বাবার বিয়ে |



মোজাফ্‌ফর হোসেন
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাবাকে কিছুই বলার ছিল না। বিয়ের খবরটা শুনে ছাদে গেলাম। আগামীকাল কিংবা পরশু বিয়ে করবেন বাবা। বাড়িতে চূড়ান্ত ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন। ছোটবোন ফোন করে রাতে জানাল। মায়ের মৃত্যুর ছ’মাসও হলো না। শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে মুখ দেখাব কেমন করে, বলে ছোটবোন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। আমি কিছু বলিনি। ওর কথা শেষ হলে মোবাইলের কলটা ও নিজেই কেটে দিল। মা জানতেন তার মৃত্যুর পর বাবা ফের বিয়ে করবেন। আমাকে বলেওছিলেন, ছোট সন্তান হিসেবে আমি যেন বাধা না দিই। মায়ের আদেশ ঠিকঠাক মেনে চলার মতো আদর্শ সন্তান আমি না। মৃত যে তার কাছে দায় তো আরো কম। তবু বাবার বিয়ে করার খবরটি আমার মধ্যে এতটুকু নাড়া দিল না। ছোটবোন তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন নিয়ে চিন্তিত। ওর সমস্যা আন্দাজ করতে পারি। আমার ওরকম কোনো সমস্যা নেই। শহর থেকে দূরে আরেকটি শহরে পড়াশোনা করছি। এখানে আমার মা জীবিত না মৃত, বাবা আবার বিয়ে করলেন কিনা, তাতে কার কী এসে যায়। কারো কিছু এসে গেলেই বা আমার কী করার আছে!

ছাদে আজ আলোটা বেশ। এত চড়া আলো রাতে বেমানান। কোনো এক রাতে এমন আলোয় বাবাকে দেখেছিলাম মাকে উঠোনে বেঁধে ঘরের হুড়কো দিয়ে পেটাচ্ছেন। সকালে উঠে মায়ের হাতে-পায়ে কোনো দাগ দেখিনি। বড় ভাইবোনদের বললে ওরা হাসতে হাসতে বলেছিল, বাবা কখনোই মায়ের গায়ে হাত ওঠান না। এরপর খেতে বসে আমার সামনেই বাবাকে যখন ওরা বলল, বাবা তুমি নাকি কাল রাতে মাকে উঠোনে মেরেছো! সঙ্গে সঙ্গে মা বাবাসহ ওদের হেসে ওঠা দেখে আমি তো লজ্জায় বাঁচি না। এরপর যতবার এ দৃশ্য দেখেছি আমি চুপ করে থেকেছি। আমার দেখার ভুল নিয়ে আরো অনেক সন্দেহ থেকে গেছে। সংসারে সব সন্দেহ দূর হয় না। এটা মায়ের কথা। কোন প্রসঙ্গে বলেছিলেন আজ আর মনে করতে পারি না। মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার অনেক কথা উড়োকথা মনে হয়। কোনো কোনো কথা ভেসে ওঠে বাতাসে। মানুষের মৃত্যুর পর যদি কিছু থেকে যায় পৃথিবীতে, সে হলো কথা। সেই কথা থেকে আবার নতুন কথা তৈরি হয়। যেমন, মাসখানেক আগে মা বললেন, ন্যায় অন্যায় সমাজের ব্যাপার। খুন করাও কখনো কখনো অন্যায় না, প্রকৃতির চেয়ে বড় খুনি তো আর কেউ হতে পারে না। তাই মনের ভেতর ন্যায় অন্যায় বলে কিছু পুষে রাখতে নেই। এই কথাগুলো মা যখন আমাকে বললেন তার কয়েকমাস আগেই তিনি মারা গেছেন। মায়ের ভাসতে থাকা কথা থেকে এমন আরো অনেক কথা তৈরি হয়, আমি কিছু শুনি, কিছু আমার অন্য ভাইবোনরা শুনতে পায়। কিছু হয়তো কেউ শোনে না। আমি কারো না শোনা কথাগুলো প্রায়ই ধরে ধরে মেলানোর চেষ্টা করি। সেদিন ভুল করে অন্য একজনের কথা ধরে ফেলেছিলাম, আমার মা নয়, অন্য মা, তার সন্তানকে বলছেন মরে উঠতে। সন্তানের কণ্ঠস্বর খুঁজে পাইনি। জীবিত মানুষের কণ্ঠস্বর শূন্যে ভাসে না। মা কেন তার সন্তানকে মরে উঠতে বলবে? কথাটি কি বেঁচে উঠতে হবে? মৃত মা কেন তার জীবিত সন্তানকে বেঁচে উঠতে বলবে? নাকি সন্তানও মৃত? সন্তান মৃত হলে মরে উঠতে বলবে কেন? অনেকদিন এই কথাগুলো নিয়ে ভেবেছি।

ছোটবোন ফের ফোন করে। ওর স্বামী বলেছে, তোর বাবা যদি সত্তরে বিয়ে করতে পারে, আমি করলে দোষ কোথায়? সম্ভবত মেরেছেও। ও না বললেও বুঝেছি। মার খাওয়াটা ওর জন্য ঘটনা না, আরেকটা বিয়ে করার হুমকি শুনে ভড়কে গেছে। একটা মেয়ে প্রাইমারি শেষ করবে, আরেকটা এখনো স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি। বিয়েটা যদি সত্যিই করে ফেলে তো ওর জন্য বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। কিন্তু ওর কষ্ট আমাকে এখন ছুঁতে পারে না। আমি যত চেষ্টা করি তত দুলাভাইয়ের কথা মনে হয়। এক মহিলার সঙ্গে প্রেম করেছে। শুয়েছেও। লোকজন সব এখন জানে। ও বিয়ে না করলে ওই নারী আত্মহত্যা করবে বলে আমাকে জানিয়েছে। আমি বোনের হয়ে ওকালতি করতে গিয়েছিলাম। সংসার টেকাতে ওকে হালকা করে হুমকিধামকিও দিতে হয়েছে। মহিলা রাজি হয়েছিল এক শক্ত শর্তে। আমি যদি বিয়ে করি তো ও আমার দুলাভাইকে ছেড়ে দেবে। মহিলার মায়ের মুখ থেকে কথাটা শুনেছি। এরপর আর ওর ব্যাপারে আমি কিছু বলিনি। তুই বিয়েটা করে ফেল। ছোটবোন আমাকে কাঁদতে কাঁদতে বলে। আমার দুধের শিশুদুটোর কথা ভেবে। আমি বললাম, ঠিক আছে করব। ও তখন নিজেই তেড়ে ওঠে, ও বেশ্যা মাগীকে বিয়ে করে তুই কেন জীবন নষ্ট করবি? ওই খানকি তো এটাই চায়, কারো গলায় ঝুলে যেতে পারলেই হয়। ও কাঁদতে কাঁদতে ফোনটা রেখে দেয়।

নীলার সঙ্গে ব্রেকআপ হয়েছে আমার। এটাকে ঠিক ব্রেকআপ বলা যায় কিনা জানি না। ও চেয়েছিল স্বামীটা যতদিন পিএইচডিটা শেষ করে দেশে ফিরছে ততদিন আমাকে দিয়ে বিছানার কাজটা মিটিয়ে নেবে। চারদিন ওর বাসাতে আর একদিন আমাদের মেসের রুমে চেষ্টাও করা হলো। কিন্তু আমার সাড়ে তিন ইঞ্চি দিয়ে ওর হলো না। বিবাহিত, এক সন্তানের মা। আমাকে দেখে নাকি ধারণাই করতে পারেনি এত ছোট হবে। ও খুব হতাশ হয়েছে। আমার কোনো অপরাধ নেই, ওকে বলেছি। এইটুকু নিয়ে কেউ প্রেম করে, তাও পরকীয়া—নীলা কাঁদতে কাঁদতে বলেছে। নীলার মনটা খুব নরম। হাসনা চাচির মতো হিজড়া গালি দিয়ে লাথি মেরে বিছানা থেকে উঠে পড়েনি। আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থেকেছে। কেঁদেছে, একটু আমার জন্য একটু নিজের জন্য। আমার চেহারা ও শরীরটা দেখে আরো অনেক নারী ধোঁকা খেয়েছে। অধিকাংশ মেয়েদের সমস্যা ওরা মোড়ক দেখে কোয়ালিটি বিচার করতে চায়। আমার রুমমেট শফিকের সাইজটা ঠিক আছে, কিন্তু চেহারা খারাপ, ছোটখাটো মানুষ বলে কোনো মেয়েকে বিছানা পর্যন্ত আনতে পারেনি। শফিকের জন্য আমার খারাপ লাগে। ভেবেছিলাম নীলাকে বলব শফিকের কথা। তার আগেই নীলা একজনকে পেয়ে গেল। ওর মেয়েকে পড়াতে আসে ছেলেটা। আমাকে ফেসবুকে ছবি দেখিয়েছে। অল্পবয়সী ছেলে। শুকনো শরীর। কিন্তু যেটা দরকার সেটা ঠিক আছে। নীলাকে খুশি দেখে আর কিছু বলিনি।

বড়ভাইয়ের ফোন এলো। বুঝেছি বাবার বিয়ে নিয়ে বলবে। ভেবেছিলাম আপত্তি করবেন। কিন্তু আমাকে বলবেন আপত্তি না করতে। বড়ভাবী বাবাকে রান্না করে খাওয়াতেন। কিছুদিন থেকেই বলছেন বাপের বাড়ি চলে যাবেন। বাবা বললেন, বাবাকে রান্না করে খাওয়ানোর জন্যও তো একজন দরকার। বুড়ো হয়েছে, বিছানায় পড়ে গেছে কে দেখবে? আমি কোনো কথা বলিনি। মায়ের মৃত্যুর পর ঠিক হয়েছিল বাবাকে বড়ভাবী আর মেজভাবী পালা করে খাওয়াবেন। গতমাসেই মেজভাই শহরে বাড়ি ভাড়া উঠেছেন। গ্রাম থেকে নাকি ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ভালো হচ্ছে না। বাবার বিয়ের বিষয়ে তার অমত থাকার কথা না। মেজভাই ফোন করে বাবার বিয়ে নিয়ে কিছু বললেন না। বললেন, বিয়ের আগে সম্ভব হলে বাবার কাছ থেকে বাড়িটা লিখে নিতে হবে। না হলে শেষ বয়সে নতুন কেউ সংসারে এসে বাড়িটা তার নামে লিখে নিতে পারে। মাঠের জমির বণ্টননামা ঠিক করে নিতে হবে। বিয়েতে আমরা মত দিলে বাবা সহযোগিতা করবেন বলে জানিয়েছেন। মেজভাবীর হাত থেকে মোবাইলটা বড়ভাবী নিলেন। বললেন, নতুন বউকে লিখে দেয়াটা বড় কথা না। যদি তার ঘরে সন্তান হয়, তাহলে সে বাড়ি-জমিজমার অংশীদার হয়ে যাবে। বাবার বয়স সত্তর পার। এ বয়সে সন্তান হয় নাকি? ভাবীকে বললাম আমি। ভাবী বললেন, সন্তান হতে বাবাকে লাগবে কেন? আশেপাশের পুরুষ মানুষের অভাব নাকি? অল্পবয়সী মেয়েকে বিয়ে করলে দু বছরের মধ্যেই পেট হবে, আমি বলে দিলাম, তুই লিখে রাখ। ভাবী আমাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বললেন। সন্তান হলে সম্পত্তির ভাগ পাবে। বড়ভাই আর মেজভাই কি আমাদের ভাগ দিচ্ছে না? আমরা আলাদা মায়ের সন্তান হলেও তো কেউ বঞ্চিত হচ্ছি না? আমি প্রশ্ন করি ভাবীকে। কিন্তু এখন যে সন্তান হবে সে তো বাবার সন্তান না, আমরা তাকে ভাগ দেব কেন? ভাবীর উত্তর। এতটা নিশ্চিত হয়ে ভাবী যখন বলেন আমার আর কিছু বলার থাকে না। শুধু আস্তে করে বলি, আমরা কে বাবার সন্তান আর কে বাবার সন্তান না, সেটা আর এখন শতভাগ নিশ্চিত হই কেমন করে যখন আমাদের মায়েরা মৃত। ভাবী আমার কথা শুনে রাগ করে ফোনটা রেখে দেন। ভাবীর পুরানো ইতিহাস আমি জানি, ইঙ্গিতটা কোন দিকে যাচ্ছে দেখে কথা বাড়াননি।

ব্যক্তির ইতিহাস সমষ্টির ইতিহাস না। এটা সবসময় লিপিবদ্ধ থাকে না। জাতির ইতিহাস ব্যক্তি ধারণ করে সেখানে তার নিজের ইতিহাস নেই দেখেও। আমার মুক্তিযুদ্ধ-পলাতক বাবা জাতীয় ইতিহাসে নিজের ভুল ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন আঞ্চলিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থে গবেষক শান্তিবাহিনীর তালিকাতে বাবার নামটি ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় বাবা তার দ্বিতীয় স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ভারতে প্রথম স্ত্রীর বড়বোনের বাড়িতে আশ্রিত ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকমাস পর গ্রামে ফেরেন। ওখানে কিছু ঋণ করে আর একটা দোকানে বিক্রয়কর্মীর কাজ করে শরণার্থী ক্যাম্পের জন্য ছোটভাইয়ের হাতে নিয়মিত টাকা দিতেন। দেশে ফিরে জানতে পারলেন তার ছোটভাই, মানে আমার আপন ছোটচাচা, কলকাতায় হোটেলে আরামে থেকেছেন সেই টাকায়। ওই গ্রন্থে মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকায় ছোটচাচার নামটা সংক্ষিপ্ত পরিচিতিসহ আছে। বাবাকে বলেছিলাম গবেষক ও প্রকাশকের নামে একটা মানহানির মামলা করতে। বাবা করেননি। বলেছেন, টাকা যখন শরণার্থী ক্যাম্পে পৌঁছায়নি তখন আর পলাতক ও শান্তি কমিটির মধ্যে পার্থক্য করে কী লাভ! বাবা লাভ লোকসান না দেখলেও ক্ষতি একটা হয়েছে আমাদের। সেজবোনের বেসরকারি স্কুলের হওয়া চাকরিটা হতে দিল না প্রতিপক্ষ ক্যান্ডিডেটের বাবা, আমার বোনকে রাজাকারের মেয়ে অভিযোগ তুলে। সেই ছোটচাচার মেয়ে মুক্তিযোদ্ধার কন্যা হিসেবে সগৌরবে চাকরিটা পেল। বাবা কোনো প্রতিবাদ করলেন না। সেজবোনটা আত্মহত্যা করলেন তার এক বছর পরে। চাকরি না হওয়ার জন্য নয়, স্বামী অন্য একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছিল, বিয়েও করেছিল। বোনটাকে মেরে ঘরের আড়ার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখল। আত্মহত্যা বলে সেজবোনের ব্যক্তিগত ইতিহাসে লেখা রইল।

সেজবোনের কোনো কোনো কথাও শূন্যে ভেসে ওঠে। আমাকে একদিন বলেছিল মেয়েটা খুব সুন্দর হয়েছে দেখতে। মরার সময় ওর পেটে ছিল। সাত মাসের। আর একদিন বলেছিল, ওর খুব আনন্দ হয় বেঁচে থাকতে। ও তো মৃত, বেঁচে থাকতে আনন্দ হয় কিভাবে আমি বুঝিনি। মৃতদের যে কথাগুলো শূন্যে তৈরি হয় তাদের আগের কথাগুলো থেকে তাতে অনেক সময় কোনো অর্থ থাকে না। থাকলেও আমরা জীবিত মানুষেরা বুদ্ধি খাটিয়ে বের করতে পারি না। কখনো কখনো সক্ষমতার প্রশ্নে কে বেশি এগিয়ে— জীবিত না মৃত আমি বুঝতে পারি না। যেমন আমার নিজের সক্ষমতা কতটুকু? নীলা কিংবা হাসনা চাচীকে কেন খুশি করতে পারি না? বাবার বিয়ে থামাতে বলে ছোটবোন, বড়ভাই-মেজভাই বলে বিয়েতে আপত্তি না তুলতে। কিন্তু আমি কি চাই সেটা নিজেও ঠিক করতে পারি না।

মাঝে মাঝে মনের এমন নিষ্ক্রিয়তা থেকে কোনো কোনো কাজ করে বসি। ছোটবোন সেদিন রাতে বলল দুলাভাইয়ের প্রেমিকার বাসায় ফের যেতে। গেলাম আমি। মহিলার বয়স আমার চেয়ে কিছুটা বেশি হবে। ঘরের ভেতরে গিয়ে বসলাম। মহিলার মা বাইরে থেকে দরজাটা আটকে দিল। আমি কিছু বলি না। জানি না কী বলতে এসেছি। ছোটবোন কিছু কথা শিখিয়ে দিয়েছিল, মনে করতে পারি না। মহিলা শাড়িটা খোলে। ব্লাউজ না খুলে পেটিকোটের ফিতা ধরে টান মারে। আর কিছু পরেনি ভেতরে। এরপর কী হবে আমার জানা। কিন্তু এই মহিলা অন্য নারীদের মতো আমার নগ্নতা দেখে হতাশ হয় না। হাঁটু গেড়ে আমার পায়ের কাছে বসে। আমি কী বলতে এসেছিলাম, কী করছি সেটা ভেবে লজ্জা হওয়া উচিত। কিন্তু আমার মহিলার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। কেউ একজন দরজাটা ফাঁক করে। ক্যাচ করে শব্দ হয়। মোবাইলে ছবি তোলার আওয়াজ আসে। ক্যামেরার সাউন্ড অফ করতে ভুলে গেছে কিংবা ইচ্ছা করেই অফ করেনি। ছবি তোলা শেষ। এখন মহিলার থেমে যাওয়া উচিত। তা না করে আমাকে বসিয়ে এক পা বিছানায় তুলে মুখটা চেপে ধরে। বের হ মাগি। ওর মা বাইরে থেকে বলে। থাম, বের করে নিই। মহিলা ভেতর থেকে ঘনস্বরে উত্তর দেয়। আমার নিস্ক্রিয়তা কখনো কখনো কারো জন্য সক্রিয়তার কারণ হয়ে ওঠে। আমি আর সে রাতে বোনের বাসায় ফিরে যাই না। বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায়। বাবা ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছেন। পেছনের মসজিদে কয়েল জ্বেলে ঘুমায় পাড়ার শফি হুজুর। মসজিদে গেল সপ্তায় দু রাতে দুটো ফ্যান চুরি হয়েছে। জুম্মার নামাজে টাকা তোলায় ব্যবহৃত টিনের বাক্সটাও কখন কে নিয়ে গেছে। এরপর থেকে শফি হুজুর পাহারায় থাকে। বউ ডাকলে উঠে যায়, কাজ সেরে আবার এসে মসজিদে ঘুমায়। মাঝরাতে মসজিদের টিউবওয়েলে ওর গোসল করার শব্দ শুনে বুঝি। আমার এখন গোসল করা উচিত কিনা জানি না। কোনো নারীর সামনে নগ্ন হলে কি গোসল করতে হয়? পাশে শুয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করি। কাজ না করলে গোসল করার দরকার নেই। শফি হুজুর আমাকে বলে। কাজ করা বলতে যা বোঝায় তা আামাদের হয়েছে কিনা বুঝে উঠতে পারি না। আমরা মসজিদের ভেতরে আর এসব নিয়ে কথা বলি না। কিছুক্ষণের মধ্যে শফি হুজুরের নাক ডাকার শব্দ আসে। একজন নারী আমাদের মাথার কাছ থেকে ছায়ার মতো ঘুরে যায়, আমি টের পাই। পেছন ফিরে তার চলে যাওয়া দেখি। শফি হুজুরের বউ সালোয়ার-কামিজ পরে না। শাড়ি পরে। সালোয়ার-কামিজ পরা মেয়েটি শফি হুজুরের বাড়ির উল্টো দিকে আমবাগানের ভেতর দিয়ে অন্ধকারে মিলে যায়। ওদিকে গোরস্থান। কোনো বাড়িঘর নেই। আমি উঠে বসি। স্বপ্ন দেখছেন, ঘুমিয়ে পড়েন। শফি হুজুর বলে। গোলস করে শুলে ভালো করতেন। ওর কথা শুনে আমার আর ঘুম আসে না।

বড়দুলাভাই ফোন করেন। উনার ধারণা বাবার বিয়েতে আমার জোর আপত্তি আছে। আমার শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর তোর মাকে যখন শ্বশুর বিয়ে করলেন তখন আমরা আপত্তি করিনি। শশুরের বয়স তখন কম ছিল, আপত্তি করলেও শুনতেন না। পুরুষ মানুষ ওই বয়সে একা থাকলে নানা বদনাম হতে পারে। তারচেয়ে বিয়ে ভালো। এখন শ্বশুরের বয়স হয়েছে। আমরা আপত্তি করলে জোর করতে পারবেন না। কিন্তু তার দেখাশোনার জন্য তোর বোনরা পড়ে থাকতে পারবে না। তোর দু ভাইয়ের বউ তো কোনো দায়িত্ব নিচ্ছে না। তুই বিয়ে করে বউকে রেখে যা। গরীবঘরের অল্প শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করলে থাকবে। দুলাভাইয়ের কথাগুলো আমি শুনলাম। বিয়ে আমি করতেই পারি। বউ আমার টিকবে না। বাবার তৃতীয় বিয়ের কেলেঙ্কারি থেকে বাঁচতে আরেকটা কেলেঙ্কারি তৈরি হবে। দুলাভাইকে সব বোঝাতে পারি না। বলি, বাবা বিয়ে করলে সমস্যা কোথায়? তাহলে তোর অমত নেই? দুলাভাই আমার মত পেয়ে খুশি হন। তখন বুঝতে পারি উনি আসলে কৌশলে আমার মত নিতে চেয়েছিলেন।

রাতটা ছাদে বেশ কাটে। শহরের সন্ধ্যারাতের প্রয়োজনীয় আলোগুলো নিভে গেলে কিছুটা অন্ধকার আসে এদিকে। কিংবা অন্ধকার আগে থেকেই ছিল, আলো সরে গেলে দৃশ্যত হয়। অন্ধকারটাই পৃথিবীর, আলোটা আসে বাইরে থেকে। গাছগুলো যে আছে এতক্ষণে টের পাওয়া যায়। প্রাণ আছে যতকিছুর তার মধ্যে গাছ এক যে নিজের ইচ্ছায় স্থান বদল করতে পারে না। শহরে এক একটা গাছ আমাদের পূর্বগাছদের বিস্মৃত স্মৃতি হয়ে অপেক্ষা করে। কোনো কোনো অপেক্ষা জড় বস্তুর মতো নিস্ফলা, বৃক্ষের মতো নিশ্চল।

রাত আরো গভীর হলে আমার স্মৃতিগুলো জেগে ওঠে। অতীতের সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতের দিনগুলোর কথা আগাম মনে পড়ে। মনে হয় মা বেঁচে আছেন। আমি গনগনে দুপুরে গোলাঘরের ছায়ায় বসে। বাবা বিয়ে করতে যাচ্ছেন, তখন আর মা বেঁচে নেই। উঠোনে দেখি রোদের ভেতর মা শুকোতে দেওয়া সিদ্ধ ধানগুলো নেড়ে দিচ্ছেন খালি পায়ে। সেই উঠোনেই আবার নতুন বউ নিয়ে বাবা বসে আছেন এক বিকালে। ঘোমটা সরিয়ে লোকজন দেখছে। আমি উঠে গিয়ে দেখি আমার মায়ের চেহারা। বাবার বয়স তখন অনেক কম। মাকে বিয়ে করে এনেছেন। আমার জন্মের আগের দৃশ্য কিন্তু আমার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। বাবার বয়স আরো কমে, ঘোমটার ভেতর চেহারাটা বদলে যায়। আমার বড় মা কিংবা মেজ মা হবে। আমি তাদের দেখিনি বলে নিশ্চিত হতে পারি না। মা যখন ধানগুলো নেড়ে দিয়ে রান্নাঘরে যান, তখনই অন্ধকার নামে। দুপুর থেকে সরাসরি রাত। বিকালটা গায়েব। রাতে আমি বারান্দায় বসে। সামনে অচেনা দৃশ্যপট। একজন নারী আমার সামনে চায়ের কাপ তুলে ধরে বলে, পেনশনের টাকাটা কাল তুলে আনো। আমার পায়ের শক্তি কমে আসে। বুঝতে পারি বয়স হয়েছে। চায়ের কাপ ধরে থাকা হাতটির মানুষকে বোঝার চেষ্টা করি। আমার স্ত্রী হতে পারে। কিন্তু আমি বিয়ে করলে আমার স্ত্রী টেকার কথা না। আমার বাকি জীবন একা থাকার কথা কিন্তু ঘরের ভেতর থেকে অনেক কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করি। একজন জোর গলায় বলছে, আমাকে কেউ মারেনি। আমি একা একা মরেছি। কিন্তু আত্মহত্যা করিনি। আমার মেজবোন কিংবা মায়ের কণ্ঠস্বর বলে মনে হয়। আরেকজন বলছে, চেষ্টা করলে হয় না, সব চেষ্টা হওয়ার জন্য না। কণ্ঠস্বরটা চিনতে পারি না। আমি ছাদে হাঁটতে হাঁটতে কার্ণিশের কাছে চলে যাই। এই আমি অতীত, বর্তমান নাকি ভবিষ্যতের কিছুক্ষণের জন্য বুঝে উঠতে পারি না।

ঘুমটা ভাঙে বড় দুলাভাইয়ের কলে। ভালো একটা পাত্রী পেয়েছি। বয়সটা কম, কিন্তু সন্তান হবে না। আগের স্বামী সেই কারণে তালাক দিয়েছে। কোনো বদনামের সুযোগ থাকল না। আমার আর বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছা করে না। আজ ভার্সিটি যাব না। দ্বিতীয়বার ঘুমটা ভাঙিয়ে দেয় ছোটবোন। বাবার বিয়ে হয়ে গেছে। ও বলে। ততটা অখুশি বলে মনে হয় না। ওই মহিলার সঙ্গে। বড় দুলাভাইয়ের প্ল্যান।
কোন মহিলা? আমি জানতে চাই।
মাগীটা। বলে আমাকে আবার প্রশ্ন করে—এখন কি গালি দেওয়া ঠিক হবে? বাপের বউ মানে তো আমাদের মা। মানি আর না-মানি।
রাখ তুই। আমি ঘুমাব। সারাদিন ঘুমিয়ে থাকব। যখন জেগে উঠব আমার কণ্ঠস্বর ভেসে উঠবে শূন্যে। তুই মোবাইল ছাড়াই শুনতে পাবি।
দিন কোথায় পেলি? এখন তো রাত। ছোটবোন বলে।
জানালা খুলে দেখি সকাল হয়েছে। মা বাসি উঠোন ঝাড়ু দিয়ে ময়লাগুলো টোকায় তুলছেন। একবার মনে হয়, মাকে ডেকে বলি বাবা আবার বিয়ে করবেন। তখন মনে পড়ে যায় মা আগে থেকেই জানেন, মৃত্যুর আগে আমাকে বলেছেন। আমি ভবিষ্যৎ দেখে এলাম নাকি অতীতে ফিরে গেছি বুঝে উঠতে পারি না। নিজের বর্তমান ছাড়া সময়ের আগপিছ নির্ণয় করা কঠিন। মৃতের কি কোনো বর্তমান থাকে?

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;