জমিলার দেশ কিরঘিজস্তানে



সঞ্জয় দে
ছবি. লেখক

ছবি. লেখক

  • Font increase
  • Font Decrease

সেই যে কবে সুকুমার রায় লিখেছিলেন না—“পুলিশ এলে ডরাই না আর, পালাই নে আর ভয়ে, আরশোলা কি ফড়িং এলে থাকতে পারি সয়ে।”—আমি কিন্তু তেমন নই। আরশোলা আর ফড়িংকে সয়ে নিলেও, পুলিশকে আমি ষোল আনা ডরাই। তাই কিরঘিজস্তানের রাজধানী বিশকেক শহরের আব্দুররাহমানিভ স্ট্রিটে চলার সময়ে যখন দুজন পুলিশ দু দিক থেকে আমাকে ঘিরে ধরে, আতঙ্কিত না হয়ে পারি না। তাদের সাথে আছেন সাদা পোশাকের আরো দুজন পুলিশ। আমাকে তারা এমনভাবে চারদিক থেকে বেষ্টন করে দাঁড়ালেন, চাইলেও সেই চক্রব্যূহ ভেদ করে ভোঁ দৌড় দেবার কোনো উপায় নেই। মুখে তাই সরল একটা অপাপবিদ্ধ অভিব্যক্তি নিয়ে তাদের জেরার অপেক্ষায় সেখানে দাঁড়িয়ে যাই। এ অঞ্চলে শুনেছি পুলিশ খুব একটা সততানিষ্ঠ নয়, তাই আমাকে পাকড়াও করে মিথ্যে অভিযোগ দিয়ে কোনো পয়সা দাবি করে কিনা, সেরকম একটা সন্দেহও মনে উঁকি দেয়। তো সেই দলে থাকা একমাত্র নারীসদস্য আমার সমস্ত ভুল ভাঙিয়ে আশ্বস্ত করে জানালেন, তারা আসলে ট্যুরিস্ট পুলিশ। কিছুদিন হলো এই বিশেষ বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু কাজ নেই তেমন। ট্যুরিস্ট যেমন কম, তার চেয়েও কম অপরাধের মাত্রা। ফলে ইনাদের একপ্রকার মাছি তাড়াবার অবস্থা। আমাকে দেখে এই দলটির আগ্রহ হয়েছে আমার কাছ থেকে দু চারটি কথা জানবার। এই যেমন কোথা থেকে এসেছি, কদিন থাকব, কেমন লাগছে বিশকেক, কোথায় কোথায় যাবার পরিকল্পনা আছে, এই সব আরকি। সবশেষে তাদের অভিলাষ হলো, আমার সাথে একটি ছবি তুলবেন। বেশ, তুলুন। ভেতরে ভেতরে বেশ উৎফুল্ল বোধ করছি ততক্ষণে। কোথায় ভেবেছিলাম উৎকোচ দাবি করা অসৎ পুলিশ, আর শেষে কিনা আবিষ্কার করলাম সদালাপী বন্ধুভাবাপন্ন ভিন্ন ধরনের পুলিশ, তাই অবাক আর উৎফুল্ল না হয়ে উপায় আছে?

আজ এখানে মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া। ছেড়ে ছেড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। গতকালও এমনই ছিল। তবে বৃষ্টির তেজ ছিল আরো বেশি। তার মাঝেই এয়ারপোর্ট থেকে আসতে হয়েছে। সে-নিয়ে বেশ রকমের ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। বিশকেকের এয়ারপোর্ট মূল শহর থেকে বেশ দূরে, প্রায় পঞ্চাশ মিনিটের পথ। গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা দু লেনের মন্থর পিচঢালা পথ ধরে সেখানে পৌঁছাতে হয়। আমি এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিইনি। ভূতুড়ে জনমানবহীন সেই এয়ারপোর্টের বাইরে আসতেই দেখা পেয়েছিলাম ‘মারসুতকা’র, যেটি আদতে হলো ভাড়ায় খাটা মাইক্রোবাস। ভাড়া ট্যাক্সির দশ ভাগের এক ভাগ। যদিও যাত্রীবোঝাই হবার জন্যে অপেক্ষা করতে হলো বেশ খানিকটা সময়। এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই ঝুমবৃষ্টি। বৃষ্টির ভারি পর্দাকে উপেক্ষা করে জোরসে ওয়াইপার চালিয়ে শম্বুকগতিতে মারসুতকা ছুটে চলে। মিনিট পনের পথ আসার পর দেখি দু পাশটা প্রায়ান্ধকার। ঝুপ করেই যেন নেমে এসেছে বিদায়ীবেলার সন্ধ্যা। আর সামনের রাস্তায় এপাশের মাঠ উপচিয়ে তীব্র গতিতে জল ছুটে যাচ্ছে উল্টো দিকের মাঠের দিকে। এর মাঝ দিয়ে গাড়ি ছোটালে জলের স্রোতে কলার ভেলার মতো ভেসে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। আমাদের ড্রাইভার বিশাল এক সিডার গাছের কোণে গাড়িটিকে দাঁড় করিয়ে পরিস্থিতির ব্যাপকতা কিছুটা বুঝে নেবার চেষ্টা করে। ওখানেই আমরা আটকে থাকি বেশ কিছুক্ষণ। কিছুটা শঙ্কা জাগে, যদি বৃষ্টি আর না থামে? যদি জলের তোড় এসে পৌঁছায় এ গাড়ি অবধি, তাহলে? আশেপাশে গ্রামের কিছু চাষিবাড়ি ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছে না। এখানে বিপদে পড়লে সাহায্য করবার কেউ এগিয়ে আসবে কি?

বৃষ্টি থেমেছিল শেষ অবধি, সেই সাথে মন্থর হয়েছিল প্লাবনের তেজ। কিন্তু এতসব ডামাডোলে আমরা যখন আলাতু বাজারের কোণে এসে পৌঁছাই, ততক্ষণে চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এখান থেকে আমার হোটেল যে কোন দিকে, কিংবা কত দূরে, কিছুই ধারণা নেই আমার। কিছুটা ক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। মাথার উপরের বুড়ো ওক গাছ থেকে টপ টপ করে ঝড়ে পড়ে বিকেলের বৃষ্টির জমে থাকা ফোঁটাগুলো। পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময়ে হঠাৎ এক যুবক দাঁড়িয়ে যায়। আমার অবস্থা আঁচ করতে পেরে নিজ থেকেই বলে, ‘ট্যাক্সি খুঁজে দেব তোমায়?’ আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলি। ছেলেটি পকেট থেকে ফোন বার করে দ্রুত কিছু টেপাটেপি করে জানায়, ‘মিনিট পাঁচেকের ভেতরেই ট্যাক্সি এসে পড়বে। ততক্ষণ আমি তোমার সাথে আছি। আমি এখানকার টিভি স্টেশনে গ্রাফিক্সের কাজ করি। আজ আমার বিকেলের শিফটে কাজ ছিল। ফেরার সময়ে দূর থেকে দেখলাম, তুমি এখানে সুটকেস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছো। তাই ভাবলাম, তোমার হয়তো কোনো সাহায্য প্রয়োজন।’ অজানা একটি দেশে এমন একজন অপরিচিত জনের কাছ থেকে বাড়িয়ে দেওয়া সাহায্যের হাত পেয়ে মুহূর্তেই মনটা ভালো হয়ে গেল।

আলাতু স্কয়ারের কোণের দিকটায় টিউলিপের বাগান। সকালের বৃষ্টির ফোঁটা লুকিয়ে আছে আধবোজা টিউলিপের জঠরে। সেই সাথে আশেপাশে ফুটে আছে বেশকিছু ধবধবে সাদা ড্যাফোডিল। টিউলিপের বাগানের পেছনেই আইরিশ পাব। তবে সকালের দিক বিধায় পাবের দরজাটি বন্ধ। আর বাগানের শেষপ্রান্তে গোয়ালঘরের মতো দেখতে টিনের চালের লম্বা বারান্দা। বিশাল সেই চাতালে দুজন মাত্র মানুষ নানা আকারের পেইন্টিং এনে ঝুলিয়ে রাখছেন। বিক্রির উদ্দেশ্যে। অবাক হয়ে খেয়াল করি, সেসব পেইন্টিংয়ের মাঝে লেনিন যেমন আছেন, তেমনি বেঁচে আছেন স্তালিনও। কিরঘিজ রমণীদের বেশ কিছু চিত্রকর্ম আছে। তবে তাদের অনেকটিতে শিল্পী নেত্রদানপর্ব সমাপ্ত করেননি। সেটি কোনো ধর্মীয় কারণে কি? এর আগে তাসখন্দে পরিচয় হওয়া একজন চিত্রশিল্পী তেমন একটি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তবে এখানে সেসব আলোচনা সম্ভব নয়। কারণ, যে দু যুবক ছবিগুলো চটের ছালা থেকে বের করে ঝুলিয়ে রাখার কাজ করছে, তাদেরকে মূল চিত্রকর বলে মনে হয় না। আর তাছাড়া ওরা মহাব্যস্ত। এই যে আমি খুঁটিয়ে ছবিগুলো দেখছি, এর মাঝে কিন্তু একবারও তারা জিজ্ঞেস করেনি, আমি কোনো সম্ভাব্য ক্রেতা কিনা। অতঃপর তাদেরকে ছুটোছুটিতে ব্যস্ত রেখে আমি মূল স্কয়ারের দিকে এগিয়ে যাই।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/21/1563705573218.jpg

কংক্রিটে ঢাকা বিশাল উন্মুক্ত সেই স্কয়ারটিকে অভিভাবকের মতো আগলে রেখেছে উঁচু বেদিতে ঘোড়া ছুটিয়ে চলা এক বীর। এই বীর পৌরাণিক কাব্যগ্রন্থ ‘মানাস’-এ উল্লিখিত বীর। এই কিরঘিজ দেশটির নানা ক্ষেত্রে মানাস-এর উজ্জ্বল উপস্থিতি। এদের এয়ারপোর্ট, এমনকি জাতীয় পতাকাবাহী বিমান সংস্থার নামও মানাস। দূরদেশের রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করে কী করে বিজয়ীর বেশে ফিরেছিলেন সেই বীর, সেটি-ই কাব্যের ছন্দে শত শত বছর ধরে পঠিত হয়েছে ধূসর স্তেপের দেশ কিরঘিজস্তানে।

আজ উদ্দাম হাওয়াকে উপেক্ষা করে স্কয়ারের উন্মুক্ত স্থানটিতে বেশ কিছু লোকের সমাগম। তারা মুগ্ধ হয়ে দেখছে সামরিক বাহিনীর কসরত। তাদের দু দিকে ব্যান্ড দলের বাদ্যের তালে তালে নাচছে স্কুলের একদল কিশোর কিশোরী। কিশোরদের মাথায় ঐতিহ্যবাহী কিরঘিজ টুপি—কালপাক। তাদের কয়েক জনার হাতে স্থানীয় বাদ্যযন্ত্র কমুজ। ত্রি-তার বিশিষ্ট কমুজ দেখতে অনেকটা গিটারের মতোই, তবে আকারে অনেক ছোট আর শীর্ণ। সেনা আর সেই স্কুলের কিশোর কিশোরীদের সাজ সাজ রব দেখে বোঝা যাচ্ছে, সামনের কোনো এক দিনে হয়তো উৎসব পালনের ঘটা আছে। তাই প্রস্তুতি হিসেবেই এই মহড়া। আমি নিজেও হাওয়া উপেক্ষা করে কিছুক্ষণ শিশুদের মহড়া দেখি।

এই স্কয়ারটির পেছন দিকে একটি সবুজ উদ্যান। নাম—দুবভি পার্ক। সে উদ্যানের সমুখেই আকাশের দিকে উদ্বাহু হয়ে সপ্রতাপে দাঁড়িয়ে আছেন লেনিন। মধ্য এশিয়ায় টিকে থাকা একমাত্র লেনিন-ভাস্কর্য। বাকিগুলোকে অনেক আগেই ধনতন্ত্রের আগমনের মধুলগ্নে সমূলে উৎপাটন করা হয়েছে। কিন্তু এখানকার এরা সমাজতন্ত্র থেকে মুক্তি নিলেও বোধকরি অতীত স্মৃতিকে এক ঝটকায় ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি। এমনকি স্বাধীনতার বেশ কিছুকাল পর অবধি লেনিন ভাস্কর্যটি স্কয়ারের সম্মুখ চত্বরেই ছিল। এই কিছু বছর আগে ওটিকে সরিয়ে এনে স্থান দেওয়া হয় ভবনের পেছন দিকে। লেনিনের প্রতি মানুষের মায়ামোহ এখনো যে কিছুটা টিকে আছে, তার আরেক প্রমাণ হলো—ভাস্কর্যের বেদিতে পড়ে থাকা গোলাপ আর টিউলিপের ম্লান গুচ্ছ।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/21/1563705392582.jpg

লেনিন ভাস্কর্যের উল্টোদিকের সেই পার্কটির একটি বেঞ্চে গিয়ে বসি। বাঁ ধারে কিরঘিজ নারীর প্রমাণ সাইজের ভাস্কর্য। মধ্যবয়েসি এক নারী। মাথায় হেঁসেলের পাতিলের মতো দেখতে প্রথাগত মেয়েলি কিরঘিজ টুপি—এলিশেক। প্রায় দশ হাত দীর্ঘ সূতি কাপড় পাগড়ির মতো করে পেঁচিয়ে তৈরি করা হয় এ টুপি। তবে বিশাল সাইজের এই কেশাচ্ছাদনকারী পরে হাঁটতে এযাবত কোনো নারীকে এ শহরে দেখিনি। হয়তো গাঁ গ্রামে এখনো এর কিছু চল থাকতে পারে। তবে পাথরের বেদির উপর সেই স্মিতহাস্যময়ী নারীর ভাস্কর্যটি দেখে আমার হঠাৎ জমিলার কথা মনে হয়। প্রখ্যাত সাহিত্যিক চিঙ্গিস আইৎমাতভ সৃষ্ট অমর চরিত্র—জমিলা। বলা চলে, জমিলার গল্পের মাধ্যমেই এই কিরঘিজ দেশটির সাথে আমার পরিচয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জমিলার স্বামী মায়ের কাছে বৌকে রেখে ফ্রন্টে যায়। সদ্য কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে উপনীত জমিলার সঙ্গী হয়ে থাকে বালক বয়সের দেবর। এর মাঝেই গ্রামের সমবায় ফার্মে কাজের জন্যে ডাক পড়ে তার। গ্রামের পুরুষরা যেহেতু সবাই যুদ্ধে, তাই সমর্থ নারীরা শস্যভাণ্ডার না সামলালে ফ্রন্টের সৈনিকদের মুখে খাবার জুটবে কী করে? জমিলা কাজে যোগ দেয়, সাথে বন্ধুর মতো লেগে থাকে সেই দেবরটি। এর মাঝেই সেখানে উদয় হয় জমিলার সমবয়েসী আরেক যুবক। জমিলা আর সেই যুবক দুজনেই একে অপরের প্রতি নৈকট্য অনুভব করে। আর সেভাবেই কাহিনী গড়ায়। ছোট গল্প। কিন্তু কী গভীর তার আকুতি! কিরঘিজ গ্রামীণ সমাজের সেই সময়কার চিত্রকে যেন জমিলার জীবনের কাহিনীর মধ্যদিয়েই আইৎমাতভ উপস্থাপন করেছেন আমাদের সামনে। আমি সেই ভাস্কর্যটির দিকে তাকিয়ে ভাবি—তুমিই কি তবে গিরিপথ পেরিয়ে গ্রাম ছেড়ে প্রেমিকের হাত ধরে দূর দেশে পালিয়ে যাওয়া সেই জমিলা?

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/21/1563705311264.jpg

ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা অব্যাহত থাকায় চায়ের তেষ্টা জেগে ওঠে। আমি রাস্তা পেরিয়ে স্কয়ারের উল্টোদিকে যাই। ওদিকটাতে বেশ কিছু ক্যাফে-বেকারির দোকান আছে। বলা চলে, এ রাস্তাই শহরের সবচেয়ে বনেদি এলাকা। খুব বেশি দূর হাঁটতে হয় না। অল্প দূরেই লোহার দরজা ঘেরা মেট্রো পাব নজরে আসে। সেটির বাইরে চক বোর্ডে লেখা—‘তুমি+আমি+কফি= আনন্দ’। যদিও আমার ক্ষেত্রে সমস্যা হলো, আমি আছি, কফিও হয়তো থাকবে, কিন্তু কোনো ‘তুমি’ নেই। তাই আনন্দের সঙ্কুলান হবে কিনা, জানি না। তবুও অনন্যোপায় না থাকায় সেই দশাতেই ভেতরে ঢুকতে হয়। ভেতরটা গুমোট অন্ধকার। বাইরের দরজার সাথে মিল রেখেই চারধারে ছড়ানো লোহার টেবিল চেয়ার। সড়কের দিকে মুখ করা জানালাগুলো ঘোলাটে কাচে ঢাকা। দেয়ালে টানানো নোটিশ বোর্ডে লেখা—টেবিল ছেড়ে উঠে গেলে মালামাল নিজ দায়িত্বে রাখুন। কোণের দিকটিতে বার। তবে সেটি বোধ করি জমজমাট হয়ে ওঠে আঁধার নামার পর। এই ভর দুপুরবেলায় কেই-বা এখানে মদ গিলতে আসবে? ওয়াটার এগিয়ে এলে আমি চায়ের অর্ডার করে পাশের টেবিলের দিকে তাকাই। সেখানে মাঝবয়েসী দু মার্কিন ভদ্রলোক আলাপ করছেন। নিচুস্বরে কথা বলায় তাদের আলাপন আমি ডিকোড করতে পারি না। ভাবতে থাকি এরা কি কোনো কনট্রাক্টর? একথা ভাবছি, কারণ, ঠিক এই মুহূর্তে না হলেও কয়েক বছর আগ অবধি এই বিশকেক শহরটিতে আনগোনা ছিল বিপুল সংখ্যক মার্কিনীর। নাইন ইলেভেনের পর আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযান শুরু হলে তারা কিরঘিজস্তানের মানাস এয়ারপোর্টে বিমান বাহিনীর ঘাঁটি বানাবার জন্যে জায়গা চেয়ে বসে। চরম অর্থনৈতিক মন্দা চলতে থাকা কিরগিজস্তানের পক্ষে সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না। তারা রাজি হয়ে যায়। সেই থেকে বিমান বাহিনীর লোক, তাদেরকে কেন্দ্র করে সাপ্লায়ার কোম্পানি ইত্যাদি নানা সংস্থার কাজ করা বিপুলসংখ্যক লোকেদের মচমচে পয়সায় গড়ে ওঠে এ এলাকার হোটেল, ডিস্ক, পাব, আর ক্যাফেগুলো। তবে কয়েক বছর আগে ক্ষমতায় আসা নয়া কিরঘিজ সরকারের চাপে মার্কিন বিমান বাহিনী এখানকার ঘাঁটিটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে বিদেয় নিলে মাথায় হাত পড়ে এ এলাকার ব্যবসায়ীদের। তারা সরকারের কাছে আর্জি জানায়—ফিরিয়ে আনুন আবার সেই মার্কিনীদের। নয়তো আমরা চলব কী করে? তাদের এই উদ্বিগ্নতার হেতুটা আমি বুঝি। এ পর্যন্ত বিশকেক শহরের নানা পথে হেঁটে যতদূর বুঝেছি, সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরুবার পর এখানকার নতুন কোনো শ্রীবৃদ্ধি হয়নি। বিদ্যুৎচালিত যে সরকারি বাসগুলো রাস্তায় চলছে সেগুলো রঙচটা, লক্কড়-ঝক্কর মার্কা। রাস্তায় এখানে-ওখানে খানাখন্দ। রাজধানীর পাড়াগুলো শ্রীহীন। দেশটির বিস্তীর্ণ এলাকা উষর, চাষাবাদ-অনুপযোগী। খনিজ সম্পদের মধ্যে আছে একটি ছোট সোনার খনি। ভারি শিল্প নেই বললেই চলে। সে কারণেই দেশটির বিপুল জনগোষ্ঠী কাজের সন্ধানে ছুটে যায় রাশিয়ায়। অর্থনীতির এমন একটি ত্রিশঙ্কু অবস্থায় মার্কিন ঘাঁটির প্রস্থানে তাই স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বিচলিত না হয়ে পারেনি। তবে ঘাঁটিটি গুটিয়ে নিলেও সব কর্মকাণ্ড হয়তো পুরোপুরি বিদেয় নেয়নি। কিছু কনট্রাক্টর, কিছু ফড়ে দালাল হয়তো এখনো রয়ে গেছে। অদূরের টেবিলে ভুঁড়ি ঠেকিয়ে বসা সেই দুই মার্কিনী তেমন কেউ কিনা কে জানে!

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/21/1563704741206.jpg

ওয়েটার চা এনে রেখে যায়। চায়ের প্লেটে দুধবিহীন লিকার চায়ের পাশে রাখা থাকে মুসুম্বির কয়েকটি টুকরো। আমি সেই টুকরো দুটোকে চায়ে ভাসিয়ে দিই। সেই সাথে ভাবতে থাকি—দুপুরের খাবারটা সারা যায় কোথায়? খাবার নিয়ে এ অঞ্চলে বেশ হুজ্জতে পড়েছি। ইংরেজি জানা লোক এখানে নেই বললেই চলে। সবজি চাইলে এনে দেয় মাংস, আর মাংস চাইলে এনে দেয় সবজি। যেটা বুঝলাম, নিজের ইচ্ছেমতো খাবার চাইলে এ দেশে আসবার আগে টুকিটাকি রুশ শিখে আসাটা বাধ্যতামূলক। ও হ্যাঁ, এরা কিন্তু এখনো রুশ ভাষাকেই ধরে রেখেছে। আর এদের বর্ণমালাও সিরিলিক বর্ণমালা।

কফি পান শেষে আমি এগলি-ওগলি হেঁটে হায়াত রিজেন্সি হোটেলটা খুঁজতে থাকি। না, এ গরিব বান্দার সেখানে ওঠবার মতো সামর্থ্য নেই। আমি আসলে ওটি খুঁজছি, কারণ এর ঠিক পেছনেই নাকি কিরঘিজ জাতীয় নাট্যশালা। সেখানে যাবার কারণ আছে। সকালে হোটেলের খাবার ঘরে প্রাতরাশ সারার পর বেরিয়ে আসার সময়ে শুনছিলাম ম্যানেজার মেয়েটি কাকে যেন বলছে—আজ এখানে বিরাট অপেরা কনসার্ট হবার কথা। ভিয়েনা থেকে এদ্রিয়ান আর হাইদেমারিয়া নামক দুজন স্বনামধন্য শিল্পী আসবেন। সাথে থাকবে স্থানীয় বাদ্যযন্ত্রীদের একটি দল। তারা বাজাবেন—পিয়ানো, চেলো, ভায়োলিন আর বাস। অপেরা শিল্পীরা কিন্তু অনেক সময় গানের সুরের সাথে কোনো একটি অভিনয়ও মঞ্চস্থ করেন। অনেকটা আমাদের গীতিনাট্যের মতো। তবে ভিয়েনা থেকে আসা অপেরা শিল্পীরা কেবলই গাইবেন, অভিনয়ে অংশ নেবেন না। এর আগে ভিয়েনায় গিয়ে পথেঘাটে এই অপেরা কনসার্টের টিকিট বিক্রি হতে দেখেছি। সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে ব্ল্যাকে টিকেট বেচা দালালদের মতোই ওখানকার থিয়েটারগুলোর আশেপাশের রাস্তায় আছে বেশ কিছু টিকেটবিক্রেতা। ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণের নিমিত্তে তাদের অনেকের পরনে পুরনো আমলের ঝলমলে পোশাক। এমন কয়েকজনের কাছে টিকেটের মূল্য শুনে আমার একেবারে অক্কা পাবার দশা হয়েছিল। প্রায় দেড়শ ইউরোর নিচে ভালো কোনো টিকেটই নেই। তাই অপেরা কনসার্টের তীর্থস্থল ভিয়েনায় অবস্থানকালে সেটির সুধা আস্বাদন আর সম্ভব হয়নি। তবে সেখানকার শিল্পীরা এখানে এসে অনুষ্ঠান করায় আমি অনুমান করি—টিকেটের মূল্য হয়তো তেমন একটা আকাশচুম্বী হবে না। ম্যানেজার মেয়েটিকে কোথা থেকে টিকেট কাটা যায়, এ নিয়ে প্রশ্ন করলে সে কিছুটা তাগিদের কণ্ঠে জানায়, “আজ রাতের এই শো যদি ধরতে চাও, তাহলে তোমাকে দুপুরের মধ্যে গিয়ে টিকেট কেটে আসতেই হবে। শোয়ের ঠিক আগে ওখানে টিকেট পাবে না।” মেয়েটির সেই কথাকে আমলে নিয়েই আমার এই নাট্যশালা খুঁজতে পথে নামা।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/21/1563705117000.jpg

গথিক স্থাপত্যে নির্মিত বিশাল সেই নাট্যশালাটি দু গলি পরেই পেয়ে যাই। চূড়োতে এখনো নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে যাওয়া তারাটি দেখেই বোঝা যায়, দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যের এই ভবনটি সোভিয়েত সময়ের অবদান। সামনের বারান্দায় উঠে দেখি, সেখানে এসে প্রতিফলিত হচ্ছে ভেতরের প্যাসেজে জ্বলতে থাকা ঝাড়বাতির আলোকছটা। সেই আলোর রেখা অনুসরণ করে ভেতরে যাবার মুখে কাঠের ভারি দরজাটির হাতলে চাপ দিই। কিন্তু সেটি আমার প্রত্যাশাকে প্রত্যাখ্যান করে। আমি বুঝে যাই, সন্ধ্যের আগে এই দোর খুলবার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাহলে টিকেট পাব কোথায়? নাকি এতটা পথ এসে আশাহত হয়ে ফিরে যেতে হবে? সেই সময়ে খেয়াল করি, বারান্দার একেবারে শেষ প্রান্তে দু পাল্লার জানালা। একটি পাল্লা খোলা, অপরটি বন্ধ। মুখে হাসি ফুটে ওঠে আমার, টিকেটের একটা বন্দোবস্ত হয়তো হয়ে গেল।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;