মোহন, কয়েকটি রাত, অশ্বথগাছ ইত্যাদি



ফারুক আহমেদ
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

রাত.
এত রাতে কারো সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নাই। তবু হাটবার বলে মোহনের মনে হয় নিশ্চয়ই দলছুট কেউ একজনের দেখা পাওয়া যাবে। সে সিগারেটটা হাতে ধরে (যেহেতু সে ভুল করে আগুন আনে নাই) খানিকটা আশার আলো জাগিয়ে রাখে। এবং আশ্চর্যজনকভাবে কিছুক্ষণের মধ্যে একজন হাজির হয়ে মোহনের আশার সলতেটা জ্বালিয়ে দেয়। লোকটাকে দেখে মোহন খুশি হয়ে ওঠে। সে প্রথম দেখতে পায়, অন্ধকারের ভেতর দিয়ে একটা আলো হেঁটে হেঁটে আসছে। এ আসার গতিটা এমনই নিশ্চিত যে, এ কোনো জোনাকি পোকার নয়, মানুষের। ফলে আলোটা তার কাছাকাছি হলে সে বিড়বিড় করে বলে, আগুনটা দেওয়া যাবে?
মোহনের কথাগুলো লোকটার কানে পৌঁছাল বলে মনে হয় না। লোকটা মোহনকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে থাকে।
মোহন পুনরায় বলে, আগুনটা দেওয়া যাবে?
এবার মনে হয় শুনতে পেল। লোকটা পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে মোহনের দিকে সিগারেটটা বাড়িয়ে বলে, নিশ্চয়ই।
সিগারেটটা নিতে গিয়ে মোহন টের পায়, লোকটার হাত কাঁপছে। কাঁপছে যে তা নিশ্চিত। আর না হয়, হাতে ধরে রাখা সিগারেটটা বাড়িয়ে দিতে গিয়ে নিচে পড়ে যাবে কেন? মোহন অবশ্য উঠিয়ে নেয়, নিজেরটায় ধরিয়ে ফেরত দেয়। তারপর খুব মৃদু স্বরে ধন্যবাদ জানিয়ে অশ্বথগাছের দিকে এগুতে থাকে।
ধন্যবাদের উত্তরে লোকটা কথা বাড়ায় না। ঘুরে সোজা হাঁটা দেয়। কয়েক সেকেন্ডের দেখায় লোকটাকে মোহনের মনে হয় কেমন চটপটে, অস্থিরচিত্তের। পোশাক-আশাকে অবশ্য শহর থেকে আসা লোক বলেই মনে হয়।

অনেকক্ষণ ধরে সিগারেট টানে। একটার আগুন থেকে আরেকটা। মাথার উপরে থাকা অশ্বথপাতায় বাতাস এসে মৃদু কলকাকলির জন্ম দেয়। সঙ্গে যোগ হয় জেগে ওঠা দু-একটা পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ। ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনে সে গাছের এদিক-সেদিক চোখ ঘুরিয়ে উৎস খোঁজার চেষ্টা করে। অন্ধকারের কারণে জায়গাটা ঠিক ঠাওর করতে না পেরে সামনে কী আছে দেখার চেষ্টা করে। অনেকক্ষণ এভাবে কাটিয়ে মোহন সড়ক থেকে নেমে পড়ে। ধানক্ষেতের আইল ধরে গ্রামের দিকে হাঁটা দেয়। গ্রামের পথটায় পৌঁছামাত্র একটা টর্চের আলো এসে মুখে পড়ে। তারপর আরেকটা টর্চের আলো। সে দাঁড়িয়ে পড়ে। এতে লাইট দুটা নিভে গিয়ে একসঙ্গে জ্বলে ওঠে। শেষবার জ্বলে ওঠার সঙ্গে লাইট দুটা একটু এগিয়ে এসেছে বলেও মনে হয়। এগিয়ে এসে নিভে যায়। নিভে গিয়ে আর জ্বলে না। মোহন দাঁড়িয়ে আলোর উৎসের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো নিভে যাওয়ার পরও সে দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করে। কিছু ঘটছে না দেখে মোহন আলোর উৎসের দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করে।

বাড়িটার চারদিক নানান গাছ ঘিরে রেখেছে। দেখে মনে হয় গাছগুলো গৃহপালিত। গাছের ছোট, বড়, লম্বা, চিকন এরকম নানা পাতা অন্ধকারের ভেতর থেকে তাকিয়ে আছে। দেউরি জড়িয়ে ধরে রাখা সন্ধ্যামালতির গাছটা একটা প্যাঁচানো রহস্যের জন্ম দিয়ে পড়ে আছে। এভাবে যথার্থ অনুগতের মতো রাত জেগে কর্তার বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। মোহন খুব মৃদু পায়ে বাড়ির বাইরের উঠোনে এসে দাঁড়ায়। সামনের ঘরে আলো জ্বলছে। অবশ্য ঠিক স্পষ্ট বোঝাও যাচ্ছে না। সে হেঁটে হেঁটে ঘরটার আরো কাছাকাছি এসে চুপচাপ দাঁড়ায়।

কোনো শব্দ নেই। এমনিতে শিয়ালের হুক্কাহুয়া চিৎকার নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে তছনছ করে দেয়। কিন্তু আজ সব সুনশান। এরকম অস্বস্তিকর নীরবতার ভেতর মোহন কান পেতে রাখে। কোথাও একটা শব্দ—পাতাটির নড়ে ওঠা, পাখির ডানা ঝাপটানো, সামনের পুকুরে একটা মাছের ঘাঁই অথবা, অথবা...। কোন একটা শব্দের জন্য মোহন অস্থির হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য মোহনের আশা পূরণ হয়। শেষ পর্যন্ত একটা নারীর মিহি হাসি মোহনের কানে এসে আছড়ে পড়ে। এতে মনে হয় নিশুতিরাত একটা হাসির সূত্র ধরে প্রাণ ফিরে পেল। এরপর, কাছের কোথাও থেকে পাখির ডানা ঝাপটানো, শিয়ালের হুক্কাহুয়া, বাতাসে পাতার বাড়ি খাওয়া—এমন বিচিত্র আওয়াজ মোহনের কানে আসে। সে এসব শব্দের উৎস (যেসব শব্দের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত একটি মিহি হাসি) নিয়ে গাছপালাঘেরা বাড়ির বাইরের উঠোন ত্যাগ করে। তার মনে হয় এমন রহস্যের ভেতর আরো দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা কোনোমতেই আর সম্ভব নয়।

যে আইল দিয়ে মোহন সড়ক থেকে গ্রামে প্রবেশ করেছিল, সে আইল পর্যন্ত হেঁটে এসে একটু থামে। তারপর সড়কের দিকে হাঁটতে শুরু করে। গ্রামে যাওয়ার পথে যেখানে ওর ওপর টর্চের আলো এসে পড়েছিল, সেখানে পৌঁছামাত্র শিকারী চিতার মতো আলোটা আবারও শরীরে ঝাপিয়ে পড়ে। ‘ক্যালা’, মোহনের গলাটা একটু চড়া বলেই মনে হয়। অথবা রাত গভীর বলে শব্দটা একটু রগড়ে গেছে। যাই হোক, ‘ক্যালা’ বলার পর আলোটা নিভে যায়। ফলে মোহন সেদিকে আর ভ্রুক্ষেপ না করে দ্রুতপায়ে বটগাছের নিচে এসে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে অশ্বথগাছটাকে ইনিয়ে বিনিয়ে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু অন্ধকারে মোহনের এই দেখার চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তারপর কী জানি হয়। অন্ধকার হাতড়ে একটা ঢিল খুঁজে বের করে। তারপর ঢিলটা বটগাছের দিকে ছুড়ে মেরে বলে, ক্যালা। ঢিল ছোড়ায় অশ্বথগাছে পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। এতে মনে হলো মোহনের উৎসাহ বাড়ে। সে আবার হাতড়ায়। কিন্তু এবার আর কিছু পায় না। ফলে বটগাছের নিচে এসে আঙুলে চেপে রাখা সিগারেটটা বটগাছের দিকে ছুড়ে মারে, তারপর পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে এনে তাও বটগাছের দিকে ছুড়ে মেরে বলে, ক্যালা। বিড়বিড় কর বলে, ক্যালা, ক্যালা...

দিন.
হৈ-চৈ হচ্ছে, খানিকটা চোটপাটও। পাশের ঘর থেকে তিন-চারটা কণ্ঠ ঘুরেফিরে উঠে আসছে। চোটপাটের এমন আওয়াজে মোহন ঠিকে থাকতে না পেরে বিছানায় উঠে বসে। চোটপাটের মধ্যেও বেশ অনেকক্ষণ ঘাপটি মেরে পড়েছিল। কিন্তু এমন চিৎকার-চেঁচামেচি কাহাতক সহ্য করা যায়। এর মধ্যে যার কণ্ঠ বেশি শোনা যাচ্ছে, তিনি হলেন কাওসারের বড় ভাই মহিউদ্দিন।
‘দ্যাউখাইন জমি আমার, খায় হে, তা ম্যালাদিন, ১৫ বছর অইবই। হের বাপের আমল থাইক্যা। এখন ফেরত চাই, দিত না, কেরে? কউহ্যাইন, দিত না কেরে?
কথা শেষ করে বোধহয় কিছু সময়ের জন্য উত্তরের অপেক্ষা করে। কিন্তু কোনো হা বা না শোনা যায় না। আবার মহিউদ্দিন, ‘আপনে যদি আমার লগে থাকুইন, তাইলে হের জমি আমি নিয়ামই। লাঙ্গল লইয়া জমিতে নামলে ঠেংডি ভাইঙ্গা দিতাম না।’
এবার মোহনের বড় ভাই সুলতানের গলা, মামু-ভাইগনার ব্যাফার, মারতে তো ফারবেন না।
‘মারার কাম নাই, একটু ডর দেখাইলেই ও আইগ্যা দিব।’

এরপর গলাটা নিচে নেমে যায়। ফিসফিস করে কিছু একটা বলে। এতে মোহন স্বস্তি পায়। আর যাই হোক চোটপাট তো শুনতে হবে না। তবে দুপুর প্রায় হয়ে গেছে বলেই মনে হয়। ঘরের বেড়ায় সূর্যের যে আলো পড়েছে, তাতে অনেক তেজ।

মোহন বিছানা থেকে উঠে পড়ে। টিউবওয়েলের সামনে রাখা বদনায় পানি ভরে বাড়ির পেছন দিকে হাঁটা দেয়।

রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে পায়, আম্বিয়া বেগম ঘরের এককোণে বসে রান্না তদারকি করছে। মোহনকে দেখে আম্বিয়া বেগম বলে, কিতা?
মোহন কোন উত্তর দেয় না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এতে আম্বিয়া বেগমের গলায় ঝাঁঝ উঠে আসে, তোর তো খাওন লাগে না। বাতাস খাইলেই অয়।
মোহন চুপচাপ দাঁড়িয়েই থাকে। মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না।
‘বহ।’
আম্বিয়া বেগম মোহনের দিকে একটা ছোট চকি এগিয়ে দেয়।
মোহন চকিটা সামনে পেয়ে তাতে বসে পড়ে।
‘কাজল চ্যারাডাটারে ভাত দে।’
আম্বিয়া বেগমের নির্দেশ পেয়ে কাজের মহিলা এক প্লেট গরম ভাত মোহনের সামনে বাড়িয়ে দেয়।
প্লেট থেকে ধোঁয়া উড়ছে। মোহন প্লেট সামনে রেখে বসে থাকে। কাজের মেয়েটা ভাতের মধ্যে একবাটি তরকারি ঢেলে দেয়।
আম্বিয়া বেগম পাখা হাতে ছেলের প্লেটে বাতাস করে।
‘নে ঠান্ডা অইছে, খাইয়া নে।’
মোহন কোনো কথা না বলে মনোযোগ দিয়ে খেতে শুরু করে।
‘তুই কি পড়ালেহা ছাইড়া দিসছ?’

মায়ের কথায় সামান্য সময়ের জন্য মোহন প্লেট থেকে মাথা তোলে। ওর মাথা ওঠানো দেখে মনে হয় কিছু একটা খুঁজছে। পরক্ষণেই অবশ্য মাথা নিচু করে আবার খেতে শুরু করে।

মোহনের কোনো উত্তর না পেয়ে আম্বিয়া বেগম চুপচাপ বসে থাকে। কিছুক্ষণ নীরবতার পর আম্বিয়া বেগমের কথা আবার শুরু হয়, তোর জীবন কি এইবাবেই যাইব?
মোহনের খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। সে মাথা তুলে বলে, পানি দিতে কও।
আম্বিয়া বেগম বলে, কাজল হানি দে।
‘কিছু একটা ক?’
‘কিতা কইতাম?’
‘তুই করবিটা কী?’
মোহন মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর সামনে রাখা গ্লাস থেকে প্লেটে পানি ঢেলে হাত ধোওয়ায় মন দেয়।
‘পড়ালেহা আর করবি না।’
‘ভালালাগে না।’
‘কয়দিন আগেও তো এমনডা আছিলি না।’
‘তুমার পুলাডিরে কও ভালা অইয়া যাইতে।’
‘তুরে কী কইতাছি, হের উত্তর দে।’
‘খালি মানুষের জমি দখল করে, মারে, আটকায়। তুমি কিছু কইতে পারো না?’ আম্বিয়া বেগম চুপ।
মোহন কাজের মেয়ের দিকে হাতের গ্লাসটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, পানি দে।
কাজল নামের মেয়েটা নিঃশব্দে মোহনের গ্লাস টেনে নিয়ে তাতে পানি ভরে মোহনের দিকে ঠেলে দেয়।

রাত.
প্রতিদিন সন্ধ্যা হতেই মোহন দক্ষিণপাড়ার দিকে হাঁটা দেয়। গ্রামে থাকলে এটা তার নিত্যদিনের কাজ। ওখানে পাড়ার অন্য বন্ধুদের সঙ্গে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে, কার্ড খেলে বাড়ি ফেরে। কোনোদিন ফেরেও না। কিন্তু আজ ভর সন্ধ্যায় বিছানায় শুয়ে আছে, চোখের সামনে বই ধরা। চোখের সামনে বই ধরা থাকলেও খুব পড়ছে, তা নয়। অনেকটা অস্থির, বইয়ের একেকটা পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছে অনেক পর পর। এভাবে বহুক্ষণ বিছানায় শুয়ে থেকে উঠে বসে। পাশে রাখা ঘড়িটা হাতে পরে নেয়। টেবিলের ড্রয়ার থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে পকেটে গুঁজে বেরিয়ে পড়ে।

বেরিয়ে আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগোয়। ভীষণ গরম। এই রাতের বেলায়ও ধরধর করে ঘাম পড়ছে। মোহন হেঁটে হেঁটে তাল গাছটার নিচে এসে দাঁড়ায়। কোথাও ধপাস করে কিছু একটা পড়ার শব্দ হয়। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে ফুকতে থাকে।
‘কেলা?’
হঠাৎ লাইটের আলো মোহনের মুখের ওপর এসে পড়ে।
মোহন অনেকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সিগারেটটা পেছন দিকে সরিয়ে নেয়। পরমুহূর্তে অবশ্য ধাতস্থ হয়ে সে আগের মতো সিগারেট টানায় মনোযোগ দেয়।
এতে লাইটটা মোহনের মুখের ওপর থেকে সরে যায়।
সুলতান জিজ্ঞেস করে, এইহানে কী করছ।
মোহনের কানে কোন কিছু ঢুকল বলে মনে হয় না। সে সিগারেটে টান দিতে থাকে। ফলে মুহূর্তের মধ্যে আলোটা সামনের দিকে চলতে শুরু করে। এর সঙ্গে একটা রগড়ানি শোনা যায়। যা অস্পষ্ট, কিন্তু রগড়ানি বলেই মনে হয়। মোহন আরো কিছুক্ষণ সিগারেট ফোকে। খুব গরম। আবার একদঙ্গল বাতাস গরমটা একটু থামিয়ে যায়। একটু বাতাস বাড়লেই মাথার উপর তালগাছের পাতা ঝনঝন আওয়াজ করে।

তালগাছের নিচ থেকে বেরিয়ে সে সড়কের দিকে এগোয়। যেখানে ঝোপ থেকে হাটবারে টর্চের আলো বেরিয়ে আসে, আজ সেখানে জোনাকিপোকার দল হাট বসিয়েছে। মোহন সড়কে উঠে এসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে মোটে নয়টা। আজকে তো আর হাটবার না। এ কারণে নয়টা বা বারোটার মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। মোহন অবশ্য এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না। সে সড়ক দিয়ে দক্ষিণ দিকে হাঁটতে শুরু করে। অশ্বথগাছটা পেছনে ফেলে হাঁটতে থাকে।

সড়কটার একপাশে গ্রাম। গ্রামের বাড়িগুলোর মুখ সড়কের দিকে ফেরানো। বাড়িগুলো শেষ হয়ে গেলে ফসলের ক্ষেত, এরপর সড়ক। সড়কের অন্যপাশে ধানক্ষেত, বিল, একাকার হয়ে আছে। অবশ্য এই রাতের বেলায় কোনো কিছুই স্পষ্ট নয়। মোহন তার ডানপাশে ছাতার মতো দাঁড়িয়ে থাকা বহু বছরের পুরনো জামগাছটা পেরিয়ে যায়, কারো সঙ্গে দেখা হয় না। তারপর সড়ক ঘেঁষে যে পুকুরটা পাড় হয়ে যায়, তাতেও কারো দেখা মেলে না। এভাবে অনেক পথ হেঁটে মোহন ফাইজুলদের বাইরের উঠোনে এসে দাঁড়ায়। একটা হারিকেন জ্বালিয়ে ফাইজুল আর কাওসার খেলছে, পাশে দাঁড়িয়ে তারেক ওদের খেলা দেখছে।

মোহনকে দেখে ওরা হৈহৈ করে ওঠে, আয় আয়। তোর লাইগ্যা খেলাডা হইতাছে না।
মোহন ক্যারামের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
‘ল তাইলে শুরু করি, তারেক তাগিদ দেয়।’
মোহন কোনো কথা বলে না।
মোহন আর তারেক একদলে ভাগ হয়ে যায়, কাওসার আর ফাইজুল আরেক দলে।
‘৫০ ট্যাহা।’
বলে ফাইজুল পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেয়। এর উত্তরে কেউ কিছু বলে না। বোর্ডে গুটি সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
খেলা শুরু হয়ে যায়।
মোহনরা প্রথম গেইম হেরে যায়, আরেকটায় হারলে টাকাটা কাওসার ও ফাইজুল জিতে নেবে।
মোহন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাড়ে ১০টা।
‘আর খেলতাম না।’ বলে মোহন বোর্ডের গুটি এলোমেলো করে দেয়।
হঠাৎ করে মোহনের এমন গোয়ার্তুমিতে কাওসার ক্ষেপে যায়, খেলতি না কেরে, হাইরা যাইতাসছ বইল্যা গুটিগুলা এইবাবে আওলাইয়্যা দিবি।
মোহন কোনো কথা না বলে পকেট থেকে ৫০ টাকা বের করে বোর্ডের ওপর ছুড়ে মারে। তারপর নিঃশব্দে সড়কের দিকে হাঁটা দেয়। মোহনের হঠাৎ এমন চলে যাওয়া দেখে পেছন থেকে কাওসার ডাকতে থাকে, ল, ল ট্যাহা লাগব না।
মোহন অবশ্য তাতে কান দেয় না, সে সড়কে উঠে উত্তরমুখী হয়ে হাঁটতে শুরু করে।

মোহন আজ বাড়িটার বাইরের উঠোনে না দাঁড়িয়ে সোজা ভেতরে ঢুকে যায়। গতকালের থেকে আজকে রাত অনেক কম। তবে আজ কোনো ঘরে আলো নেই। বোধহয় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। মোহন নিঃশব্দে পূর্ব দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা আধাপাকা ঘরটার দক্ষিণ কোনে এসে কয়েক মিনিট জিরিয়ে নেয়। তারপর পাশের দরজায় দুবার টোকা দিয়ে একটু সরে আসে। টোকা দিতে না দিতেই দরজা খুলে যায়। মনে হয় অনেকক্ষণ ধরে কেউ কান পেতে ছিল। মোহনের মন হঠাৎ ভালো হয়ে যায়। এমনকি দরজা খুলে যাওয়ার পরমুহূর্তে জুঁই বেরিয়ে আসবে—এমনটাই আশা করে ছিল। কিন্তু দরজা দ্রুততার সঙ্গে খুলে গেলেও ঘর থেকে কেউ বেরিয়ে আসে না। বেশ কিছুক্ষণ এরকম নীরবতা চলে। খুব বেশি সময় না হলেও মোহন এই সামান্য সময়ের ভেতর একটা বিরাট গোলকধাঁধায় পড়ে যায়। সে বুঝে উঠতে পারে না, এখন তার কী করা উচিত। এমন একটা ভাবনা মোহনকে যখন এপাশ-ওপাশ টানছে, তখন ভেতর থেকে জুঁইয়ের কণ্ঠ শোনা গেল, ভেতরে এসো।

জুঁইয়ের এমন আহ্বানে মোহন খুব অবাক। সে কী করবে বুঝে উঠতে না পেরে ওখানেই স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। মনে হয়, ইচ্ছা করলেও কোনোমতেই পা নাড়ানো তার পক্ষে সম্ভব হবে না। মনে হয় বহুদিনের অনভ্যস্ততা তাকে একটা স্থির বিন্দুতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

জুঁই বেরিয়ে এলে মোহন স্থির তাকিয়ে থাকে। জুঁই বেরিয়ে এসে মোহনকে দেখে দাঁড়ায়। মনে হয় চিনে নিতে একটু সময় নিচ্ছে। তারপর হাত ধরে টেনে ঘরের ভেতর নিয়ে যায়।

মোহন দেখে সবকিছু সেই আগের মতোই আছে। অবশ্য এমন কী সময় পেরিয়েছে, মাত্র তো ছয়টি মাস। তাতে আর কী বদলাবে? বদলায়নি। ঘরটায় এককোনে রাখা জুঁইয়ের পছন্দের গাছটা সেরকমই আছে। প্লাস্টিকের, কিন্তু মোহনের এখানে এলে সব সময় মনে হতো, এ জুঁইয়ের মতোই জীবন্ত।
‘কী ভাবছো?’
মোহন স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে।
‘না, কতদিন পর তোমার কাছে এলাম।’
জুঁই শব্দ করে হাসতে গিয়ে থেমে যায়। মোহনের মনে হয়, গতকাল রাতে যে হাসিটা শুনেছিল, তার সঙ্গে এ হাসির মিল খুব। তারপরই সে অবশ্য সন্দিহান হয়ে ওঠে, জুঁই যে হাসল এ হাসি কতদিন ধরে মোহন শুনে আসছে। এই হাসির সঙ্গে গতকাল রাতের হাসির মিল কোথায়? এসব ভাবনা রেখে মোহন সোজা পথ হাঁটে—
‘জুঁই, তুমি গত ৬ মাস কই ছিলা?’
মোহনের কথায় জুঁই বিরক্ত বলেই মনে হয়।
‘নেত্রকোনা।’
‘নেত্রকোনা মানে?’
‘মুর্শেদা আপার বাসায়।’
‘গ্রামের লোক কিন্তু এই কথা বলে না।’
‘আমার কথা শুনার জন্য তুমি কি গ্রামের লোকদের জিজ্ঞেস করো?’
‘তা কেন?’
‘তাহলে আমারে খুঁজে দেখছিলা?’
‘তোমারে খোঁজে মুর্শেদা আপার বাসায় গেছিলাম।’
‘কবে?’
‘বেশ কয়বার।’
‘কই আমার সাথে তো দেখা হইল না।’
‘ভেতরে যাই নাই। বাসার সামনে থাইকা কয়েকদিন ঘুইরা আইছি।’
‘মোহন, সবাই বলে তুমি তুখোড় ছাত্র, আমি বলি, তুমি তুখোড় গাধা।’
এই কথার পর মোহন হঠাৎ চুপসে যায়। হারিকেনের আবছা আলোয় ঠিক বোঝা যায় না মোহনের মুখ লাল হয়ে উঠল কিনা।
‘তুমি নাকি পড়াশোনা বন্ধ করে দিছো?’
মোহন চুপ করেই থাকে।
‘তুমি আমাকে বিয়ে করবে বলছিলা, ওই ইচ্ছা কি এখনো আছে?’
কথা কটা বলে জুঁই হাসতে থাকে।
এমন প্রশ্নে মোহন আগের মতোই চুপ করে থাকে।
‘এটা হচ্ছে তোমার আরেক সমস্যা। তোমার ভাইগুলার ঠিক উল্টা হইছো তুমি।’
‘আমার ভাইরা এইখানে আসলো কিভাবে।’ মোহন কথা বলে।
‘ভাইরা আসে নাই। কিন্তু ভাইদের ভাই তো আসছে।’
মোহন আবারও আগের মতো চুপ হয়ে যায়। দুজন বেশ কিছুক্ষণ একটা নীরবতার ভেতর ডুবে থাকে। তারপর জুঁই বলে, তুমি এখন যাও।

রাত (দ্বিতীয় ভাগ)
মোহন সড়কে এসে দাঁড়ায়। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ১১টা পেরিয়ে গেছে। এখন কোনো দিকে যাওয়ার নাই। ফাইজুল, তারেক সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই। নিজেকে মোহনের বেশ অসহায় মনে হয়। ফলে ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও সে বাড়ির দিকে রওনা করে। কিন্তু বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পায় চোখের সামনে সড়ক এসে হাজির। কখনো কখনো মোহনের এরকম হয়।

হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে শোনে জুঁই নাই। নাই মানে ওই বাড়ির রুস্তমের বউ জানাল, জুঁই নাই। পালাইয়া গেছে। রাতে উঠেছিল রুস্তমের বউ, জঙ্গলে গিয়ে কাজ সারতে। তখন সে দেখতে পায়, একটা লোকের সঙ্গে জুঁই সড়কের দিকে উঠছে।

অশ্বথগাছের পাতার ভেতর থেকে ডানা ঝাপটানোর শব্দ মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসছে। মোহন ঘড়ির দিকে তাকায়। পাখিরা তাদের নিয়মের ব্যত্যয় ঘটায় না। তারা প্রতিদিন খুব সকালে বেরিয়ে যায়। সারাদিন খাদ্য অন্বেষণ করে। নানা জায়গা ঘুরে সন্ধ্যায় সারাদিনের স্মৃতি নিয়ে ফিরে আসে, রাতে ঘুমানোর চেষ্টা করে বা সঙ্গম করে, ডানা ঝাপটায় ইত্যাদি। এরকম অনন্তকাল ধরে চলে আসছে। আসুক, তাতে মোহনের কী। সে নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করে, কীরে পাখি বিশেষজ্ঞ হয়ে যাাচ্ছিস নাকি।

অনেকক্ষণ পর মনে হলো সড়ক দিয়ে কেউ আসছে। কেউ আসছে তা টের পেয়ে মোহন ওর হাতে থাকা সিগারেটটা ফেলে দেয়। সঙ্গে একটু যেন সতর্ক হয়ে ওঠে। মিনিটখানেক অপেক্ষার পর লোকটা মোহনের কাছে পৌঁছালে মোহন লোকটার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।
‘আগুন হইব?’ বলে অনেকটা পথরোধ করে দাঁড়ায় মোহন।
‘জ্বি।’
লোকটা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পকেট থেকে ম্যাচ বের করতে উদ্যত হয়।
তখন মোহনের খেয়াল হয়, তার হাতে সিগারেট নাই। সে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে দেখে প্যাকেটেও নাই। এতে মোহন নয়, মনে হলো লোকটাই খানিক বিব্রত। সে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে মোহনের দিকে এগিয়ে দেয়। মোহন একটা সিগারেট টেনে নিয়ে জ্বালায়।
‘থ্যাঙ্কস...স।’ ধন্যবাদটা দীর্ঘ হয়েই বের হয় মোহনের মুখ থেকে।
তারপর ম্যাচটা লোকটার হাতে গুঁজে দিয়ে মোহন সামনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। লোকটা অবশ্য কথা বাড়ায় না। সে হাঁটতে শুরু করে।

লোকটার চলে যাওয়ার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে কয়েক পা এগোয়, তারপর দাঁড়িয়ে পড়ে। ওদিক থেকে ঘুরে সে আবার অশ্বথগাছের নিচে চলে আসে। হাতে থাকা ফাঁকা সিগারেটের প্যাকেটটা গাছের দিকে ছুড়ে মেরে বিড়বিড় করে। তারপর হাতে সিগারেটটা অশ্বথ গাছের দিকে ছুড়ে মারে। এই ব্যাপারগুলো এতো নিস্তরঙ্গ যে, এতে গাছের ভেতর থেকে পাতা বা পাখিদের কোনো গুঞ্জরনও বেরিয়ে আসতে শোনা যায় না।

দিন.
মোহন ঘুম থেকে উঠে দেখে বিকাল হয়ে গেছে। এটা অবধারিত, না জাগা পর্যন্ত কেউ ডাকবে না। ঘুমের মধ্যে যদি মরে পড়ে থাকে, তাহলে? কিচ্ছু যায় আসে না। এসব ব্যাপার নিয়ে সে অবশ্য ভাবতেও চায় না। পেট ক্ষুধায় চোচো করছে। সে প্রথমে বালিশ টেনে নেয়। কিন্তু তাতে কাজ হয় না। ক্ষুধাটা অস্বাভাবিক রূপ নিয়েছে। উঠে পড়ে। কোনোমতে হাতমুখ ধুয়ে মোহন রান্নাঘরের দিকে ছোটে। ওর জন্য কিছু খাবার রাখা থাকে সবসময়। সে আশায় পুরো রান্নাঘর তন্নতন্ন করে খোঁজে। দুয়েকটা পাতিলের তলানীতে কিছু তরকারি পড়ে থাকলেও ভাতের পাতিল ফাঁকা। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে আসে। একবার মনে হয় মার কাছে গিয়ে বলবে। কিন্তু এ কোনোদিনই ওর হয়ে ওঠেনি। আজকেও না। ঘড়িটা হাতে পরে নেয়। ক্ষুধা সাপের মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে সারা পেট ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে ক্ষুধাটাকে কোনোমতেই পাত্তা দিতে চায় না। তার মাথাজুড়ে গতরাতের সড়ক, বটগাছ, একটা মানুষ স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট রেখায় একটা দাড়িয়াবান্দার ঘর তৈরি কর যাচ্ছে।

মোহন দক্ষিণ দিকের জঙলাটা পার হয়ে জুঁইদের বাড়ির উঠোনে উঠে আসে। জুঁইদের উঠোনে কয়েকটা ছোট ছোট ছেলেমেয়ে হৈহৈ করে এদিক-সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। মোহন বাচ্চাগুলোকে পাশ কাটিয়ে ভেতরের উঠোনে চলে আসে। ভেবেছিল ওকে দেখে কেউ না কেউ বেরিয়ে আসবে। কিন্তু সেরকম কারো মুখোমুখি হতে হলো না। এমনকি কালাচান মিয়া, ওই কাল্লুটা, যে সারাদিন বাইরের ঘরের বারান্দায় বসে থাকে দুটা লাল চোখ নিয়ে—সেও নাই। বস একসঙ্গে হাগতে গেছে, বিড়বিড় করে বলে মোহন হেসে ওঠে। বাড়ি ফাঁকা থাকলেও জুঁই সচরাচর ঘর থেকে বের হয় না; মোহন এটা ভালো করেই জানে। সে সোজা এসে দরজায় দাঁড়ায়। জুঁই আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে।
‘জুঁই।’ মোহন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।
‘এই সময় তুমি কেন এসেছো?’
মোহন কথা না বলে ভেতরে এসে বিছানায় বসে পড়ে।
‘তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই।’
জুঁই চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপ, তারপর বলে, কী বলবে বলো।
‘তুমি কী চাও?’
‘কার কাছে?’
‘কারো কাছে না, আমার কাছে তো নয়ই? তুমি আসলে চাওটা কী?’
জুঁইকে একটু গম্ভীর দেখায়। এই গম্ভীরতা অবশ্য মুহূর্তের মধ্যে পথ ঘুরে বিরক্তিতে রূপ নেয়।
‘মা যে কোনো সময় চলে আসবে। তুমি এখন যাও।’
‘যাব না।’
‘মানে? তুমি এখন যাও।’
‘যাব, কিন্তু শিয়ালদের তাড়াবে কে?’
এবার জুঁইয়ের কপালে মিছিলের মতো কয়েকটা ভাঁজ জড়ো হয়। সে মোহনকে অনেকটা ধাক্কা দিয়ে বলে, তুমি এখন যাও।
মোহনও কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু দরজায় এসে কী ভেবে দাঁড়িয়ে পড়ে। কণ্ঠে অনেকটা মিনতির সুর। বলে, আমার অনেক ক্ষুধা পেয়েছে, সামান্য একটু ভাত হবে?
‘কি আবোল-তাবোল বলছো মোহন। তুমি এখনই বেরোও।’
মোহন বেরিয়ে যায়। বেরিয়ে যাওয়ার আগে ওর কণ্ঠ জড়িয়ে আসে, তুমি জগদ্বমাতা। তোমার কাছে একটু খাবার হলো না! বলে অনেকটা যাত্রার নায়কের মতো মাথা দুলিয়ে মোহন উঠোন থেকে বেরিয়ে যায়।

রাত (প্রথম ভাগ)
মোহন ফায়জুলদের বাড়িতে এসে দেখে বাইরের ঘরের বারান্দায় তারেক বসে আছে।
‘তুর এইখানেই যাইতাম। তারেক মুখটা খুশিতে জ্বলে ওঠে।’
‘আমার এইখানে কেরে?’
তারেক কোনো কথা না বলে মিটিমিটি হাসে। মোহন বেঞ্চিতে বসতে গিয়েছিল। কিন্তু ফায়জুল চলে আসায় তারেক উঠে পড়ে। বলে, ল।
কই? মোহন জানতে চায়।
ওরা মোহনের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। পিছু পিছু মোহন। তার তখন পেটের ভেতর একটা বিরাট শূন্যতা দোল খাচ্ছে। একবার মনে হয় ওদের দাঁড় করিয়ে ফায়জুলকে বলবে, আমারে ভাত দে, আমার পেট ভরা ক্ষুধা। বিরাট ক্ষুধা।
কিন্তু বলতে পারে না?
দক্ষিণ দিকে কিছুদূর হাঁটার পর পশ্চিম দিকে আরেকটা অপেক্ষাকৃত ছোট সড়ক নেমে গেছে। তারেক, ফায়জুল নতুন সড়ক নেমে গেলে মোহন ওদের অনুসরণ করে।
ছোট সড়কটায় নেমে গেছে দেখে মোহন নিশ্চিত হওয়ার জন্য বলে, ও তোরা তাইলে দরগায় যাবি?
‘দরগা!’ দুজন একসঙ্গে হেসে ওঠে।
ওদের এমন হাসি মোহনকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেয়। ওর ভেতর একটা অবিশ্বাসও উঁকি দিয়ে যায়। ফলে মোহন ওদের দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়। ওদের হাঁটা, চলার গতি সব পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করে। তাতেও বিষয়টা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।

কোনো কূল-কিনারা না পেয়ে সকালের কথা মাথায় আসে। সকালে চোটপাটের দাপটে তার ঘুম ভেঙে যায়। শেষে কী জানি ফিসফিসানি। ওদের এই রহস্য করার সঙ্গে সেই ঘটনার কি কোনো যোগসূত্র আছে? মোহন দাঁড়িয়ে পড়ে, টের পেয়ে ওরাও।
‘কী, কী অইলো?’
‘না কিছু না।’ মোহন এমন ভাব করে যেন পায়ের স্যান্ডেলটা খুলে গিয়েছিল।
ওরা আবার হাঁটতে শুরু করে। খুব বেশিক্ষণ না, আধাঘণ্টা হবে। গ্রামের পথ আধাঘণ্টা কিছুই না। ওরা হেঁটে হেঁটে একটা ছোট নদীর পাড়ে এসে পৌঁছায়। মোহন এর আগে বহুবার এখানে এসেছে। নিজেদের গ্রাম থেকে দুইটা গ্রাম, তারপর একটা ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে এখানে আসতে হয়।
‘ওই আচস?’ তারেক হাঁক দেয়।
‘হ তারেক ভাই।’ একটা স্বর নদীর ওপার থেকে ভেসে আসে।
পরমুহূর্তে বলে, খাড়ান আইতাছি।
‘কই যাস তোরা।’ মোহনের কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা।
ফায়জুল বলে, এত অস্থির কেরে, যেখানে যাইতাছি তোর বালাই লাগব।

মোহন আর কথা বাড়ায় না। নদীর ওপার থেকে একটা নৌকা এসে এপাড়ে ভিড়ে। ওরা দুজন উঠে মোহনকে তাগিদ দেয়। মোহনও উঠে পড়ে। নৌকাটা দুলুনি দিয়ে ছেড়ে দেয়। নদীটা এমনিতেই ছোট। এই ভাদ্র মাসে তা পেরুতে মিনিট দশেকের বেশি সময় নেয় না। নদীর এপাড়ে এসে দেখে কাওসার দাঁড়ানো। ওদের পেয়ে খুশিতে ওর দাঁত বেরিয়ে আসে, আইছস।

কাওসারকে দেখে বিষয়টা ওর কাছে আরো রহস্যময় মনে হয়। একবার ভাবে সে যে করেই হোক এখান থেকে বেরিয়ে যাবে। পরক্ষণেই মনে হয়, ভয় পাওয়ার তো কোনো মানে নেই। সবাই ছোটকালের বন্ধু, নিজে নিজে আশ্বাস খোঁজে।
‘মোহনরেও লইয়া আইছস?’ কাওসারের হাসি কান পর্যন্ত লম্বা হয়।
কাওসারের এই কথায় মোহন নিশ্চিতভাবে আশ্বাস পেয়ে যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ১১টা বাজে বাজে করছে। রহস্যের কূলকিনারা করতে ওদের সঙ্গে থাকতে ইচ্ছা হয়, আবার অশ্বথগাছটাও অনবরত টানছে।

নদীর পাড় থেকে দক্ষিণের দিকে হাঁটতে থাকে। নৌকা বয়ে নিয়ে আসা ছেলেটা সবার সামনে; আর মোহন সবার পেছন পেছন হাঁটছে। মোহনের মনটা ঘুরে যায়। সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে, আমি যাই।
‘কী কস?’ তারেক ঘুরে মোহনকে আটকায়।
‘আমার যাইতে ইচ্ছা করতাছে না।’
সামনে থেকে ফায়জুল আর কাওসার একসঙ্গে কাই কাই করে ওঠে, আইয়া পড়ছি, আইয়া পড়ছি রে।
মোহন আবার ওদের পিছু পিছু হাঁটে।
কিছুক্ষণের মধ্যে একটা ছোট জঙ্গল পেরিয়ে খালের কাছে চলে আসে।
‘এটা তো শশ্মান?’ মোহন বলে কিন্তু তা অস্ফূট থেকে যায়।

শশ্মান পেরিয়ে আরো একটু পথ। ওরা একটা ছোট কুঁড়েঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। বাড়িটার ছোট্ট একটা উঠোন এই রাতের বেলাতেও সাদা চাদরের মতো আলো ছড়াচ্ছে। উঠোনের এপাশ থেকে ওপাশ দড়ি টাঙানো। ঘর ঘেঁষে একটা পেঁপেগাছ অনেকগুলো কাঁচাপাকা পেঁপে ধরে বড্ড কষ্টে দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গের ছেলেটা বলে, মুর্শেদা দরজা খোল।
এতক্ষণে মোহনের কাছে বিষয়টা স্পষ্ট হয়। একটা মেয়ে দরজা খুলে উঁকি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে একটা কুপি। কুপির আলোতে মেয়েটাকে দেখে মোহনের মায়া লাগে। ওর উঁকি দেওয়ার ভেতর কেমন একটা আড়ষ্টতা। এ আড়ষ্টতা, না অসহায়ত্ব মোহন তা বুঝে উঠতে পারে না।
তারেক, কাওসার, ফায়জুল হা হা করে মেয়েটাকে অনেকটা ধাক্কা দিয়ে ভেতর ঢুকে যায়। মোহন বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে।
‘কই, ভিতরে আয়।’ ভেতর থেকে কাওসার আমুদে গলায় মোহনকে ডাকতে থাকে। এর মধ্যে ওদের পথ দেখিয়ে আনা ছেলেটা বাইরে এসে বলে, বাই, আওহাইন, ভিতরে আওহাইন।
তারেক, কাওসার, ফায়জুল চকির ওপর বসে পড়ে।
যে মেয়েটাকে একঝলক দেখেছিল, সে নাই। ঘরের ভেতর একটা ছাচের বেড়ার উল্টাদিকে কুপির আলোটা জ্বলছে।

এখানে সে কী করবে! তার খুব জুঁইয়ের কাছে যেতে ইচ্ছা করছে। আজও গতকালের মতো টোকা দেওয়ামাত্র যদি দরজা খুলে আহ্বানের স্বরে ডেকে ওঠে। কিন্তু না বড্ড বিরক্ত লাগে মোহনের। পৃথিবীটা অনেক বড়, পৃথিবী না হোক নিদেনপক্ষে বাংলাদেশ। এখানের কোটি কোটি মানুষের ভেতর থেকে দুটা চোখ নিয়ে অপেক্ষায় থাকা একটা মানুষ নিশ্চয়ই আছে। নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।
একটা আঁচলের স্পর্শে মোহন ফিরে আসে। দেখে মেয়েটা সামনে দাঁড়ানো।
বাহ, কী লাবণ্যতা ঘিরে আছে মেয়েটাকে। কপালে একটা টিপ, ঠোঁটও লাল করেছে। সবার ভেতর একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
‘নাম কী?’ ফায়জুল জিজ্ঞেস করে।
‘মুর্শেদা।’ মেয়েটা ফ্যাশফ্যাশে গলায় উত্তর দেয়। এই ফ্যাশফ্যাশে গলাটা শুনে মোহনের মুগ্ধতা মিলিয়ে যায় একদম।
এরপর মোহনের কাছে দৃশ্যটা খুব বিশ্রি ঠেকে। সবাই চকিতে বসা, শুধু মেয়েটা দাঁড়ানো। কেন? কিছুই নয়, অথচ মোহনের কাছে দৃশ্যটা অনেক বাজে মনে হয়।
‘পয়লা ক্যাডা।’ তারেকের মুখ দিয়ে কথা কয়টা যে গতিতে বেরোয়, তার থেকে বেশি গতিতে বেরোয় হাসি।
কিন্তু বিষয়টা প্রকৃতই অনেক সিরিয়াস, তা এই কথার পর সবার নীরবতা দেখে বোঝা যায়। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে কাওসার বলে, মোহন?
‘হ, হ মোহন।’ অন্য দুজন সায় দেয়।
ওরা যে ছোটকালের বন্ধু, ওরা যে অনেক ভালো বন্ধু, মোহন তা টের পেতে থাকে। আরো টের পায়, একটা অস্বস্তি ওর ভেতরে বিরাট জায়গা দখল করে নিয়েছে। মোহন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ১২টা। সে বলে, আমি যাই?
‘কিতা কছ?’ তারেক অনেকটা চিৎকার দিয়ে ওঠে।
ফায়জুল ওকে বেড়ার উল্টোদিকে প্রায় ঠেলে দিয়ে আসে। পেছন পেছন মেয়েটা এসে হাজির।
‘আওহাইন।’ মেয়েটার আহ্বান শুনে মোহন চমকে ওঠে। এমন একটা আহ্বানের জন্য কি সে এতদিন অপেক্ষা করে ছিল! বিরাট একটা ঘোরের ভেতর সে ব্যাপারটা ভাবে। এই ভাবনার ঘোরে মেয়েটার একদম মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় মোহন। পরক্ষণে কী ঘটবে এমনটা আন্দাজ করা সহজ। কিন্তু মোহন সহজ পথে যায় না। সে যায় অন্য পথে। অসহায়ের মতো বলে, বাড়িতে ভাত আছে?
মোহনের এমন কথায় মেয়েটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। মোহন অবশ্য আর কোনো কথা না বাড়িয়ে এ ঘরে চলে আসে।

‘কী অইছে?’ সবাই জানতে চায়।
‘আমি যাই।’ মোহন এই কথা বলে বন্ধুদের অনুমতির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে।
‘যেডার এইখান যাইবি, হেইডাও তো একই।’ তারেক খ্যাক করে ওঠে।
মোহন কোন কথা বলে না। এতে বোধহয় ওদের উৎসাহ বেড়ে যায়।
ফায়জুল বলে, বড্ডারে আগে, হেরপরে ছোডডার ওইহান যাইস।
বড়টা মানে এই মেয়েটার নাম তো মুর্শেদা। মোহন ক্ষেপে যায়।
‘চুপ। কুত্তার বাচ্চা।’ মোহন চিৎকার দিয়ে ওঠে।
‘কী, কী কইছস?’ ফায়জুল মোহনের দিকে তেড়ে আসে।
তিনজনের মাঝখানে তখন কাওসার এসে দাঁড়ায়।
আর এগোয় না। সবাই চুপ হয়ে যায়।
এরপর মোহন সোজা নদীর দিকে হাঁটা দেয়।

রাত (দ্বিতীয় ভাগ)
বটগাছের নিচে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঘড়ির কাঁটা ১টা পেরিয়ে যায়। কই, রাতগুলোর মধ্যে বিশেষ কোনো পরিবর্তন নেই! একই। কিন্তু মোহনের শরীর আজ কোনোমতেই চলছে না। সিগারেট ধরিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে বলে ভাবে। কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে আর সময় ব্যয় করে না। সোজা জুঁইদের বাড়ির বাইরের উঠোনে এসে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে একটু ভাবে। শরীর বড্ড টলায়মান। যে কোনো সময় যে কোনো দিকে হেলে যেতে পারে। তারপরও মোহন গুটিগুটি পায়ে ভেতরের উঠোনে এসে পড়ে। উত্তরপাশের ঘরটার কাঠের দরজার ফাঁক দিয়ে আলোর সামান্য রেখা বেরিয়ে বাইরে পড়েছে। মোহনের কাছে এই আলোকে একটা দ্যোদুল্যমান রঙধনু বলে মনে হয়। সে এই আলোর ঝিলিক মাথায় নিয়ে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। তারপর ঘর থেকে একটা হাসি ছিটকে বেরিয়ে আসামাত্র মোহন দরজায় এসে ধাক্কা দেয়।
দরজায় শব্দ হতেই ভেতরের আলোটা নিভে যায়।

মোহন বোধহয় আরেকটু টলায়মান হলো। এবার তার হাত পা কাঁপতে শুরু করে। সে অনেক কিছু খুঁজে বেড়ায়, মনে করার চেষ্টা করে, এই আলো নিভে যাওয়ার ইতিহাসের সঙ্গে তার কি কোনোদিন দেখা হয়েছিল? এই আলো নিভে যাওয়ার পর কী ধরনের দৃশ্যের অবতারণা হয়। এসব ভাবার চেষ্টা করলেও পেটটা ঠিকমতো সহযোগিতা না করায় সে আবার দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে।
না কোনো সাড়া নেই। ফলে আবার ধাক্কা।
‘কে?’ জুঁই বড্ড কড়া গলায় আওড়ায়। মনে হয় ফ্যাসফ্যাসে।
‘দরজা খোল।’ মোহনের কথাগুলো কাঁপা কাঁপা হয়ে বেরয়।
‘তুমি এত রাতে কী চাও?’
‘দরজা খোল।’ মোহনের গলায়ও চড়া ভাব।
আর দেরি হয় না। দরজা খুলে যায়। জুঁই মোহনের মুখোমুখি হয়ে বলে, কী চাও?
মোহন জুঁইকে পাশ কাটিয়ে ঘরের ভেতর চলে আসে। ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার। সে একটা ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে এর আলোয় কিছু একটা খুঁজে নেয়। সে দেখতে পায় ঘরের এক কোণে একটা লোক গুটিসুটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক ঝলকে চিনতে পারে। চিনে সে চমকে ওঠে। এ যে তার বড় ভাই, সুলতান।
আর দেরি করে না। মোহন ঘর থেকে বেরুতে গিয়ে দরজায় জুঁইয়ের সঙ্গে ধাক্কা খায়। ধাক্কা খেয়েই বোধহয় জেগে ওঠে। জুঁইয়ের হাতটা চেপে ধরে।
‘ছাড়। জুঁই ধমক দিয়ে ওঠে।’
মোহন বাধ্যগতের মতো ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে আসে।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;