আফ্রিকার উত্তর-উপনিবেশিক কথাসাহিত্যের পঞ্চপ্রদীপ



ফজল হাসান
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

আফ্রিকার উত্তর-উপনিবেশিক সাহিত্য শুরু হয়েছে ১৯৫৭ সালের পরে, বিশেষ করে ষাটের দশকে । সেই সময় থেকে আফ্রিকার দেশগুলো সরকারিভাবে স্বাধীনতা লাভ করে । অনেক সমালোচকের মতে উত্তর-উপনিবেশবাদী সাহিত্যে সাত ধরনের বিপ্রতীপ বিষয়বস্তু স্থান পেয়েছে, যেমন আফ্রিকার অতীত এবং বর্তমানের সংঘাত, চিরায়ত নিয়মকানুন এবং আধুনিকতা, আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠী এবং বিদেশি, ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত, সমাজতন্ত্র এবং ধনতন্ত্র, উন্নয়ন এবং আত্মনির্ভরশীলতা, এবং আফ্রিকাবাসী ও মানবতা । এছাড়া উত্তর-উপনিবেশবাদী সাহিত্যে অন্যান্য সামাজিক বিষয়বস্তুও স্থান পেয়েছে, যেমন দুর্নীতি, নব্য স্বাধীন দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক বিমাতাসুলভ আচরণ এবং নারীদের ভূমিকা ও অধিকার।

এ কথা সত্যি যে, উপনিবেশিক শাসনতন্ত্রের শুরু থেকে আফ্রিকার সাহিত্যে বিদেশি ভাষা, বিশেষ করে ইউরোপের ফরাসি, ইংরেজি এবং পর্তুগিজ, অনুপ্রবেশ করে । এসব বিদেশি ভাষার বিভিন্ন কলা-কৌশল, আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লক্ষ্যে অথবা আফ্রিকার সাহিত্যকে ভিনদেশে পৌঁছে দেওয়ার অভিপ্রায়ে অনেক লেখক সাহিত্য রচনা করেন ।

সমকালীন বিশ্ব সাহিত্যে আফ্রিকার লেখকদের উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষণীয় এবং তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন লেখক নিজেদের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন । এই নিবন্ধে মাত্র পাঁচজন লেখকের ব্যক্তিজীবন, সাহিত্য ভাবনা এবং উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো। এই পঞ্চপ্রদীপ লেখকরা হলেন কেনিয়ার এনগুগি ওয়া থিওং’ও, ঘানার আমা আতা আইদু, সোমালিয়ার নুরুদ্দিন ফারাহ্, মোজাম্বিকের মিয়া কুতো এবং কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের বংশোদ্ভূত  ফরাসি লেখক অ্যালেন মাবানকো ।

এনগুগি ওয়া থিওং’ও
কেনিয়ার সবচেয়ে আলোড়িত এবং আলোচিত লেখক এনগুগি ওয়া থিওং’ও। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্প লেখক, নাট্যকার এবং প্রাবন্ধিক। তাঁর জন্ম কিয়াম্বু জেলার লিমুরু শহরর নিকটবর্তী কামিরিথিতে, ৫ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে। শৈশবে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত (ব্যাপটাইজ) করে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল জেমস্ এনগুগি। তিনি ১৯৬৩ সালে উগান্ডার ম্যাকেরে ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজিতে গ্রাজুয়েশন লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি ইংল্যান্ডের লিডস্ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেন এবং লিডসে অধ্যয়নকালে ১৯৬৪ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘উইপ নট চাইল্ড’ প্রকাশিত হয়, যা কোনো পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলির লেখকদের মধ্যে ইংরেজিতে লেখা প্রথম উপন্যাস। আন্তর্জাতিক পাঠকমহলে সাড়া জাগানো এবং নন্দিত উপন্যাস ‘এ গ্রেইন অব হুইট’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। এই উপন্যাসে ফ্যানোনিস্ট মার্কসজমের প্রতি তাঁর আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। ‘এ মিটিং ইন দ্য ডার্ক’ এবং ‘সিক্রেট লাইভস্ অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ তাঁর ছোটগল্প সংকলন। যদিও সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জনের যোগ্য প্রার্থী হিসাবে তাঁর নাম অনেকবার আলোচনায় এসেছে, কিন্তু এখনো ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Dec/08/1544257610990.jpg

একসময় এনগুগি ওয়া থিওং’ও খ্রিস্টান ধর্ম, ইংরেজি ভাষা এবং জেমস এনগুগি নাম প্রত্যাহার করে তিনি ফিরে যান তাঁর আদি নামে এবং লেখালেখি করেন মাতৃভাষা গিকুয়ুতে। সেন্সরশিপ ছাড়া ১৯৭৭ সালে তাঁর প্রকাশিত নাটক ‘আই উইল মেরি হোয়েন আই ওয়ান্ট’-এর জন্য তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পর তিনি নাইরোবি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃত্ততা থাকার জন্য তিনি নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন। বর্তমানে এনগুগি ওয়া থিওং’ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, আর্ভিন-এ ইরেজি এবং তুলনামূলক সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন।

আমা আতা আইদু
ঘানার স্বনামধন্য এবং বিশ্বখ্যাত নারী ঔপন্যাসিক, ছোটগল্প লেখক, কবি, নাট্যকার, শিশু-কিশোর সাহিত্যিক এবং শিক্ষাবিদ আমা আতা আইদু (পুরো নাম ক্রিস্টিনা আমা আতা আইদু)। তাঁর জন্ম ১৯৪২ সালের ২৩ মার্চ। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্টের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফেলোশিপ অর্জন করেন। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি স্বদেশে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট এবং কেনিয়ায় শিক্ষক ছিলেন। এছাড়া ১৯৮২-৮৩ সালে ঘানা সরকারের শিক্ষা মন্ত্রী ছিলেন।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Dec/08/1544257736362.jpg

ঘানা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.এ. পড়াকালীন আমা আতা আইদু গভীর মনোযোগের সঙ্গে লেখালেখি আরম্ভ করেন এবং লেখালেখির শুরুতেই ‘দ্য ডিলেম্যা অব এ ঘোস্ট’ (১৯৬৫) নাটক রচনার জন্য পুরস্কৃত হন। নাটকটি মঞ্চায়িত এবং গ্রন্থ হিসাবে প্রকাশিত হয়। এই নাটকে তিনি দেখিয়েছেন যে ঘানার ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য সম্প্রদায়ের অপরিচিত একজনের অনুপ্রবেশের জন্য পারিবারিক জীবনে নেমে আসা সংঘাত, অশান্তি এবং টানাপোড়েন। ‘আনওয়া’ (১৯৭০) তাঁর রচিত অনন্য নাটক। তাঁর প্রথম উপন্যাস (‘আওয়ার সিস্টার কিলিজয়’ বা ‘রিফ্লেকশন্স ফ্রম এ ব্ল্যাক-আইড  স্ক্যুইন্ট’) প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে । তিনি একাধিক ছোটগল্প সংকলন প্রকাশ করেন। এগুলোর মধ্যে ‘নৌ সুইটনেস হিয়্যার অ্যান্ড আ দার স্টোরিজ’ (১৯৭০), ‘দ্য গার্ল হু ক্যান অ্যান্ড আ দার স্টোরিজ’ (১৯৮৭) এবং ‘ডিপলোম্যাটিক পাউন্ড অ্যান্ড আ দার স্টোরিজ’ (২০১২) উল্লেখযোগ্য। ‘নৌ সুইটনেস হিয়্যার অ্যান্ড আ দার স্টোরিজ’ সংকলনের বিভিন্ন গল্পে তিনি ঘানার উত্তর-ঔপনিবেশিক সময়কে তুলে ধরেন এবং চরিত্রকে হেঁয়ালী, কিন্তু সততার সঙ্গে উপস্থাপন করেন। তিনি প্রায় পনের বছরে (১৯৭০-১৯৮৫) একমাত্র কাব্যগ্রন্থ (সামওয়ান টকিং টু সামওয়ান) প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে তাঁর একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এগুলোর মধ্যে শিশু-কিশোর উপযোগী ছোটগল্প সংকলন ‘দ্য ঈগল অ্যান্ড দ্য চিকেনস্’ (১৯৮৬), কাব্য গ্রন্থ ‘বার্ডস্ অ্যান্ড আদার পোয়েস্’ (১৯৮৭), উপন্যাস ‘চেঞ্জেস্: এ লভ স্টোরি’ (১৯৯১) এবং কবিতার বই ‘অ্যান অ্যাংগ্রি লেটার ইন জানুয়ারি অ্যান্ড আদার পোয়েমস্’ (১৯৯২) উল্লেখযোগ্য। তিনি ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা করেন। তাঁর লেখার বিষয়আশয় পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে আফ্রিকার বৈষম্যমূলক আচরণ এবং টানাপোড়েন। এছাড়া তাঁর বিভিন্ন লেখায় স্থান পেয়েছে আধুনিক আফ্রিকার সমাজে নারীদের করুণ অবস্থান। বর্তমানে তিনি ঘানায় বসবাস করেন। সেখানে তিনি ‘মাবাসেম’-এর (ঘানা এবং আফ্রিকার অন্যান্য দেশের নারীদের কাজকে উৎসাহ প্রদান এবং উন্নতিবর্ধন করার সংস্থা) নির্বাহী পরিচালক হিসাবে কর্মরত আছেন।

নুরুদ্দিন ফারাহ্
আফ্রিকা মহাদেশের সফল এবং অন্যতম প্রভাবশালী লেখক সোমালিয়ার নুরুদ্দিন ফারাহ্। তিনি একই সাথে ঔপন্যাসিক, গল্প লেখক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক এবং অধ্যাপক। তাঁর জন্ম তৎকালীন ইতালি অধ্যুষিত সোমালিল্যান্ডের বাইডোয়া শহরে, ১৯৪৫ সালের ২৪ নভেম্বর। তাঁর শৈশব কেটেছে পার্শ্ববর্তী ইথিওপয়া শাসিত ওজাডেন শহরের কালাফোতে। তিনি ভারতের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন, সাহিত্য ও সমাজ বিজ্ঞানে গ্রাজুয়েট ডিগ্রি এবং পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের এসেক্স ইউনিভার্সিটি থেকে নাট্যকলায় মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ইউনেস্কো ফেলোশিপ লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন নুরুদ্দিন ফারাহ্ সোমালি এবং ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু করেন। তাঁর লেখাকে ‘রাজনৈতিক রোমহর্ষক’ বা ‘পলেটিক্যাল থ্রিলারস্’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। তাঁর লেখার মূল বিষয় সোমালি সমাজ এবং রাজনীতি, বিশেষ করে পারিবারিক সম্পর্ক, জীবনের জটিলতা এবং নারীবাদ। প্রথম উপন্যাস ‘ফ্রম এ ক্রুক্ড রিব’ প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে, যা নারীবাদী পাঠকের কাছে ভূঁয়সী প্রশংসা লাভ করে। এই উপন্যাসে তিনি পারিবারিকভাবে এক  কিশোরীর জোর করে বেশি বয়সী লোকের সঙ্গে বিয়ে নির্ধারিত হওয়ার পর কিশোরীর  পালিয়ে যাওয়া এবং বুড়ো লোকটির নতুন করে জীবন সংগ্রামের কাহিনী  তুলে ধরেছেন। ‘এ ন্যাকেড নিডল্’ (১৯৭৬) তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস। এই উপন্যাসে তিনি মধ্য-সত্তুরের বিপ্লবী-পরবর্তী সোমালিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতার এবং জনসাধারণের দুর্গতির কথা চিত্রায়িত করেন।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Dec/08/1544257762913.jpg

উপন্যাস প্রকাশের পর ইউরোপে ভ্রমণকালীন তিনি জানতে পারেন, দেশে ফিরে গেলে উপন্যাসের বিষয়বস্তুর জন্য সরকার তাঁকে গ্রেফতার করবে। তাই গ্রেফতার এড়াতে তিনি স্বেচ্ছায় প্রায় বাইশ বছর দেশান্তরিত ছিলেন। সেই সময় তিনি বিভিন্ন দেশে শিক্ষকতা করেন। তিনি তিনটি ত্রয়ী উপন্যাসের সিরিজ রচনা করেন। এগুলো হলো : ‘ভেরিয়েশনস্ অন দ্য থিমস্ অব অ্যান আফ্রিকান ডিক্টেটরশিপ’ [‘সুইট অ্যান্ড সাওয়্যার মিল্ক’ (১৯৭৯), ‘সারডিনস্’ (১৯৮১) এবং ‘ক্লোজ সেস্যামি’ (১৯৮৩)], ‘ব্লাড ইন দ্য সান’ [‘ম্যাপস্’ (১৯৬), ‘গিফটস্’ (১৯৯২) এবং ‘সিক্রেটস্’ (১৯৯৮)] এবং ‘পাস্ট ইমপার্ফেক্ট’ [‘লিঙ্কস্’ (২০০৩), ‘নটস্’ (২০০৭) এবং ক্রশবৌনস্’ (২০১১)]। এসব সিরিজ উপন্যাসের মধ্যে ‘সুইট অ্যান্ড সাওয়্যার মিল্ক’ তাকে সুখ্যাতি এনে দেয় এবং তিনি ‘ইংলিশ স্পিকিং অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। ২০১৪ সালে তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস ‘হাইডিং ইন প্লেইন সাইট’ প্রকাশিত হয়। তাঁর একাধিক নাটক মঞ্চে মঞ্চায়িত এবং রেডিওতে প্রচারিত হয়েছে। তাঁর সাহিত্য কর্ম বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি ২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার অন্যতম প্রার্থী ছিলেন। বর্তমানে তিনি ভাগাভাগি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিন্যায়াপলিস এবং দক্ষিণ আফ্রিকার ক্যাপটাউনে বসবাস করেন।

মিয়া কুতো
আফ্রিকা মহাদেশে পর্তুগিজ ভাষার অন্যতম লেখক মিয়া কুতো (পোশাকি নাম আন্তোনীয় এমিলিও লিতে কুতো)। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্প লেখক, কবি এবং সাংবাদিক। তাঁর জন্ম মোজাম্বিকের বেইরা শহরে, ১৯৫৫ সালের ৫ জুলাই। সেখানেই তিনি শৈশব কাটিয়েছেন। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে স্থানীয় সংবাদপত্রে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়। তিনি মেডিসিন পড়ার জন্য ১৯৭৪ সালে মপুতো শহরে গমন করেন। কিন্তু সেখানে পড়াশোনার সময় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৫ সালে মোজাম্বিক স্বাধীনতা অর্জন করার পর তিনি মেডিসিন পড়ায় ইস্তফা দেন এবং সাংবাদিকতা শুরু করেন। একাধিক সংবাদপত্র এবং ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছাড়াও তিনি রাষ্ট্র পরিচালিত মোজাম্বিক ইনফরমেশন এজেন্সির ডিরেক্টর ছিলেন। গত শতাব্দীর আশির দশকে জীব-বিজ্ঞানে পড়াশোনা করার সময় তাঁর কবিতা এবং ছোটগল্প প্রকাশিত হয়।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Dec/08/1544257844288.jpg

তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ (রুট অব ডিউ) প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালে এবং প্রথম ছোটগল্প সংকলন (ভয়েসেজ মেইড নাইট) প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। এই সংকলন তাঁকে আন্তর্জাতিক সাহিত্য জগতে পরিচয় করিয়ে দেয়। ‘এভরি ম্যান ইজ এ রেইস্’ (১৯৯৪) তাঁর অন্য ছোটগল্প সংকলন। সংকলন দুটির বেশির ভাগ গল্পের পটভূমি মোজাম্বিকের দশ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা পরবর্তী গৃহযুদ্ধের পাশবিক ঘটনা। তাঁর প্রথম উপন্যাস (স্লিপওয়াকিং ল্যান্ড) ২০০২ সালে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসটি বিংশ শতাব্দীর আফ্রিকার প্রথম ছয়টি উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে একটি। এছাড়া এই প্রথম উপন্যাসই তাঁকে এনে দেয় ‘জিম্বাবুয়ে ইন্টারন্যাশনাল বুক ফেয়ার’ পুরস্কার। সাহিত্য কর্মের স্বীকৃতি হিসাবে তিনি একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন, যেমন ‘লাতিন ইউনিয়ন’ সাহিত্য পুরস্কার (প্রথম আফ্রিকার লেখক) (২০০৭), ‘নিউস্টাড ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ফর লিটারেচার’ (২০১৪) এবং ‘ক্যামোস প্রাইজ’ (২০১৩)। বর্তমানে তিনি মপুতোতে পরিবেশ বিজ্ঞানী হিসাবে কর্মরত আছেন।

অ্যালেন মাবানকো
কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের বংশোদ্ভূত ‘আফ্রিকার স্যামুয়েল বেকেট’ নামে অভিহিত ফরাসি লেখক অ্যালেন মাবানকো একাধারে কথাসাহিত্যিক, কবি, সাংবাদিক এবং অধ্যাপক। তাঁর জন্ম ১৯৬৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। শৈশব কাটে কঙ্গোর সামুদ্রিক শহর পয়েন্ট-নোয়্যারে। তিনি দর্শন-শাস্ত্রে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করার পরে মায়ের ইচ্ছে অনুযায়ী প্রাইভেটে আইন  বিষয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি বাইশ বছর বয়সে বৃত্তি নিয়ে ফ্রান্সে যান এবং ইউনিভার্সিটি অব প্যারিস থেকে আইন বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০২ সালে তিন বছরের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যান অ্যারবর ক্যাম্পাসে ফ্রাঙ্কোফোন সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন এবং পরে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট লস অ্যাঞ্জেলেস-এর অধ্যাপক নিযুক্ত হন।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Dec/08/1544257870375.jpg

অ্যালেন মাবানকোর প্রথম উপন্যাস ‘রেড-হোয়াইট অ্যান্ড ব্লু’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে। প্রথম উপন্যাস প্রকাশের পর তিনি লেখালেখিতে নিয়মিত হন। ‘গ্লাস ব্রোকেন’ (২০০৫), ‘মেম্যোয়্যার অব পর্কুপাইন’ (২০০৬), ‘ব্ল্যাক বাজার’ (২০০৯), ‘টুমরো আই  উইল হ্যাভ টুয়েনটি ইয়ার্স্’ (২০১০), ‘লাইটস্ অব পয়েন্টে-নোয়্যার’ (২০১৩) এবং ‘স্মল চিলি’ (২০১৫) তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। সাহিত্য কর্মের স্বীকৃতি হিসাবে একাধিক পুরস্কার লাভ করেন, যেমন ‘রেড-হোয়াইট অ্যান্ড ব্লু’ উপন্যাসের জন্য ‘গ্র্যান্ড লিটারেরি প্রাইজ ফর ব্ল্যাক আফ্রিকা’, ‘মেম্যোয়্যার অব পর্কুপাইন’ উপন্যাসের জন্য ‘প্রি রেনো’ (২০০৬)  এবং ‘স্মল চিলি’ উপন্যাসের জন্য ‘প্রি গনকোর্ট’ (২০১৫)। ‘স্মল চিলি’ উপন্যাসের জন্য ২০১৭ সালে ‘ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ’-এর তালিকায় ছিলেন। এছাড়া ‘ব্ল্যাক বাজার’ এবং ‘লাইটস্ অব পয়েন্টে-নোয়্যার’ উপন্যাস দুটি সমালোচকদের ভূঁয়সী প্রশংসা অর্জন করে এবং ফ্রান্সের কুড়িটি বেস্ট সেলার উপন্যাসের তালিকায় (যথাক্রমে ২০০৯ এবং ২০১৩ সালে) অন্তর্ভুক্ত হয়। তাঁর উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্ররা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। তিনি আফ্রিকার অভিবাসীদের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে চরিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। উপন্যাস এবং ছোটগল্প সংকলন ছাড়াও তিনি একাধিক কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা। যদিও তিনি সাহিত্য কর্মের জন্য সমাদৃত, কিন্তু সমালোচনাও কুড়িয়েছেন। তাঁর সাহিত্য রচনা বিশ্বের পনেরটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বর্তমানে তিনি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট লস অ্যাঞ্জেলেস-এর ফ্রাঙ্কোফোন সাহিত্যের অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত আছেন।

পরিশেষে বলা যায়, গত শতাব্দীর পঞ্চাশের এবং ষাটের দশক থেকে, অর্থাৎ স্বাধীনতা লাভের সময় থেকে আফ্রিকার সাহিত্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। কেননা তখন থেকেই আফ্রিকার সাহিত্যে বিদেশি ভাষা, বিশেষ করে ইউরোপের ফরাসি, ইংরেজি এবং পর্তুগিজ, অনুপ্রবেশ করে। এসব বিদেশি ভাষার বিভিন্ন কলা-কৌশল, আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লক্ষ্যে অথবা আফ্রিকার সাহিত্যকে ভিনদেশে পৌঁছে দেওয়ার অভিপ্রায়ে উত্তর-উপনিবেশিক সময়ে অনেক লেখক সাহিত্য রচনা করেন। বলাবাহুল্য, এসব সাহিত্য শুধু স্বদেশেই নয়, বিদেশেও প্রকাশিত হতে থাকে এবং আন্তর্জাতিক পাঠক মহলে আন্তরিকতার সঙ্গে গৃহীত হচ্ছে।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;