আনা বার্ন্স কে?



এনামুল রেজা
আনা বার্ন্স

আনা বার্ন্স

  • Font increase
  • Font Decrease

১.

..আনা বার্ন্স ম্যান বুকার জিতেছেন। আগেই কিছুটা অনুমান করেছিলাম। বিশ্বসাহিত্যে ফ্যান্টাসি আর ডিস্টোপিয়ার এই রমরমায় রিয়েলিস্ট ঘরাণার কাউকে খুঁজতোই কমিটি। মাস খানেক আগে এক লেখক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল এ নিয়ে।

এবার কে জিতবে?

সবচেয়ে কমবয়সি হিসেবে ডেইজি জনসন?

প্রায় সমবয়সী ওই ব্রিটিশ লেখিকা পেয়ে যেতে পারেন, এরকম অনুমান বহু পশ্চিমা পাঠক-পাঠিকা ও পত্রিকা সম্পাদকদেরও ছিল। তার উপন্যাসের নাম এভরিথিং আন্ডার। কিন্তু, বললাম, হোক না ইডিপাসকে নারী হিসেবে কল্পনা করে পৌরাণিক কাহিনীটির রিটেলিং দারুণ ব্যাপার, আমার বাজি আনা বার্ন্সের ওপর। 

এ কে?

উত্তর আয়ারল্যান্ডের লেখিকা। অন্য জিনিসি। তার লেখা ডিপ, এনগেজিং, সোশাল এওয়ারনেসে ভরপুর, বুদ্ধিদীপ্ত। কিছুটা ট্র্যাডিশনাল, অনুচ্ছেদহীন লং প্রোজে লেখেন।

বন্ধু শুকনো মুখে জবাব দিল, ‘আচ্ছা আচ্ছা।’

আমার অনুমানশক্তি ভালো, এই যে বিকল্প সাহিত্য নোবেল দেওয়া হলো এক বছরের জন্য, মুরাকামি পুরস্কার ঘোষণার আগে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিলেন, এসব কি আর বুঝিনি? মনে করে দেখো, এমন কিছু একটা তোমাকে বলেছিলাম না? এমনকি নমিনিদের শর্টলিস্ট প্রকাশ হবার আগেই ভেবেছিলাম, মুরাকামিকে নিশ্চয় এবার..

বেশ। এবার একটু দম নেওয়া যাক। 

২০১৮ সনের বুকার পুরস্কার ঘোষণার পর উপরের অনুচ্ছেদের মতো কোনো কিছু আপনার পড়ার সুযোগ ঘটেছে বাংলাদেশি পত্র-পত্রিকায়? আমি কিছুটা নিশ্চিত যে ঘটেনি, কারণ আমারও মেলেনি সুযোগ।
আনা বার্ন্স কে? বলা নেই, কওয়া নেই, আনকোরা এক লেখিকাকে বুকার কমিটি মিষ্টি দিয়ে দিল!

২.

সাহিত্যের রাজনীতি নিয়ে অনেক কচকচি করা যেতে পারে এ ধরনের রচনায়। বুকার কারা দেয়, কেন দেয়। বুকার পেলে কী হয়। কী কী হিসেব কষমান থাকে একটা বইকে নির্বাচন করবার আগে। এসব আলাপ প্রতি বছরই পড়ি আমরা দৈনিক পত্রিকা বা ওয়েব ম্যাগাজিনগুলোতে। পড়ি আর ভুলে যাই, পরের বছরের জন্য অপেক্ষা করি। একেবারে প্রতি শীতে দুস্থ লোকজন যেভাবে শীতের কাপড়ের জন্য অপেক্ষা করে, শীত গেলে কাপড়টা আর সংরক্ষণ করে না, নতুন বছরে ফের তো মিলবে।

নিবন্ধ রচয়িতারও শ্রম নেই। একই ফর্মা, খালি বিজয়ীর নাম, বইয়ের সারসংক্ষেপ আর দিন তারিখ বদলে দিলেই হলো।

তো, এ বছর আমি ভেবেছিলাম, একটু ব্যতিক্রম হবে। বুকার কমিটি যাকে নির্বাচন করেছে, একদম আনকোরা ঔপন্যাসিক। আনা বার্ন্স নামটা শুনলেই বারবার জুলিয়ান বার্নসের কথা মনে পড়ে। ২০১২ সালে ওই বার্নসও (জুলিয়ান) বুকার পেয়েছিলেন, তিনি আগে থেকেই ছিলেন বিখ্যাত লেখক।

এই বার্ন্সকে (আনা) প্রথম সাক্ষাতেই আমার অপছন্দ হয়ে গেল।

পুরস্কার পেয়ে বোকা বোকা হাসছেন। ফ্যাকাশে একজন প্রৌঢ়া। গ্ল্যামারহীন। হালের পশ্চিমা লেখিকারা প্রায় নায়িকাদের মতো সুন্দরী, সে তুলনায় এনাকে পছন্দ করার কোনো কারণ দৃশ্যমান নাই। উপরন্তু, আনার পেছনে এক হাতে থাবা দিয়ে স্মারক এওয়ার্ডটা ধরে আছেন তারচেয়ে আধহাত লম্বা ডাচেস অব কর্নওয়াল। ছবিটাও অপছন্দ করার মতো।  

যাই হোক, আমরা জানি যে, সত্যিকার লেখকের পারফর্মেন্স আর্টিস্ট না হলেও চলে, লেখাই আসল, ট্রু লিটারেচার নিজে থেকেই তার পথ করে নেয়—ইত্যাদি ইত্যাদি।
মিল্কম্যান (২০১৮) বা আনা বার্ন্সের নাম আরো অনেক সাহিত্য রসিকের মতো আমিও শুনিনি আগে। পরেও খুঁজে পেতে তার সম্পর্কে বিস্তর কিছু জানা গেল না। জানা গেলেও বা কী। চিনি না জানি না, এরকম একজন লেখককে হুট করে

কোন আগ্রহে খুঁজব? বইয়ের শেষ আছে? বুক শেলফ ভরে আছে অপঠিত বইয়ে। 

এ প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গিয়েই বুকারের গুরুত্ব সামনে চলে আসলো।

উত্থানের পর থেকেই বুকার পুরস্কার এক ধরনের বুস্টার হিসেবে কাজ করে আসছে লেখকদের জন্য। তুলনামূলক তথ্য উপাত্ত বের করলে দেখা যাবে, নোবেল পুরস্কারও কোনো লেখকের বই বিক্রি এতটা বাড়িয়ে দেয় না যতটা বুকার দেয়। কোনো লেখকের বুকার পাওয়া মানেই উত্তর আমেরিকা, ব্রিটেন ও পৃথিবীর প্রায় সবখানে তার উপন্যাসটা হটকেকের মতো বিক্রি হওয়া। লেখক রাতারাতি সেলিব্রেটি বনে যান। বিশেষ করে একবিংশ শতকে এই পরিসংখ্যান দারুণ উর্ধ্বগামী।

একটু গভীর বইপ্রেমিরা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, ঢাকার নীলক্ষেতেও কী রকম কয়েক হাজার বিক্রি হয়ে যায় বুকারজয়ী বইয়ের নীলক্ষেত কপি। পড়া হয় কী হয় না, সে আলাপের সঙ্গে বই বিক্রির সম্পর্ক সামান্যই।
মানুষ গ্ল্যামার খায়। বুকার হলো বিশ্বসাহিত্যের সবচেয়ে বড় গ্ল্যামারের মুকুট।

সুতরাং, আমি না চিনেও হতাশ হইনি, ভেবেছিলাম, গেলবারের জর্জ সন্ডার্সের মতন এ বছরেও আনা বার্ন্স আনা বার্ন্স করে সকল দেশীয় পত্রিকা, ওয়েব ম্যাগ, আর ফেসবুকের নিউজফিড মশগুল হয়ে উঠবে। তা হলো না। দৈনিকগুলোতে বিদেশি নিউজ থেকে অনুদিত কিছু রিপোর্ট ছাড়া মিল্কম্যান নিয়ে উচ্ছাস কোথাও দেখিনি।

প্রথমত, বার্ন্স প্রসঙ্গে পশ্চিমা পাঠক-সম্পাদক গোষ্ঠীও কিছুটা হতাশা মিশ্রিত বিস্ময়ে ভুগছেন। দ্বিতীয়ত, উপন্যাসটা এখনো প্রকাশিত হয়নি আমেরিকায়। মূল হৈচৈটা তারাই করে থাকে। তৃতীয়ত, আনা বার্ন্স গ্ল্যামারহীন, তার ট্র্যাক রেকর্ড এখনো অস্পষ্ট। যেহেতু আমরা কগনিটিভ বায়াসে (শব্দটা নতুন শিখেছি, ঝেড়ে দিলাম) ভুগি, যাকে অন্যরা ভালো বলছে না বা ভালো কি না ওভাবে শোনা যাচ্ছে না, তার বিষয়ে না বলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

৩.

এই অংশটা, অর্থাৎ মিল্কম্যান কী নিয়ে লেখা গুগল করলেই আগ্রহীরা পেয়ে যাবেন। তবু গুগল করতে যারা চান না, তাদের জন্য এই অনুচ্ছেদ:  
উইকিতে লেখা হয়েছে, উত্তর আয়ারল্যান্ডে ১৯৬০ থেকে ১৯৯৮ সন পর্যন্ত যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংঘাত চলেছিল তাকেই ‘দা ট্রাবল’ (যেন দুনিয়াতে আর কোনো ট্রাবল নাই) বলে, মিল্কমানের সেটাপ তার শেষ দিকে, অর্থাৎ ১৯৯০ সনের এদিকে ওদিকে। উপন্যাসের নায়িকা ‘মিডল সিস্টার’—এ ছাড়া তার আর কোনো নাম পাওয়া যায় না, মূলত কোনো কিছুরই নাম পাওয়া যায় না সেভাবে। ১৮ বছরের এ তরুণী আমার মতোই বই লাভার। সে ক্লাসিক পড়তে ভালোবাসে। বর্তমান তার পছন্দ নয় বলেই ক্লাসিক তাকে টানে। কিন্তু আসলে দেখা যায়, সে এক যুবককেও ভালোবাসে। কিন্তু, সে এমন একটা সমাজে বসবাস করে, যেখানে মেয়েদের পক্ষে উল্লেখযোগ্য বা বিশেষ যে কোনো কাজ করাটা বিপদজনক। কেউ তেমন কিছু করলেই শহরের আর সবার আলাপের বস্তু হয়ে উঠতে হয়। আমাদের নায়িকা এজন্যই তার প্রেমিককে গোপন করে রাখতে খুব সতর্ক। এমনকি নিজের মা’কেও সে কিছু জানায় না। এইসব সতর্ক দিনেই মিল্কম্যানের বদনজরে পড়ে সে। মিল্কম্যান এক প্যারামিলিটারি লিডার। উপন্যাসের অনামা শহরে সে সর্বেসর্বা। সমাজটাও ঘোর মোড়লতান্ত্রিক (একেবারে গ্রামবাংলা টাইপ মনে হয়)। মিল্কম্যান জোর করেই আমাদের নায়িকাকে বিয়ে করে, যে তার চেয়ে বয়সে কয়েক গুণ বড় এবং হুমকি দেয়, টেরিবেরি করলে সে মিডল সিস্টারের প্রেমিককে খুন করে ফেলবে|

সহজ গুগলিং করা অনুচ্ছেদ শেষ হলো। এবার ডিপ গুগলিং ও মনের কথা। এ অনুচ্ছেদ থেকে আমি আবার আগের মতো স্বাধীন:
ধর্মীয় গোঁড়ামিতে পরিপূর্ণ যে কোনো দেশের প্রেক্ষাপটেই হয়তো আনা বার্ন্সের মিল্কম্যানকে ফেলে দেওয়া যাবে। উত্তর আয়ারল্যান্ডের এমন এক সমাজের গল্প এই উপন্যাসে করা হয়, যেখানে মেয়েরা সমাজের চাপা পড়া অংশ। তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নেই। এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার চেয়ে কোনো একক ব্যক্তি আর সকলের ওপর ক্ষমতাশীল। এতে কারো তেমন মাথাব্যথাও নেই। সবচেয়ে ভয়ানক বিষয়টা হচ্ছে, কেউ যদি বলে সে নির্যাতিত, নির্যাতনের চিহ্ন তাকে দেখাতে হবে। শরীরে ক্ষতের দাগ নেই মানে সব ঠিকঠাক। একজন নারী পরিবার ও সমাজ থেকে যত রকম মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়, সেসবের অধিকাংশই তো দৃশ্যমান চিহ্নবিহীন। আমাদের নায়িকা ‘মিডল সিস্টার’ যে শহরে বসবাস করে সেখানে বিশ্বাস করা হয়—চিহ্ন যেহেতু নাই, নির্যাতনও নাই। এবং পুরো শহরটা কানকথায় সরগরম। একে অন্যকে নিয়ে কেচ্ছাকাহিনী ও কুৎসা ছড়ানো ও সেসবে আড্ডা গরম করাটা শহরবাসীগণের অন্যতম কাজ।

এইসবের মধ্য দিয়েই উঠে আসে রহস্যময় মিল্কম্যানের জীবন, ক্ষমতার অপ-ব্যবহার, ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের অসহায় আত্মসমর্পণ আর পৃথিবী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন বুক লাভার মিডল সিস্টারের অন্ধকার থেকে মুক্তির সংগ্রাম। সে সংগ্রাম করে কি না এটাও বলা যায় না, সে আসলে তার গল্পটা বলে যায়। 

এ কাহিনীতে ‘দা ট্রাবলের’ বিশেষ কোনো ধারাবর্ণনা নেই, ঐতিহাসিক ইভেন্ট নিয়ে যেমন নেই মিডল সিস্টারের কোনো আগ্রহ, তার না জানাটা দারুণ কুশলীভাবে পাঠকেরও না জানা হয়ে থাকে।
এই দিকটা আমার কাছে দারুণ লেগেছে।

ঐতিহাসিক উপন্যাস মানেই যে মূল চরিত্রকে এনসাইক্লোপেডিক হবে, তা তো না। মিল্কম্যানের নায়িকা এক নির্যাতিতা যুবতী, তার জ্ঞানের জগত ক্লাসিক উপন্যাসে সীমিত, চলমান পৃথিবী নিয়ে তার ধারণা বা আগ্রহ দুটোই সামান্য। সে জানে একটা সংঘাত চলছে দেশে, এটুকুই আমাদের জানায় যে সেটা “দা ট্রাবল”, সে তাই আমাদের শোনায় মানব জীবনের অদৃশ্যমান, প্রমাণহীন সঙ্ঘাতের গল্প, যা আরো অন্ধকার, অধিক বিধ্বংসী।  

৪.

সময়টা গুরুত্বপূর্ণ।
অনেকে মনে করছেন, নিজেরা ভুক্তভোগী কিন্তু বলা যায় না এমন গোপন সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে নারীরা মুখ খুলতে শুরু করেছেন আজকের পৃথিবীতে। মি টু মুভমেন্টের এই সময়ে বিস্ময়করভাবেই মিল্কম্যান খুব প্রাসঙ্গিক একটা উপন্যাস।

এজন্যই কি বইটা পুরস্কৃত হলো?

এ মুভমেন্ট কত লম্বা হবে, সেটা নিয়ে কারো ধারণা নেই। কিন্তু, বুকার কমিটি বা সমালোচকদের সন্দেহ নেই যে মিল্কম্যান ট্রু লিটারারি পিস। তার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হবার যোগ্য।

এ বই কোন দিক থেকে বৈশ্বিক? আমি বলেছি আগে। আশা করি, আপনিও বুঝতে পারছেন। পৃথিবীটা এখনো মোড়লতান্ত্রিকই আছে। নারীরা এখনো নির্যাতিত হচ্ছেন পৃথিবীর সকল দেশেই। মিল্কম্যান উপন্যাসটিকে সে অর্থে এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটা শক্ত কণ্ঠ হিসেবে ধরে নেওয়া চলে।

৫.

বিষয়বস্তু গেল, পড়তে কেমন আনা বার্ন্সের গদ্য?

লেখিকার সাক্ষাৎকার থেকে যা জানলাম, মিল্কম্যানে মিশে আছে তার আত্মজৈবনিক উপাদান। তিনি নিজে যে সমাজ থেকে উঠে এসেছেন, তা ছিল অপরাধ, অবিশ্বাস আর বিকৃতিতে সয়লাব। মিল্কম্যানে সেই সমাজে নারীর অস্তিত্বের গল্পই তিনি করতে চেয়েছেন।

যতটা পড়বার সুযোগ হয়েছে, এ উপন্যাস একই সঙ্গে আকর্ষণীয় এর গদ্যের জন্য, আবার অনাকর্ষণীয় সেই সুন্দর গদ্যের বিরামহীনতার কারণেই। দম নেবার ফুরসত নেই। যেন ঔপন্যাসিক চাইছেন মূল চরিত্রের যে অস্থিরতা, জীবনের প্রতি অনাগ্রহ, ভয় ও বিরক্তি—সেসব অভিজ্ঞতা পাঠকও পাক, কাহিনী তো আছেই, গদ্যেও বা ওসব পাইয়ে দেবার প্রচেষ্টা বাদ থাকবে কেন?

সুতরাং, সহজপাঠ্য নয় মিল্কম্যান।

মনোযোগী পাঠের দুর্গম উপকূল পাড়ি দিয়েই পাঠককে নতুন কোনো অনুভূতির মুখোমুখি হতে হবে। সেটাই অনুমান।

৬.

ঔপন্যাসিক হিসেবে আনা বার্ন্সের যাত্রাটা কখনো মসৃণ ছিল না। এর আগে তার দুটি উপন্যাসের (নো বোনস - ২০০১, লিটল কন্সট্রাকশন - ২০০৭) ও একটি নভেলার (মোস্টলি হিরো - ২০১৪) কোনোটাই সেভাবে পাঠকের মনোযোগ পায়নি। তবে প্রথম উপন্যাসটি ক্রিটিকালি সফল হয়েছিল, জিতেছিল উইনিফ্রেড হলবাই মেমোরিয়াল প্রাইজ (নাম শুনেছেন আগে? আমিও শুনিনাই)।

বুকারে শর্টলিস্টেড হবার আগে মিল্কম্যানও সেভাবে কারো মনোযোগ কাড়েনি। সেজন্যেই হয়তো, একদম অপ্রত্যাশিত এই পদক ও অর্থ হাতে ৫৬ বছর বয়সী গ্ল্যামারহীন লেখিকা আপ্লুত হওয়া ছাড়া আর কিছু করবার সুযোগ পাননি।
আর্থিক সঙ্কটে ছিলেন তিনি। ডুবে ছিলেন ঋণে। পুরস্কারের অর্থমূল্য পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড (বাংলাদেশি টাকায় ৫৩ লাখের মতো) তার দারুণ কাজে লাগবে, অকপটে বলেছেন, ঋণদাতারা তার জন্য অপেক্ষা করে আছেন।

কিন্তু, বুকার কমিটির এ ব্যতিক্রমী পছন্দ কি বইয়ের বাজারে অন্যান্য বারের মতোই ঝড় তুলবে? বেস্ট সেলার হবার উপাদান কি আছে মিল্কম্যানে? অবশ্য নেম অব দা রোজের মতো দুষ্পাঠ্য উপন্যাসও বেস্ট সেলার যেহেতু হতে পারে, আনা বার্ন্সের সম্ভাবনা কম ভাবার কারণ নেই। এমন একদল লোক তার মাঝে সাহিত্যের মৌলিক উপাদান আবিষ্কার করেছে, যারা পর্যাপ্ত গ্ল্যামারেরও যোগানদাতা।

এমনটা খুব অল্পই ঘটতে পারে আজকের পৃথিবীতে। প্রায় অজ্ঞাত এক ঔপন্যাসিককে এভাবে আবিষ্কার করতে পারাটা বুকার কমিটির জন্য বড় অর্জন।

হয়তো বিশ্বসাহিত্যে আরো অনেক উপন্যাসের বিখ্যাত সূচনা বাক্যের সঙ্গে যোগ হতে চলেছে মিল্কম্যানের এই অসাধারণ বাক্যটিও:  The day Somebody McSomebody put a gun to my breast and called me a cat and threatened to shoot me was the same day the milkman died.   

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;