মধুপ-কাহিনী



রহিমা আখতার কল্পনা
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

বিষয়টা হঠাৎ করেই, বহু বছরের ব্যবধানে আমাকে চমকে দেয়। কিংবা তার চেয়েও বেশি। বলা যায়, আমাকে আমূল নড়িয়ে দেয়। আমার বন্ধু শামীম, শামীম খন্দকার—মাঝখানে ন’বছরের অদর্শন সত্ত্বেও, তার চেহারা সুরতে নয়টি বছরের পরিষ্কার পরিবর্তনের ছাপ বহন করা সত্ত্বেও, কথাটি এমন সহজে বলে, যেন এটি গতকাল বা পরশুর ঘটনা। যেন রোজ আমাদের দেখা হয়। যেন ঘটনাটি ঘটবার পর পুরো ঊনিশটি বছর কেটে যায়নি। প্রসঙ্গটা কিভাবে যেন উঠেছিল মনে নেই। এক পর্যায়ে শামীম বলে
- দোস্ত, সেদিন তোমার পরনের শাড়িটা ছিল সবুজ, খুব তাজা সবুজ।
আমি চমকে যাই—শাড়ির রঙটাও তোমার মনে আছে?
- হ্যাঁ। সবুজ। পাড়টা লাল। এ দু’টো রঙের মিশেল কি ভুলে যাওয়া সম্ভব! বিশেষ করে একজন বাঙালির পক্ষে?

সামান্য ক’টি বাক্য, কয়েকটি মাত্র শব্দ, অথচ কী যে হয়ে যায় আমার ভেতরে। আশ্চর্য, এতগুলো বছরের এত হাজার হাজার দিনের লক্ষ লক্ষ ঘণ্টার দীর্ঘ সময়ে কথাটা একবারও আমি ভাবিনি। কেন ভাবিনি?

আমাদের জাতীয় পতাকার, আমার মাতৃভূমির, আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক লাল-সবুজ কম্বিনেশনের শাড়ি আমার খুব কম বয়স থেকেই পছন্দের। প্রায়ই পরি। এখনো। লাল শাড়ি সবুজ পাড়। সবুজ শাড়ি লাল পাড়। পাড়হীন সবুজ থান অথবা পাড়হীন গাঢ় লালও, সময়ে সময়ে। কিন্তু বহুদিন আগেকার সেই ঘটনাটির সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে মিলে যাওয়া এই প্রতীকী বর্ণ-সমন্বয়টি আমার মনে কখনো উদিত হলো না কেন, সেটাই বিস্ময়ের। শামীম আজ এতদিন পরে কী কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে! আমি কি বাংলাদেশ!

হ্যাঁ, আমি একটা দেশ। বাংলাদেশ। আজ থেকে ঊনিশ বছর আগে, যখন আমার বয়স ছিল চব্বিশ, আর আমি শেষ জুলাইয়ের এক মধ্যদুপুরে স্বাধীন বাংলাদেশেই প্রথমবারের মতো ধর্ষিত হই—তখন আমার পরণে ছিল লাল পাড়ের তাজা কিন্তু গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি। টাঙ্গাইলের তাঁত। আহা, ঐতিহ্য। সেদিনের কোনো কিছুই ভুলে যাবার কথা নয়। আমি ভুলিওনি। কিন্তু শাড়ির রঙ টঙের ব্যাপারটা কেমন যেন আবছা হয়ে এসেছিল স্মৃতিতে। অথবা তেমনভাবে স্মৃতিতে আঁচড়ই কাটেনি বিষয়টা।
- তুই আমার বাড়ি থেকেই গিয়েছিলি।
শামীমের কথায় আমি নিজের মধ্যে ফিরে আসি—হ্যাঁ। তুমি তখন নীলক্ষেত কোয়ার্টারে সাবলেট থেকে ল্যাব এইডে কাজ করো।
- হুঁ। অফিস সেক্রেটারি ছিলাম। কোম্পানি সেক্রেটারিও, সাকুল্যে ওই একটা অফিসই তখন ওদের কোম্পানি ছিল তো।

আমি একবার শামীমের দিকে তাকাই। সেদিনের স্বল্পায়তন প্রতিষ্ঠানটির অফিস সেক্রেটারি শামীম খন্দকারকে আজকের শামীমের ভেতরে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অবশ্য বদলে গেছে প্রতিষ্ঠানটিও, অনেক বড় হয়েছে। তবু সেখানকার ‘চাকুরে’ হিসেবে আজ শামীমের অবস্থান অকল্পনীয়। আজ সে ওরকম ব্যবসার কমপক্ষে বিরাট শেয়ারের মালিক হতে পারে। আমি তার কথার জের ধরি—
- আমি তোমার বাসায় তৈরি হয়ে কোথাও যাব বলে তুমি আধাবেলা ছুটি নিয়েছিলে।
- কারণ আমি জানতাম দিনটা তোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ল্যাব এইড তখন সদ্য প্রতিষ্ঠিত ছোট একটা ডায়াগনোস্টিক সেন্টার। আজকের বিশাল হাসপাতাল-ভবন তখন কল্পনারও বাইরে। তিনতলা ভবনের ওই পরীক্ষাগারে কাজের ব্যস্ততা বলতে গেলে ছিলই না। আমার সব মনে পড়ে। বলি—ওই টেবিলে বসে থেকে তুমি খুব বোর হতে তখন।
- হ্যাঁ। ওটার মালিকের নামও শামীম। ডা. শামীম। নামের সূত্রে খানিকটা সৌহার্দ্য থাকায় শামীম ভাইয়ের অনুমতি পেয়েছিলাম সহজে। কোম্পানি-সচিবের মাছিমারা দায়িত্বের টেবিল ছেড়ে উঠে এসেছিলাম দুপুর বারোটার পরপরই।
- হুঁ।
- হুঁ মানে কী। তোর জন্যই করেছিলাম সব। অকৃতজ্ঞ।

ওর উষ্মার মুখে আমি আর কোনো শব্দই করি না। আমাদের আড্ডার তৃতীয় সদস্য, শামীমের বান্ধবী নাজনীন আমাদের আলাপচারিতা সবিস্ময়ে শুনছিল, নীরবে। খানিক পরে শামীম আবার সক্ষোভে বলে—আমি জানতাম দিনটা তোর বিশেষ দিন।
- হুঁ।
- আবার হুঁ। আমি কিন্তু জানতাম দোস্ত, সেদিন ঘটবে।

এবার শামীমের উচ্চারণে ক্ষোভ নেই, বরং নির্বিকার সে। কিছুটা কি কৌতুকপ্রবণও? কেন যেন আমার সুক্ষ্ম একটা অপমানবোধ হয়—কী অশ্লীল ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলো শামীম। ‘ঘটবে’। কী ঘটবে ?
- এটা অশ্লীল ইঙ্গিত? যাহ্ শালা। যার জন্য করি চুরি...। কামখান বানাইতে পারলা তোমরা, আমি আন্দাজ করতে পারলে দোষ।
- আবার বাজে কথা?
- কথা যেরকমই হোক, আমি একশো ভাগ সিওর ছিলাম, জানতাম যে ওই দিন অঘটনটা ঘটবেই।
- মাই গড, তুমি এতো নিশ্চিত জানতে ? আমি তো কিছুই জানতাম না। তুমি কী করে...
- ওসব বুঝা যায়, কাঞ্চনমালা।

শামীমের মুখে আমাকে ‘কাঞ্চনমালা’ ডাকতে শুনে আমার কোনো স্মৃতিমেদুরতা তৈরি হয় না, কারো প্রতি ক্ষোভ কিংবা ঘৃণাও না। হাসি পায়। একদা এক যুবক আমার ‘মালা’ নামটিকে অলংকৃত করিয়া কাঞ্চনমালা বলিয়া আহ্বান করিত বটে। সুমিত। সুমিত ফায়জুল্লাহ। কী ছিল তার ঢলোঢলো আবেগ! বাথটাব ভর্তি সুগন্ধি সাবান-ফেনার মতো। কিন্তু শামীম তো মনে হচ্ছে আজ এই বিদঘুটে প্রসঙ্গ—কচলানো থেকে রেহাই দেবে না আমাকে। দেড় হাত দূরত্বে মুখোমুখি বসে সে যেন কোন এক দূরাগত গলায় স্বগতোক্তি করে—
- রওনা দেবার আগে আমার রুমে এসে তুই যত্ন করে গাঢ় লাল টিপটা কপালে দিলি। সঙ্গে ম্যাচ করে লিপস্টিক... টিপটপ ড্রেসআপ...
- তুমি শামীম, মুখস্ত করে রেখেছো ওই সব!
- কেন, অস্বাভাবিক? বলতে চাস তোরও মুখস্ত নেই! মনে পড়ে না এখনো?

আমি জবাব দেই না। চুপ থাকি। একসময় চোখ বুজে মুখটা আকাশমুখো তুলে ধরি। যেন এক্ষুণি আকাশ থেকে বৃষ্টি নামবে, মুখটা ধুইয়ে দেবে। বৃষ্টি নামে না। নাজনীন অধৈর্য হয়ে এসময় বলে—অনেক হয়েছে ভাই। তোমরা এবার দু’জনেই ঊনিশ বছর পেছন থেকে আজকের দিনটাতে ফিরে আসো তো।

হঠাৎ শামীম হাসতে থাকে। আমিও। নাজনীনও। যে যার নিজস্বতায়, আনন্দে, স্বস্তি বা অস্বস্তিতে, অর্থহীনতায় কিছুক্ষণ হাস্য-আক্রান্ত থাকি। এরপর একসময় থিতিয়ে আসে যার যার নিজস্ব অনুভূতি। খানিক আগের ঝলমলে বিকেলটা কেমন যেন বিমর্ষতায় মরে আসতে থাকে। জাতীয় জাদুঘরের ভেতরের পুকুরটা কমলারঙের মিহি সরভাসা পানি বুকে নিয়ে স্থির হয়ে আছে। পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যরশ্মি তির্যকরেখায় পুকুরের পানিতে পড়ে কেমন একটা সব্জে-কমলা রঙ ধরেছে। আমরা তিনজন পুকুরপাড়ের সবুজ মাঠে বসে থেকে নিজেদেরকে চিনতে পারি না। অথচ বহুদিনকার যোগাযোগহীনতাকে দূর করে দেবার জন্যই আমরা খুব উদার প্রকৃতির স্পষ্টতায় খোলা আকাশের নিচে বসেছিলাম; শামীম বারবারই কাছের কোনো চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসবার জন্য পীড়াপীড়ি করা সত্ত্বেও। শুধু তারুণ্যের স্মৃতিমেদুরতার কারণেই এই প্রান্তরবিহার। না হলে বয়স এবং তথাকথিত পদমর্যাদার দৌরাত্ম্যে আমাদের জীবন থেকে সাধারণ দিনযাপনের আনন্দ অন্তর্হিত হয়েছে বহু আগে। আমি চারপাশে চোখ ফেলি। দূরে দূরে ছড়ানো নানান গাছপালা। এ মুহূর্তে এই বৃক্ষমালাদের মতো আমরাও আমাদেরকে অনড় বলে বোধ করি। তিনজনই চুপ করে যাই। যেন আমরা সত্যিই গাছ হয়ে গেছি। ভাষাহীন। গাছগুলো মাটির গভীরে চলে যাওয়া শেকড়ের বন্ধনে আঁটো, তবে এই গাছ তিনটির কাণ্ডগুলো হাঁটু ভেঙে জুবুথুবু হয়ে জমে পড়েছে বুঝি। আমরা মাঠের দুর্বাঘাসের ওপর বসেছিলাম।

একটু দূরে, মাঠের অন্যপাশে কয়েকটি শিশু-কিশোর কল্পিত পীচের দু’প্রান্তে পরপর চার পাঁচটা করে ইট বসিয়ে স্ট্যাম্প বানিয়ে ক্রিকেট খেলছিল। বিপদজনক স্ট্যাম্প, কিন্তু বাচ্চাদের মুখে ভীতি বা দুশ্চিন্তার চিহ্ন নেই। এসময় আমাদের নীরবতার অখণ্ডতায় একটা ঢিল পড়ে। আচমকাই। ওদের একটি বল ব্যাটের আঘাতে উড়ে এসে আমার ঠিক ডান হাঁটুতে লেগেছে। ক্ষুদে খেলোয়ারদের হল্লা উঠলে আমরা আবার ধুলোওড়া বিকেলটাতে ফিরে আসি। আমি বলটা হাতে নিয়ে ওদেরকে হাত ইশারায় ডাকি। খুব দ্বিধার সঙ্গে একজন এগুচ্ছে। হাতে ব্যাট। স্ট্যাম্পের কাছে ব্যাট হাতে আরেকটি ছেলে। তার পাশে বড় জোর ন’দশ বছরের একটি মেয়ে। কী মায়াবী মুখটা তার! খুশির হাসিতে চোখ দুটো বুজে আসার যোগাড়। হাসতে হাসতে ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে। তার কথা শুনতে পাচ্ছি—আমাকে তো খেলতে নাও না। এই জন্য। এইজন্য বিচার হইছে।

আগুয়ান ছেলেটি সম্ভবত ‘বিচার’- এর ভয়েই মুখ শুকনো করে একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়াল। শামীম গম্ভীর গলায় বলে—কী ঘটনা? ছেলেটি উসখুশ করছে। শামীম আবার বলে—ঘটনাটা কী, বল নিতে এসেছো?
নাজনীন হেসে ফেলে—বেচারা ভয় পেয়েছে। শামীম আবার রহস্য করে আমাকে দেখিয়ে বলে—ভয়ের দেখেছো কী, শোনো ছেলে, এই ম্যাডাম যে খুব রাগী, তা জানো?
ছেলেটি না বোধক মাথা নাড়ে।
- এই রাগী ম্যাডাম যদি সত্যিকার রেগে যায়, তাহলে তোমাদের খেলাটা একদম খেয়ে হজম করে ফেলবে, বুঝলা?
- কী খেয়ে ফেলবে? এতক্ষণে বিস্মিত মুখে কথা ফুটল ছেলেটির।
- তোমাদের খেলাটা।
- খেলা-টা? খেয়ে হজম?
- হ্যাঁ ব্যাট-বল-স্ট্যাম্প সব। বেশি রাগ করলে উনি হাতের কাছে যা-ই পান, তাই খেয়ে ফেলেন।
তারপর আমার দিকে চেয়ে উদাস গলায় বলে—নিজের রাগটা খেতে পারেন না তো! এজন্য।
এবার সম্ভবত কৌতুকটা ধরতে পারল ক্রিকেটার। সে মুচকি হেসে আমার দিকে হাত বাড়াল বলটার জন্য। বলল—আমরা সরি আন্টি। আপনি কিন্তু খুব বেশি রাগ করেন না।

আমরা এবার নিজেরাই হাসতে লাগলাম। ছেলেটা বল হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে ফিরে গেল। অনেকক্ষণ ধরে খেলা বন্ধ রেখে ওদের হাসাহাসিই চলছে, দেখলাম। বিকেলটা ফের তার নিজস্বতা নিয়ে ফিরে এসেছে শাহবাগ অঞ্চলে। আমাদের মধ্যেও কি ফিরে আসে প্রত্যেকের নিজ নিজ দিনরাত, ভিন্ন ভিন্ন জীবনযাপনের অশ্রুত পাঁচালী! কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা, সম্পূর্ণ ভিন্ন তিনটি বাস্তবতার প্রতিনিধি, কিছু কমন বিষয় নিয়ে মামুলি আলোপচারিতায় অংশী হয়ে উঠি। একটু পরেই জাদুঘরের ডেপুটি কিপার ড. নীরু শামসুন্নাহারকে আসতে দেখা যায়। মুখে উজ্জ্বল আভা। তার সম্প্রতি পাওয়া দু’বছর মেয়াদী জাপানের স্কলারশিপসহ ভিসা প্রাপ্তির খবর এবং আগে থেকে জানা তার সদ্যসূচিত সপ্রেম দ্বৈত-জীবনের তথ্য আমাদের দারুণ আনন্দিত করে অথবা নিজেদের কিছু কিছু না-পাওয়ার ক্লেশকে অধিকতর গভীর করে। আমরা তাকে উইশ করি, সঙ্গে থাকা মিষ্টি সকলে মিলে খাই। নিমকিভাজা খাই, বোতলের পানিতে তৃষ্ণা দূর করি। নানান বিষয়ে কথা চলতে থাকে। মিনিট চল্লিশেক পরে নীরু আপা ‘মোশারফ ভাই আমার জন্য অপেক্ষা করতেছে, না হইলে আরো অনেকক্ষণ থাকতাম’ বলে উঠে গেলে আবার তিনজন একা হয়ে পড়ি।

শামীমের বহুদেশ ঘোরার অভিজ্ঞতা আছে। আজ সে নিউইয়র্ক তো পরশু ব্রাসেলস। এক সপ্তাহ পরেই  হয়তো সে ফ্রান্সে, পরের মাসেই থাকতে পারে হংকং। কয়েক মাস ধরে সে বাংলাদেশে আছে। সম্প্রতি সে বিরিশিরিতে বিঘা দশেক জমি কিনেছে। আরো দশ পনের বিঘা কেনার ধান্দায় আছে। আপাতত কিনে ফেলা জমিতে একটা ট্যুরিস্ট-রিসোর্ট আর বৃদ্ধাবাস করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাথমিক কাজকর্ম সেরে ফেলেছে। মহাব্যস্ত লোক।

নাজনীনের ব্যাপারটাও জানা গেল। সম্প্রতি নিঃসঙ্গ হয়েছে সে। বিয়ে হয়েছিল পারিবারিকভাবে। ছেলে রূপে গুণে বিদ্যায় ছিল অতুলনীয়। মনকাড়া সুন্দরী নাজনীনও মেধায় নান্দনিকতায় চূড়াস্পর্শী। সোনায় সোহাগা। কিন্তু স্বামীধনের গুণপনার অলিগলিতে বিচরণ করতে নিয়ে সে যখন আবিষ্কার করে যে, প্রতিরাতে স্বামী তাকে কিশোরীসুলভ কিছু ব্রীড়াভাঙার ক্রীড়াশৈলীতে আবিষ্ট রাখবার চেষ্টা করে ঘুম পাড়াতে চায়, অভিযাত্রার প্রান্তদেশে পৌঁছাতে উদ্যোগী হয় না, তখন সে সংশয়ে পড়ে। লোকটি কি শারীরিকভাবে অক্ষম! মগজে কেউটের মতো ফণা তোলা এ প্রশ্নের জবাব কিন্তু সে অচিরেই পেয়ে যায়। দেহ আর মনের বিবাদভঞ্জন হয়—নাহ, অমূলক সন্দেহ। বরং পারঙ্গম স্বামী নিজের দাদীর কাছে শোনা স্বামী-স্ত্রীর মিলন বিষয়ক অব্যর্থ প্রবাদটি তাকে শোনায়—‘মাসে এক, বছরে বারো, এর থাইককা যে যতো কমাইতে পারো।’ নাজনীন বিশ্বাস করেছিল। তীব্র আকাঙ্ক্ষায় জর্জরিত বহু রাতেই সে স্বামীর ঔদাসীন্যে তেমন দোষ দেখেনি। আর দীর্ঘ বিরতিতে যেদিন প্রত্যাশিত সন্তরণ ঘটেছে, সেদিন তার মতো সুখী আর কেউ নয়। ভালোই কাটছিল। মন্দের ভালো। দু’বছর আগে স্বামী যখন উচ্চতর বিদ্যালাভের জন্য ইংল্যান্ড পাড়ি দেয়, তখনই সে প্রথম জানতে পারে যে লোকটি সম্পর্কে তার জানাশোনায় ফাঁক থেকে গেছে। ইংল্যান্ডে সে একা যায়নি। সঙ্গে স্বামীর কৈশোরোত্তীর্ণকাল থেকে সখ্যের সম্পর্কধারিনী একজন দু’সন্তান-শোভিত বিধবা যুবতী মাতাও গিয়েছেন। সন্তানসহ তার ভিসা অবশ্য আলাদাভাবে হয়েছে। তার বাচ্চারা ওখানে পড়াশোনা করতেই যাচ্ছে।

নাজনীনের সঙ্গে তার স্বামীর বিয়েটা ছিল পরিবারের চাপে। এ বিয়ের ফলে তাদের পূর্বসম্পর্কের কোনো বিরতি ঘটেনি। সবকিছু জানাজানি হলে ঘুমন্ত স্বামীর পাশে জেগে কাটানো উপোসী রাতগুলো তার চোখে টেঁটাবিদ্ধ করে বুঝিয়ে দেয় সত্য কী। তারপরও সে চেষ্টা করেছিল। বৃথা। দু’বছর প্রকৃত প্রোষিতভর্তৃকার জীবন কাটানোর পর সম্প্রতি তালাকের নোটিশ এসেছে। যে ফ্ল্যাটটিতে সে এখন বসবাসরত, সেটি দেনমোহরের হিসাবে ফেলে নাজনীনের নামে লিখে দিয়ে স্বেচ্ছায় মুক্তি নিচ্ছে তার প্রবাসী স্বামী। দেনমোহর এবং তিনমাস দশদিনের ইদ্দতকালের খোরপোশের খরচের অন্তত আট ন’ গুণ বেশি হবে ফ্ল্যাটটির দাম। কিন্তু নাজনীন এই প্রাপ্তির হিসাব বুঝিয়ে অনির্বাণ জ্বলতে থাকা মনকে শান্ত করতে পারে না। অপমান। তীব্র অপমান অবিরত দংশনে তাঁকে মৃত্যুমুখী করে ফেলছিল।

এ অবস্থায় শামীম তাকে সঙ্গ দিচ্ছে। অথবা শামীমকে সে। বন্ধু হিসেবে পরস্পর পরস্পরের নির্ভরতা হয়ে উঠছে। ফেরার পথে কলাবাগানে আমার বাড়িতে আমাকে নামিয়ে দিয়ে যায় ওরা। আমার বাচ্চাদের জন্য অনেক খাবার আর গিফট কিনে দিয়েছে শামীম। কিন্তু সময়ের তাড়া বলে ওরা আমার বাড়িতে নামে না, রওনা দেয় উত্তরার দিকে, নাজনীনের বাড়ির উদ্দেশ্যে। শামীম কিছুদিন ধরে নাজনীনের ফ্ল্যাটে থাকছে। আমি দেখি, আমার বন্ধু শামীম তার বন্ধু নাজনীনকে নিয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে জনাকীর্ণ রাজপথে। কিন্তু শামীম কি জানে, কী মারাত্মক একটি জখমের চাপাথাকা মুখ সে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খুলে দিয়ে গেছে আজ!

সে দিনটা অন্য দিনগুলো থেকে ভিন্ন ছিল।
গরম কালটা আমার অপছন্দের। কিন্তু শেষ জুলাইয়ের সেই অসহ্য গরমেও নিজেকে আমার ফুরফুরে লাগছিল। আমার বন্ধু... দীর্ঘদিনের বন্ধু, যাকে আমি খুব মামুলি মেয়েদের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে ভালোবাসি—আজ আমাকে নিভৃতে ডেকেছে। আমরা বহুবছর বন্ধুত্ব রক্ষার দূরত্বে থেকেছি, তার বিভিন্ন নারী বা তরুণী বিষয়ক গল্প, তা প্রেম বা নিছক কামের তাড়নাতেই হোক—আমি শুনেছি। জানি। আমার রক্ষণশীল প্রেমপ্রবণতাও জানে সে। আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে একটা ধুম্রজাল রয়েছে বন্ধুদের মধ্যে। কেউ বলে, আমি সুমিতের পেছনে অর্থহীন মোহে সময় নষ্ট করছি। কেউ বলে সুমিত আমাকে খেলাচ্ছে, লক্ষ্যে পৌঁছামাত্র কেটে পড়বে। বন্ধুরা, বিশেষত মেয়ে বন্ধুরা আমার ব্যাপারে খুবই শংকিত। তারা মনে করে, আমি সুমিত ফায়জুল্লাহর মতো একটা চিহ্নিত প্লেবয়ের পাল্লায় পড়ে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করতে যাচ্ছি। আমি জানি প্রকৃত সত্য। ভুল শুদ্ধ যা-ই হোক কাজটা আমি করেই বসেছি। সুমিতকে ভালোবেসেছি। বাইরে অবশ্য আমি এর তীব্র বিরোধিতা করি। সুমিতও। সে কী বুঝে আমাদের প্রেমসম্পর্ক হওয়ার সম্ভাবনাকে স্রেফ অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেয় জানি না। তবে আমিও ঠিক তারই মতো করে সবকিছু অস্বীকার করি। কারণ সকলের মনোযোগ সরিয়ে দিয়ে আমি ওকে সত্যিকারেরই পেতে চাই। এরপর জানতে পেরে চমকে উঠুক সবাই। তবে মেলামেশার ব্যাপারে আমি খুবই সাবধানী। আগামী মাসে আমার চব্বিশ পূর্ণ হবে। এখনো আমি কোনো পুরুষের শারীরিক সাহচর্যে যাইনি। দীর্ঘ ছ’বছরের বন্ধুত্বে সুমিত পর্যন্ত কাছ ঘেঁষতে পারেনি। কত গান, কত সাংগঠনিক কাজ, ডাকসু সাংস্কৃতিক দলের অনুষ্ঠান আমরা একসঙ্গে অনেকের সাথে করেছি। আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি শুধু দু’জনে, আমি যে চাচাজির বাড়িতে থাকি, সেখানে। কোনো নির্জনতার প্ররোচনাতেই সে বন্য হয়ে ওঠেনি। অথচ কত কথাই ওর লাম্পট্য সম্পর্কে আমি শুনেছি।

সুমিতের আমার সাথে একান্তে দেখা করে আমাদের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার প্রস্তাবে আমি সানন্দে রাজি হয়েছিলাম। তবে কথাটা যাতে কোনোভাবেই প্রচার না হয় সেদিকে আমরা দু’জনেই সর্তক।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সুমিত অন্য সাবজেক্টের ছাত্র আমাদের ইয়ারেই। তার একাডেমিক রেজাল্ট খুব সাধারণ হলেও সে কোনো বিচারেই সামান্য নয়। সুমিতের বাবা দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী শিক্ষাবিদ। সে নিজে সঙ্গীত-শিল্পী। সম্প্রতি সিনেমার প্লে ব্যাকও শুরু করেছে। আমার অনার্সের রেজাল্ট আশানুরূপ, একই পর্যায়ের রেজাল্ট এমএতেও হবে আশা রাখি। এরপর তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় যোগ দেবার সিদ্ধান্ত পাকা হয়েই আছে। স্বপ্নের জীবন পেয়ে যাব বাস্তবে। কঠিন সংগ্রামের দীর্ঘ জীবন থেকে বিদায়। আমি এখন নিজের উপার্জনে পড়ি। পার্টটাইম কাজ করি দু’টো জাতীয় দৈনিকে। অনেকে ছাত্র পড়াতে বলে। আমার পোষায় না। শিক্ষকতা একেবারে বিশ্ববিদ্যালয়েই শুরু করব। সুমিত আমার এই ডিটারমিনেশনটা খুব সম্মান করে। সীমাহীন প্রতিকূলতায়ও হাল ছেড়ে না দেবার দৃঢ়তাকে সম্মান করে। আরেকটা ব্যাপারে আমার আশ্চর্য লাগে—ও তার সমস্ত গোপন কথা, লোভ, ঈর্ষা, ভবিষ্যত-ভাবনা এমনকি অপরাধবোধের কথাও আমাকে জানায়। আমি মাঝে মাঝে সংশয়ে পড়ে যাই। ও কি আমাকে সত্যিই ভালোবাসে ? নাকি এ কেবল কথামালা ? আবার বিভ্রান্ত লাগে—ভালো না বাসলে কেউ কাউকে এত চায়? এত কিছুতে জড়িয়ে নেয়! মাঝে মাঝে আমার সম্পর্কে সুমিত বন্ধুদের কাছে উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করে, যার মর্মার্থ হচ্ছে—আমি একটা খুব অন্যরকম চরিত্র। মামুলি মেয়েদের মাপকাঠিতে আমাকে বিচার করা যাবে না। এগুলো কি স্তুতি? সে চিঠিতেও আমাকে লেখে—কাঞ্চনমালা, আমার প্রতি আপনার কোনো তুচ্ছ অধিকারবোধ নেই বলেই আপনার অধিকার আমার ওপর সবচাইতে বেশি। সম্পর্কের ভেতরকার দাবি মানুষের সম্পর্ককে জীর্ণ করে। আপনাকে এত বেশি ভালো লাগার এটা অনেক বড় কারণ যে আপনি অনাবশ্যক দাবির কথা তুলে আমাদের অসাধারণ সম্পকটা, জীর্ণ করেন না।

হ্যাঁ—আমি হয়তো সুমিতের কথাগুলোর মতোই একটা চরিত্র। আমি এখন পর্যন্ত কিছু চাই না ওর কাছে। সে-ও না। কিন্তু চাওয়া কি নেই, এমনকি দাবি? আমি আপনমনেই হেসে ফেলি। সে-ও তো মুখে কিছু উচ্চারণ করে না। কিন্তু গত মাসখানেক আগে এই প্রথমবারের মতো, ফাঁকা বাড়িতে বড় চাচাজির বেডরুমে আমরা যখন আচার খুঁজছি, পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আচমকা একটা চুমু খেয়ে ফেলেছিল সুমিত। দীর্ঘ সময়ের চুমু। আমি আচারের বয়াম রাখবার সেল্ফটাতে খুঁজে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছি মাত্র, কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে একহাতে কোমর জড়িয়ে ধরে মুখটা অন্যহাতে ঘুরিয়ে গ্রাস করতে শুরু করেছে ঠোঁট দুটো। দম আটকে ছটফট  করতে শুরু করার আগে পর্যন্ত ছাড়েনি। আমি ক্ষুণ্ণ হয়েছিলাম। প্রতিক্রিয়ায় এক সপ্তাহ আর দেখা করিনি। সেও সাহস করে আমার বাসস্থানে আসেনি। একটা চিঠি পেয়েছিলাম সে সময় তার। অনেক কথার সঙ্গে লিখেছিল যে, আমরা দু’জন পরস্পরকে ভালোবাসি আর বিষয়টাও উপভোগ না করার মতো কিছু ছিল না, তবে ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ কী। এ-ও লিখেছিল—এরকম একটা ঘটনার জন্য কান্নাকাটি করাটা কোনো সোলেমানীয় ব্যাপার না। ‘সোলেমানীয়’ কী? কথাটা আমি বুঝতে পারিনি। এবার জিজ্ঞাসা করতে হবে। আরেকটা ভয় হচ্ছে—এবারও কি একবার সেদিনের মতো দুঃসাহস করে ফেলতে পারে সে? ভাবতেই আমার গায়ে শিহরণ বোধ করি। বজ্জাত। এবার ওকে কাছে আসার সুযোগই দেওয়া যাবে না। অবশ্য সে নির্জনতাও আজ পাবে না। আমরা যে বাসায় দেখা করব, সেটা আবৃত্তিকার দম্পতি ফরহাদ-নাবিলার। ফরহাদ ভাই আর নাবিলা আপা দু’জনেই চাকরিজীবী। তাদের বাসায় আমি আসবো জানালে নাবিলা আপু বলেন—
- সুমিতও আসবে শুনলাম?
- হ্যাঁ। কিন্তু আমি তো এখনো তোমাকে সেটা বলিনি। জানলে কিভাবে।
- ফরহাদ বলেছে। আসো দু’জনেই। কিন্তু মালা, যত দ্রুত সম্ভব সম্পর্কটার পরিণতি ঠিক করে ফেলো। সুমিত খুব অস্থির ধরনের ছেলে।
- কী করব?
- কী করব মানে? আমরা কি করেছি, আমি আর ফরহাদ? জগতের আর সব জুটিরা কী করে? বিয়ে করবে। সরাসরি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে বলবে এবার।

নাবিলা আপার কথার যুক্তি আমাকে প্রভাবিত করে। সুমিতের সঙ্গে সম্পর্কটা নিয়ে একমুখী সিদ্ধান্তে স্থির হয়ে আমি তার মুখোমুখি হবার অপেক্ষায় থাকি।

বাজে ধরনের গরম পড়েছিল সেদিন। বকশিবাজার এলাকায় নাবিলা আপার শ্বশুরবাড়ি। বাড়িটায় তিনতলার ছাদে আরেকটা ফ্লোর করে গোটা অর্ধেক অংশ জুড়ে একটা এ্যাপার্টমেন্ট বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি অর্ধেকটা ছাদ যেন স্নিগ্ধ উঠান। চারপাশে টবের বাগান। ফুলের, ফলেরও। কিন্তু এ মুহূর্তে চারতলার কংক্রিটের উঠান রোদে জ্বলছে। দু’জোড়া ক্লান্ত পা দু’টি পরিশ্রান্ত মানুষকে সেই আঙিনাতে এনে পৌঁছায়। সুমিত আর আমি অথবা আমি আর সুমিত। তবু রক্ষা, চলে তো এলাম। স্বস্তি। স্বস্তির কথা ভাবতে না ভাবতেই আমার মাথায় একটা চক্কর দিয়ে উঠল। অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় বিশাল এক তালা।

আমার মনে হলো ক্লান্তি যেন শতগুণ বেড়ে গেছে। ইচ্ছে করছে কয়েক পা পিছিয়ে ছায়াচ্ছন্ন সিঁড়িঘরেই বসে পড়ি। হঠাৎ চোখে পড়ে, তালার আঙ্টায় একটা কাগজ গুঁজে রাখা। দ্রুত ভাঁজ খুলি। নাবিলা আপার লেখা—মালা, দুঃখিত। ভোরবেলা খুব জরুরি খবর পেয়ে নরসিংদী যেতে হচ্ছে। মা অসুস্থ। রাতের আগে ফিরতে পারব না, ওখানে আজ থেকে যেতেও হতে পারে। তোদের বোঝাপড়াটা আরেকদিন হোক। অবশ্যই, আমার বাড়িতেই হোক। দুঃখিত সোনা।

আমি হতাশ হয়ে সুমিতের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হই। তার মুখে চিন্তার ছায়া নেই। এবং অচিরেই পকেট থেকে চাবি বের করে সে গেট খোলে। আমি প্রায় চিৎকার করে উঠতে গিয়ে সতর্ক হই। গলা খাটো করে বলি
- অ্যাই, কিভাবে?
- ফরহাদ ভাই। চিরকুটে লেখা খবরটা সকালে আমাকে জানালে আমি রিকোয়েস্ট করেছিলাম...।
- কী রিকোয়েস্ট?
- বলেছিলাম, আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আজকেই কথা বলা খুব জরুরি।
- নাবিলা আপা?
- জেনে থাকতে পারে, না-ও জানতে পারে। এটা তাদের ব্যাপার। আমরা তো আর লুকিয়ে চুরি করতে আসিনি।
- তবু
- তবু কী। খোদ গৃহকর্তাই তো চাবিসহ প্রবেশাধিকার দিয়েছে। নাকি?
- ধূর। কেমন যেন হয়ে গেল না?
- হ্যাঁ। খুবই ‘কেমন’ হয়ে গেল। এসো ভেতরে।

জ্বলতে থাকা দুপুরের ঝাঁজ থেকে স্নিগ্ধ পরিচ্ছন্ন আরামদায়ক ফ্ল্যাটটিতে ঢুকে আমি মুগ্ধ হই। সুমিতও। ঘুরে ঘুরে দ্যাখে ঘরগুলো। বেডরুমটায় ঢুকতে গিয়ে সুমিত একবার পেছনফিরে তাকায়—‘এসো।’ ও সব সময় আমাকে ‘আপনি’ বলে। আমিও। আজকে সেই প্রথম থেকেই ‘তুমি’ বলছে। বিনা কারণেই কেমন একটা ভয় হয় আমার। দ্বিধার সঙ্গে বলি,
- একজনের অনুপস্থিতিতে তার বেডরুমে ঢুকে পড়া উচিত হয়?
- আরে কী মুশকিল। এ বাড়িটা পুরোটাই আজ আমাদের জন্য বরাদ্দ আছে তো।
- তবু
- আবার তবু। বিছানার পাশে ড্রেসিং টেবিলের সেটিংটা দারুণ না?

সত্যিই দারুণ। এ সংসারে অনেক কিছুই দারুণ। কিন্তু আমরা এসব ‘দারুণ গৃহসজ্জা’ কতক্ষণ দেখব? কথা বলা জরুরি। নিজেদের ভবিষ্যত-পরিকল্পনার কথা। হঠাৎ করেই সুমিত আমার কাঁধে হাত রাখে। আমি চমকে উঠি। সে আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করে না। একজন সম্পূর্ণ আলাদা সুমিত আমাকে সর্বাঙ্গে জড়িয়ে ধরে তীব্র চুমু খেতে থাকে। আমার সাধের পাটভাঙ্গা টাঙ্গাইলের শাড়ি, সাথে রঙমেলানো যাবতীয় আবরণ তার কাছে বাহুল্য বলে সে সব সে অপসারণে ব্যস্ত হয়। আমি একটি মরিয়া প্রাণীর মতোই প্রতিরোধ করতে থাকি। আজন্ম যত্ন-লালিত সংস্কার আমাকে আমার সবচাইতে আকাঙ্ক্ষিত মানুষের বিরুদ্ধে প্রায় যুদ্ধে অবতীর্ণ করে। এক সময় সমস্ত শরীরে অনিচ্ছার মুদ্রা নিয়ে বিছানায় আমাকে কুঁকড়ে থাকতে দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে সুমিত—এ সবের কী মানে মালা, এটা কী রকম আচরণ?
- এই কথা তো আমি জিজ্ঞেস করব আপনাকে।
-  না, করবে না। এটাই স্বাভাবিক।
- না।
- তাহলে চলো, ফিরি।

সুমিতের ফিরে যাবার প্রস্তাব শুনে আমার অন্তর আর্তনাদ করে ওঠে—ফিরি মানে? আমরা কি এসবের জন্য এসেছিলাম? আমরা কথা বলব না?
- অবশ্যই বলব। অনেক কথা বলার আছে আজ। একটু সহজ হও।

আমি সহজ হবার চেষ্টা করি। সুমিতও অনেকটা শান্ত, আমার অন্তত তাই মনে হয়। অভয় দেবার ভঙ্গিতে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ। এবং আর কিছুক্ষণ পরেই সে সমস্ত নিয়ন্ত্রণের বাইরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। তার প্রাণের ‘কাঞ্চনমালা’ এবার তার আগ্রাসী পৌরুষের কাছে সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়। এরপর অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে সুমিত। কোনো কথা বলে না। আমার ভেতরে অকারণে একটা ভয়-শিরশিরে অনুভূতি হয়। আর এত অসহায় লাগে ! নিজেই বুঝতে পারি না কখন নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করেছি।
- এতে কান্নাকাটির কী হলো...।
আমি আহত বোধ করছি, তবুও বলি—‘সরি।’
- সেদিন একটা চুমু খাওয়ার পরও তুমি কেঁদেছিলে। এসব কী ন্যাকামো। নাকি বুঝাতে চাও এর আগে কেউ তোমাকে চুমুও খায়নি!

সুমিত ব্যঙ্গ করে বললেও কথাটা সত্যি। কিন্তু এ মুহূর্তে তথ্যটা অর্থহীন লাগে, ওকে তা জানিয়ে কী হবে। বরং তার চোখমুখে নির্মমতার অভিব্যক্তি দেখে আমি বিস্মিত হয়ে পড়ি। সুমিতকে আমি চিনতে পারি না। ওর কণ্ঠস্বর, আমার এত প্রিয় কণ্ঠশিল্পীর নিয়মিত রেওয়াজের স্বর এত কর্কশ! আমার কান্নার বেগ দ্বিগুণ হয়ে উঠছে। কিন্তু আমি নিজেকে সামলে নিই। মনে হয় যেন অন্য কেউ আমার গলায় মরিয়া হয়ে বলছে—এসব কী বলেন আপনি।
- হ্যাঁ, ঠিকই তো বলছি। তুমি এত খুকী নাকি। সামান্য একটা চুমুতেও তুমি ক্ষয়ে গিয়েছিলে?

আকাশপাতাল খুঁজেও এ প্রশ্নের জবাব আমি পাই না। কিন্তু ঠেলে ওঠা কান্নার দমকটা এবার আর সামলাতে পারি না আমি। উপুড় হয়ে দু’হাতের ওপর মুখটা রেখে কাঁদতে থাকি। শুধু বেডকভারটাই আমার শরীর ঢেকে রেখেছে। খানিকটা সময় ভীষণ অস্বস্তির মধ্যে কাটে। আবার সুমিতের গলা শোনা যায়, এবারে অনেকটাই কোমল—‘শোনো।’
আমার অভিমান হয়। হায় আল্লাহ, এরপরও আমার অভিমান হয়! কিন্তু সত্যিই হয়েছে তো। আমি সাড়া দিই না। আমার তলপেটে খুব ব্যথা, দুই উরুর মাঝখানের গহীনে তীব্র জ্বালা। বরফঠান্ডা পানিতে যদি এক্ষুণি গোসল করা যেত! কিন্তু আমি উঠব না। ও বেরিয়ে যাক এ বাড়ি থেকে। তারপর উঠে, অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে ধুয়ে ফেলে দেব সমস্ত ক্লেদ। সুমিত অপরাধী। সুমিত অপরাধী। আমাকে ফাঁদে ফেলে কলঙ্কিত করেছে সে।
- শোনো, মালা। জরুরি কথা আছে।
আমি মুখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে দেখি সে বেশ শান্ত। আমার মনে হয় যেন কিছুটা আপোষের বা অনুতাপের ভাব ফিরে এসেছে তার মধ্যে। আমি চোখভরা পানি নিয়ে ওর দিকে তাকাই। এখন যেভাবেই হোক, আমি তাকে মনস্থির করাব। আমি তাকে সরাসরি জানাব যে আমার পক্ষে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব না। আমরা আজ হোক কাল হোক দ্রুত বিয়ে করব। এরকম একটি ঘটনার পর আমার শরীর-মন আর কারো হতে পারে না। ভিতরে ভিতরে ক্ষীণ একটা আশা দৃঢ় হতে থাকে। সুমিত নিজের ভুল বুঝতে পারছে। এমন রক্ষণশীল একটা সমাজে আমার মতো একটা অসহায় নিরুপায় অভিভাবকহীন মেয়েকে পরিকল্পনা করে ঠকাবার মতো হীন সুমিত নিশ্চয় না। আমার স্ট্রাগলকে, আমার মেধাকে সে তো খুবই সম্মান করে। সে তো জানে, একটি সৎ জীবনের আশায় আমি এই প্রতিকূল সমাজের সমস্ত অশুভ নেতিবাচক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছি। ঘটনার আকস্মিকতায় সে হয়তো খানিকটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। সামলে নিচ্ছে এখন। কত দীর্ঘদিন আমরা এক অপরকে জানি।  

ওকে চিনতে এমন ভুল কিছুতেই হতে পারে না। আমি উৎসুক হয়ে জানতে চাই,
- কী জরুরী কথা?
- মানে... বলছিলাম, তোমার কি শরীর খারাপ?
আমার গলা বুজে আসে। ওর গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে বলতে ইচ্ছে করে—হ্যাঁ গো সোনা, আমার শরীর খারাপ, খুব খারাপ। মনও খারাপ। তুমি আমাকে আগের মতো আদর করে কথা বলো, আমি ঠিক হয়ে যাব।
বলা হয় না। আমি রুদ্ধস্বর চুপ করে থাকি।
- কিছু বলছো না কেন। তোমার পিরিয়ড চলছে এখন?
এবার আমি প্রশ্নটার প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারি। আমার ক্ষোভ হয়—‘পিরিয়ড? না, আমার এখন পিরিয়ড চলছে না।’
- তুমি সিওর?
- হ্যাঁ, সিওর। কেন?  
- এদিকে তাকাও। এটা কী!

আমার সবুজ শাড়ির অর্ধেকটা বিছানায়, অর্ধেকটা বিছানার পাশে রাখা ড্রেসিং টেবিলের সীটার-এ। বিছানায় থাকা অংশটুকুতে বেশ অনেকটা রক্ত। তাজা লাল রক্ত সবুজ কাপড়ে পড়ে সামান্য কালচে দেখাচ্ছে। আমার ভেতরে শিরশির করে ওঠে। অস্বাভাবিক লজ্জায় আমার সর্বাঙ্গ ঝিমঝিম করছে। কুমারীর প্রথম সঙ্গম সম্পর্কে আমার পড়াশোনা ছিল। আমার নিজের জীবনে সেই অপূর্ব ঘটনাটি ঘটেছে। শাড়িটা বিছানায় থাকায় তাতে লেগেছে রক্তের ছোপ।
- বলো, কী এটা।
- আপনি বুঝতে পারছেন না?
কথাটা বলতে গিয়ে আবেগে আমার গলা কেঁপে ওঠে।
- নতুন করে বুঝবার আর কী আছে। বলো তো শেষবার তোমার পিরিয়ড হয়েছে কবে?
আমি একটু হিসাব করে জবাব দেই—প্রায় সতের আঠারো দিন আগে।
- মিথ্যা বলো না মালা। আমার কাছে সতী সাজবার কোনো দরকার নেই। এসব কৌশল বিয়ের রাতে স্বামীর সঙ্গে কোরো।
- কীহ্?

আমার এই আহত জিজ্ঞাসা যেন সুমিতকে আরো হিংস্র করে তোলে। হিসহিসিয়ে বলে,
- আজকে তোমার পিরিয়ডের কত দিন? আর এ অবস্থায় আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে কেন?

আমি হতভম্ব হয়ে সুমিতের দিকে তাকিয়ে থাকি। তার চোখে তীব্র ঘৃণা। আমার সমস্ত স্বপ্নপ্রাসাদ ভেঙে খান খান হয়ে যায়। সুমিতের প্রতিটা কথা ধারাল চাবুক হয়ে আমার সর্বাঙ্গে আঘাত করতে থাকে। আমার মনকে ক্ষত বিক্ষত করতে থাকে। আমি সহ্য করতে পারি না। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে—তুমি এখান থেকে যাও সুমিত। তুমি আমার জীবন থেকে একেবারে দূর হয়ে যাও। তুমি একটা মেরুদণ্ডহীন কীট। দায়িত্ব নেবার ভয়ে তুমি আমাকে এমন নোংরাভাবে আক্রমণ করছো।

বলতে চাই, কিন্তু আমার জিভ সরে না। আমার কণ্ঠ স্বরহীন। আমি অকল্পনীয় বিস্ময়ে হতবাক। সুমিত বাথরুমে গেলে আমি উঠে দ্রুত আমার বাসি, ক্লেদাক্ত বেশবাস আবার শরীরে উঠাই। অরণ্যে পশুদের আক্রমণে বিধ্বস্ত বনমানুষের মতো বাকল জড়াই গায়ে। সবুজ বাকল। শাড়ির প্যাঁচটা এমনভাবে জড়াই যেন রক্তের দাগগুলো সহজে দেখা না যায়। হায়, আরব সভ্যতার ইতিহাসে প্রসিদ্ধ কুমারী নারীর পবিত্র রক্ত। পাপস্পর্শহীনতার প্রতীক। কান পাতি, বাথরুমে কলকল করে পানি পড়ার শব্দ। আমার জীবনের প্রথম পুরুষ আমাকে বলাৎকার শেষে গোসল করছে। আমি তার জীবনের কততম নারী? এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসার আর কোনো প্রয়োজন নেই। আমি বাড়ির চাবিটা ড্রেসিং টেবিলে রেখে অভুক্ত স্নানহীন ধর্ষিতা এক স্বপ্নভুক নারী বেরিয়ে এসেছিলাম সেদিনের পড়ন্ত দুপুরে। পুড়ন্ত দুপুরে। সেই দুপুরের আগুন সমগ্র জীবন ধরে অপমান সাথী করে জ্বলছেই। সেদিনের পর সুমিত নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিয়েছিল। আমিও।

আমার জন্মভূমিতে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। আমি তখন শিশু। কিন্তু সেদিনের লক্ষ নারীর সম্ভ্রম হারানোর ইতিহাসে পরবর্তীকালে যোগ দেওয়া আমিও যে একজন সৈনিক, আমার গোপন রক্তও যে বাংলাদেশের সবুজ জমিনে মিশে লাল সূর্যটা তৈরি করেছে, কথাটা আমি আজকের আগে একবারও ভাবিনি। আমার বন্ধু শামীম, আমার গভীর গোপন গ্লানির সাক্ষী শামীম আজ কথাটা আমাকে মনে পড়িয়ে দিয়েছে।

   

১২৫তম জন্মবর্ষ

মুক্তির অন্বেষী নজরুল



ড. মাহফুজ পারভেজ
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

নজরুল জীবনের ‘আর্তি ও বেদনা’র সম্যক পরিচয় পেতে হলে সেকালের মুসলিম সমাজের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের কিছু আলোচনা আবশ্যক হয়ে পড়ে। নজরুলের আবির্ভাবকালে মুসলমানদের সামাজিক আবহাওয়া এমনই জীর্ণ ও গণ্ডিবদ্ধ ছিল যে, কোনো শিল্পীরই সেই আবহাওয়াতে আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রসার সম্ভব ছিল না। জীবনের প্রথমদিকে তাই কামাল পাশা প্রমুখ ইতিহাসখ্যাত বীর মুসলিমেরা নজরুল-মানসকে আচ্ছন্ন করেছিল।

কিন্তু অচিরেই তিনি বাঙালির জাগরণের পথিকৃতে রূপান্তরিত হন। বাংলার জাগরণ গ্রন্থে ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’-এর অগ্রণীজন কাজী আবদুল ওদুদ জানাচ্ছেন, ‘নজরুলের অভ্যুদয়ের পরে ঢাকায় একটি সাহিত্যিক গোষ্ঠীর অভ্যুদয় হয়; তাঁদের মন্ত্র ছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’ এবং যারা ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করে বুদ্ধির মুক্তি ঘটাতে চেয়েছিলেন এবং বাঙালি মুসলমানের চেতনার জগতে নাড়া দিলে সচেষ্ট হয়েছিলেন।’

চরম দারিদ্র্যের মাঝে থেকেও জীবনের জয়গান গেয়েছেন কবি নজরুল, ছবি- সংগৃহীত

উল্লেখ্য, ১৯ জানুয়ারি ১৯২৬ সালে ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় অধ্যাপক ও ছাত্রের মিলিত প্রয়াসে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে একটি সংগঠনের জন্ম হয়। সংগঠনটির সঙ্গে ‘সাহিত্য’ শব্দটি যুক্ত থাকলেও এটি গতানুগতিক ও মামুলি কোনো সাহিত্য সংগঠন ছিল না। ‘সাহিত্য’ শব্দটিকে বৃহত্তর পরিসর ও অর্থে গ্রহণ করেছিলেন উদ্যোক্তারা। ফলে, তাঁদের কাছে সাহিত্যচর্চা ছিল জীবনচর্চার নামান্তর। এই সংগঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা। নিজেদের কর্মকাণ্ডকে তাঁরা অভিহিত করেছিলেন ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ নামে।

‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-প্রতিষ্ঠার পরের বছরেই (১৯২৭) সংগঠনের বার্ষিক মুখপত্র হিসেবে সাময়িকী ‘শিখা’ প্রকাশ করে, যে কারণে এদের ‘শিখা গোষ্ঠী‘ নামেও অভিহিত করা হয়।

শিখা প্রকাশিত হয়েছিল পাঁচ বছর (১৯২৭-১৯৩১)। বাঙালি মুসলমানের বিভিন্ন সমস্যা তথা শিক্ষা, সাহিত্য, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, দর্শন, চিন্তা ইত্যাদি নিয়ে জ্ঞানদীপ্ত আলোচনা করেছেন এই সমাজের লেখকগণ। ‘বুদ্ধির মুক্তি ও কবি নজরুলকে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

বুদ্ধির মুক্তি, মানব মুক্তি, সমাজের মুক্তি তথা মানুষের শির উচ্চতর করার বাণী উৎকীর্ণ করেছিলেন নজরুল। গেয়েছিলেন মানবতার জয়গান। অসাম্প্রদায়িকতা ও সাম্যের গানে মুখরিত ছিল তাঁর জীবন ও কর্ম। মানুষের চেয়ে বড় কিছু ছিল না তাঁর কাছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে চির বিদ্রোহী ছিলেন তিনি। জগতের বঞ্চিত, ভাগ্য বিড়ম্বিত, স্বাধীনতাহীন বন্দিদের জাগ্রত করার মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন নজরুল। মানবতার জয়গান গেয়ে লিখেছিলেন-'গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্ …’।

মানুষ আর মানুষের হৃদয়কে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন- ‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই’। আবার তাঁর কলম থেকেই বেরিয়ে এসেছিল বজ্রনির্ঘোষ আহ্বান- ‘জাগো অনশন-বন্দি, ওঠ রে যত জগতের বঞ্চিত ভাগ্যহত’।

শুধু যে কবিতাই লিখেছেন তা তো নয়। তিনি এমন অনেক প্রবন্ধও রচনা করেছেন। নজরুলের দেশপ্রীতি, দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আজও অনুপ্রাণিত করে। তিনি ছিলেন জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে।

সাম্য ও মানুষের কবি ছিলেন কবি নজরুল ইসলাম, ছবি- সংগৃহীত

‘সাম্য, সম্প্রীতির কবি নজরুল তাঁর হৃদয়মাধুর্য দিয়ে সব শ্রেণিবৈম্য দূর করতে চেয়েছিলেন। তাঁর কাছে জাত–ধর্ম ছিল হৃদয়ের প্রেমধর্ম; যে প্রেম মানুষের কল্যাণে উৎসারিত হয়ে ওঠে। শুধু লেখনীর দ্বারা নয়, নিজের জীবনের সবরকম ঝুঁকি নিয়ে ঐক্যের আশায় আশাবাদী ছিলেন নজরুল।

তাঁর ব্যক্তিজীবনে এই ভাবনার প্রয়োগ করেছিলেন তাঁর বিবাহের ক্ষেত্রে, পুত্রদের ক্ষেত্রেও। তাঁর পরিবারের সব সদস্য এবং আপামর বাঙালি এই সত্য নিত্য উপলব্ধি করেন।

১২৫তম জন্মবর্ষে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চৈতন্য মুক্তির অন্বেষী। তাঁর গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক তথা সুবিশাল সাহিত্যকর্ম বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু প্রাসঙ্গিকই নয়, নানা কারণে তাৎপর্যবাহী।

কেননা, বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রখর প্রতাপে ত্রস্ত এবং যুদ্ধ ও আগ্রাসনে জর্জরিত পৃথিবীতে থেমে নেই অন্যায়, অবিচার, হামলা, নির্যাতন।

ইউক্রেন, ফিলিস্তিন থেকে মিয়ানমার হয়ে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত পৃথিবীময় শোষণ, নির্যাতন, হত্যা, রক্তপাতে ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত করোনা-বিপর্যস্ত পৃথিবী আর মানুষ এখন অবর্ণনীয় দুর্দশা ও দুর্বিপাকে বিপন্ন।

এমতাবস্থায় অনাচারের বিরুদ্ধে চিরবিদ্রোহী নজরুলের মানব অধিকারের রণহুঙ্কার বড়ই প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। কারণ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মহীরুহ-তুল্য কাজী নজরুল ইসলাম প্রেম, বিদ্রোহ, মুক্তি ও মানবতার মহান সাধক।

১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ অবিভক্ত বৃটিশ-বাংলার সর্বপশ্চিম প্রান্তের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ায় জন্ম নেন কাজী নজরুল ইসলাম আর ১৩৮৩ বঙ্গাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

বাংলাদেশের এবং বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষীদের শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়, যেমনটি তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই।'

উল্লেখ্য, কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুর পর তাঁর কবরস্থানের স্থান নির্ধারণ নিয়ে নানাজন নানামত দিতে থাকেন। এ অবস্থায় স্থাননির্ধারণী সভায় রফিকুল ইসলাম প্রস্তাব করেন নজরুল তাঁর এক গনে লিখেছেন-

‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/ যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই’॥

সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁর কবর হোক। তাঁর এ প্রস্তাব সভায় গৃহীত হলো। পরবর্তীকালে এ কবর পাকা ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করার ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবি নজরুলকে ভারত থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন, ছবি- সংগৃহীত

‘বিদ্রোহী কবি’ কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবনযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে। তাঁর বিখ্যাত কবিতাগুলির একটি 'বিদ্রোহী', যা স্পর্শ করেছে রচনার শতবর্ষের ঐতিহাসিক মাইলফলক।

কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়, ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি ‘বিজলী’ পত্রিকায়। এরপর কবিতাটি মাসিক ‘প্রবাসী (মাঘ ১৩২৮), মাসিক ‘সাধনা (বৈশাখ ১৩২৯) ও ‘ধূমকেতু’তে (২২ আগস্ট, ১৯২২) ছাপা হয়।

বলা বাহুল্য, অসম্ভব পাঠকপ্রিয়তার কারণেই কবিতাটিকে বিভিন্ন পত্রিকা বিভিন্ন সময়ে উপস্থাপিত করেছিল। ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশিত হওয়া মাত্রই ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালি মানসে কবিতাটি ও রচয়িতা কবি নজরুল ‘চির উন্নত শির’ রূপে বিরাজমান।

পুরো বাংলা ভাষা বলয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এমন শাণিত প্রতিবাদ তুলনাহীন। বিদ্রোহীর শতবর্ষকে ‘জাগরণের শতবর্ষ’ রূপে উদযাপন করা হয়, বাংলা ভাষাভাষী পরিমণ্ডলে আর ১২৫তম জন্মবর্ষে মুক্তির অন্বেষী নজরুলকে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় স্মরণ করে সমগ্র বাঙালি জাতি!

 ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম

;

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;