“মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছেন”



অনুবাদ ও গ্রন্থনা : আন্দালিব রাশদী
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

হেনরি কিসিঞ্জারকে জোসেফ জে সিসকোর চিঠি ও অন্যান্য

[জোসেফ জে সিসকো (জন্ম ৩১ অক্টোবর ১৯১৯-মৃত্যু ২৩ ডিসেম্বর ২০০৪), ইতালিয়ান-আমেরিকান, ১৯৭১-এ আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট; চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল রিভিউ গ্রুপ। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে হেনরি কিসিঞ্জারের শাটল ডিপ্লোম্যাসি চলাকালে তিনিই প্রধান দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন করেন। সিসকো ১৯৫১ সালে কূটনৈতিক চাকরিতে যোগদানের আগে কিছুসময় সিআইএ-ও কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন। হেনরি কিসিঞ্জার তখন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এম নিক্সনের সহকারী।]

১৫ মার্চ ১৯৭১ : আজ ঢাকায় দিনের প্রথম ভাগে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছেন, তার দল আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে (৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি অধিকার করে) পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার নিয়ে নিয়েছে।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সামরিক আইন প্রশাসন, যা এখনো পাকিস্তান সরকার, তার তোয়াক্কা না করেই মুজিব এককভাবে এ কাজটি করেছেন। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, মুজিবের ঘোষণার ৩৫টি নির্দেশনা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নেওয়ার ইচ্ছাকৃত ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ।

এই পদক্ষেপ নিয়ে মুজিব সরাসরি ইয়াহিয়া সরকারের মুখোমুখি দাঁড়ালেন, তবে তিনি সচেতনভাবে পূর্ব পাকিস্তানের নিঃশর্ত স্বাধীনতা ঘোষণা এড়িয়ে গেছেন এবং তার এ কাজের ভিত্তি যে গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে জনগণের গণতান্ত্রিক রায় তা উল্লেখ করেছেন।

ইয়াহিয়া প্রশাসন এই সংকটাকীর্ণ পদক্ষেপের কারণে অবশ্যই দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাবে। মুজিবের সঙ্গে কথা বলার জন্য ইয়াহিয়া ঢাকায় ছুটে এসেছেন।

ইয়াহিয়ার সামনে দুটি পথ—এর যে কোনোটি ইতিমধ্যেই ভঙ্গুর হয়ে পড়া পাকিস্তানের ঐক্য আরো বিপদাপন্ন করে তুলবে। ইয়াহিয়া যদি মুজিবের এ পদক্ষেপ মেনে নেন, তাহলে ধরে নিতে হবে তার সামরিক আইনের ক্ষমতা অন্তত পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্যাহৃত হয়েছে, পশ্চিম পাকিস্তানে তা বহাল রাখা দুরূহ হয়ে পড়বে (ভুট্টোর রোববারের ভাষণ তা আরো স্পষ্ট করে তুলেছে)।

যদি ইয়াহিয়া কিংবা সামরিক বাহিনীর অন্যরা বলপ্রয়োগ করে মুজিবকে প্রতিহত করেন, পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠবে সামরিক বাহিনী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের লড়াইয়ের রণক্ষেত্র। যার ফলে শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলার আত্মপ্রকাশ ঘটবে।

পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন হবে—যদি-না দীর্ঘমেয়াদে সেনাবাহিনী বিদ্রোহ দমন করতে পুরোপরি সক্ষম হয়। ‘সম্ভাব্য সব পন্থায়’ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত সব শক্তিকে প্রতিহত করতে মুজিব এক বিবৃতিতে বাঙালিদের আহ্বান জানান।

সোমবার করাচিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো দাবি জানিয়েছেন ক্ষমতা দুই অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে হস্তান্তর করা হোক—ভুট্টোর দলকে পশ্চিমাংশের, মুজিবকে পূর্বাংশের।

ভুট্টোর ভাষণ মুজিবের পদক্ষেপকে উজ্জীবিত করে থাকতে পারে। বিগত কিছুদিন ধরে যা সন্দেহ করা হচ্ছিল—ভুট্টো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সম্পূর্ণ বা আংশিক খণ্ডিত দেশে পশ্চিমাংশের ক্ষমতা গ্রহণই তার জন্য উত্তম, তবে মুজিবের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ ভুট্টোর বেলায় সহজ হবে না কারণ সেনাবাহিনী পশ্চিমাংশে এত শক্তিশালী যে বিদ্রোহীদের দমন করা কঠিন হবে না। এ সময় ইয়াহিয়া কী সাড়া দেন তা-ই হয়ে উঠবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক।

বিবিসি লন্ডন

২৭ মার্চ ১৯৭১ (দ্বিতীয় সংবাদ)
তিন দিন আগে সেনা মোতায়েনের একজন চাক্ষুষ সাক্ষী বিবিসি প্রতিনিধি নিজেই : তাকে ঢাকা থেকে বহিষ্কারের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেছেন, ঢাকা শহরের লোকদের সন্ত্রস্ত করার জন্য সেনাবাহিনী পূর্ব-পরিকল্পিত নিষ্ঠুর একটি অপারেশন চালিয়েছে।

আমাদের সংবাদদাতা আরো বলেছেন, ট্যাংক ও আর্মার্ড ট্রাকভর্তি সৈন্য খুব কমই প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে, যদিও ছাত্রদের হাতে কিছু অস্ত্র ছিল। চারদিকে গুলির শব্দ এবং ভবনগুলোতে লেলিহান অগ্নিশিখা।

আমাদের প্রতিনিধি ও তার সঙ্গী ফিল্ম ক্রুকে তিনবার ব্যাপকভাবে তল্লাশি করা হয়েছে। দেশের বাইরে প্রেরণের আগেই তাদের সংবাদ ও কাগজপত্র জব্দ করে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, সামরিক সরকার মরিয়া হয়ে উঠেছে যাতে সেন্সরবিহীন সংবাদ দেশের বাইরে যেতে না পারে।

প্রতিনিধি আরো জানিয়েছেন, সামরিক বাহিনীর বিবৃতিতে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতার হওয়ার সংবাদটি সম্ভবত সত্য।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শেষ হয়ে আসছে। রেডিও পাকিস্তান জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হয়েছে। ভারতীয় বাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী সংসদে বলেছেন, দু পক্ষের প্রতিনিধি ঢাকায় আত্মসমর্পণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। পাকিস্তানের পক্ষে এই চুক্তি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের।

তিনি বলেন, ভারত আশা করে যে পাকিস্তানে আটক পূর্ব পাকিস্তানীদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান নিজ দেশের মানুষের মধ্যে তাঁর আসন গ্রহণ করবেন এবং বাংলাদেশকে শান্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

তিনি বলেন, ভারতীয় বাহিনী প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় অবস্থান করবে না। তিনি আরো বলেন, লাখ লাখ শরণার্থী এর মধ্যেই দেশের পথে পা বাড়িয়েছে।
(বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস থেকে প্রচারিত ইংরেজি সংবাদের অনুবাদ)

একটি অসাধারণ সাক্ষাৎকার

[তেহরানের দৈনিক কিয়ান আওয়ামী লীগ প্রধানের যে সাক্ষৎকার গ্রহণ করে তার ওপর ভিত্তি করে ডন ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১-এ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তা অনূদিত হলো]

মুজিব প্রদেশসমূহের অধিকার নিশ্চিত করতে চান
তেহরান, ১৯ ফেব্রুয়ারি : আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, কেবল পূর্ব পাকিস্তানের নয়, ফেডারেল কাঠামোর আওতায় পশ্চিম পাকিস্তানের সব প্রদেশের অধিকার তিনি নিশ্চিত করতে চান। তেহরানের দৈনিক কিয়ানের প্রতিনিধিকে ঢাকায় দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, আমরা চাই সুবিচার ও ঐক্যের ভিত্তিতে সমগ্র জাতি উন্নতি লাভ করুক। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক পাকিস্তানই হবে শক্তিশালী পাকিস্তান। তার পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে শেখ মুজিব বলেন, পররাষ্ট্রনীতি হবে জোট নিরপেক্ষ কিন্তু পৃথিবীর সকল দেশের সাথে সক্রিয় বন্ধুত্ব থাকবে।

শেখ মুজিবুর রহমান জোর দিয়ে বলেন, যারা তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে, তারা কুৎসা রটনাকারী। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে যেসব ভুল করা হয়েছিল তা সংশোধন করতে পারলে পাকিস্তান শক্তিশালী হয়ে উঠবে, অন্যদিকে বর্তমান প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে পাকিস্তান এত দুর্বল হয়ে পড়বে যে, তা থেকে আর উত্তরণ সম্ভব হবে না।

শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে ইসলামাবাদ আর পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যতের নির্দেশনা দিতে পারবে না। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসন প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, আমাদের কর্মসূচি কেবল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নয়। ফেডারেল কাঠামোর আওতায় আমরা চাই পাঞ্জাব, সিন্ধু, বালুচিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের অধিকারও সুরক্ষিত হোক।

বাংলাদেশকে দারিদ্র্যের মধ্যে ফেলে রাখা পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইদেরও প্রকৃত স্বার্থের পরিপন্থী। এখন যা স্থানীয় দারিদ্র্য, দীর্ঘমেয়াদে তা-ই সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়বে। আমরা চাই ধনবাদী পদ্ধতির যে একচেটিয়াবাদ ও ট্রাস্ট লাখো মানুষের দারিদ্র্যের বিনিময়ে কিছু মানুষকে মোটাসোটা করছে, তার অবসান ঘটুক।

ভারত কি বাংলাদেশকে খেয়ে ফেলবে?
যখন জিজ্ঞেস করা হলো, ফেডারেল পাকিস্তান হবার কারণে ভারত না আবার বাংলাদেশকে ‘খেয়ে ফেলে’, মুজিব হেসে উঠেন। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করলেন, ‘আজকাল কেউ কাউকে খেয়ে ফেলতে পারে না। ভারত তো তাদের বাংলাকে নিয়ন্ত্রণ করতেই হিমশিম খেয়ে যায়, আমাদের দরিদ্র লোকেরা ভেঙে পড়ার পর্যায়ে এলেও তাদের স্বাধীনতা রক্ষা কতে পারবে।’

তিনি বলতে থাকলেন ‘ভিয়েতনামের দিকে তাকান, আমেরিকার মতো শক্তিশালী দেশ তার ইচ্ছে চাপাতে গিয়ে গরিব কৃষকের মাতৃভূমিতে কত অসহায় হয়ে পড়ছে। আমেরিকা যদি ভিয়েতনামকে খেয়ে ফেলতে না পারে, ভারত কেমন করে বাংলাদেশকে খাবে?’

অর্থনৈতিক নীতিমালা
সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে রচিত প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ মুজিবের অর্থনৈতিক নীতিমালায় প্রধান সেক্টরসমূহ ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স, ভারি শিল্প, বিদেশ বাণিজ্য, পাট, তুলা, যানবাহন বিশেষ করে জাহাজ পরিবহন পুরোপুরি জাতীয়করণের কথা বলা হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন, এতে ‘কোটারি শক্তি ভেঙে যাবে এবং দেশের ফেডারেল ইউনিটগুলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যার যার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারবে এবং জনগণ রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড নিয়ে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পাবে।

বিদেশী ঋণ
তার অর্থনৈতিক নীতিমালার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, উদারীকরণ, ‘বৈদেশিক ঋণের অভিশপ্ত বোঝা’ থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করা—‘আমরা অতীতে উন্মত্তের মতো বৈদেশিক ঋণ গ্রহন করেছি, আমাদের গ্রহণ করা ঋণে কিছু সংখ্যক পুঁজিবাদী এবং প্রশাসনে তাদের এজেন্টগণ পুষ্ট হয়েছে আর ঋণের বোঝা ও ঋণের সুদের বোঝা বহন করতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে।’

তিনি চান ফেডারেল সরকার পূর্ণ কর্মসংস্থান, খাদ্যসহ মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং ইরানের ‘লিটারেসি কোর’-এর মতো সংগঠনের মাধমে দারিদ্র্য বিমোচনের গ্যারান্টি দিক। তার পররাষ্ট্রনীতি জোটনিরপেক্ষ থাকার এবং পৃথিবীর সব জাতির সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষার এবং আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা নিষ্পতি করার।

তিনি চান পাকিস্তান ‘সেন্টা’ এবং ‘সিয়োটো’ থেকে বেরিয়ে আসুক, তবে তিনি চান পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্কের একত্রে থাকার আরসিডি গ্রুপ থাকুক এবং বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অংশগ্রহণে তা আরো বড় হোক।

কাশ্মীর বিরোধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একনায়কত্বের দোহাই দিতে এবং সমরাস্ত্রের জন্য বিপুল ব্যয় করতে সামরিক বাহিনী ও পুঁজিবাদীরা কাশ্মীরকে ব্যবহার করছে। ‘তবুও জম্বু ও কাশ্মীরের জনগণের জন্য আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করিনি।’

মুজিব ভারতের সঙ্গে সর্বোত্তম সম্পর্ক রক্ষা করতে চান। তিনি বলেন, ‘আমরা একই উপমহাদেশের ভাগীদার। পছন্দ হোক বা না হোক আমাদের একসঙ্গে থাকতে হবে, একসঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে।

চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব
চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব মুজিবের পররাষ্ট্রনীতির অংশ। ভৌগোলিক অবস্থান এবং নীতিই বন্ধু নির্ধারণ করে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘কিন্তু তার মানে এই নয় আমাদের পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। আমরা মুসলমান এবং আমরা কখনো কমিউনিজম গ্রহণ করব না।’ ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে মুজিব বলেন, ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক এবং আবেগময় বন্ধনে দু দেশ এমন দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ যে এ নিয়ে বেশি কথা বলার প্রয়োজন নেই এবং এই দুই ভ্রাতৃপ্রতীম দেশকে কেউই বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না।

জাতিসংঘ মহাসচিব বললেন

জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট পূর্ব পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ সমর্থিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনীত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার গোপন বিচার নিয়ে পাকিস্তান সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, নভেম্বরে পূর্ব বাংলায় হারিকেনের ধ্বংসযজ্ঞ এবং পরবর্তী কলেরা মহামারির চেয়ে ভয়াবহ হবে এই বিচারের পরিণতি।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা উ থান্টের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। আওয়ামী লীগের জন্য ৯৮ ভাগ জনসমর্থনের ওপর ভিত্তি করে তারা এই মন্তব্য করেন।... ইয়াহিয়া খানের প্রশাসন কোথায় মুজিবুর রহমানের বিচার হচ্ছে তা প্রকাশ করতেও অস্বীকার করছে। তাদের সরবরাহকৃত তথ্যে বলা হয়েছে ‘পাকিস্তানের কোথাও’ তার বিচার হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাঙালিরা কোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেবে তা যেখানে উদ্বেগের বিষয়, যেখানে তারা পশ্চিমাপন্থী, কিন্তু তারা রেড চীনের প্রতিবেশী, মুজিবুর রহমান যেখানে মধ্যস্থতার চেয়ে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে বেশি ঝুঁকে আছেন—তিনি ভোটারের মতামত ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর চাওয়ার তফাতটা ভালো করে জানেন তার গোপন বিচারের পরিণতি ভালো হওয়ার নয়।
(১৩ আগস্ট, ১৯৭১)

মুজিবকে অবশ্যই মুক্তি দিতে হবে - ইন্দিরা গান্ধী

[ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দুটি অফিসের একটি দিল্লির প্রশাসনিক ভবন, যেটি সাউথ ব্লক নামে পরিচিত। সানডে টাইমস-এর নিকোলাস ক্যারোল এখানে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে।]

গান্ধী বললেন, তাঁর কোনো সন্দেহ নেই যে ভারত ও পাকিস্তানের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে, যদি বাইরের কোনো হস্তক্ষেপ না থাকে তাহলে উপমহাদেশে স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে।

ক্যারল : বাংলাদেশ প্রশ্নে আপনার ঘোষিত লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। আপনি স্পষ্টভাবেই বলেছেন, ভারতের রাষ্ট্রসীমা বৃদ্ধির কোনো অভিলাষ নেই। তাহলে কবে নাগাদ শেষ ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের কাজটি সম্পন্ন হবে?
মিসেস গান্ধী : এ পর্যায়ে বলা কষ্টকর। বিষয়টি প্রধানত বাংলাদেশ সরকারের ওপর নির্ভর করে। আমরা আশা করি তা শিগগিরই ঘটবে।
ক্যারল : কত সপ্তাহ বা মাস এমন কিছু কি ভাবছেন?
মিসেস গান্ধী : এখনো বিষয়গুলো এলোমেলো অবস্থায় রয়েছে বলে আমি এ অবস্থায় কিছু বলতে পারছি না। সেখানকার জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টিও দেখতে হবে। অবাঙালিদের প্রতি এবং অন্যান্য বিষয়েও আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। আমি মনে করি ভারতীয় সেনাবাহিনী এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারবে।
ক্যারল : আপনি কি আবারও সুনির্দিষ্টভাবে বলবেন যে পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো এলাকা ভারতের অধিকারে রাখার ইচ্ছে আপনার নেই?
মিসেস গান্ধী : আমি মনে করি আমি সুনির্দিষ্টভাবেই জনসভায় এবং সংসদে বলেছি যে আমাদের সীমানা সম্প্রসারণের কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই।
ক্যারল : পাকিস্তানের অধিকারে যে এলাকা রয়েছে যা আপনার মতে ন্যায্যত ভারতের—সেক্ষেত্রেও কি এমনই কথা প্রযোজ্য?
মিসেস গান্ধী : আমি বলেছি যে আমরা বল প্রযোগ করে তা উদ্ধার করব না। কিন্তু আপনি জানেন, আমরা কেবল বিশ্বাসই করি না, এটা প্রমাণিতও হয়েছে যে যুদ্ধরহিতকরণ রেখা বরং খামখেয়ালির মাধ্যমে নির্ধারিত এবং তা শান্তি নিশ্চিত করতে সাহায্য করে না। তবে এটা নিয়ে সরকার নতুন করে বা নতুন কিছু ভাবছে না।
ক্যারল : বাংলাদেশের জন্য তার নেতা শেখ মুজিবুরের বিশেষ প্রয়োজন। তার মুক্তি নিশ্চিত করতে ভারত কী করছে? আপনি কোন ধরনের চাপ দিচ্ছেন?
মিসেস গান্ধী : আমি মনে করি না আমরা অনেকটা চাপ দিতে পারব। আমাদের দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে আমরা বিশ্ব সরকারগুলোর কাছে আপিল করেছি, আমি ব্যক্তিগতভাবে সবার কাছে চিঠি লিখেছি। আমরা একান্তভাবে প্রত্যাশা করি, তারা কিছুটা চাপ দেবে। আজ সকালেই দেখলাম আমেরিকান সরকার (পাকিস্তানের সাথে ভারতের) যুদ্ধবিরতির কিছুটা কৃতিত্ব দাবি করে বসেছে: আশা করি তারা তাহলে এ ব্যাপারটাও দেখবে।
ক্যারল : কিন্তু আপনি তো তার জন্য জিম্মি হিসেবে পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের আটকে রেখেছেন। এটা কি সমঝোতার দরকষাকষিতে একটা ভূমিকা রাখতে পারে?
মিসেস গান্ধী : এ নিয়ে আমি তেমন কিছু বলতে পারব না, কারণ আমি জানি না কিভাবে সে আলোচনা হবে বা কী ঘটবে।
ক্যারল : ভারত শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে বলে মনে করেন?
মিসেস গান্ধী : পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হবে এ নিয়ে আমার কখনোই কোনো সন্দেহ ছিল না। আমি মনে করি দুর্ভাগ্যজনক দিকটি হচ্ছে মাঝেমধ্যে এমন সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে যারা এই সম্পর্ক স্থাপনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে আমাদের প্রতি একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ অনুভূতি রয়েছে। যখনই আমাদের কেউ যে কোনো উদ্দেশে সেখানে গিয়েছে যেমন শিখদের, অতীতে আমাদের ক্রীড়াদলকে তারা উষ্ণ স্বাগতম জানিয়েছে।
ভারতেও দেখবেন পাকিস্তানের ব্যাপারে কোনো কথা নেই; এটা ঠিক তাদের খবরের কাগজে ঘৃণা প্রচারণা অব্যাহত আছে। এমনকি শিক্ষা কর্মসূচিতে।...ভারতে কী ঘটছে, উন্নয়ন কিভাবে হচ্ছে সে দৃষ্টিতে যদি তারা তাকায়, আমরা যদি সহযোগিতা করি তাহলে দুই দেশই আরো শক্তিশালী ও সামর্থ্যবান হয়ে আমাদের কঠিন সমস্যার মোকাবিলা করতে পারব।
ক্যারল : আপনাকে যুক্তিসংগত আশাবাদী শোনাচ্ছে।
মিসেস গান্ধী : আমি মনে করি আমি একজন আশাবাদী মানুষ।
ক্যারল : বাংলাদেশ ও শরণার্থী প্রশ্নে ভারতের অবস্থান বুঝতে না পারায় আপনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে তিরষ্কার করেছেন, ফলে আপনার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছে। যদি ধরে নিই আপনার প্রত্যাশা অনুযায়ী যত দ্রুত সম্ভব এ সম্পর্কের উন্নয়ন হয়, আপনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পদক্ষেপ গ্রহণ দেখতে চান?
মিসেস গান্ধী : হ্যাঁ, এটি আপনিই উল্লেখ করেছেন। শেখ মুজিবের মুক্তির বিষয় তাদের বাংলাদেশ পরিস্থিতির বাস্তবতায় স্বীকার করতে হবে। তাদের পাকিস্তান পরিস্থিতির বাস্তবতাও মানতে হবে। একটা দূরের দেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে উৎসাহ জোগাতে পারে না, হস্তক্ষেপও করতে পারে না। আপনার পছন্দের বিশেষ সরকারকে আপনি সমর্থন করতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেই সরকার সে দেশের জনগণের জন্য সঠিক কিনা? যদি তা না হয়, তাহলে এটি কখনো শক্তিশালী সরকার হতে পারে না—এর পেছনে যত সেনাবাহিনীই থাকুক না কেন, তাতে কিছু এসে যায় না। এটা আমাদের বিষয় নয়, তাদের। এটা পাকিস্তানের ব্যাপার।
ক্যারল : বর্তমানে ভারতের সঙ্গে ব্রিটেনের চমৎকার সম্পর্ক। এশিয়ায় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষায়, যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ বা কমনওয়েলথ বিষয়ক ব্রিটেন কী করতে পারে বলে আপনার ধারণা?
মিসেস গান্ধী : আমি আগেই বলেছি বাইরের শক্তি যদি হস্তক্ষেপ না করে তাহলে স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ব্রিটেন সম্প্রতি কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু আপনারা আগে করেছেন। বর্তমান পরিস্থিতি অংশত সে কারণেই সৃষ্টি হয়েছে—কেবল আপনাদের নয়, অন্যদের হস্তক্ষেপেও।
ক্যারল : আপনি কি মনে করেন আপনার এই উদ্বেগের বিষয়টি আমরা সবাই অবহিত?
মিসেস গান্ধী : হ্যাঁ, আমি মনে করি আপনারা জানেন।
ক্যারল : আমরা যদি বাংলাদেশকে আগে স্বীকৃতি দিই, আপনি তা স্বাগত জানাতেন?
মিসেস গান্ধী : বাংলাদেশের জনগণ স্বাগত জানাবে।
ক্যারল : আপনি কি মনে করেন আমাদের স্বীকৃতি আন্তর্জাতিকভাবে সংকট সমাধানে সহায়ক হবে?
মিসেস গান্ধী : আমি মনে করি তা হবে। এটা বাংলাদেশের জন্য ভালো, কারণ তারা বুঝবে তাদের বন্ধু আছে।
ক্যারল : গত সপ্তাহে মি. কুজনেতজভ যখন দিল্লিতে আসেন, তখন কি বাংলাদেশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বীকৃতি দান নিয়ে আলোচনা করেছেন?
মিসেস গান্ধী : না, আমরা এ ধরনের বিষয় নিয়ে আলাপ করিনি। তবে আমরা নিশ্চয়ই আশা করব, আরো বহুসংখ্যক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে।
ক্যারল : অন্য সব দেশ পেছনে ফেলে কেবল সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ছুটে আসবে—এটাকে আপনি অনাকাঙ্ক্ষিত মনে করেন না?
মিসেস গান্ধী : এটাকে বরং আমি এভাবে দেখতে চাই, যত বেশিসংখ্যক দেশ স্বীকৃতি দেবে, বাংলাদেশ তত আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে, এখন বাংলাদেশকে যেসব সমস্যার মোকাবিলা করতে হচ্ছে তখন তার সমাধান সহজ হয়ে যাবে। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, স্বাধীনতা দরজাটা খুলে দেয়; কিন্তু আসল কাজ আসে তারপর।

   

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;