ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধ : আশা ও বেদনার যৌথভাষ্য



বীরেন মুখার্জী
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

‘মা রে, তুই ছাড়া আমার কেউ নাই।... মারে রে কথা কসনা ক্যান? হোন্। জানোয়ারে কিছু কইরলে হে মনে রাখতা নাই। কুকুর কামর দিলে কি মানুষে মনে রাখে, না পা কাইট্যা ফেলে? মানুষের কিছু করইলে অন্য কথা। জানোয়ারকে মানুষ মাফ কইরা দ্যায়।’

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনির নারী ধর্ষণের চিত্র এভাবে অঙ্কন করেছেন শওকত ওসমান তার ‘ক্ষমাবতী’ গল্পে। পাকিস্তানিদের বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা, নির্যাতন যে কত মর্মস্পর্শী ও ভয়াবহ ছিল তা একাত্তরের নয় মাসের যুদ্ধে প্রত্যক্ষ করা গেছে। পাকিস্তানি শাসকের শোষণ ও নিপীড়নের জটাজাল থেকে জাতিসত্তা রক্ষা, আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অস্তিত্ব পুনরুদ্ধারে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল বাঙালি জাতি। ‘৫২-এ বাংলা ভাষা রক্ষার বিজয় বাঙালির হৃদয়পটে সাহসের রাজটীকা এঁকে দেয়; সেই সাহসকে ভিত্তি করে একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পৃথিবীর মানচিত্রে লাল সবুজের পতাকাবাহী স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটাতে সক্ষম হয় বাঙালি জাতি। যুদ্ধের সাফল্য ও গৌরবগাঁথা, ক্লেদ, হতাশা এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রাপ্তির কাঙ্ক্ষা ইত্যাদি প্রপঞ্চ বাঙালির মননে নানামুখী আবেগের সৃষ্টি করে। যার প্রতিফলন পাওয়া যায় সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়। বলা যায়, মুক্তিসংগ্রামের ইতিবৃত্ত ও যুদ্ধোত্তর বাস্তবতা সসম্ভ্রমে বিকশিত হয়েছে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে। শিল্পসংবেদনশীল মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন দেশের সাহিত্যিকগণ এমনকি ভিনদেশি সাহিত্যিকরাও নিষ্ঠার সঙ্গে এই কাজটি করেছেন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক দৃশ্যপট নানান আঙ্গিকে তুলে ধরা হয়েছে ছোটগল্পে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে যেমন এ দেশের স্বাধীনতাকামী আপামর ছাত্রজনতা, সৈনিক, শ্রমিক-কৃষক, শিক্ষক, লেখক, বুদ্ধিজীবী নানাভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে, তেমনিভাবে এ দেশের কবি-সাহিত্যিকরাও মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা ও পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে কলমকে শাণিত রেখেছেন। রচনা করেছেন গান, কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস ও নাটক। এসব সাহিত্যকর্ম একদিকে যেমন যুদ্ধরত বাঙালিকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে অন্যদিকে বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারকেও করেছে সমৃদ্ধ। ‘সাহিত্যের আরেক নাম জীবন সমালোচনা (Criticism of life) মাধ্যমে জীবনের সত্য, জীবনাতীতের সত্য ভাষার সৌন্দর্যে মণ্ডিত হয়ে সাহিত্যে উদ্ভাসিত হয়।’ সাহিত্যের দর্পণে যদি প্রতিবিম্বিত হয় একটি জাতি তথা একটি রাষ্ট্রের জীবন প্রণালী। প্রতিফলিত হয় সেই দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি। তাহলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়েও বাঙালি জাতির আপোসহীন সত্তাকে শনাক্ত করা যায়। 

কথাসাহিত্যে, বিশেষ করে ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপক প্রতিফলন লক্ষণীয়। সৃজনশীলতার প্রশ্নে একটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কিত থাকায় আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তির স্বার্থে নৃ-তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ উজিয়েও অপরাপর ক্ষুদ্র জাতিসত্তা সংগ্রামের সোপানতলে একীভূত হয়েছে—অস্তিত্বের লড়াইয়ে। বিভিন্ন সময়ে ঔপনিবেশিক শক্তির দীর্ঘ ও ধারাবাহিক শাসন-শোষণে ভঙ্গুর আর্থ-সামাজিক অবস্থায় নিমজ্জিত বাঙালির মধ্যবিত্ত মানস যুদ্ধচলা সময়ে দু’টি বিপরীতমুখিন দর্শন অবলম্বন করে স্পষ্ট হয়। প্রথমত ধর্মীয় ভীরুতা, স্বাচ্ছন্দ ও সুবিধাবাদী নীতি গ্রহণ ও তোষণের সনাতন রূপ এবং দ্বিতীয়ত সমস্ত পঙ্কিলতা ও সীমাবদ্ধতা থেকে উত্তীর্ণ হবার চেতনা। প্রথম ধারার সমর্থকরা সত্য ও যুক্তিনিষ্ঠ দ্বিতীয় ধারার বিপরীতে অবস্থান করলেও ঘটনার প্রবহমানতা ও প্রতিক্রিয়ায় একসময় মুক্তিকামী চেতনায় মিলিত হয়। মানবিক উন্নয়ন ঘটে। ব্যক্তির অভিজ্ঞানসঞ্জাত, মর্মস্পর্শী উপলব্ধি নিয়ে বশীর আল হেলাল-এর গল্প ‘প্রথম কৃষ্ণচূড়া’। পাকবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে ঢাকা শহরের অর্ধেক মানুষ শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গোলাম রসুল তার পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দেয়। শিক্ষকের তরুণ পুত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে আগ্রহী হলেও পিতার অনুমতি পায়নি। কিন্তু ঢাকা শহরে অবস্থান ও প্রতিদিন নির্যাতন, হত্যা প্রত্যক্ষ করে তার বিদ্রোহী সত্তার জাগরণ ঘটে। বয়সের ভারে নিজে যুদ্ধে যেতে না পারলেও ওই শিক্ষক পুত্রকে চিঠি লিখে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের নির্দেশ দেয়।

হানাদার বাহিনীর মানবতা বিরোধী হত্যা-নির্যাতন ও দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে যুদ্ধে অংশ নেওয়া এক যুবকের বীরত্বগাঁথা নিয়ে রচিত জহির রায়হানের শ্রেষ্ঠ গল্প ‘সময়ের প্রয়োজনে’। গল্পের মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রের যুবক জীবনত্যাগী বীর সহযোদ্ধাদের কথা ভেবে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়ে আবার একই সঙ্গে পাকবাহিনীকে হত্যা করে উল্লাসে ফেটে পড়ে। গল্পের চূড়ান্ত পর্যায়ে সে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে নিজের জীবনও উৎসর্গ করে। তবে ধরা পড়ার পূর্বে সে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধের কারণ অনুসন্ধান করে। গল্পটি একজন মুক্তিযোদ্ধার দিনলিপি হিসেবে ধরা যায়। বাঙালি জাতি সেদিন কোন সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে লড়েছে? বর্তমানের বাস্তবতায় দ্বিধান্বিত জাতির সামনে সেই সত্যটিই কি নানা মাত্রিকতা নিয়ে দৃশ্যমান নয়? গল্পটিতে লেখকের শক্তিমত্তা পূর্ণমাত্রায় সমর্থনযোগ্য। আবেগী, তারল্যপূর্ণ লেখকদের মতো মুক্তিযুদ্ধকে তিনি শুধু নারী-লাঞ্ছনা হিসেবে দেখেননি। পাকসেনা ও এদেশীয় বর্বরদের যৌনলিপ্সা যুদ্ধখণ্ডের একটি প্রপঞ্চমাত্র। যে বাস্তবতা, কাঙ্ক্ষা নিয়ে একাত্তরের যুদ্ধে অংশ নেয় সাধারণ জনতা, তার মনস্তাত্ত্বিক চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন গল্পটিতে পূর্ণমাত্রায় উপস্থিত।

প্রায় সমজাতীয় বাস্তবতা নিয়ে রচিত হারুন হাবীবের ‘লালশার্ট’ গল্পটি। কামালপুর নামের এক অখ্যাত অঞ্চলের রণক্ষেত্রের প্রকৃত অবস্থা এ গল্পে পূর্ণরূপে ফুটে ওঠে। এলাকার পাকিস্তানি ঘাঁটির নিকটবর্তী মুক্তিযোদ্ধাদের বাঙ্কার পাহারারত জলিল, সতিশ ও মোতালেব নামের তিন মুক্তিযোদ্ধার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এ গল্পে। পাকসেনারা বাঙ্কার আক্রমণ করলে তিনজনের একজনও ফিরে আসে না। পরদিন খুঁজতে গিয়ে তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় এক বাঁশঝাড়ের মধ্যে স্থির বসে থাকতে দেখে সহযোদ্ধা তাহের। ওই আক্রমণে সতিশ ও মোতালেব নিহত হয়। জলিল আহত হলেও মৃত দুই সহযোদ্ধার অস্ত্র দু’টি যুদ্ধের কাজে লাগবে বলে সে সঙ্গে নিয়ে আসে। জলিলও ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথে এগুতে থাকে। এ সময় তার মনে পড়ে মা আর বোনের কথা। যাদের না বলে সে যুদ্ধে অংশ নেয়। স্বাধীনতা প্রত্যাশায় জীবন উৎসর্গকারী এই যুবক যোদ্ধা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও নিহত সহযোদ্ধাদের অস্ত্র, তাদের রক্তাক্ত লালশার্টের ছেঁড়া অংশ বহন করে দেশমাতৃকার প্রতি অগাধ ভালোবাসার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ দেশমাতৃকার সম্মানই গল্পে নিঁখুত ভাবে উঠে আসে।

হাসান আজিজুল হকের ‘আটক’ গল্পটি যুদ্ধখণ্ডের আরেক বাস্তবতা নিয়ে বিকশিত। মিত্রবাহিনীর সঙ্গে বাঙালি যোদ্ধাদের সম্মিলিত আক্রমণে দিশেহারা পাকসেনারা। রাতের আঁধারে তাদের পশ্চাদপসরণ নিখুঁতভাবে বিবৃত হয়েছে। তার ‘ভূষণের একদিন’ গল্পে পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার নির্যাতনে বাঙালির বিধস্ত জীবনের চিত্র ও বাঙলার প্রত্যন্ত জনপদের বিবর্ণ ছবি ফুটে ওঠে। গল্পে তিনি যুদ্ধ শুরু হওয়ার অব্যবহিত পরের বাস্তব অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন। নামহীন গোত্রহীন গল্পটি বিকশিত হয়েছে থমথমে ও ভয়াবহ পরিস্থিতিকে সামনে রেখে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর লোমহর্ষক বর্বরতার ছবি তিনি এ গল্পে শিল্পসম্মভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ‘সে’ নামের এক চরিত্র সৃষ্টির মাধ্যমে। গল্পটি মুক্তিযুদ্ধ প্রেক্ষাপটে রচিত অপরাপর গল্পের ভেতর ভিন্নতা নির্দেশ করে।

বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন ‘মুক্তিযুদ্ধের বিজয়’ বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই। মুক্তিযুদ্ধ সমগ্র জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিয়েছে একথাও সত্য। কিন্তু এর জন্যে বাঙালি জাতিকে যা হারাতে হয়েছে তার পরিমাণও নিতান্ত কম নয়। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত ছোটগল্পগুলোতে বিজয়ের পাশাপাশি বেদনারও ভয়াবহ চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। বিজয়ী বেশে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন দেশের মাটিতে ফিরে এলেও তাদের মুখোমুখি হতে হয়েছে নিষ্ঠুর বাস্তবতার। ভয়াবহ যুদ্ধের কারণে মা হারিয়েছে সন্তান, নারীরা বিসর্জন দিয়েছে সম্ভ্রম, প্রিয়জনের মৃতদেহ মাড়িয়েও যুদ্ধ করতে হয়েছে সতীর্থ যোদ্ধাদের। নিজ জন্মভূমি ছেড়ে উদ্বাস্তু, উন্মুল হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়েছে সাধারণ মানুষদের। গল্পগুলোতে এসব মানুষেরও অসহায়ত্বের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ফুটে উঠেছে মানবিক সকরুণ আর্তি। সেলিনা হোসেন তার পরজন্ম গল্পে যুদ্ধ যন্ত্রণায় নিঃসঙ্গ ও বেদনাজর্জর এক পিতার করুণ আর্তি তুলে ধরেছেন। বৃদ্ধ কাজেম আলীর মুক্তিযোদ্ধা চার সন্তান এক অপারেশনে গিয়ে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। তার চোখের সামনেই পাকসেনারা তাদের গুলি করে হত্যা করে। স্বাধীনতার পর নিঃসঙ্গ কাজেম আলীর স্ত্রী পুত্রশোকে মারা গেলে বৃদ্ধ কাজেম আলী আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে।

হরিপদ দত্ত’র বাস্তব সত্যদর্শন ‘কাকজোছনার বনপুদিনা’ গল্পটি। মুক্তিযুদ্ধকে নিকট থেকে দেখার অভিজ্ঞতা এবং গল্পে বিবৃত সত্য ঘটনাটি তিনি সৃজনশীল চেতনার মিশেলে শিল্পঋদ্ধ ফসল হিসেবে উপস্থাপন করেন। যুদ্ধে ধর্মীয় ভীরুতা ও আখের গোছাতে উৎসাহী এক অর্থলিপ্সু অধ্যাপক পিতা ও যুদ্ধশেষে পাকক্যাম্প থেকে ফিরে আসা কন্যার বেদনাদায়ক সংলাপ গল্পের চুম্বকীয় অংশ হিসেবে গল্পটিকে বিশিষ্টতা দান করে। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি নিয়ে লিখিত এটি একটি সার্থক ছোটগল্প।

ছোটগল্প লেখকরা নানারৈখিক চিত্র অঙ্কনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলোকে মাত্রিক, ব্যঞ্জনাঋদ্ধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকসেনা কর্তৃক নারী ধষর্ণের চিত্র অঙ্কনের পাশাপাশি তুলে ধরেছেন বাঙালি নারীর গুপ্তচরবৃত্তির সফল কাহিনী। নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বাঁচাতে পাকসেনাদের নিষ্ঠুরতা মেনে নিয়েছে আবার বিষধর ছোবল দিয়েও তাদের প্রাণ সংহারে ব্রতী হয়েছে। পাকসেনাদের নির্যাতনে অন্তঃসত্ত্বা এবং সন্তান প্রসব করে মাতৃত্বের অপমানের প্রতিশোধ হিসেবে সেই সন্তানকে মেরে ফেলার দৃশ্যও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গল্পে। শক্তিশালী গল্পকার শওকত ওসমান ‘দ্বিতীয় অভিসার’ গল্পে এইভাবে বাঙালি নারীর প্রতিশোধ গ্রহণের প্রবৃত্তিকেই সফলভাবে চিত্রায়িত করতে সচেষ্ট হয়েছেন।

এছাড়া শওকত ওসমান-এর ‘দুই ব্রিগেডিয়ার’, ‘ক্ষমাবতী’, ‘জননী: জন্মভূমি’, ‘দ্বিতীয় অভিসার’, বশীর আল হেলাল-এর ‘প্রথম কৃষ্ণচূড়া’, ‘রণকৌশল’, জহির রায়হান-এর ‘সময়ের প্রয়োজনে’, আবু জাফর শামসুদ্দীন-এর ‘ছাড় দেয়াল’, ‘চাঁদমারি’, হাসান আজিজুল হক-এর ‘নামহীন গোত্রহীন’, ‘রাফি’, ‘কৃষ্ণপক্ষের দিন’, ‘আটক’, কায়েস আহমেদ-এর ‘নচিকেতাগণ’, ‘বাংলাদেশ কথা কয়’, মঈনুল আহসান সাবের-এর ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’, শাহরিয়ার কবির-এর ‘একাত্তরের যীশু’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস-এর ‘অপঘাত’, মাহমুদুল হক-এর ‘বেওয়ারিশ লাশ’, ‘কালো মাফলার’, আলাউদ্দিন আল আজাদ-এর ‘আমাকে একটি ফুল দাও’, হরিপদ দত্ত-র ‘কাকজোছনার বনপুদিনা’, সেলিনা হোসেন-এর ‘পরজন্ম’, হারুন হাবীব-এর ‘লালশার্ট’, কাজী ফজলুর রহমান-এর ‘২৫ শে মার্চ’ গল্পগুলো সন্ধানী পাঠশেষে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত সার্থক ছোটগল্প হিসাবে উল্লেখ করা যায়।

পরিশেষে বলতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের আবেগ, উপলব্ধি, তৎকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিত, মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা নিবিড়ভাবে ধরা পড়েছে বাংলা ছোটগল্পের জমিনে। গল্পগুলোতে চিত্রায়িত হতে দেখি যুদ্ধখণ্ডে বাঙালির নিজস্ব উপলব্ধি, স্বাধিকার প্রশ্নে আত্মোৎসর্গকারী জনতার নির্লোভ মুখ। বিবৃত হয় এদেশীয় স্বাধীনতা বিরোধী ও পাক হানাদার বাহিনীর যৌথ যৌনলিপ্সা। অপরাপর ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে সম্ভ্রম হারানো নারীর হৃদয়। লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও শক্তিশালী কল্পনার মিশেলে পুষ্ট গল্পগুলো আবেগসঞ্চারী বাক্যবিন্যাসে মূর্ত হয়ে ধরা দেয় মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত যাবতীয় হতাশা, দীর্ঘশ্বাস, আশা, প্রাপ্তিসহ নানাবিধ প্রপঞ্চ। লেখকের শক্তিমত্তা, বুননশৈলীতে শব্দচিত্রে ভাস্বর হয় অসহায়-অনাহারী আমজনতার দীর্ঘশ্বাস ও দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। গল্পে বিবৃত ঘটনারাশি তাই পারস্পরিক সহমতের নিরিখে স্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি করে পাঠক চেতনায়। গল্পগুলোতে অঙ্কিত বিভিন্ন চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক অভিব্যক্তি ঘটনা পরম্পরায় মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ ইতিহাস হয়ে ওঠার দাবি রাখে।

দোহাই
১. মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের ছোটগল্প, মুহম্মদ হায়দার, বাংলা একাডেমি, মে ২০০৩
২. বাংলাদেশের ছোটগল্প (গবেষণা গ্রন্থ), খালেদা হানম, চট্টগ্রাম

   

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী আজ



নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মজয়ন্তী। ১৮৬১ সালের (বঙ্গাব্দ ১২৬৮) এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। তার বাবার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। তার পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন।

তিনি একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত ও পাঠ্য সূচিতে সংযোজিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বকবি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে কবিগুরু সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৮৯১ সাল থেকে বাবার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে ও উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন তিনি। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবী ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীতে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার দেওয়া বাণীতে বলেন, ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রধান পাথেয় ছিল মনুষ্যত্বের বিকাশ, মানবমুক্তি ও মানবপ্রেম। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য অঙ্গনের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার ও প্রবন্ধকার। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি গেয়েছেন মানবতার জয়গান। শুধু সাহিত্য সাধনা নয়, পূর্ববঙ্গের জমিদারি পরিচালনার পাশাপাশি দরিদ্র প্রজাসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি ও মানবিক বিকাশের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেওয়া বাণীতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। তার হাতেই বাংলা কবিতা, গান, ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতি নাট্য, নৃত্য নাট্য পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলা সাহিত্য স্থান করে নিয়েছে বিশ্বসভায়। তিনিই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তি ও মানবতার কবি। বিশ্বমানবতার সংকটে তিনি সবসময় গভীর উদ্বেগ বোধ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান বিষয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা, বিশ্বমানবতাবোধ ও মানুষে মানুষে মিলন। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা বিজ্ঞানভিত্তিক, যা আধুনিক শিক্ষায় অগ্রগামী হতে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তার (রবীন্দ্রনাথের) রচনা আলোক শিখা হয়ে বাঙালিকে দেখিয়েছে মুক্তির পথ। বাঙালির সুখে-দুঃখে তার গান যেমন দিশা দিয়েছে, বাঙালির জাতীয় সংকটেও তার গান হয়ে উঠেছে একান্ত সহায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান হয়ে উঠেছিল মুক্তিকামী বাঙালির চেতনা সঞ্চারী বিজয় মন্ত্র।

 

 

;

তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা



ড. মিল্টন বিশ্বাস
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  • Font increase
  • Font Decrease

‌‌আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ।
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে।'

আজ ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী। দুর্যোগময় পৃথিবীতে তাঁর জন্মদিন ভিন্নতর তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিত্যসঙ্গী, বাঙালির আত্মপরিচয়ের অন্যতম স্তম্ভ। তাঁকে কেন্দ্র করে কেবল পাকিস্তানি সরকারের বিতর্কিত ভূমিকা নয় ১৯৭১ এর আগে থেকেই বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত হয়েছে তাঁর মাধ্যমে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহানপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এর অন্যতম অনুঘটক। তাঁর দীর্ঘ কারাজীবনের সঙ্গী ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’। লেখাবাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের ভক্ত বঙ্গবন্ধুই আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’কে সংবিধানভুক্ত করেন। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি পূর্ব বাংলার শিল্পীগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তাঁকে দেওয়া এক সংবর্ধনার ভাষণে রবীন্দ্রনাথের কথা এভাবেই বলেছিলেন তিনি- Go to anywhere in the world and tell them that you have come from the country of Tagore, they will respect you.

বিশ্বকবির দেশ বাংলাদেশ। বিশ্বকবির ভাষাপ্রেম এদেশের মানুষকে ভাষা সংরক্ষণের সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তাঁর কবিতা ও গান একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর সঙ্গে বাংলা ও বাঙালির হৃদয়ের সম্পর্ক এবং সংকট-মুহূর্তে তাঁর সাহিত্য-সংগীতের দ্বারা উজ্জীবিত হওয়া সাধারণ একটি ঘটনা। মনে রাখতে হবে পাকিস্তানিদের চেয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য রবীন্দ্রনাথকে বারবারই সামনে এনেছেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন- ‘সাত কোটি বাঙালিকে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি- ‘কবিগুরু, তোমার উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখে যাও তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ জীবদ্দশায় কবিগুরু দেখেছেন যুদ্ধ-বিপর্যস্ত পৃথিবীতে মহাবিপর্যয়ের ত্রাস। মারণব্যাধির মহামারি, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তরে মানবসভ্যতার পরাজয়ের ভয়ঙ্কর ও বিব্রতকর চিত্র। তবু তিনি মানুষকে আশ্বাস দিয়েছেন, উজ্জীবিত করেছেন ‘দুঃসময়’ (কল্পনা)-এর মতো আরো অনেক কবিতা-গানে।

লিখেছেন-দিক-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা-/তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,/এখনি, অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা।’ (দুঃসময়) রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগে-পরে বিশেষত ১৮১৭ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত একশ বছরে সাতবারের কলেরা মহামারিতে ভারতবর্ষে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। ১৮৯৬ সালের প্লেগ মহামারি, ১৮৯৭ সালের বড় ভূমিকম্প অথবা ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুতে বিপুল সংখ্যক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ভূমিকম্পে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কয়েকটি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দুর্যোগের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সংক্রামক ব্যাধি, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়মনীতি বিশ্বকবির মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।

২.
‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থের ‘সমবায়ে ম্যালেরিয়া-নিবারণ’ (ভাদ্র, ১৩৩০) এবং ‘ম্যালেরিয়া’ (জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩১) প্রবন্ধ ছাড়াও সমাজ ও রাষ্ট্রের নানান প্রসঙ্গে তিনি মানবজীবন থেকে ব্যাধি নিবারণের কথা বারবার বলে গেছেন। একটি উদ্ধৃতি- ‘একটা কথা মনে রাখতে হবে, দুর্গতির কারণ সব দেশেই আছে। কিন্তু মানুষের মনুষ্যত্ব কী। না, সেই দুর্গতির কারণকে অনিবার্য বলে মনে না করে, যখন যাতে কষ্ট পাচ্ছি চেষ্টা-দ্বারা তাকে দূর করতে পারি, এ অভিমান মনে রাখা। আমরা এতদিন পর্যন্ত বলেছি, ম্যালেরিয়া দেশব্যাপী, তার সঙ্গে কী করে লড়াই করব, লক্ষ লক্ষ মশা রয়েছে তাদের তাড়াব কী করে, গভর্মেণ্ট আছে সে কিছু করবে না... আমরা কী করব! সে কথা বললে চলবে না। যখন আমরা মরছি, লক্ষ লক্ষ মরছি... কত লক্ষ না মরেও মরে রয়েছে...যে করেই হোক এর যদি প্রতিকার না করতে পারি আমাদের কিছুতেই পরিত্রাণ নেই। ম্যালেরিয়া অন্য ব্যাধির আকর। ম্যালেরিয়া থেকে যক্ষ্মা অজীর্ণ প্রভৃতি নানারকম ব্যামো সৃষ্টি হয়। একটা বড়ো দ্বার খোলা পেলে যমদূতেরা হুড়্ হুড়্ করে ঢুকে পড়ে, কী করে পারব তাদের সঙ্গে লড়াই করতে। গোড়াতে দরজা বন্ধ করা চাই, তবে যদি বাঙালি জাতিকে আমরা বাঁচাতে পারি।’ আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে সম্মিলিতভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ব্যাধি বিস্তার রোধ করার উপায় বলেছিলেন কবি।

আরো এক জায়গায় তিনি লিখেছেন- ‘আমরা অনেকে জানি ম্যালেরিয়া কিরকম গোপনে ধীরে ধীরে মানুষকে জীবন্মৃত করে রাখে। এ দেশে অনেক জিনিস হয় না; অনেক জিনিস আরম্ভ করি, শেষ হতে চায় না; অনেক কাজেই দুর্বলতা দেখতে পাই...পরীক্ষা করলে দেখা যায় ম্যালেরিয়া শরীরের মধ্য থেকে তেজ কেড়ে নিয়েছে। চেষ্টা করবার ইচ্ছাও হয় না।’ অর্থাৎ রোগের প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর ছিল স্পষ্ট ধারণা। তাছাড়া তখন বিশ্বভারতীর একটা ব্যবস্থা ছিল- শান্তিনিকেতনের চারিদিকে যে-সমস্ত পল্লিবসতি দেখা যেত সেগুলিকে তিনি নীরোগ রাখার জন্য বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন।

৩.
বিশ্বকবি লিখেছেন- ‘সন্ত্রাসের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।/সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ/মুক্তো করো ভয়/আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।’ বিভিন্ন সংকটে ও দুর্যোগে আমরা ‘ম্রিয়মাণ’ কিন্তু ভয়-মুক্ত হওয়ার জন্য যাঁর কাছে মানসিক শক্তি পেতে পারি তিনি আমাদের জীবনে আবির্ভূত সংকট নিবারণের বাঞ্চিত সঙ্গী। তিনি নিজেও আশি বছর বয়স পর্যন্ত নিজের স্ত্রী, সন্তান ও নিকটাত্মীয়দের মৃত্যুর করালগ্রাসে হারিয়ে যেতে দেখেছেন; তবে বিচ্ছেদ ও একাকিত্বের গভীর বেদনাকে অন্তরে ধারণ করে নিজের শক্তিতে জয়ী হয়েছেন। তাঁর দু কন্যা মাধুরীলতা ও রেণুকা দেবীর হয়েছিল যক্ষ্মাতে মৃত্যু এবং ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছিল কলেরায়। অন্য কন্যা মীরাদেবীর পুত্র নীতীন্দ্রনাথের অকাল প্রয়াণও তাঁকে মর্মদাহিক বেদনায় দিশেহারা করেছিল।

তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পিতৃস্মৃতি’তে লিখেছেন- ‘ভাগ্যের উত্থান-পতন, দুঃখ কিংবা ক্লেশ কোনো কিছুই অবশ্য বাবার চিত্তের প্রশান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারত না। মহর্ষির মতই তিনিও সর্বাবস্থায় অবিচলিত থাকতেন। বেদনা যতই পীড়াদায়ক হোক না কেন, তা তাঁর ভিতরের শান্তিকে নষ্ট করতে পারত না। সবচেয়ে দুঃখের দুর্ভাগ্যকে সইবার মত এক অতিমানবিক শক্তি ছিল তাঁর।’

এর কারণ হলো তিনি ছিলেন বিশ্বের তাবৎ মানুষের ঐক্যবদ্ধতায় বিশ্বাসী। তিনি ভেবেছেন- ‘মানুষের মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ নেই, সমস্ত মানুষ এক। মানুষের সমাজে একজনের পাপের ফলভোগ সকলকেই ভাগ করে নিতে হয়; কারণ, অতীতে ভবিষ্যতে, দূরে দূরান্তে, হৃদয়ে হৃদয়ে, মানুষ যে পরস্পর গাঁথা হয়ে আছে।...যে পাপের ভার এতদিন নানা স্থানে নানা জনে জমাইয়া তুলিতেছিল, তাহারই আঘাতে রুদ্র আজ জাগ্রত হইয়াছেন-দেবতার ও মানবতার অপমান তিনি সহ্য করিতে পারিতেছেন না।’

রুদ্রের রোষেই আজ করোনা মহামারিতে এত মৃত্যু, এত ঝড়-ঝঞ্ঝা; এই মৃত্যু মানবেরই পাপের প্রায়শ্চিত্ত। তাই নতুন বন্দরে নোঙর করতে হলে সে মৃত্যুকেও বরণ করতে হবে; সে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে অকম্পিত বুকে বলতে হবে- ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।/তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,/বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।/...নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ।’

২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে একদিকে যুদ্ধের মৃত্যুভীতি অন্যদিকে উষ্ণ প্রকৃতির অসহনীয়তার পর সতেজ ও অবিনশ্বরতায় প্রাণের নিত্যধারা প্রবহমান। এই কঠিন ও সহজ সময়ে আনন্দ-বেদনা, মিলন-বিরহ, আগমন-বিদায় আর পুনরাগমন-পুনর্মিলনের খণ্ডাংশের যাপিত-জীবনে এসেছে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী- যা উজ্জ্বলতর মুহূর্তগুলোর একটি। আর দুর্যোগ, দুর্বিপাকে তাঁকে স্মরণ করেই আমাদের শান্তি ও আনন্দ লাভ সম্ভব।

৪.
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের সংকটে মৃত্যু, যন্ত্রণা ও দুঃখ-কষ্টে আমরা যেমন রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করছি তেমনি যারা মানবতার সেবায় নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছেন কিংবা মানুষের ধর্ম পালন করছেন তাদেরও সম্মান জানাচ্ছি বিশ্বকবির ভাবনা দিয়েই। রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘যা আমাদের ত্যাগের দিকে, তপস্যার দিকে নিয়ে যায় তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম।’ ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন-‘মানুষ বিষয়বুদ্ধি নিয়ে নিজের সিদ্ধি অন্বেষণ করে। সেখানে ব্যক্তিগত জীবনযাত্রানির্বাহে তার জ্ঞান, তার কর্ম, তার রচনাশক্তি একান্ত ব্যাপৃত।

সেখানে সে জীবরূপে বাঁচতে চায়। তাঁর আরো এবটি দিক আছে যেখানে ব্যক্তিগত বৈষয়িকতার বাইরে। সেখানে জীবনযাত্রার আদর্শে লাভ-ক্ষতির বিচার করে না বরং অনিশ্চিত কালের উদ্দেশে আত্মত্যাগ করতে চায়। সেখানে স্বার্থের প্রবর্তনা নেই। আপন স্বতন্ত্র জীবনের চেয়ে যে বড়ো জীবন সেই জীবনে মানুষ বাঁচতে চায়।’ রবীন্দ্রভাষ্য মতে, আত্মত্যাগী মানুষই মনুষ্যত্বের দিশারি। তারাই এই বিশ্বজগতকে সংকট থেকে রক্ষা করতে পারে। মহামারির সংকটে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

৫.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের প্রারম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলেন আধুনিক সভ্যতার দান হলো ইউরোপের অন্তরের সম্পদ। কিন্তু পৃথিবীর সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ দেখে ৮০ বছর বয়সে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে যায় তাঁর। ‘তবু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’ সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করে গেছেন তিনি। ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে আশা করেছিলেন- ‘মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে।

আর-একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান মনে করি। এই কথা আজ বলে যাব, প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে; নিশ্চিত এ সত্য প্রমাণিত হবে...। ‘অপরাজিত মানুষে’র জয় আর ‘প্রবলপ্রতাপশালীর ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা’র অবসান যে সত্য হবে সে কথা মৃত্যুর ঠিক আগে বলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রত্যাশা করেছিলেন ‘মানব-অভ্যুদয়ে’র মধ্য দিয়ে নতুন জীবনের। লিখেছেন- ‘অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত/ধূলিতলে হয়ে যাবে ভগ্ন।/ নবজীবনের আশ্বাসে।/ জয় হবে মানব-অভ্যুদয়।’

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় মানবপীড়নের মহামারি দেখেছিলেন। দেখেছিলেন মানুষে মানুষে যে সম্বন্ধ সবচেয়ে মূল্যবান এবং যাকে যথার্থ সভ্যতা বলা যেতে পারে তার কৃপণতা ভারতীয়দের উন্নতির পথ সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে দিয়েছিল। দেখেছিলেন পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর বর্বরতা জাগ্রত হয়ে উঠে মানবাত্মাকে অপমানে নিঃস্ব করে দেবার ঘটনাও। তিনি নিভৃতে সাহিত্যের রসসম্ভোগের উপকরণের বেষ্টন থেকে বেরিয়ে এসে ভারতবর্ষের জনসাধারণের নিদারুণ দারিদ্র্য সচক্ষে দেখেছেন। অন্ন-বস্ত্র-পানীয়- শিক্ষা-আরোগ্য প্রভৃতি মানুষের শরীরমনের পক্ষে যা-কিছু অত্যাবশ্যক তার নিরতিশয় অভাব দেখে তিনি আধুনিক-শাসনচালিত ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি রুষ্ট হয়েছেন।

জনসাধারণের প্রতি ব্রিটিশদের অপরিসীম অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদাসীন্য ছিল বলেই বাংলায় সংক্রমিত কলেরা ও ম্যালেরিয়া মহামারিতে তাঁর ভূমিকা ও দিক-নির্দেশনা পূর্বে উল্লিখিত ‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থে যথার্থভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরের সময়টিও ছিল মানবসভ্যতার এক সন্ধিক্ষণ। সেসময় মানবসভ্যতার পরিবর্তনের রূপ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন কবি। সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের পতন চেয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধনতন্ত্র গণতন্ত্রের সঙ্গেই পথ ধরে চলেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে কবির শঙ্কিত মন বারবারই বিশ্বের মানুষকে সচেতন করার জন্য উদগীব হয়েছে। এজন্যই ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ ও আত্মতৃপ্তির পরিধি থেকে মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন- ‘মানুষ আপন উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিসীমাকে পেরিয়ে বৃহৎমানুষ হয়ে উঠছে, তার সমস্ত শ্রেষ্ঠ সাধনা এই বৃহৎমানুষের সাধনা। এই বৃহৎমানুষ অন্তরের মানুষ। বাইরে আছে নানা দেশের নানা সমাজের নানা জাত, অন্তরে আছে এক মানব। ইতিহাসে দেখা যায়, মানুষের আত্মোপলব্ধি বাহির থেকে অন্তরের দিকে আপনিই গিয়েছে, যে অন্তরের দিকে তার বিশ্বজনীনতা, যেখানে বস্তুর বেড়া পেরিয়ে সে পৌঁচেছে বিশ্বমানসলোকে।’

সংকীর্ণ মানসিকতা দিয়ে পৃথিবীর মঙ্গল করা যায় না। জীবনকে সার্থক করার জন্য প্রয়োজন বিশ্বজনীন কর্মপ্রয়াস। সকল মানুষের মধ্যে ঐক্যসূত্র গাথাই হলো বিশ্বজনীনতা। মানুষ ব্যক্তিগত সীমাকে অতিক্রম করতে পারলেই তার বিশ্বমানব সত্তা চিহ্নিত হয়। ব্যক্তিগত মানুষ নয়, সে বিশ্বগত মানুষের একাত্ম। দেশকালগত সংকীর্ণ পার্থক্যের দিকে মনোযোগ না দিয়ে মানব সভ্যতার সমস্যাকে সমগ্র মানবের সত্য বলে জানতে হবে। চেষ্টা করতে হবে তা থেকে উদ্ধারের।

কবির মতে, ‘মানুষ আপনাকে জেনেছে অমৃতের সন্তান, বুঝেছে যে, তার দৃষ্টি, তার সৃষ্টি, তার চরিত্র, মৃত্যুকে পেরিয়ে। মৃত্যুর মধ্যে গিয়ে যাঁরা অমৃতকে প্রমাণ করেছেন তাঁদের দানেই দেশ রচিত। সব মানুষকে নিয়ে; সব মানুষকে অতিক্রম করে, সীমাবদ্ধ কালকে পার হয়ে এক-মানুষ বিরাজিত।’ এই যে দেশকালপাত্র ছাড়িয়ে মানুষের বিদ্যা, মানুষের সাধনা সত্য হয়ে ওঠা এখানেই মানবধর্মের সারকথা নিহিত। ‘মানুষ এক দিকে মৃত্যুর অধিকারে, আর-এক দিকে অমৃতে; এক দিকে সে ব্যক্তিগত সীমায়, আর-এক দিকে বিশ্বগত বিরাটে। এই দুয়ের কোনোটাকেই উপেক্ষা করা চলে না।’ তবে প্রবৃত্তিতাড়িত মানুষ কখনও বিশ্বজীবনের জন্য কিছু করতে পারে না। এজন্য দরকার আত্মত্যাগী মানুষ যার আত্মগৌরব নেই।

৬.
মূলত জলবায়ুর উষ্ণতা কিংবা যুদ্ধের মহামারিতে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট ও সভ্যতার বিপর্যয় মোকাবেলা করার জন্য আমরা বিশ্বকবির জন্মদিনে তাঁর রচনা থেকেই আতঙ্ক ও কষ্ট দূর করার রসদ পাচ্ছি। তিনি যেন এসব সংকটে ঠেলে ভাঙনের পথে এসেছেন পৃথিবীকে রক্ষা করতে। কারণ মৃত্যুভীতিতেও আমরা মনে করি তাঁর কথাই সত্য- ‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’… ‘আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।’

মারণঘাতি ভাইরাসের মধ্যে তাঁর প্রকাশ সূর্যের মতো কুহেলিকা উদঘাটন করছে। ভয়কে জয় করার জন্য রিক্ত, ব্যর্থ, শূন্য মানুষকে বিস্ময়ে তিনিই উজ্জীবিত করছেন আজও। ২৫ বৈশাখে লেখা তাঁর নিজের কবিতাতেও সেই অভিব্যক্তি- ‘তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন/সূর্যের মতন।/ রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন।/ ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,/ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময়।’ অসীমের চিরবিস্ময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজকের পৃথিবীতেও স্মরণীয়।

লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email: [email protected]

;