মৃত্যুর কাছাকাছি আলোর মশাল



রেহানা বীথি
ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

-- আপনাকে তো আগে দেখিনি এপথে। নতুন বুঝি এ এলাকায়?

হাঁটুঅব্দি লম্বা জ্যাকেটের হুডটা যেমন ছিল তেমনই রইলো। হুডের ভেতর থেকে উত্তর এলো,

-- বলতে পারেন নতুন, আবার না-ও বলতে পারেন।

-- ঠিক বুঝলাম না। আপনি কি আগে এ মহল্লায় থাকতেন?

দুলে দুলে হাসতে লাগলো লম্বা জ্যাকেটের হুডতোলা লোকটা। অদ্ভুত তো! কে এটা? হাইজ্যাকার নয় তো? পঁয়তাল্লিশের জাকির হঠাৎ করেই কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো। নিজের অজান্তেই তার বাম হাতটা চলে গেলো প্যান্টের পকেটে। ওখানে বেশ কিছু টাকা আছে, আর আছে দামি মোবাইলটা।

লোকটা কি তাকে অনুসরণ করছে? কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছে অবশ্য পাশাপাশি। একবারের জন্যও জাকিরের সাথে কথা বলার কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। জাকির যে একটু পর পর শঙ্কামিশ্রিত চাহনি ফেলছে তার ওপর সেটাও লক্ষ্য করছে না একেবারেই। আপনমনে হাঁটছে তো হাঁটছেই। দেখতে দেখতে ওরা চলে এলো পাড়ার শেষমাথার বিশাল দীঘিটার কাছে। এই দীঘির ধার ঘেঁষে পথটা একটু বেঁকে গিয়ে মিশেছে অন্য এক মহল্লায়। জাকির প্রতিদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ আয়েশ করে। আয়েশ করতে করতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যখন রাত ছুঁই ছুঁই তখন বের হয় হাঁটতে। এটা তার প্রতিদিনের অভ্যেস। কারণ সে বেশ স্বাস্থ্য সচেতন। সে চায় একটুও মেদ যেন না জমে তার শরীরে। তাহলে প্রাতঃভ্রমণ না করে সান্ধ্যভ্রমণ কেন?

তার উত্তরও আছে, ওই সামান্য আলসেমিটা তার ছোটবেলা থেকেই, ভোরবেলায় বিছানা ছাড়তে পারে না সহজে। আর এই পৌষের শীতে সেটাতো একেবারেই অসম্ভব। তাই সে অনেক ভাবনা চিন্তা করে এই সান্ধ্যভ্রমণটাই বেছে নিয়েছে। এ সময় কেউ বের হয় না ভ্রমণে, পথটাও নিরিবিলি। তারওপর এখন শীতকাল। লোকজন বাড়িমুখী হয় তাড়াতাড়িই। পাড়ার পথেঘাটে নেমে আসে নিরবতা। সুনসান নিরবতা, মাঝে মধ্যে দুই একটা সাইকেলের টুংটাং কেমন যেন সুখ এনে দেয় মনে।

-- বাহ্, দীঘিটা তো খুব সুন্দর! আসুন , দু'জনে এখানে বসি একটু।

অবাক হয় জাকির এই আহ্বানে। ভয় ভাব তো রয়েছে। একজন সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ, যার চরিত্র নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে, চোর না ছ্যাঁচ্চোড় জানা নেই, সে কী না দীঘির সৌন্দর্য উপভোগ করতে ডাকছে জাকিরকে! প্রায় মিনিট বিশেক হয়ে গেলো, একবারও লোকটার জ্যাকেটের হুড নড়েনি একটুও। হুড না নড়লে তো চেহারা দেখার কোনো উপায়ও নেই। লোকটার বয়স সম্পর্কে কোনো ধারনাই করা যাচ্ছেনা। তবে বেশ লম্বা। পরনের ওই লম্বা কালো জ্যাকেটের কারণে কিনা কে জানে, আরও বেশি লম্বা দেখাচ্ছে। ঢেকে রাখা চেহারায় প্রায় রহস্যময় এক অবয়ব। কিন্তু হাইজ্যাক করার ইচ্ছে বোধহয় তার নেই। যদি ইচ্ছে থাকতো, এতক্ষণে সে তা করে ফেলতো। এত সময়ক্ষেপণ করবে কেন সে? এসব ভাবতে ভাবতে দীঘল দীঘিটা পেরিয়ে যাবার উপক্রম। পাশ দিয়ে একটা ফাঁকা রিক্সা চলে গেলো। রিক্সাওয়ালা গান গাইছে গুনগুন করে। ধীরে ধীরে সে মিলিয়ে গেলো সামনের ঘন কুয়াশায়। জাকির যখন বেরিয়েছিল তখন কুয়াশা হালকা ছিল। এখন তা ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে। ডানহাতে ধরা উলের টুপিটা মাথায় পরে নিলো সে। আর এগোনো কি ঠিক হবে? আজ ফিরে যাই বরং ... ভাবতেই আবার শুনতে পেলো,

-- আসুন না, বসি একটু!

শীতল অথচ গমগমে কণ্ঠস্বর ভেসে এলো যেন কোনো গভীর কুয়ো থেকে। এই কণ্ঠস্বর জাকিরের ভেতরটা কাঁপিয়ে দিলো একেবারে।

প্রতি লোমকূপ সজাগ হয়ে উঠলো মুহূর্তেই।

লোকটা এগিয়ে আসছে পায়ে পায়ে। এসে জাকিরের মুখোমুখি দাঁড়াতেই যেন একরাশ কুয়াশা এসে পাক খেতে লাগলো ওদেরকে ঘিরে। এভাবে কুয়াশা কেন ঘিরে ধরলো হঠাৎ! কখনও তো কুয়াশার এমন আচরণ চোখে পড়েনি আগে! চোখের সামনে চেনা জায়গাটা কেমন যেন অচেনা মনে হলো। কুয়াশার ভেতর থেকে আবারও ভেসে এলো শীতল কণ্ঠটা।

-- আপনার সাথে আমার কথা হওয়া জরুরি। আর তার জন্য এই জায়গাটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে আমার। কিন্তু বার বার আমার আহ্বান আপনি উপেক্ষা করছেন কেন? আপনি হয়তো জানেন না, আপনাকে বাধ্য করা আমার জন্য খুব সহজ ব্যাপার।

-- কে আপনি? এ..এভাবে কথা বলছেন কেন আমার সাথে? জানেন আমি কে? ভয় দেখাতে চাইছেন? এক্ষুণি ফোন করছি দাঁড়ান। থানা বেশি দূরে নয়, পাঁচ মিনিটও লাগবে না পুলিশ আসতে।

আবারও দুলে দুলে হাসতে লাগলো লোকটা। বড় নিষ্ঠুর সেই হাসি। পকেট হাতড়াতে লাগলো জাকির। মোবাইলটা পাচ্ছে না। দু'টো পকেটই তো প্যান্টের, মোবাইলটা পাচ্ছে না কেন সে? হাতড়াতে হাতড়াতে অবশেষে পেলো একসময় ।

হাতে নিয়ে আঙুল ছুঁইয়ে কী-প্যাড বের করার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারলো, কাজ করছে না মোবাইল। সুস্থ সবল মোবাইল তার। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগেই দেখেছে, চার্জ ফুল ছিল, এখন কাজ করছে না কেন? যদিও হাতদুটো তার ভীষণরকম কাঁপছে, তবুও আবারও চেষ্টা করলো।

নাহ্, ঠাণ্ডা মেরে আছে একেবারেই!

কিন্তু লোকটা যে একদম নিকটে! পালাতে গেলেও জাপটে ধরবে সাথে সাথে। কেউ তো নেই আশেপাশে! কুয়াশা অসম্ভব রকমের জমাট ধরেছে। দীঘির কাছাকাছি কয়েকটা বাড়িঘর ছিল , সেগুলো কি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল?

কিছুই দেখতে পাচ্ছে না কেন সে? দীঘিটাই স্পষ্ট শুধু। ধোঁয়া ধোঁয়া কুয়াশা দুলছে ঢেউয়ের মতো। দুলছে দীঘির টলটলে জল। লাইটপোস্টের মৃদু আলো জ্যাকেটধারীর লম্বা দেহের ধাক্কায় বেঁকে গিয়ে পড়েছে সেই জলে। নরম সোনালী রঙ ছড়িয়ে পড়ছে ছোট ছোট ঢেউয়ের মাঝে।

এতক্ষণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়েছিল লোকটা। সামান্য নড়ে উঠলো এবার। দুই হাত দুইদিকে এমনভাবে প্রসারিত করলো যেন উড়াল দেবে এখনই।

শোঁ শোঁ করে বইছে হিমেল হাওয়া। জাকিরের প্রতিটি অঙ্গ কাঁপতে লাগলো ঠকঠক করে। লোকটা এগিয়ে এলো তার দিকে দু'বাহু প্রসারিত করেই। বললো,

-- এসো, সঙ্গী হও আমার, আমি যে তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি!

-- কোথায়?

-- যেখানে গেলে কেউ খুঁজে পাবে না তোমায়!

-- খুঁজে পাবে না!! কেন?

-- খুঁজে পাওয়ার কথা নয় তাই! কেউ খুঁজে পায় না, কেউ ফিরেও আসে না ওখান থেকে।

-- কিন্তু কেন যাবো? আমাকে কেউ খুঁজে পাবে না, এমন জায়গায় আমি কেন যাবো?

-- আমি চাইছি তাই!

-- তুমি চাইবার কে? তোমাকে তো আমি চিনি না! যাদেরকে আমি চিনি, তাদেরকে ছেড়ে যাবো না আমি তোমার সাথে।

-- কাকে চেনো তুমি? কে আছে এমন, যাকে তুমি চিনে গেছো খুব ভালোভাবে?

-- কে নেই? আমার বাবা-মা, একমাত্র বোন, দশবছর আগে বিয়ে করা আমার বউ, আমার ছোট্ট তুলতুলে কন্যাটা, কে নেই! আরও আছে বন্ধু- বান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী।

-- এদের সবাইকে চেনো তুমি? কোনো দ্বিধা নেই মনে?

-- দ্বিধা থাকবে কেন? সব্বাইকে চিনি আমি। তোমার সাথে গিয়ে যদি হারিয়ে যাই, খুঁজে বেড়াবে ওরা হন্যে হয়ে।

-- কিছুদিন খুঁজবে, তারপর ভুলে যাবে। তারপর ভুলে যায়। তোমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হবে না।

-- না হোক, তবুও আমি হারাতে চাই না এত তাড়াতাড়ি। চেনার ঘাটতি থাকলেও না। আমার ছোট্ট মেয়েটা যখন হারমোনিয়ামে বসে দুলে দুলে গান করে, দু'চোখ জুড়িয়ে যায় আমার! ওর একমাথা কোঁকড়া চুলে বিলি কেটে কেটে ঘুম পাড়াই আমি। তা নাহলে মেয়েটা যে আমার ঘুমোতেই চায় না!

-- এ সবই মিথ্যে মায়া, তুমি তা ভালো করেই জানো। যত জড়াবে তত বেদনা বাড়বে, বাড়বে মোহ।

-- বাড়ুক! মায়ায় জড়িয়ে যে বেদনা, সে বেদনাতেও সুখ খুঁজে নিতে জানি আমি।

-- হা হা হা! কোথায় সুখ? সে তো অধরা! প্রতিদিন নতুন চাওয়া, না পেলে বেদনা ভর করা, পেয়ে গেলেও আবার নতুন কোনো চাওয়া। সুখ ধরা দেয় কখনও? মিছেমিছি সময় ব্যয়।

-- দেয় দেয়, এসবের মাঝেই সুখ ধরা দেয়। অতি তুচ্ছ তুচ্ছ বিষয়েও লুকিয়ে থাকে সুখের ঠিকানা।

-- যত্তসব! আর সময় দিতে পারবোনা। তুমি আমার সাথে যাবে কিনা বলো।

-- না যাবো না।

-- অসহ্য দুঃসাহস তোমার।

-- জানি। আমি এও জানি, তুমি ভীতু।

চারিদিক প্রকম্পিত করে বিকট শব্দে হেসে উঠলো লোকটা। মনে হলো তার হাসির শব্দে জমাট কুয়াশারা ভেঙে যাচ্ছে ছোট ছোট টুকরোয়। আর সেই টুকরোগুলো অসহ্য এক যন্ত্রণা হয়ে ঝরে পড়ছে জাকিরের ওপর। লোকটা আরও এক ধাপ এগিয়ে এসে প্রবল তাচ্ছিল্য ছুঁড়ে দিয়ে বললো,

-- আমি ভীতু!! আমি???

-- অবশ্যই! ভীতু না হলে নিজেকে ওভাবে আড়াল করে রেখেছো কেন?

-- আমাকে দেখলে সাথে সাথে সংজ্ঞা হারাবে তুমি, নির্বোধ কোথাকার!

-- তাহলে দেখাও! ভয়ই তো পাওয়াতে চাইছো তুমি আমাকে!

-- শুধু তোমাকে নয়, সবাইকেই। সবাই ভয় পায় আমায়।

-- আমি পাই না। তোমার মতো মামুলি একটা লোককে ভয় পাওয়ার কি আছে?

-- ওহ্, তাই? শুরুতে তো ভীষণ কাঁপাকাঁপি করছিলে।

-- শুরুতে ওরকম হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। তবে যত সময় গেছে, ভয়কে দূরে ঠেলতে সক্ষম হয়েছি আমি, অস্বীকার করতে পারো?

-- না, তা পারি না।

-- তাহলে বিদেয় হও।

-- বিদেয় হবো? দেখবে না আমাকে? হুডে ঢাকা আমার চেহারা নিয়ে তোমার যে সংশয়, দূর করবে না তা?

-- নাহ্

-- কেন?

-- কী হবে সংশয় দূর করে? হয়তো আড়াল সরে গেলেই ভয়াবহ কিছু দেখবো। দেখে হয়তো আতঙ্কে শিউরে উঠবো। দেখতে চাই না আমি তা। যা কিছু ভয়াবহ তা আড়ালেই থাক। সামনে আসুক শুধুই সুন্দর... শুধুই মনোরম কিছু।

-- কিন্তু তোমাকে না নিয়ে যে আমি যেতে পারি না। অযথা সময় নষ্ট করেছো অনেক। চলো এবার!

-- কতবার বলবো? এখনই যাবো না আমি। অযথা সময় তো তুমি নষ্ট করছো। বহু আগেই তোমাকে চলে যেতে বলিনি?

-- বলেছো। তুমি বললেই চলে যাবো ভাবছো কেন? তুমি একটা অতি সাধারণ আজ্ঞাবাহী মানুষ। এই পৃথিবীতে তোমার মেয়াদ শেষ। আর তোমার ইচ্ছে অনিচ্ছেয় তো তোমার যাওয়াটা নির্ভরশীল নয়। যখন ডাকা হবে তখনই যেতে বাধ্য তুমি।

-- বললেই হলো? জীবনের সৌন্দর্য পেখম মেলছে একে একে, এখনই চলে যাবো? বাবা-মা ক্রমশঃ বৃদ্ধ হচ্ছেন। তাঁরা শিশুকাল থেকে যেমন করে আগলে রেখে বড় করেছেন আমায়, আমারও তো কর্তব্য বার্ধক্যে যেন তাঁরা অসহায় বোধ না করেন, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখা। চলে গেলে সেটা কে দেখবে শুনি?

-- সেটা জানা আমার কাজ নয়। আমার কাজ তোমাকে নিয়ে যাওয়া। যেভাবেই হোক নিয়ে যেতে হবে । কিন্তু তুমি বড় বেশি অবাধ্য, বড় বেশি সাহস তোমার। জানো, অবাধ্যদের কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা আছে?

-- জানি জানি। জেনেও অবাধ্য হবো। যাও, ভাগো এখান থেকে!

ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে গেলো যেন লোকটা। দু'হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আঘাত করতে লাগলো নিজের বুকে। তারপর এমনভাবে একটা হাত এগিয়ে নিয়ে এলো যেন চেপে ধরবে জাকিরের কণ্ঠনালী। এক ঝটকায় কিছুটা পেছনে সরে এসে জাকির বললো,

-- খবরদার, ছোঁবে না আমাকে! যাও, চলে যাও!

-- ওহ্!! অবাধ্য মানুষ! তুচ্ছ মানুষ! আমার হাতের ছোট্ট একটা ধাক্কায় ছিটকে পড়বে তুমি ওই শান্ত দীঘির জলে। কিছুক্ষণ তোলপাড় উঠে থেমে যাবে সব। একসময় ভেসে উঠবে তোমার নিথর দেহ। কিছুই করতে পারবে না তুমি।

-- পারবো। কারণ আমার আছে ভালোবাসার শক্তি। আমি এই পৃথিবীকে, আমার স্ত্রী, সন্তান, বাবা-মা সবাইকে ভালোবাসি ভীষণ। সেটাই আমার শক্তি। সেই শক্তির কাছে পরাজিত হবেই তুমি। শূন্য হাতেই ফিরে যেতে হবে তোমাকে।

-- কী নির্বোধ! কী ভীষণ নির্বোধ তুমি! আমি আর সহ্য করতে পারছি না তোমার এই নির্বুদ্ধিতা। প্রচণ্ড রাগে জ্বলে যাচ্ছে আমার সারাদেহ। এত সহজে হেরে যাবো ভেবেছো? কেউ হারাতে পারেনি আমাকে কোনোদিন, তুমিও পারবে না।

কোনো কথা বললো না এরপর জাকির। কোনো কথা বলারই আর প্রয়োজন নেই এরপর। পরাজিতরা আড়ালেই থাকে। আড়ালে থাকতে থাকতেই ওরা আরও আড়াল হয়ে যায়, ডুবে যায় অন্ধকারে। জাকিরের দৃষ্টি স্থির। ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি। সে হাসিতে স্পষ্ট, হারবে না সে। লড়ে যাবে শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত। কালো জ্যাকেটের আড়ালে লোকটার দিশেহারা ভাব। হয়তো এই প্রথমবার সে হেরে যেতে বসেছে। হয়তো কেন? অবশ্যই হেরে গেছে সে। নিশ্চিত হার.... নিশ্চিত হার- এ সে এখন ক্ষতবিক্ষত, বিধ্বস্ত!

হঠাৎ যেন মৃদু গুঞ্জন ভেসে এলো কানে। সমবেত গুঞ্জন। ধীরে ধীরে সেই গুঞ্জন নিকটে... আরও আরও নিকটে চলে এলো। কুয়াশা ফুঁড়ে দৃশ্যমান হলো আলোর মশাল। সমবেত গুঞ্জন সেই মশাল হাতে জাকিরের কাছাকাছি এসে থেমে গেলো। জাকির বললো,

-- কোথায় যাও তোমরা, মশাল হাতে?

-- আলো বিলিয়ে বেড়াই। সব কালো দূর করি মশালের আলোয়!

ভালোলাগায় ভরে গেলো জাকিরের মন। ও দাঁড়িয়ে রইল ভালোলাগায় বুঁদ হয়ে। একসময় দেখলো, হুডে ঢাকা লোকটা কোথাও নেই । নেই সমবেত গুঞ্জন আর মশালের আলো কাছাকাছি।ওই আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে দূরে বহুদূরে....ঢেউয়ের মতো।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;