নগরে দেবদূত



রেহানা বীথি
প্রচ্ছেদ/তাসকিন আল আনাস

প্রচ্ছেদ/তাসকিন আল আনাস

  • Font increase
  • Font Decrease

নিস্তব্ধ নির্জন রাত। আমার পতনের শব্দটা প্রতিধ্বনি তুলে মিলিয়ে গেলো রাতের বুকে। বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে উঁচু বেদিতে চালকসহ একটা ঘোড়ার গাড়ি। নিশ্চল। বুঝলাম, ওটা আসল নয়, চালকসহ ঘোড়ার গাড়ির কাঠামো। পথবাতির আলো পড়ে চকচক করছে। কে বানিয়েছে এটা? একেবারে নিখুঁত তো! তিনদিক থেকে তিনটে প্রশস্ত পথ এসে মিলেছে এখানটায়। প্রতিটি পথের মাঝেই বিভাজন রেখায় হাঁটুসমান ঘন সবুজ গাছ। নিয়ন বাতির আলোয় যেগুলো কালচে দেখাচ্ছ। কালচে দেখাচ্ছে গাছের বিপুল কৃষ্ণচূড়াগুলোকেও। এখন কি কৃষ্ণচূড়া ফোটার সময়? বিশাল পৃথিবীর মাঝারি এই নগরে এখন কোন ঋতু? কিছু দূরে কাঠগোলাপও ফুটে আছে দেখছি! একটা মিষ্টি মৃদু ঘ্রাণ প্রবেশ করলো আমার নাকে। সেখান থেকে ছড়িয়ে গেলো মস্তিষ্কের কোষে কোষে। আমি আবেশিত হলাম। ইচ্ছে করছে গান গাইতে। না না, তারচাইতেও বেশি ইচ্ছে করছে ঘুমিয়ে যেতে। আমার বাঁ হাতের ওপর ময়ূরকণ্ঠী নীল প্রজাপতিটিও বোধহয় ঘুমিয়ে গেছে। ওটার উড়ু উড়ু করে বসে থাকার ভাবটি নেই এখন। আমিও ক্লান্ত ভীষণ। এই তো..... ঘুমে জড়িয়ে আসছে দু'চোখ।

ভোরের আলো আসি আসি করেও আসছে না। গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টি ঝরছে আকাশ থেকে। সেকারণেই যেন কুয়াশাময় চারপাশ।তবুও একটু একটু করে জেগে উঠতে চাইছে শহর। এই সামান্য বৃষ্টিতে থেমে যাবে না কিছুই। সবই চলবে আপন গতিতে। আব্দুল ওয়াহাব, একজন স্কুল শিক্ষক, সে-ও থেমে নেই। ফজরের আজানের আগেই বিছানা ছেড়েছে সে।ছোট্ট মুরগির পাতলা ঝোল আর একেবারে নরম করে একটু খিঁচুড়ি রান্না করেছে। আর করেছে পাঁচটা সেদ্ধ আটার রুটি, একটা ডিমও ভেজেছে। তারপর গোসল করে, পরিপাটি হয়ে বেরিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে ছাতা মাথায়। তিনরাস্তার মোড়ের ওই বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছটার কাছে যখন সে পৌঁছালো, তখনও হালকা অন্ধকার, কুয়াশার মতো বৃষ্টি তো আছেই। তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে তাকে, না জানি মা ছেলে কী করছে! হয়তো ছেলের খিদে পেয়েছে। বলছে, মা, জলদি আমাকে কিছু খেতে দাও, অনেকদিন পর আমার খুব খুব খিদে পেয়েছে! ছেলেকে একটু নরম খিঁচুড়ি আর মুরগির ঝোল খাইয়ে ওরা মিয়াবিবিতে রুটি আর ডিমভাজি খাবে খুশিমনে। যাই তাড়াতাড়ি, আর একটু পা চালাই। একথা ভেবেই তার চোখ গেলো ঘোড়ার গাড়ির ওই বেদিটার দিকে। দেখলো, গাড়োয়ানের ঠিক পেছনেই, গাড়ির মধ্যভাগে কে যেন একজন হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। আশ্চর্য হলো আব্দুল ওয়াহাব। ওখানে তো কাউকে কখনও ঘুমাতে দেখেনি সে! আর দেখবেই বা কেন, ওটা কি ঘুমানোর জায়গা? তারওপর আকাশ থেকে গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টি ঝরছে! যাক গে! ভেবেও আবার কি মনে করে এগিয়ে গেলো একটু। নজরে এলো, একটি লোক, গায়ে পাতলা ফিনফিনে নীল রঙের একটা জামা আর নিম্নাংশ আবৃত একখণ্ড সাদা কাপড়ে। লুঙির মতো। তার দু'পা ঝুলে আছে গাড়ির বাইরে। ডানহাতটাও। বাঁহাত বুকের ওপর ভাঁজ করা। এবং......এবং সেই হাতে ওপর অদ্ভুত সুন্দর একটা প্রজাপতি। ময়ূরকণ্ঠী নীল তার রঙ। সেটিকে ঘিরে রেখেছে এক আশ্চর্য নীলাভ আলো। আব্দুল ওয়াহাব নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না। সে একেবারে হতবাক হয়ে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো লোকটির দিকে। কে সে? নাকি স্বপ্ন দেখছে আব্দুল ওয়াহাব? স্বপ্নই হবে.... স্বপ্নই হবে! হাতের টিফিনবাটিটা নামিয়ে রেখে দু'হাতে রগড়ে নিলো চোখ। নাহ্, একই অবস্থা। সেই একইভাবে ঘুমিয়ে আছে ঘোড়ার গাড়ির ওপর লোকটা। ডাকবে নাকি? কিন্তু.......! নড়ে উঠলো যেন একটু! মনে হচ্ছে জেগে উঠছে সে। হ্যাঁ, আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলতে যাচ্ছে বটে!

এহ্ হে, বেশ ভিজে গেছি দেখছি! ওহ্, বৃষ্টি? আর আমি কি না টেরই পাইনি! বেশ ঘুমিয়ে নিলাম একচোট! কিন্তু আমার পায়ের কাছে ওটা কে দাঁড়িয়ে ছাতা মাথায়? এই কুয়াশাময় হালকা অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে তার চোখে এক অদ্ভুত বিস্ময়। সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত বছর চল্লিশ- এর এক লোক, কেমন যেন জুবুথুবু। একটু যেন ভয়ে ভয়েও আছে সে। সে থাক, চারপাশের প্রকৃতিকে একটু দেখি তো আগে দু'চোখ ভরে। তারপর না হয় তার সাথে কথা বলা যাবে। বাহ্, ঝকঝকে শহর তো! রাতে বোঝা যায়নি ঠিকমতো। উঁচু উঁচু ভবন, গাছপালাও আছে কিছু। গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টি যেন কেমন রহস্যময় করে তুলেছে সবকিছু। এই যাহ্, লোকটা দেখছি চলে যেতে উদ্যত!

-- এই যে শুনছেন? চললেন কোথায়? একটু দাঁড়ান, কথা বলি আপনার সাথে!

-- আমার সাথে? কেন?

-- ইচ্ছে করছে যে! বলবেন না কথা আমার সাথে?

-- আমার একটা জরুরি কাজ আছে, দেরি হয়ে যাবে। পরে বলবো কোনো এক সময়।

আব্দুল ওয়াহাব হাঁটা দিলো জোরে জোরে। অন্যকিছুর ভয় নেই তার তেমন, কিন্তু পাগলকে তার খুব ভয়। এ লোকটা যে পাগল নয়, তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? 

-- কিন্তু আর যদি আপনার সাথে দেখা না হয়? কী এমন জরুরি কাজ আপনার?

গলা উঁচিয়ে বললো লোকটা।

-- হাসপাতালে যেতে হবে।

কী ভেবে জবাব দিয়েই ফেললো আব্দুল ওয়াহাব।

-- হাসপাতালে, কেন? কেউ অসুস্থ বুঝি?

-- হ্যাঁ, আমার ছেলে।

-- আপনার ছেলে! কী হয়েছে তার? আহা রে!

-- কঠিন অসুখ। একদম শুকিয়ে গেছে। খেতে চায় না কিছুই।

-- বয়স কত তার?

-- দশ বছর।

-- ইশ্, এ বয়সী একটা ছেলে হাসপাতালে? কতদিন ধরে আছে?

-- একমাস।

-- একমাস? বলেন কী! কিছু যদি মনে না করেন, আমি কি যেতে পারি আপনার সাথে?

আচ্ছা মুশকিল তো! মনে মনে ভেবেও রাজি হয়ে গেলো আব্দুল ওয়াহাব।

বৃষ্টি ঝরছে এখনো। আব্দুল ওয়াহাব হাঁটছে, তার পাশে পাশে চলেছে অদ্ভুত লোকটা। ওর হাতের প্রজাপতিটি চঞ্চল। ভেজা ভেজা পথঘাট জেগে উঠছে একটু একটু করে। পথের ধারের দোকানপাট খুলে যাচ্ছে একে একে। ফাঁকা রিক্সাগুলো হুড তুলে চলেছে টুংটাং। হাসপাতালে পৌঁছে গেলো ওরা। এ জায়গা কখনোই পুরোপুরি ঘুমিয়ে যায় না। নিশুতি রাতেও এখানে ব্যস্ততা দিনের মতো। নতুন রোগী আসে, পুরোনোদের হতাশ চলাফেরা, হঠাৎ হৃদয়বিদারক কান্নায় ভাবি হয় বাতাস, কারও মুখ আবার নতুন প্রাণের আগমনে উদ্ভাসিত, সবমিলে কর্মচঞ্চল সবসময়।

আব্দুল ওয়াহাব লোকটাকে নিয়ে প্রবেশ করলো সেই কর্মচঞ্চলতায়। লোকটা কেমন যেন অবাক হয়ে দেখছে সব। লম্বা করিডোরের শেষ মাথায় উপরে ওঠার সিঁড়ি। পাশে কিছু ফুল গাছে নানা রঙের ফুল। ওরা সিঁড়িভেঙে চলে গেলো সোজা তিনতলায়, ছেলের ওয়ার্ডে। ছেলেকে বিছানায় হাসিমুখে বসে থাকতে দেখে মনটা ভরে গেলো আব্দুল ওয়াহাবের। সাথের লোকটিও মিটি মিটি হাসছে দেখছি! ছেলে বউও তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে লোকটার দিকে। লোকটির বাঁহাতের ওপর খেলতে থাকা প্রজাপতিটি অবাক হয়ে দেখছে ওরা।

-- তোমার পছন্দ এটা?

-- খুউব! কিন্তু ওটা তোমার হাতের ওপর কেন?

-- হা হা... কারণ ওটা যে আমার প্রজাপতি! সবসময় ওটা আমার সাথে থাকে।

-- সত্যি? কিন্তু তা কী করে হয়? প্রজাপতি আবার কখনও কারও নিজের হয় নাকি? আমার তো নিজের কোনো প্রজাপতি নেই! আমাদের কারোরই নেই, আমার বন্ধুদেরও না।

-- এটা তুমি ঠিক বললে না। তুমি হয়তো জানো না, তোমারও একটা প্রজাপতি আছে। তোমারা যারা ছোট, তাদের সবারই একটা করে প্রজাপতি থাকে।

-- তাহলে দেখতে পাই না কেন? ওগুলোর রঙও কি এটার মতোই? এত সুন্দর!

-- ঠিক এটার মতো নয়, তবে ওগুলোও খুব সুন্দর।

-- তাই! আমি দেখবো!

-- অবশ্যই দেখবে। তার আগে লক্ষী ছেলের মতো খেয়ে নাও তো! তোমার বাবা কত কষ্ট করে তোমার জন্য খিঁচুড়ি আর মুরগির ঝোল রান্না করে এনেছে, দেখো!

-- হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি খাবো! মা, তাড়াতাড়ি আমাকে খেতে দাও, খুব খিদে পেয়েছে.... খুব!

খুশিতে ঝলমল করে উঠলো আব্দুল ওয়াহাব আর তার বউয়ের মুখ। কতদিন পর নিজে থেকে খেতে চাইছে ছেলে! টিফিন বাটি খুলে ছেলেকে খাবার দিচ্ছে বউ। কিন্তু আব্দুল ওয়াহাবের মনটা হঠাৎ খচ খচ করে উঠলো, সে কি কি রান্না করে এনেছে, লোকটা জানলো কেমন করে? কে লোকটা? অন্তর্যামী! বউটাও জানি কেমন, অচেনা এক লোককে সাথে করে এনেছে সে, একবারও কোনো প্রশ্ন করলো না? মা ছেলের ভাব দেখে তো মনে হচ্ছে, কতকালের চেনা! লোকটাও এমন ভাব জমিয়ে ফেলেছে এই অল্প সময়ের মধ্যে! তবুও লোকটার কারণেই এতদিন পর খেতে চেয়েছে ছেলে, সেটা তো অস্বীকার করা যায় না!

একমাত্র সেজন্যেই লোকটার ওপর পুরোপুরি রেগে যেতে পারছে না সে। কেমন যেন খুব সূক্ষ্ম একটা প্রশ্রয়বোধ কাজ করছে। কিন্তু তা বোধহয় আর বেশিক্ষণ থাকবে না। এবার বোধহয় রেগেই যাবে আব্দুল ওয়াহাব। লোকটা তার ছেলেকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যেতে চাইছে, কী আশ্চর্য! ছেলে তো হাসপাতাল থেকে ছাড়াই পায়নি! যত্তসব পাগল ছাগল!

পৃথিবীতে পতনের পর পরই এমন একটা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবো ভাবিনি আমি। একটা এত ছোট্ট, এত মিষ্টি ছেলে এতদিন ধরে হাসপাতালে! অথচ মনে হচ্ছে, ছেলেটির কোনো অসুখই নেই। যেটা আছে সেটা হলো অসুবিধা। কিন্তু কি সেই অসুবিধা? জানতে হবে......গভীরভাবে জানতে হবে! যে করেই হোক আজই হাসপাতাল থেকে ছুটি পেতে হবে ছেলেটিকে। তারপর ওকে নিয়ে নগরীর কোনো সুন্দর জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে জেনে নিতে হবে ওর সমস্যা। এত সুন্দর একটা ছেলের জীবনে কোনো আনন্দ থাকবে না, তা কী করে হয়? আমার হাতের প্রজাপতিটি দেখে ওর চোখে যে খুশির ঝিলিক ফুটে উঠেছে, তা হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না কোনোমতেই। ওর মনের মধ্যে যে একটা অপূর্ব রঙের প্রজাপতি আছে সেটার সন্ধান ওকে জানাতেই হবে।

-- আজ কেমন আছো বাবু? দেখি জিভটা। হুমম....!

-- জানো ডাক্তার, আমি না ভালো হয়ে গেছি! আমাকে ছেড়ে দাও, বাড়ি যাবো। আর এই যে লোকটাকে দেখছো, যার কাছে একটা প্রজাপতি আছে, ও আমার বন্ধু। ও বলেছে, আমারও একটা প্রজাপতি আছে। ওকে সাথে নিয়ে খুঁজে বের করবো সেটাকে। দেবে না ছুটি আজ?

ডাক্তার বেচারা আশেপাশে তাকিয়ে কোনো প্রজাপতিওয়ালাকে দেখতে পেলো না। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আব্দুল ওয়াহাব আর তার বউয়ের দিকে তাকাতেই ওরা বললো, সত্যিই ও ভালো হয়ে গেছে ডাক্তার সাহেব! অ-নে-ক দিন পর ও আজ নিজে থেকে খাবার খেয়েছে। ভালোমতোই খেয়েছে। ছুটি দিয়ে দিন, বাড়ি যেতে চাইছে, হয়তো বাড়ি গেলে আরও তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে।

চিন্তার রেখা ডাক্তারের কপালে। হাসপাতালে থেকেও তো বিশেষ লাভ নেই, ভাবলো ডাক্তার। কিন্তু প্রজাপতিওয়ালার কথাটা তো ঠিক বোধগম্য হলো না! ছেলেটির বাবা মা-ও তো কোনো দ্বিমত করছে না ছেলের কথায়! হয়তো ছেলের হঠাৎ কিছুটা সুস্থতায় তাদের এই প্রশ্রয়। যাইহোক, ছুটি দিলে মন্দ হয় না। দেখা যাক! আগামী সপ্তাহে একবার দেখা করে যেতে বললেই হলো।

ঘাসে ছাওয়া নদীর ধার। একটা ছোট্ট ডিঙি বাঁধা আছে ঘাটে। অব্যবহৃত বোধহয় বহুদিন। আব্দুল ওয়াহাব তার বউকে নিয়ে বসে আছে ঘাসের ওপর। ওদের চোখেমুখে উপচে পড়ছে খুশি। ছেলে তাদের ছাড়া পেয়েছে হাসপাতাল থেকে। আমার বাঁহাতের প্রজাপতিটিও অকারণে ফুরফুর করছে। ছেলেটি ছুঁয়ে দেখছে সেটিকে একটু পর পর। বলছে, এত সুন্দর..... এত সুন্দর! আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে বার বার। আশ্চর্য, আমার চোখে জল!

-- তোমার স্কুলটা কোথায়? নিয়ে যাবে আমাকে?

-- তুমি যাবে ওখানে? কিন্তু আমার স্কুল তোমার ভালো লাগবে না যে!

-- কেন?

-- ভীষণ উঁচু একটা ভবন। লিফ্ট এ ওঠানামা, আমার ভালো লাগে না।

-- কেন? স্কুলের মাঠে খেলো না বন্ধুদের সাথে? 

-- নাহ্, মাঠই তো নেই! আর যা লেখাপড়ার চাপ! খেলার সময় কোথায়? খেললে পিছিয়ে যাবো না? যে খেলবে সেই পিছিয়ে যাবে। আমরা তো খালি পড়ি। জানো, আমার কয়টা বই?

-- কয়টা?

-- অ-নে-ক! আর প্রতিটা বইয়ের জন্য আলাদা আলাদা খাতা। প্রাইভেট, স্কুল, কোচিং সবকিছুর জন্য আলাদা আলাদা খাতা। সেসবে ব্যাগ এত ভারি হয়, কী বলবো তোমায়! আমার সব বন্ধুদের পিঠে ব্যথা, চোখেও চশমা অনেকের। লেখাপড়া এমন কেন? এত পড়তে হয় কেন? আচ্ছা, তুমিও কি এমন করেই লেখাপড়া করেছো? আমার বাবা করেনি জানো? বাবা যখন ছোট ছিলো, তখন নাকি তাদের স্কুলে বিশাল একটা মাঠ ছিলো। ক্লাসের ফাঁকে তারা বন্ধুরা ওই মাঠে খেলা করতো। গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা আরও কত কী! আমরাও তো ছোট, আমাদের মাঠ নেই কেন? দেখো, পুরো শহরজুড়ে শুধু উঁচু বিল্ডিং। আমার ভালো লাগে না একদম। আমার বন্ধুরা মোবাইলে, কম্পিউটারে গেম খেলে। আমার ভালো লাগে না ওসব।

-- তোমার কী ভালো লাগে বলো?

-- বললে তুমি দিতে পারবে তা?

-- হ্যাঁ পারবো।

-- সত্যিই?

-- একদম সত্যি। বলেই দেখো না!

-- আমি চাই খোলা মাঠ। অনেক গাছ, অনেক প্রজাপতি উড়ে বেড়াবে ফুলে ফুলে। আমি বন্ধুদের সাথে ঘুরবো, খেলবো, মাঝে মাঝে লেখাপড়াও করবো। স্কুলের ব্যাগটা হবে অনেক বেশি হালকা। পারবে করতে এসব? আর আমার প্রজাপতি? ওটা কোথায়? তুমি যে দেবে বলেছিলে আমাকে!

-- দেবো দেবো। সব দেবো তোমাকে। এখন বাড়ি চলো, সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে। ওই দেখো, তোমার বাবা মা ডাকছেন আমাদের।

-- কিন্তু কখন দেবে? আমার যে আর দেরি সহ্য হচ্ছে না! ওগুলো পেলেই আমি একদম সুস্থ হয়ে যাবো। আর কোনোদিনও হাসপাতালে যেতে হবে না আমাকে।

-- দেবো, অতি শীঘ্রই! চলো, এবার বাড়ি যাই, অন্ধকার হয়ে গেলো।

-- চলো।

-- ও হ্যাঁ, তোমার নামটাই তো বলোনি আমাকে!

-- উচ্ছাস।

-- বাহ্, উচ্ছাস!

-- আর তোমার নাম?

-- পরে বলবো।

একটা ঝাঁ চকচকে সুন্দর শহরের আড়ালে অসুস্থ শিশু? অসুস্থ ভবিষ্যত! হাজার হাজার শিশুর মনে হাজার হাজার প্রজাপতি বন্দী হয়ে আছে এভাবে? ওরা ওড়ার জায়গা পাচ্ছে না। এই সুন্দর শহর এই অসুস্থ সন্তানদের দিয়ে কী ভবিষ্যত গড়বে? ভেবেই পাচ্ছি না আমি। সুন্দর পৃথিবীটা দু'চোখ ভরে দেখবো বলে এসেছিলাম। কিন্তু কোথায় সৌন্দর্য? শুধু প্রশস্ত পথঘাট আর ঝকঝকে উঁচু বিল্ডিংই কী সৌন্দর্য? ছোট, নিষ্পাপ বাচ্চাদের শৈশব হরণ করে এ কেমন সৌন্দর্য? বেদনার পাহাড় যেন বুকে চেপে বসেছে আমার। আমি যেখান থেকে নেমে এসেছি, সেখানে বসে এসব বাচ্চাদের কষ্ট অনুভব করা সম্ভবই নয়। ওদের কষ্ট অনুভব করতে হবে ওদের পাশে থেকে। হঠাৎ পৃথিবীতে আসার সিদ্ধান্তটা ভুল নয় তাহলে! আর এসেই যখন পড়েছি, এইসব কচিমুখগুলোর কষ্ট কিছুটা লাঘব করি। আমার অনন্ত জীবন, আমার অপার্থিব ক্ষমতা যদি কিছুটা কাজে লাগে ওদের, ধন্য হবো আমি।

ওরা ঘুমিয়ে পড়েছে। মাঝখানে ছেলে, দু'পাশে বাবা-মা । ছেলের বুকের ওপর দু'জনের হাত রাখা। আহা, কী নিশ্চিন্তি! কী পরম নির্ভরতা! ওই যে স্বর্গ, যেখানে আমার বাস, আব্দুল ওয়াহাবের ঘরটায় আজ রাতে সেই স্বর্গই নেমে এসেছে যেন। ভোর হওয়ার আগেই সেরে ফেলতে হবে আমার কাজ। মাঝারি এই নগরে প্রতিটা বাড়ির সামনে এক চিলতে উঠোন, উঠোনে ফুল গাছ, ফুলগাছে হাজার হাজার প্রজাপতি ওড়াতে হবে রাতের মধ্যেই! স্কুলের সামনে থাকবে বিশাল খোলা মাঠ। ভোরে সব শিশু কলকল করে উঠবে। অসংখ্য প্রজাপতির ভিড়ে খুঁজে নেবে নিজের প্রজাপতি। ওরা বেড়ে উঠবে সুস্থ সুন্দর মন নিয়ে। গড়ে তুলবে এক স্বপ্নের আগামী। আমি চলে যাবো নিঃশব্দে।

আচ্ছা, উচ্ছাস কে কি বলে যাবো, আমার পরিচয়? 

না থাক, ওরা তো ভুলে যাবে বেদনাময় অতীত। শুধু থাকবে বর্তমান, আর সুন্দর ভবিষ্যত!

সুখে থাকুক ওরা। উচ্ছাস থাকুক আমার মনে, আর আমি নাহয় থাকি উচ্ছাসের মায়াবী ঘোর হয়ে।

   

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;