মেসার্স গঘ ব্রাদার্স



শফিকুল কবীর চনদন
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

‘তুমি ছাড়া সত্যিই আমার কোনো বন্ধু নেই, এবং অসুস্থ হলেও তুমি সর্বদাই আমার ভাবনা জুড়ে থাকো।’১

কী ছিল ভ্যান গঘের অনুপ্রেরণা? কিভাবে তিনি আধুনিক চিত্রশিল্পী হিসাবে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন? কারা তাঁর এই যাত্রার সহযোগী ছিলেন? তিনি তাঁর বহুবিধ সীমাবদ্ধতাকে কিভাবে অতিক্রম করেছিলেন? তিনি কি ভাগ্যবান প্রেমিক বা চিত্রশিল্পী ছিলেন? এমনই নানাবিধ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে ভিনসেন্টের এই নাতিদীর্ঘ জীবনজুড়ে খানাতল্লাশী দেওয়া যায়।

বিশ্ব-শিল্পের ইতিহাসে সবচে দৃঢ় ভ্রাতৃত্ব ‘ভ্যান গঘ ভাই’। একদিকে এক ছাদের নিচে ভ্ৰাতৃদ্বয়ের বসবাস যখন বিরক্তির চরমে তখনও বড়ভাই ভিনসেন্টের অনুপস্থিতি থিও’র কাছে অকার্যকর ও অসম্পূর্ণ যাপন হয়ে উঠেছিল। অবিচল পত্রালাপ আমাদের দেখিয়ে দেয়, তাঁরা শারীরিক সংস্থানে পৃথক হলেও সর্বদাই তাঁদের জীবনের জমা খরচের হিসাব নম্বর যেন যৌথই ছিল।

‘পরস্পরের কাছে আমাদের একনাগাড়ে চিঠি লিখে যেতে হবে।’২

থিও ছিলেন ভিনসেন্টের সর্বশ্রেষ্ঠ সমর্থক। উভয় ভাইয়েরই ছিল অস্থির জীবনযাপন। তাঁদের সম্পর্কের পরতে পরতে দৃষ্টি দিলে যে কারো চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠতে বাধ্য। তা আনন্দ বেদনার এক সমূহ তাৎপর্যে। সর্বকালের অন্যতম সেরা চিত্রকর হয়েও তিনি ছিলেন উদ্বেগাকুল ও বিষণ্ণ। তার সময়ে অনালোচিত। প্রথাগত প্রজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করেই তারা যে লড়েছিলেন সেসব নির্যাস নিয়েই একটি অভিসন্দর্ভ হয়ে ওঠে। থিও ভাইদ্বয়ের গল্প ছাড়া যা অসম্পূর্ণ।

এক ‘গঘ’ ঋণদাতা আরেক ‘গঘ’ ঋণ গ্রহীতা। একজন চিত্রকলা ব্যবসায়ী আরেকজন চিত্রকর্ম নির্মাতা। কেনা বেচার হিসাব মাথায় রেখেই যত আগাম দেনা পাওনা ‘গঘ ব্রাদার্সের’। যদি এই ব্যবসায় লক্ষ্মী হতো তাহলে গোপীল এন্ড কোং গঘ ব্রাদার্সে রূপ নিতে পারত! তবে এই ‘মেসার্স গঘ ব্রাদার্স’ তাদের অব্যবসায়িকতার শিল্পঋণ দিয়ে অনাগত ভবিষ্যত্বের জন্য দুনিয়াকে যে ঋণে আবদ্ধ করেছেন তা বলাই বাহুল্য।

সম্প্রতি এক গবেষণার হিসাবে দেখা যায় অনুজ ভ্রাতঃ থিও তাঁর জীবদ্দশায় আনুমানিক ১৮০০০ ডলার ভিনসেন্টের জন্য অকাতরে খরচ করেছেন। যার পুরোটাই সহায়তার মোড়কে। অসাধারণ তাই না? আমরা যদি আজকের মুদ্রাস্ফীতির হিসেবে কষে দেখি তাহলে সে অঙ্ক দাঁড়ায় চার লক্ষ ডলারের কাছাকাছি। আমরা এখানে সেই সত্যিকার ভ্রাতৃত্বের ভালোবাসার বন্ধনের কথাই আলাপে নিচ্ছি। অবশ্যই থিও সব সময় আলাপে এই অর্থকে দাতব্য হিসাবে নয়—বিনিয়োগ হিসাবেই দেখেছে। কিন্তু সংবেদনটা হলো, এমন ভাইয়ের সন্ধান সহজলভ্য নয় নিশ্চয়ই যে কিনা শিল্পলগ্নি থেকে অর্থ সমাগমের সম্ভাবনা নেই জেনেও ‘বিনিয়োগে’ ব্রতী হয়।

‘আমার কাজের অর্থমূল্য আছে কিনা সে বিষয়ে বলতে চাই যে, আমাকে তা খুবই বিস্মিত করবে যদি অন্যদের কাজের মতো আমার আঁকা ছবিগুলিও সময়মত  বিক্রয়যোগ্য হয়ে না ওঠে, ব্যাস এর বেশি আমার আর কোনো ভড়ং নেই।’৩

একসময় গঘ ভাইদের যৌথ প্রকল্প হিসাবেই ভিনসেন্টের চিত্রশিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠাকল্পে থিও মানসিক, আর্থিক, শিল্প পরামর্শক হিসাবে স্বনিয়োজিত হন। অস্বীকার করার জো নেই যে আজকের বিশ্ববরেণ্য শিল্পীর প্রতিষ্ঠার পেছনে থিও’র নিরন্তর প্রণোদনাই মুখ্য হয়ে আছে। ভিনসেন্টের কাজের উদ্ভাবনী বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করেও শিল্প-ব্যবসায়ী থিও কোনো সংগ্রাহককেই উৎসাহী করে তুলতে না পারার ব্যর্থতা সত্ত্বেও, ছবি বিক্রি করতে না পারার অযোগ্যতা সত্ত্বেও নিঃসন্দেহে থিওই ভিনসেন্টের এক নম্বর সমর্থক হয়ে হাজির থেকেছেন সারাজীবন।

দুই দশকের চ্যালেঞ্জ-মুখর সময়ের মধ্যে দুই ভাইয়ের লেখা অসংখ্য চিঠি। ভিনসেন্টের হৃদয়ের কোরক থেকে উৎসারিত পত্রপুঞ্জের অধিকাংশ এমনকি আসন্ন মৃত্যুর অব্যাবহিত পূর্বে লেখা পত্রটিরও প্রাপক ছোটভাই থিও। থিও তাঁর ভাইয়ের হৃদয় নিঙড়ানো এসব শিকড় সমাচারের প্রাপক। ভিনসেন্ট নিজেরই গরজে তার অন্তর্জীবন ব্যক্ত করেছিলেন ভাই থিওর কাছে।

‘তোমার কাছে সেসব সুযোগ পেয়েছি তার সমতুল্য তত ভালো ছবি আমি এখনো এঁকে উঠতে পারিনি। কিন্তু বিশ্বাস করো, একদিন যদি সেটা করে উঠতে পারি তাহলে যেন তুমিও তাদের রচনা করেছো, কেননা আমরা দুজনেই সেসব ছবি এঁকে তুলেছি।’৪

‘থিও এই প্রশংসার উপযুক্ত পাত্র; নিজেকে করে তুলেছিলেন নিমিত্ত মাত্র আধার। সেজন্যেই ভাইয়ের শতপ্লাবী সৃষ্টির শরিক হিসেবে নিজেকে কখনোই দাবি করেননি। একমাত্র অহংকার ছিল তার; ভিনসেন্টের কাছ থেকে তিনি যত চিঠি পেয়েছেন এমন সৌভাগ্য আর কারো হয়নি।’৫

ভাই ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের জীবন ও রচনার ভাণ্ডারী হবার অধিকার তারই। ১৮৭৩ সাল থেকে পত্র বিনিময় ভাইয়ের সাথে। আত্মবিশ্বাসের বুনিয়াদ গড়ে ওঠে সেই থেকে ধীরে ধীরে। আর কখনো যে বনিবনার কোনো পরোয়াও করেনি তার লক্ষণও আছে পত্র চালাচালিতে। থিও মনে করেছিলেন তার ভাইয়ের মধ্যে দুটি পরস্পর বিরোধী সত্তা বিরাজিত—‘একজন বিস্ময়কর প্রতিভাদীপ্ত, পরিমার্জিত, দয়ালু এবং অন্যজন স্বার্থপর ও অনুভূতিহীন।’

কিন্তু ভিনসেন্ট তার জীবনের সমুদয় কর্জ করেছেন ভাই থিও’রই কাছ থেকে। তিনি প্রশান্তির জন্য মাথাও গুঁজেছেন ভাইয়েরই মমত্বের কাছে তার মুরোদকে ফিরিয়ে আনতে।

গরিমা, লালসা, ছলনা ছিল না, দুর্ভাগার পরনির্ভরশীলতার আশ্রয় যেমন হয়, তেমনি খ্যাতি, অর্থলিপ্সার জন্য নয়, এক অনন্যোপায় ভাবি-চিত্রীর মর্ম প্রকাশের একমাত্র উপায় হয়ে ওঠেন থিও। সেও নিষ্কলুষ ভ্রাতৃপ্রেম চিত্ত বিজড়িত পরিপূর্ণ অনুভব সাদা-নীল-হলুদের তারা ভরা রাতের মাহাত্ম্যকে রঙ চুবিয়ে টাঙিয়ে দেন ভবিষ্যতের প্রদর্শন দেয়ালে।

‘জীবনে কোনো মহৎ ঘটনায় আকস্মিকভাবে ঘটতে পারে না, তাকে ইচ্ছাশক্তিতেই ঘটাতে হয়।’৬

গঘ ভাইদ্বয় তাঁদের জবানে চিত্রশিল্পের সাথে ভ্রাতৃত্বের সহযোগিতার এমন এক প্রবল শক্তি ও আকর্ষণ দান করেছেন যা অনাগত ভবিষ্যৎ জুড়ে অসংখ্য শিল্পপ্রেমীদের হৃদয়কে আলোড়িত করবে।

ভিনসেন্টের জীবন-গগন জুড়ে নিনাদিত রং রেখার অবয়বচিত্রের থিও—বাস্তবের মনোজগতের মোহনচিত্র আঁকানোরও কারিগর। ভিনসেন্টের জীবনানুসন্ধান যে মগ্ন চৈতন্যের গভীরে তার কিনার ঘেঁষে অবস্থান থিও’র। রক্তক্ষরণের দাগে প্রকৃতি এঁকেছেন ভিনসেন্ট, তার ভাইকে এঁকেছেন শত শত পত্রের অসংখ্য বর্ণ  শব্দ ও বাক্যের মোহনীয় বিস্তারে।

‘আমার আশা তোমার সাহায্য ও সহানুভূতি কোনোভাবেই প্রত্যাহৃত হবে না এবং আমরা ভ্রাতৃত্ববোধে একে অপরের হাত ধরে থাকব বরাবরের মতো, যতই থাকুক না কেন সেসব জিনিস “জগৎ” যাদের বিরোধিতা করে।’৭

থিও ভিনসেন্টের আশ্রয়ের প্রতীক। প্রশ্রয়ের নীড়। প্রেমের জানালা। ক্ষরণের দাগ মেখে জীবনকে চেতনার সামর্থ্যে বাগে রাখার দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে, নিজেদের বোধ ও উপলব্ধির জাগরণে।

আর্থিক শূন্যতায় হাত রেখে প্রকরণে চোখ রেখে এঁকেছেন ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ। সহনস্বরের প্রত্যয়ে লেখা পত্র থিওকে, অথচ প্রতিকৃতি? নিজের পঁয়ত্রিশটি আত্মপ্রতিকৃতির সন্ধান পাওয়া গেলেও থিওকে এঁকেছেন মাত্রই একবার। যা আবার আবিষ্কৃত হয়েছে ২০১১ সালে। এতদিন যা আত্মপ্রতিকৃতি হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছিল। কেন প্রতিকৃতি রচনায় থিও বিষয় হয়ে উঠে আসেনি? নাকি নিজেকে আরো পরিশীলিত করে থিওকে আঁকার কোশেশের বাসনা ছিল?

‘তোমার আন্তরিক সাহায্য যতটুকুই পাই না কেন, তা আমি যতটা ভালো করে পারি কাজে লাগাব, কাজে উন্নতি ঘটাবার জন্য আমি সর্বাধিক প্রচেষ্টা চালাব।’৮

গঘ ভাতৃদ্বয়ের সজীব ধারাভাষ্য তাঁদেরই মর্জির নিরীক্ষণের অনপনেয় স্বাক্ষর। তাতে সম্পর্ক জড়িয়ে রাখার মেহন্নত আছে। যা একজনকে টপকে গিয়ে আরেকজনকে প্রত্যক্ষ করার জো নেই। আছে বিবেকের যথোচিত প্রশ্রয়ের দাগ। যা মুদ্রিত হয়ে থাকে ভ্রাতৃপ্রেমের উজ্জ্বলতার আখরে। তাঁর শিল্পেরই মতো ভাই সম্পর্কের সমস্ত পূর্বধার্য্য সীমানাকে মানবিক উচ্চতায় সম্পর্কের অপাপবরণে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে স্থাপন করেন।

নিজেকে তিনি কোনোদিন সস্তা শ্রমে বিক্রয় করেননি। যদিও তাঁর সাধ ছিল চিত্রিত আলেখ্য যেভাবেই হোক বিক্রিবাট্টা করে আহার সংস্থান। এমনই ছিল তাঁর মর্জি। সৃষ্টিরাও তো চূড়ান্ত মর্জি মাফিক। তাঁর গোটা জীবন জুড়ে মেহন্নতের অনপনেয় স্বাক্ষর। শিল্পের নতুন ধারার পূর্বগামী হতে গিয়ে পত্রলেখক, ভ্রাতৃপ্রেম, সহোদরের সাথে চুক্তি, এসবই আসলে আপাত অস্থিরচিত্তের মানুষটার সৃষ্টিকাজের বৈভব মেনে নেওয়ার পথে অন্তরায় নয়।

‘....আঁকাচর্চা আরো আন্তরিকভাবে যদি করতে পারি সেটাই হবে বেশি কাজের, অন্তত তাঁর ওইসব বিক্রিযোগ্য অবিক্রিযোগ্য ইত্যাদি কথাবার্তার চাইতে কাজের কাজ। ওইসব বিক্রিটিক্রি ব্যাপার নিয়ে তাঁর যা মনে হচ্ছে সেসব জ্ঞান ট্যান আমার না শুনলেও চলবে।’৯

চিত্রকলা সমঝদার ব্যবসায়ী হয়েও থিও’র—ভাইয়ের প্রতি পক্ষপাত তো ছিলই, উপরন্তু যৌথ জীবন কারবারের এক প্রতিনিধির প্রতি ভালোবাসার শক্তির এক অন্তর্গত প্রবর্তনাও কি থিও’র দান নয়? ফলে এসব বাণিজ্য কায়কারবার ছাপিয়ে সহানুভূতি সেখানে কালান্তরে প্রসারিত হয়ে গিয়েছে। ফলত ‘মেসার্স গঘ ব্রাদার্স’-এর শিল্প পূর্বধার্য্য সীমানা চুরমার করে দিয়ে আত্মিক শিল্পায়নের দিকে তাঁদের যাত্রাপথের নিশানা সাব্যস্ত করেন।

‘প্রিয় ভাই, এটা তোমার কাছে পরিষ্কার করে দেওয়া ভালো যে, তোমার বিশ্বস্ত সাহায্যের জন্য কত দৃঢ় ও তীব্রভাবে অনুভব করি যে তোমার কাছে আমি বিশালভাবে ঋণী।’১০

ফলে আলাদা নজর দেওয়ার কথা ওঠানোই পরিমিত জ্ঞান কেননা ঘনিষ্ঠ পরিসরে এক চিত্রকলা ব্যবসায়ী আরেক চিত্রকর্মী শরিককে কী-রকম প্রসন্ন উদ্বেগে প্রত্যক্ষ করেছেন সেদিকে আমাদের দরদ-মন যেমন আদ্র হয়, উষ্ণতায়ও ছাপিয়ে সেদিকে মন পড়ে থাকে। আর ‘গঘ ব্রাদার্স’-এর সর্বব্যাপী অস্তিত্বের সংগ্রাম ভাবসঙ্গে জেগে থাকে।

‘থিও না থাকলে আমার কাজের যথাযথ মূল্যায়ন করা কখনোই সম্ভব হতো না।’১১

ভিনসেন্টের মৃত্যুর পর থিও ভাই হারানোর বেদনায় তাঁর মৃত্যুর দায় অনুভব করেছিলেন? নিজেকে দোষী ভেবেছিলেন? একজনের গৃহী ব্যবসায়ী জীবন অন্যজনের শিল্পী জীবনের আপাত ভিন্ন জীবন হলেও গঘ ভাইদের জীবন এক সমাবৃত্তে এসে মীমাংসিত হয়ে যায়! থিও’র সমর্থন জারি থাকে। আওভারসের অদূরে বিস্তীর্ণ তৃণভূমির সবুজ কোমলে ঘেরা সমাধিক্ষেত্রে পাশাপাশি অন্তিম শয়নের মধ্য দিয়ে যৌথ যাপন, যৌথ হিসাব, যৌথ শিল্প প্রকল্প ‘মেসার্স গঘ ব্রাদার্স’-এর শহিদত্বের এজমালি স্মারক হয়ে।

কর্জ স্বীকার
০১. থিও ভ্যানগঘ, ২২ জুলাই, ১৮৮৩ হেগ
০২. ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ, ১৩ ডিসেম্বর ১৮৭২
০৩. ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ, জুলাই ৩১, ১৮৮২ হেগ  
০৪. ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ, পত্র সংখ্যা ৫৩৮
০৫. ট্রুডবার্টা দাশগুপ্ত, আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত
০৬. ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ
০৭. ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ, মে ১৮৮২, হেগ
০৮. ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ, মার্চ ১৮৮৩, হেগ
০৯. ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ, মার্চ ১৮৮২, হেগ
১০. ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ, মার্চ ১৮৮৩, হেগ
১১. ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ, অক্টবর ১৮৮৭, প্যারিস

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;