আলো আসে ওখানেও



রেহানা বীথি
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

আতরের কড়া গন্ধটা ঘরময় ছড়ানো। কেমন যেন গা গুলিয়ে উঠছে ববিতার। মোচড় দিচ্ছে নাভির কাছাকাছি। চোকির ওপর টানটান হয়ে শুয়েছিলো ও। নাভির কাছে মোচড় দিতেই ডানহাতে তলপেটটা চেপে ধরে কুঁকড়ে ফেললো শরীরটা। মাথার কাছের ছোট্ট জানালাটা খোলাই তো আছে, তবু একটুও বাতাস আসছে না কেন? ঘাম চুঁয়ে পড়ছে কানের পাশ দিয়ে বালিশে। উঠে গিয়ে পানি খাবে, না হয় ফ্যানটা চালাবে একটু তার শক্তিও যেন নেই শরীরে।

খুটখুট করে হাসছে বুড়োটা। হামানদিস্তায় পান ছেঁচার মতো একটা শব্দ সেই হাসির। অসহ্য লাগে ববিতার। তাকে নিয়ে মস্করা! এই যে আতরের গন্ধে মোচড় উঠছে তার নাভিতে, তাই নিয়েও মস্করা! শান্তিতে থাকতে দিলো না বুড়োটা তাকে কোনোদিনই। দূর হ, দূর হ! দূর হয় না সহজে। দিনে কিংবা রাতে হানা দেয় যখন তখন ববিতার ঘুপচি ঘরটাতে। আতরের গা গুলানো কড়া গন্ধটা ছড়িয়ে দেয় ঘরময়। সুরমা দেয়া জুলজুলে চোখে শাসনের ভঙ্গিতে তাকায় ববিতার দিকে। ভয় দেখাতে চায়? পাবে না ভয় ববিতা। হাড়কিটকিটে বুড়ো কোথাকার, শাসন করার অধিকার সে পেলো কোত্থেকে!

বহুকষ্টে উঠে ফ্যানটা চালায় ববিতা। গায়ে হাওয়া লাগতেই অনেকটা হালকা লাগলো নিজেকে। ঘরের বাঁদিকে ড্রেনের ঠিক কাছাকাছি গোসলের জায়গা। টিনের বেড়া আর নীল রঙের মোটা পলিথিনে ঢাকা তার আসা যাওয়ার পথটা। সন্ধ্যে হতে দেরি নেই বেশি। গোসল করে নিলো সে। শুধু পেটিকোট আর ব্লাউজ পরেই চলে এলো ঘরে। আতরের গন্ধটা আর নেই এখন। লাল টুকটুকে একটা ফিনফিনে পাতলা শাড়িতে নিজেকে জড়িয়ে বসলো চারকোণার এককোণ ভাঙ্গা আয়নাটার সামনে। মনে হচ্ছে কেউ যেন বালি ঘসে দিয়েছে আয়নাটার ওপর। প্রায় ঝাপসা। তবুও কেমন মায়া ওর এটার ওপর। চাইলেই ফেলে দিয়ে নতুন আয়না কিনতে পারে। কিন্তু... ওই যে, মায়ায় আটকে আছে মন! ঘন কাজল এঁকে নিলো দু'চোখে। গাঢ় লাল লিপস্টিকে ঠোঁটদুটোকে টসটসে করে তুললো। দু'গালেও একটু ছোঁয়ালো সেই লাল। ঠোঁটের ওপরে চন্দ্রবিন্দুর ফোঁটার মতো কালো তিল বসিয়ে ভালো করে আয়নায় দেখলো নিজেকে। চোখে, ঠোঁটে, গালে কামনা উপচে পড়ছে যেন। সারা শরীরে উথাল পাথাল যৌবন। জানে সে, পুরুষের বুকের ভেতর কাঁপন ধরায় তার এই রূপ। তার ঘরের চৌকাঠ ডিঙ্গানো পুরুষের সংখ্যা দেখে ঈর্ষার আগুনে জ্বলে যায় আরতি, বাতাসি, চুমকিরা। বেশ বোঝে সে। ঘনিয়ে আসছে আঁধার। শুরু হয়ে যাবে আনাগোনা রাতের পাখিদের। ঘরের সাথে লাগোয়া একচিলতে বারান্দাটায় গিয়ে বসলো ববিতা। বসে আছে অন্যরাও নিজেদের ঘরের সামনে। খিলখিলিয়ে হাসছে উৎকট প্রসাধনে ঢাকা মুখগুলো।

লাইটপোস্টের আলোটা তেরছাভাবে এসে পড়েছে ববিতার মুখের ওপর। সেই আলোটা ঢেকে দিয়ে একটা লম্বা ছায়া এসে দাঁড়ালো একেবারে ওর পাশটিতে। বললো, যাবি?

হাতে দামি মোবাইল, ভীষণ সভ্য পোশাকের মানুষটাকে দেখে চমকে গেলো ববিতা। গলির মোড়ে দাঁড়ানো লাল টুকটুকে গাড়িটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকেই। এই বস্তিতে এমন গাড়ির মালিক! স্বপ্ন দেখছে না তো! গায়ে চিমটি কেটে দেখবে নাকি? তখনই আবার শুনতে পেলো,

কী রে, যাবি না?

অন্ধকার ঘরটা দামি পারফিউমের সুগন্ধে ভরে গেলো। বাতি জ্বালাতে দেয়নি লোকটা। আঁধারেই অনুভবে আসে, লোকটা কাঙ্গাল। এতকিছু থেকেও নিঃস্ব একেবারে। আলোতে আসুক তার এই নিঃস্বতা হয়তো চায় না সে। তাই আঁধারে এসে আবার মিলিয়ে গেলো আঁধারেই, কে জানে! যাওয়ার আগে ফিসফিসিয়ে শুধু বলে গেলো...... শুনেছিলাম তুই জাদু জানিস। সত্যি, একদম সত্যি!

অবসন্ন শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো ববিতা। আজ রাতে আর কেউ পার হোক তার দরজার চৌকাঠ চায়নি সে। কয়েকটা কড়কড়ে হাজার টাকার নোট দিয়ে গেছে আঁধারে মিলিয়ে যাওয়া লোকটা। তাছাড়া শরীরটাও ঝিমিয়ে আছে সেই বিকেল থেকেই। চোখের পাতা ভারি হতে হতে যেন তলিয়ে গেলো কোনো এক অতল গহ্বরে। তলিয়ে যেতে যেতে হাজার প্রজাপতির ভীড়ে খুঁজে পেলো নিজেকে। যেন বকুল বিছানো একটা পথ, যেন জলে ধোয়া ঝকঝকে প্রকৃতি চারপাশে। নাম না জানা কত ফুল, আর অসংখ্য প্রজাপতি। মিলিয়ে যাবো যাবো করেও সূর্যটা রয়েই যাচ্ছে যেন। হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওকে, ফুলি...........

আতরের গন্ধটা নাকে ধাক্কা দিতেই ফিরে এলো সেই গহ্বর থেকে। বুড়োটা তাকিয়ে আছে সোজা ওর চোখের দিকে। এমন চাবুকের মতো সেই চাহনি, ভেতরটা কাঠ কাঠ হয়ে গেলো ববিতার। তবুও বুঝতে দিলো না বুড়োকে। বুড়োর ওই চাহনিকে তাচ্ছিল্যে উড়িয়ে দিয়ে বিছানা থেকে নেমে এলো। ঘরের পশ্চিমে, যেদিকে একটা কাঠের চেয়ার টেবিল আছে, দাঁড়ালো সেদিকটায় এসে। বুড়ো তাকিয়ে তেমনই।

--- অতো দূরে গেলা ক্যান ফুলি? কাছে আসো, তুমি না বউ আমার!

--- খবরদার কইতাসি, আর একটা কতা না। এক্ষণই বাইরান আমার ঘর থাইকা! পিরিত দেখাবার আইসেন? বুড়া মাইনষের এত পিরিত ক্যান? আমার জীবনডা শ্যাষ কইরাও শান্তি হয় নাই আপনের?

--- আহা, চ্যাতো ক্যান ফুলি? তুমার তো খুশি হওনের কতা, এত বড়লোকের সাতে বিয়া হইসে। কত আরাম আয়েশ তুমার। গয়না শাড়ি ভালো খাওন! কুনুদিন কি ভাববার পারসিলা, এইসব পাইবা? পারো নাই। তবুও পাইসো। পাইয়াও দিগদাড়ি করো। পরপুরুষের লগে রাইত কাটাও? এইডা আমি কেমনে মাইনা লই, কও তুমি?

--- মানতে না পারলে চক্ষু মুইদা থাকেন। কে কইছে আপনেরে দেখতে?

--- বেগানা পুরুষের লগে মেলামেশা ঠিক না ফুলি, আল্লাহ্ নারাজ হয়। দোজখের আগুনে ভাজা ভাজা হইবার চাও? এখনও সময় আছে, শুনো আমার কতা। বিয়ার পর কত হাউস কইরা তুমারে বোরখা বানাইয়া দিলাম, পর্দায় চলাফেরা করবা বইলা। বড় ঘরের বউ ঝি রা সারাক্ষণ পর্দা মাইনা চলে। বাইরের পুরুষের সামনে মুখ দেখানোও তাগো পাপ। আর তুমি কিনা......! যাউগ্গা, কই ফালাইসো সেই বোরখা খান। আবার বানায় লও। এহন তো আমি বানায় দিতে পারবো না। পারলে তোমারে এমুন বেপর্দা চলতে দিই? জোর কইরা আটকাইতাম। কিন্তু আল্লাহ্ আমারে তুইলা নিলো। বড় অসময়ে তুইলা নিলো! তুমার মতো কচি বউরে সাপখোপের মইদ্যে রাইখাই তুইলা নিলো। এই আপসোস আমার কুনুদিন ফুরাইবো না ফুলি! তাই তো ঘুইরা ফিইরা তুমার কাছে আসি। তুমি রাগ হও তাও আসি।

অতৃপ্তিতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো বুড়ো। সুরমার আড়ালে একটু বোধহয় নোনাজলও উঁকি দিলো চোখে। দিক, তাতে ফুলির কী! শুধু টাকা পয়সাই সব? গলা পর্যন্ত কবরে যার সেই বুড়ো কিনা বিয়ে করলো চৌদ্দ বছরের ফুলিকে! কী? না, বউ মরেছে।

বুড়া বয়সে বউ তো মরতেই পারে। ছেলে, বৌমা,নাতি, নাতনিতে ভর্তি বাড়িঘর। তারা নাকি কেউ তার যত্ন নিতে পারবে না। বিয়ে করা লাগবেই।

পরনে একটা বেঢপ ঘটিপ্যান্ট আর কোমরের কুঁচি ছিঁড়ে ঝুলতে থাকা একটা চিটচিটে ময়লা জামা গায়ে ফুলি বেগম মায়ের আঙুল ধরে গিয়েছিলো আক্কাস মিয়ার বাড়িতে। সদ্য স্বামী হারানো তার মা কাজের আশায় গিয়েছিলো ওবাড়িতে। পানের রসে টইটুম্বুর মুখে আক্কাস মিয়ার স্ত্রী বলেছিলো, আইচ্ছা রাখলাম তুমারে, তয় মাইয়াডারে সাতে আইনো না। পোলাপান কামের সময় বড় ত্যক্ত করে।

--- বয়স কত তুমার মাইয়ার?

-- ছয়। তয় আম্মা, অরে রাখোনের কুনু জায়গা নাই। খুব ঠাণ্ডা মাইয়া, আপনেরে একটুও ত্যক্ত করবো না।

--- ঠিক আছে, আইনো তাইলে। তয় সাবধান কিন্তু।

তারপর রোজ মায়ের আঙুল ধরে ভোরবেলায় আসে ফুলি। খায় দায়, জামাকাপড়ও জোটে। একমাথা পাটের আঁশের মতো চুলগুলো তেলে চুপচুপে। সুগন্ধী সাবানে গায়ের কালো হয়ে আসা রঙ ধুয়ে মাজা মাজা শ্যামলা রঙটা হাসিমুখে বেরিয়ে পড়ে যেন। নজরে আসতে থাকে তার মায়া মায়া মুখটা। এই মায়াভরা মুখটার কারণেই হোক, আর ছুটে ছুটে এর তার ফাই ফরমাস খাটার কারণেই হোক, প্রিয় হয়ে গেলো সবার কাছে ফুলি বেগম। একে একে আটটি বছর কেটে গেলো তাদের এ বাড়িতে। সরকারের খাস জমির কুঁড়েঘর থেকে উচ্ছেদের পর এ বাড়ির রান্নাঘরের এক কোণায় জায়গা হয়েছিলো তাদের। কৃতজ্ঞতায় মা তার গদ গদ।

মালকিনের মৃত্যুর চল্লিশ দিন পার হতে যত দেরি, তারপরেই বৃদ্ধ আক্কাস মিয়া জেদ ধরে বিয়ে করার। ছেলেদের তো মাথায় হাত, বুড়ো বাপের এ কী ভীমরতি! ফুলি যে ফুলি, যে কিনা বেড়ে উঠলো চোক্ষের সামনে, তার চেয়েও বড় বয়সের নাতি নাতনি আক্কাস মিয়ার, তারে কিনা বিয়া করবার চায় সেই আক্কাস মিয়াই! তাগোরই বাপ! হায় আল্লাহ্!

নাহ্, আল্লাহ্ আক্কাস মিয়ার ছেলেমেয়েদের হাহাকারে সাড়া দেয়ার সুযোগই পায়নি। তার আগেই বাড়ির লাগোয়া দু'কাঠা ভিটে ফুলির নামে লিখে দেয়ায় হাত হয়ে গেলো ফুলির মা।

স্বপ্নেও ভুল করে কখনও চায়নি যা, পেয়ে গেলো। মালকিনের দুই একটা গয়না, সোনালী জরির ঝকমকে বেনারসি আরও কত কী! ফুলি তার রাজরাণী এখন। সুখে তার রাতের ঘুম যায় যায়।

বুড়োর সাদা জোব্বা থেকে আতরের গন্ধটা বাতাসে ভেসে ভেসে যেন ববিতার মাথার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। অসহ্য....অসহ্য! দু'হাতে মাথা চেপে ধরে ধপ করে চেয়ারটায় বসে পড়লো সে। হামানদিস্তায় পান ছেঁচা হাসিটা বেশ কায়দা করে এমন সময়েই হাসলো বুড়ো। এক ঝটকায় উঠে ঘরের বাতিটা জ্বেলে দিলো ববিতা। কেউ নেই। বুক ভরে শ্বাস নিলো ও, আহ্..... আতরের গন্ধটাও নেই! রাত বাকি আছে আরও কিছুটা। বাইরে অন্ধকার এখনও অনেক গাঢ়। নিবিড় এই আঁধারে কিছু মুহূর্ত খুব মিষ্টি পরশ বুলিয়ে দিলো যেন ববিতার চোখে। যদিও মুহূর্তগুলো পেরিয়ে এসেছে অনেকটা সময়। তবুও সেগুলো ভালোলাগার প্রলেপ দিলো ওর বেদনায়। সদ্য পাঁপড়ি মেলা গন্ধরাজের মতো বউটাকে সবসময় চোখে চোখে রাখতো বুড়ো। জড়িয়ে ধরে আদর করতে চাইতো যখন তখন। কিন্তু চাইলেই কি আর হয়? ঝিমিয়ে যাওয়া যৌবন তার কেন যেন জাগতেই চাইতো না! নিষ্ফল চেষ্টার পরিশ্রমে ঘুমে ঢলে পড়তো বুড়ো। দু'হাতের শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে রাখা ফুলি আলগা হয়ে যেতো কখন টেরই পেতো না! চুপিচুপি সেই বাঁধন আরও খানিকটা আলগা করে ফুলি তখন উঠে পড়তো। বুড়োর ঘরের সাথে লাগানো বাথরুমে গিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে ঠান্ডা পানির ধারা বইয়ে দিতো শরীরে। সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে বুড়োর ব্যবহৃত আতরের গন্ধ দূর করার চেষ্টা করতো প্রাণপণে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে গাঢ় নিঃশ্বাসের শব্দে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তো ফুলিও। একদিন কি ভেবে সিঁড়িভেঙ্গে উঠে পড়লো ছাদে। বিশাল ছাদ। আগে কত উঠেছে, কিন্তু বিয়ের পর বুড়োর কড়া বারণ। দীর্ঘ বিরতির পর হঠাৎ ছাদে যেতে কেমন যেন ভয় ভয় করছিলো ফুলির। তারওপর আবার গভীর রাত। বুড়ো টের পেলে কি হবে কে জানে! তবুও উঠে গিয়েছিলো ও। ভীষণ আঁধার চোখে সয়ে যাওয়ার পর তো ফুলি তাজ্জব! তার আগেই কে যেন এসে বসে আছে ছাদে। একটা ছায়া যেন নড়ে উঠলো তার আভাস পেয়ে। ঘুরে এক্কেবারে ফুলির দিকেই তাকালো। আতঙ্কে ছুটে সিঁড়ির দিকে চলে আসতে চাইলো ফুলি, কিন্তু পারলো না। তার আগেই জাপটে ধরলো ফুলিকে সেই ছায়া। চিৎকার করতে চাইলো ফুলি, কিন্তু শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া ফুলির গলা দিয়ে কোনো আওয়াজই বের হলো না। ছায়াটি ততক্ষণে ওকে ধরে বসিয়ে দিয়ে বললো, এত ভয় পেলে চলে? বলে হাসতে লাগলো।

বুঝলো ফুলি, আক্কাস মিয়ার মেজো নাতি। মেলা বড় পাশ দিবো বইলা যে শহরেই থাকে। ছুটি ছাটায় বাড়িতে আসে। লজ্জায় ফুলি আরও কাঠ হয়ে গেলো।

--- তুমি কি রোজ রাতেই ছাদে আসো?

ফুলি মাথা নাড়ে জোরে জোরে। এই পোরথম, বিশ্বাস করেন বিয়ার পর এই পোরথম!

--- ও আচ্ছা, এত ভয় পাচ্ছো কেন?

--- দোহাই লাগে, আপনের দাদাজানরে কিছু কইয়েন না। আর কুনুদিন আসুম না আমি!

আবার হেসে উঠলো আক্কাস মিয়ার নাতি।

--- বলবো না। কিন্তু কাল রাতে যদি আবার আসো তবে। তা না হলে বলে দিতে পারি!

ধান্দায় পড়ে গেলো ফুলি। এই পোলা তারে রাইতের কালে ছাদে ডাকে ক্যান? ভুল কইরা একদিন নাহয় আইসা পড়সে, তাই বইলা আবার! যদি ধরা পইড়া যায়! কিন্তু..... না আইলে যদি কইয়া দেয়! এই দোটানায় দুলতে দুলতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে চলে আসে। নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ে ঘাপটি মেরে। নাহ্, জাগেনি বুড়ো। কিন্তু হৃদয়ে কেমন যেন তোলপাড় হতে থাকে। বাকি রাত দুই চক্ষে আর নামে না ঘুম। বড় অস্থির... বড়ই অস্থির ফুলি আজ। অচেনা..... ভীষণ অচেনা এক ইচ্ছে জেগে উঠছে বুকের ভেতর। এক অজানা কাঁপন টের পাচ্ছে সে। প্রস্ফুটিত যৌবন তার যেন বাঁধন আলগা করে জেগে উঠতে চাইছে ভীষণভাবে। বুড়োর স্পর্শে কোনোদিন এমন হয়নি তো! কিন্তু.... ও যে বুড়ো আক্কাস মিয়ার বিয়ে করা বউ। তবে কেন অন্য কারো ছোঁয়ায় কাঁপছে তার বুক ভালোলাগায়? শরীরে তার এত আবেশ কেন জাগলো ওই ছোঁয়ায়? কী করবে ও এখন? পরপুরুষের কথা ভাবনায় আনাও যে পাপ। কিন্তু শরীর যে চাইছে! অচেনাকে জানার প্রবল ইচ্ছেটাকে কেমন করে চেপে রাখবে ফুলি? অন্ধকার ছাদ যে তাকে ডাকছে বার বার! সেই ডাক উপেক্ষা করার শক্তি আছে কি তার? না নেই। আর কেনই বা উপেক্ষা করবে ফুলি সেই ডাক? যাবে সে। কাল রাতে যাবে সে ছাদের অন্ধকারে।

পরের রাতে গিয়েছিলো ফুলি সেই অন্ধকার ছাদে। মিয়ার নাতি যেন অপেক্ষায় ছিলো ভীষণ। ফুলি যেতেই এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছিলো যেন দম আটকে যাবে। যেন তার গরম নিঃশ্বাসে পুড়িয়ে দেবে ফুলিকে। সারাগায়ে গতরাতের সেই অদ্ভুত শিহরণ টের পেয়েছিলো ফুলি। আগে কখনও এমন শিহরণ অনুভবে আসেনি তার। সেই শিহরণে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ফুলি যেন নিজের ভেতর দেখতে পেলো একটা দু'কূল ছাপানো নদী। আর সেই নদীর ছলাৎছল ঢেউয়ে দুলতে দুলতে চলে গেলো সে বহুদূর... বহুদূর! যেন হারিয়ে গেলো।

তারপরে ছুটির প্রায় প্রতিটি রাত ছিলো ওদের হারিয়ে যাওয়ার রাত। হারাতে হারাতে ফুলি শুনতে পেতো সেই যুবকের প্রেমের কথা, ভালোবাসার কথা। হতবাক ফুলি তখন চৌদ্দ ছেড়ে আঠারোয়। তবুও শরীরের সাথে লেপ্টে থাকা যুবকের কথাগুলো কেমন যেন দুর্বোধ্য লাগতো তার কাছে। কেমন যেন ভয়, তবুও অদ্ভুত এক আবেশ। সেই আবেশের প্রতীক্ষায় থাকতো দু'জনেই সবার অলক্ষে।

এরপরের ঘটনাগুলো ঘটে যায় খুব দ্রুত। যেন স্বপ্ন! এক জ্যোৎস্নারাতে আক্কাস মিয়া এ সংসারের মায়া ছেড়ে, তার টলোমলো যৌবনবতী বউকে ছেড়ে চলে গেলো ওপারে। মিয়াসাহেবের ছেলেরা তাদের বাপের বউটাকে আর স্বীকারই করতে চাইলো না! জোর করে সাদা কাগজে বুড়ো আঙুলের টিপ নিয়ে তাড়িয়ে দিলো ফুলিকে। ফুলির মা বুক চাপড়িয়ে অভিশাপ দিতে দিতে বেরিয়ে এসেছিলো ও বাড়ি থেকে মেয়ের আঙুল ধরে। মিয়ার সেই নাতি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখেছিলো সব। এমন ভাব যেন ফুলিকে সে চেনেই না! কেন যেন একটুও কাঁদেনি ফুলি। শক্তমুখে মায়ের আঙুল ধরে বেরিয়ে এসে হাঁটা দিয়েছিলো অজানার পথে। গাঁয়ের শেষ মাথায় শাপলা বোঝাই দীঘিটার পাড়ে যে বিরাট আমগাছটা, তার নিচে যে মাটির বাড়িটা, সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে একজন জানতে চেয়েছিলো সমাচার। কেঁদেকেটে ফুলির মা বলেছিলো সব। সেই একজনকে ভাই বলেও সম্বোধন করছিলো ফুলির মা। সেই ভাই সব শুনে বললো, শহরে কামের ছড়াছড়ি। মাইয়ারে পাঠাও আমার লগে। হাজার হাজার টাকা কামাইয়া পরে তুমার মাইয়াই লইয়া যাইবো তুমারে। ততদিন তুমি আমাগো বাড়িতেই থাকো, চিন্তার কিসু নাই। কোন দূর সম্পর্কের ভাই, যাকে ফুলি তো দূরের কথা, ফুলির মাও কোনোদিন তাদের খোঁজখবর নিতে দেখেনি। না নিক, এই অসময়ে তাদের পাশে তো দাঁড়াতে চাইছে, কম কী! একেবারে গলে গিয়ে ফুলির মা পাঠিয়ে দিলো মেয়েকে। মায়ের সেই ভাই ফুলিকে শহরে নিয়ে এসে বেঁচে দিলো এই রঙমাখা বস্তিতে। মা তার জানতেই পারলো না, ফুলি তার কখন কখন ববিতা হয়ে গেলো!

এতকিছু হয়ে যাওয়ার পরেও কেন যেন ভুলতে পারে না ববিতা সেই আঁধার ছাদের শিহরণ। দুখে ভরপুর জীবনে সেটুকুই একটু সুখের স্মৃতি বলেই হয়তো! একথা মনে হতেই আর রাগ থাকে না তাকে কয়েকদিনের আদরে ভরিয়ে দেয়া সেই যুবকের ওপর। কিন্তু বুড়ো আক্কাস মিয়া! বুঝতো না বলে বিয়েটা তখন বড় প্রাপ্তি মনে হয়েছিলো ফুলি আর তার মায়ের। কিন্তু ঠকেছে তো সে বুড়োর কারণেই! দু'কাঠা মাটির লোভে ঠকানো হয়নি তাকে! অবশ্য বউ বলে একটু আধটু ভালোও কি বাসতো বুড়ো তাকে? কে জানে! সবসময় তো চোখে চোখে রেখে জীবন অতীষ্ট করে তুলেছিলো। এখন আবার তার ঘুপচি ঘরে এসে তাকে শাসন করার চেষ্টা! টিপছাপ নিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিলো যখন, তখন তো কব্বর থেকে একবারও আসেনি সে! এখন আবার শাসন দেখায়! কিসের শাসন! না খেয়ে মরবে নাকি ববিতা? তাছাড়া এখন তো সে ফুলি নয়, ববিতা। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত একটু ঘনালেই কত টাকা আসে তার হাতে! সেই যে বিক্রি হয়ে গেলো ফুলি, তারপর আর যায়নি গাঁয়ে। কোন মুখে যাবে? টাকা পয়সা পাঠিয়েছে মাকে। পরে যখন একটা মোবাইলের মালিক হলো সে, কথাও হতো তখন মায়ের সাথে। তবে খুব কম। মায়ের সেই ভাই ফোন দিতে চাইতো না মাকে, নানান টালবাহানা। খুব কাহিল গলায় কথা বলতো ওর মা। টাকা পেয়েছে কিনা জানতে চাইলে কেমন আমতা আমতা করে বলতো, পেয়েছে।

হঠাৎ একদিন শুনতে পেলো, মরে গেছে ফুলির মা। সেদিন খুব কেঁদেছিলো ফুলি। আর কেউই যে রইলো না তার!

দু'চোখ জ্বালা করে উঠলো ববিতার। বাতিটা নিভিয়ে বিছানার পাশের জানালাটা খুলে দিলো। কোথাও শিউলী ফুটেছে কী? ফোটারই কথা। একটু যেন হিম হিম বাতাসে ভেসে এলো তার সুবাস! দূর্বা ঘাসে জমে কি এখনও শিশির সেই গাঁয়ে? পথের ধারের কলমিঝোপে এখনও ফোটে কি সাদা কিন্তু সাদা নয়, ঠিক বেগুনীও নয় আবার গোলাপীও নয়, এমন কলমি ফুলগুলো?

আহ্..... ধীরে ধীরে বাড়ছে শিউলীর সুবাসটা। গুমোট ঘরটা তার ভরে যাচ্ছে মিষ্টি গন্ধে। বুক ভরে স্বাস নিলো ববিতা। একবার, দুইবার, তিনবার.......

হঠাৎ আবার সেই অনুভূতি। সেই আতরের গন্ধ, সেই মোচড় নাভির চারপাশে। নাহ্, একেবারে পেয়ে বসেছে যেন তাকে গন্ধটা! গা গুলিয়ে ওঠার আগেই বেরিয়ে আসতে হবে ওখান থেকে। আর চায় না পেতে ও সেই গন্ধ, সেই হামানদিস্তায় পানছেঁচা হাসিটাও শুনতে চায় না আর। ওসব ওর অতীত। যে অতীতে ফুলি ছিলো। এখন নেই। এখন ববিতা আছে, আছে রাতের বস্তি, খিলখিল হাসি। এখানেও ভোর আসে, শিউলীর সুবাস আসে, আলো আসে জানালা দিয়ে । ওই যে, একটু একটু ফর্সা হচ্ছে আকাশের পুব দিকটা............

 

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;