প্যারাকজম



মাহরীন ফেরদৌস
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

সাঁকো
প্রায় অনেক বছর পর এমন কারো সাথে পরিচয়। পরিচয়টুকু পথে কিংবা গলির মাথায়। বাড়ির সামনের বিখ্যাত মিষ্টির দোকানে, ব্যাঙের ছাতার মতো সদ্য গজিয়ে যাওয়া রেস্তোরাঁয়। টঙের দোকানে কারো ভীষণ শব্দ করে চায়ে চুমুক দেওয়ায়। ছাদের অলকানন্দা ফুল কিংবা খুলনার ঝপঝপিয়া নদীর তীরে। এতবার পরিচয় কিভাবে হয় ভাবতে পারে সবাই। তবে তা ব্যাখ্যা করা দুর্বোধ্য ও জটিল। তার সাথে দেখা হবার পর থেকেই বারবার, নানা স্থানে হচ্ছে পরিচয়। আমরা দুজন অবশ্য ফেসবুকে বন্ধু নই। ইন্সটাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট কিংবা টুইটারেও আমরা একে অন্যকে দেখি না। কারণ, আমি খুঁজে দেখেছি সে এসব কিছুই ব্যবহার করে না। তারপরেও ক্যামোন অদ্ভুত জায়গায় আমাদের দেখা হয়ে যায়।

যেমন, মৌনতার ঘরের বারান্দা দিয়ে তার ঘর দেখা যায়। জনমানবশূন্য শহরের মতো সেই মস্ত ঘরে সে বই পড়ে সময় কাটায়। সম্ভবত মৃদু শব্দে শোনে গান। বই পড়ার সময় মাঝে মাঝে অল্প মাথা ঝাঁকায়, যেন গল্পকার ও পাঠক দুটো সে নিজেই। তারপর, ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা হাঁটতে থাকে। তার দেখাদেখি আজকাল আমিও খুব হাঁটতে শুরু করেছি। বাড়ির ছাদে, ঘরের ভেতরে, রাস্তায় কিংবা গলিতে আমি রিকশা না ডেকে, গাড়িতে না চড়ে হাঁটতে থাকি। আমার কেবলই মনে হয় এভাবে হাঁটতে হাঁটতেই আমাদের একদিন সত্যিই পরিচয় হয়ে যাবে। এ যুগে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে জুড়ে না থাকলে একে অন্যকে কাছ থেকে দেখার আর উপায় আছে কি? নেই। তাই আমার মাঝেমাঝে মনে হয় আমি মৌনতার ঘরটা ভাড়া নিয়ে থাকি, কিন্তু তা সম্ভব না। সেজন্য ছুটির দিনগুলোতে খুব ভোরে আমি ওর বাসায় চলে যাই। ওদের বারান্দায় অনেক গাছ। বাড়ির নানা পরিত্যক্ত জিনিস সেখানে বস্তাবন্দী করে ফেলে রাখা। এছাড়াও বারান্দার উপরের গ্রিলের এপাশ থেকে ওপাশে টাঙিয়ে দেওয়া তিন, চারটা লম্বা নাইলনের দড়ি। দিন-রাত সেখানে শত শত রঙ বেরঙের কাপড় শুকাতে দেওয়া হয়। একটা টুল নিয়েও বসার জায়গা নেই। ঠেস দিয়ে দাঁড়ানোর জন্য কোনো ফাঁকা দেয়ালও অনুপস্থিত। এমন একটা জায়গা থেকে আমি তাকে দেখি। বারান্দা দিয়ে তার ঘরের দেয়ালে ক্রিকেট ব্যাট দেখে মৌনতাকে জানিয়েছিলাম। শুনে ও বলেছিল, ‘হয়তো খেলার মাঠ নিয়ে তার অনেক স্মৃতি আছে। সে হয়তো ক্রিকেট খেলতে খুব পছন্দ করে।’

শুনে আমারও বলতে ইচ্ছা করল, আমার বাড়ির পাশে একটা মস্ত বড় খেলার মাঠ আছে। আর মাঠ পেরিয়েই একটা ঘন সবুজ পার্ক। সেই পার্কের নির্দিষ্ট বেঞ্চিতে বসলে নাকি অকারণেই সবার মন খারাপ হয়ে যায়। আমার খুব ইচ্ছা করে খেলার মাঠের পাশের এই পার্কের গল্প আমি তাকে শোনাই, কিংবা ঘর থেকে একটা বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে তাকে তুলে নিয়ে এসে বলি, ‘চলো দেখে আসি স্টেশনের শেষ ট্রেনটা কোন গ্রামে যায়। কী আছে সেখানে? অনেক অনেক গাছ, শান্ত নদী, লেবু বাগান, বৃষ্টির পর রংধনু আর সন্ধ্যা নেমে আসার আগেই ঝিঁঝিঁ পোকাদের ঘোরলাগা গান!’

এসব ছাড়াও, আমি মনে মনে অনেকবার ভাবি তার সাথে হঠাৎ করে কোথাও দেখা হয়ে যাবে নাকি? হয়তো ব্যস্ত নগরীতে ভিড়ের মধ্যে সে হুট করে সামনে এসে খুব পরিচিত ভঙ্গিতে বলবে ‘কেমন আছো?’ জানি না তখন আমি কী উত্তর দেব। হয়তো পেছন ঘুরে হাঁটতে শুরু করব বিব্রত ভঙ্গিতে। মুগ্ধতা কিংবা প্রেম যে নামই হোক, আমাকে বিব্রত করে খুব। লুকাতে পারি না, আবার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতেও ইচ্ছে করে না। আমি জানি আর অল্প কয়মাস পরেই মৌনতারা এই বাসা ছেড়ে দিবে। এরপর তার সাথে দেখা হবে কিভাবে? জানা নেই। যদি ওর প্লে লিস্টের গানগুলো পেতাম হয়তো গানে গানে একটা সাঁকো তৈরি করে ফেলতাম দুজন। সেখানে আমাদের দেখা হতে পারত। মৌনতা আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, ‘এই মানুষটাকে নিয়ে তোর পরিকল্পনা কী?’

আমি বিশেষভাবে কিছু বলতে পারি না। এই ভালোলাগা, ঘোরলাগা কিংবা ‘আমাদের মাঝে যেন কী মিল আছে’ ধরনের অনুভূতির পৃথক কোনো সংজ্ঞা আমার কাছে নেই। শুধু জানি তার কথা না ভাবলে মনে হয় এবেলায় আকাশের দিকে তাকানো পাপ। আর মনে হয় সবকিছু এভাবেই থাক। মানিক মিয়া এভিনিউয়ের পার্ক থেকে গলা বাড়িয়ে দেওয়া ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ ছুঁয়ে দিক তার চিবুক। টঙের দোকানের মস্ত বড় কেতলির বিকট হুইসেল আর বাষ্পগুলো ঝাপসা করে দিক ওর কালো ফ্রেমের চশমা।

আমি শুধু ভুলতে চেষ্টা করে কিছু স্বপ্ন দেখে ফেলি। এই যেমন কিছুদিন আগে একরাতে দেখলাম, এক বিষাদ জাগানো ল্যাম্পপোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। পেছনে চেনাজানা বহু মানুষ। আমি পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, যাওয়ার সময় অকপটে ছুঁয়ে দিলাম তার হাত। কেউ দেখল না, কেউ জানল না। এরপর চলে গেলাম দূরে, বহুদূরে। শান্ত হয়ে এলো চারপাশ।

আবার স্বপ্নে দেখলাম কোনো এক বইয়ের দোকানে দেখা হয়ে গিয়েছে আমাদের। শেলফের শতশত বইয়ের পাতাগুলোর ভেতর থেকে অনবরত পানি ঝরে একটা নদী হয়েছে। সেই নদীতে অল্প অল্প ঢেউ। ভাসছে অজস্র বই। বইয়ের খোলা পাতার ভেতর থেকে ফুটে উঠেছে কচুরিপানা ফুল। আমরা দাঁড়িয়ে আছি দুজনেই। হঠাৎ কী যেন একটা খুঁজতে চলে গেল ও। আমি একলা দাঁড়িয়ে। আমার পায়ে বাড়ছে জড়তা। যেন ডুবে যাচ্ছি আর আটকে যাচ্ছি কোথাও। মনে হচ্ছে, মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই আলো ফুটে উঠবে, আর হারিয়ে যাবে সব। আমি প্রাণপণে চোখ বন্ধ করে রাখার চেষ্টা করতে থাকি। তারপর ভুলে যাই আমি কেন সেখানে আছি। এমন সময় কোথা থেকে আসা এক অচেনা বাতাসে কচুরিপানা ফুলগুলো দুলতে থাকে। আর নিয়ম করে পুড়তে থাকে আমার স্বপ্নের তারাবাতিগুলো।


অফবিট
- ‘তারপর?’
- ‘তারপর আর কিছুই না।’
- ‘ আশ্চর্য! এই সোশিওপ্যাথ ধরনের রহস্যময় মানুষটার সাথে তোর কোনো কথা বা কিছুই হয়নি?’ বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে আমার বন্ধু জাহিদ, যাকে আমরা মজা করে জ্যাক বলে ডাকি।
- ‘উঁহু।’ আমি মাথা নাড়ি। আর জ্যাক আমার দিকে একটু সন্দেহজনক দৃষ্টি ফেলে কফিকাপে শব্দ করে চুমুক দেয়।

আমি চুপ করে থাকি। জ্যাককে কিভাবে বলি, মাঝেমাঝে এমন সময় আসে যখন মনে হয় পৃথিবীটা একই সাথে ভয়ংকর সুন্দর এবং প্রচণ্ড বেদনায় ভরপুর। আর তাই, বারান্দায় দাঁড়ালে যখন আচমকা বিপুল বাতাসের ঢেউ এসে সমুদ্রের মতো আমার ওপর আছড়ে পড়ে, তখন আমি দু চোখ বন্ধ করে ফেলি। আজকাল এত দীর্ঘশ্বাস আসে থেকে থেকে, যে মনে হয় ঝড় উঠে যাবে আকাশে। গুমোট, গম্ভীর আর ভারী এই শ্বাসের ভার নিতে পারি না।

আমি কিভাবে ওকে বলি, মৌনতারা বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছে মাসখানেক হলো। আর আমি তবুও ঘুরেফিরে হেঁটে যাই তার বাড়ির সামনে। আর দাঁড়িয়ে থাকি। তবে এখন সম্ভবত আমি জানি যে, সেও জানে আমি হেঁটে যাচ্ছি। আর সম্ভবত তার সাথে আমার একটা গোপন প্রেম আছে। বাস্তবতায় নিয়ন্ত্রিত এবং ফ্যান্টাসিতে অনিয়ন্ত্রিত এক প্রেম। সেখানে জীবনানন্দ দাশের সোনালি ডানার গাংচিলের সাথে আবুল হাসানের সাদা চামেলি ফুলের দেখা হয়ে যায়। অবাস্তব লাগছে? হ্যাঁ, আমারও এমন লাগে।

- ‘সে তোর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে কোনো?’ জ্যাক আরেক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে আমার পাশে বসতে বসতে বলে। আমি প্রমাদ গুনি। নিশ্চয়ই এটা মৌনতার কাজ। বাড়ি বদলের পর থেকে আমি এখনো ওদের আগের বাড়ির সামনে নিয়মিত যাই এটা বোঝার পর সে অতিরিক্ত চিন্তায় পড়ে গিয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সেই কিছু একটা জ্যাককে বলেছে, আর তাই সবসময় নিজের প্যাঁচানো দুনিয়ায় ব্যস্ত থাকা বন্ধুটি হঠাৎ করেই বেশ সময় দিচ্ছে আমাকে। এমন গ্যাঁড়াকলে পড়ে নিজেকে নিজেরই লাথি মারতে ইচ্ছে হয়।

কপিশপের বাইরের স্বচ্ছ কাচে ঘনিয়ে আসে ছায়া। আকাশে বেশ মেঘ করছে। বখাটে বাতাস রাস্তায়। ধুলা আর ছেঁড়া কাগজ অহেতুক উড়ছে এলোমেলো। আমি আনমনা হই আর জ্যাকের চেহারা ঝাপসা হয়ে আসে ক্রমশ। আজকাল আমার তাকে নিয়ে ভাবতে আরো ভালোলাগে। চোখ বন্ধ করলে মনে হয় সে ভীষণ কাছে। এই তো পাশে। চোখ খুললে হারিয়ে যায় সব। এমন তো মনে হয়নি আগে কোনোদিন, বরং আমি অনেকটাই ঠেকে শেখা ও টুকে নেওয়া একলা মানুষ। একটা সময় ছিল যখন শামুকের মতো খুব গুটিয়ে থাকতাম, কিন্তু এই কর্পোরেট কালচার আর সিজিআইতে ভরপুর সেলুলয়েড পৃথিবী আমাকে বদলে দিয়েছে অনেকটুকু। এ কারণে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে নিহিলিস্ট হই। নিহিলিজম চর্চাই হবে আমার এগিয়ে যাওয়া। ‘নিহিল’ অর্থ যেমন ‘কিছুই না’ আমিও তেমন ‘কিছুতেই কিছু যায় আসে না’ ধরনের জগতে থাকব। তবে কোথাও যেন তবুও কী বাকি থেকে যায়, সে কারণেই আমি হয়তো নানা জায়গায়, নানা মানুষের মাঝে গল্প খুঁজে বেড়াই। তবে এই পৃথিবীর ৭,৭৮০ মিলিয়ন মানুষের মাঝে হুট করে উল্টা কেউ আমারই গল্পে চলে আসবে, আমার সাথে বসবাস করতে শুরু করবে তা ভাবতে পারি না। তাই যেখানে তার সাথে আমার তিন থেকে পাঁচ মিনিটের জন্যও কোনোদিন মুখোমুখি আলাপ হয়নি, তবুও কিভাবে তাকে নিয়েই এতকিছু ভাবছি, এই ভেবে নিজের মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। মনের মধ্যে প্রশ্ন ঘুরে, ‘আমাদের মাঝে ক্লিক করলটা কোথায়?’

জ্যাকের দ্বিতীয় কাপ কফি চলে আসে। এবার দেখতে পাই আমার জন্য বাটারস্কচ আইসক্রিম অর্ডার করেছিল ও। ওয়াফেলের ভেতর থেকে মোলায়েম আইসক্রিম উঁকি দিয়ে বলে, ‘হাউডি!’ কফি হাতে নিয়ে স্মোকিং জোনের দিকে যেতে ইশারা করে ও। আমি ওর পিছু নেই। কী কী যেন বলতে থাকে, আমার কানে আসে না। না শুনেই মাথা নাড়ি।
- ‘তুই কোনো কথাই শুনছিস না তাই না?’ প্রায় ধমকে বলে ওঠে আমার সুদর্শন বন্ধু। আমি শূন্য চোখে তাকাই।
- ‘আমি তোকে বললাম, অফিসে এবার প্রমোশন লিস্টে আমার নাম আসেনি। তুই মাথা নাড়লি যেন এটা খুব স্বাভাবিক। বললাম, বাড়ি বদলাব, নতুন ফ্ল্যাট খুঁজছি, তুই উত্তর দিলি না। এরপর স্মোকিং জোনে আসতে আসতে বললাম, আমার বসের বউয়ের সাথে আমার ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড হয়েছে। মিড লাইফ ক্রাইসিসে ভোগা মহিলা এখন আমার পিছু ছাড়ছে না। এত চরম কথা শুনে তুই শুধুই মাথা নাড়লি। হয়েছেটা কী তোর?’
আমি থতমত খেয়ে যাই। প্রাণপণে মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে মনে মনে নার্সারির একটা হাস্যকর ছড়া কাটি,
“অল দ্য লিটল ফিশেস আর সুইমিং ইন দ্য ওয়াটার
সুইমিং ইন দ্য ওয়াটার,
সুইমিং ইন দ্য ওয়াটার,
অল দ্য লিটল ফিশেস আর সুইমিং ইন দ্য ওয়াটার
স্প্লিশ, স্প্লিশ, স্প্লিশ, স্প্লিশ, স্প্ল্যাশ”

অল্পক্ষণে ধাতস্থ হই। তারপর জ্যাককে শান্ত করার জন্য বলি, ‘আইসক্রিমটা দারুণ। আর ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড শুনলে আমি আগে ভাবতাম ছেলে-মেয়ে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে কিস করেছে। এখন বুঝি এর মাহাত্ম্য। তোর প্রমোশন কি এ জন্যই আটকে গিয়েছে?’

নির্মমভাবে নিজের গালের ফ্রেঞ্চ কাট দাঁড়ি চুলকাতে চুলকাতে ও বলে, ‘আসলে রাতে থাকিনি। ডিনারে গিয়েছিলাম শুধু। ডিনার থেকে অন্যকিছু হয়ে যেতে পারে বুঝতে পেরে এড়িয়ে চলে আসছি, কিন্তু মহিলা পিছু ছাড়ছে না। তুই আমার কথাকে পাত্তা দিচ্ছিলি না বলে চাপাবাজি করলাম, কিন্তু লাভ কী? তুই তো দেখছি মঙ্গল গ্রহের বাসিন্দা হয়ে আছিস। যাই হোক, আমি বের হব একটু পর। যাওয়ার আগে তোকে বাড়ির কাছে নামিয়ে যাব?’

আমি সবগুলো দাঁত বের করে মাথা ঝাঁকাই। খানিক পরেই অল্প বৃষ্টির মাঝে আমি ওর বাইকের পেছনে উঠে বসি।

- ‘সাবধানে বস। পড়িস না আবার।’ সিরিয়াস কণ্ঠে বলে জ্যাক। আর মিনিট দুয়েকের মাঝে হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে শোঁ করে উড়ালপঙ্খীর মতো চলতে শুরু করে ওর বাইক। জ্যামের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাইকের এঁকেবেঁকে যাওয়া, সাথে প্রবল বাতাস, একটু আধটু বৃষ্টি আমার মনের গুমোট ভাব অনেকটুকুই দূর করে দেয়।

আমি আকাশের দিকে মুখ তুলে চোখ বুজি। সাথে সাথে এটাও খেয়াল রাখি যেন পড়ে না যাই। তবে মানিক মিয়া এভিনিউয়ের কাছে পৌঁছাতেই আবার আনমনা হই। এখানের ছাতিম গাছটা কি আমার কথা রেখেছে? আমার কথা ভেবে বকুলের ঘ্রাণ সেই মানুষটার পিছু নিয়েছে তো? সে কি জানে, নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে আমি এখন এত কবিতা পড়ি, এত বই পড়ি যে মাথা বনবন করে ঘুরতে থাকে। সারাক্ষণ পেছনে বাজতে থাকে নানারকম ইন্সট্রুমেন্টাল মিউজিক। মনে হয়, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি মোনালিসাকে ভুলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে ঠা ঠা করে। আর এই স্টুপিড হৃদয় তার কথা ভাবতে ভাবতে আমার চোখে আনন্দের বাষ্প এনে দেয়। মনে হয় জাদুর শহর, প্রাণের শহর সব চাপাবাজি। ঢাকা নামের এই প্রাইভেসিহীন শহরে আমি এমন কোনো শূন্য রাজপথ খুঁজে পাব না যেখানে শুধু আমরা দুজন থাকব। তার একটা হাত তুলে এনে চেপে ধরতে পারব না আমার রাত জাগা শুষ্ক গালে। সবখানে শত শত মানুষ। আমরা পালাব কোথায়? তারপর আবার প্রশ্ন জাগে, একই রকম দেখতে দুই হাত, দুই পা, ২০৬টা হাড়, একটা হৃদয়, নাক, কান, গলা সমেত একধাঁচের মানুষদের মাঝে আমার কেন তার সাথেই একটা অলীক যোগসূত্র শুরু হলো? এই অতি পুরাতন কিন্তু আধুনিক, আধ্যাত্মিক ব্যাপার শুরু করল কে? আমি নাকি সে?

- ‘এখানে নামাই। বাকি পথটুকু হেঁটে যেতে পারবি নাকি রিকশা নিবি?’ আমার বাড়ির সামনের মূল সড়কে এসে জিজ্ঞেস করে জ্যাক। আমি বাস্তবে ফিরি। এক গাল হেসে বলি, ‘এটুকু পথ, হেঁটেই যাব।’
- ‘সাবধানে যা। আর আমি রাতে ফোন করে কথা বলছি আবার তোর বিষয়ে।’ চোখ পাকিয়ে বলে ও। আমি মনে মনে বলি, ‘নো ওয়ে।’ তবে মুখে বলি, ‘কল করিস। আমি রাতে জেগেই থাকি।’

মাথায় হেলমেট ঠিক করে একটা স্যালুট দেওয়ার ভঙ্গি করে বিদায় নেয় ও। আর খুব ধীর পায়ে আমি বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি। মূল সড়ক থেকে বাড়ি ফেরার এই পথটুকু আমার খুব চেনা, খুব আপন। বাড়ি থেকে ক্রমশ ফ্ল্যাটবাড়ি হয়ে ওঠা কৃত্রিম দালান, ওষুধের দোকানের পাশের নর্দমা, মুদি দোকানের অলস আনিস চাচা, একটা জারুল, দুইটা কৃষ্ণচূড়া গাছ আর পিচঢালা মসৃণ অথচ সরু পথ আমার খুব পরিচিত। কত কত বছর ধরে এখানে আমি পায়ের ছাপ ফেলে যাচ্ছি। বাড়ি ফিরছি, বাড়ি ছাড়ছি। ওদের মতো করে এই শহরের আর কোনো পথ কি আমাকে চেনে? অবশ্য মৌনতাদের বাড়ি সামনের পথটুকু আজকাল আমাকে একটু একটু করে চিনতে শুরু করেছে। সে পথকে কি আমি প্রশ্ন করতে পারি, কেন দিনের খুব ক্ষণস্থায়ী কিছু মুহূর্তে আমার দেজাভু হয়? কেন মনে হয় তার সাথে আমার হয়তো পরিচয়টা আগেই ছিল। কথা হয়েছিল, দেখা হয়েছিল, কিন্তু আসলে তো এসব কিছু হয়নি। আমার মস্তিষ্কের ‘টেম্পোরাল লোব’ কেন আমার সাথে এমন বেইমানি করছে? কেন পৃথিবীর সব ফুলের রঙ আমার কাছে হয়ে যাচ্ছে তীব্র সুন্দর? কেন বহু দূরে অচেনা কোনো পাখি ডেকে গেলেও আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় প্রচণ্ড সচেতন হয়ে ওঠে? মধ্যরাতে ঝিঁঝিঁ পোকারা একসাথে কোরাস গাইতে শুরু করলে কেন ইচ্ছে হয় আমি ওদের মাঝে গিয়ে মুখ ডুবিয়ে ঘুমিয়ে থাকি? ঘুম ভেঙে যায় মাঝরাতে, আর ভাবি, ‘এই অবেলায় সে করছে কী?’ তারপর আবার মনে হয়, ‘আমাদের ক্লিক করল কোথায়? কিউপিড কি সত্যি আছে পৃথিবীতে?’

বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে একটা গাড়ি চলে যায় আমার পাশ দিয়ে। আর ঠিক তখনই ব্যাগে থাকা মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে। সম্বিৎ ফিরে আসে আমার। বাসা থেকে ফোন। কলটা ধরে মৃদু স্বরে বলি, ‘আর দুই মিনিট লাগবে।’

হাতঘড়ি দেখি। রাত প্রায় আটটা। এ সময় সেও কি বাইরে থেকে নিজের বাড়ি ফেরে? আবার এমন কি হতে পারে, আমার যা হচ্ছে তা হলো প্যারালাল ইউনিভার্সের সংঘাত। অর্থাৎ, আমরা এ জগতে অচেনা থাকার পোশাক পরে আছি আর অন্য জগতে একসাথে বইয়ের দোকানে খুব ঘুরছি। সে কারণেই তার প্রতি আমার এত টান। আমার ইচ্ছে করে সে যখন খাবার খাবে, আমি সেই খাবারের দারুণ কোনো স্বাদ হয়ে তার মাঝে থাকি। সে যখন প্রিয় গান শোনে, সেই গানের সুর হয়ে কানের ভেতর প্রবেশ করি। কিংবা, আমি তার কোনো বেদনার স্মৃতি হই। সে যখন কাঁদবে, সেখানে আমিই কারণ হব।

আবার মোবাইলটা বেজে ওঠে। আমি কলটা কেটে দিয়ে মাথা ফাঁকা করতে করতে দ্রুত পা চালাই।

নিজের ঘরে এসে ক্লান্ত লাগে খুব। কাঁধের ব্যাগ ছুড়ে ফেলি বিছানায়। তারপর সোজা চলে যাই শাওয়ার নিতে। অনবরত মাথার ওপর বৃষ্টির মতো ঝরে যাওয়া এই জলের সাথে আমার একান্ত সময়। এই সময়টা আমি সবচেয়ে বেশি বিচ্ছিন্ন থাকতে পারি সবকিছু থেকে। প্রতিটি জলের ফোঁটা আমার ক্লেদ, ক্লান্তি আর বিষণ্ণতা মুছতে থাকে। দীর্ঘ সময় তাই অকারণেই ঝর্নার নিচে দাঁড়িয়ে থাকি। প্রায় মিনিট চল্লিশেক পর বের হই। হালকা লাগে ভীষণ। ডাইনিং টেবিল থেকে প্লেটে অল্প কিছু খাবার নিয়ে নিজের ঘরে চলে এসে একটা সিরিয়াল ছেড়ে দিই। আসলে ওটায় মন নেই শুধুই সফট নয়েজের জন্য চালিয়ে রাখা। আশা করছি জ্যাক রাতে ফোন করবে না, প্রাক্তন প্রেমিকা, অফিসের ক্যাচাল নিয়ে এমনিতেই সে সবসময় খুব চাপে থাকা মানুষ। আজ বহুদিন পর দেখা হলো, আগে প্রতি সপ্তাহেই আড্ডা হতো। সেই দিনগুলো হারিয়ে গেলেও বন্ধুত্ব ঠিকই টিকে আছে। জানি না মৌনতা আমাকে নিয়ে ঠিক কতটুকু বলেছে ওকে। তবে, আমার নিজের কথা কাউকে বলতে ভালো লাগে না। একদমই না।

এরচেয়ে মনে মনে তার সাথে কথা বলা ভালো। আমি কি তার সাথে কথা বলতে যাব? একদিন সরাসরি সামনে গিয়ে বলে বসব, ‘আমাদের কথা বলা উচিৎ।’ সে নিশ্চয়ই চোখেমুখে বিশাল বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে ফেলবে। আর আমাকে পালানোর পথ খুঁজতে হবে। নাকি কোনো পাঞ্চ লাইন দিয়ে জিজ্ঞেস করব, ‘হ্যালো, তুমি কি কোনো বিখ্যাত ব্ল্যাক কফি? তোমাকে ভাবলে তাহলে আমার ঘুম আসে না কেন?’ ছিঃ! খুব বাজে ছিল। এসব কেন ভাবছি? বাদ, সব বাদ। বরং পরিকল্পনা করি, আজকে আগে আগে ঘুমিয়ে যেতে চেষ্টা করব। তবে তা সম্ভব হয় না, আমাকে ভুল প্রমাণ করে, ঠিক মধ্যরাতে জ্যাক ফোন করে। ওর কলটা ধরব না ভেবেও ধরে ফেলি।

- ‘তুই কী কিছু বলবি আমাকে আর ওই বিষয়ে?’ ফোন করেই গম্ভীর স্বরে বলে জ্যাক।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকি।
- ‘কিছু তো বল। হালকা লাগবে। ওই বিখ্যাত সিনেমাটা দেখিসনি, যেখানে প্রশ্ন করা হয় মানুষ নিজের গোপন কথা কাউকে বলতে না পারলে কী করবে? উত্তর দেওয়া হয়, শহরের শেষ প্রান্তের কোনো গাছের ভেতর গর্ত করে, সেখানে ফিসফিস করে নিজের মনের কথা বলে গর্তটা মাটিচাপা দিয়ে বন্ধ করে দিবে। তোর তো এত খারাপ দিন আসেনি। আমাকেই একটা গাছ হিসেবে ধরে নিয়ে কিছু তো বলতে পারিস।’ বলতে বলতে জ্যাকের কণ্ঠ নরম হয়ে আসে কিছুটা।
আমিও ঢোঁক গিলি, সময় নিই। তারপর বিড়বিড় করে বলি, ‘আমার রোজকার কাজে সে নিয়ত আসা-যাওয়া করতে থাকে।’
- ‘আর?’ প্রশ্ন করে জ্যাক।

আমি চুপ করে যাই। আর মনে মনে ভাবি, এভাবেই তাকে নিয়ে প্রাণপণে অভ্যস্ত হতে চেষ্টা করছি। যেভাবে আমি প্রথম অভ্যস্ত হয়েছিলাম যখন আমাকে মাইনাস পাওয়ারের চশমা নিতে হয়েছিল। আগে আমি ভাবতাম চশমা একটা কদাকার বস্তু, মানুষের চোখ হবে বাহুল্য ছাড়া। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, চশমাটা আমার চেহারায় মানিয়ে গেল। গত পনের বছরে সেই বাহুল্যকে আমি আপন করে নিয়েছি। তবে আমার চশমা আমাকে পীড়া দেয় না। সে দেয়। আমার খালি মনে হয় সেও আমাকে দেখে, খালি দেখে। সে কি অন্যজগতে আটকা পড়া মানুষ? কথা বলতে পারে না? তবে সে কথা বলতে আসলে হয়তো আমি ইশারায় বলতাম, ‘সসসসস...’ তারপর তার কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম কয়েক ঘণ্টা। আমাদের হয়তো তখন কথা হতো, কিন্তু হতো না কোনো শব্দ। এমন যোগাযোগ চলত যা শুধু আমরাই শুনতাম।

- ‘ হ্যালো, শুনতে পাচ্ছিস? কথা বলছিস না কেন?’ ফোনের অন্যপাশ থেকে ডাকতে থাকে আমার চিন্তিত বন্ধু। আমি তবুও চুপ করে থাকি।
- ‘আমার সাথে কথা বল। মৌনতা আমাকে সব বলেছে। এসব ফ্যান্টাসি থেকে বের হয়ে আয়।’ ঠান্ডা স্বরে বলে ও।
- ‘কী বলেছে?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করি আমি।
যা বলার বলেছে, ‘তুই হয় আমাকে সব বলে নিজেকে হালকা কর। নয়তো মাথা থেকে সব ঝেড়ে দে। এসব কিছুই নেই।’
- ‘নেই মানে?’ খেই হারিয়ে ফেলার মতো প্রশ্ন করি আমি।
- ‘নেই, এমন কোনো মানুষ নেই। ও বাসাটা খালি। বহুদিন থেকেই। মৌনতা আগেই বলেছে তোকে, তুই একাই নানাকিছু ভেবে যাচ্ছিস। এসব তোর নিজের প্যারাকজমের প্যারা। নিজের কল্পজগত। বাদ দে। আমি জানি চেষ্টা করলেই পারবি।’

আমার মাথায় উঠে যায় ঝড়। একটা তুমুল কালো মেঘময়, বিষণ্ণ ঝড়। সেই ঝড়ে জ্যাকের কথা আবছা হয়ে আসে। আমি শুধু ভাবি, আমার আজকাল খুব ঘুম পায়, কিন্তু শান্তিমতো ঘুমাতে পারি না। সেকি শিশুর মতো ঘুমায়? আমি কল্পনা করতে চেষ্টা করি এবং বুঝি, যে যাই বলুক, বোধ থেকে বোধের, সুর থেকে সুরের আর ঠিক-বেঠিকের সীমারেখা পেরিয়ে যে গাঢ় সবুজ মাঠ আছে, সেখানে তার সাথে আমার যোগসূত্র। সে আমাকে দেখেছে কিন্তু আসলে শুধু আমাকে দেখেনি, সে আমার ভেতরের বইটার হার্ড কভারে হাত বুলিয়ে পড়ার জন্য পাতা উলটে ফেলেছে। আর পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত লকারে রেখে দেওয়া সেই বই কেউ দেখে ফেলেছে বুঝতে পেরে আমি ভেতরে ভেতরে থতমত খেয়ে কেঁপে উঠেছি। আমি তার হাত ধরতে চাই চাহিদা থেকে না, তার সাথে যোগাযোগ করতে, অনুভব করতে। কপালের সাথে কপাল ঠেকাতে চাই চিন্তাগুলো ছড়িয়ে দিতে। একটা মন্থর, স্পন্দিত নদীর মতো।

- ‘হ্যালো... তুই ঠিক আছিস? কথা বল প্লিজ।’ জ্যাক আবার ডেকে যায়।

আমি কিছুই শুনি না। হ্যাঁ, হয়তো ওরা ঠিক। আসলে হয়তো তার সাথে আমার কিছুই নেই। আসলে এই পৃথিবীতে সে নেই। মৌনতার উল্টা দিকের বাসাটা বরাবর খালিই ছিল। সেখানে গেলে সবাই হয়তো দেখতে পাবে, ‘ভাড়াটিয়া চাই’ নামে ঝুলছে বিবর্ণ কোনো সাইনবোর্ড। এইসব আমার ঘুণে ধরা মস্তিষ্কের ‘প্যারাকজম’। আমার লিখতে না পারা ভালোবাসার ১০০ সনেট। আমার আশ্চর্য সাম্রাজ্য, সুখী ফানুস। তাতে কী? আমার জন্য তো এসব সত্যি। ভীষণ সত্যি। আর তাই এই প্রত্যাখ্যাত হবার খালি খালি ভাব নিয়ে যখন আমি হাওয়ায় ভেসে যাওয়া কোনো বিষণ্ণ শুকনো পাতার মতো উড়তে থাকি, তখনই জেনে যাই আমাদের মাঝে যোগসূত্রটা আসলে কোথায় এবং কিভাবে। জেনে যাই, বনভূমি লোকালয় থেকে কেন এত দূরে থাকে। হ্যাঁ, ঠিক সে কারণে, সেই একই কারণে সে আর আমি পাশাপাশি থাকি; কাছাকাছি থাকি…

ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আমাকে আমার কাছের কেউ বারবার ডেকে যায়। আমি উত্তর দিই না। বরং, দূরের কারো জন্য আমি সবকিছু ছেড়ে তার সাথেই জলের মতো ঘুরতে থাকি।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;