডেকে আনা হয়েছে বলে ছাত্রেরা সেদিন কোন গোলযোগ করেনি। কিন্তু ১০ জানুয়ারি ১৯১৬ তারিখে তিনি কয়েকজন ছাত্রকে কলেজের বারান্দায় ধাক্কা দেন।

ছেলেরা যেহেতু থার্ড ইয়ার অর্থাৎ বি এ ফার্স্ট ইয়ারের ছিল এবং সুভাষচন্দ্র সেই ক্লাসের প্রতিনিধি ছিলেন, তিনি অধ্যক্ষ মিঃ এইচ আর জেমসের কাছে গিয়ে প্রতিবাদ জানান। অধ্যক্ষ মিঃ জেমস জানান, যেহেতু অধ্যাপক ওটেন ইন্ডিয়ান এডুকেশান সার্ভিসের সদস্য তাই তিনি অধ্যাপক ওটেনকে শাসন করতে পারবেন না। পরদিন ছাত্ররা ধর্মঘট শুরু করে এবং ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিন কর্তৃপক্ষ ওটেনকে চাপ দিলে ওটেন ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলেন। কিন্তু প্রায় একমাস পর ওটেন একই কাজ করে ফেলেন।

যদিও সেবারের ছাত্রটি আই এ ফার্স্ট ইয়ারের ছিল, সুভাষচন্দ্র ছাত্র-প্রতিনিধিদের মিটিংয়ে জানান, এই অধ্যাপককে এভাবে শোধরানো যাবে না এবং তাকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে। ছাত্র-প্রতিনিধিদের সভায় তাঁর এই প্রস্তাব অনুমোদিত হয় এবং পরদিন, ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯১৬, মিঃ ওটেন কলেজের করিডোরে প্রহৃত হন। এই ঘটনার জন্য সুভাষচন্দ্র এবং শ্রী অনঙ্গ মোহন দাম কলেজ ও ইউনিভারসিটি থেকে বহিষ্কৃত হন। যদিও সুভাষচন্দ্র নিজে মিঃ ওটেনকে প্রহার করেননি, তিনি নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে চুপ করে থাকেন। সত্যি বলে দায়িত্ব এড়িয়ে বহিষ্কার এড়াতে রাজি হন না।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ছোটবেলায় প্রথমে তিনি ইংরেজি শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেছেন এবং ইংরেজদের সঙ্গে মিশেছেন। তারপর তিনি নিজের দেশের সংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচিত হন। যখন তিনি স্কুলে পড়েন তখন বিভিন্ন প্রদেশের ছেলেদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। মুসলমানদের সম্বন্ধে উদারতার জন্য তাঁর ছেলেবেলার অভিজ্ঞতাই বহুল পরিমাণে দায়ী। তাঁদের কটকের বাড়ী ছিল মুসলমান এলাকায় এবং প্রতিবেশীরা বেশীরভাগই ছিল মুসলমান। তাঁর বাবাকে সবাই খুব শ্রদ্ধা করতেন।

তাঁরাও মুসলমানদের উৎসব অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। তাঁদের বাড়ীর কাজের লোকেরা অনেকেই মুসলমান ছিলেন এবং তাঁরাও সুভাষচন্দ্রদের খুব অনুরক্ত ছিলেন। স্কুলে মুসলমান শিক্ষক আর ছাত্রদের সাথেও তাঁদের খুব সৌহার্দ্য ছিল। মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করা ছাড়া কোন ব্যাপারেই তিনি কোন প্রভেদ দেখতেন না। এই জন্যই আজাদ হিন্দ ফৌজে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিষ্টান-সব ধর্মাবলম্বীরা এক হয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পেরেছিল।

বাল্যকাল আর কৈশোর ছিল সুভাষচন্দ্রের প্রস্তুতির সময়। যে দেশপ্রেম তাঁর পরবর্তী জীবনে প্রস্ফুটিত হয়েছে, তার ব্যাপকতা, গভীরতা, বিস্তীর্ণটা ইত্যাদি বুঝতে হলে তাঁর বাল্যকাল আর কৈশোরকে ভাল করে জানতেই হবে। যারাই নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনী অধ্যয়ন করেছেন তাঁরাই একমত হবেন যে তিনি এই উপমহাদেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক।

পূর্বেই বলেছি, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মধ্যে কোন প্রাদেশিক, ধার্মিক বা জাতপাতের সঙ্কীর্ণতা ছিল না। তিনি মনে করতেন, ধর্ম যার যার নিজস্ব ব্যাপার। তিনি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে দেশের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন এবং তাঁর এই দেশপ্রেম কৈশোরেই অঙ্কুরিত হয়েছিল। এমনকি তিনি যে আই.সি.এস পাস করে তা থেকে পদত্যাগ করবেন তাও সেই কৈশোরেই স্থির করে ফেলেছিলেন। বালক-কিশোর সুভাষচন্দ্রই পরে নেতাজী হয়ে আমাদের দেশকে ইংরেজের হাত থেকে স্বাধীন করেছিলেন।

সেসময়কার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এ্যাটলি নিজমুখে একথা স্বীকার করে গেছেন। শুধু দুঃখের কথা এই যে কিছু স্বার্থান্বেষী নেতার জন্য যে অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন নেতাজী দেখেছিলেন, তা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। আজ এত বছর পর নেতাজীর আকাঙ্ক্ষিত বৃহত্তর ভারতের প্রয়োজনীয়তা কিছুটা হলেও আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। নেতাজীর জীবনযাপন, চিন্তাভাবনা, কার্যকলাপ সব একটি মাত্র আবেগ দ্বারাই সঞ্চালিত হয়েছে এবং তা হচ্ছে দেশপ্রেম।

অহিংসার পূজারি গান্ধীজী পর্যন্ত তাঁকে “Patriot of Patriots” আখ্যা দিতে বাধ্য হয়েছেন। নেতাজীর দেশপ্রেম নেলসন ম্যান্ডেলা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আরও অনেককে অনুপ্রাণিত করেছে। আজও ভারতবাসী এবং বাঙালী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর তুলনাহীন দেশপ্রেম থেকে অনুপ্রাণিত হন। যতদিন মানবজাতি থাকবে এবং দেশপ্রেম আলোচিত হবে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জনক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নাম পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হবে। জয়তু নেতাজী।।

লেখক: সাবেক কুটনীতিক ও ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু, নয়াদিল্লি; ভারত। ইমেল: [email protected]

;

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;