পাখি ও চৈতির গল্প



এম এল গনি
পাখি ও চৈতির গল্প

পাখি ও চৈতির গল্প

  • Font increase
  • Font Decrease

খুব বড়ো পদে চাকরি করেন যদু মিয়া। সরকারি কাজে দেশ হতে টরন্টো এসে উঠেছেন বন্ধু মামুনের বাসায়। দুজনই রাজু সাহেবের এককালের কাছের মানুষ।

যদুর অনুরোধে মামুন রাজু সাহেবকে ফোন দিলেন। রাজু থাকেন কানাডার এডমন্টন শহরে। টরন্টো হতে যোজন যোজন দূর। এতটাই দূরে যে এডমন্টনে যখন সকাল ছটা, টরোন্টোতে তখন আটটা বেজে যায়; মানে, দুঘণ্টার সময়ের পার্থক্য।

মামুন রাজু সাহেবের সাথে সৌজন্যমূলক কুশল বিনিময় করে দ্রুত তাঁর বন্ধু যদুকে ফোন দিলেন।

বেশ কিছুক্ষন কথা হলো যদু মিয়া আর রাজু সাহেবের। দেশে থাকতে তাঁরা এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন, একই হলে থাকতেন। স্বভাবতঃই, অনেক পুরোনো স্মৃতি দুজনেরই বুকে জমে ছিল। তাঁরা রাজু সাহেবকে রাজু ভাই বলে ডাকেন।

কথা শেষ করে যদু ফোন রেখে দিলেন। তবে, তার ফোন রাখাটা যথাযথ হয়নি। মানে, রাজু তখনও অন্য প্রান্তের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছিলেন।

যদু মিয়া মামুনকে প্রশ্ন করলেন: 'রাজু ভাইয়ের ইমিগ্রেশন ব্যবসা কেমন চলছেরে?' [রাজু সাহেব কানাডায় ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট, বা অভিবাসন পরামর্শক।]

- মনে হয় ভালো, তবে লোকটা কিন্তু ঘাউরা প্রকৃতির, কিছুটা লোভীও।

- বলিস কি, লোভী হলে দেশের সরকারি চাকুরিতেই তো থেকে যেতে পারতেন; উনি কি অতো টাকাপয়সা কানাডায় কামাতে পারবেন?

- না, তা বুঝাইনি। বলতে চাচ্ছি, টাকা ছাড়া কারো সাথে কথা বলে না।

- ওহ, প্রফেশনাল ফি এর কথা বলছিস? তা তো উনি নেবেনই।

কথা যখন এ পর্যায়ে ঠিক তখনই ফোনটা জায়গামতো রাখা হয়েছে কিনা যদু মিয়াকে পরখ করে দেখতে বললেন মামুন। যদু মিয়া এবার ফোনটা ঠিকঠাক রাখলেন। ফলে, অপর প্রান্তের কথাবার্তা রাজু আর শুনতে পাননা।

এই যে টাকা পয়সা ছাড়া কথা না বলা লোভী মানুষ রাজু, তিনিও কিন্তু মাঝেমাঝে ফ্রি সার্ভিস বা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অনেকক্ষেত্রে তা না দিয়েও উপায় থাকে না; বিশেষতঃ যখন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের অনুরোধ এড়িয়ে চলার সুযোগ থাকে না। তেমনই একদিনের ঘটনা শুনুন।

রাজু সাহেবকে তাঁর ভাবি সম্পর্কের এক নিকটাত্মীয়া দেশ থেকে ফোন দিলেন দেশ হতে।

- কেমন আছেন ভাই? আমি আপনার পাখি ভাবি।

- সালাম, কেমন আছেন? আপনি কি জমির ভাইয়ের ...

- হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, উনার মিসেস।

প্রায় দুই যুগ আগের কথা। পাখি নামের এই মেয়েটির সাথে জমিরের তুখোড় প্রেম ছিল। কিন্তু, তখন জমির ছিল বেকার যুবক। তার বাবা ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, আর, জমির উচ্চমাধ্যমিকে ফেল করে মহল্লার চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিত। এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী একজনের সাথে পাখির পরিবার তাঁর বিয়ে পাকাপাকি করে ফেলে। খবর শুনে জমির নিয়েছিল গলায় ফাঁস। ভগবান সদয় ছিলেন। স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে জমিরকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে সে যাত্রায়। পরে অনেক নাটকীয়তার পর জমিরের সাথেই পাখির বিয়ে হয়। সেই পাখি ভাবীর ফোন পেয়ে রাজু সাহেবের মনে পুরোনো স্মৃতিমালা জেগে উঠে ফকফকা সূর্যালোকের মতো।

সম্বিৎ ফিরে পেয়ে রাজু আবারো কথা শুরু করলেন।

- কি মনে করে আজ এতো বছর পর আমাকে ফোন দিলেন ভাবি; কেমন আছেন আপনি?

- ভালো আছি ভাই। আপনি তো ব্যস্ত মানুষ, তাই ফোন দিতে ভয় করে। তাছাড়া, শুনেছি আপনি ফি ছাড়া কথাও বলেন না।

হি হি হি .. খলখলিয়ে হাসেন পাখি। বুকে কাঁপন, আর, গালে পড়ে টোল।

- কি যে বলেন ভাবি! [সরবে হেসে] এই যে আপনার সাথে ফি ছাড়াই কথা বলছি এখন।

- আসলে একটা জরুরি আলাপ করতে আপনাকে ফোন দিয়েছি। আমার বান্ধবী চৈতির বিষয়ে।

- চৈতিটা কে যেন?

- আপনি চিনবেন না, চৈতি আমার স্কুল ফ্রেন্ড। তার হাসব্যান্ড এখন কানাডায়। তবে, ইমিগ্রেশন জটিলতা আছে কিছুটা। আপনার হেল্প দরকার।

- তাই? আচ্ছা, চৈতিকে বলুন ইমেইল বা ফোনে আমার সাথে যোগাযোগ করতে। তবে, আপনার রেফারেন্স যেন দেয়। অপরিচিতের ফোন অনেক সময় ধরা হয়না।

- ও আপনাকে ইমেইল দিয়েছিল। আপনি দেড়শো ডলার ফি চেয়ে কথা বলার শিডিউল নিতে বলেছিলেন। আর্থিক সমস্যা চলছে ওর। স্বামী ঠিকমতো টাকা পাঠায় না। ওকি মিনিট দশেক ফ্রি কথা বলতে পারবে? দুই বাচ্চা নিয়ে খুব টেনশনে আছে চৈতি, খুব টেনশন!

- ঠিক আছে, তাঁকে বলুন সম্ভব হলে এখনই ফোন দিতে। আমি কিছুক্ষন ফ্রি আছি। - -

চৈতি থাকেন ঢাকায়। দীর্ঘদিন ধরে স্বামী বিদেশে। দীর্ঘদিন মানে প্রায় সাত-আট বছর। বাংলাদেশ থেকে তিনি কিভাবে যেন ইউরোপের একটা দেশে গিয়েছিলেন। সেখানে পড়েছিলেন ইমিগ্রেশন বিষয়ক জটিলতায়। সে অনেক লম্বা কাহিনী। চৈতি সব কথাই অকপটে রাজু সাহেবের সাথে শেয়ার করলেন। ডাক্তারের কাছে সব কথা খুলে না বললে যেমন ডাক্তার সঠিক ওষুধ নির্বাচন করতে পারেন না, ইমিগ্রেশনের বিষয়গুলোও তেমনই। চৈতি শিক্ষিত মেয়ে, এমএ পাশ; অফিশিয়াল বিষয়গুলো ভালোই বুঝেন। তাই, কোন কথা লুকাননি।

আদ্যোপান্ত শুনে রাজু সাহেব চৈতিকে বললেন তাঁর স্বামী যেন তাঁকে (রাজু) সুযোগমতো ফোন দেন। তাঁর সমস্যা নিয়ে আরো বিস্তারিত জানা দরকার।

পরদিন চৈতির স্বামী জাকির হোসেনের সাথেও রাজুর কথা হলো। আলাপকালে রাজু সাহেব যা উপযুক্ত মনে করেছেন সেভাবে পরামর্শ দিয়েছেন। কোনপক্ষের কাছ থেকেই এ খাতে কোন পরামর্শ-ফি নেননি তিনি। এছাড়া, ফি নেবেনই বা কেন? দীর্ঘকাল পর একজন নিকটাত্মীয়া যেখানে তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর জন্য সহায়তা চেয়ে একটু কথা বলতে চেয়েছেন, সেখানে কি আর ফি দাবি করা যায়? জীবনে টাকাপয়সাই তো সব নয়, আত্মীয়তা বা সামাজিকতা বলে একটা বিষয়ও আছে তো! রাজু সাহেব সম্পর্কে মামুন তাঁর বন্ধুকে যা বলেছেন তা নিছক বাড়াবাড়ি। মামুনরা এমনই। মুখোমুখি হলে তেলের ডিব্বা নিয়ে বসে যাবে, আর আড়ালে করে সমালোচনা। টিপিক্যাল বাঙালি আর কি!

পাখি কিন্তু গত প্রায় দুই দশকের আত্মীয়তায় কোনদিন রাজু সাহেবকে এভাবে ফোন করেননি। কানাডা অভিবাসনে ফ্রি সার্ভিস পেতে কারো জন্য তদবিরও করেননি। নিঃস্বার্থ পরোপকার, অর্থাৎ, বান্ধবীর প্রয়োজনেই তাঁর এ ফোন করা।

রাজু মনে মনে ভাবলেন, বাঙালিরা তো সচরাচর বিনা স্বার্থে কারো উপকার করে না। পাখি ভাবি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমই বলা চলে। তাঁর হৃদয়টা নরম, তুলতুলে; একইসাথে বন্ধুবৎসলও, যা যোগাযোগের অভাবে এতদিন রাজু সাহেবের জানা ছিল না। পাখি আক্ষরিক অর্থেই একজন পরোপকারী মানবিক মানুষ, বন্ধুতার এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। ভক্তি-শ্রদ্ধায় তাঁর পাখি ভাবীকে আজ নতুন করে আবিষ্কার করলেন রাজু। আসলে বিপদে না পড়লে মানুষ চেনা যায় না। তা হতে পারে নিজের বিপদ বা অন্যের। বাঙালি সমাজে পাখির মতো কিছু নিবেদিতপ্রাণ পরোপকারী মানুষ থাকলে দেশটা কেবল বক্তৃতা বিবৃতিতে নয়, সত্যি সত্যিই সোনার বাংলা হয়ে যেতো।

এ অবসরে অতীতের অনেক তুচ্ছ-অতুচ্ছ ঘটনাও রাজু সাহেবের মনে উঁকি দিয়ে যায়। পাখি ভাবি একসময় এতো ভালোমানুষ ছিলেন না; ছিলেন খুব বদমেজাজি। গায়ে-গতরে স্বামী জমিরের চেয়ে সুঠাম তিনি। রেগে গেলে বেসামাল হয়ে মাঝে মাঝে কৃশকায় জমিরের গায়ে হাত তুলতেন। জমিরের দাঁতের উপরের পাটিতে যে সোনার দাঁতটি চকচক করে ওটা নাকি পাখির কারণেই লাগাতে হয়েছিল। কাজের মেয়ের সাথে অহেতুক সন্দেহ করে পাখি একবার জমিরকে নাকে মুখে কিল ঘুষি মেরেছিলেন। তখনই নাকি জমিরের মূল দাঁতটি ভেঙে যায়। কিশোরী কাজের মেয়ের বেডরুমের দরোজার ফাঁক দিয়ে ঘুমন্ত মেয়েটিকে দেখছিলেন জমির। এমন সময় পেছন থেকে এসে ঝাপটে ধরেন পাখি। জমিরের যুক্তি ছিল তিনি ওই রুম থেকে গোঙানির শব্দ শুনেছিলেন। কিন্তু, পাখি কি আর ওসব যুক্তি আমলে নেন? ... সে অনেক কথা, অনেক স্মৃতি। সেই পাখি ভাবির এমন মানবিক পরিবর্তনে রাজু ভেতরে ভেতরে বেশ অবাক হন, আর ভাবেন, 'মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়', এ অমূল্য কথাগুলো কি মুনীর চৌধুরী সাধে বলেছিলেন? - -

তিনদিনের মাথায় সেই পাখি ভাবি রাজু সাহেবকে আবারো ফোন দিলেন।

- কেমন আছেন ভাই?

- জি, ভালো। আপনি?

- আপনাকে আরেকটু বিরক্ত করছি। চৈতিরা কি আপনার সাথে কথা বলেছিল?

- জি, বলেছে।

- ওদের সমস্যাটা কি জটিল কিছু?

- হ্যাঁ, জটিলই বলা চলে। আপনি জানেন তো, ইমিগ্রেশন সম্পর্কিত বিষয়; একবার প্যাঁচ লেগে গেলে তা ছাড়ানো কঠিন।

- কি হয়েছে একটু খুলে বলবেন?

- ওসব ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, একান্ত গোপনীয়। আমি তা আপনাকে বলতে পারবো না। আপনি বরং চৈতিকেই জিজ্ঞেস করতে পারেন। উনি আপনার বান্ধবী; চাইলে আপনার সাথে শেয়ার করবেন।

- ওকে জিজ্ঞেস করতে যাবো কেন, আপনি তো সবই জানেন? আপনিই তো খুলে বলতে পারেন আমাকে।

- আমি লিগেলি অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে আপনার সাথে কথা বলতে পারি না ভাবি; প্রফেশনাল কিছু বিধিনিষেধ আমাদের মানতে হয়। জানেন তো, আমি কানাডার একজন রেজিস্টার্ড ইমিগ্রেশন প্রফেশনাল, আরসিআইসি। ক্লাইয়েন্টের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করলে সাজা পেতে হতে পারে। কানাডা যে নিয়মে চলা দেশ!

- পারবেন না কেন? এখানে আমি-আপনি ছাড়া আছে কে? বাইরের কেউ তো কিছু শুনছে না। এছাড়া, ওরা আপনার ক্লাইয়েন্ট হলো কিভাবে, আপনি তো কোন ফি নেননি?

- পরামর্শ যেহেতু দিয়েছি, তাই, ফি না নিলেও ক্লাইয়েন্ট। এটাই নিয়ম।

- ভাবীর সাথে এতো নিয়ম ফলাতে নেই, ঝটপট বলে ফেলুন ঘটনা আসলে কি?

- না না ভাবি, আমি সেটা পারবো না। নীতিগতভাবেও আমি এ কাজ করতে পারি না।

- বাহ্ বাহ্, আপনি তো দেখি আসলেই ঘাউরা মানুষ। এতবছর পরও এতটুকু বদলাননি। দেশে থাকতে আমার খালাতো বোনের বাড়ির নক্সা অনুমোদনে একটু হেল্পের জন্য আপনার অফিসে গিয়েছিলাম, আপনি না করেছিলেন, মনে আছে? [কানাডায় পাড়ি জমানোর আগে রাজু বাংলাদেশে সরকারি চাকরি করতেন।]

- ঘাউরা বলেন আর যাই বলেন, আমি চৈতি বা তাঁর স্বামীর বিষয়ে কোন তথ্য আপনাকে দিতে পারবো না ভাবি; মাফ করবেন।

- আচ্ছা, কিছু না বলুন তাতে সমস্যা নেই, কেবল একটি প্রশ্নের হ্যাঁ-না জবাব দেবেন; এ ছোট্ট আবদারটুকু রাখবেন তো?

- চেষ্টা করবো, বলেন।

- আমি শুনেছি চৈতির হাসব্যান্ড এখনো কানাডায় ঢুকতেই পারেনি, যদিও চৈতি বলেছে উনি কানাডায়। ও মনে হয় মিথ্যা বলছে। আপনি শুধু বলবেন, উনি কি কানাডায় ঢুকেছেন নাকি এখনো ঢুকতে পারেননি? হ্যাঁ বা না বললেই চলবে।

- ভাবি, কিছু মনে করবেন না। আপনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উনার ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাসই জানতে চাইছেন। আমি এ বিষয়ে মন্তব্য করবো না।

- তাহলে ওদের সাথে আপনাকে কথা বলিয়ে দিয়ে আমার লাভটা কি হলো?

- লাভ-লোকসান হিসেব করে ওদের সাথে কথা বলিয়ে দিয়েছেন তা আঁচ করতে পারলে আমি আপনার অনুরোধ রাখতামই না। আমাকে ক্ষমা করবেন, আজ এখানেই কথা শেষ করতে চাই। - -

পাখি রেগেমেগে আগুন। খট করে ফোন রেখে দিলেন। সৌজন্যমূলক সালামও জানালেন না। কেবল তাই নয়, দীর্ঘদিনের আত্মীয় এবং ফেইসবুক বন্ধু রাজুকে ব্লকও মারলেন।

দুদিন পর দেখা গেলো পাখির স্বামী, মানে, জমিরও রাজু সাহেবকে ফেইসবুকে ব্লক করেছেন। একান্ত অনুগত ভৃত্যের মতো কোন বিষয়ের বিস্তারিত না জেনেই পাখির নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন এই মেরুদন্ডহীন জমির। স্ত্রৈণ আর কাকে বলে!

রাজু সাহেব প্রথমটায় ধারণা করেছিলেন কালের আবর্তে, প্রজ্ঞা, বয়স ও অভিজ্ঞতার কারণে পাখি ভাবি নিঃস্বার্থ, পরোপকারী, এক সুপ্রভ বাঙালি রমণীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। কিন্তু, চৈতির এ ঘটনায় তিনি পরিষ্কার বুঝলেন, এই পরোপকার আসলে সেই পরোপকার নয়, এতে ছিল বান্ধবীর স্বামীর গোপন তথ্য হাতিয়ে নিয়ে পরবর্তীতে সেই বান্ধবীকেই হেনস্তা করা কু-মানস। ভাগ্যিস, রাজু সাহেব পাখির সে ফাঁদে পা দেননি।

লেখক: এম এল গনি
পেশা: কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট (RCIC-IRB)
ইমেইল: [email protected]

   

ফেরদৌস আরার প্রবন্ধের আলপথ বেয়ে পাঠক চলে যান জ্ঞানের সমুদ্রদর্শনে



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘লেখকের প্রচুর অধ্যয়ন, পাঠগভীরতা, নিবিড় অনুসন্ধিৎসা, ঘোরলাগা শব্দপুঞ্জে, ভাষার শিল্পিত সুষমায় লেখাগুলি প্রাণ পেয়েছে। তাই গ্রন্থের তথ্যসমৃদ্ধ বারোটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য শুধু নয়, নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, জানার তাগাদা তৈরি করবে—বোধে, তৃষ্ণায়, জীবনজিজ্ঞাসায়। নিজের কথাই বলি, ফেরদৌস আরা আলীমের চোখ দিয়ে পড়তে পড়তে আমি নিজে প্রায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আফরোজা বুলবুল কিংবা প্রতিভা মোদক (‘যে জীবন শিল্পের, যে শিল্প জীবনের’), করুণা বন্দোপাধ্যায়, রবিশংকর বলকে (‘চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর’) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে আস্বাদ করি সময়-পরিক্রমায় লেখক ফেরদৌস আরা আলীমের কলমের ক্ষুরধার ক্রমমুগ্ধকর সৌন্দর্য।’

শনিবার (৪ মে নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক গলিতে অবস্থিত মাসিক নারীকণ্ঠ পত্রিকা-আয়োজিত ‘বই আলোচনা’-অনুষ্ঠানে ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আলপথে শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের মূল আলোচকের আলোচনায় তহুরীন সবুর ডালিয়া এসব কথা বলেন। বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনায় আরও অংশ নেন নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা জিনাত আজম, সালমা রহমান ও মাধুরী ব্যানার্জী।

নারীকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আহমেদ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শাহরিয়ার ফারজানা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতারী ইসলাম বলেন, ‘নানা বিষয়ে ফেরদৌস আরা আলীমের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সহজভাবে তিনি আমাদের সমাজবাস্তবতার যে-চিত্র আঁকেন তা মনের গভীরে সাড়া জাগায়। তার লেখা পড়ে এটুকু বলতে পারি যে, তার লেখা আমাদের জন্য গবেষণা ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান আকর।’

প্রবন্ধের আলপথে বইয়ের প্রকাশক, কবি ও খড়িমাটি-সম্পাদক মনিরুল মনির বলেন, ‘নারীমুক্তি বিষয়ে এ-বইয়ে দুটি তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে আরও কাজ করার জন্য গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রকাশিত বই নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘বড় কিছু হওয়ার কথা ভেবে লিখিনি, মনের আনন্দেই গোপনে গল্প-কবিতা লিখেছি। এমন একসময়ে আমরা লিখতাম, লেখা প্রকাশ করতে খুব লজ্জাবোধ করতাম। অবশ্য লিখতে গিয়ে তেমন কঠিন বাধা আমাকে ডিঙোতে হয়নি। একালের চেয়ে আমাদের সময়টা ছিল অনেক সুন্দর ও ভালো। মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল সমাজে। গণ্ডগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে চড়ে ঢাকা গিয়েছি একা-একা, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। মা-বাবারাও নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকাল মেয়েরা পদে-পদে বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের কলুষিত সমাজব্যবস্থা ও নষ্ট রাজনীতি।’ সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রশংসার ভূমিকা কম নয়। একজন লেখক তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য পেলে অনুপ্রাণিত হন যা তাকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি জোগায়।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা ও সদস্য রোকসানা বন্যা, মহুয়া চৌধুরী, রেহানা আকতার, সাহানা আখতার বীথি, কানিজ ফাতেমা লিমা, বিচিত্রা সেন, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, চম্পা চক্রবর্ত্তী, প্রচার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জয়, কবি মেরুন হরিয়াল ও কবি মুয়িন পারভেজ প্রমুখ।

;

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

;

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;