মানুষ একটি চতুষ্পদ জন্তু



প্রিন্স আশরাফ
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

ইদানীং শামসাদ আজাদের মনে হয় মানুষ একটি চতুষ্পদ জন্তু, চারিদিকে চোখকান খোলা রাখলেই তা টের পাওয়া যায়। জন্মগতভাবেই চারপেয়ে মানুষ জোর করে দুপেয়ে মানুষ হয়ে নিজেকে একটা ঝামেলাযুক্ত অবস্থানে নিয়ে গেছে। শামসাদ আজাদের এই চারপেয়ে অনূভূতি শুরু হয় সকালে পত্রিকা নিয়ে হাইকমোডে বসার পর থেকেই। পত্রিকার নৈর্ব্যক্তিক খবরগুলোর সাথে দীর্ঘদিনের কোষ্ঠকাঠিন্য মিলিয়ে তার মনে হয় চারপেয়ে জন্তু হলে তাকে এখন এই অদ্ভুত দুপেয়ে পজিশনে বসে পত্রিকা পড়তে পড়তে মলত্যাগের জন্য অপেক্ষা করতে হতো না, চারপেয়ে জন্তুরা শারীরিক গঠনগত কারণেই স্বাভাবিকভাবে মলত্যাগ করে, কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগে না।

দেশের সবচেয়ে নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুধুমাত্র ভিন্নমত প্রকাশের ধারণায় একটা তরতাজা প্রাণকে তারই সহপাঠী শিক্ষার্থীরা রাতভর নির্যাতন করে মেরে ফেলার ঘটনা পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় দেখে এবং পড়ে শামসাদ আজাদের না হওয়া মলত্যাগ বন্ধ হয়ে গেল। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বাবা চাচারাই পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশুর নাক, কান, লিঙ্গ কেটে সেই ধারালো অস্ত্র দুখানিই নৃশংসভাবে পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে শিশুটিকে গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছে। খুন, ধর্ষণ, নৃশংসতার অসংখ্য ঘটনাসহ মানুষের ভেতরের পশু প্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দেখলে শামসাদের নিজেকেও চতুষ্পদী জন্তু বলে মনে হতে থাকে।

শামসাদ আজাদ হাই কমোডের ওপর বসা অবস্থা থেকেই হামাগুড়ি দিয়ে বাথরুমের মেঝেতে দুহাত সামনের পায়ের মতো ব্যবহার করে যেন সেই সূদূর শৈশবে ফিরে গেলেন। বাথরুমের দরজা খোলাই থাকে তার, একা বাসায় বাথরুম লকের দরকার হয় না, তাছাড়া বাথরুম লক করলে তার সাফোকেশন হয়ে মগজের অক্সিজেন কমে যায়, এর আগেও তিনি মগজে অক্সিজেনের ঘাটতির কারণে বাথরুমে পড়ে দুদুবার মাথা ফাটিয়ে হাসপাতালে গেছেন। সেই কারণে কাজের ছেলের ওপর দায়িত্ব আছে যাতে তিনি বাথরুম লক না করেন। শামসাদ আজাদ খুব সহজে বাথরুমের ভেজানো দরজা টান দিয়ে খুলে ফেললেন। দুরুমের ফ্লাট বাড়িতে তাকে দেখভালের জন্য বছর ষোল সতেরোর মজনু মিয়া তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। মজনু মিয়া তখন সকালের সাহেবী ব্রেকফাস্ট পুরানো কাঠের ডাইনিং টেবিলে সাজানোতে ব্যস্ত থাকলেও মজনুর মন পড়েছিল মোবাইলের রিংটোনের শব্দের দিকে। এই সময় তার কয়েকটা মিসড কল আসবে, কয়েক বাসা পরের হাউজমেইড লাবণীর মোবাইল থেকে। শুধুমাত্র লাবণীর কারণেই সে এই আধবুড়োর বাসায় মুখ গুঁজে পড়ে আছে।

মোবাইলের রিংটোনের শব্দের জন্য উৎকীর্ণ থাকায় মজনু মিয়া বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেয়ে স্যার যে বেরিয়ে এসেছেন এটা বুঝতে পারলেও প্রথমে পাত্তা দিল না। কিন্তু যখন ডাইনিং থেকে বাথরুমের দিকে তাকিয়ে মানুষটাকে দেখতে পেল না তখন একটু অবাক হলো। মানুষটা শব্দ করে বাথরুমের দরজা খুলল অথচ নেই হয়ে গেল কিভাবে? তখনই ডাইনিং টেবিলের পায়ের কাছে মানুষের গলা শুনে মজনু মিয়া এরকম চমকাল যে তার হাতে থাকা জুসের গ্লাস থেকে ছলকে একটুখানি জুস ডাইনিং টেবিলের ওপর পড়ল।
‘মজনু, সকালের নাস্তা যা বানিয়েছিস ওসব ডিম মামলেট টামলেট সব অফ। আমি এখন শাকপাতা খাব।’
মজনু এমনিতেই স্যারকে চার হাতপায়ে এক বছরের বাচ্চার ভঙ্গিতে হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে দেখে এত হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল যে সে স্যারের কথা কিছু বুঝতে পারল না। শুধু বিড়বিড় করে বলল, ‘স্যার, শাকটাক কিছু কেনা নেই স্যার। বাজার করতে হবে।’
‘ওকে। ঠিক আছে। চারপেয়ে জন্তুরা যে শুধু ঘাসলতাপাতা খায় তা নয়, ওরা সব খায়। ঠিক আছে, তুই ডাইনিংয়ে যা খাবার দিয়েছিস তা আমার মুখের সামনে টেবিলের নিচে দে। এখানেই খাওয়ার কাজটা সেরে ফেলি। চারপাওয়ালারা ডাইনিং টেবিলে খায় না।’

শামসাদ আজাদ খাবারের লোভে মুখ থেকে কুকুরের মতো জিহবা বের করেই রাখলেন। মজনু কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। রান্নাঘরে মোবাইলের রিংটোন বেজেই চলেছে, কিন্তু মোবাইল ধরার মতো মনের অবস্থা এখন নেই। মজনু স্যারের দ্বিতীয়বার ধমক খেয়েই পাউরুটি, জেলি, ডিম মামলেট ও জুসের গ্লাস কাঁপা কাঁপা হাতে নিচে দিতে দিতে বলল, ‘স্যার, বাজার থেকে শাকপাতা কিনে নিয়ে আসি?’
শামসাদ আজাদ পাউরুটির ওপর লাগানো জেলি বিড়ালের মতো করে জিহবা দিয়ে একমনে চাটতে চাটতে মজনুর দিকে না তাকিয়েই বললেন, ‘যা, যা, শিগগিরই যা। টাটকা দেখে শাকসবজি নিয়ে আসবি। ফরমালিন দেওয়া ছ্যাতা পড়া না। চারপেয়েরা সব টাটকাই খায়, জানিস না?’

মজনু মিয়া মোবাইলটা হাতে নিয়ে এত দ্রুত ফ্লাটের বাইরে চলে এলো যে স্যারের কাছ থেকে বাজারের টাকাটা নিতেও ভুলে গেল। অন্য সময় এই বাজারের টাকা থেকেই তার দুপাইস ইনকাম হয়, তাতে হাতখরচ, মোবাইল খরচ উঠে আসে। এমনকি লাবণীর তিনটে মিসড কল দেখেও সে কলব্যাকের দিকে না গিয়ে সরাসরি খালাম্মার নাম্বারে ফোন দিল। খালাম্মাকে এরকম হুটহাট কল দেওয়ার কড়া নিষেধ আছে। স্যারকে ছেড়ে স্যারের বিপত্নীক বন্ধুর সাথে সংসার করায় যখন তখন কেউ খালাম্মাকে ফোন দিয়ে জ্বালায় না। বলা আছে, শুধুমাত্র ইর্মাজেন্সি বা অসুখ-বিসুখেই মজনু মিয়া ফোন করতে পারবে। মজনুর মনে হয় এরচেয়ে ইর্মাজেন্সি বোধ হয় হার্ট এ্যাটার্ক করলেও হয় না। খালাম্মা ওপাশে ফোন ধরতেই মজনু তোতলাতে তোতলাতে কোনমতে বলল, ‘খালাম্মা, স্যার কেমন জানি করতেসে!’

খালাম্মা আফরোজা তখন নতুন স্বামীর প্লেটে রাইস তুলে দিচ্ছিলেন, কিন্তু রাইসের চামচ প্লেটের ওপরে গিয়েই থেমে গেল। কানের কাছে ধরা মোবাইলে আতঙ্কিত গলায় বললেন, ‘কী হয়েছে? আবার বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথা ফাটিয়েছে?’
‘না খালাম্মা। কুকুর বেড়ালের মতো কেমন করে জানি চার হাতপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খাবারও খাচ্ছে জিব দিয়ে চেটে চেটে, কুকুর বেড়ালে যেরকম করে খায়। আমি খুব ভয় পাইছি খালাম্মা। আপনি একটু এসে দেখে যান।’

খালাম্মার স্বামী জাফর, যে শামসাদের ভূতপূর্ব বন্ধুও, খাওয়ার প্লেটে হাত গুটিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। স্ত্রীর ফোনে কথা বলা শেষ হলে বললেন, ‘শামসের কী হয়েছে? হার্ট এ্যার্টাক? স্ট্রোক? এক্সিডেন্ট?’
‘কী বলল মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারলাম না। বলল, ঘরজুড়ে নাকি হামাগুড়ি দিয়ে চারপেয়ে জন্তুর মতো হাঁটাহাঁটি করছে।’
‘নতুন কোনো ব্যায়াম ট্যায়াম?’ জাফর প্লেটেই হাত ধুয়ে উঠে পড়লেন। ‘আমার মনে হয় আমাদের এখুনি গিয়ে ব্যাপারটা কী দেখা উচিত?’
‘তোমার না আজ একটা ক্লায়েন্ট মিটিং ছিল?’ আফরোজারও খাওয়ার রুচি নেই, ডাইনিংয়ে খাবার ঢাকা দিতে দিতে বললেন।
‘বাদ দাও, অন্যরা সামলে নেবে। আগে শামসের কী হলো দেখা দরকার। তুমি তার প্রাক্তন স্ত্রী হলেও তার আগে ও আমার বন্ধু। চলো এখনি বেরিয়ে পড়ি।’ জাফর একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘তোমার ছেলেদেরও ব্যাপারটা জানানো দরকার। বাবার ব্যাপার।’
‘হুম।’ আফরোজা একটু গম্ভীর স্বরে বললেন। ‘জানাব। তার আগে চলো আমরাই গিয়ে দেখি ব্যাপারটা কী? না হলে ওদের জানাবটা কী? নিজেই যখন জানি না।’

জাফর নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে আফরোজাকে সাথে নিয়ে সারি সারি এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের শামসাদের এপার্টমেন্টের সামনে এসে দেখলেন মজনু মিয়া দরজার বাইরে পাংশু মুখে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনে মজনুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার? তুই এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’
‘ভেতরে যেতে ভয় করছে খালাম্মা।’ মজনু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল। আফরোজা দরজার দিকে এগিয়ে ধাক্কার দেওয়ার আগেই মজনু বলল, ‘সাবধানে ধাক্কা দেন। স্যার দরজার কাছে হামাগুড়ি দিয়ে থাকতে পারে।’
আফরোজা আর দরজা ধাক্কা দেওয়ার ঝামেলায় না গিয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে প্রাক্তন স্বামীর নাম ধরে ডাক দিলেন, ‘সামু, সামু?’ পাশ থেকে জাফরও গলা চড়ালেন, ‘শামস? শামস?’
ভেতর থেকে একবারে শান্ত গলা ভেসে এলো। ‘দরজা খোলাই আছে, ভেতরে আয়। মজনু মিয়া দরজা খুলে রেখে বাজার করতে গেছে। আমি আর দরজা লাগাতে পারছি না।’
দুজনে খুব সাবধানে দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেললেন। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের চোখ চোখের সমান্তরালে মানুষ খোঁজে। ওরাও সোজাসুজি তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলেন না। তখনই দরজার একপাশে হামাগুড়ি দেওয়া মানুষটাকে এবং তার কণ্ঠস্বরও শুনতে পেলেন। ‘চারপেয়ে হয়ে বেশ আছি। দুপায়ে দাঁড়াতেই এখন আমার বেশি কষ্ট হয়!’
জাফর একটু বিরক্ত স্বরেই বললেন, ‘তুই কি ওভাবেই হামাগুড়ি দিয়ে আমাদের সাথে কথা বলবি নাকি?’
আফরোজার চোখ ততক্ষণে ডাইনিংয়ের নিচের খাবারের প্লেট এবং ছড়ানো ছিটানো খাবার ও উচ্ছিষ্টগুলোর দিকে চলে গেছে। তিনি ভয়ে ভয়ে পেছনে ঢোকা মজনুর দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললেন, ‘এখান থেকে এগুলো সব পরিষ্কার কর। আমি দেখি ভেতরের ঘরে কোনো ঝামেলা পাকানো আছে কিনা?’ প্রাক্তন স্বামীর সামনে থেকে সরে যাওয়াই আফরোজার মূল উদ্দেশ্য।

জাফরের পায়ের কাছে হামাগুড়ি দিয়ে চলে আসা শামসাদ আজাদ খুব স্বাভাবিকস্বরে বললেন, ‘তুই আরাম করে সোফায় বস। আমি দুপায়ে দাঁড়িয়ে বসছি।’ তিনি দুপায়ে দাড়িয়ে জাফরের মুখোমুখি সোফায় বসতে বসতে বললেন, ‘দুপায়ে দাঁড়ানোটা প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজ। আমরা মানুষেরা সবসময় সেই কাজটাই করে যাচ্ছি। একারণেই প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তার ফলস্বরূপ এই মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি, হিংসা দ্বেষ। আজ সকালের পেপার দেখেছিস?’
‘হু। চোখ বুলিয়েছি। একটা মিটিং ছিল। মিস দিলাম।’
‘দেখিসনি একটা মেধাবী ছেলেকে কিভাবে তার হলের বন্ধুরা, বড়ভাইরা মিলে সারারাত ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। দুপেয়ে হয়েই এভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা সম্ভব হয়েছে। চারপেয়ে হলে হতো না। চারপেয়েরা প্রয়োজন ছাড়া কাউকে হত্যা করে না।’

জাফর একটু বিরক্ত হলেন। বন্ধুর মাথা আগে থেকেই একটু অন্যরকম ছিল, এখন আরো বেড়েছে মনে হয়, সে কারণেই তো আফরোজা এই শেষ বয়সে এসেও আর ওর ঘর করতে পারল না, অথচ দোষটা গিয়ে পড়ে তার ওপরে। যত্তসব। এখন ক্লায়েন্ট মিটিং বাদ দিয়ে এই পাগলের সাথে বসে দুপেয়ে চারপেয়ে পার্থক্য শুনছে। যত্তসব!

‘চারপেয়ের সবচেয়ে বড় সুবিধে কী জানিস? ব্যালেন্স! খুব চমৎকার ব্যালেন্স হয়। আমার মনে হয় এই ব্যালেন্স শুধু শারীরিক নয়, প্রাকৃতিকও। সবাই চারপেয়ে থাকলে প্রাকৃতিক ব্যালেন্স ঠিকঠাক থাকত। আমার তো মনে হয়, প্রকৃতির সব নিয়ম ঠিকঠাক মানলে আমরা সবাই আবার চারপেয়ে হয়ে যাব। আমাকে দিয়েই ধর না, আমি তো ধীরে ধীরে চারপায়ে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। আর এটা অভ্যস্ততার কি আছে? আমরা জন্মেছিলাম চারপেয়ে, জোর করে দুপেয়ে হয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করেছি। এখন প্রকৃতিই ভারসাম্য রাখতে আবার আমাদেরকে চারপেয়ে করতে চাচ্ছে। আমি প্রকৃতির সেই তাল রক্ষার চেষ্টা করছি।’ বলেই শামসাদ আবার সোফা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে নেমে গেলেন নিচে। জাফরের পায়ের কাছে এসে মুখ তুলে ফিসফিস করে বললেন, ‘আমরা সঙ্গমও করি চারপেয়ে তাই না? চতুষ্পদী জন্তুর মতো। হা হা হা!’

জাফরের অসহ্য লাগছিল। এখনো গাড়ি টেনে গেলে ক্লায়েন্ট মিটিংয়ে এটেন্ড করা যাবে। তাহলে বসে বসে এই পাগলের প্রলাপ শুনতে হবে না। ওর প্রাক্তন স্ত্রী শুনতে চাইলে শুনুক। ইচ্ছে করলে ওরা চারপেয়ে হয়ে সঙ্গমও করতে পারে, আগে তো অসংখ্যবার করেছে। যা ইচ্ছে তাই করুক। জাফর খোলা দরজা দিয়ে কাউকে কিছু না বলে গটগট করে বেরিয়ে গেলেন।

আফরোজা ভেতরের রুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখেন শামস হামাগুড়ি দিয়ে ঘরময় ছুটে বেড়াচ্ছে। জাফর বেরিয়ে গেছে। একটু যেন স্বস্তি পেলেন তিনি। যত যাই হোক, বর্তমান স্বামীর সামনে প্রাক্তন স্বামীকে নিয়ে আদিখ্যেতা দেখানো যায় না। আফরোজা নিজেও বসে প্রায় হামাগুড়ির ভঙ্গিমায় প্রাক্তন স্বামীর মুখোমুখি হয়ে গায়ে মাথায় কপালে হাত দিয়ে নরোম স্বরে বললেন, ‘তোমার শরীর তো ঠিকই আছে মনে হচ্ছে, তাহলে এরকম করছো কেন?’
শামস স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আহবানের স্বরে বললেন, ‘চারপেয়ে হওয়ার পরে আমি খুব ভালো আছি। তুমিও আমার মতো চারপেয়ে হয়ে দেখ শরীরে অদ্ভুত একটা ব্যালেন্স চলে আসবে। মনে হবে শরীরে কোনো রোগব্যাধি নেই, ছিলও না।’
‘না বাবা, আমি তোমার মতো ওরকম করতে পারব না। পুরুষ মানুষ যা পারে নারীরা তা পারে না।’
‘পারে, পারে। চারপেয়ে হয়ে গেলেই পারে। তখন এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, মান-অপমানবোধ, হিংসা-দ্বেষ, ঈর্ষা কোনো কিছুই আর মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়াতে পারে না। মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেই কেবল আমাদের মধ্যে হিংসা-দ্বেষও মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। এবং তখনই যত বিপত্তি ঘটতে থাকে। চারপেয়ে হয়ে গেলে তখন আর আমাদের মধ্যে এইসব মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে না। এবং এই ঘটনাগুলোও ঘটবে না। বন্ধুরা তখন পিটিয়ে বন্ধুদের মেরে ফেলবে না। এই ধরো, এখন আমি হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটছি, আমার মধ্যে কোনো রাগ ক্ষোভ নেই। জাফর যে আমার কাছ থেকে তোমাকে ফুসলিয়ে নিয়ে গেছে দুপেয়ে অবস্থায় থাকলে আমি ওকে কস্মিনকালেও আমার এই ঘরে ঢুকতে দিতাম না, কিন্তু চতুষ্পদী হয়ে ওর ওপরে আমার কোনো রাগ ক্ষোভ নেই। যেমন তোমার ওপরেও আমার কোনো মান অভিমান রাগ-ক্ষোভ-দ্বেষ কোনো কিছুই নেই। তোমাকে সহজেই ক্ষমা করে দিয়েছি। চারপেয়ে হলেই সবাইকে সহজে ক্ষমা করে দেওয়া যায়।’

আফরোজা কিছুই বললেন না। চুপ করে রইলেন। ওকে ছেড়ে যাওয়াটাই কি এই মস্তিষ্ক বিকৃতির কারণ? নাকি এগুলো আগেই ভেতরে চাপা দেওয়া ছিল, তিনি ছেড়ে চলে গেছেন বলেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে? ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে। তার আগে সামর্থ্যবান, আলাদা আলাদা এপার্টমেন্ট নিয়ে থাকা দুই সংসারী ছেলেকেও ব্যাপারটা জানাতে হবে। হাজার হোক তাদের বাবা তো!

আফরোজা শামসের গায়ে মুখে একটু হাত বুলাতেই শামস চতুষ্পদী জন্তুর মতো গরগর শব্দ করে আদর খেতে লাগলেন। আফরোজা একটু বিরক্ত হলেও মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বললেন, ‘তুমি কি সারাদিন এভাবেই থাকবে? সোজা হবে না?’
‘দেখি কতক্ষণ থাকা যায়। এভাবেই থাকতে ভালো লাগছে। এখন দুপেয়ে হতে গেলেই কষ্ট হয়।’
‘ঠিক আছে, তুমি থাকো এভাবে। আমি মজনু মিয়াকে সব বলে যাচ্ছি। ও তোমার খাবারদাবার যেভাবে চাও গুছিয়ে দেবে। শুনলাম তুমি শাকপাতা খেতে চেয়েছো। ওকে কিনতে পাঠিয়েছিলাম। এখন রান্না করতে বলেছি। আর তুমি তোমার মতো থাকো। ওকে ভয় দেখিয়ো না। বেচারা ভয়ে একদম শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। শোনো, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। এই কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরব। এরমধ্যে উল্টোপাল্টা কিছু করে বসো না যেন।’

এপার্টমেন্টের বাইরে বেরিয়ে আফরোজা একটু মুক্ত বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নিলেন। সামনে অনেকগুলো করণীয় কাজ। মানুষটা এভাবে উন্মত্ত হয়ে পড়লেও তাকে এই অবস্থায় ছেড়ে যাওয়া যায় না। প্রাক্তন স্বামী হলেও তার সন্তানের বাবা। তারচেয়ে বড় কথা, একজন সুস্থ মানুষকে খুব সহজেই ফেলে চলে যাওয়া যায়, একজন অসুস্থ মানুষকে ফেলে চলে যাওয়া যায় না। মানুষটা অসুস্থ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মানসিকভাবে অসুস্থ। সেই সাথে বয়সজনিত শারীরিক অসুস্থতাগুলোও বেড়েছে কিনা একটু দেখা দরকার। ব্লাড প্রেশারের ওঠানামা, ডায়াবেটিসের বেড়ে যাওয়া, মস্কিষ্কে অক্সিজেন সাপ্লাইজনিত যে সমস্যাটা ওর মাঝেমধ্যে দেখা দিত সেগুলোর চেকআপের জন্য একটা ক্লিনিকে নেওয়া দরকার। কিন্তু সেটা তিনি একা পারবেন না। ছেলেরা এসে বুঝিয়ে সুঝিয়ে যদি কোথাও নিয়ে যেতে পারে এবং মনে হয় কোনো একটা সাইকিয়াট্রিস্টের সাথেও এপয়েনমেন্ট করে রাখা দরকার। কিন্তু তার আগে দরকার ওর চারপেয়ে থেকে দুপেয়ে হওয়া। আফরোজার হঠাৎ মনে হয়, চারপেয়ে হওয়াটা খারাপ কিছু না। চতুষ্পদী জন্তু হলে এত এত অসুখ বিসুখ হয়তো দেখা দিত না!

বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার আসিফ একটা সাইটে কনস্ট্রাকশনের কাজ তদারকি করছিল। জেনারেটরের একটানা জোরালো ঘটরঘটর ইঞ্জিনের শব্দে ওপাশ থেকে মায়ের কথাবার্তা তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তবে আসিফ যেটুকু বুঝল মা এখন বাবার বাসায় আছে। বাবার কিছু একটা হয়েছে। তাকে তাড়াতাড়ি যেতে বলছে। শুধু এটুকু বুঝল, বাবা আর মানুষ নেই। চতুষ্পদ জন্তু হয়ে গেছে। মানুষের স্বভাবের সবচেয়ে বড় প্রবৃত্তি হলো দুবোর্ধ্যতা। সাইটে জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার আছে, কাজ চলছে ঠিকঠাকভাবে। সে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য ঘুরে এলে কিচ্ছু যাবে আসবে না, তবুও হয়তো সে মায়ের কাছ থেকে বাবার ব্লাড প্রেশার ট্রেশারের কথা শুনলে যেত না। মানুষের বয়স হয়ে গেলে অসুখ বিসুখ লেগেই থাকবে, এ তো স্বাভাবিকই। এজন্য নিজেদের কাজকর্ম বন্ধ করে বাবা মায়ের কাছে কে বসে থাকে? তাছাড়া তার স্ত্রী সোমা শ্বশুর-শাশুড়িকে সহ্যই করতে পারে না। আলাদা ভাড়া বাসা নিয়ে পৃথগন্ন হতে হয়েছে সোমার কারণেই। মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পরে তো সোমা এখন খোঁটা দেওয়ার নতুন সাবজেক্ট পেয়েছে। ফেসবুকে কোনো অফিসিয়াল মহিলার সাথে চ্যাট করতে দেখলেও মুখ ঝামটি দিয়ে বলে ওঠে, ‘যেমন মা তার পেটে আর কেমন পয়দা হবে। খানকির ঘরে নাঙই জন্মায়!’ বাবা চতুষ্পদ জন্তু হয়ে গেছে শুনে আসিফের আগ্রহটা বেড়ে উঠল, ব্যাপারটা কী সরেজমিনে দেখাই যাক, সিরিয়াস কিছু না হলে মা যে পরিস্থিতিতে বাবাকে ছেড়ে গেছে তাতে এখনো বাবার ওখানে যাওয়ারই কথা না। আসিফ সোমাকে কিছু না জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে জুনিয়রের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

ছোটছেলে ব্যাংকার সাকিব ব্যাংকের জটিল গাণিতিক হিসাব নিকেশ মেলাচ্ছিল। এখন ব্যাংকে রাশ আওয়ার। দম ফেলাবারও ফুসরত নেই। মায়ের কল দেখেও প্রথমে দুবার সে রিসিভ না করে সাইলেন্ট করে দিল। তিনবারের বার জরুরি কিছু ভেবেই রিসিভ করে গাণিতিক মাথায় মার দুর্বোধ্য কথা কিছুই বুঝতে পারল না। শুধু এটুকু বুঝল, বাবার কিছু একটা হয়েছে। এখনি যেতে হবে। বড়ভাইয়াও আসছে। বড়ভাইয়াও আসছে শুনে সাকিবের মাথার মধ্যে গাণিতিক হিসেব নিকেশ শুরু হয়ে গেল। তার মানে কি বাবার অন্তিম সময় উপস্থিত? তাই কি উইল টুইল করার জন্য এভাবে ডেকে পাঠাচ্ছে? না হলে যে বড় ভাইয়া কখনো বাবার সাথে দেখাও করতে যায় না, সে কেন আগ বাড়িয়ে যাবে? নিশ্চয়ই ধনসম্পত্তি লাভের কোনো ব্যাপার-স্যাপার আছে। এই সময় বাবার মুখের কাছে না থাকলে উইলে যদি ভাইয়াকে লায়ন শেয়ার দিয়ে বসে? বাবার তো কোনো মতিগতির ঠিক নেই!

ব্যাংকার সাকিব তাড়াতাড়ি আসিফ ভাইয়াকে ফোন দিয়ে জানাল, মা কল করেছিল, বাবার ব্যাপারে। অর্থাৎ সে ফোন দিয়ে ভাইয়াকে সাবধান করে দিতে চায় তুমি কিছু ধান্দাবাজি করার চেষ্টা করো না। আসিফও তাড়াতাড়ি বলল, ‘হ্যাঁ, আমাকেও কল করেছিল। আমি গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছি। তুই কই? ব্যাংকে আছিস। তাহলে তোকে লিফট দিয়ে নিয়ে যাই। আমি তোর ব্যাংকের সামনে দিয়েই যাব।’

সাকিব মনে মনে ভাইয়ার নতুন কেনা গাড়ির ফুটানি সহ্য করলেও গাড়িতে গেলে একসাথে যাওয়া যাবে এবং ভাইয়ার সাথে ব্যাপারটা কী তা নিয়ে কথা বলা যাবে ভেবেই রাজি হলো। আসিফ নিজেই ড্রাইভ করছিল। সাকিব ব্যাংকের সামনে থেকে আসিফের পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল, ‘ব্যাপারটা কী তুমি কি কিছু জানো ভাইয়া? আমি মায়ের কথা ঠিক বুঝতে পারিনি।’
‘আমিও না। বলল, বাবা নাকি কেমন করছে। চারপেয়েদের মতো চলাফেরার চেষ্টা করছে। বাবার কি মাথাটাতা খারাপ হয়ে গেল নাকি?’ দুভাই কোনো সিদ্ধান্তে না আসতে পারলেও এই নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করতে করতে কোন ডাক্তার দেখানো যায়, কার কোন পরিচিত ডাক্তার আছে সেইসব নিয়ে আলোচনা করতে করতেই পথ এগুতে লাগল। এমনকি মায়ের এই বয়সে বিয়ে নিয়ে দুভাই রসিকতা করতেও ছাড়ল না। মা বাবা অনেক সুখী মানুষ। কারণ তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। একজন পুরুষ মানুষের সব চাইতে বড় দুভার্গ্য হচ্ছে সুখী বিবাহিত জীবন, বিবাহবিচ্ছেদের যখন আর কোনো আশা ভরসাই নেই।

বাবার এপার্টমেন্টের দরজার সামনে কোনো ভিড় নেই দেখে দুভাই একটু অবাক হলো। একজন মানুষ গুরুতর অসুস্থ হলে কিছু না হোক আশপাশের দুচারজন মানুষ তো জড়ো হয়ে পরামর্শ দেয়। ব্যাপার কী? কলিংবেল চাপতেই মজনু মিয়াই ভেতর থেকে দরজা খুলে দিল, যেন ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। মজনু নিচু গলায় বলল, ‘আপনারা ওই ঘরে যান। স্যার ম্যাডাম ওই ঘরেই আছেন।’ কিন্তু তারা বেডরুমের দিকে রওনা দেওয়ার আগেই মা বেডরুম থেকে পায়ে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে আসতে থাকে এবং দুভাই অবাক হয়ে দেখে তাদের একসময়ের দাপুটে চাকুরিজীবী, বর্তমান রিটায়ারমেন্টে থাকা বাবা মায়ের পিছু পিছু আদুরে বেড়ালের মতো হামাগুড়ি দিয়ে চারহাতপায়ে হেঁটে এগিয়ে আসছে। দৃশ্যটা দেখে দুভাই এতটাই হতভম্ব হয়ে যায় যে তাদের মুখে রা কাড়ে না। মা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ডাইনিংয়ের চেয়ার টেনে দুই ভাইকে বসতে সাহায্য করেন।

মায়ের আঁচলের পেছন থেকে মুখ বের করে দিয়ে শামসাদ আজাদ কিছুটা লজ্জিত মুখে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জীবনে সব প্রাকটিস থাকা ভালো। আগে পরে তো মানুষকে চতুষ্পদীই হতে হবে। তাই আমি আগেভাগে হয়ে গেলাম। ঠিক করেছি না?’
পাগল না ঘাঁটানোর মতো ভয়ার্ত দুভাই একসাথে যন্ত্রচালিত রোবটের মতো মাথা একদিকে কাত করে হীরক রাজার দেশের সভাসদদের মতো ‘ঠিক, ঠিক, ঠিক’-এর সংকেত দেয়। তাই দেখে প্রফুল্ল মুখে শামসাদ আজাদ বলেন, ‘চারপেয়ে হয়ে গেছি দেখে তোর মা ভয় পেয়ে গেছে। আরেক ব্যাটা তো ভয়ে প্যান্টে প্রচ্ছাব করে দিয়ে তড়িঘড়ি আমার সামনে থেকে পালিয়ে গেছে। তা, তোমরা দুভাই আছো কেমন? সংসারে সব ঠিকঠাক চলছে তো?’
দুভাই আবারও হীরক রাজার সভাসদ। ‘ঠিক, ঠিক, ঠিক।’
‘যখনই দেখবা সংসারে কোনো কিছুর ঠিকঠাক নাই, তখনই আমার মতো চতুষ্পদী হয়ে যাবা, দেখবা সবই ঠিক হয়ে যাবে। চতুষ্পদীর কোনো ঝামেলা নাই।’
দুভাই যেন বাবার সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারলেই বাঁচে। বাবাকে একাকী ছেড়ে দুভাই-ই বউয়ের কথায় আলাদা নিজেদের সংসার পেতেছে, সেই সংসারে বাবার আশ্রয় হয়নি, এক ধরনের অপরাধবোধের তাড়নায় তাদের দুজনেরই মনে হতে থাকে হয়তো এই কারণেই বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, বাবা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন।

মজনু মিয়াকে চা-নাস্তার কথা এবং দুপুরে দুভাই মা সবাই যাতে লাঞ্চ করে যায় সে কথা বলে বাবা হামাগুড়ি দিয়েই আবার বেডরুমে ঢুকে যেতেই ওরা দুভাই হাফ ছেড়ে বাঁচল। ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে বলল, ‘মা, মজনু মিয়াকে আগে পানি খাওয়াতে বলো। যা ভয় পেয়েছে না!’ পানি পান করে দুভাই ধাতস্থ হয়ে পরবর্তী করণীয় কী করা যায় তাই ঠিক করতে বসল। দুভাই যখন মায়ের সাথে কথা বলে ডাক্তার, সাইকিয়াট্রিস্টের ব্যাপারে আলোচনা করছে তখনই আসিফের মোবাইল সোমার কল এলো। সোমাকে নিয়ে মায়ের ব্যাপারে কিছু তিক্ত ঘটনা আগে ঘটে গিয়েছিল বলে আসিফ কল রিসিভ করেই দরজা খুলে এপার্টমেন্টের বাইরে এসে চুপি চুপি গোটা ঘটনাটা সোমাকে জানাল। ধুরন্ধর স্বভাবের বিজনেসম্যানের কন্যা সোমা ওপাশ থেকে বলল, ‘এটা তো তোমাদের জন্য শাপেবর হলো। এই তো সুযোগ!’ আসিফ সোমার কথার মমার্থ ধরতে পারল না, তার শুধু মাথায় ভাসছিল বাবার মতো একজন মানুষের ছোট বাচ্চাদের মতো হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে তাদের দিকে আসার দৃশ্য। সে চাপা স্বরেই বলল, ‘তুমি কী বলছো বুঝতে পারছি না।’ ওপাশ থেকে বউয়ের উত্তেজিত কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘তুমি তো দুধের শিশু, কিছুই বোঝ না, দুদু খাও! শোন, বাবা চারপেয়ে জন্তুর মতো হাঁটছে মানে বাবা পাগল হয়ে গেছে। এখন এই সুযোগে বাবাকে ধরে বেঁধে পাগলা গারদে পাঠিয়ে দাও। প্রয়োজনে টাকা পয়সা দিয়ে পাগলের ডাক্তারদের হাত করো। তারপর পাগল বাবার সব সম্পত্তির পাওয়ার অব এর্টনি হয়ে তোমরা দুভাই ভোগ দখল করো। তুমি তো মাথামোটা ঠিক বুঝবে না ব্যাপারটা। তোমার ব্যাংকার ভাইকে এই কথাগুলো বলো। সে হিসেব নিকেশের মানুষ। সহজেই বুঝে ফেলবে।’ আসিফ ইতস্তত করে বলল, ‘মাকেও কি বলব?’ ওপাশ থেকে খেকানো গলা, ‘সে মাগিও দরদ দেখাতে এখানে চলে এসেছে নাকি? ছেড়ে যাওয়ার সময় এত দরদ ছিল কই?’ আসিফ বুঝল সোমার সাথে আর কথা বাড়ানো ঠিক হবে না। সে ‘মা ডাকছে,’ বলে সোমার কল কেটে দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে মুখ বাড়িয়ে চাপা স্বরে সাকিবকে বাইরে ডেকে নিল। তারপর সোমার বলা কথাগুলোই আবার পুনরাবৃত্তি করল। কথাগুলো শুনতে শুনতেই সাকিবের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এই ব্যাপারটা তো তার মাথায়ই ঢোকেনি। ভাবী একটা জিনিয়াস! সে ফিসফিস করে বলল, ‘মাকে এসব ব্যাপারে কিছু জানানোর দরকার নেই। সব আমরা দুজনেই করব। তার আগে মাকে এখান থেকে বিদায় করতে হবে। বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেলেও বাবার উপরে টান যে আছে তা তো দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আর এই টান থাকলে মা আমাদের কাজ হাসিল করতে দেবে না।’

দুভাই পরিকল্পনা গুছিয়ে বাসার ভেতরে ঢোকে। মাকে পরামর্শ দেয়, ‘মা, আমরা ডাক্তার, সাইকিয়াট্রিস্ট সব ব্যবস্থা করছি। কিন্তু আমাদের মনে হয় বাবার আর তোমার সম্পর্কের ব্যাপারটা তুমি সামনে থাকলে আপনাতেই চলে আসবে। তাতে তুমিও বিব্রতবোধ করবে, এদিকে বাবারও সুস্থ হতে সময় লাগবে। তারচেয়ে ভালো হয়, আমি গাড়ি চালিয়ে তোমাকে তোমার বাসায় দিয়ে আসি। তারপর বাবাকে এ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে হাসপাতাল ডাক্তার, টেস্ট সব করিয়ে নেব। তোমাকে ফোনে সব খবরাখবর জানাব।’

ছেলেদের কথার উপর কথা চলে না বিবেচনা করেই মা বাবার সাথে বিদায় নেওয়ার জন্য বেডরুমে দেখা করতে গেলেন। বাবা বিছানার নিচে মেঝেতে দুপায়ের ওপর বসে দুহাতে থাবা মেলে ছিলেন। মাকে রুমের ভেতর আসতে দেখে বিব্রত স্বরে বললেন, ‘বয়স হয়ে গেছে। একটানা বেশিক্ষণ চললে ফিরলে ক্লান্ত লাগে। তাও চতুষ্পদী হয়ে ক্লান্তি কম লাগছে। চুতষ্পদীর সুবিধে কি জানো? স্পিড।’
মা ছলছল চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ছেলেরা তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। ওদের কথা শুনে ডাক্তার দেখাও। তোমার একটু থরো চেক-আপ দরকার। ওদের কথা শুনো। পাগলামী করো না। আর আমি মাঝে মধ্যে এসে তোমাকে দেখে যাব।’
স্ত্রীর মমতা দেখে বাবারও মন দ্রবীভূত হয়ে গেল। তিনি ভেজা ভেজা কণ্ঠে বললেন, ‘তোমার যখন মন টন খারাপ হবে তখন রুমের মধ্যে চারপেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে দেখো। মন ভালো হয়ে যাবে। একবার চতুষ্পদী জন্তু হতে পারলে বাঁচোয়া। মনটন খারাপের তখন আর কোনো বালাই নেই।’
আফরোজার মনটা এতটাই খারাপ হলো তিনি আর প্রাক্তন স্বামীর সামনে দাঁড়াতে পারলেন না। মজনু মিয়াকে সব দেখভালের কথা বলে পার্স থেকে একশ টাকা বের করে মজনু হাতে গুঁজে দিয়ে বড় ছেলের সাথে গাড়িতে বেরিয়ে পড়লেন।

এই সময়ে সাকিব অনেকগুলো কাজ গুছিয়ে আনল। তার মধ্যে প্রধান কাজ একজন মানসিক রোগের ডাক্তারকে বাসায় এপয়নমেন্ট দিয়ে আনা এবং তার সাজেশন মতোই প্রথমে মানসিক হাসপাতালে এবং সেখান থেকে যাতে পাগলা গারদে পাঠানো যায় সেই ব্যবস্থা করার জন্য উপযুক্ত অর্থ ঢালার প্রতিশ্রুতিও দিল।

চতুষ্পদী জন্তুও খায়, ঘুমায়, রেচনক্রিয়া করে। শামসাদ আজাদও দুপুরে ডাইনিং টেবিলের নিচে বসে হামাগুড়ি দেওয়া অবস্থায় খাবারের প্লেটের ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে, জিহবা দিয়ে চেটেপুটে দুপুরের খাবার খাওয়া শেষ করলেন। ছোটছেলে সাকিব যে পুরো খাওয়ার দৃশ্যটাই ডাইনিং টেবিলের আড়ালে দাঁড়িয়ে উপর থেকে মোবাইলে ভিডিও করে নিয়েছে তা চতুষ্পদী হয়ে মাথা নিচু হয়ে থাকায় শামসাদ আজাদের চোখে পড়েনি। এই ভিডিওটাই বাবার পাগল হয়ে যাওয়ার জন্য জোরালো সাক্ষ্য প্রমাণ হিসাবে কাজ দেবে। দৃশ্য মুখের কথার চেয়ে অনেক শক্তিশালী।

শামসাদ আজাদ নিজের মতো করে খেয়ে, ছেলেকে খেয়ে নিতে বললে সাকিব, ‘ভাইয়া এলে একসাথে খাব, তুমি ঘুমিয়ে যাও’ বলল। কারণ সে জানে বাবা কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে যাবে, মানসিক ডাক্তারের পরামর্শে রোগী যাতে ভায়োলেন্ট না হয়ে যায় সেজন্য ডাক্তারের প্রেসক্রাইব করা ঘুমের ওষুধ মজনু মিয়ার মাধ্যমে বাবার খাবারের সাথে মিশিয়ে দিয়ে রেখেছিল সাকিব।

ঘুম থেকে উঠে শামসাদ আজাদ খুবই অবাক হলেন, এমনকি তার চতুষ্পদী হয়ে যাওয়ার কথাও কিছুই মনে রইল না। তিনি অন্ধকারে ঘরে চোখ সয়ে আসা আলোয় দেখতে পেলেন তার গলায় একটা চামড়ার মোটা বেল্ট। সেই বেল্টের সাথে একটা শিকল জাতীয় কিছু আটকানো এবং সেই শিকলের শেষ মাথা একটা খাঁচার সাথে বাঁধা। তিনি শিকল ধরে টান দিতেই ঝনঝন শব্দে চারিদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে গেল। আর সাথে সাথে গোটা কক্ষ উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠল। এবং সেই উজ্জ্বল আলোতে তিনি দেখতে পেলেন তিনি একটা সাদাটে রঙের দেয়াল ঘেরা কক্ষের মধ্যে আছেন, যে কক্ষে কোনো জানালা নেই, শুধু একটা বন্ধ দরজা এবং সেই কক্ষের মধ্যে একটা মজবুত লোহার খাঁচা, হিংস্র চতুষ্পদী জন্তুকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরের সময় সর্তকতার সাথে যে খাঁচা ব্যবহার করা হয়। তিনি দুহাতে গলার শিকল আকড়ে ধরে জোরে জোরে ঝাঁকি দিয়ে ঝনঝন আওয়াজ তুলতেই কক্ষের দরজা খুলে সাদা এপ্রন পরা দশাসই একজন হাতে একটা লোহার ডাণ্ডি উঁচিয়ে ভেতরে ঢুকেই লোহার খাঁচার ওপর বারকয়েক আঘাত করে হিসহিস করে বলল, ‘কোনো শব্দ হবে না। চতুষ্পদী জন্তুরা অযথা শব্দ করে না।’

শামসাদ আজাদ ভয় পেয়ে চুপ করে গেলেন। হাতের ধরে রাখা শিকলটা ছেড়ে দিয়ে খাঁচার এককোণে ভয় পাওয়া চতুষ্পদী জন্তুর মতো হাতপা গুটিয়ে বসে রইলেন। শামসাদের ভয় পাওয়া দেখে বিকৃত স্বরে হেসে উঠল এপ্রনপরা লাঠিধারী। তারপর মুখে ক্রুর হাসি ধরে রেখে বিকৃত ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে আদেশ দিল, ‘বল, আমার সাথে বল, মানুষ একটি চতুষ্পদী জন্তু। মানুষ একটি চতুষ্পদী জন্তু। মানুষ একটি চতুষ্পদী জন্তু।’
শামসাদ আজাদ কিছুই বললেন না। কারণ তিনি জানেন, চতুষ্পদী জন্তুরা কথা বলতে পারে না।

   

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরীকে এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসাকে রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪-এ ভূষিত করেছে।

অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানাকে নজরুল পুরস্কার ২০২৪-এ ভূষিত করেছে।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;

চতুর ঘুঘু



শরীফুল আলম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

নেশাখোরের মত কখনো কখনো খিলখিল করে হাসি
প্রথমত দহন উষ্ণতায় ,
তারপর সুবিশাল শূন্যতায় ,
কখনো কখনো ছুঁয়ে ফেলি সাজানো প্রতিমা
জীবনের দাবী ,
তবে আপাতত গন্তব্য বলে কিছু নেই আমার
কবিতার অবয়ব এখনো যেটুকু আছে
তাকে আমি রঙ্গের উৎসবই বলি
কিম্বা যেটুকু আছে তা জীবনের দাবী ।

ক্রমাগত অন্তর্গত দ্বন্দে
অবাধ্য ভাষা এখন প্রাচীর তোলে
প্রসারিত মৃত্যুর কথা বলে ,
আমি তার গল্পের শেষটা জানার চেষ্টা করি
রাতের গহ্বর থেকে তোলে আনি মৃত্যুর পরোয়ানা ,
কিন্তু অস্পষ্টতা কিছু থেকেই যায়
আবার নিজে নিজেই বলি
আমার জলভূমিতে আবার কিসের নিঃসঙ্গতা ?

স্বপ্নবাসর ? সে এক চতুর ঘুঘু
আমি তার ক্ষণিকের হটকারীতা বুঝতে পারি
এমনকি চোখ বুজে
আমি ভুলে যাই তার সন্ধ্যার ঘায়েল
যেন দেখেও দেখিনা
বিনা মোহে সারারাত অহেতুক তার অহংকার
নিরর্থক বাজি ধরে সে
অর্কিড নিরালায় আমিও একা থাকি
ভাঙ্গা চোরা রাত জেগে থাকে আমার পাশে
মনে হয় চোখ দিয়ে ছুঁয়ে দেখি তার ঢাকাঢাকি
ফিরতি নজরে সেও আমায় দেখে
আমার মিষ্টি কবিতার মতই
আমিও থমকে যাই পাখীর ডাকে
দূর দরিয়ায় তখন উলুধ্বনি শংখ বাজে ,
ইচ্ছে হয় নাগরদোলায় আবার গিয়ে দুলি
আর জানই তো কবিরাই প্রেমে পড়ে
কবিরাও চুমু খায়
সুন্দরী পেলে তাঁরাও শুয়ে পরে।

*************************
শরীফুল আলম ।
২১এপ্রিল । ২০২৪ইং
নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।

;

শিশু সুভাষচন্দ্রের চেতনায় স্বদেশপ্রেমের উন্মেষ যেভাবে



উৎপল আইচ
-নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ছবি: সংগৃহীত

-নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে আমরা প্রায় সকলেই বৃহত্তর ভারতবর্ষের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক বলে মানি এবং শ্রদ্ধা করি। তাঁর তুলনাহীন দেশপ্রেমের সামগ্রিক পর্যালোচনা শুধু একটা নাতিদীর্ঘ রচনার পরিসরে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। তাই বালক-কিশোর সুভাষচন্দ্রের জীবনে দেশাত্মবোধের অঙ্কুরোদয় আর তার উন্মেষই এই রচনার উপজীব্য থাকলো।

১৯০২ সালের জানুয়ারি মাসে ৫ বছর বয়স থেকে ১৯০৮ সালের ডিসেম্বর মাস অবধি, অর্থাৎ প্রায় ১২ বছর বয়স অবধি, দীর্ঘ ৭ বছর, সুভাষচন্দ্র ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত কটকের প্রটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান স্কুলে পড়াশুনা করেন। বিলিতি আদর্শে নিয়ন্ত্রিত এই স্কুলের বেশির ভাগ ছাত্রই ছিল ইউরোপীয় কিংবা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। যদিও এই স্কুলে খুব ভালো ইংরেজি শেখানো হতো, আসল প্রচেষ্টা ছিল ছাত্রদের মনেপ্রাণে ইংরেজ করে গড়ে তোলার। তাই বাইবেলের উপর খুব জোর দেওয়া হত। তাছাড়া গ্রেটবৃটেনের ইতিহাস ও ভূগোল, ল্যাটিন ইত্যাদি শেখানো হতো। সেই স্কুলে সংস্কৃত বা অন্য কোন ভারতীয় ভাষা শেখাবার প্রশ্নই উঠে না। তবে পড়াশুনার সাথে সাথে স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিয়মানুবর্তিতা এবং ভদ্র-ব্যবহারকে শিক্ষার বড় অঙ্গ বলে মনে করতেন।

এই স্কুলে প্রবেশের কয়েক বছর পরই বালক সুভাষচন্দ্র বঙ্গভঙ্গ-জনিত দেশের রাজনৈতিক নবজাগরণের ব্যাপারটা বুঝতে শিখেছিলেন। প্রথম দিকে না বুঝতে পারলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটাও অনুভব করতে পারলেন যে তাঁদের বাড়ির বা তাঁদের সমাজের জীবন আর স্কুলের জীবন একদম ভিন্ন ধরণের। সুভাষচন্দ্র এও জানলেন যে ভারতীয়রা পরীক্ষায় সর্বোচ্চ স্থানাধিকারী হলেও শুধুমাত্র ভারতীয় বলে স্কলারশিপ-পরীক্ষা দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তাছাড়া, ইউরোপীয় এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছেলেরাই ভলান্টিয়ার কোর-এ যোগ দিতে পারে, বন্দুক ব্যবহার করা শিখতে পারে যা ভারতীয় ছাত্রদের জন্য নিষিদ্ধ।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ‘অ্যান ইন্ডিয়ান পিলগ্রিম’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এইসব ছোটোখাটো ব্যাপার থেকেই আমাদের চোখ খুলতে শুরু হল, বুঝলাম যে এক বিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় হিসাবে আমরা কতটা আলাদা’ (“Small incidents like these began to open our eyes to the fact that as Indians we were a class apart, though we belonged to the same institution.”) । সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীর শুরুতেই লিখেছেন যে তাঁর মন স্পর্শকাতর এবং তিনি একজন অন্তর্মুখী ব্যক্তি। (“I was and still remain an introvert.”) সুভাষচন্দ্র সেই আত্মজীবনী অসুস্থ অবস্থায় ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে দশদিনে অস্ট্রিয়ার ব্যাডগাসটেন-এ অবস্থানকালে লিখেছিলেন। তিনি সেখানে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য গিয়েছিলেন।

আত্মজীবনীতে তিনি আরও লিখেছেন, “সব কিছু বিচার করে আমি এখন একজন ভারতীয় বালক বা বালিকাকে এরকম স্কুলে পাঠাবো না। সে নিশ্চিত সুসমন্বয়ের অভাবে এবং তজ্জনিত অশান্তিতে ভুগবে, বিশেষতঃ সে যদি স্পর্শকাতর স্বভাবের হয়। (“Considering everything, I should not send an Indian boy or girl to such a school now. The child will certainly suffer from a sense of mal-adaptation and from consequent unhappiness, especially if he or she is of a sensitive nature.”)

১৯০৯ সালের জানুয়ারি মাসে সুভাষচন্দ্র কটকের র‍্যাভেন্-শ কলেজিয়েট স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে (এখনকার হিসাবে সপ্তম শ্রেণিতে) ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি চার বছর পড়াশুনা করে ১৯১৩ সালের মার্চ মাসে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। সুভাষচন্দ্র বসু যখন র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন তখন সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রী বেণীমাধব দাস। সুভাষচন্দ্রের বয়স তখন ১২ বছর। কিশোর সুভাষ তার আগে এক বর্ণও বাঙলা পড়েননি। এদিকে তাঁর সহপাঠীরা সবাই বাঙলায় পারদর্শী ছিল। কিন্তু চরম অধ্যবসায়ী সুভাষ এক বছরের মধ্যেই বাঙলাটা রপ্ত করে ফেলেন। সংস্কৃতের ব্যাপারও একই কথা বলা যায়। এই নতুন স্কুলে তাঁর বন্ধুও জুটে যায় যেটা প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান স্কুলে হয়নি।

সুভাষচন্দ্র ছিলেন নিরহংকারী এবং প্রচারবিমুখ মহাপুরুষ, তাই অনেক কথা বিস্তারিতভাবে আত্মজীবনীতে লেখেননি বা হয়তো আত্মপ্রশংসা হবে মনে করে এড়িয়ে গেছেন। র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে তাঁর বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী ছিলেন শ্রী চারুচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি সুভাষচন্দ্রদের প্রতিবেশীও ছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য যে চারুচন্দ্র তাঁর স্মৃতি রোমন্থন করে শ্রী সুবোধচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়ে “সুভাষচন্দ্রের ছাত্রজীবন” নামে একটা বই লিখে গেছেন। তাঁর কাছ থেকে আরো অনেক তথ্য জানা যায়। এছাড়া অন্যান্য সূত্র থেকেও কিছু নতুন তথ্য জানা যায় এবং কিছু তথ্যের সমর্থন মেলে।

প্রথম ভর্তি হবার দিন সুভাষচন্দ্র কোট-প্যান্ট পরে র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে গিয়ে দেখতে পান যে সমস্ত শিক্ষক এবং অন্যান্য সব ছাত্ররা দেশীয় পোশাক পরে আছেন। তার পরদিন থেকে তিনিও ধুতি-পাজ্ঞাবি পরে স্কুলে যেতে শুরু করেন। সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে ক্ষুদিরাম বসুর নাম উল্লেখ না করে লিখেছেন যে ১৯০৮ সালে যখন প্রথম বোমা নিক্ষেপ করা হয় তখন চারদিকে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল এবং তাঁদের মধ্যেও সাময়িক উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে এও লিখেছেন যে সেসময় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে, স্বদেশি জিনিস ব্যবহারের পক্ষে মিছিল ও আন্দোলন চলছিল এবং তাঁরা কিছুটা সেদিকে ঝুঁকেছিলেন, কিন্তু বাড়ির নিষেধ থাকায় রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। তবে তাঁরা বিপ্লবীদের ছবি কেটে কেটে পড়ার ঘরে টাঙিয়ে রাখতেন। এক আত্মীয় পুলিশ অফিসার দেখে ফেলায় সেগুলোও পরে অপসৃত হয়েছিল এবং এতে তাঁদের মন খারাপ হয়েছিল।

আমরা “সুভাষচন্দ্রের ছাত্রজীবন” গ্রন্থ থেকে জানতে পারি যে, ১৯১১ সালের ১১ আগস্ট তারিখে র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র (বর্তমান নবম শ্রেণি) সুভাষচন্দ্র নিজ উদ্যোগে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির তৃতীয় বাৎসরিক স্মরণ দিবস উপযুক্ত ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালন করেছিলেন স্কুলে এবং র‍্যাভেন্শ কলেজ ও স্কুল হোস্টেলে। সুভাষচন্দ্রের প্রস্তাব মত সব ছাত্ররা উপবাস করে এই পূণ্য দিনটি অতিবাহিত করেছিল সেদিন। অবশ্য এর পরিণতি ভালো হলোনা; ডিভিশনাল কমিশনারের কাছে খবর পৌঁছে যায় আর ফলস্বরূপ ম্যাজিষ্ট্রেট এই বিষয়ে তদন্ত করে প্রধান শিক্ষক শ্রীবেণীমাধব দাসকে কটক থেকে কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে বদলি করে দেয়।

র‍্যাভেন্শ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই সুভাষচন্দ্র শিক্ষক শ্রীবেণীমাধব দাসের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্বের জন্য। তিনি প্রধান শিক্ষককে মনেপ্রাণে শ্রদ্ধা করতে শুরু করেন। যেহেতু বেণীমাধববাবু দ্বিতীয় শ্রেণির নীচে কোন ক্লাস নিতেন না তাই অধীর আগ্রহে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠার জন্য অপেক্ষায় থেকে যখন সেই সুযোগ সুভাষচন্দ্র পেলেন তখন তাঁর সে ভাগ্যও দীর্ঘস্থায়ী হলো না। তবে এই কয়েক মাসের মধ্যেই শ্রী বেণীমাধব দাস ছাত্র সুভাষের মধ্যে একটা নৈতিক মূল্যবোধ জাগিয়ে দিয়ে গেলেন।

এই বিচ্ছেদ সুভাষের জন্য খুব বেদনার হয়েছিল কিন্তু তাঁর সাথে বেণী মাধবাবুর চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রইল। সুভাষচন্দ্র আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, প্রকৃতিকে কিভাবে ভালবাসতে হয়, প্রকৃতির প্রভাবকে জীবনে কিভাবে গ্রহণ করতে হয় তা মাস্টারমশাই শ্রী বেণীমাধব দাসই তাঁকে শিখিয়েছিলেন। প্রকৃতি তো দেশমাতৃকারই অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ। কিন্তু মাস্টারমশাই যে তাঁকে স্বদেশপ্রেম শিখিয়েছেন তা অবশ্য স্পষ্ট করে সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেননি। হয়ত ১৯৩৮ সালে ছাপা বইতে তেমন কিছু কথা লিখে বেণীমাধব বাবুকে ইংরেজ-পুলিশের কুনজরে পড়তে দিতে চাননি।

বেণী মাধববাবুর বদলির কিছুদিন পর থেকেই সুভাষচন্দ্র বয়ঃসন্ধিজনিত কিছু মানসিক অশান্তিতে ভুগছিলেন। সৌভাগ্যবশতঃ ঠিক এই সময়ই তিনি কটক শহরে নবাগত এক আত্মীয়ের বাসায় অপ্রত্যাশিতভাবে স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলী পেয়ে যান এবং তা অতি উৎসাহে পড়ে ফেলেন। সুভাষচন্দ্র বুঝতে পারেন যে এই জিনিষই তিনি এতদিন ধরে খুঁজছিলেন এবং এগুলোর মধ্যেই তিনি তাঁর মানসিক অশান্তির সমাধান খুঁজে পেলেন। স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের আদর্শই সুভাষচন্দ্র হৃদয়ঙ্গম করে নিলেন, যার মূল কথাটা হল, “আত্মনঃ মোক্ষার্থম জগৎহিতায় চ” অর্থাৎ ‘মানবজাতির সেবা এবং আত্মার মুক্তি’।

মানবজাতির সেবা বলতে স্বামী বিবেকানন্দ স্বদেশের সেবাও বুঝিয়েছেন। স্বামীজীর প্রধান শিষ্যা এবং জীবনীকার ভগিনী নিবেদিতা আমাদের জানিয়েছেন যে, মাতৃভূমিই ছিল স্বামী বিবেকানন্দের আরাধ্যা দেবী। আত্মজীবনীতে সুভাষচন্দ্র আরও লিখেছেনঃ ‘একটি বক্তৃতায় স্বামীজী বলেছেন, “সদর্পে বল মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী, আমার ভাই।”

নেতাজী সুভাষচন্দ্র লিখেছেন যে তাঁর বয়স যখন ১৫ ছুঁই ছুঁই, ঠিক তখন বিবেকানন্দ তাঁর জীবনে প্রবেশ করলেন; বিবেকানন্দের প্রভাব তাঁর জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিল এবং তিনি স্বামী বিবেকানন্দের পথই বেছে নিলেন। বিবেকানন্দের সাথে সাথে তাঁর গুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রতিও সুভাষচন্দ্র আকৃষ্ট হলেন এবং কটকে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভক্তবৃন্দের একটা সংগঠন গড়ে তুললেন। সেই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল অধ্যাত্মচর্চা করা আর দুঃস্থের সেবা করা। স্কুল ছাড়ার সময় যত এগিয়ে আসছিল, সুভাষের মধ্যে ধর্মভাব আর মানবসেবা করার প্রবণতা ততই বেড়ে যাচ্ছিল। লেখাপড়ায় আর মন বসছিল না।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শিশু সুভাষ (দণ্ডায়মান, ডান থেকে প্রথম)

এরপর ১৯১২ সালের অক্টোবর মাসে মহাসপ্তমীর দিন কৃষ্ণনগর থেকে মাস্টারমশাই শ্রী বেণীমাধব দাসের পরিচয়পত্র নিয়ে হাজির হলেন সুভাষেরই সমবয়সী একই (ফার্স্ট) ক্লাসের ছাত্র শ্রী হেমন্তকুমার সরকার। হেমন্ত কলকাতার একটা রাজনৈতিক দলের সভ্য ছিলেন যাদেরও আদর্শ ছিল আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং দেশসেবা। সেই প্রথম সুভাষ ও তাঁর কটকের বন্ধুরা প্রথমবারের মত কলকাতার রাজনৈতিক প্রেরণার আস্বাদন পেলেন। হেমন্তের কাছে তাদের দলের নানাবিধ কাজের বর্ণনা শুনে সুভাষচন্দ্র মুগ্ধ হলেন।

হেমন্ত একদিন সুভাষের দলের ছেলেদের দেশের প্রতি তাদের কর্তব্য সম্বন্ধে অনুপ্রাণিত করে একটা আবেগময় বক্তৃতাও দিলেন। এইসঙ্গে সুভাষচন্দ্রের সাথে তাঁর নিবিড় সখ্যতাও গড়ে উঠল। চারদিন কটকে থেকে বিজয়া দশমীর সন্ধ্যায় হেমন্তকুমার পুরী চলে গেলেন এবং কলকাতায় ফিরে গিয়ে তাঁর দলের প্রধানকে সব জানালেন। সেই দলনেতা চিঠির মাধ্যমে কটকের এই দলটার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন এবং কয়েক বছর এই যোগাযোগ ছিল।

হেমন্তকুমার পরে তাঁকে লেখা সুভাষের বেশ কিছু চিঠি প্রকাশ করেন যার থেকে সুভাষচন্দ্র বসুর কৈশোরের এবং যৌবনের অনেক কথা জানা যায়। তিনি তাঁর বিখ্যাত “সুভাষের সঙ্গে বারো বছর (১৯১২ – ১৯২৪)” বইতে জানান যে, সুভাষের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময়ই তাঁদের মধ্যে স্থির হয়েছিল যে পাশ করে তাঁরা চাকরি করবেন না এবং সুভাষ আই-সি-এস আর হেমন্ত আই-ই-এস-এ ঢুকে সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে চাকরি-মোহগ্রস্ত বাঙালীর সামনে আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন।

১৯১৩ সালের ১ মার্চ সুভাষচন্দ্র আর হেমন্তদের ম্যাট্রিক পরীক্ষা শুরু হয়। দুজনেই তাঁদের এই নূতন বন্ধুত্বের আর নতুন জীবনের আলোড়নে পড়াশুনায় তেমন মন দিতে পারেন নি। সুভাষচন্দ্র তো তারও আগে থেকেই পড়াশুনায় অমনোযোগী হয়ে গিয়েছিলেন। তৎসত্ত্বেও সুভাষ ৭০০-র মধ্যে ৬০৯ নম্বর পেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। পরীক্ষার পর আগের পরিকল্পনা মত সুভাষচন্দ্র কিছুদিনের জন্য হেমন্তের কাছে কৃষ্ণনগরে যান।

কলকাতার দলের কয়েকজন সদস্যও সেখানে আসেন এবং তাঁরা সদলবলে পলাশী, মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি ঐতিহাসিক স্থানগুলি দেখতে বের হন। পলাশীতে তাঁরা দেখতে পান যে সেই আম্রকানন আর নেই আর লর্ড কার্জনের আদেশে বিজয় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। হেমন্ত নবীনচন্দ্র সেনের “পলাশীর যুদ্ধ” আবৃত্তি করতে করতে যখন নবাব সিরাজদৌল্লার সেনাপতি মোহনলালের মুখনিঃসৃত অংশে আসেন তখন সুভাষচন্দ্র আর চোখের জল চেপে রাখতে পারেন না। তাঁর দলের সেই ভ্রমণ সাতদিনে সমাপ্ত হয়েছিল।

এরপর সুভাষচন্দ্র কলকাতায় এসে তাঁর বড় দাদাদের মত প্রেসিডেন্সি কলেজে আই এ ক্লাসে ভর্তি হলেন ১৯১৩ সালের জুলাই মাসে। তখন তাঁর বয়স সাড়ে ষোল। ভর্তি হওয়ার সাথে সাথেই তিন মাসের গ্রীষ্মের বন্ধ হয়ে যায়। সেই তিন মাসে তিনি কলকাতার সেই দলটাকে খুঁজে বার করলেন আর পছন্দমত কিছু নতুন বন্ধুও জুটিয়ে ফেললেন। কটকের পরিবেশ আর কলকাতার পরিবেশে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

অবশ্য এর প্রায় বছর দেড়েক আগে স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার সমাপ্ত হয়েছে। বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছে তবে তার জন্য বঙ্গ প্রদেশকে (বাংলা প্রেসিডেন্সিকে) অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। হিন্দী-উড়িয়া-অসমীয়া-ভাষী অঞ্চলগুলোকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে আর ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। তবে এই স্বদেশী আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামকে এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং এজন্য সশস্ত্র বিপ্লব আন্দোলনের তৎপরতাও বৃদ্ধি পেয়েছিল।

সুভাষের আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে এসময় সুভাষচন্দ্র শ্রীঅরবিন্দের লেখা ও চিঠিপত্র পড়ে তাঁর প্রতিও আকৃষ্ট হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের কিছু ছাত্রদের মধ্যেও এই বিপ্লবী চিন্তাধারা সক্রিয় ছিল। কিন্তু সুভাষচন্দ্র কলকাতায় এসেছিলেন মানবসেবা আর আধ্যাত্মিক উন্নতির সঙ্কল্প নিয়ে, যদিও তাঁর মধ্যে বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতি ছিল এবং স্বদেশচিন্তা তাঁকে গভীরভাবে আলোড়িত করত। আত্মজীবনীতে সুভাষচন্দ্র লিখে গেছেন, ‘কলেজ-জীবনে প্রবেশ করবার সময় জীবন সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা জন্মে গিয়েছিল। বুঝেছিলাম যে জীবনের একটা উদ্দেশ্য আছে এবং এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য নিয়মিত শরীর ও মনের অনুশীলনের প্রয়োজন।’

এসময় তাঁর সাথে কয়েক মাস আগে প্রয়াত বিখ্যাত কবি, নাট্যকার, গীতিকার, স্বদেশী-সংগীতস্রষ্টা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপ কুমার রায়ের বন্ধুত্ব হয়। দিলীপ কুমার রায় সুভাষচন্দ্রের সমবয়সী ছিলেন এবং সেবছরই প্রেসিডেন্সি কলেজে আই-এস-সি ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁরা কাছাকাছিই থাকতেন। সুভাষ একদিন দিলীপকুমারের বাড়ীতে এসে দিলীপকুমারকে তাঁর উদ্যোগে কলেজে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিতর্কসভায় যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানান। সেই প্রথম পরিচয়ের বর্ণনা খুবই সুন্দর।

সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন যে, আমাদের দেশে তর্ক-বিতর্কের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে কারণ স্বাধীনতার জন্য বড় বড় বক্তার, বাক-যোদ্ধার খুব প্রয়োজন। শ্রী দিলীপকুমার রায় তাঁর “আমার বন্ধু সুভাষ” বইতে লিখেছেন যে তিনি বলেছিলেন, রামকৃষ্ণ তো বলে গেছেন তর্ক দিয়ে সত্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। সুভাষচন্দ্র উত্তরে বলেছিলেন, “তিনি কি বলেছিলেন তাতে আমাদের দরকার কি? ... আমাদের গড়ে তুলতে হবে ভবিষ্যৎকে। কেন, আপনার বাবা কি বলেননিঃ ‘চোখের সামনে ধরিয়া রাখিয়া অতীতের সেই মহা আদর্শ, জাগিব নূতন ভাবের রাজ্যে রচিব প্রেমের ভারতবর্ষ?” দিলীপকুমার আশ্চর্য হয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘তাঁর কবিতা আপনার মনে আছে?’ উত্তরে সুভাষের দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তিনি বলেছিলেন, “অন্তরে গাঁথা আছে।”

সুভাষের দলের সকলেই ব্রহ্মচর্যের ব্রত নিয়েছিলেন। দলের প্রধান লক্ষ্য ছিল ধর্ম আর জাতীয়তাবাদের সমন্বয় ঘটানো – শুধু চিন্তায় নয় কাজের মাধ্যমে। তাঁর দলের ছেলেরা নতুন নতুন ভাবধারার সন্ধানে দর্শন, ইতিহাস, জাতীয়তাবাদের উপর বই খুঁজে খুঁজে পড়তেন এবং নিজেদের মধ্যে তা আলোচনা করতেন। তাছাড়া নতুন সদস্য সংগ্রহ করতেন এবং নামকরা লোকদের সাথে আলাপ পরিচয় করতেন। এছাড়া সাধু-সন্তদের সন্ধানে থাকা এবং ছুটির সময় তীর্থস্থানে তাঁদের সন্ধান করাও একটা কাজ ছিল। ১৯১৩ সালে বড়দিনের ছুটিতে তাঁরা দলবেঁধে গিয়ে কলকাতা থেকে ৫০ মাইল দূরে শান্তিপুরে কিছুদিন গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী হয়ে বাস করেছিলেন। ১৯১৪ সালে তাঁরা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সাথেও দেখা করতে গিয়েছিলেন। বেলুড় রামকৃষ্ণ মঠ ও অন্যান্য জায়গায় প্রায়ই যেতেন। দক্ষিণ কলকাতার অনাথ ভাণ্ডার দরিদ্র সেবা প্রতিষ্ঠানের জন্য রবিবার বাড়ি বাড়ি ঘুরে অর্থ ও চালডালও সংগ্রহ করেছেন।

সেসময় কলেজে অধ্যাপকদের পড়ানো সুভাষচন্দ্রের একঘেয়ে লাগতো। এই একঘেয়েমি কাটানোর জন্য জনহিতকর কাজে মেতে থাকতেন। বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা, বন্যা বা দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য টাকা তোলা, সহপাঠীদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়া–এই ধরণের কাজ তাঁর ভালো লাগত। প্রথম বছরের কলেজের ছুটিতে কটক গিয়ে কাছের একটা গ্রামে কলেরা হওয়ায় সে গ্রামে রোগীর শুশ্রূষা করতেও যান। সেই এক সপ্তাহে তিনি দেশের দারিদ্র্য, মৃত্যুর তাণ্ডবলীলা আর নিরক্ষরতার অভিশাপ প্রত্যক্ষ করেন। কলকাতায় ফিরে এসে ষাট মাইল দূরে কৃষ্ণনগরে এক উদাসী পাঞ্জাবী শিখ তরুণ সাধুর সন্ধান পেয়ে হেমন্তকে নিয়ে পায়ই তাঁর কাছে যেতে শুরু করেন। সেই সন্ন্যাসীকে দেখে সুভাষের মনে দীক্ষা নেবার ইচ্ছা জাগে।

১৯১৪ সালের গরমের ছুটির সময় সুভাষচন্দ্র প্রায় দুমাস গুরু খুঁজতে উত্তর ভারতের প্রায় সবকটা তীর্থস্থান ঘুরে বেড়ান। বাড়িতে শুধু একটা পোস্টকার্ড পাঠিয়ে জানিয়েছিলেন মাত্র। এই তীর্থভ্রমণের সময় হিন্দু সমাজব্যবস্থার মূল গলদগুলি তাঁর কাছে ধরা পড়ে। অবশ্য অনেক প্রকৃত ধার্মিক সন্ন্যাসীরও দর্শন পান। সেখান থেকে ফিরে এসে কিছুদিনের মধ্যেই সুভাষচন্দ্র টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হন। সেবার তাঁর ৬৩ দিন জ্বর ছিল। জ্বর সেরে গেলে সুভাষচন্দ্র স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে কার্সিয়াং গিয়ে এক মাস থেকে আসেন। এরপর ১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসে হেমন্ত ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হন এবং সুভাষ কৃষ্ণনগরে গিয়ে বন্ধুর সেবা করেন। এসব গোলযোগে পড়াশুনার ব্যাঘাত হওয়ায় ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ফল ভাল হলনা। তবুও ১৯১৫ সালে তিনি ফার্স্ট ডিভিশনে আই এ পাশ করেছিলেন এবং দর্শনে অনার্স নিয়ে একই কলেজে বি এ ভর্তি হলেন।

কৈশোরে সুভাষচন্দ্র বসু

১৯১৬ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাস সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনে একটা তাৎপর্যপূর্ণ সময়। তখন তাঁর বয়স ১৯ বছর। ঘটনাটা সবার জানা। অনেকেই এই সম্বন্ধে বিস্তারিত লিখেছেন। তাই খুব সংক্ষেপে সেই ঘটনাটার বিবরণ দিয়ে এই লেখাটা শেষ করব। প্রেসিডেন্সি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন এডওয়ার্ড ফারলে ওটেন। এই ইংরাজ অধ্যাপক ছিলেন I.E.S. (ইন্ডিয়ান এডুকেশান সার্ভিসের সদস্য) এবং বর্ণবিদ্বেষী। তিনি ১৯১৫ সালে ইডেন হিন্দু হোস্টেলে আমন্ত্রিত হয়ে ভাষণ দেন এবং সেই বক্তৃতায় ভারতীয়দের সম্বন্ধে খারাপ মন্তব্য করেন। অসন্তুষ্ট হলেও তাঁকে সভাপতি করে ডেকে আনা হয়েছে বলে ছাত্রেরা সেদিন কোন গোলযোগ করেনি। কিন্তু ১০ জানুয়ারি ১৯১৬ তারিখে তিনি কয়েকজন ছাত্রকে কলেজের বারান্দায় ধাক্কা দেন।

ছেলেরা যেহেতু থার্ড ইয়ার অর্থাৎ বি এ ফার্স্ট ইয়ারের ছিল এবং সুভাষচন্দ্র সেই ক্লাসের প্রতিনিধি ছিলেন, তিনি অধ্যক্ষ মিঃ এইচ আর জেমসের কাছে গিয়ে প্রতিবাদ জানান। অধ্যক্ষ মিঃ জেমস জানান, যেহেতু অধ্যাপক ওটেন ইন্ডিয়ান এডুকেশান সার্ভিসের সদস্য তাই তিনি অধ্যাপক ওটেনকে শাসন করতে পারবেন না। পরদিন ছাত্ররা ধর্মঘট শুরু করে এবং ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিন কর্তৃপক্ষ ওটেনকে চাপ দিলে ওটেন ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলেন। কিন্তু প্রায় একমাস পর ওটেন একই কাজ করে ফেলেন।

যদিও সেবারের ছাত্রটি আই এ ফার্স্ট ইয়ারের ছিল, সুভাষচন্দ্র ছাত্র-প্রতিনিধিদের মিটিংয়ে জানান, এই অধ্যাপককে এভাবে শোধরানো যাবে না এবং তাকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে। ছাত্র-প্রতিনিধিদের সভায় তাঁর এই প্রস্তাব অনুমোদিত হয় এবং পরদিন, ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯১৬, মিঃ ওটেন কলেজের করিডোরে প্রহৃত হন। এই ঘটনার জন্য সুভাষচন্দ্র এবং শ্রী অনঙ্গ মোহন দাম কলেজ ও ইউনিভারসিটি থেকে বহিষ্কৃত হন। যদিও সুভাষচন্দ্র নিজে মিঃ ওটেনকে প্রহার করেননি, তিনি নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে চুপ করে থাকেন। সত্যি বলে দায়িত্ব এড়িয়ে বহিষ্কার এড়াতে রাজি হন না।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ছোটবেলায় প্রথমে তিনি ইংরেজি শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেছেন এবং ইংরেজদের সঙ্গে মিশেছেন। তারপর তিনি নিজের দেশের সংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচিত হন। যখন তিনি স্কুলে পড়েন তখন বিভিন্ন প্রদেশের ছেলেদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। মুসলমানদের সম্বন্ধে উদারতার জন্য তাঁর ছেলেবেলার অভিজ্ঞতাই বহুল পরিমাণে দায়ী। তাঁদের কটকের বাড়ী ছিল মুসলমান এলাকায় এবং প্রতিবেশীরা বেশীরভাগই ছিল মুসলমান। তাঁর বাবাকে সবাই খুব শ্রদ্ধা করতেন।

তাঁরাও মুসলমানদের উৎসব অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। তাঁদের বাড়ীর কাজের লোকেরা অনেকেই মুসলমান ছিলেন এবং তাঁরাও সুভাষচন্দ্রদের খুব অনুরক্ত ছিলেন। স্কুলে মুসলমান শিক্ষক আর ছাত্রদের সাথেও তাঁদের খুব সৌহার্দ্য ছিল। মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করা ছাড়া কোন ব্যাপারেই তিনি কোন প্রভেদ দেখতেন না। এই জন্যই আজাদ হিন্দ ফৌজে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিষ্টান-সব ধর্মাবলম্বীরা এক হয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পেরেছিল।

বাল্যকাল আর কৈশোর ছিল সুভাষচন্দ্রের প্রস্তুতির সময়। যে দেশপ্রেম তাঁর পরবর্তী জীবনে প্রস্ফুটিত হয়েছে, তার ব্যাপকতা, গভীরতা, বিস্তীর্ণটা ইত্যাদি বুঝতে হলে তাঁর বাল্যকাল আর কৈশোরকে ভাল করে জানতেই হবে। যারাই নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনী অধ্যয়ন করেছেন তাঁরাই একমত হবেন যে তিনি এই উপমহাদেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক।

পূর্বেই বলেছি, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মধ্যে কোন প্রাদেশিক, ধার্মিক বা জাতপাতের সঙ্কীর্ণতা ছিল না। তিনি মনে করতেন, ধর্ম যার যার নিজস্ব ব্যাপার। তিনি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে দেশের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন এবং তাঁর এই দেশপ্রেম কৈশোরেই অঙ্কুরিত হয়েছিল। এমনকি তিনি যে আই.সি.এস পাস করে তা থেকে পদত্যাগ করবেন তাও সেই কৈশোরেই স্থির করে ফেলেছিলেন। বালক-কিশোর সুভাষচন্দ্রই পরে নেতাজী হয়ে আমাদের দেশকে ইংরেজের হাত থেকে স্বাধীন করেছিলেন।

সেসময়কার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এ্যাটলি নিজমুখে একথা স্বীকার করে গেছেন। শুধু দুঃখের কথা এই যে কিছু স্বার্থান্বেষী নেতার জন্য যে অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন নেতাজী দেখেছিলেন, তা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। আজ এত বছর পর নেতাজীর আকাঙ্ক্ষিত বৃহত্তর ভারতের প্রয়োজনীয়তা কিছুটা হলেও আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। নেতাজীর জীবনযাপন, চিন্তাভাবনা, কার্যকলাপ সব একটি মাত্র আবেগ দ্বারাই সঞ্চালিত হয়েছে এবং তা হচ্ছে দেশপ্রেম।

অহিংসার পূজারি গান্ধীজী পর্যন্ত তাঁকে “Patriot of Patriots” আখ্যা দিতে বাধ্য হয়েছেন। নেতাজীর দেশপ্রেম নেলসন ম্যান্ডেলা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আরও অনেককে অনুপ্রাণিত করেছে। আজও ভারতবাসী এবং বাঙালী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর তুলনাহীন দেশপ্রেম থেকে অনুপ্রাণিত হন। যতদিন মানবজাতি থাকবে এবং দেশপ্রেম আলোচিত হবে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জনক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নাম পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হবে। জয়তু নেতাজী।।

লেখক: সাবেক কুটনীতিক ও ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু, নয়াদিল্লি; ভারত। ইমেল: [email protected]

;