আকবর আলীর তৃতীয় পাপের আগে



রুমা মোদক
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

মোমেনা ঘরে এসে পাশে বসে কপালে হাত রাখতেই ধপ করে নিবে যায় ইলেকট্রিসিটি। আকবর আলীর মনে হয় তার প্রস্তুতির সাথে এই শত্রুতা পূর্বপরিকল্পিত, মোমেনা ঘরে আসার সাথে সাথে অন্ধকার নামা আর তার সাথে চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা আবহাওয়া। দীর্ঘ প্রস্তুতির কঠোর আত্মনিয়ন্ত্রণের পথ বেয়ে আজ সে নিজেকে দাঁড় করিয়েছে যে হিমশীতল চূড়ান্ত গন্তব্যের কাছাকাছি, আকবর আলী টের পায় মোমেনার করতলের উষ্ণতা সংক্রামক হয়ে সেই হিমশীতলতা গ্রাস করে ছড়িয়ে পড়তে চাইছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে.....বিশেষ অঙ্গেও! কী লজ্জা!! হিমশীতলতার বরফ গলে গলে পরাজিত হতে চায় জীবনের উষ্ণতার কাছে, নৈতিক কিংবা অনৈতিক, পাপ কিংবা পূণ্য কোনো হিসাবের ধার না ধেরে বেহিসাবী দুর্নিবার হতে চায়। কিন্তু, কিন্তু  প্রাণপণ লড়াই করে নেওয়া প্রস্তুতিকে এত তাড়াতাড়ি পরাজিত হতে দেবে সে? হতেই পারে না।

ঠিক তখন স্বর্গ মর্ত্য পাতাল কাঁপিয়ে একটা ঠাডা পড়ে বাইরে, ইলেকট্রিসিটিহীন জমাট জমাট অন্ধকার ছিঁড়ে ফুড়ে যায় বিজলীচমকের ডালপালায়। বিছানা লাগোয়া জানালার শার্সির কাঁপন থামে না, সমতলে ছুঁড়ে দেওয়া পানির মতো ছড়িয়ে যায় জানালা লাগোয়া নিষ্প্রাণ খাট-বিছানা আর সপ্রাণ মানুষ পর্যন্ত। আকবর আলী পাশ ফিরে শোয়, আজ তার শেষ সিঁড়ির ধাপগুলো পার হওয়ার কথা। প্রস্তুতিকাল অনতিদীর্ঘ হলেও প্রস্তুতির লড়াইটা কঠিন। প্রতিনিয়ত নিজের সাথে। লড়াইটা তার জন্য কঠোর হয়েছে অনভ্যস্ততার কারণে। এমন নয় যে সে আগে জীবনের জন্য কোনো সিঁড়ি বানায়নি সিঁড়ি বানানোর জন্য কোনো পাপ করেনি। মূলত জীবনের অতি অনিবার্য প্রয়োজনগুলো পাড়ি দেওয়ার জন্যই আরো দুটি পাপ করতে হয়েছে তাকে, পাপের বিনিময়ে সিঁড়ি বানাতে হয়েছে। কিন্তু তখন পাশে সান্ত্বনা নিয়ে আশ্রয় দিয়ে পরামর্শ দিয়ে পাশে ছিল জহুরা, জহুরা খাতুন। জহুরা খাতুন ছাড়া সে ছিল অচল, অসহায়, কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

জননী যেমন খুন করে আসা পুত্রকেও ক্ষমা করে আশ্রয় দেয়, জহুরা ঠিক তেমন আশ্রয় ছিল তার। কিন্তু এই অন্তিম সিঁড়ি বানানোর লড়াইটি সম্পূর্ণ তার একার। কেবলই একার। আর এই লড়াই সিঁড়ি বানিয়ে প্রয়োজন পাড়ি দেবার নয়। বরং সব প্রয়োজন শেষ করে পাপ থেকে মুক্তি পাবার। যে পাপের কথা যে লড়াইয়ের কথা জহুরাকে জানানো যায় না। জানায় নি সে।

মোমেনার গায়ের গন্ধ তাকে বিচ্যূত করছে লক্ষ্য থেকে, শেষ সিঁড়িতে পা রাখার সকল প্রস্তুতি তার নস্যাৎ করে দিচ্ছে সুচতুর রাজনীতিবিদের মতো। মেয়েটা নিষ্পাপ। আকবর আলী জানে। তাই যতই সে অন্তর থেকে চাইছে মোমেনা চলে যাক, চলে যাক এখান থেকে, মুখে বলতে পারছে না। থাকুক বসে মোমেনা। তীরে এসে তরী ডুবালে চলবে না তার। অগ্রাহ্য করতে হবে মোমেনার উপস্থিতি, অবিচল থাকতে হবে নিজের লক্ষ্যে। তৃতীয় এবং শেষ ধাপের সিঁড়ি বানানো শেষ তার, এবার শুধু পাড়ি দেবার পালা...বানানো যখন শেষ তখন পাড়ি দিতে আটকে গেলে চলবে? ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না শেষ জীবনের শেষ  লড়াই।

আকবার আলী পা রাখে সিঁড়ির প্রথম ধাপে। ঠিক তখন দেখতে পায় একদম শেষ প্রান্তে, চূড়ান্ত গন্তব্যে হাত বাড়িয়ে বসে আছে জহুরা খাতুন। আশ্চর্য! জহুরা খাতুন কী টের পেয়ে গেল? সে তো এই বলেনি জহুরা খাতুনকে। তবে কেন সে হাত বাড়িয়ে বসে আছে বাউন্ডুলে ছেলের ঘরে ফেরার অপেক্ষায় থাকা মায়ের মতো?

সেই প্রথমবার প্রথম পাপটি করে বাড়ি ফেরার পরও জহুরা চেহারা দেখেই বুঝে ফেলেছিল কিছু একটা ঘটেছে। কিন্তু তারপরও সারা বিকাল-সন্ধ্যা তাঁকে ঘাটায়নি কিন্তু রাত গভীর হলে, নিঃশব্দ হলে, আদিম প্রবৃত্তি যখন উত্তাল হয় বিপরীত লিঙ্গের সান্নিধ্যের নেশায়, তখন জহুরা একে একে শরীরের ভাঁজ খুলে খুলে জানতে চায়—কী হইছে কন দেহি তোবারকের বাপ। আকবর আলী জানে জহুরার কাছে লুকাবার কোনো উপায় নেই। প্রয়োজনও নেই। স্বীকারোক্তি নয়। বরং বলাটা প্রয়োজন। কারণ জহুরাই একমাত্র আশ্রয় তার। নিজেকে নির্দোষ কিংবা মহান প্রমাণপূর্বক সামান্য সহানুভূতি প্রত্যাশার ভান না করেই সে বলে, সদ্য অবসরপ্রাপ্ত হেড কেরানি কেরামত খানের পেনশনের ফাইল আটকে পঞ্চাশ হাজার টাকা উৎকোচ নেবার ঘটনাটা। জহুরা  দু’ হাতে আকবর আলীকে শরীরের অলিন্দে অলিন্দে টেনে নিতে নিতে ফিসফিস করে—খুব ভালা করছো। খুব ভালা কাম করছো। ব্যাটার কামটাও হইল, আম্রারটাও। জহুরা খাতুনের উৎসাহে সেদিন আকবর আরীর শিরায় শিরায় যেন নতুন যৌবনের টগবগে ঘোড়ার জোয়ার নামে। উদ্দাম হয়ে পড়ে সে......জহুরাও ফোঁস ফোঁস শব্দে আত্মসাৎ করে স্বামীর মধ্যযৌবনের উপচে ওঠা জোয়ার। দুজনেই পরমতৃপ্ত। এই পঞ্চাশ হাজার টাকা এই মূহুর্তে না হলে বড় মেয়ের বিয়ের খরচের শুরুটা করা যাচ্ছিল না।

এই ছেলে যে দুনিয়াতে কেমনে করে খাবে—এই চিন্তায় চিন্তায় শেষ শয্যায় গেছে আকবার আলীর বাপ-মা। তিন ছেলের মধ্যে আকবর আলী সবচেয়ে সরল-সহজ। পাড়ার ছেলেরা তারে মূল দলে না নিয়ে সাইড লাইনে বসিয়ে তারই ফুটবল দিয়ে দিব্যি খেলে যায়। বন্ধুত্বের খাতিরে সময় সময় তার মাথায় হাত বুলিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে কড়া বৈশাখের রোদে গাছের সব কাঁচা আম, শেষ মাঘের শীতে কোঁচড়  ভরে কুল পেড়ে নিয়ে যায়। পরীক্ষার আগের রাতে পড়া বই সে সহপাঠীর বাসায় দিয়ে আসে সহপাঠীর কান্নায় গলে। এই ছেলে দুনিয়াতে খাবে কেমনে—বাপ-মায়ের পুনপুন এই আক্ষেপ প্রোথিত হয়েছিল তার বিশ্বাসেও। দুনিয়াতে চলে-ফিরে খাবার যোগ্যতা তার নাই।

কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ্ সে ঠেকে নাই। টেনেটুনে মাধ্যমিক এবং বার কয়েকের মাথায় ভাগ্যক্রমে বাহাত্তার সনে সদ্য স্বাধীন দেশে বই খুলে পাশের হিড়িকের সুযোগে উচ্চমাধ্যমিকের ঘরও। আর দিব্যি একখানা চাকরি আর চাকরির খাতিরে জহুরার মতো বুদ্ধিমতী-কৌশলী স্ত্রীও জুটে গেছে। যার অপরিসীম বুদ্ধি আর সুনিপুণ দক্ষতায় চাকরির গোনা টাকায় দিব্যি সংসার চলে গেছে। তার গায়ে কোনো আঁচই লাগেনি কোনো সংকট-উত্তাপের। বাসা ভাড়া থেকে ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, ঈদে গরু কেনা থেকে শ্বশুরের চেহলামে চাঁদা দেওয়া কিছুই সংসারের প্রচলিত নিয়মানুসারে পুরুষ হয়েও ভাবতে হয়নি তার।

বড় নির্ভার-নিরিবিলি-নিশ্চিত দিনযাপন করেছে সে। বাপ-মায়ের আক্ষেপ-দুশ্চিন্তা মিথ্যে করে তার দুনিয়ায় চলে খাওয়া বরং ঈর্ষাই জাগাত আশে পাশের পুরুষদের। অন্য পুরুষরা যখন সংসারের দৈর্ঘ্য-প্রস্থে অপর্যাপ্ত কম্বলের মতো খরচ টানতে হিমসিম খেতো, পা ঢাকলে মাথা ঢাকতে পারত না, মাথা ঢাকলে পা উদোম হয়ে পড়ত, তখন আকবর আলীর নিশ্চিত দিনযাপনের অলক্ষ্যে স্ত্রী ভাগ্য আবিষ্কার করে তারাই আক্ষেপে ডুবে মরত।

প্রথমবার জহুরার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ দেখেছিল সে সেবারই। নইলে বাপ-মায়ের আক্ষেপ মিথ্যে করার স্বস্তিতেই দিন কাটছিল তার। বড় মেয়েটার বয়স আঠারোর ঘর পার হতে না হতেই আমেরিকা প্রবাসী পাত্রপক্ষ বাড়ি পর্যন্ত এলে জহুরার জহুরী বিবেচনা সুযোগটি হাতছাড়া করতে চায়নি। পাত্রের ফিরে যাবার তাড়া। সাতদিনের মধ্যে বিয়ে দেওয়ার তাগাদায় একবারই সে ভাঁজ দেখেছিল জহুরার কপালে—এই মূহুর্তে বিয়া ধরলে কম কইরা লাখখানেক টাকা লাগব, পাই কই!

সবসময় সংসারের সব আপদ-টানাপোড়েন থেকে তাঁকে আগলে রাখা জহুরার এই অস্থির ভাঁজ—তারে অসহ্য করে। কী করে সে! কেমনে মুক্তি দেয় সে জহুরাকে এই দুশ্চিন্তা থেকে। ভিতরে ভিতরে ভেবেছে সে, জহুরাকে বুঝতে দেয়নি। শেষ পর্যন্ত সামনে খোলা থাকা একমাত্র উপায়টিই কাজে লাগিয়েছে সে। পাপ জেনেই। অন্যায় জেনেই। ঘাম ধুয়ে ভিজে জবজবে শরীরে ওয়াশরুম থেকে ফিরে শরীরে খুলে রাখা কাপড়খানা জড়িয়ে জহুরা ফ্যানের স্পিড বাড়াতে বাড়াতে পাশে বসে কাঁধে হাত রেখে বলেছিল—শোনো, কতজন জীবনে উপ্রে উডার সিঁড়ি বানাইতে কত আকাম করে, মাইয়াডারে বিয়া দেওয়ার জইন্য সামান্য হাজার পঞ্চাশেক টাকা নিয়া মুখডা অমন পাতিলের তলার মতো কালো বানাইয়া রাখছো কেন? যা করছো, ঠিক করছো। এরকম একটু-আধটু সিঁড়ি আগে থেকে বানাইলে এতদিনে কই থাকতা একবার ভাবো!

জহুরার কথায় কী স্বর্গীয় সুধা ছিল কে জানে, সঙ্গমক্লান্ত শ্রান্ত শরীরে যেন শীতাতপযন্ত্রের হাওয়া লাগে। অপার শান্তি আর স্বস্তিতে জীবনের এক কঠিন সিঁড়ি পাড়ি দেওয়ার সুখে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসতে থাকে তার...।

ঘুম ঘুম চোখে জহুরার হাত বাড়িয়ে আকুল বসে থাকার দিকে দ্রুত আবার সিঁড়িতে পা রাখে আকবর আলী। এই শেষ সিঁড়ি, দীর্ঘ লড়াই শেষে প্রস্তুতি তার। দ্রুত পাড়ি দিতেই হবে। পৌঁছাতে হবেই শেষ মাথায়… মোমেনার ব্লাউজভেজা ঘামের মাতাল গন্ধ সিঁড়িতে রাখা পা টলিয়ে দেয়, ভরপেট মাতালের পায়ের মতো। আকবর আলী বিপর্যন্ত বোধ করে। বাইরে বিজলি ঝড়ের তুমুল দাপাদাপি, সুপারি গাছের পাতায় পাতায় বিপন্নতার শো শো...। বাইরের ঠাডার গর্জন যেন মোমেনার উষ্ণতার মতো ভীষণ। সংযমের সব দেয়াল ভেঙেচুরে ঢুকে পরতে চায় অন্দরে। এই ঠাডা ঝড় ঝঞ্ছা না থামলে মোমেনা তাকে একা ফেলে যাবে না। ভালোই জানে আকবর আলী। বাঁধভেঙে পানির তোড়ের মতো বাড়তে থাকে বৃষ্টির তোড়… কাছাকাছি থামার কোনোই লক্ষণ নেই আকাশে-বাতাসে। বৃষ্টির তোড় আর বিজলি চমকানোর প্রতিযোগিতা যতই বাড়তে থাকে, ততই বাড়তে থাকে আকবর আলীর বিপন্নতাও। কপালে রাখা মোমেনার উষ্ণ হাত চঞ্চল হয়। আঙুলগুলো সমদূরত্বে সুবিন্যস্ত ফাঁক হয়ে হাঁটতে থাকে চুলের গহীনে গহীনে। আকবর আলীর সংহত লক্ষ্য শিথিল হয়ে যেতে চায়। নিজের সাথে নিজের তীব্র লড়াই চলতে থাকে অবিরাম। এই উষ্ণতার লোভে পড়ার পাপে জড়িয়ে পড়লে চলবে না কোনোমতেই। ঐ তো সিঁড়ির শেষ ধাপে জহুরা খাতুন দাঁড়িয়ে আছে হাত বাড়িয়ে...। তাকে যেতে হবে।

এমনি দাঁড়িয়েছিল জহুরা খাতুন সেদিনও, যেদিন দ্বিতীয় পাপটি করে তার আশ্রয়েই ফিরেছিল সে। ঢাকা থেকে নতুন প্রজেক্টের পিডি ট্রেনিং প্রোগ্রাম উদ্বোধন করে কেন যেন আকবর আলীকেই সবচেয়ে বিশ্বস্ত ভেবে কানে কানে জানিয়েছিল, হোটেলে রাতটা একটু এনজয় করতে চায়। আকবর আলী একটু থতমত খেলেও, জ্বী স্যার জ্বী স্যার বলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থার যোগাড়ে নামে। সবার আগে ফোন করে জহুরাকে। জহুরা এক কথায় তাঁকে অধিক উৎসাহে প্ররোচিত করে। বস বইলা কথা, খুশি অইলে কপালে কী ঘটে আল্লায় জানে। খুশি করেন খুশি করেন...। এসব ব্যাপারে আকবর আলীর অভিজ্ঞতা একবারেই নাই, জীবনে জহুরা ছাড়া দ্বিতীয় নারী শরীর দেখে নাই সে। তবে এমএলএসএস তকদিরের অভ্যাসের কথা অফিসে খোলা গোপনীয়। তকদিরের দ্বারস্থ হলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ম্যানেজ করে ফেলে সে। সারাটা সময় বুক ধুকধুক করে... মেয়েটাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়েই জহুরার আশ্রয়ে ফিরে ঘামতে থাকে সে। ঠান্ডার ফ্রিজের পানিতে লেুবু-লবন-চিনির শরবত গুলে আকবর আলীর হাতে দিয়ে হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ে জহুরা—আহারে, দেখো কাণ্ড!  পাঁচ বাইচ্চার বাপ একটা মাইয়া মানুষ লইয়া এমুন কাঁইপা কুঁইপা শেষ। আর কেউ অইলে ঠিক… জহুরা শেষ করে না, নাউজুবিল্লাহ নাউজুবিল্লাহ পড়ে আকবর আলী, জীবনেও যেন এমন বিপথে চালিত না হয় সে। সে যাত্রা অবশ্য একটা বাজারী মেয়ের বিনিময়ে দারুণ নিশ্চিত নির্ভাবনার সিঁড়ি বানানো হয়ে গিয়েছিল তার। তিন ধাপ প্রমোশন পেয়েছিল আকবর আলী, বেতনের কাঠামোটা এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অফিসের সবাই ঘটনাটা জানলেও প্রকাশ্যে কারো কিছু বলার সাহস ছিল না, কারণ বলাটা যে বসের বিপক্ষেই যায়।  তবে অনেকেই ঠেস দিয়ে কথা বলতে ছাড়ত না, গায়ে মাখত না আকবর আলী। তবে কেউ কেউ এমন সন্দেহও করত যে এমন নারীসঙ্গ বোধ করি তারও অভ্যাস, নইলে বস আর কাউকে না বলে তাকেই কেন বলতে গেল! সবার ঠেস দেওয়া কথা যদিও বা সহ্য করা যেত নীরবে, সন্দেহটুকু সইত না। জহুরার কাছে এসে গুজগুজ করত রাগে। জহুরা মুখ টিপে হাসত—ভালাই তো! সবাই যদি জানে আমার জামাইর এমন মুরোদ তো মন্দ কী? আমি তো জানি আফনে খালি আমার কাছেই পুরুষ মানুষ!

জহুরার এই তীব্র বিশ্বাস কী না ভেঙে পড়তে চাইছে! মোমেনার স্পর্শ তাকে জড়িয়ে জড়িয়ে বাঁধছে! মোমেনা এবার তার ঠোঁট দুটি নামিয়ে আনে প্রায় নিঃসাড় আকবর আলীর কানের কাছে, নিঃশ্বাসের উষ্ণতা টের পায় আকবর আলী। মোমেনা জানতে চায়—ডরাইতাছেন? ডরাইয়েন না। আমি পাশে বসা আছি। বাইরে আরো তুমুল বেগে নামে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি। ইলেকট্রিসিটি আসার নামগন্ধ নাই। ঘরের ভিতর জ্বালানো মোমবাতির শিখাটা ফাঁক-ফোঁকড় গলে আসা বাতাসের সাথে লড়াই করেও জ্বলে যাচ্ছে অক্লান্ত। মোমেনার কণ্ঠ আর উদ্বিগ্নতা তাকে অস্থির করে। তাকে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিতে চায় সে। কিন্তু নির্দেশ দেওয়ার সে বাসনা কণ্ঠনালীতেই ফ্যাসফ্যাস করে ঘুরে মরে। কেমনে বলে সে মোমেনাকে, কেমনে বলে। বলা নেই কওয়া নেই  হঠাৎ করে হার্ট এটাকে জহুরার মৃত্যুর পর যে অথৈ সমুদ্রে পড়েছিল আকবর আলী সেখান থেকে তো তাকে টেনে তুলেছে এই মোমেনা। ঠিক জহুরার মতো ওষুধখানা হাতের কাছে এনে দিয়ে, পাশে বসে পান বানিয়ে দিয়ে, মোজা জোড়া খুঁজে দিয়ে দিনের পর দিন নিজেকে অনিবার্য করে তুলেছে আকবর আলীর কাছে।

নইলে  জহুরার মৃত্যুর পর সবাই যখন জহুরার বেহেশত নসিবের জন্য হাত তুলছিল তখন আকবার আলী হাবুডুবু খাচ্ছিল মধ্য সমুদ্রে। কেমনে পাড়ি দেবে সে বাকি জীবন। যদিও বড় আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর চিন্তা, তবুও সে অস্বীকার করতে পারে না জহুরার বেহেশত প্রাপ্তির চিন্তার চেয়ে নিজের বাকি জীবন কাটানোর চিন্তাই বেশি পীড়িত করেছিল তাকে সে মূহুর্তে। তৎক্ষণাৎ ছেলেমেয়েরা ‘আব্বা ভাইঙ্গা পইড়েন না, আমরা আছি তো’ ইত্যাদি সান্ত্বনা বাণী ক্রমাগত করে গেলেও দুই ছেলে আর তাদের বউরা ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা-প্রাইভেট-স্কুল ইত্যাদি বাহানায় কেটে পড়েছে মাস না ফুরাতেই। আর দেশে থাকা একমাত্র মেয়ের স্বামীরও হোটেল রেঁস্তোরায় খেয়ে পেটের পীড়ার বাড়াবাড়িও আটকে রাখা গেল না মাসাধিক কাল।

ভাগ্যিস মাসখানেকের মধ্যেই ঘরে এলো মোমেনা আর লাগাম টেনে ধরল আউলা-ঝাউলা হয়ে পড়া আকবর আলীর জীবন। সবই ঠিকঠাক ছিল। বাকি ছেলেমেয়েরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিল মোমেনার যত্নআত্তি দেখে। কিন্তু সমস্যাটা তৈরি হলো নিজের ভেতরেই। এমন সমস্যা!! এমন সমস্যা কাউকে বলা যায় না, সহ্যও করা যায় না। এক দুঃসহ পাপবোধের ক্ষরণ তাকে রক্তাক্ত করতে থাকে প্রতিদিন। মোমেনা পাশে বসলে তার গায়ে গা লাগলে টের পায় আকবর আলী সে এখনো পুরুষ রয়ে গেছে। মনে মনে বয়স হিসাব করে সাত দশকের ঘর পার হয়নি যদিও, তবু এটা তো সব প্রবৃত্তি থেকে অবসর নেয়ারই বয়স। সামাজিকভাবেও প্রাকৃতিকভাবেও। কিন্তু কী আশ্চর্য! রাতে মশারির চারমাথা লাগিয়ে তোষকের নিচে টানটান গুঁজে দেওয়ার সময় ব্লাউজের গলা ভেদ করে দেখা যায় যে মোমেনার সুডৌল যৌবন, তা কিনা তার সারারাতের ঘুম কেড়ে নেয়। নানাভাবে চেষ্টা করে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের। ধর্মে-কর্মে অধিক মনোযোগী হয়। কিন্তু দিনকয় পরেই টের পায় লাভ হচ্ছে না। বরং মোমেনার প্রতি আকর্ষণ দ্বিগুণ মাত্রায় বাড়তে থাকে তার।

তারপরই এই সিঁড়ি বানানোর সিদ্ধান্ত নেয় সে। ধীরে-ধীরে, দিনে-দিনে। তৃতীয় পাপের আগেই জীবনের শেষ সিঁড়িটি বানাতে থাকে নিজের সাথে লড়াই করে করে...। কাউকে জানতেও দেয়নি, বুঝতেও...। আজই সেই সিঁড়ি বানানো শেষ করেছে সে। আজই তার শেষ বোঝাপড়ার রাত। এর আগে দু’ দুটো পাপ তার জীবনের সিঁড়ি পাড়ি দেওয়ায় অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়েছে। আর এবারের সিঁড়িটা তাকে তৃতীয় পাপ থেকে মুক্তি দিয়ে পৌঁছে দেবে চূড়ান্ত গন্তব্যে।

ওষুধগুলো সে খেয়েছে মিনিট বিশেক আগেই। জমিয়ে রাখা ঘুমের ওষুধ। আকবর আলী ধীরে ধীরে তীব্র ঘুম টের পায়… টের পায় নিজ দেহের ক্রমশীতলতার দিকে যাত্রা।। কিছু কথা অস্পষ্ট কানে ঢোকে তার, কিছু ঢোকে না। মোমেনার উষ্ণ হাতও শীতল লাগে ততক্ষণে, শুনতে পায় মোমেনা উদ্বিগ্ন গলায় ডাকছে তার স্বামীকে, ডাকছে তার স্বামী আকবর আলীকে তৃতীয় ছেলে সোবহানকে—শুনছেন, তাড়াতাড়ি আইয়েন আব্বাজানের শরীলডা ক্যামন সাপের মতো ঠান্ডা লাগতাছে!! আকবর আলী শোনে কী শোনে না... অনেক দূর থেকে ছেলে সোবহানের কণ্ঠ—ও আব্বা! আব্বা!! চোখদুটো একবার খুলতে চায় সে.....পারে না। ততক্ষণে সে পৌঁছে গেছে সিঁড়ির শেষ ধাপে, জহুরার বাড়িয়ে থাকা হাত ছুঁয়ে।

   

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন: পূর্ণ স্বীকৃতি কতদূর?



প্রদীপ কুমার দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

আমরা বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন বলতেই বুঝি বৃটিশ শাসন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে ১৯৪৮-এ শুরু হওয়া এবং বায়ান্নর অমর ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের জন্য একটি দিক নির্দেশক দিন। সেই আন্দোলনের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে দানা বাঁধে স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের অবর্ণনীয় কষ্ট আর সমুদ্রসম আত্মত্যাগ এবং অসীম বীরত্বের ফলশ্রুতিতে আমরা পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

এর বহু পরে, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বাংলাদেশী কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর নেতৃত্বে পৃথবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিয়ে মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অফ দি ওয়ার্ল্ড গঠিত হয় কানাডার ভ্যাংকুভারে। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও নিরলস প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সহযোগিতায় দিনটি বিশ্বসভায় আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এই দিনের জাতিসংঘ ঘোষিত অঙ্গিকার বিশ্বের প্রতিটি ভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বিদ্যমান প্রায় ৭০০০ ভাষার একটিকে ও আর হারিয়ে যেতে না দেয়া। ইতিমধ্যে আধিপত্যবাদের কারণে ও সচেতন মহলের সচেতনতার অভাবে বহু ভাষা, সাথে সাথে তাদের সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব ও ইতিহাস পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।

কাজেই আমাদের বুঝতে হবে, ভাষা আন্দোলনের স্বর্ণখচিত ইতিহাস ও সাফল্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র বাংলাদেশের ((তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) বাঙ্গালীরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করা ও প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতিগোষ্ঠী নই। অর্ধ সহস্রাব্দের আগে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দক্ষিণ আমেরিকার মায়া,আজটেক,ইনকা নামের তৎকালীন উন্নত সভ্যতার জাতিসমূহকে জেনোসাইডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছে।প্রতি মায়া লোকালয়ে একটি করে পাঠাগার ছিল। এইরকম দশ হাজার লোকালয়ের পাঠাগারের সব বই তারা ধ্বংস করে দেয়। আজকের দিনে মাত্র আদি মায়া ভাষার তিনখানা বই (মেক্সিকো সিটি,মাদ্রিদ ও ড্রেসডেনে) সংরক্ষিত আছে। যুদ্ধ করেও মায়ানরা পাঠাগারগুলো বাঁচাতে পারেন নি। সাথ সাথে ক্রমে ধ্বংস হয়ে যায় তাঁদের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা।

বাংলাভাষী জনগণের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় উল্লেখ্যোগ্য অবদান রয়েছে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত মানভূমের বাঙ্গালীদের। বহু বছর সংগ্রাম,রক্ত ও জীবনের মূল্যে তাঁরা তাঁদের দাবি অনেকটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এরপর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনের সূচনা আসামের কাছাড়ে।বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ এগার তরুন প্রাণ ঝড়ে পড়েছে এই আন্দোলনে।

১৯৬১-তে আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে শামিল হয়। যদিও বরাকের সিংহভাগ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তবুও ১৯৬১-তে অহমিয়াকে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ফুসে ওঠেন বরাকের বাঙ্গালীরা।বাংলাভাষা বরাক উপত্যকার অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়।

মানভূম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। সাঁওতাল পরগণার মানভূম জেলা বাঙালি অধ্যুষিত হলেও তা দীর্ঘকাল বিহারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতের স্বাধীনতার পর সেখানে হিন্দি প্রচলনের কড়াকড়িতে বাংলা ভাষাভাষীরা চাপের মুখে পড়েন। মাতৃভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। ১৯৪৮ থেকে দীর্ঘ আট বছর চলা এই আন্দোলনের সাফল্যে ১৯৫৬ এর ১ নভেম্বর মানভূমের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পুরুলিয়া জেলা। বিহার থেকে নিয়ে পুরুলিয়াকে যুক্ত করা হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের দ্বার উন্মুক্ত হয় তাঁদের সামনে।

এবারে আবার ফিরি ১৯ মে'র ইতিহাসে। আসামের বরাক উপত্যকা আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। একসময় এই এলাকার অধিকাংশ ডিমাসা জনগোষ্ঠীর কাছাড় রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ডিমাসা রাজন্যবর্গ ও বাংলাভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কালক্রমে ব্রিটিশরা ভারত বিভাগ করে চলে গেলে আসাম প্রদেশের একাংশ সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। সিলেটের একাংশ ও ডিমাসা পার্বত্য ও সমতল অঞ্চল নিয়ে কাছাড় জেলা গঠিত হয়। এই জেলা বর্তমানে বিভক্ত হয়ে কাছাড়,হাইলাকান্দি,করিমগঞ্জ ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলা (ডিমা হাসাও)এই চার নতুন জেলায় রূপ নিয়েছে।

১৯৪৭ এ দেশবিভাগের পর থেকেই বরাক উপত্যকার কাছাড় জেলার অধিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। আসাম অহমিয়াদের জন্য এবং বাঙ্গালীরা সেখানে বহিরাগত এমন বক্তব্য ও ওঠে। এখনও সেই প্রবণতা বিদ্যমান। জাতীয়তাবাদের জোয়ারে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদরাও গা ভাসান। বঙ্গাল খেদা আন্দোলনও গড়ে ওঠে একসময়ে। সরকারিভাবে সেসব আন্দোলন ও সহিংসতা দমন হলেও পরবর্তী কালে সময়ে সময়ে এই জাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে।

আসাম রাজ্য বিধান সভায় ভারতের স্বাধীনতার পর পর সদস্যরা বাংলা, হিন্দি বা ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে পারতেন।প্রথম আঘাত এলো ভাষার উপর। অহমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা ঘোষণা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুর চেষ্টা এবং বিধানসভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে আইন চালুর বিরুদ্ধে আসামের বাঙ্গালী জনগণ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসাম রাজ্য সরকার কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে গেলেন না। তাঁরা অহমিয়া জাতীয়তাবাদ এর সংকীর্ণ মানসিকতার নেতাদের প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। বাঙ্গালীরাও সংগঠিত হতে থাকেন।

অনুমান করা যায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ বাহান্নর ঢাকার ভাষা আন্দোলন ও মানভূমের ভাষা আন্দোলনের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।১৯৬০ সালের শেষে আসাম বিধান সভায় ভাষা বিল পাশ হয়। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেলো। বাঙ্গালীরা ফুঁসে উঠলেন। লাগাতার আন্দোলন চলতে থাকলো।সত্যাগ্রহ,অসহযোগ, হরতাল, রেল রোখো,সংকল্প দিবস, ইত্যাকার অহিংস আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল বরাক উপত্যকা। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬১ সালের ১৯মে তারিখে বরাকের কেন্দ্রবিন্দু শিলচরের রেলস্টেশনে ভোর থেকে আন্দোলনকারী সত্যাগ্রহীরা জড়ো হয়। হাজার হাজার ছাত্র যুবা জনতা রেলস্টেশন প্রাঙ্গন ও রেললাইনের উপর অবস্থান নেয়। তাঁদের সরাতে না পেরে সরকার নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেয়। পুলিশ বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। নিহত হন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য সহ মোট ১১ জন ছাত্র যুবা। তাঁরাই একাদশ ভাষা শহীদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

তাঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা দ্বিতীয় রাজ্যভাষার মর্যাদা পায়। শিলচর রেলস্টেশনের সামনে স্থাপিত হয় শহীদদের প্রতিকৃতি সম্বলিত শহীদ মিনার। যার পথ ধরে পরবর্তী কালে ছড়িয়ে পড়ে একই আকৃতির শহীদ মিনার সমগ্র বরাক উপত্যকায়। শিলচর রেলস্টেশনের নাম পাল্টে জনতা ভাষা শহীদ রেল স্টশন নাম রেখেছেন। যদিও পূর্ণ সরকারি স্বীকৃতি এখনও তার মেলেনি।

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একাদশ শহীদ সহ আন্দোলনকারীদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু সব এলাকার বাঙ্গালিরা কি এই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন? উত্তরটি ‘না’ সূচক। আমাদের কর্তব্য তাঁদের আত্মত্যাগের কাহিনী সকলকে জানানোর উদ্যোগ নেয়া যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে শেখে। বরাক উপত্যকার একাদশ ভাষা শহীদ অমর রহে। বাংলা সহ সকল মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

এখনও সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এমন অনেকেই বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে অনেকে। সাথে সাথে প্রত্যক্ষদর্শীদের ও সন্ধান পাওয়া এখনও কষ্টকর নয়। তবে সামনের সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই তাঁরা আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। এখনই প্রকৃষ্ট সময় তাঁদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করে রাখার। পর্যাপ্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন সেই আন্দোলন,তার কুশীলব এবং শহীদ পরিবার সমূহের বিষয়ে। বীরের সন্মান উপযুক্ত ভাবে হওয়া প্রয়োজন। বাংলা ভাষার এবং বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মর্যাদা বিশ্বব্যাপী সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আরও অনেক বীরের আমাদের প্রয়োজন। যে মাটিতে বীরের যথাযোগ্য সন্মান নেই, সে মাটিতে বীর জন্মায় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;

রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার পাচ্ছেন ১৫ কবি-সাহিত্যিক



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

‘বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার’ ২০২২ ও ২০২৩ ঘোষণা করা হয়েছে। পাঁচ ক্যাটাগরিতে ১৫ জন কবি ও সাহিত্যিককে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এক অনুষ্ঠানে পুরস্কার মনোনীতদের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের জ্যৈষ্ঠ সদস্য কবি আসাদ মান্নান।

তিনি জানান, ২০২২ সালে কবিতায় পুরস্কার পেয়েছেন- শাহ মোহাম্মদ সানাউল হক ও রিশাদ হুদা। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে মালিক মো. রাজ্জাক। এছাড়া প্রবন্ধে বিলু কবীর, শিশুসাহিত্যে আনজীর লিটন, অনুবাদে ইউসুফ রেজা এবং কথাসাহিত্য জুলফিয়া ইসলাম।

আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, কবি খুরশীদ আনোয়ারকে।

কবি আসাদ মান্নান জানান, ২০২৩ সালে কবিতায় মিনার মনসুর ও মারুফুল ইসলাম পুরস্কার পাচ্ছেন। প্রবন্ধে আসাদুল্লাহ, কথাসাহিত্যে জয়শ্রী দাশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ে নাজমা বেগম নাজু, শিশুসাহিত্য আমীরুল ইসলাম এবং অনুবাদে মেক্সিকো প্রবাসী আনিসুজ্জামান।

আগামী ১৯ মে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। পুরস্কার ঘোষণা কমিটির প্রধান ছিলেন কবি শ্যামসুন্দর শিকদার। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা।

;

ঢাকার মিলনায়তনেই আটকে ফেলা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে! 



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে তাদের জন্মজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রথা কি তবে লুপ্ত হতে চলেছে? দীর্ঘসময় ধরে মহাসমারোহে কয়েকদিন ধরে এসব জন্মজয়ন্তী আয়োজনের রেওয়াজ থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণ দেখিয়ে সেই মাত্রায় আর হচ্ছে না রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর মহাআয়োজন। ঢাকার বাইরে উন্মূক্ত স্থানের বদলে রাজধানীতেই সীমিত পরিসরে মিলনায়তনে আটকে ফেলা হচ্ছে এসব আয়োজনের পরিধিকে। 

বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই দুই পুরোধা পুরুষের জন্ম ও মৃত্যুদিন ঘিরে বিশাল আয়োজনে তাদের পরিধিবহুল সৃষ্টিকর্ম ও যাপিত জীবনের আখ্যান তুলে ধরা হতো। রাজধানীর বাইরে জেলা পর্যায়ে কবিদের স্মৃতিধন্য স্থানসমূহে এই আয়োজনকে ঘিরে দীর্ঘসময় ধরে চলতো সাজ সাজ রব। যোগ দিতেন সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু নানা অজুহাতে পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকাতেই যেমন আটকে যাচ্ছে রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় আয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণও কমে এসেছে। 

জাতীয় কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এবারও কোন ভিন্নতা থাকছে না জানিয়ে কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীর জাতীয় পর্যায়ের আয়োজনগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক পালিত হয়। আর মৃত্যুবার্ষিকীগুলো নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। যেমন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট যেহেতু কবির নামে প্রতিষ্ঠিত, তাই নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি ইনস্টিটিউটই আয়োজন করে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর যেভাবে উদযাপিত হয় এবারও সেভাবেই আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ২৫ মে (২০২৪) বেলা ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে শুরু হবে। রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানগুলো কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে অনুষ্ঠিত হত। এই বারও হবে, তবে জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানগুলো ঢাকার বাইরে হবে না।’

‘ঢাকার বাইরে যেসব জেলাগুলো নজরুলের স্মৃতিসংশ্লিষ্ট; যেমন-ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা-এসব জেলাগুলোতে নজরুল গিয়েছেন, থেকেছেন আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের সূত্রে। এবার জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানও ঢাকায় হয়েছে, নজরুলের জন্মজয়ন্তীও ঢাকায় হবে। ঢাকার বাইরে এবার নজরুল জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠান না হওয়ার পেছনে সরকারের কাছে যে যুক্তি তা হচ্ছে-এই সময়ে দেশের উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে। বিশেষত জেলা প্রশাসন এইগুলো আয়োজনে মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করে থাকে। জেলা প্রশাসনগুলো নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকবে। নজরুল জয়ন্তী আয়োজনে মনযোগ হয়ত কম দেবে। যে উদ্দেশ্যে জনমানুষের কাছে পৌছানোর জন্য এই অনুষ্ঠান, তা পরিপূর্ণ সফল হবে না বিধায় এবার এই আয়োজনগুলো ঢাকায় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে’-বলেন সরকারের এই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র ও নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপনে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি আছে। এতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২ এপ্রিল (২০২৪) কমিটির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে শিল্পকলা একাডেমিতে এবং নজরুল জয়ন্তী হবে বাংলা একাডেমিতে।

জানা গেছে, বাংলা একাডেমিতে কিছু রেনুভশন ওয়ার্ক চলমান থাকায় বিদ্যুতের সমস্যা হতে পারে। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা থাকায় মুক্তমঞ্চেও এই আয়োজন না করে জাতীয় জাদুঘরে প্রধান মিলনায়তনে নজরুল জয়ন্তীর তিন দিনব্যাপী জাতীয় অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২৫ মে বেলা ৪টায় উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামীলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। স্মারক বক্তা থাকবেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খান, এমপি। আলোচনা অনুষ্ঠানের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে থাকবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।

২৬মে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের প্রধান অতিথি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাজ্জাদুল হাসান, এমপি। বিশেষ অতিথি থাকবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মোঃ কামরুজ্জামান। ২৭ মে তৃতীয় দিনের আয়োজনের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। বিশেষ অতিথি থাকবেন শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। শেষ দিনের স্মারক বক্তা কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় কমিটির একজন সদস্যের কাছে জয়ন্তী আয়োজনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঐতিহ্যিক ধারা বজায় না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্র ও নজরুল অনুরাগীরা বলেছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সাহিত্য-জীবনদর্শন আমাদের পাথেয়। তাদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে মহাসমারোহে ঢাকার বাইরে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহে আয়োজনের যে ধারাবাহিকতা ছিল তা দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক চর্চাকে বেগবান করতো। কিন্তু এই আয়োজনকে সীমিত করে রাজধানীর মিলনায়তনে আটকে ফেলা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির বিকাশকে রূদ্ধ করারই অংশ। এর পেছনে সুক্ষ্ণভাবে কারা কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করা জরুরি বলেও মনে করেন তারা।

;

হাসান হাফিজের একগুচ্ছ কবিতা



অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পিপাসার্ত ঘোরে

প্রান্তরের মাঝে আছে নিঃস্বতার ডাক
আত্ম অনুসন্ধানের
ফিরতি ঢেউ
আছড়ে পড়ে
আশ্লেষের বালুকাবেলায়
মুমূর্ষু যেমন তীব্র পিপাসায়
জীবনের আলিঙ্গন চায়-
আর্ত রাত্রি হিমেল কামের ঘোর
নীরবে দংশায়
ঘর পোড়ে, আকাক্ষার
বাতি নিভে যায়
কোথায় প্রান্তর, শূন্যতা কোথায়
আছে সে নিকটে জানি
সুদূরের এলানো চিন্তায়
যেখানে গোধূলিদগ্ধ
সন্ধ্যা কী মায়ায়
গুটায় স্বপ্নের ডানা
দেবদারু বনে বীথিকায়
তার দিকে সতৃষ্ণ সমুদ্রঘোর
ছটফট করছি পিপাসায়।

না, পারে না

লখিন্দর জেগে উঠবে একদিন
বেহুলার স্বপ্ন ও সাধনা
বৃথা যেতে পারে না, পারে না।

কলার মান্দাস, নদীস্রোত
সূর্যকিরণের মতো সত্য ও উত্থিত
সুপ্ত লখিন্দর শুয়ে, রোমকূপে তার
জাগৃতির বাসনা অপার
এই প্রেম ব্যর্থ হতে পারে না পারে না

মনসার হিংসা একদিন
পুড়ে টুড়ে ছাই হবে
এমন প্রতীতি নিয়ে স্বপ্নকুঁড়ি নিয়ে
প্রতীক্ষা-পিদিম জ্বেলে টিকে থাকা
এমন গভীর সৌম্য অপেক্ষা কখনো
ম্লান হয়ে নিভে যেতে পারে না পারে না

রেণু রেণু সংবেদবর্ণালি-৮

ক.
আমার না পাওয়াগুলি অবরুদ্ধ দীর্ঘশ্বাসগুলি
মুক্তি চায়, বেরোতে পারে না
কার্বনের নিঃসরণ
নতুন মাত্রিক আর বিপজ্জনক
সেও তো দূষণ বটে
বলতে পারো প্রণয়দূষণ!

খ.
আদিপ্রাণ বৃক্ষতলে
ছায়াশান্তি মাঙনের সুপ্তি বর্তমান
এসো লই বৃক্ষের শরণ
পরিবেশ প্রশান্তির সেও এক
স্বস্তিমন্ত্র, অনিন্দ্য ধরন।

গ.
নদীকে বইতে দাও নিজস্ব নিয়মে
গলা টিপে ধোরো না ধোরো না,
নদী হচ্ছে মাতৃরূপ বাৎসল্যদায়িনী
দখলে দূষণে তাকে লাঞ্ছিত পীড়িত
হে মানুষ এই ভুল কোরো না কোরো না

ঘ.
উচ্চকিত শব্দ নয় বধিরতা নয়
মৃদু শব্দ প্রকৃতির সঙ্গে কথা কও
শব্দ যদি কুঠারের ঘাতকপ্রতিম
তবে হে মানুষ তোমরা অমৃতের পুত্রকন্যা নও

ঙ.
মৃত্তিকার কাছ থেকে সহনশীলতা শিখি
মৃত্তিকাই আদি অন্ত
জীবনের অন্তিম ঠিকানা
মৃত্তিকাই দেয় শান্তি সুনিবিড়
ক্ষমা সে পরমা
শরীর মূলত মাটি
গন্তব্য যে সরল বিছানা।

ছিন্ন কথন

আমি ভুখা পিপীলিকা
চেয়েছি আলোর দেখা।
পুড়ে যদি মরি তাও
ওগো অগ্নি শান্তি দাও।
অঙ্গার হওয়ার সাধ
এসো মৃত্যু পরমাদ।
চলো ডুবি মনোযমুনায়
এসো এসো বেলা নিভে যায়!

ধ্রুব সত্য

না-পাওয়াই সত্য হয়ে ফুটে থাকে।
পুষ্পিত সে প্রতারণা, চেনা মুশকিল।
বৃতি কুঁড়ি পাপড়িতে মায়াভ্রম লেপটানো
দেখলেই ছুঁতে ইচ্ছা হয়। ছুঁলেই বিপদ।
সেই ফুলে সম্মোহন জড়িয়েমড়িয়ে আছে
কোমলতা লাবণ্যও পুঁজি তার, এমত বিভ্রমে
লোভী ভ্রমরের মতো প্রেমিকারা ছোটে তার কাছে
গিয়ে মোক্ষ পাওয়া দূর, অনুতাপে আহত পাথর
মাথা কুটে মরলেও স্রোতধারা জন্ম নেয় না
যা কিছু হয়েছে পাওয়া, তাও এক দম্ভ সবিশেষ
মর্মে অভ্যন্তরে পশে গতস্য শোচনা নাস্তি
এই বিষ গলাধঃকরণ করে কী যে পাওয়া হলো
হিসাবে নিকাশে মন থিতু নয় সম্মতও নয়
না-পাওয়াই ধ্রুব সত্য চিরন্তন মানুষ-জীবনে!

;