রিজিয়া রহমান: রক্তের অক্ষরে জোনাকির আলো



ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তাটোয়েন্টিফোর
কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান/ ছবি: সংগৃহীত

কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান/ ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

১.

ময়দান পেরিয়ে অভিজাত ভবানীপুর এলাকা থেকে দক্ষিণ কলকাতার শুরু। ৮০ বছর আগে অবিভক্ত বাংলার সেই বনেদী পাড়ায় জোনাকি নামের একটি শিশুর জন্ম হলো। রাজনৈতিক দোলাচল, দেশবিভাগ ইত্যাদি কারণে শিশুটি সপরিবারে বাংলার পশ্চিমাংশ ছেড়ে চলে আসেন পূর্বাঞ্চলের আজকের বাংলাদেশে। চরম বিরূপতার মধ্যে থেমে থেমে অর্জন করেন উচ্চশিক্ষা। চালিয়ে যান গল্প-উপন্যাস রচনা।

তার হাত দিয়ে বের হয় ‘বং থেকে বাংলা’, ‘শিলায় শিলায় আগুন’, ‘রক্তের অক্ষর’-এর মতো মানুষ ও জীবনের সুগভীর বর্ণনা-সমৃদ্ধ, ঐতিহাসিক-বিন্যাসের আখ্যান। ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে তিনি অর্জন করেন বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘একুশে পদক’, ‘বাংলা একাডেমী পুরস্কার’সহ অনেক স্বীকৃতি। 

১৯৩৯ সালের ২৮ ডিসেম্বরে জন্ম নিয়ে ২০১৯ সালের ১৬ আগস্ট মৃত্যু হয় যে জোনাকির, তিনি রক্তের অক্ষরের শরীরে জোনাকির মতো আলো ছড়িয়ে বেঁচে থাকবেন বাংলা কথাসাহিত্যে। তার মৃত্যু হলেও তার বইগুলো বেঁচে থাকবে বাংলাসাহিত্যের ভাণ্ডারে ও পাঠকের চিত্তে। অক্ষয় মলাটে লিপিবদ্ধ থাকবে তার নাম, রিজিয়া রহমান।

২.

রিজিয়া রহমান অসামান্য ভাষায় বহুবিধ বিষয়বস্তুর বর্ণনা দিয়েছেন তার রচনাসমূহের প্রতিটি অক্ষরে। শুধু পাঠেই নয়, অনুভূতির গভীরতম মর্মমূলে পৌঁছে যায় সেসব চিত্ররূপ কাহিনীপ্রবাহ। ‘রক্তের অক্ষর’ উপন্যাসে এই লেখকের কৃতিত্বের ছাপ সুস্পষ্ট: 

‘সবাই বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল কয়েকবার দাপাদাপি করে পেটে ছুরির ঘাই খাওয়া ইয়াসমীনের অর্ধনগ্ন দেহটা নিস্পন্দ হয়ে গেল। হীরুর চোখ টকটকে লাল! হাতে রক্তমাখা ছুরি। হীরু বাইরে এলো। 

মেঝেতে পড়ে থাকা ইয়াসমীনের বইয়ের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে রক্ত মুছে কাগজটা ছুড়ে দিল হীরু কিছুক্ষণের জন্য বজ্রাহত, নির্বাক হয়ে যাওয়া মেয়েদের সামনে।

তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল-দ্যাখ ছিনালেরা! এইবার চক্ষু মেইল্যা দ্যাখ হীরু কী করবার পারে।

পিছিয়ে গেল মেয়েরা। মার খাওয়া পরাজিত পশুর মতো বেদনাহত চোখে ইয়াসমীনের মৃহদেহের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

রক্তমাখা কাগজটা ওদের সামনে। ওরা শুধু কাগজের এক পিঠের রক্ত দেখল। ওরা জানল না কাগজের আরেক পিঠে লেখা সর্বকালীন সত্যের সেই বিখ্যাত বিদগ্ধ উক্তি: ‘ম্যান ইজ বর্ন ফ্রি, বাট এভরি-হোয়্যার ইজ ইন চেইন।’

নিস্তব্ধ বজ্রাহত বাড়িটায় তখন একটি শিশুর স্বাধীন প্রতিবাদের কান্না বেজে উঠল। ফুলমতীর বাচ্চা কাঁদছে প্রবল চিৎকারে।’     

৩.

‘রক্তের অক্ষর’ উপন্যাসে নির্মম মৃত্যুবরণকারী নারী ইয়াসমীন কে? এই প্রশ্ন ও সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলি পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করবেই। ১৯৭৮ সালে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত রিজিয়া রহমানের উপন্যাসটি ছিল নারী ও মুক্তিযুদ্ধের মিলিত সংগ্রামের ধারাভাষ্য। 

রেকর্ড রাখা দরকার যে, বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতে যারা সর্বাগ্রে এগিয়ে আসেন, তিনি তাদের অগ্রণী। বিশেষত নারী কথাশিল্পীদের মধ্যে রিজিয়া রহমানের সমকালে রাবেয়া খাতুন (ফেরারী সূর্য, ১৯৭৪ সাল), ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ (বন্দী দিন বন্দী শিবির, ১৯৭৬ সাল), সেলিনা হোসেন (হাঙর নদী গ্রেনেড, ১৯৭৬ সাল) ছাড়া আর কাউকে মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে কথাসাহিত্য চর্চায় এগিয়ে আসতে দেখা যায় নি।

রিজিয়া রহমানের ‘রক্তের অক্ষর’ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধর্ষিতা, লাঞ্ছিতা বাঙালি নারীদের করুণ জীবনের আখ্যান। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা ধর্ষিত ও নির্যাতিত লক্ষ লক্ষ নারীকে স্বাধীনতার পর সরকার যে সম্মানসূচক বীরাঙ্গনা উপাধিতে ভূষিত করেছিল, নৃশংস আঘাতে মৃত্যুবরণকারী ইয়াসমীন তাদের অন্যতম।

তৎকালীন সরকার রণাঙ্গণে ও যুদ্ধের সময় নিপীড়িত, নির্যাতিত নারীদের সামাজিক ভাবে পুনর্বাসন, তাদের বিয়ে ও কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিয়েছিল। এসব রাজনৈতিক উদ্যোগ-আয়োজন সামাজিক বাস্তবতায় বিভিন্ন ঘাত ও প্রতিঘাতের সম্মুখীন হচ্ছিল। যুদ্ধোত্তর সমাজের একটি অংশ বীরাঙ্গনা নারীদের স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করে নি। তাদের পরিবারও এইসব বীর নারীদের ফিরিয়ে নিতে ছিল কুণ্ঠিত। ফলে লাঞ্ছিতা মেয়েদের জায়গা হয়েছিল আশ্রয়কেন্দ্র, পতিতালয় বা অন্য কোথাও। 

রিজিয়া রহমান তার উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসাবে এমনই এক ভাগ্যাহত নারী ইয়াসমীনকে বেছে নিয়েছিলেন। ইয়াসমীন চরিত্রের মধ্য দিয়ে রিজিয়া রহমান তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের একটি ভিন্ন বাস্তবতা, যেখানে এইসব বীরাঙ্গনাদের জীবনকাহিনী বর্ণনার পাশাপাশি অঙ্কিত হয়েছে পতিতাপল্লির অন্ধকারময় বীভৎস জীবনে নারীনির্যাতনের মর্মন্তুদ কাহিনীচিত্র।   

৪.

‘রক্তের অক্ষর’ আবর্তিত হয়েছে ইয়াসমীনের জীবন, সংগ্রাম ও অস্তিত্বের সঙ্কটকে ঘিরে। পটভূমিতে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় কামাল নামে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে পাকিস্তানি সৈন্যরা ইয়াসমীনের বাবা, মা, ভাই, বোনকে হত্যা করে। ইয়াসমীনকে ধরে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করে চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। মাসের পর মাসের পাশবিকতায় নিত্য জর্জরিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের শেষে বন্দি জীবন থেকে মুক্তি পায় ইয়াসমীন। অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় মুক্ত স্বদেশে নিপীড়িত ইয়াসমীনের ঠাঁই হয় একটি নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে।

কিন্তু কঠিন বাস্তবতা ইয়াসমীনের পিছু ছাড়ে না। আক্রান্ত ও ক্ষত-বিক্ষত ইয়াসমীনের জীবনকে অন্ধকারের স্তব্ধতায় রেখে আর সব কিছু চলতে থাকে ঠিক আগেরই মতো। পরিবারের সবাই পাকিস্তানি বর্বরদের হাতে নিহত ও ইয়াসমীন নিজে চরম লাঞ্ছিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে তার যে প্রেমিক সারা জীবন সুখে-দুঃখে ইয়াসমীনের সঙ্গী হওয়ার সঙ্কল্প করেছিল, সে এখন আরেকজনের স্বামী। 

এমনই পরিস্থিতিতে ইয়াসমীন একদিন তার চাচার বাসা খুঁজে পায়। কিন্তু এতদিন পর তাকে দেখে চমকে উঠে চাচা। ইয়াসমীন বুঝতে পারে তাকে আর আগের মতো গ্রহণ করছে না। চাচা ইয়াসমীনকে চাকরি ও অন্যান্য সহযোগিতার আশ্বাস দিলেও নিজের পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত। 

ক্ষুব্ধ ইয়াসমীন আবার ফিরে আসে তার শেষ ভরসাস্থল পুনর্বাসন কেন্দ্রে। ইয়াসমীনের চাচা তার একটি চাকরির ব্যবস্থা করলেও ইন্টারভিউ বোর্ডে ইয়াসমীনকে সম্মুখীন হতে হয় চরম বিব্রতকর পরিস্থিতির। সর্বত্র তার বীরাঙ্গনা পরিচয়ই মুখ্য হয়ে উঠে। উচ্চ শিক্ষিত ইয়াসমীনের যোগ্যতার চেয়ে তার লাঞ্ছিতা জীবনের কাহিনীই প্রশ্নকর্তাদের কৌতূহলের বিষয় হয়ে পড়ে। প্রশ্নকর্তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ ইয়াসমীনের বিক্ষুব্ধ উক্তির মাধ্যমে ঔপন্যাসিক নারীর আত্মসম্মানের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত্ব করেন:

‘আমার সম্পর্কে আপনাদের আগ্রহের চেয়ে কৌতূহল বেশি। কারণ আমি সরকারের দেয়া বীরাঙ্গনা খেতাব নিয়ে এসেছি। আপনাদের দৃষ্টি, আপনাদের ভঙ্গি বলে দিচ্ছে যে, আমি সমাজ ছাড়া মানুষ। সরকার বোধ হয় বারাঙ্গনা বলতে ভুলে বীরাঙ্গনা খেতাব দিয়ে ফেলেছে। ... পাকিস্তানি সৈন্যরা আমার দেহের ক্ষতি করেছে। আর আমার মনের ক্ষতি করছেন আপনারা। আপনাদের মতো মানুষেরা যারা কিছু না হারিয়েও স্বাধীনতার ফল ভোগ করছেন।’

৫.

ইয়াসমীনের সংক্ষুব্ধ বক্তব্যের মাধ্যমে উন্মোচিত হয়েছে তীব্র বিদ্রূপ, ঘৃণা এবং পুরুষশাসিত সমাজে নারীর প্রতি নেতিবাচত দৃষ্টিভঙ্গির স্বরূপ। মুক্তিযুদ্ধের বীর নারীদের প্রতি সমাজ ও কতিপয় মানুষের হীন মনোভাবেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ইয়াসমীনের ঘটনায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষিত ও লাঞ্ছিতরা বীরাঙ্গনা খেতাব পেলেও সামাজিক ক্ষুদ্রতার কারণে কিছু মানুষ তাদেরকে গ্রহণযোগ্যতা ও যথাযথ মূল্যায়ন করে নি। পরিবারের সদস্য, নিকটাত্মীয় এবং সমাজের বিভিন্ন পেশায় আসীনরাও দেখাতে পারে নি উদারতা ও সম্মান।

ইয়াসমীনের জীবন-বাস্তবতার কঠিন পরীক্ষার এখানেই শেষ নয়। শারীরিক লাঞ্ছনা ও মানসিক পীড়নের পাশাপাশি তার ওপর নেমে আসে শোষণ ও অবদমন। উপন্যাসের এক পর্যায়ে দেখা যায়, আশ্রয়কেন্দ্র থেকে একজনের সঙ্গে ইয়াসমীনের বিয়ে হলেও তার পেছনে ছিল নোংরা ষড়যন্ত্র, লোভ ও অসাধু মনোভাব। 

অল্প সময়ের মধ্যেই ইয়াসমীন আবিষ্কার করে যে, তার বিবাহিত স্বামীর আসল উদ্দেশ্য দাম্পত্য ও প্রেম নয়, অন্য কিছু। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্কুল পরিস্থিতিতে ইয়াসমীনের দখল হয়ে যাওয়া বাড়িটি উদ্ধার ও ভোগ-দখল করতে এবং ইয়াসমীনের শরীরকে ব্যবহার করে ফায়দা লোটার জন্যই বিয়ে নামক প্রহসন করেছে। প্রতিদিনই নিত্যনতুন পুরুষের শয্যাসঙ্গী হতে ইয়াসমীনকে তার কথিত স্বামী বাধ্য করছে। স্বামীর অত্যাচারে শেষপর্যন্ত ইয়াসমীনের ঠাঁই হয় নিষিদ্ধপল্লী পতিতালয়ের অন্ধকার জগতে। জীবনের রূঢ় বাস্তবতাকে মেনে প্রতিবাদী ইয়াসমীন তারপরেও বলতে থাকে তার ক্ষুব্ধ কথামালা:

‘যুদ্ধ যদি আমাকে বেশ্যাই বানাল, তবে তার ফলভোগ ওই ক্রীম খাওয়া লোকদের করতে দেব না। আমি বেশ্যা। আমি বেশ্যা হয়েই যাব।’ 

৬.

মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত রণাঙ্গণ আর জীবন-যুদ্ধের কঠিন ক্ষেত্র পেরিয়ে পতিতালয়ের অন্ধ-অন্ধকার জগতেই শেষপর্যন্ত ইয়াসমীনের করুণ মৃত্যু ঘটে বেশ্যাপল্লীর পাষণ্ড গুণ্ডার ছুরিকাঘাতে। এইভাবে উপন্যাসের সমাপ্তির মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে মহান মুক্তিযুদ্ধে সব কিছু হারানো এক বীরাঙ্গনা নারীর। 

ইয়াসমীনের মর্মান্তিক মৃত্যু পুরুষশাসিত ও শ্রেণিবিভক্ত সমাজে নারীর বিপন্ন অস্তিত্বকেই কেবল নির্দেশ করে না, একটি জাতির স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গজনিত ট্র্যাজেডির স্বরূপও উন্মোচিত করে। ব্যক্তির করুণ আখ্যান ও আত্মত্যাগ জাতীয় জীবনকে উজ্জ্বল করলেও সামাজিক অন্ধকার আর ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ ইয়াসমীনের মতো সেইসব উজ্জ্বল মুখচ্ছবিকে ঢেকে দেয়। জীবনের প্রয়োজনে ও জাতীয় তাগিদে এক মহান মানবীর ত্যাগ ও লড়াইয়ের গৌরবকে লুটেরা সমাজ ও স্বার্থান্ধ মানুষ নস্যাৎ করে। যার অবদান হওয়ার কথা কথা ইতিহাসের স্বীকৃতিতে ধন্য এবং তার অবস্থান হওয়ার কথা জাতীয় জীবনের উচ্চতর স্থানে, তাকে যুদ্ধোত্তর সমাজ বাস্তবতা লাগাতার শোষণ ও লাঞ্ছনার পর নৃশংসভাবে হত্যা করে পাঠিয়ে দেয় মৃত্যুর ঠিকানায়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ ও মুক্তি সংগ্রামে এদেশের নারী সমাজের একটি ব্যাপক অংশের আত্মত্যাগ ও বীরোচিত ভূমিকা ইতিহাসের গৌরবময় অংশ হলেও সেইসব নির্যাতিতা নারীদের যথাযথ মূল্যায়ন, পুনর্বাসন ও সম্মানজনক স্থান নির্ধারণ করতে ব্যক্তি, সমাজ ও প্রশাসন চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। রিজিয়া রহমান ‘রক্তের অক্ষর’ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধে নারীর আত্মত্যাগ, মানবিক বিপর্যয় এবং সেই বিপর্যয়কে কাটিয়ে উঠার ক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক ব্যর্থতার প্রকট চিত্রটিই তুলে ধরেছেন ইয়াসমীনের বিয়োগান্ত করুণ পরিণতির আখ্যান নির্মাণের মাধ্যমে।

৭.

শুধু ‘রক্তের অক্ষর’ নয়, রিজিয়া রহমান মুক্তিযুদ্ধকে বার বার এবং বহুমাত্রিকভাবে স্পর্শ করেছেন তার কথাশিল্পের মাধ্যমে। ‘একটি ফুলের জন্য’ উপন্যাসে তিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের সমাজজীবন ও সময়-প্রবাহকে নানামুখী ঘাত-প্রতিঘাতে চিত্রিত করেছেন। তুলে ধরেছেন তৎকালীন সামাজিক বৈষম্যের পাশাপাশি জীবনযুদ্ধে পরাজিত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষোভ, হতাশা ও বঞ্চনার আখ্যান। মনে রাখা দরকার যে, সে সময় সমাজ বাস্তবতা বদলে গিয়েছিল বিপরীত মেরুতে এবং অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাই বাস্তব জীবনে নিদারুণ অবহেলা ও করুণার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন।

যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা, যারা রণাঙ্গণের কঠিন সমরে হারিয়েছিলেন তাদের হাত, পা এবং হয়েছিলেন পঙ্গু, তাদেরকে বড় গলায় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নামে ডাকা হলেও, তাদেরকে যথাযথ সামাজিক সম্মান, স্বীকৃতি দেওয়ার বদলে এক ধরনের অবজ্ঞা ও অবহেলার শিকারে পরিণত করা হয়। বীরাঙ্গনার মতো যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারেও সমাজ ছিল কুণ্ঠিত। এইসব বীরদের স্থান হয়েছিল সরকারি হোম-এ। কেউ কেউ জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার তাগিদে রিকশা চালিয়েছেন। অনেকে বেছে নিয়েছিলেন ভিক্ষাবৃত্তি। এমনই ছিল যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের অতি নির্মম আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা।

রিজিয়া রহমানের ‘একটি ফুলের জন্য’ উপন্যাসের নায়ক আলফু তেমনই একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে তার একটি পা হারিয়েছে। অন্যদিকে তার সহযোদ্ধা সাজ্জাদ পঙ্গু হয়ে সরকারি হোম-এ আশ্রিত হয়ে থাকে। রণাঙ্গনের আরেক সহযোদ্ধা ফরহাদ একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করে। অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সমীহ করলেও তারা তার মুক্তিযোদ্ধা ইমেজটাকেই বাণিজ্যিক স্বার্থে কাজে লাগাতে চায়। 

এমন বিরূপ পরিস্থিতি ও বাস্তবতা টের পায় উপন্যাসের চরিত্রসমূহ। যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তারা যে কখনো কখনো লৌকিক সম্মানের বাইরে বাস্তবে অবজ্ঞা-অবহেলা ছাড়া কিছুই পাচ্ছেন না, সেটাও অনুভব করেন। ফলে হতাশ ও ক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধারা এক ধরনের অবসাদ ও বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত হন। বঙ্গভবন ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের দাওয়াত দেয়া হলেও সেখানে এইসব পঙ্গু বীরযোদ্ধারা যেতে চান না। এই অব্যক্ত বেদনা ও প্রান্তিকীকরণের মনস্তত্ত্ব মূর্ত হয় রিজিয়া রহমানের প্রাঞ্জল ভাষায়:

‘গণ্যমান্য সম্মানী মানুষের ভিড়ের মধ্যে বুকের সেই ভয়টা ওদের প্রত্যেকটা মুহূর্তে সচেতন করে রেখেছে। কি যেন এখানে যে মুখগুলো ওদেরকে স্বাগত জানাচ্ছে, তাদের দৃষ্টির গভীরেও কি সেই কথাটা লুকানো আছে কিনা, তোমরা পঙ্গু।’

উপন্যাসে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবহেলা এবং তাদের হতাশা ও গ্লানির স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। সমাজে তারা যে অপাংক্তেয় ও করুণার পাত্র, তা-ও পরিস্ফুটিও হয়েছে। বিশেষ বিশেষ দিনে রাষ্ট্র ও সরকার তাদেরকে স্মরণ করলেও তা তাদের কোনও কাজেই আসে না। যে সত্য প্রকাশ পায় উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র পঙ্গু-যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মুনিরের হতাশামিশ্রিত কথায়:

‘ভোর থেকে সবাই সাভারের শহীদ মিনারে ছুটছে। এদেশে মানুষের চেয়ে মিনারের দাম বেশী; মরে গেলেই বোধ হয় দাম বাড়ে।’

যারা জীবন বাজি রেখে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন, হারিয়েছিলেন অঙ্গ, সেইসব জীবিত ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষোভ, বিদ্রূপ, হতাশার মধ্য দিয়ে যে বাস্তবতার দেখা উপন্যাসে পাওয়া যায়, তা হলো, দেশের বীর ও শ্রেষ্ঠ সন্তানরা রাষ্ট্র ও সমাজে প্রকৃত স্বীকৃতি বঞ্চিত ও চরম অবহেলার শিকার। রিজিয়া রহমান তাদের মর্যাদা না দেওয়ার বেদনাকে শিল্পিত করে তুলেছেন তার লেখায়। উন্মোচিত করেছেন নির্মম সমাজ বাস্তবতার প্রবঞ্চনা ও ব্যর্থতাকেও।

৮.

উপন্যাসের এক প্রান্তে প্রকৃত ও ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধাদের অবহেলিত পরিস্থিতির পাশাপাশি আরেক প্রান্তে দেখা পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে আরেক নিকৃষ্ট খেলার। যে খেলায় জড়িত অসৎ রাজনীতিবিদ, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসক ও স্বার্থান্ধ মানুষ। যারা মুক্তিযুদ্ধের মতো মহৎ ও ঐতিহাসিক প্রপঞ্চকেও ক্ষুদ্র স্বার্থে ব্যবহার করতে পিছপা হয় না।

আখ্যানে এ পর্যায়ে দেখা যায়, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্ভব, মুক্তিযোদ্ধাদের সার্টিফিকেট ও নাম ভাঙিয়ে স্বার্থবাদী মহলের আখের গুছিয়ে নেওয়ার মচ্ছব। একই সঙ্গে স্বাধীনতা বিরোধীদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে পুনর্বাসন ও সামাজিক মর্যাদায় পুনরাধিষ্ঠানের ঘটনা অতি দ্রুততার সঙ্গে ঘটতে থাকে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ রাজনৈতিক ঘুর্ণাবর্তে ও অবক্ষয়ের ফলে বিকৃত ও কোণঠাসা হওয়ার এই চিত্র উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। 

রিজিয়া রহমান সাহসের সঙ্গে এবং শৈল্পিক সুষমায় দেখান যে, মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত ষড়যন্ত্রের ফলে সাধারণ জনমানসে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরির একটা অপচেষ্টা সন্তর্পনে চলছে, তাদেরকে কোণঠাসা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে উপন্যাসে দেখানো হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা ফরহাদের ছোট ভাই আহাদ মুক্তিযুদ্ধে যোগদান না করেও কৌশলে দ্রুত প্রতিষ্ঠা লাভ করছে। বাংলাদেশের সমাজে এই নেতিবাচক রাজনৈতিক বিবর্তন উন্মোচন করেছেন তিনি পারঙ্গম বর্ণনায়:           

‘ফরহাদের দু’বছরের ছোট আহাদ। মুক্তিযুদ্ধে যায় নি সে। সেই আহাদ স্বাধীনতার পর মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার হয়ে গিয়েছিল। অমুক্তিবাহিনী বন্ধুদের নিয়ে সে দল তৈরি করে ফেলেছে। … মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট যোগাড় করেছিল সে। ম্যাট্রিক পাশ আহাদ কি চমৎকারভাবে অন্ধকারের সিঁড়িগুলো টপকে গেলো। ব্যবসা করল। … এখন বিলাতে চাকুরী করে। ফ্ল্যাট কিনেছে।’

কিন্তু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ভাই ফরহাদ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মূল্যবোধকে বিসর্জন দিতে পারে নি বলেই পিছিয়ে পড়ল। এইসব মুক্তিযোদ্ধারা যারা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য যুদ্ধে গিয়েছিল, তারাই দেশ ও সমাজ থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছরের মধ্যেই, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ এবং চেতনার বিলুপ্তি ঘটল রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে। উপন্যাসে সেই যুদ্ধোত্তর বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধবাদীদের উত্থান ও বিকাশের বাস্তবতাকেই রিজিয়া রহমান মূর্ত করেছেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মজৈবনিক ধারাক্রমের বর্ণনার মাধ্যমে। 

এক সময় মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির চরম শক্তি সঞ্চয়ের ফলে এমন একটি প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মধ্যে তো বটেই, খোদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও উচ্চারিত হতে থাকে যে, কেন তারা যুদ্ধে গিয়েছিল? উপন্যাসে এই আত্মজিজ্ঞাসায় ক্রমাগত ক্ষত-বিক্ষত হয়ে উপসংহারে একটি আশাবাদী প্রত্যয় তুলে ধরেন রিজিয়া রহমান। কোনও ব্যক্তিগত আকাক্ষা নয়, যুদ্ধ ও ত্যাগ শুধুমাত্র দেশের জন্য, স্বাধীনতার ফুলকে ধরার জন্য। এ চিরায়ত মনোভাব তিনি ব্যক্ত করেন উপন্যাসের শেষ দিকে, মুক্তিযোদ্ধা ফরহাদের কণ্ঠে:

‘আমরা চাই না কোনও বিদেশী ট্যাংকের নীচে আমাদের সে ফুল পিয়ে কলঙ্কিত করা হোক। অনেক দুঃখ নিয়েও অনেক কষ্ট করেও আমরা এই ফুলকে মুক্ত রেখেছি। এ ফুলকে আমরা বাঁচাবোই।’

স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ন রাখতে, স্বাধীনতাকে পেতেই মানুষের যুদ্ধযাত্রা সম্পন্ন হয়। শত ক্ষোভ, যন্ত্রণা ও না-পাওয়ার বেদনাকে ভুলেই বীর যোদ্ধারা স্বাধীনতার ফুলকে ধরে রাখেন। উপন্যাসে রিজিয়া রহমান নৈরাশ্য, অন্ধকার, জীবনযন্ত্রণা ও হতাশার বিরুদ্ধে সন্ধান করেছেন আলোকিত ভবিষ্যতের সোনালী দিনের। ব্যর্থতা, যন্ত্রণা ও পরাজয়ের সর্বগ্রাসী প্রতিষ্ঠার মধ্যেও রিজিয়া রহমান সন্ধান করেছেন আলো ও শ্রশ্রূষা। তার জীবনবাদী মন ও মনন বিপন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের অপরিমেয় প্রেমশক্তিতে উত্তরণের শক্তিমত্তাকে আবিষ্কার করেছে।  

৯.

রিজিয়া রহমানের উপন্যাসে প্রত্ন-ঐতিহাসিক আবহ আধুনিক বাংলা উপন্রাসের এক উজ্জ্বল অর্জন। বেলুচিস্তানের পটভূমিতে তার রচিত উপন্যাস ‘শিলায় শিলায় আগুন’ শুধু শক্তিশালী রচনাই নয়, সুগভীর সমীক্ষাও বটে। তিনি প্রত্বতাত্ত্বিকদের মতো ইতিহাস আর ঐতিহ্য খুঁড়ে খুঁড়ে তুলে এনেছেন তার প্রায় প্রতিটি উপন্যাসে। 

যেমন, ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাসটির ব্যাপ্তি বাঙালির জাতি গঠন ও ভাষার বিবর্তণের ইতিহাস। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বং গোত্র থেকে শুরু হয়ে একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় পর্যন্ত এই উপন্যাসের বিস্তৃতি। 

আবার নীল বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে খুলনা অঞ্চলের এক বিপ্লবী রহিমউল্লাহর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার বীরত্বগাঁথা নিয়ে লিখেছেন ‘অলিখিত উপাখ্যান’। 

বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির সাঁওতাল শ্রমিকদের জীবনচিত্র পর্যবেক্ষণ করে তিনি রচনা করেছেন ‘একাল চিরকাল’। 

‘প্রাচীন নগরীতে যাত্রা’ উপন্যাসে লিখেছেন ঢাকার অতীত ও বর্তমান জীবনযাপন।

চট্টগ্রামে হার্মাদ পর্তুগিজ জলদস্যুদের অত্যাচার এবং পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের দখলদারিত্বের চিত্র তুলে ধরেছেন ‘উত্তর পুরুষ’ উপন্যাসে, যেখানে চিত্রিত হয়েছে আরাকান-রাজ-সন্দ-সুধর্মার অত্যাচার, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বীরত্ব, পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের গোয়া, হুগলি, চট্টগ্রাম দখলের ইতিহাস।

গভীর মননশীলতায় রিজিয়া রহমান নির্মাণ করেছেন তার লেখালেখির জগৎ। এতো বড় মাপের লেখক শুধু তার সমকালেই নয়, অনাগতকালেও আলো ছিড়াতে থাকবেন। শেষ জীবনে তিনি ছিলেন নিভৃতচারী, এবং অবশেষে জীবনের চেয়ে দূরের ঠিকানায় তিনি চলে গেছেন চিরকালের জন্য। তথাপি পাঠক চিত্তে তিনি জাগ্রত থাকবেন তার অক্ষয় অক্ষরমালায় সজ্জিত গল্প-উপন্যাস, কথাশিল্পের সম্ভারে।

১০.   

খুব কাছ থেকে পর্বতকে বড় ও বিশাল দেখায় না। মনে হয় দেয়াল মাত্র। তেমনি আশেপাশের বড় মাপের মানুষদের বিশালতাও আমরা টের পাই না। শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমরা অজ্ঞতা বা ক্ষুদ্রতার জন্য নিজস্ব মেধাকে এড়িয়ে যাই। ঔপন্যাসিক রিজিয়া রহমান তেমনি বড় মাপের একজন কথাকার। যদিও আমরা আমাদের কাছের মেধাবীদের বিশালত্ব মূল্যায়ন করতে পারি না। দূরের কেউ হলে, সেটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার বন্যা শুরু হয় সাহিত্যের পাতায়। অথচ বিশ্ব বরেণ্য লেখকদের মতোই তার লেখার মান, তা আমরা মূল্যায়নের আলোয় আনতে পারি নি। 

রিজিয়া রহমান  ভারতের কলকাতার  ভবানীপুরে এক মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । তার পৈত্রিক বাড়ি ছিল কলকাতার কাশিপুর থানার নওবাদ গ্রামে। তার পারিবারিক নাম ছিল জোনাকী। তার বাবা আবুল খায়ের মোহম্মদ সিদ্দিক ছিলেন একজন চিকিৎসক ও মা মরিয়াম বেগম একজন গৃহিণী। তাদের পরিবার ছিল সংস্কৃতিমনা। তার দাদা মুন্সী আব্দুল খালেকের পড়ালেখার অভ্যাস ছিল। তার ঘরে সেলফ ভর্তি ছিল ইংরেজি আর ফার্সি বই। তার বাবা ছিলেন সঙ্গীত অনুরাগী। তিনি এসরাজ ও বাঁশি বাজাতেন এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতেন।

রিজিয়া রহমানের বাবার চাকরীর কারণে তাদের ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়েছে। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর তারা বাংলাদেশে চলে আসে। দেশে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ফরিদপুরে। সেই সময় শখের বশে কবিতা লিখতেন। তখনই তার লেখালেখির সূচনা হয়।  পরে তিনি কষ্ট করে শিক্ষা জীবন এগিয়ে নেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। 

পুরোটা জীবন তিনি কাটিয়েছেন সাহিত্য সাধনায়। তার প্রচেষ্টায় আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্য ঋদ্ধ হয়েছে। তিনি তার অনন্য সাহিত্য সম্ভারের মধ্যে বেঁচে থাকবেন মৃত্যুর পরেও। নারী, মুক্তিযোদ্ধা, সংগ্রামী মানুষ, প্রান্তিক জনজীবনের কথা যে রক্তের অক্ষরে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন, তা জোনাকির আলোর মতো প্রজ্বলিত থাকবে বাংলাদেশের সাহিত্যের আকাশে।

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;