বিন্নাবেড়া গ্রামের পথে



মঈনুস সুলতান
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

থিকথিকে আবর্জনায় জুতাখানা ঘিনঘিনে ময়লায় ভরে উঠল। কিন্তু এসব দিকে নজর দেওয়ার সময় কই। দেওয়ান তরজার বেড়া মড়মড় করে ভেঙে হীরা মিয়ার ভুষিমালের দোকানের পেছনে বেগুনের খেতে এসে পড়ে। পাতার আর্দ্রতা গুটানো পায়জামার পায়ায় দাগ কেটে দেয়। এলাকায় বড় দেওয়ান বলে পরিচিত আসিফ হাসান বসে ছিলেন কামাল ফার্মেসির পেছনের কামরায়। খানিকটা রাশভারী লোক, হাটেবাজারে তিনি তেমন একটা আসেন না। তবে আজ আসতে হয়েছে, কারণ তাঁর ফিলিপস্ ট্রানজিসটারের ব্যাটারি ফুরিয়েছে। খান সেনারা গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে। রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে নানা জায়গায়। বাজারে মাল সামানের চালান আসছে না। তাই পয়সা দিয়েও কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না রেডিওর ব্যাটারি।

তো বড় দেওয়ান বাজারে এসে কামাল ফার্মেসির পেছনে বসে ভলিওম কমিয়ে কমপাউন্ডারের সাথে ফিসফিস করে কথা বলতে বলতে স্বাধীনবাংলা বেতারের সংবাদ শুনছিলেন। কপাটের বাইরে পায়ের শব্দ হতেই কমপাউন্ডার দ্রুত নভ ঘুরিয়ে নিয়ে আসেন রেডিও পাকিস্তানের অনুষ্ঠানে। ওখানে গীত হচ্ছে আহমেদ রুশদীর উর্দু গান ‘একেলে না জানা/হামে ছোড় কর তুমহারে বিনা।’ এলাকার তরুণ কমরুদ্দীন কামরায় ঢুকে ফিসফিস করে দেওয়ানকে খবরটি দেয়। একটু আগে চারজন খান সেনা তার চাচা শান্তি কমিটির প্রধান বদরুদ্দীন হাজিকে নিয়ে দেওয়ানবাড়িতে যায়। তারা হয়তো গ্রামে রেইড সেরে এবার বাজারের দিকে আসবে। তাই সময় থাকতে দেওয়ানের সরে পড়া উচিত।

নুরমনার বেগুন খেতের বেড়া ডিঙ্গিয়ে বড় দেওয়ান এবার বাজারের মসজিদের পেছনে ওজু করার পুকুরের কাছে এসে পড়েন। কমরুদ্দীন সম্পর্কে তার ছাত্র। বছর কয়েক আগে তিনি জেলা সদরের কলেজ থেকে বি এ পাশ করে ফিরে আসেন নিজস্ব সাকিন ঝিগরকান্দি গ্রামে। অবশ্য বি-এ’র রেজাল্ট আউট হওয়ার পর ঢাকা শহরেও দু’বার গিয়েছিলেন ভার্সিটিতে মাস্টার্স করা যায় কিনা তার সুলক সন্ধান করতে। কিন্তু ভার্সিটির ক্যাম্পাসে সারাক্ষণ মিছিল স্লোগান, কখনো কখনো টিয়ার গ্যাস লাঠিচার্জ ইত্যাদি নজর করে মনে হয়েছিল এসব জঞ্জাল থেকে দূরে থাকাই বেহতর। দেওয়ানবাড়িতে পুরানো পত্রিকা পড়ে সময় তার কাটছিল না। এলাকার হাই স্কুলে তখন শিক্ষকদের খুব আক্রা যাচ্ছে। মাসের শেষে মাইনার সঙ্কুলান হচ্ছে না বলে অনেক শিক্ষকই সরে গেছেন অন্যত্র। তখন দেওয়ান সিদ্ধান্ত নেন বিনা মাইনায় স্কুলে ক্লাস নেওয়ার। বছর খানেক তার খারাপ কাটেনি। শীতের সিজনে স্যুটটাই পরে স্কুলে যেতেন। বর্ষাকাল আসতেই গামবুট পরে জলকাদা ডিঙ্গিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া বেজায় বিরক্তির ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। তারপর ছাত্র সামলানোর বিষয়টিও তার কাছে উটকো ঝামেলা মনে হতো। কমরুদ্দীন ছাত্র হিসাবে মেধাবী না হলেও তার আউট বই পড়ার ধাত আছে। বিষয়টি দেওয়ান খুব পছন্দ করতেন। তো স্কুল মাস্টারি ছেড়ে দেয়ার পরও তার সাথে ছাত্র হিসাবে কমরুদ্দীনের একটা সম্পর্ক থেকে গেছে। মাঝে মাঝে তার কাছে আসে সে দেওয়ানবাড়ির লাইব্রেরি থেকে তারাশঙ্করের ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ বা সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’ ইত্যাদি বইপত্র ধার নিতে।

মসজিদের পেশাবখানার পাশে এসে বড় দেওয়ান রুমালে নাক চেপে ধরেন। ঠিক তখনই কমরুদ্দীন ফিসফিস করে বলে—গতকাল শান্তি কমিটির গোপন বৈঠকে তার চাচা বদরুদ্দীন হাজি তাকে চা ও খিল্লিপান সরবরাহের দায়িত্ব দেন। তখন সে শুনতে পায় যে—খান সেনাদের কাছে দেওয়ানের আচরণ সম্পর্কে নালিশ করার বিষয়টি। দেওয়ান ছাত্রদের বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা সোনালি-সবুজ পতাকা দর্জি দিয়ে তৈরির জন্য পঞ্চাশ টাকা চাঁদা দিয়েছিলেন। এ ছাড়া .. মাস খানেক আগে যখন এলাকার লোকজন, বিশেষ করে হিন্দুরা শরণার্থী হিসাবে ভারতে চলে যাচ্ছিল তখন তিনি প্রমোদ বাবুকে পাওয়ার টিলারখানা ব্যবহার করতে দেন। বাবু টিলারের ট্রেইলারে করে খেশকুটুম বিশেষ করে তার বিরাশি বছরের বৃদ্ধা মাকে ত্রিপুরাতে পাঠান। আরো কিছু হিন্দু পরিবারও ট্রেইলারে করে সীমান্ত পাড়ি দেয়। আর গতকাল সন্ধ্যাবেলা সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির এক সদস্য স্কুলের বয়োবৃদ্ধ হেডমাস্টার আব্দুল খালেক সাহেবকে খান সেনারা গুলি করে হত্যা করছে। তার লাশ পড়ে আছে কালের থলির পাঁকুড় গাছের তলায়, কেউ দাফন করার সাহস পাচ্ছে না। বিষয় দুশ্চিন্তারই বটে। দেওয়ানবাড়িতে ফিরে যাওয়া হবে এখন আজরাইলের সাথে মোলাকাতের শামিল। সামনে উপায় একটাই। প্রায় মাইল পাঁচেক হেঁটে গিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ত্রিপুরায় চলে যাওয়া। সড়ক ধরে যাওয়াটা সঠিক হবে না। রিক্সা ফিক্সার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কমরুদ্দীন তাকে আলপথে হাঁটার পরামর্শ দিয়ে বিদায় নিতে চাইলে দেওয়ান ভীষণ অসহায় বোধ করেন। তার সাথে কমরুদ্দীনের বর্ডার অব্দি যাওয়া খুবই মুশকিল। কারণ তার চাচা বদরুদ্দীন হাজি তাকে টাকা দিয়ে বাজারে পাঠিয়েছেন। ডালডা, গরমমশলা ও তেজপাতা কিনে তার তাড়াতাড়ি এখনই হাজিবাড়িতে ফেরা উচিত। কারণ মেয়েরা অপেক্ষা করছে, ডালডা ও তেজপাতা পাওয়া গেলেই তারা খান সেনাদের জন্য দোপেঁয়াজা রাঁধবে। কমরুদ্দীন তাকে অভয় দিয়ে বলে—স্যার, সোজা যাবেন বিন্নাবেড়া গ্রামে। নাসিরুদ্দীন বিড়ির চোরাচালানী বোংগা করবারি দানাউল্লাহকে বিষয় খুলে বলবেন। সে সন্ধ্যার পর আপনাকে নিরাপদে সীমান্তের ওপারে পৌঁছে দেবে।

কমরুদ্দীন ফিরে যাওয়ার পর দেওয়ান খেয়াল করেন যে—তার সফেদ পায়জামার পায়া চোরকাটায় ভরে উঠছে। আলপথে তিনি কি কখনো এর আগে হেঁটেছেন? একবার কি এক খেয়ালে একখানা পাওয়ার টিলার কিনেছিলেন। বাপ দাদার আমলের জমিদারী না থাকলেও তার বিষয় সম্পত্তির খাসে ধানি জমি-মিরাশ এখনো প্রচুর। ভেবেছিলেন আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করবেন। চাষবাসের ওপর দু’চারখানা বইপত্রও কিনেছিলেন। একদিন গামবুট পরে ফেল্টহ্যাট মাথায় আলে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন পাওয়ার টিলারের লাঙ্গল বাওয়া। কিন্তু জমিজিরত চাষবাসের জঞ্জাট তার পোষালো না। ড্রাইভার তেল চুরি করে। কিছুদিন পরপর কিনতে হয় পার্টস্, সারাই করাতে হয় টিলার। তো একলটে ঘুরঘুরি বন্দের সাড়ে তিন হাল খাস-জমি তিনি প্রমোদ বাবুর কাছে বর্গা দিয়েছেন। বাবু তার পাওয়ার টিলার মেনটেইন করেন, তিনি মাসওয়ারি খানিকটা ভাড়া পান।

পরিস্থিতি গুরুতর হলেও দেওয়ানের মনে ভয়ের কোনো অনুভূতি হয় না। বদরুদ্দীন হাজির সাথে তার বাবা মরহুম দেওয়ান আবুল হাসানের মামলা মোকদ্দমা নিয়ে কাজিয়া সংঘাত ছিল। এসব তো তিরিশ বছর আগের পৌদপুরানী কেসসা। হাজির সাথে তার তো কোনো দুশমনী নেই। হাজি তার পেছনে লাগলেন কেন? এসব ভাবতে গিয়ে দেওয়ানের শরীর খারাপ লাগে। মনে হয় জ্বর এসে যাচ্ছে। পাকস্থলিতেও নিঃসরিত হচ্ছে এসিড। ঠিক বুঝতে পারেন না বিন্নাবেড়া গ্রামের নিশানা কি এদিকে? তার মন কেবলই ফিরে যেতে চায় দেওয়ানবাড়িতে। ইচ্ছা হয় কুসুম গরম জলে গোসল সেরে একটু বারান্দার ইজি চেয়ারে বসবেন। বাড়িতে কাজবাজও পড়ে আছে অনেক। তার স্ত্রী গোলমালের কারণে বাপের বাড়িতে চলে যাওয়ার পর থেকে পোষা ময়না ও টিয়ে পাখিকে আদার তিনি নিজ হাতে দেন। আর নতুন প্রজাতির গোলাপের যে চারা লাগিয়েছেন তাতে বিকালে পানিই বা কে দেবে? শমসেন নগরে গোলাগুলির পর স্ত্রী রওশন বানুকে যমজ বাচ্চা দুটিসহ বাপের বাড়ি তিনিই পাঠিয়েছেন। ওরা মফস্বল শহরের বাসায় নিরাপদে আছে। তবে স্ত্রী বাপের বাড়িতে চলে যাওয়ার পর দেওয়ানবাড়িতে কামকাজের লোকজন তিনি নিজেই কমিয়ে দিয়েছেন। কেবলমাত্র এক বৃদ্ধা বাপের আমলের বান্দীবেটি তার জন্য রান্নবান্না করে দিয়ে নিজের গ্রামে ফিরে যায়। মাঝে মাঝে তার নাতনিও আসে দালানঘরের যে দু’তিনটি কামরা তিনি ব্যবহার করেন তা ঝাড়পোছ করতে। পাখি দুটিকে আদার দেওয়ার বিষয়টি কি তাদের মাথায় আসবে? আর ঝারি দিয়ে গোলাপ গাছে একটু পানি দেওয়া।

বিকাল পড়ে যাওয়ার সময় নানা হাঙ্গামার ভেতর দিয়ে দেওয়ান বিন্নাবেড়া গ্রামে পৌঁছান। পায়ে ফোস্কা পড়ে যাওয়ায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। বোংগা কারবারী দানাউল্লার বাড়িতে গিয়ে তিনি বড় খাজুল হন। তার স্ত্রী দরজার বেড়ার আড়াল থেকে কেঁদে-কেটে হাহাকার করে জানায় যে, তার স্বামী সপ্তাহ দিন আগে ইন্ডিয়া যায় বোংগায় বিড়ির চালান আনতে। এদিকে বর্ডারে চলছে গোলমাল, রাতবিরাতে গোলাগুলি হলে সে আর ফিরে আসতে পারেনি।

হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ করে দেওয়ানের মাথায় কী যেন ঘুরে ওঠে। বেশ মশগতে শরীরের ভারসাম্য বাজায় রাখেন তিনি। শীতের সন্ধ্যায় দু’তিন পেগ ব্র্যান্ডি খেলে এরকমের অনুভূতি হয়। চন করে বিষয়টি মনে পড়ে। দেওয়ানবাড়ির ধান রাখার বাড়ার-ঘরের আধো অন্ধকারে শুয়ে আছেন প্রমোদ বাবু। কামরাটি বাইরে থেকে তালা দেওয়া। প্রমোদ রঞ্জন দাসের বিষয় আশয় প্রচুর। বাজারে আড়ত ছাড়াও আছে রেশনের দোকান ও স্ট্যাম্প ভেন্ডারের কারবার। অত্র এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় সকলে শরণার্থী হিসাবে ত্রিপুরা গেলে প্রমোদ বাবু তাঁর পরিবার পরিজন সকলকে ওপারে পাঠান। তবে তিনি থেকে যান নিজ বাড়িতে। পাঁচদিন আগে খান সেনারা হিন্দুপাড়ায় নাপাম ছিটিয়ে বেড়-আগুন দিলে তার ঘরবাড়ি তাবৎ কিছু পুড়ে যায়। প্রমোদ বাবু বাঁশঝাড়ের ভেতর লুকিয়ে থেকে প্রাণে বাঁচেন। তারপর সন্ধ্যাবেলা দেওয়ানবাড়িতে এসে আশ্রয় নেন। বাড়ার-ঘরের ধানগোলার ঠিক উপরে ছাদের কাছে আছে একটি গুপ্ত কামরা। চাকর নকরদের যাতে সন্দেহ না হয় এর জন্য দেওয়ান কামরায় দরোজায় বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিয়েছেন। বুড়ি বান্দীবেটি কাজে আসার আগে তিনি তাঁকে নিজ হাতে নাস্তা দিচ্ছেন। আর বুড়ি চলে যাওয়ার পর, তাকে থালায় করে খাবারও তিনি পৌঁছে দিচ্ছেন।

প্রমোদ বাবুকে বাড়ার-ঘরে তালাবদ্ধ রেখে দেওয়ান পালিয়ে ইন্ডিয়ায় যেতে পারেন না। এর একটা বিহিত করতে হয়। তিনি ঝিকরকান্দি গ্রামে ফেরার পথে এবার ঘুরে দাঁড়ান। প্রমোদ বাবু সাথে তার সম্পর্ক বাপের আমল থেকে। বিবাহের সময় কিংবা মামলা মোকদ্দমা ইত্যাদি সংসারের নানাবিধ দুর্বিপাকে যখন তার টাকা পয়সার তঙ্গি পড়েছে তখনই তিনি প্রমোদ বাবুর কাছ থেকে সামান্য সুদে টাকা ধার নিয়েছেন। তার প্রতি দেওয়ানের আছে এক ধরনের কৃতজ্ঞতা। আর প্রমোদ বাবুর বুদ্ধিসুদ্ধির ওপরও তিনি নির্ভর করেন বিপুলভাবে। ঝিকরকান্দির দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবেন—পথঘাট না জেনে একা বর্ডার অতিক্রম করতে যাওয়াটা হবে বেআকলামির শামিল। আর সাথে টাকা পয়সাও তেমন কিছু নেই। ত্রিপুরাতে পৌঁছে দিনগুজরানই বা করবেন কিভাবে? খান সেনারা এতক্ষণে টহল ছেড়ে নিশ্চয়ই ফিরে গেছে থানা সদরে। দ্রুত হাঁটতে থাকলে ঠিক সন্ধ্যার পরপরই তিনি ফিরতে পারবেন দেওয়ানবাড়িতে। তালা খুলে দিয়ে প্রমোদ বাবুর সাথে জলদি একটু শলা পরামর্শও করা যাবে। সিন্দুক থেকে টাকাপয়সা ও সোনার জেওরাত কয়েকখানাও তুলে নিতে পারেন। তারপর না হয় রাত থাকতে থাকতে প্রমোদ বাবুকে সাথে নিয়ে আবার মেলা দেবেন ত্রিপুরার দিকে।

হঠাৎ করে দেওয়ানের খেয়াল হয় যে—তিনি এবার সড়ক ধরেই হাঁটছেন। আলপথে ফিরে যেতে ইচ্ছা হয় না। কারণ আলপথ ধরে বিন্নবেড়া গ্রামে আসার পথে ফোঁস করে ওঠা সাপের মুখে পড়ে যেতে যেতে অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন। মনে একটি কুচিন্তা খেলে যেতেই তিনি নিজেকে প্রবোধ দেন—খান সেনারা কেবল মাত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়িতে আগুন দিচ্ছে। দেওয়ানবাড়ির বারমহলে আছে মিনারওয়ালা মসজিদ ও মকতব। তাকে বাড়িতে না পেয়ে হয়তো খান সেনারা রেগে যাবে, কিন্তু আগুন দিতে যাবে না। সড়কের বাঁকে এসে দেওয়ান ইতস্তত করেন—রাজপথ ধরে হেঁটে যাওয়াটা কি সঠিক হবে? পথে জনমানুষ কিছু নেই কেন? তবে কি তিনি সাপখোপের রিস্ক নিয়ে আবার ফিরে যাবেন আলপথে। ঠিক তখনই হরন দিয়ে ধুলাবালি উড়িয়ে বাঁকের ওপার থেকে বেরিয়ে আসে গাড়িটি। লালরঙের পিকাপ। গাড়িখানা ঝিমাইচাল চা-বাগানের। দেওয়ান শুনেছেন যে বাগানের বিহারী মালিক লাল পিকাপটি পাক-আর্মিকে ব্যবহার করতে দিয়েছেন টহলের কাজে। তিনি ভাবেন—গাড়ির আরোহীরা হয়তো তাকে চিনতে পারবে না। কিন্তু নসীব খারাপ। পিকাপটি এসে দাঁড়ায় তার পাশে।

গরু-ভইস বাঁধার একখানা দড়ি তার হাতে প্যাঁচাতে গেলে দেওয়ানের মেজাজ বিগড়ে যায়। তিনি চীনা কারবাইন ঝুলানো খান সেনাকে পরিষ্কার উর্দু জবানে বলেন—গায়ে হাত দেবে না। হাম আপস্ তোমহারা সাথ ক্যাম্প-ছে যাওগি। বাত করোঙ্গি খোদ কমান্ডার কা সাথ। কিন্তু ছ-ফুটি খান সেনা তাকে পিছমোড়া করে বাঁধতে গেলে তিনি বেঁকে ওঠেন। তখন জোরাজোরিতে চোখ থেকে চশমা খুলে ছিটকে পড়ে ধুলায়। খান সেনা তার কোমরে বন্দুকের কোন্দা দিয়ে ঘাঁ দিলে তিনি হুমড়ি খেয়ে পড়েন পিকাপের চেসিসে। তখন মিলিটারির বুটের তলায় পড়ে মড়মড় করে ভেঙ্গে যায় তার বাইফোকাল চশমা।

পিকাপ ট্রাকে দড়ি বাঁধা হয়ে বসে আছে আরো কয়েকজন মানুষ। এদের মাঝে বাবরি চুলের মরম আলীকে তিনি চিনতে পারেন। মাথা ফেটে রক্ত বেরিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে তার গালের বা’ দিক। বাউলা গানের লোক মরম আলীকে তিনি খুব ভালো করে চেনেন। ইলেকশনের সময় মাইকে তার গলার স্বর প্রায়ই শোনা যেত। দোতারা বাজিয়ে সে গাইছে জয় বাংলার গান।  মরম আলী দেওয়ানের দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকে। তার মুখে কোনো কথা জোগায় না। হঠাৎ করে সে চোখমুখ ভেঙেচুরে শিশুর মতো কেঁদে ওঠে হু হু করে। কিছু যেন বলে। দেওয়ান খেয়াল করে তা শুনতে গেলে পিকাপে দাঁড়িয়ে থাকা এক খান সেনা ‘হাল্লা মত করো হারামজাদে’ বলে বন্দুকের কোন্দা দিয়ে মরম আলীর মাথায় বাড়ি মারে। বড় দেওয়ানের আদ্দির ফিনফিনে কোর্তা ঘামে জবজবে হয়ে উঠছে। মরম আলীর কথা কি তিনি ঠিক মতো শুনতে পেরেছেন? তবে কি আগুনে পুড়ে দেওয়ানবাড়ি সত্যিই খাক হয়ে গেছে। খান সেনারা শুধু কি তার দালানঘরে আগুন দিয়েছে। নাকি আগুনের লেলিহান শিখা পুড়িয়ে ভস্ম করেছে ধানের বাড়ার-ঘরও?

যদি মরম আলীর বাচন সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে শত বৎসর আগে মুর্শিদাবাদের নবাবের দরবার থেকে পাওয়া দেওয়ানী সনদ খানাও পুড়ে গেছে। এই প্রথম বিশাল কিছু হারানোর বেদনা তার কলিজায় শেলের মতো এসে বিঁধে। দারুণ আফসোস হয়—তার যমজ বাচ্চা দুটি কোনো দিন দেখবে না দেওয়ানবাড়ির দড়ো বুনিয়াদের দলিলি প্রমাণ। আলমারির উপরের তাকে সনদের পাশেই রাখা আছে তার পরদাদা দেওয়ান নুরুল হাসানের হাতে লেখা ইয়াসিন শরীফ। আল্লার কালাম আগুনে পোড়ে না। তবে কী পবিত্র সুরার তাসিরে দগ্ধ হওয়া থেকে রেহাই পাবে নবাবী জামানার সনদ? ধানের বাড়ার-ঘরটি দালান থেকে বেশ দূরে মহলের পুকুরের ওপারে। আগুন হয়তো অত দূর অব্দি পৌঁছবে না। কিন্তু গুপ্ত কামরার দুয়ারে যে তালা লাগানো। আর যদি হার্মাদ সেনারা বাড়ার-ঘরেও আগুন দিয়ে থাকে,তাহলে..? কী করবেন ঠিক বুঝতে পারেন না, প্রমোদ বাবু তার বড়ো কাছের মানুষ। এক ধরনের অসহায় রাগে দেওয়ান উঠে দাঁড়াতে গেলে মাথায় চীনা কারবাইনের বাড়ি দিয়ে তাকে বসিয়ে দেওয়া হয়।

তখনই লাল পিকাপটি থামে। ফ্রন্টসিট থেকে নেমে আসেন বদরুদ্দীন হাজী। পিকাপের চেসিসের কাছে এসে হাজি মেহদীমাখা দাড়ি খিলাল করতে করতে গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন—দেওয়ানজীর বেটা দেওয়ান, মনে মনে কয়েক মর্তবা তওবা আসতাগফার পড়েন। রক্তের ধারায় বুজে যাওয়া চোখের পাপড়ি খানিক কসরতে খুলে বড় দেওয়ান কী যেন বলতে চান। কিন্তু ঝাঁকি দিয়ে ঝিমাইচাল চা বাগানের লাল পিকাপটি ধুলা উড়িয়ে খান সেনাদের ছাউনির দিকে ছোটে।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;