একলা একলা আকার



দেবদুলাল মুন্না, অতিথি লেখক
অলংকরণ ও সম্পাদনা: রুদ্র হক

অলংকরণ ও সম্পাদনা: রুদ্র হক

  • Font increase
  • Font Decrease

‘সাব-লেট যারা দেন তারা মাঝারি অসহায় । যারা সাব-লেট নিন তারা প্রান্তিক। ফলে এই দুই অসহায় পক্ষের মালিক বাড়িমালিক। আবার ভাড়াটে ও সাব-লেট নেনেওয়ালা না থাকলে মালিক অসহায়। এটিকে একটি স্পেসকে নিয়েও দ্বন্ধ। সপ্তদশ শতাব্দীতে প্যারিসের লুঁগে শহরে সাব-লেট সংক্রান্ত একটি মামলায় বলা হয়েছিল, ইহা আপাত স্থানসংকুলানের জন্য মানবিক মনে হলেও খুব ঝুঁকিপূর্ণ সহাবস্থান।’
-সেভেন লেটার্স ডাউন মেমোরি: মন্টেস্কু

এক

পুরোটাই খেলা। আমি দেখছিলাম ব্রা। কালো। বেশ আটসাট করে জড়ানো তাবুর শরীরে। এবার আস্তে আস্তে হাতুড়ি গাঁইতি নিয়ে এগোলাম। টুকরোগুলো খুলি। নগ্ন নারী শরীরের স্তনকে কতভাবে ভেবেছি। কিন্তু ‘বাস্তবে এই প্রথম। আচ্ছা এভাবেওতো ভাবা যায় ব একটা র-ফলা পরে আছে। গ্রেট, তার মানে এভাবে বলা যায় যে র-ফলা পরে ফেললেই বিতর্কিত হয়ে ওঠে বা"- এটা তো ডিকন্সট্রাকশান এবং লিটারেল থিংকিং এর প্রথম ভাগ।

এটা একটা দেখাপদ্ধতি , আমরা কি দেখতে পারি একটা ত্রিভুজের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার আকার, ত্রিভুজের সাথে ডিভোর্স তাই সে ত্রিভুজাকার নয়? ত্রিভুজের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার একলা আকার... এইসবই কিন্তু র-ফলা ছাড়িয়ে নেওয়া অবিতর্কিত বা এর সন্তান... বা, আমরা কি এমন কোন দিকে যেতে পারি যেখানে র-ফলা কে ঢেউ বা তরঙ্গ’র মতো দেখি। ভাবি, বক্ষবন্ধনী থেকে তরঙ্গ খুলে নিলে দুইটি স্তনের মাঝে অপশান জেগে ওঠে।

তাবু জানতে চায়, এ আদরের সময়ও তুমি কি ভাবো ?
বলি, ধরো যদি তোমার উপরে আমি মারা যাই হঠাত, তখন কি হবে ? পুলিশ, মামলা কি করে তুমি হ্যান্ডলিং করবে বা পালাবে আমার লাশ ফেলে?
তাবুর মনে হলো বিছানাটা কেমন যেন আর্দ্র আর্দ্র লাগছে। এক ঝটকায় কাঁথাটা সরিয়ে দিতেই বিস্ফারিত চোখে সে তাকাল বেডশিটের উপর। রক্তজবার মতো লালরক্তে ভিজে আছে বিছানার মাঝখানটা। সমস্ত চাদরটা যেন দেখাচ্ছে জাপানের পতাকার মতো। রাতে তার রজস্বলা হয়েছে সে টেরই পায়নি। আজ তো ঋতুস্রাব হওয়ার কথা নয়। ধার্য তারিখ আরো দু’দিন পর। জলের স্রোতের মতো এমন রজোদর্শনে খানিকটা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে তাবু।

সে জানতে চায় এ অবস্থায় আমি তার ভুবনে যেতে চাই কিনা। আমি বলি, তুমি তো আমার কাছে সাব-লেটের মতো ছিলে। মালিক ছিল তোমার স্বামী। আমি প্রেমিক। আমি তোমার মন ও শরীর ভাড়া করেছিলাম প্রেমের দেনমোহরে। কিন্তু আমারই জন্যে তোমার সংসার ভাঙবে, তুমি সত্যি ইন্দিরা রোডে একটা বাসায় সাবলেট নিয়ে একা একা থাকবে, আমি ভাবিনি কোনোদিন।

এসব বলার সময় আমি আবারও তার তলপেটে ত্রিভুজাকারের একটি কোণ দেখি। কিছু ঘাস। আর রক্তপাত। আমি তার ভেতরে যেতে যেতে ভাবি,না , আর কখনো কোথাও বিপ্লব বা প্রতিবিপ্লব হবে না,এখন সব যেন একলা একলা আকার। অন্যরকম খেলা। গ্র্যান্ড ম্যাটা ন্যারেটিভলেসের। তাবু তবু কিসব জানি বলতে থাকে। বসন্ত তুমি আর এসো না এটি তো বলা যায় না। বলা গেলেও সে আসবে।

পাওলো কোয়েলহোর একটা উপন্যাস আছে। নাম, ইলাভেন মিনিট। এটির গল্প তাবু আজ আসার পরই শুনিয়েছি। মুভি হয়েছে এটি। তাবু কয়েকদিন আগে দেখেছে জানালে আমার মনে পড়ে সব। সেখানে মারিয়া নামের যৌনকর্মী এক জায়গায় ভাবছে বা বলা যায় ডায়েরিতে লেখছে : আমি আবিষ্কার করেছি কী কারণে একজন পুরুষ একজন মহিলাকে টাকা দেয়। সে সুখী হতে চায়। শুধুমাত্র অর্গ্যাজম পাওয়ার জন্য সে এক হাজার ফ্রাংক দেয় না। সে সুখী হতে চায়। আমিও চাই। সবাই চায়। অথচ কেউ সুখী নয়। আমার কী হারাবার আছে, যদি কিছুক্ষণের জন্য আমি ঠিক করি আমি হব একজন ‘ ’।

তার রেগুলার কাস্টমার বা প্রেমিক র্যালফের সঙ্গে কিছু আলাপ:
মারিয়া:একজন বেশ্যার প্রেমে পড়লে কী করে?
র‌্যালফ : আমার মনে হয় এর কারণ, তোমার শরীর কোনোদিন আমার একার হবে না জেনে আমি মন দিয়েছি তোমার আত্মাকে জয় করাতে।
মারিয়া: তোমার ঈর্ষা হয় না? আমার কাছে তো অন্যরাও আসে?
র‌্যালফ : না। তুমি বসন্তকে বলতে পারো না, এখানে এসো আর যতদিন সম্ভব থাকো।
মারিয়া: মানে ?
র‌্যালফ : মানে হলো ১১ মিনিটই অসীম। তুমি তো স্থায়ী কারো না। তাই তোমাকে পাওয়ার ব্যাকুলতা। হয়তো অস্থায়ীকেই মানুষ নিজের অজান্তে বেশি ভালবাসে। ঠিক জানি না। এটাও উত্তর হতে পারে।
তাবু ওইসব আমাদের এডাল্ট সিনগুলো উপভোগ ও আমি ‘ইলেভেন মিনিট’ কাটানোর ঘোর কাটাতেই বুঝতে পারি সন্ধ্যা নামছে। তাবু ওয়াশরুমে যায়। ফ্রেশ হয়। শাড়ি পরে। আমিও সে যাহা আমি তাহা। এরপর তাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য বিশ্বরোড পর্যন্ত এসে একটা স্কুটারে তোলে তাবুকে বিদায় দিই।

দুই

রোজেনের সঙ্গে আমার ডিভোর্স হয়েছে কতোবছর আগে ঠিক মনে নেই। সেটার হিসাব রাখতেও চাই না। রোজেন মাঝেমধ্যে ফোনকল দেয়। আমিও। আমাদের এখনও যোগাযোগের কারণ সন্তান । তুণা। তুণা এ লেভেল শেষ করে চেষ্টা করছে বাইরে পড়তে যাওয়ার। রোজেন একদিন আমাকে ফোনকল দেয়, বলে, তোমার মেয়েতো ডিপ্রেসনে ভুগতেছে। তার নাকি কিচ্ছু ভাল লাগে না। হাত ব্লেড দিয়া কাটছে। এতটুকু বলে লাইন কেটে দেয়।

আমি তুণাকে ফোন করি। সে ধরে না। ওইদিনই সন্ধ্যায় আমি রোজেনদের বাসায় যাই। নিজেকে মেহমান মনে হচ্ছিল। তুণাকে বলি , তোমার সমস্যা কী ? তুণা উত্তর দেয়, সমস্যা কী ? নাই তো! আমি তাকে যেন এখুনি হারিয়ে যাবে কিন্তু হারাতে দেবো না এমন ভয়ে খুব জোরেসোরে জড়িয়ে ধরি। সে ঘটনার আকস্মিকতায় একটু অপ্রস্তুত। আমি বুঝি ঠিক হচ্ছে না, বিয়িং ইজি। ওকে ছেড়ে দিয়ে দুহাত ধরে নেইলপালিশ দেখার ভান করে বলি, বাহ, সুন্দর রঙ তো।

আসলে দেখি তার বাম হাতের ব্লেডে কাটা ধীরে ধীরে লাল থেকে কালো হতে থাকা দাগগুলো। বলি, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। আসলে দেখি তার চোখ ভরা বিষন্নতা। রোজেন চাওমিন দেয়। আমি ও তুণা খাই। খাবার ফাঁকে তুণা হঠাৎ জানতে চায়, বাবা, তুমি কি এখনও মদ খাও ? ভাবি, খাইতো। কিন্তু তাকে এখন বলা ঠিক হবে কি! বলি খাই, খুব কম। মাসে এক বা দুইদিন।

এসব কথার মাঝেই তার হাউস টিউটর এলে তুণা পড়তে চলে যায় রিডিংরুমে। কিছুক্ষণ টিভি চ্যানেল সার্ফিং করি। রোজেন এলে এটা সেটা মানে দরকারি কথা বলি। এরপর কি মনে করে বলে ফেলি, তুণার জন্য আমাকে কি সাবলেট দিবে ? ওর ডিপ্রেসন কেটে গেলে বাইরে চলে গেলে আমিও চলে যাবো।’

রোজেনের এমন একটা প্রতিক্রিয়া দেখি যেন বাংলা মুভির কোন সংলাপ আওড়াচ্ছি আমি। সে আমাকে বিদায় দেবার সময় এতো জোরে দরজা লাগায় সে শব্দটা চারতলা থেকে আমি নিচে নামার আগেই বাসার গেট পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। আমি সিড়ি দাপিয়ে নিচে নামতে থাকি এবং আমার মাঝে সেই প্রথম ইচ্ছা জাগে কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করুক। কিন্তু আমি জানি, বাস্তবতা হলো মানুষের জীবনে অপেক্ষার চেয়ে বড়ো কাজ হলো বহুপথে বারবার নিজের কাছে ফেরা।

বাসায় ফেরার পর রোজি ফোন করে জানায়, পরদিন দেখা করতে । পরদিন ধানমন্ডির সাতাশ নাম্বারের একটা রেস্তেরায় স্লাইডার ঠেলে রোজি ঢুকে । সোফার কোণে বসে ছিলাম। বসল মুখোমুখি। একটু সময় নিলো। মাঝে দুটি কফির মগ। আমি বললাম, 'দেখো রুচিবোধ চিরস্থায়ী কোনো ব্যাপার না। যার থাকে সে কুপমণ্ডুক। এটি তুমি ও না। আমি ও না। আমাদের মধ্যে অনেক কিছু হয়েছে। একটা ডিপ রিলেশন।

এটাকে কেউ প্রেম বলে। কিন্তু প্রেম বলো আর যাই বলো মানুষের রিলেশন তো স্থবিরতার শর্ত মেনে বেচেঁ থাকবে না। যদি বেচেঁ থাকে তবে সেটি ভণ্ডামি । অবশ্য জীবন একটু কপটতাকে ও এ্যালাও করে। অকপট হয়ে সমাজ সংসারে বেঁচে থাকা যায় না। এটাও তুমি জানো।'

এর বেশি কিছু বলিনি। বেরিয়ে যায় রোজি যা বোঝার সেটি বোঝে। কি বুঝেছে সেটি অবশ্যই আমার জানার কথা না। লাটিমের চক্কর। এই চক্রকে ঘিরে নাচে বাদর। মানুষের ভীড়। এরিমধ্যে হেটে যায় সবুজ টিয়া। রব উঠে, আমার নাম সুশান্ত। টিয়া যায় এগিয়ে। একটি হলুদ এনভেলাপ তোলে। ওই এনভেলাপ নেয় কারবারি। বলে যায় , ‘সুশান্ত ঘোষ, আপনার সামনে মহা বিপদ’।
এসব দেখতে দেখতে খবর পাই, রোজি আরেকজনের সঙ্গে প্রেম করছে। সরেছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। যেন ঘুরে বেড়ানোর জন্যই মন জন্মেছি আমরা। ঘুরেফিরে বলছি,‘নিঃসঙ্গতা মানে সঙ্গের অভাব নয়। নিঃসঙ্গতা আরো ব্যপ্ত এক ক্ষেত্র, এক কুয়াশাময় জগত। ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য মিস্ট। সেখানে ঢুকে যাওয়া সহজ, সেখান থেকে ফিরতে পারা সহজ নয়। মুখ বদলে গেলেও সঙ্গীর,থেকে যায় স্মৃতি। আই এ্যাম সিঙ্গেল বাট নট এলোন।’

রোজির সাথে আর আমার দেখা হয়নি। এখন শরতকাল। তবু বৃষ্টি হচ্ছে। ঘরে বসে গান শুনি। কথাগুলো এমন,একটা কাঁচঘর। সেই কাঁচঘরে বসে তুমি ই ঢিল ছুড়ছো। ভেঙে পড়ছে তোমার চারপাশ। তুমি কি তোমার সব্বাইকে ভুলে গিয়েছ !

আসলে এসব যেনবা আমার সাজানো ফ্যান্টাসি। আমি একটা অন্যজগতে ঢুকে পড়েছি। বারবার যখন প্রেমে পরা কোনো নারীকে প্রত্যাখান করে ফিরে আসছি তখন যেন মনে হয়, রোজেন আমাকে যেভাবে ডিভোর্স দিয়ে প্রত্যাখান করেছিল সেসময়ের আমার যন্ত্রণা, বিষাদ সবটুকু সেসব নারীদের ভেতর দিয়ে আমি রোমেনকে ফেরত দিতে চাচ্ছি। এরকম খেলায় মেতে উঠা নিশ্চয়ই সুস্থতা না। অদ্ভুত একটা ব্যাপারও ঘটে, যেমন প্রেমে জড়ানোর সময় মনে হয় ঠিক ঠিক আশ্রয় চাইছি। কিন্তু কিছুকাল চলে যাওয়ার পর ওইসব প্রেমিকারাই আমার কাছে একঘেয়ে উঠে পড়ে কিনা আমি খুব ক্লিয়ার না। নাকি তুণার কথা মনে পড়ে বলে সরে আসি?

মনে হয় সেসব সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার ঠিক আগে যেনবা তুণা আমাকে ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে আনছে। আমার হাত’ পা মোটা রশি দিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধা। সারা শরীরে কালো বসন্তের দাগ। একমুখ চুল দাড়ি। চোখ ঘোলাটে।বিছুটি। আমাকে কোথাও থেকে নিয়ে হেটে হেটে ফিরছে তুণা। সে সামনে। আমি পেছনে। দেখা যায় এরপরও আমি তুণার কাছ থেকে ছিটকে পড়ে ফের ভুলপথে পা বাড়াচ্ছি।

তিন

সেই ভুল পথেই পা দেওয়াতেই কী তুণা ডিপ ডিপ্রেসনে যাচ্ছে ? আমিও তো খুব ছোটবেলা থেকে খালি পালাতেই চেয়েছি। কখনো প্লেনে করে, কখনো ট্রেনে, কখনো কালিঘাটের ট্যাক্টরে, কখনো বা ঘুমের ওষুধে, মদে, আবার কখনো অচেনা মানুষদের নিজের ঘরবাড়ি ভেবে নিয়ে। এভাবে পালাতে পালাতেই তো দুদিক থেকে দুজন মানুষ জড়ো হয়েছিল রেলস্টেশনের ওয়েটিং রুমে। শ্রীমঙ্গলে। ট্রেনের দেরি। রোজেন আর আমি। এরপর আলাপ। ট্রেনে মুখোমুখি সিটে বসে যাত্রা।

ওহ আচ্ছা, রোজেন আপনার নাম? অর্থ কি? অর্থ হচ্ছে উপযুক্ত ? আধুনিক? অস্থির? নাকি আইনস্টাইনের ক্ষুদ্র বিবর ? আচ্ছা ওই ক্ষুদ্র বিবরটা কেমন ? সেই বিবর চিনতে চিনতে একসময় ঘরের মেঝেতে বিছানা। শিওরে লাল টেবিল ল্যাম্প। মাথার নিচে কার্লমার্কসের চারখন্ড ও কহলিল জিবরানের প্রফেট, এসবের ওপরে গোটা পাঁচেক ওড়না। কিন্তু তুণার জন্মের পরপরই তো পাল্টে গেল সব।

সেই তুণাই কি এখন প্রতিদিনের অন্ধকার ভেতরে নিয়েছে, অনেক ভেতরে। খুব যখন ছোট্ট ছিল, অন্ধকার ঘরে তাকে বন্ধ করে দেওয়া হত মজা দেখার জন্য। ওইটুকু মেয়ে, অন্ধকার ঘরে ভয় পায় না! কাঁদে না! যে কাঁদে না, সে কি ভয় পায় না? অনেক, অনেকদিন পর একদিন বলেছিল আমাকে, যে বলাগুলো বহুকাল ধরে গভীরে পুঁতে রাখা, শিকড় গজিয়ে গাছ হয়ে যাওয়া অভিজ্ঞতা খুঁড়ে বের করে আনা, যে ভয় তো পেত, খুব ভয় করত। কিন্তু কাঁদত না। কাঁদতে পারত না।

আসলে, বুঝতেই পারত না যে কাঁদা উচিৎ। ওসব সে শিখেওছিল দার্জিলিং এ মাউন্ট হারম্যান বোর্ডিং ইশকুলে যখন তাকে পড়তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

ওই ছোট্টবেলা থেকেই তুণার একটা ভেতরকার জগৎ ছিল। একটা অন্য মাত্রার সত্যি, যা বাস্তবের মিথ্যে রাংতা-মোড়ক ঢাকা পৃথিবীতে খুলে দেখানো যায় না। খুব ছোট্ট ছোট্ট কিছু চাহিদা ছিল তার, কিছু পুঁচকে পুঁচকে আনন্দ, যার অধিকাংশই, অন্ধকারের স্বাভাবিক নিয়মে, কারো না কারো বাস্তবের বুটজুতো থেঁতলে দিয়েছে। সেই থেঁতলানো ইচ্ছেগুলোই অপু জমিয়ে রেখেছে তাও।

সহজে সে কিছু ফেলে দিতেও পারে না। নিজের পুরনো কাপড়, ডায়েরি, বলপ্যান , টর্চলাইট সবই। মনের ভেতরে যে বিশাল দিঘীটার বাস, সেখানে সবচেয়ে গহন জায়গাটায় কৌটোয় পুরে রাখা তুণার যে প্রাণভোমরা, তা আসলে এক সমুদ্রসমান মায়া। খালি চোখে দেখা যায় না, চশমা পরেও না। আমি হয়ত দেখি। বা দেখিনা। বা ওকে ঘিরেও রয়েছে হয়তোবা আমার ফ্যান্টাসি।

চার

তাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় ফেসবুকে। এরপর ঘনিষ্ঠতা। একদিন দেখাও হয়। তখন তার স্বামী আছে। সংসার আছে। ভালো চাকরি আছে। বাড়ি আছে। গাড়ি আছে। যা নেই সেটি হলো কোনো বন্ধু নেই। আর আমার, বন্ধু রাখার জায়গা নেই প্রায়। সন্ধেবেলা শিশির পড়ছে,শিল্পকলা একাডেমিতে ‘নিত্যপুরাণ’ নাটক দেখে আমি আর তাবু মাঠে বসে ছিলাম। সেদিনই প্রথম দেখা।

আমি বলি, ‘এত গল্প জমে আছে আমার কাছে, তুমি শুনতে শুনতে বোরড ফিল করবে না তো?’ সে হাসে। বলে, ‘একটু অদলবদল ছাড়া সব মানুষের আসলে একই গল্প। তুমি যেভাবেই বলো না কেন, চমকাব না। ঘোর লাগার সময় কেটে গেছে আমার। হয়তো সেজন্যই নির্বান্ধব। তড়িঘড়ি করে বলার কিছু নেই। আবার ধীরে আস্তে অনেক ভেবেও বলার কিছু নেই।’

আমি তাবু’কে মুগ্ধ করার জন্য বললাম, আচ্ছা, তোমার কি ওই গল্পটা জানা আছে যে এক বৃদ্ধ লোক নিজেকেই চিঠি লিখত ও পোস্টঅফিসে গিয়ে চিঠি পোস্ট করে চলে আসত। এরপর সেই চিঠির অপেক্ষায় থাকত। পিয়ন এসে চিঠি দিয়ে গেলে সে পড়ত। এভাবে একশো একুশটা চিঠি লিখেছিল প্রেরক ও প্রাপক হিসেবে।

তাবু বলে, জগৎ পুরনো। মানুষ নতুন। এ গল্প নতুন ভার্সন। পুরনোটা এমন, এক আদিবাসী দ্বীপে একা থাকত। কেউ কথা বলার ছিল না। তাই কাজকর্মের ফাঁকে সে দুই কণ্ঠস্বরে কথা বলত। এক নারীকণ্ঠ। অন্যটি তার। পরে একদিন তার কণ্ঠই নারীকণ্ঠের মতোন হয়ে গেল। আর আসল কণ্ঠ ফিরে পেল না।

আমি জানতে চাই, তুমি এ দুটি গল্পে কী পাও?
সে বলে, মানুষের একাকিত্ব। আসলে মায়ার সংসারে ভাষার সংসারে আমরা প্যান্টোমাইম। আমরা কতোটুকুই বা ভাষায় প্রকাশ করতে পারি? পারি না। গল্পের ভাষার তো তাই ভাণ্ডার বড়ো থাকার কথা নয়। আপনি পারবেন আমার অনুভূতি অনুবাদ করতে? বা আমি আপনার?

আমার তখন সদ্য রোজেনের সাথে ডির্ভোস হয়েছে। ফলে একটা নারীসঙ্গ দরকার। কিন্তু কথা বলে বুঝতে পারি তাবু বেশ ফেমিনিস্ট। নিজেকে যতোটুকু আমি জানি সেটা হচ্ছে আমার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে মেল শভিনিজম কাজ করে। কিন্তু সেটা প্রকাশিত হলে তো আর কাজ হবে না। তাই আমি তার সাথে যে কৌশলটা নিই সেটি হলো, নারীবাদ পশ্চিমা প্রেডাক্ট,বিশেষ ইস্যু, এটসেটরা এটসেটরা। যে সমাজে পুরুষই মানুষ হিসেবে মুক্ত না সেখানে কে কাকে মুক্তি দিবে।

মানে রাষ্ট্রকে দাঁড় করানোর চেষ্টার ভেতর দিয়ে কৌশলে আমার মেলশেভিনিজমকে আড়াল করে তার ফেমিনিস্ট সত্ত্বাকে ভাঙতে থাকি। সে আমাকে জানায়, তার স্বামী শরীরে হাত তোলে। মাস্টারবেশন করে। পর্ণো দেখে। মানুষের সঙ্গে মিশুক চায় না। অনেকটা বোঝে না বোঝে একটা ঘোরের মধ্যেই তাবু একসময় আমার প্রেমিকা হয়ে ওঠে। আমাদের গল্প পুরনো হয়। হয় প্রাগহৈতিহাসিক।

এরপর বহুদিন পর কোভিডকালে হোম কোয়ারেন্টাইনের কোনো একদিনে আমি ফোনকল পাই তাবুর। ওপাশে সে কাঁদছে। তার কান্না যেন কুন্ডুলি পাকিয়ে আমার কানে এসে ঢুকে আমার শৈশবের কালিঘাটের তেতুল গাছের ওপরে বসে থাকা ঘুঘুর মতো। বৃষ্টির দিনে ঘুঘু ডাকে সেই প্রথম আমি জেনেছিলাম। সেই শৈশবে। তাবু জানায়, সে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েছে। মনে হয়, তার বেরিয়ে পড়া যেন ট্রেন মিস করা হোটেলের বিল মিটিয়ে বেরিয়ে পড়া একটা মেয়ের নিরুপায় রিকশা নিয়ে ইতস্তত এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি।

তাবু জানায়, কোথাও উঠবে। আর স্বামীর বাসায় ফিরবে না। মনে হয়, আমি এভাবে বহুবার এখান থেকে ওখানে আশ্রয়ের জন্য ছুটেছিলাম, সেই ছুটা শেষে ফের রাস্তায় ওভারস্যাক ঝুলিয়ে দাড়িয়ে থাকা। তাবু সেই থেকে সে ইন্দিরা রোডে একটা বাসায় এক বান্ধবীর সহায়তায় সাবলেটে উঠে। এর আগে বান্ধবীর বাসায় ছিল। তাবু আমাকে ফোন করে, জানতে চায় তুণার খবর। বলি, আমি রোজেনের কাছে তুণার জন্য সাবলেট চেয়েছি। এ সাবলেটটা আমার খুব দরকার।

পাঁচ

এর দুমাসের ভেতরেই আমি রোজেন ও তুণাদের সঙ্গে নতুন কলাবাগানের বাসায় সাবলেট উঠি। তুণা বাসায় থাকলে বেশিরভাগ সময়ই আমার ঘরে কাটায়। আমি ও তুণা প্রায়ই খাবার খেতে একসাথে টেবিলে বসি। টিভি দেখি। আমাদের বাবা-মেয়ের সহাবস্থানের সময় পাশের রুমে বা অন্যখানে রোজেন থাকে। তার কোনো অংশগ্রহণ থাকে না। টের পাই, আমার পছন্দের খাবার রান্না করতে সে ভুলে যায়নি। মাঝেমধ্যে শুনি রোজেন তুণার কাছে আমাকে নিয়ে গল্পও করে।

এই যেমন, প্যাথলজিক্যাল টেস্টের জন্য তুণাকে নিয়ে রোজেন গিয়েছিল। ব্লাড দেওয়ার সময় একটু ভয় পাচ্ছিল তুণা। ছয় টিউব রক্ত দিতে হবে শুনেই ভয় পেয়েছিল মা-মেয়ে। সেসময় রোজেনও বেশ নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। ব্লাড দেওয়ার পর রোজেন তুণাকে বলেছিল, তুমি ছোট তাকতে টিকাটুকা দেওয়ার সময় তোমার আব্বু আসত। আমি তো এসব দেখে অভ্যস্ত নই। এ ঘটনা তুণা আমাকে না বললে আমি জানতাম না।

জগতের নিয়মই তাই যে কোনোকিছুই একইরকম থাকে না। বিলীন অথবা বিস্তার। ভয় থেকে সভ্যতার শুরু। আবার সভ্যতাই ভয়েরও জন্ম দেয়। কী অবাক প্যারাডক্স। চিকিৎসাবিজ্ঞান এগুলো ঠিকই কিন্তু যেন জানান দিলো একটা ধুলির চেয়েও ক্ষুদ্র অদৃশ্য ভাইরাস বা ব্যকটেরিয়া সবকিছু শেষ করে দেয়। তুণা ফিজিক্সে ভাল। সে আমাকে এসব শোনায়। আমি জানি না এমন ভাব করে সব শুনি তাকে মুগ্ধ করার জন্যে। মেটোনিমি ও মেটাফোরের ক্ষেত্রে যে সাদৃশ্য রয়েছে সেটির ব্যাখা আমাকে শোনায়। আমি শুনি আর বয় পাই। আহা তুণা অল্প বয়সে জগতের বেশিকিছু জেনে ফেলেনি তো!

সে কি রহস্যগুলোর দরজা একে একে পেরিয়ে যাচ্ছে! একদিন ড্রয়িংরুমে খুব জোরে একটা ব্যালেন্ডিয়া মিউজিকের সুর শুনি। এরপরই তুণা আমাকে ডাকতে ডাকতে আমার গরে আসে। জড়িয়ে ধরে। জানায়, সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ের যে বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লাই করেছিল ভর্তির জন্যে। সেখান থেকে পরীক্ষার রেজাল্ট পেয়েছে। পাস করেছে। ভর্তি হতে বলেছে। আমিও ছুটে যাই আনন্দে। রোজেন সোফায় বসেছিল। সেইপ্রথম ডিভোর্সের পর তিনজনে আড্ডায় আনন্দে মেতে উঠি।

আমি ও রোজেন তুণাকে তিন/চারটা অতীতের গল্প শোনাই যেসব অনুপ্রেরণামুলক। ফাঁকে প্রেসার কুকার বাজে। বিড়ালটা সোফার কোণ থেকে লাফ দিয়ে দেয়ালে ঝুলানো স্মার্ট টিভিতে আরেকটি বিড়ালকে দেখে ঝাপটে ধরতে যায়। রোজেন কোনো কারণে ঘরের বাতি নিভিয়ে দেয় ‘চোখে বড় লাগছে’ বলে। তুণার মধ্যে কোনো ডিপ্রেসন নেই। অনেকদিন থেকেই ছিল না অবশ্য। আমি তুণা’কে বলি, কতো কতো দেশ ঘুরবে। কি আনন্দ তোমার!

তোমার ইলিনয়ের ম্যাজিক হোমে যাওয়ার খুব ইচ্ছা করত একসময় আমার। আমি তো যেতে পারিনি। তুমি যেও। সেই ম্যাজিশিয়ানের বাড়ি। কি যেন নাম, ডেভিড ক্র্যাটস। তুণা খুব আগ্রহভরে জানতে চায়। ম্যাজিক হোম নিয়ে আমিও ভালো একটা জানি না। কি বলব, মিথ্যার ধরণই এমন যে বেশিক্ষণ সে সাবলীল থাকেনা। তাই যতোটুকু জানি সেটুকুই বলতে থাকি, ম্যাজিক হোমে একসময় কলম্বাসের সঙ্গী এক ম্যাজিশিয়ান আশ্রয় নিয়েছিল। সে সারাদিন সারাসন্ধ্যা হাটত শহরময়। কারো সাথে কথা বলত না। এমনকি কখনো কখনো হেটে একশহর থেকে অন্য শহরেও যেতো। সে বেঁচে ছিল অনেকদিন। কিন্তু মরে যাওয়ার কয়েকবছর আগে তার বাড়ির বিভিন্ন ঘরবাড়ি সে বিভিন্নজনকে সাব-লেট দেয়। সন্ধ্যার পর সে একটা হলঘরের মতো রুমে সবাইকে আসতে বলত।

সবাই মিলিত হওয়ার পর সে পিয়ানো বাজিয়ে শোনাতো। এরপর মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে সে নিরুদ্দেশ হয়। তার বাড়ির সাব-লেটবাসীরা অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু সে ফিরে না।এরপর একরাতে বোমা বর্ষিত হয় বাড়িতে। কারা করেছিল, কে জানে। কোনো একটা যুদ্ধে এমন হয়েছিল। মজার ব্যাপার সে ই বোমা বর্ষণে সবাই মারা যান। এর পঁচিশবছর পর একটা মানুষকে দেখা যায় সেই ভাঙা বাড়ি ঠিক করছেন। গড়ছেন। যারা ম্যাজিশিয়ানকে চিনতেন তারা দেখেন সেই ম্যাজিশিয়ান ফিরে এসেছেন। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব ! আবার এটাও তো সত্য সেই মানুষ , বয়স চেহারা , আচরণ, উচ্চতা সবদিক থেকে মিলিয়ে ওই ম্যাজিশিয়ানেরই মতোন।
এসব আনন্দমুখর দিনগুলো আমাদের কেটে যায় দ্রুতই। রোজেন, তুণা ও আমি ঘুরে ঘুরে শপিং করে তুণার জন্য। টিকেট কনফার্ম করি। এরপর একদিন সেই দিন আসে। তুণার বিমানে চড়ার। আমরা একটু আগেভাগেই যাই।

তুণা চলে যায়। একটা ট্যাক্সিক্যাবে আমি ও রোজেন নিশ্চুপ বসে বাসায় ফিরি। দুজন দুঘরে। এর সপ্তাহ খানেকের ভেতরেই রোজেন আমাকে জানায় সাব-লেটের দিন শেষ। সংসার মানে একসঙ্গে একটা প্রোডাকশন, একটা ছবি, একটা গল্প। সংসার মানে অদরকারি এটাসেটা, মনের ভুলে কিনে ফেলা চায়ের কাপ, চুড়ি, মাটির পাতিল, যা কোনো কাজে লাগে না। কিন্তু কখনো দেখলে মনে হয় আহা কিনেছিলাম এইসবও । এইসব... সব... প্যাকিং বাক্সে চালান হয় বারংবার। ভাঙ্গা জিনিস, ভাঙ্গা কথা, ভাঙ্গা স্মৃতি, ভাঙ্গা প্রমিস, এসব নিয়েই ভাঙ্গা সংসার আবার একটু একটু করে ফেভিকল দিয়ে জোড়া লাগানো।

আমি ও রোজেনও ফেভিকল দিয়ে জোড়া লাগিয়েছিলাম। ফেভিকল হয়ত তুণা ছিল। তারপর একদিন পরবর্তী সংসারের জন্য বা একা থাকাকেই মেনে নিয়ে গোপন দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে নতুনভাবে চলা। যেন জিনসের প্যান্টে ধুলো লেগেছে। ঝেড়ে ফেলা। বিশ্ব সংসারে মনে হয় সবাই একাই , জাস্ট নিজের কাছেই অচেনা । ডার্ক পোট্রেট । তবু আরেকজনকে চিনতে চিনতে সংসারে গুম হয়ে যাওয়া । প্রেমে গুম হওয়া। যেন মনুষ্য জীবন একটা তৈরিই হয় শিকারের জন্য । শীরিষ গাছের ডালে বিতুয়া পাখি তাকিয়ে আছে আপনার দিকে, বিশ্বাস করেন একটু নড়লে চড়লেই ঠোকর। বেইসিক্যালি মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু সেটাই আসলে বড়ো প্রোডাকশন। আমিও এক সন্ধ্যায় ফের রোজেনের বাসা ছাড়ি।

ছয়

এসবের মধ্যে আরো কিছু আলেখ্য রয়েছে। যেমন তাবুর স্বামী স্ট্রোক করে মারা গেছে। তাবু সেকথা জানিয়েছিল কয়েকদিন আগে। আমি বসুন্ধরায় এক বন্ধুর বাসায় ফের সাবলেটে উঠি। তুণা ভর্তি হয়েছে। ভালো আছে। রোজেনের প্রমোশন হয়েছে। বদলি হবে চিটাগাং , একদিন ফোনে জানালো। তাবু প্রেম করছে শহিদুল নামের এক ব্যাংকারের সাথে। রোজি একটা এনজিওর কাজে দেশবিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে।

একরাতে আমার কাছে মেসেনজারে কল আসে। সম্ভবত ছোটবেলার বন্ধু উৎপলের। আমি কি বলি ঠিক মনে নেই। বা সে কি বলে সেটিও বুঝতে পারি না। মনে হয় আমরা অনেক দুরে দুরেই কথা বলছি। নেটওয়ার্কের সমস্যা। বাসার বেলকনিতে রকিং চেয়ারে বসেছিলাম , এটুকু শুধু মনে আছে। এর আগে বা পরে সত্যি কথা কি আমি মনেই করতে পারছিলাম না আলঝেইমার বা ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের মতো। হয়। এমন হয়। অনেক বেশি গল্প জমা হলে। লাম্পট্যের গল্প। প্রেমের গল্প। অপ্রেমের গল্প । মায়ার গল্প। বিশ্বাসহীনতার গল্প। ঠিক কোন গল্পটা থেকে আমি নিজেকে আলাদা করব অথবা সব গল্পতেই আমাকে খুঁজতে খুঁজতে যেন আমি একটা মলাট তৈরি করি।

মলাটের মধ্যে মিশে যেতে থাকি। যেখানে সবটাই গল্প। এক বৃহত্তর গল্প, তার মধ্যে আরো কিছু বড়গল্প, মেজোগল্প, ছোটগল্প। যেমন, শৈশবে জ্যামিতি বইয়ের পাতায় বিদঘুটে সম্পাদ্যের চিত্রের নিচে যে “অংকনের বিবরণ” লেখা থাকে সেখানে মাঝে মাঝেই দেখা পেতাম হঠাৎ সূক্ষ্মকোণ কিংবা স্থূলকোণ অঙ্কিত। আবার উপপাদ্যের প্রমাণেও দেখতাম, “তারা পরস্পর বিপ্রতীপ কোণ” কিংবা “তারা পরস্পর সম্পূরক কোণ”-এই ধরণের লেখা। এখন আমি যদি সূক্ষ্মকোণ আর স্থূলকোণ কীভাবে আঁকতে হয় তা না জানি অথবা বিপ্রতীপ কোণ আর সম্পূরক কোণ কখন হয় তা না জানি, তাহলে আমার জন্যে সম্পাদ্য আঁকা কিংবা উপপাদ্য প্রমাণ করা উভয়ই প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। আমি যেন ওই অসম্ভব ধাঁধায় জড়িয়ে পড়েছি।

আমার এরপর আর সত্যি আগে বা পরের কিছুই মনে ছিল না। শুধু কিছু একলা আকার সেই রাতে দেখতে পারছিলাম। আর কিছুই না। এমনকি আমার প্রাণপ্রিয় তুণাকেও না।

 

   

ফেরদৌস আরার প্রবন্ধের আলপথ বেয়ে পাঠক চলে যান জ্ঞানের সমুদ্রদর্শনে



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘লেখকের প্রচুর অধ্যয়ন, পাঠগভীরতা, নিবিড় অনুসন্ধিৎসা, ঘোরলাগা শব্দপুঞ্জে, ভাষার শিল্পিত সুষমায় লেখাগুলি প্রাণ পেয়েছে। তাই গ্রন্থের তথ্যসমৃদ্ধ বারোটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য শুধু নয়, নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, জানার তাগাদা তৈরি করবে—বোধে, তৃষ্ণায়, জীবনজিজ্ঞাসায়। নিজের কথাই বলি, ফেরদৌস আরা আলীমের চোখ দিয়ে পড়তে পড়তে আমি নিজে প্রায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আফরোজা বুলবুল কিংবা প্রতিভা মোদক (‘যে জীবন শিল্পের, যে শিল্প জীবনের’), করুণা বন্দোপাধ্যায়, রবিশংকর বলকে (‘চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর’) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে আস্বাদ করি সময়-পরিক্রমায় লেখক ফেরদৌস আরা আলীমের কলমের ক্ষুরধার ক্রমমুগ্ধকর সৌন্দর্য।’

শনিবার (৪ মে নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক গলিতে অবস্থিত মাসিক নারীকণ্ঠ পত্রিকা-আয়োজিত ‘বই আলোচনা’-অনুষ্ঠানে ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আলপথে শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের মূল আলোচকের আলোচনায় তহুরীন সবুর ডালিয়া এসব কথা বলেন। বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনায় আরও অংশ নেন নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা জিনাত আজম, সালমা রহমান ও মাধুরী ব্যানার্জী।

নারীকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আহমেদ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শাহরিয়ার ফারজানা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতারী ইসলাম বলেন, ‘নানা বিষয়ে ফেরদৌস আরা আলীমের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সহজভাবে তিনি আমাদের সমাজবাস্তবতার যে-চিত্র আঁকেন তা মনের গভীরে সাড়া জাগায়। তার লেখা পড়ে এটুকু বলতে পারি যে, তার লেখা আমাদের জন্য গবেষণা ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান আকর।’

প্রবন্ধের আলপথে বইয়ের প্রকাশক, কবি ও খড়িমাটি-সম্পাদক মনিরুল মনির বলেন, ‘নারীমুক্তি বিষয়ে এ-বইয়ে দুটি তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে আরও কাজ করার জন্য গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রকাশিত বই নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘বড় কিছু হওয়ার কথা ভেবে লিখিনি, মনের আনন্দেই গোপনে গল্প-কবিতা লিখেছি। এমন একসময়ে আমরা লিখতাম, লেখা প্রকাশ করতে খুব লজ্জাবোধ করতাম। অবশ্য লিখতে গিয়ে তেমন কঠিন বাধা আমাকে ডিঙোতে হয়নি। একালের চেয়ে আমাদের সময়টা ছিল অনেক সুন্দর ও ভালো। মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল সমাজে। গণ্ডগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে চড়ে ঢাকা গিয়েছি একা-একা, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। মা-বাবারাও নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকাল মেয়েরা পদে-পদে বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের কলুষিত সমাজব্যবস্থা ও নষ্ট রাজনীতি।’ সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রশংসার ভূমিকা কম নয়। একজন লেখক তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য পেলে অনুপ্রাণিত হন যা তাকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি জোগায়।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা ও সদস্য রোকসানা বন্যা, মহুয়া চৌধুরী, রেহানা আকতার, সাহানা আখতার বীথি, কানিজ ফাতেমা লিমা, বিচিত্রা সেন, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, চম্পা চক্রবর্ত্তী, প্রচার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জয়, কবি মেরুন হরিয়াল ও কবি মুয়িন পারভেজ প্রমুখ।

;

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

;

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;