গ্রন্থ পর্যালোচনা: “অ-জনগণকরণের” রাজনৈতিক অর্থনীতি



ড. মতিউর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে গণমানুষের অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত রচিত গবেষণাগ্রন্থ ‘“অ-জনগণকরণের” রাজনৈতিক অর্থনীতি: বাংলাদেশে ৫০ বছরের রাষ্ট্রীয় বাজেটে পারিবারিক কৃষি, গ্রামীণ নারী, আদিবাসী মানুষ ও ভূমি সংস্কার’। দেশ ও দেশের বাইরে বরেণ্য এই অর্থনীতিবিদ ও গবেষক তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “ধারণা হিসেবে “অ-জনগণ” এখনও পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় স্পষ্ট ধারণা নয়। সমাজ বিশ্লেষণে “অ-জনগণ” ধারণাটি এখনও পর্যন্ত খুব একটা স্বীকৃত নয়। অথবা বলা চলে ব্যাখ্যায়িত নয়।

এসবের বিপরীতে আমাদের ধারণা হলো সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র-এর বিবর্তন ও বিকাশ বিশ্লেষণে সমাজবদ্ধ মানুষের বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতা-বিচ্ছিন্নতার বহুমুখী রূপ ও মাত্রা অনুসন্ধান বেশ কার্যকর ফল দিতে পারে। এসব বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতা-বিচ্ছিন্নতা যে সমাজে বিধিবদ্ধ রূপ পরিগ্রহ করে সে সমাজে সংশ্লিষ্ট মানুষ―ব্যক্তি হিসেবে এবং সমাজবদ্ধ গোষ্ঠী হিসেবে―জনগণ নন। তারা অ-জনগণ। আর “অ-জনগণকরণ” অথবা একই কথা “অ-জনগণীকরণ” হলো সে প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট মানুষের বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতা-বিচ্ছিন্নতা বিধিবদ্ধ রূপ পরিগ্রহ করে এবং এসবের গতি হয় ঊর্দ্ধমুখী (সরকারি—আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান যাই-ই বলুক না কেন)।”

স্বনামখ্যাত গবেষক ড. আবুল বারকাত উল্লেখ করেছেন, “এই গ্রন্থে বড় মাপের দু’টো কাজ করতে হয়েছে। প্রথম কাজটি হলো—“অ-জনগণ” ধারণাটি সুসংহত করা; এবং তার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সারবত্তা উদ্ঘাটন করা। গ্রন্থ রচনার প্রক্রিয়ায় বহুবার পরীক্ষা-নীরিক্ষাপূর্বক “অ-জনগণ” ধারণাটি পরিবর্তন-পরিমার্জন করতে হয়েছে। আর দ্বিতীয় কাজটি হলো, বিভিন্ন বৃহৎ বর্গের “অ-জনগণ” মানুষকে রাষ্ট্র—সরকার কোন দৃষ্টিতে দেখেন—সেটা উন্মোচন করা। দ্বিতীয় কাজটি করা হয়েছে গত ৫০ বছরের জাতীয় বাজেটে বৃহৎ বর্গের “অ-জনগণ” মানুষের হিস্যার বির্বতন ও ধারা অনুসন্ধান করে। একই সঙ্গে করা হয়েছে “অ-জনগণ” মানুষের “জনগণকরণ” রূপান্তরে জাতীয় বাজেটে ন্যায়সঙ্গত-ন্যায্য হিস্যা কী হতে পারে এবং কেন—সেসবেরও ব্যাখ্যা—বিশ্লেষণ।”

তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, “এ কাজটি সম্পন্ন করতেই মনে হলো ওইসব মানুষের জন্য রাষ্ট্র-সরকার তাদের জাতীয় বাজেটে কী বাবদ—কতটুকু (কী পরিমাণ) ব্যয়-বরাদ্দ দেয় সেটা দেখা দরকার। একপর্যায়ে মনে হলো, এসবের প্রবণতা দেখা জরুরি। আর সে ক্ষেত্রে কোনো এক/দুই বছরের জন্য নয় বিষয়টি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘমেয়াদে দেখা দরকার। এভাবেই সিদ্ধান্ত নিলাম যে সম্ভব হলে স্বাধীনতাপরবর্তী বিগত ৫০ বছরের জন্য এসব দেখব। এই সিদ্ধান্ত নেবার সময় জানতাম যে প্রযোজ্য পদ্ধতিতত্ত্বসহ ৫০ বছরের হিসেবপত্তরের কাজটিই হবে একমাত্র চ্যালেঞ্জ। কিন্তু কাজে নেমে দেখলাম যে বিগত ৫০ বছরের সংশ্লিষ্ট সব বাজেট দলিল-দস্তাবেজ পাওয়াটাই এক দুরূহ কাজ।”

অধ্যাপক আবুল বারকাত লিখেছেন, “এই গ্রন্থে অ-জনগণকৃত চারবর্গের মানুষের জন্য বিগত ৫০ বছরের বাজেটীয় হিসেবপত্তর উত্থাপন ও বিশ্লেষণ করেছি। এ ক্ষেত্রে পর্বতসমান চ্যালেঞ্জ দেখা দিল তখন, যখন আমরা বিগত ৫০ বছরের বাজেটে প্রত্যেক বছরের জন্য উন্নয়ন বাজেটের আওতাধীন প্রকল্প/কর্মসূচি ধরে ধরে এসবের কোনটা-কীভাবে-কতটুকু আমাদের অনুসন্ধানউদ্দিষ্ট চার বর্গের (পারিবারিক কৃষি, গ্রামীণ নারী, আদিবাসী, ভূমি সংস্কার) সাথে সম্পর্কিত সেসব হিসেবপত্তরে হাত দিলাম। এ সম্পর্কে পদ্ধতিগত কোনো প্রাক্-ধারণা না থাকার কারণে সংশ্লিষ্ট ধারণা বিনির্মাণে একমাত্র উপায় ছিল নিজের মস্তিষ্ক।”

ড. বারকাত উল্লেখ করেছেন, “রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী দলিল হিসেবে আমাদের সংবিধান সবধরনের বঞ্চনা থেকে মানুষকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়। এই প্রতিশ্রুতি কার্যকর হলে মানুষের দারিদ্র্য-বঞ্চনা-অসমতা দূর হবার কথা। কিন্তু গত ৫০ বছরের সমাজ ইতিহাস বলে―তা হয়নি। বিভিন্ন ধরনের দরিদ্র-বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অসমতা। এমনকি সরকারি পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে হিসেবকৃত ক্রমবর্ধমান গিনি সহগ এবং পালমা অনুপাত দিয়ে এসবের পরিমাণগত দিকও উপলব্ধি করা যায়।”

এই গ্রন্থের দু’টি অংশ। প্রথম অংশের শিরোনাম “অ-জনগণকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতি: একটি বিভাবনা”। গ্রন্থের এই অংশটিকে অ-জনগণকরণ-এর রাজনৈতিক অর্থনীতি বিশ্লেষণের পদ্ধতিতত্ত্ব বলা চলে। মানুষের “অ-জনগণকরণ” বলতে যা বুঝায় সে-সবের শবব্যবচ্ছেদই গ্রন্থের প্রথম অংশের মর্মবস্তু।

এই গ্রন্থের প্রথম অংশে “অ-জনগণকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতি”-সংশ্লিষ্ট চিন্তাভাবনায় যুক্তিপরম্পরা যেসব বিষয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে তা নিম্নরূপ: ক. অ-জনগণকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতির মর্মবস্তু; খ. অ-জনগণ হলো সংবিধান অমান্য-উদ্ভূত মানুষ; গ. পারিবারিক কৃষিকাজে নিয়োজিত কোনোমতে বেঁচে থাকা মানুষ—অ-জনগণ; ঘ. গ্রামীণ নারীরা অ-জনগণ (এর অর্থ এই নয় যে শহর/নগরের নারী অ-জনগণ নয়); ঙ. আদিবাসী মানুষ—অ-জনগণ; চ. কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার-উদ্দিষ্ট মানুষ‒অ-জনগণ; ছ. প্রত্যক্ষ ‘দাস’ ও দাসতুল্য মানুষ—‘অ-জনগণ’; তারা ‘মানুষ’ পদবাচ্য কি-না সেটাও প্রশ্ন।

গ্রন্থের প্রথম অংশে “অ-জনগণকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতি” নিয়ে যা বলতে চেষ্টা করা হয়েছে, তাই-ই গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশের পদ্ধতিতত্ত্বীয় ভিত্তি বা কাঠামো। বাস্তব জীবনে “অ-জনগণকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতি” কোথায়, কতটুকু, কীভাবে বিদ্যমান ও দৃশ্যমান সেসবই গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশে অনুসন্ধান করা হয়েছে। এবং সেটা করা হয়েছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। আর তা করা হয়েছে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় (জাতীয়) বাজেটে কয়েকটি বড় বর্গের অ-জনগণকে মাথায় রেখে। এসব বড় বর্গের মধ্যে আছেন পারিবারিক কৃষির সাথে সম্পর্কিত মানুষ, গ্রামীণ নারী, আদিবাসী মানুষ এবং কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার-উদ্দিষ্ট মানুষ । চারবর্গের এসব মানুষ-ই সংখ্যাগরিষ্ঠ―দেশের মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ।

অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, সেইসব মানুষ এবং গোষ্ঠী অ-জনগণ, যারা রাষ্ট্রে রেডারের বাইরে “বহিঃস্থ”, “অন্যজন” , যারা হিসেবের খাতায় অন্তর্ভুক্ত নন, যারা গণনার বাইরে, যারা নাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন-উচ্ছেদিত, সমূলে উৎপাটিত, নির্বংশ। ঐতিহাসিকভাবে এহেন অ-জনগণ—এর “বিশুদ্ধতম রূপ” হলো দাসব্যবস্থার “দাস”; পরবর্তীকালে অ-জনগণ হলো সামন্তবাদী ব্যবস্থায় “প্রজা কৃষক”, আর পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় “মজুরি শ্রমিক”। দাসব্যবস্থার “দাস” হলেন “বিশুদ্ধতম অ-জনগণ” আর আধুনিক যুগের এখনকার “অ-জনগণ” হলেন “মুক্তির প্রলেপযুক্ত দাস” ।

তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, দেশের মানুষের মধ্যে যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিরন্তর বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতার শিকার একই সাথে যা দেশের আর্থসামাজিক কাঠামো সৃষ্ট তারাই অ-জনগণ প্রক্রিয়াভুক্ত। এ দৃষ্টিতে গুটিকয়েক লুটেরা-পরজীবী-রেন্টসিকার ও তাদের সহযোগীরা ছাড়া সবাই সম্ভাব্য অ-জনগণ। আর সম্ভাব্য অ-জনগণদের মধ্যে সম্ভবত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ও গোষ্ঠীই হবেন নিরঙ্কুশ অ-জনগণ। নিরঙ্কুশ অ-জনগণকৃত এসব মানুষের কোনো তালিকা নেই, তবে তা হবে অনেক দীর্ঘ—বিস্তৃত।

গবেষণাকাজের সুবিধার জন্য নিরঙ্কুশ অ-জনগণকৃত এত ব্যাপক, বিস্তৃত ও বহুমুখী অ-জনগণকৃত মানুষদের গবেষক চারটি বৃহৎ বর্গে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন; (১) পারিবারিক কৃষিসংশ্লিষ্ট মানুষ, (২) গ্রামীণ নারী, (৩) আদিবাসী, ও (৪) কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারউদ্দিষ্ট মানুষ। গবেষক বারকাত উল্লেখ করেছেন সুনির্দিষ্ট ধরনের নিরঙ্কুশ অ-জনগণ মানুষ প্রস্তাবিত চার বৃহৎ বর্গের এক বা একাধিক-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং সম্পর্ক জালটি জটিল।

অনুসন্ধিৎসু গবেষক ড. বারকাত তাঁর গ্রন্থে গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, পারিবারিক কৃষি ও সংশ্লিষ্ট মানুষ (ভূমিহীন-প্রান্তিক মানুষ, দরিদ্র-বিত্তহীন-নিম্নবিত্ত, খুদে খামারি), গ্রামীণ নারী, আদিবাসী মানুষ এবং কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারউদ্দিষ্ট মানুষ―এসব বর্গের প্রতিটির ক্ষেত্রে বিগত ৫০ বছরে জাতীয় বাজেট বরাদ্দ জনসংখ্যানুপাতে নগণ্য; প্রকৃত বরাদ্দ “স্বল্প বরাদ্দ ফাঁদ”-এ পড়ে আছে; বরাদ্দ বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। এই চারটি বর্গের মানুষই হলেন অ-জনগণ। এদের সম্মিলিতভাবে দেখলে এরা হবেন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, মোট জনসংখ্যার ৯০%। অথচ বিগত ৫০ বছরের বাজেটে এদের সম্মিলিত বরাদ্দ হবে জনসংখ্যানুপাতে ন্যায্য হিস্যার বড়জোর ১৩%, আর বাদবাকি ৮৭% তাদের বরাদ্দ দেয়া হয়নি, তা আত্মসাৎ করা হয়েছে। বিগত ৫০ বছরে সম্মিলিতভাবে এসব মানুষের জন্য বাজেট “অন্যায্যতার মাত্রা”অথবা “বৈষম্য মাত্রা” হবে ৬৬৯%। সুতরাং জাতীয় বাজেট বরাদ্দের নিরিখে এসব মানুষ একক বর্গের মানুষ হিসেবে এবং সম্মিলিতভাবে অ-জনগণ। তাহলে প্রশ্ন―“জনগণই যদি প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক” হন, সেক্ষেত্রে এই চারবর্গের মানুষ কী জনগণ?

বিগত ৫০ বছরের জাতীয় বাজেটে পারিবারিক কৃষি, গ্রামীণ নারী, আদিবাসী মানুষ এবং কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারউদ্দিষ্ট মানুষের হিস্যার হিসেবপত্র ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ যেসব প্রবণতা তিনি দেখিয়েছেন এককথায় তা হতাশাজনক। এসব থেকে উল্লেখিত চার বর্গের মানুষ (যারা দেশের ৯০% মানুষ)-এর নিরন্তর অ-জনগণকরণের-এর এক “হতাশ চিত্র” বা “ক্ষোভ-বিক্ষোভ চিত্র” বা “আক্ষেপ চিত্র” বিনির্মাণ সম্ভব। গবেষক ড. বারকাত উল্লেখ করেছেন, “আমরা প্রশ্ন করেছি অ-জনগণকৃত এসব মানুষের জনগণে উত্তরণ-রূপান্তর সম্ভব কিনা? রাষ্ট্রীয় বাজেটের নিরিখে তা সম্ভব কিনা? আমাদের উত্তর―সম্ভব। কীভাবে?”

মানব দরদী গবেষক অধ্যাপক আবুল বারকাত তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, চারবর্গের মানুষের অ-জনগণকৃত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে জনগণকৃত অবস্থানে রূপান্তরে অন্যান্য অনেক কিছুর মধ্যে রাষ্ট্রীয় বাজেট হতে পারে অন্যতম মাধ্যম। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি বর্গের মানুষের জন্য বাজেটে মাথাপিছু বরাদ্দ হতে হবে জাতীয়ভাবে মাথাপিছু বরাদ্দের তুলনায় বেশি। বিষয়টি শুধু জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ সংশ্লিষ্ট পরিবর্তনই নয় তা বাজেটের আয় উৎসে পরিবর্তন সংশ্লিষ্টও (যেমন বর্ধিত হারে সম্পদ করারোপ, বর্ধিত আয় কর, কালোটাকা উদ্ধার, অর্থপাচার রোধ ইত্যাদি)। মূল কথা হলো রাষ্ট্রীয় বাজেটের ব্যয়-বরাদ্দ ও আয়―উভয় কাঠামোকেই বৈষম্য নিরসনউদ্দিষ্ট হতে হবে। এর অন্যথা মানুষের অ-জনগণকরণের গভীরতা ও তীব্রতা বাড়াবে। ফলে অনিবার্য হবে সামাজিক সংঘাত-সংঘর্ষ। সমাধানউদ্দিষ্ট পুরো বিষয়টি রাজনৈতিক।

ড. বারকাত আরও উল্লেখ করেছেন, “রাষ্ট্রীয় বাজেটে পারিবারিক কৃষি, গ্রামীণ নারী, আদিবাসী মানুষ এবং কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারউদ্দিষ্ট মানুষের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করার বিষয়টি শেষ বিচারে বৈষম্য নিরসনউদ্দিষ্ট বাজেট বিনিমার্ণ ও তা বাস্তবায়নসংশ্লিষ্ট। আর এটাই সে প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অ-জনগণ থেকে জনগণে রূপান্তর সম্ভব, যে জনগণই হলেন “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক”।

তবে, একথা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার করলেই মানুষের অ-জনগণকরণ নিমিত্ত সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আসলে এ সংস্কার হলো ব্যাপক জনগোষ্ঠীর অ-জনগণ থেকে জনগণে রূপান্তরের প্রয়োজনীয় শর্ত , পর্যাপ্ত শর্ত নয়। পর্যাপ্ত শর্ত পূরণে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের পাশাপাশি আরো যেসব সংস্কার করতে হবে তার মধ্যে অন্যতম হলো―বস্তুগত উৎপাদন খাত (অর্থনীতির শিল্প ও সেবা খাত) এবং নৈতিক দ্রব্য উৎপাদন খাতে (সামাজিক―স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি খাত) জনকল্যাণমুখী সংস্কার। অর্থাৎ সংস্কারকাজটি হতে হবে আংশিক নয়―পূর্ণাঙ্গ-সামূহিক-সামষ্টিক। আর এ সংস্কারে রাষ্ট্রের বাজেট হবে অন্যতম ফলপ্রদ রাজনৈতিক-অর্থনীতিক নীতিকৌশলিক হাতিয়ার।”

অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত এর এই গবেষণা গ্রন্থটি জ্ঞানপিপাসু পাঠকদের জন্য নতুন জ্ঞান ও ধারণার দ্বার উম্মোচনকারী হিসেবে ইতিমধ্যেই পাঠক মহলে সমাদৃত হয়েছে। সেই সাথে উন্নয়ন নীতিনির্ধারক ও শাসনব্যবস্থা পরিচালনাকারী মহলের জন্যও গ্রন্থটি দিক নির্দেশক হিসেবে কাজ করবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। এছাড়াও দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থা যারা এই নিয়ে কাজ করছেন, গবেষক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার জন্য গবেষণা গ্রন্থটি সহায়ক হবে বলে মনে করি। সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি এমন একটি বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন যা ইতিপূর্বে আর কেউ করেছেন বলে জানা নেই।

সব্যসাচী হাজরার প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ও অলঙ্করণে দুই অংশে বিভক্ত ও পনেরোটি অধ্যায়ে সুবিন্যস্ত এই গবেষণা গ্রন্থটির পৃষ্টা সংখ্যা ২৬৫। এ ছাড়াও ৩০ টি সারণি, ১৫ টি লেখচিত্র, ৭ টি চিত্র, ১ টি ম্যাপ, ১০টি ছকসহ এই গ্রন্থে রয়েছে একটি তথ্যপঞ্জী ও নির্ঘণ্ট। ঢাকাস্থ মুক্তবুদ্ধি প্রকাশনার পক্ষে এই গবেষণা গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন অরনি বারকাত এবং এর মূল্য রাখা হয়েছে ১০০০ টাকা।

ড. মতিউর রহমান: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

 

   

দক্ষিণ এশিয়ার নদী-অববাহিকায় চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন



রামকৃষ্ণ জানা
দক্ষিণ এশিয়ার নদী-অববাহিকায় চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন

দক্ষিণ এশিয়ার নদী-অববাহিকায় চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন

  • Font increase
  • Font Decrease

রামকৃষ্ণ জানা

[বিশ্ব নদী দিবস প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের চতুর্থ রোববার। বিশ্ব নদী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘রাইটস অব রিভার'। বিশ্বেরা অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে দিবসটি। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আয়োজন করা হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি। ইতিহাসবিদ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যপক ড.  রূপকুমার বর্মণ নদী ও ইতিহাসের চর্চায় উন্মোচন করেছেন মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির বাহুমাত্রিক বিন্যাস।]

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্য দিয়ে অসংখ্য নদী প্রবাহিত হওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত নদী-অববাহিকাগুলোতে ঘটে চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন যা বিশ্বব্যাপী অভিবাসনচর্চার অন্যতম বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বর্তমানে নদীকে বহুমুখী ব্যবহারের মাত্রাবৃদ্ধির ফলে উদ্ভূত নদীজনিত সমস্যার কারণে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের াা অঞ্চলের মানুষেরা নিজেদের জীবনকে রক্ষা করতে জোরপূর্বক অভিবাসনে বাধ্য হচ্ছে। এইরকম একটি প্রেক্ষাপটকে ড. রূপকুমার বর্মণ তাঁর লেখনীর মাধ্যমে ইতিহাসচর্চায় এক বিশেষ স্থান দিয়েছেন।   

মোট তিনটি অধ্যায় এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক সারণীসহ এই বইটিতে একই সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় আলোচিত হয়েছে। গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে নদীমাতৃক বাংলার জেলেসম্প্রদায়ের মানুষের জীবনজীবিকার ওপরে নদীর অপরিসীম প্রভাব। ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীতে লিখিত বিভিন্ন সাহিত্যগুলি যে তৎকালীন সমাজের দর্পণ-লেখক তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে সাহিত্যের নিরিখে  বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণের লেখা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নামক উপন্যাসকে লেখক উক্ত অঞ্চলের মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে শুধু নদীর সম্পর্কের আলোচনায় সীমাবদ্ধ না রেখে একে কেন্দ্র করে নদী-উপকূলবর্তী মানুষের জীবনসংকট ও তারই প্রভাবে যে তাদের অভিবাসন ঘটেছিল সেই প্রেক্ষিতকে নদীর ইতিহাসচর্চার মাধ্যমে নতুনভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। কীভাবে তিতাস-অববাহিকায় মালোসম্প্রদায়-অধ্যুষিত চরটি একে একে জনশূন্য হয়ে উঠেছিল-তাও এতে পরিস্ফুটিত। বর্তমানে পরিবেশ-ইতিহাসচর্চায় আভ্যন্তরীণ অভিবাসনের একটি প্রামাণ্য দলিল রূপে বর্ণিত এই উপন্যাসকে কেন্দ্র করে মানুষের আভ্যন্তরীণ স্থানচ্যুতি ও অভিবাসন সংকটের কথাকে স্মরণ করিয়ে ডঃ বর্মণ এই সাহিত্যকে ইতিহাসের এক অন্যতম আধারে পরিণত করেছেন। 

ই. এইচ. কার(E. H. Carr)-এর ইতিহাসচর্চার মূল নির্যাস-‘ইতিহাসকে জানার আগে ঐতিহাসিক কে. জানো’-এ সম্পর্কে গ্রন্থকার পূর্ণমাত্রায় সচেতন। তিনি মালোজাতির ইতিহাসকে তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে বুকানন হ্যামিল্টন(Francis Buchanan-Hamilton), নৃতত্ত্ববিদ জেমস(Dr.James Wise) ও রিসলে(H.H. Risley) প্রদত্ত বিভিন্ন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে জেলেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণ করেছেন। পরবর্তীকালে ঔপনিবেশিক সরকারের হীনবিভাজন নীতি থেকে মুক্তি পেতে তারা যে ১৯১৩ সালে ‘ঝালো-মালো ক্ষত্রিয় সমিতি’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সংস্কৃতায়ন ঘটিয়েছিল লেখক তা বর্ণনা করেছেন।   

অধ্যাপক বর্মণ গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে আসাম ও বাংলার নদী-উপত্যকাগুলিতে বসবাসকারী মানুষদের সার্বিক জীবনের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সাক্ষী হিসেবে ঐ অঞ্চলের নদীকেন্দ্রিক সাহিত্যগুলোকে তাঁর ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে ব্যবহার করেছেন। দেবেশ রায় রচিত ‘তিস্তা পারের বৃত্তান্ত’-কে লেখক একজন ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখিয়েছেন যে একটি নদী  কীভাবে আঞ্চলিক স্তরের সংগ্রাম থেকে মানুষকে আন্তর্জাতিক স্তরের সংগ্রামে উত্তীর্ণ করতে পারে। তিস্তা নদী রাজবংশী সম্প্রদায়ের কাছে ছিল এক দেবীস্বরূপা আবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ থেকে আগত প্রভূত মানুষের কাছে এই নদী-উপকূল হয়ে উঠেছিল আশ্রয়দাত্রী জননীস্বরূপা। এই প্রসঙ্গে লেখক অত্যন্ত সুচারুভাবে এই অঞ্চলের আদিবাসিন্দা রাজবংশী সম্প্রদায় ও আগন্তুক উদ্বাস্তু বাঙ্গালীর দ্বন্দ্বকে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে তুলে  ধরেছেন। যুক্তফ্রন্ট সরকার ও বামফ্রন্ট সরকারের আমলে গৃহীত বিভিন্ন ভূমিসংস্কারমূলক পদক্ষেপ (যেমন-‘অপারেশন বর্গা’) এই রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটায় এবং ইউ. কে. ডি. (UKD) ও ইউ. টি. জে. এ. এস. (UTJAS)-নামক আঞ্চলিক দলগুলি অচিরেই তাদের পূর্বতন দাবী তথা কামতাপুর রাজ্যগঠনের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। তিনি দেখিয়েছেন ভারত ও বাংলাদেশ জলবণ্টনচুক্তি অনুযায়ী তিস্তা নদীতে বাঁধ নির্মাণের দ্বারা সরকার মানুষের উন্নতি ঘটাতে সচেষ্ট হলেও সেই উন্নয়নযজ্ঞই কীভাবে নদী-উপকূলবর্তী মানুষগুলোকে বঞ্চনার শিকারে পরিণত করেছিল। অবশেষে ডঃ বর্মণ প্রশ্ন তুলেছেন-বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর মানুষ কি তবে তিস্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে নাকি এখনও  মানুষ তিস্তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে?  

এরই সঙ্গে গ্রন্থকার সাহিত্যিক জিতেন্দ্র দাস লিখিত ‘কলহি নদীর একুল হিকুল’-গ্রন্থের ইতিহাসনির্ভর বিশ্লেষণের মাধ্যমে তৎকালীন আসামের বিশেষত দিপার বিলসংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী মানুষের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতকে একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছেন। কালক্রমে এই নদীর চরে অশান্তির বার্তা বহন করে আনে বঙ্গাল খেদাও আন্দোলন এবং এরই  ফলশ্রুতিতে এখানে শুরু হয় বহিরাগত ও স্থানীয় মানুষদের সমাজের সর্বক্ষেত্রে আধিপত্য স্থাপনের এক তীব্র অসম লড়াই। অসমের একটি নদীচরের মানুষের আভ্যন্তরীণ সংকট কীভাবে একটি বৃহত্তর আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল তা লেখক বর্ণনা করেছেন। 

এই গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে ড.  রূপ কুমার বর্মণ তাঁর বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন যে, ভুটানের ওয়াং-চু (পশ্চিমবঙ্গে রায়ডাক ও বাংলাদেশে দুধকুমার নামে পরিচিত) নদী কীভাবে ভুটানের প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থনৈতিক সম্পদকে নিয়ন্ত্রণ করে ক্রমশ সমগ্র ভুটানবাসীর জীবনের অবলম্বন হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ভুটানের বৌদ্ধধর্মকে কেন্দ্র করে কীভাবে এই নদী ভুটানবাসীর মনে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছিল তার ইতিহাস লেখক তুলে ধরেছেন।  লেখকের বর্ণনায় প্রাধান্য পেয়েছে রায়ডাক-১ ও রায়ডাক-২ নদীর গতিপথে অসম ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় উদ্ভূত ঝাউকুঠি, বলাভুত ও রামরাই কুঠির মত অসংখ্য চরে বসবাসকারী মানুষের জীবনসংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। তিনি দেখিয়েছেন যে এই অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকে কোচ, মেচ, রাভা ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর সাথে সাথে এখানকার অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে রাজবংশী মানুষের বসতি। ঔপনিবেশিক আমলে ছোটনাগপুর অঞ্চল থেকে সাঁওতাল, কোল, ভিল, মুন্ডাদের শ্রমিক হিসেবে আগমনের ফলে এই নদী-অববাহিকার বসতিগুলি এক মিশ্র সংস্কৃতির পীঠস্থান হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালের পর পূর্ব-পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) থেকেও অনেক মানুষকে এই অঞ্চল সাদরে গ্রহণ  করে নিয়েছিল। ডঃ বর্মণের নৃ-তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এইভাবেই এই নদী-অববাহিকা হয়ে উঠেছিল এক টুকরো ভারতবর্ষ।  

লেখক এই অধ্যায়ে আরও দেখিয়েছেন যে একই নদীর জল বহুধর্ম ও বহুসংস্কৃতির সাক্ষ্য বহন করে চলেছে আবহমানকাল ধরে। কোচবিহারের রাজাদের অনুগ্রহে কামাক্ষ্যা মন্দিরের ভিত্তিস্থাপনের ইতিহাস লেখক তুলে ধরেছেন। পরবর্তীতে আবার এই রাজারা এই অঞ্চলেই একাধিক শিবমন্দির স্থাপন করে কোচবিহারের প্রধান দেবতা হিসেবে শিবকে স্থান দেন। অন্যদিকে এখানেই শঙ্করদেবের হাত ধরে একসময় যে বৈষ্ণবধর্মের উত্থান ঘটেছিল তা পরবর্তীতে কোচসাম্রাজ্যের রাজধর্মে পরিণত হয়। তিনি বর্ণনা দিয়েছেন কীভাবে বৈষ্ণবসত্রগুলি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়েছিল। একদা কোচপ্রশাসনের ওপর বৈষ্ণবধর্মের প্রভাব এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে তাঁরা নিজেদের নামের সাথে ‘নারায়ণ’ উপাধি সংযোগ করেছিলেন ও কোচমুদ্রার নাম ‘নারায়ণী মুদ্রা’ রেখেছিলেন। সেইসঙ্গে এই অঞ্চলে লৌকিক দেবদেবীরও পূজা-পাঠ প্রচলিত ছিল। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে ঔপনিবেশিককালে খ্রিষ্টান মিশনারীরা ‘ইভানজেলিকালিজম্’ ধারণার বশবর্তী হয়ে রাভা ও মেচ উপজাতিদের কীভাবে খ্রিষ্টানধর্মে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেছিলেন এবং এইসকল প্রান্তিক মানুষদের জীবনে পাশ্চাত্য ধর্ম ও শিক্ষা প্রবেশের সাথে সাথে তাদের নিজেদের চিরায়ত ঐতিহ্য, ধর্ম-সংস্কৃতির যে পরিবর্তনগুলি ঘটেছিল সে বিষয়েও তিনি আলোকপাত করেছেন।

তবে আলোচ্য গ্রন্থে এই অঞ্চলের অন্যান্য অনেক নদীর কথা লেখকের আলোচনায় স্থান পায় নি। তিনি এই অঞ্চলের নিম্নবর্গের মানুষের ইতিহাসকে তুলে ধরলেও তাঁর লেখায় একটি বিশেষ জনজাতির কথা প্রাধান্য পেয়েছে। নদীর অভিশাপ তাহলে কি শুধুমাত্র জেলেসম্প্রদায়ের ওপর পড়েছিল কিংবা ঝালো-মালো সম্প্রদায়ের বর্তমান সামাজিক অবস্থান কেমন-এসকল প্রশ্নের উত্তরসন্ধানে লেখক নীরব থেকেছেন। তিনি অভিবাসনের ফলে সৃষ্ট এই অঞ্চলের আদি-অধিবাসীদের ক্ষোভের কথা উল্লেখ করলেও বাঙ্গালী উদবাস্তুর যন্ত্রণার কথা তাঁর লেখায় উহ্য থেকেছে। নদীকেন্দ্রিক উন্নয়নযজ্ঞ এই অঞ্চলের জনজাতিবিন্যাসকে কতখানি প্রভাবিত করেছিল তা আরও স্পষ্টভাবে পরিস্ফুটিত হলে তা পাঠকের মনে অধিক আগ্রহের সঞ্চার করত। কামতাপুর রাজ্যের দাবী উত্থানের পশ্চাতে অন্যান্য ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ভূমিকা এবং অসমের বঙ্গাল খেদাও আন্দোলনের ফলে দেশের অভ্যন্তরে বাঙ্গালীদের অভিবাসনের ঘটনা লেখক ক্ষুদ্র পরিসরে তুলে ধরেছেন।

ডঃ বর্মণ তাঁর লেখা এই বইটিতে দেখিয়েছেন যে কোন অঞ্চলের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে সেই অঞ্চলকেন্দ্রিক রচিত সাহিত্যগুলি কীভাবে ইতিহাস রচনার প্রামান্য দলিল হয়ে উঠতে পারে। সাহিত্যে প্রতিভাত দলিত মানুষের জীবনসংগ্রামকে নদীকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চায় স্থান দিয়ে লেখক তাঁর অনন্য রচনাশৈলীর পরিচয় পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। নদী কীভাবে জনমানসের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে উদ্দীপিত করতে পারে এবং সেইসঙ্গে মানুষের জীবনধারণের অর্থনৈতিক কাণ্ডারী হয়ে উঠতে পারে তা লেখক তাঁর সুদক্ষ লেখনীর মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন। তাঁর লেখায় নদী হয়ে উঠেছে নদী-অববাহিকা অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর গোষ্ঠীগত এবং জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রতীক। আবহমানকাল ধরে নদী মানুষের অভিবাসনের ফলে উদ্ভূত বিভিন্ন আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের সাক্ষী থেকেছে এবং দ্বন্দ্বপ্রসূত অভিবাসনের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট আদি-অধিবাসী ও আগন্তুক সম্প্রদায়ের লোকেদের মধ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্কের দলিল এই উপন্যাসকেন্দ্রিক ইতিহাস-বিশ্লেষণ। উত্তরবঙ্গের কামতাপুরি আন্দোলন(১৯৬৯) এবং অসমের বঙ্গাল খেদাও আন্দোলন(১৯৭৯-১৯৮৫) উদ্ভবের ক্ষেত্রে নদী কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হয়ে ওঠে তা লেখকের ইতিহাসচর্চায় এক বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। সেইসঙ্গে নদী কীভাবে ধর্ম-সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করতে পারে তার এক নির্ভরযোগ্য ইতিহাস-বিশ্লেষণ লেখকের লেখনীতে পরিস্ফুটিত হয়েছে। উত্তরবঙ্গ ও অসমের পরিবেশ-ইতিহাসচর্চায় এই বই যে কতখানি মূল্যবান তা পাঠক  বইখানি পাঠের পর সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন।     

......

গ্রন্থ সমালোচনা

Rup Kumar Barman, River, Society and Culture: Environmental Perspectives on The Rivers of Assam and Bengal. Delhi: Primus Books, 2023, xix+95pp, ISBN: 978-93-5687-835-8(Paperback)

.........

রামকৃষ্ণ জানা ,গবেষক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।

;

গড়তে চান বই পড়ার অভ্যাস?



মোঃ শরীফুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম
বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশের জন্য বই পড়ুন

বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশের জন্য বই পড়ুন

  • Font increase
  • Font Decrease

লাইব্রেরিগুলো আজকাল ফাঁকা পড়ে থাকে। ক্যাম্পাসের আড্ডায় বই, সে বড়ই হাস্যকর! বই পড়ার মতো সময় হয়ে ওঠে না কারোরই! আমাদের বর্তমান সময়টা কেড়ে নিয়েছে মোবাইল আর ইন্টারনেট। অথচ বই পড়ার গুরুত্ব কমবেশ সকলেরই জানা।

মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য বই কতটা জরুরি সেটা আমাদের অজানা নয়। কিন্তু একটি বই পড়ার জন্য যে সময় প্রয়োজন, প্রয়োজন উপযুক্ত স্থান। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, সঠিক বই নির্বাচন।

বই পড়া শুরুর ক্ষেত্রে নতুন পাঠকরা নানান সমস্যার সম্মুখীন হন। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না পেরে অনেকের আর বই পড়াই হয় না। আজকের আলোচনায় আমরা জানব কীভাবে একটি বই পাঠ করা যায়, গড়ে তোলা যায় বই পড়ার অভ্যাস।

সময়: বই পড়ার কথা বললেই সবাই এক বাক্যে বলবে, ‘সময় নেই!’ সময় নিয়ে আমাদের অভিযোগের বড় কারণ হলো, নিজের কাজগুলো গুছিয়ে না করা। প্রতিদিন মাত্র ২০-৩০ মিনিট সময় দিয়েই কিন্তু গড়ে তোলা যায় বই পড়ার অভ্যাস। সময় না পাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়া। তাই, সকাল কিংবা সন্ধ্যা হাতের ফোনটা দূরে সরিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বসে যান বই নিয়ে।

পরিবেশ: উপযুক্ত পরিবেশ বই পড়ার মনোযোগ বাড়িয়ে দেয়। জানালার পাশে, বেলকনিতে কিংবা বাসার ছাদে বই পড়ার স্থানটি যেন হয় নির্জন এবং শান্ত। আজকাল বিভিন্ন পার্কে ‘নীরব বই পাঠ কর্মসূচি’ দেখা যায়। চাইলে যোগ দিতে পারেন তাঁদের দলেও। বই পড়ার পাশাপাশি পরিচয় হবে বইপ্রেমী মানুষদের সাথে।

বই নির্বাচন: বই পড়ার ক্ষেত্রে ইচ্ছে যেমন জরুরি তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সঠিক বই নির্বাচন। এক্ষেত্রে নিজের ভালো লাগাকে প্রাধান্য দিন। যেসব গল্প আপনাকে আকর্ষণ করে শুরুতে সেই বইগুলোকেই আপনার পাঠ্য তালিকায় রাখুন। 

পাঠাগার: পাঠাগারে গেলেই যে বই পড়তেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বইয়ের সাথে সময় কাটালে এক সময় সেটা ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে হবে। আর ছুঁয়ে দেখতে গিয়ে কখন যে দু’য়েক পাতা পড়ে ফেলবেন, নিজেই টের পাবেন না! তাই বই পড়ার অভ্যাস গড়তে চলে যান পাঠাগারে। বই না পড়ুন, অন্তত সুন্দর সুন্দর ছবি তোলা তো হবে!

সোশ্যাল মিডিয়া: আমরা সবকিছুতেই সোশ্যাল মিডিয়াকে দায়ী করি। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ার সুষ্ঠু ব্যবহার আপনার অভ্যাস গড়ার বড় সহায়ক। ফেসবুকে সাহিত্য তথা বই বিষয়ক বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে। যেখানে বিভিন্ন বই নিয়ে আলোচনা হয়, হয় বই বিষয়ক আড্ডাও। এসব গ্রুপে যুক্ত হয়ে বাড়াতে পারেন বইয়ের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা।

ধারাবাহিকতা: বলা হয়ে থাকে টানা ২১ দিন কোনো কাজ করলে সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়। বই পড়ার ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয়। অভ্যাস গড়তে হলে ধরে রাখতে হবে ধারাবাহিকতা। সামান্য হলেও প্রতিদিন পড়ুন। এই ধারাবাহিকতায় আপনার বই পড়াকে অভ্যাসে পরিণত করবে। 

বই পড়ার অভ্যাস রাতারাতি তৈরি হবে না। এজন্য প্রয়োজন ধৈর্য্য এবং অধ্যাবসায়। নতুন পাঠকদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছুদূর পড়ার পর বইটি আর ভালো লাগে না। এক্ষেত্রে ধৈর্য্যহারা হওয়া যাবে। জোর করে সে বই পড়ার প্রয়োজন নেই।

বই মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়ায়। বই পড়ার অভ্যাস গড়তে পারলে জীবনে উন্নতি সাধন অবধারিত। একাডেমিক পড়ার বাইরেও বইয়ের বিশাল একটি জগত রয়েছে। সেই জগতে মানুষ জানার জন্য পড়ে, পড়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য। বই পড়লে মানসিক চাপ হ্রাস পায়, হয় মস্তিস্কের ব্যায়াম, বাড়ে শব্দ ভান্ডার ও স্মৃতি শক্তি। বই পাঠকের চিন্তার জগতকে বিস্তৃত করে, বৃদ্ধি করে বিশ্লেষণ ক্ষমতা। বই পড়ার মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশ হয়। তাই বই হোক প্রত্যেক মানুষের উত্তম বন্ধু এবং বইয়ের সঙ্গে হোক আমাদের মিতালি।

;

মায়ের সমাধির খোঁজে



মহীবুল আজিজ
মায়ের সমাধির খোঁজে

মায়ের সমাধির খোঁজে

  • Font increase
  • Font Decrease

কন্ডাক্টরকে বললাম, এখানে নামিয়ে দিন,
এখানে এই মিয়াপাড়ায় আমি নামবো—
মিয়াপাড়া কবরস্থানে শুয়ে আছে আমার মা।
মায়ের কবর দেখতে এলাম আটান্ন বছর পরে,
জ্যাঠা বলেছিলেন, গেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে একটু গেলে
একটা গোলাপ গাছ ঘেঁষে কবরটা,
কবরের আগে আমাকে গোলাপ গাছ খুঁজতে হয়—
জ্যাঠা চলে গেছেন তা-ও বত্রিশ বছর।
ডানদিকে ঘুরতেই জড়িয়ে ধরে তাজা গোলাপের ঘ্রাণ,
পাশাপাশি চারটা কবর, চারটাতেই গোলাপের পাহারা;
এত কবর এত কবর, কবরে ভর্তি কবরস্থান—
কোথায় শেষ শয্যা নিয়েছিলেন আমার মা!
হাওয়ায় পাতা দোলে গোলাপের, চারটাই একসঙ্গে,
চারটা গাছ থেকেই মুখবাড়ানো গোলাপ ডাক দেয়—
এইখানে এইখানে এইখানে—কোন্খানে!
উবু হবো কবরের মাটি নিতে
কিন্তু চারটাই ডানদিকে, চারটাই গোলাপের পাশে,
প্রতিটি কবর থেকে একটি একটি মুঠো নিয়ে
পলিথিনের চারটে ব্যাগে রাখি।
একবার মনে হয় প্রথমটাতে,
তারপর মনে হয় দ্বিতীয়টাতে,
আবার মনে হয় তৃতীয়টাতে
এবং মনে হয় চতুর্থটাতে সন্ধান রয়েছে মায়ের।
মা সুপ্ত থেকে যান অনির্দিষ্ট মাটিতে ,
তবে কোন্ মানবের মাটি ধরে রাখি বুকের কাছে!
ঠিক তখন বিস্ময়ের মতন একটি ফুটন্ত গোলাপ
গাছ থেকে ঝরে পড়ে দ্বিতীয় কবরে,
সংশয়ী মন বলে, তবে কী গোলাপই বার্তাবহ মায়ের!
অদৃষ্টে অবিশ্বাসী মন দোলে সংশয়ে,
তখন আরেকটি গোলাপ ঝরে পড়ে চতুর্থ কবরে।
অর্থাৎ দুই যোগ দুইয়ে এসে আমার আর হিসেব মেলে না,
জ্যাঠা বলেছিলেন, কবরটা গেটের ডানদিকে ঘুরতেই
এবং গোলাপের পাশে।
বত্রিশ বছরে চতুর্গুণ হয়েছে গোলাপ
কিন্তু এক ও অবিভাজ্য আমার মা’কে
এই গোলাপের কারণেই খুঁজে পাই না আমি—
ফিরে আসি শুধু গোলাপের ঘ্রাণ নিয়ে।

১১-০৯-২০২৩

;

অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল



শরীফুল আলম
অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল

অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল

  • Font increase
  • Font Decrease

 

আমি সীজার হতে চাইনি
তবুও তুমি ক্লিওপেট্রাই থেকে গেলে
অহেতুক লড়াইয়ে তুমি জয়ী হতে চেয়েছিলে
সম্ভবত একেই পরিযায়ী প্রেম বলে
আলো আঁধারীর খেলা বলে
স্বপ্ন আর জেগে থাকা বলে ,
সমাপ্তি কিম্বা বিবিধ, তা সে যাই হউক
এই সহজ কথাটি
আমরা কেউ কাউকে সহজ ভাবে বলতে পারিনি
অথচ তুমি ফ্রিজিডেয়ারটি বন্ধ করে রাখলে
আর বললে, "নোটেড ",

নিউইয়র্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
হ্যাঁ, এটাই সত্যি
তুমি লৌহশৃংখলে অনুজ্জ্বল এক ডিমলাইট
সুচারু মোহের অভাবে তুমি প্রমত্তা নদী
বাবুই পাখীর বাসার ন্যায় তুমি ঝুলে থাক আমার স্বপ্নে
যা হতে পারতো নির্মল এক সবুজের প্রান্তর ।

তুমি ওঁত পেতে থাকা বাঁশপাতার ফাঁকে পূর্ণিমা
আমি তোলপাড় করে ছুটে চলা এক্সপ্রেস ট্রেন
দলছুট শালিক,
আজ কোন বৈভব নেই
ভালোবাসাবাসি নেই ,
কবিতাও ইদানিং প্রিয় লাগেনা
তবু স্নায়ুরা জেগে থাকে
মনে হয় হলুদ পাতায় যেন ক্লোরোফিল
আমিও প্রবণতায় ফিরে যাই সাইবেরিয়া ।

আনচান মনে কত আকুলতা
কালবৈশাখীর তান্ডব
যেন বাতাসে কাঁপন ধরে,
এসো সখা,
এই শ্রাবণে আবার রিডিজাইন করি,
স্যাটেলাইটে প্যারালাল বার্তা পাঠাই
ভুলে যাই অর্ধেক রিয়েল আর অর্ধেক ভুল
প্লাবনে অবাধ্য ঢেউয়ের উছ্বল ।

________________________________________

 ৯ সেপ্টেম্বর । ২০২৩।
নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।

 

;