বুকের পাঁজরে কাশফুল



হাসান অরিন্দম
অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

শনিবার সকাল পৌনে দশটার দিকে নাস্তা সেরে টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে বারন্দায় বসে খবরের কাগজ উল্টাচ্ছিলাম, কার কাছ থেকে যেন কানে খবর উড়ে এলো টিপু সুলতানকে কাল সন্ধ্যা থেকে কোত্থাও পাওয়া যাচ্ছে না। হতে পারে রাস্তার পথচারীরাই বলা-কওয়া করছিল। ১১ বছরের টিপু সুলতান আমার আপন কেউ নয়, কাজেই উদ্বেগ যতোটা না, কৌতূহল ও অনুসন্ধিৎসা বরং তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। আমি ওকে বোধ হয় প্রায় আট বছর ধরে দেখে আসছি। ওর মায়ের ভাষ্যমতে জন্মের বছর-দুই পরে পায়ে কাঁটা ফুটে গ্যাংগ্রিনের লক্ষণ দেখা দেয়। তখন থেকেই কবিরাজ, ওঝা, হোমিওপ্যাথের পিছনে ছুটে কোনো ফল এলো না। আজকাল গায়ে সারা দিনরাত জ্বর থাকে, খেতে গেলে বমি পায়, প্রায়ই যন্ত্রণায় কাতরায়; তবে কারো প্রতি কোনো অভিযোগ তার নেই। পাড়ার লোকেদের কেউ কেউ বলল ও ছেলের ক্যান্সার, বাঁচবে না বেশি দিন। পরে টিপু সুলতানের যখন সাড়ে দশ বছর বয়সে সার্জারির ডাক্তারের কাছে গেল জবা আর ওর স্বামী, তখন ডাক্তার বলল ছেলেকে বাঁচাতে গেলে পুরো পায়ের পাতাটা কেটে ফেলতে হবে, সেটার আবার বায়োপসি না কি, তাও করা লাগবে। আরো আশঙ্কার কথা এতোদিন কেবল বাম পায়ে ক্ষত রক্ত আর লালচে কষানি ছিল, এখন ডান পায়ের তলায়ও লক্ষণটা দেখা দিয়েছে। যদিওবা এক পায়ে ভর দিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে বেশ হাঁটতো এখন লাঠি ছাড়া এক পা-ও এগোতে পারে না। জবা চার-চারটে সন্তানের মা, কাজেই একটাকে নিয়ে তার সারাদিন হা-হুতাশ করে বসে থাকবার ফুরসত নেই। ওদের অকালবৃদ্ধ হাড্ডিসার বাপও বছর দশেক হলো শ্বাসকষ্টের রোগী। দুদিন ভ্যানটা নিয়ে বেরোয় তো তিনদিন ভাঙা চালের দিকে তাকিয়ে ঘরে শুয়ে ‘ও আল্লাহ ও আল্লাহ’ বলে ছালওঠা বুড়ো কুকুরের মতো কাতরায়। কাজেই জবাকে কখনো কখানো জুটমিলে কখনো তামাকের ফ্যাক্টরিতে গতর খাটিয়ে ছেলেমেয়েগুলোর মুখে ভাত জুটাবার ব্যবস্থা করতে হয়। গা-গতর এখনো বেশ আঁটোসাঁটো বলে চকচকে নোট দেখিয়ে অনেক পুরুষই নিভৃতে পাওয়ার ইশারা করলেও জবা আজ অবধি সে-সব ইঙ্গিত পদদলিত করে চলতে পেরেছে। তার নিজেরও আশঙ্কা হয় কবে না আবার সংযমের মিহি সুতোখানা ছিঁড়ে যায়। দুএকবার যে মনে হয়নি গায়ে সুগন্ধীমাখা কোনো পুরুষের ডাকে সাড়া দিয়ে কুড়ি মিনিট জাপ্টাজাপ্টি করে দুতিন শ টাকা আয় করে আনবে—এমনও নয়। ঘরের মিনশের তো শরীরে কিছু নেই আবার তেজের বেলায় ষোলো আনার জায়গায় আঠারো আনা। একদিক দিয়ে ভাগ্যটা খানিক ভালো জবার, বড় মেয়ে জুলেখাকে বছর তিনেক আগে এক হোটেল কর্মচারীর সাথে বিয়ে দিয়েছে, সেখানে মেয়েটা দুবেলা খেয়ে মোটা কাপড় পরে দিব্যি দিন পার করে দিচ্ছে, সপ্তাহে কি মাসে জামাই একবার বৌকে পিটালেও সেটা আমলে নেয়ার প্রয়োজন বোধ করে না জবা। টিপু সুলতানের মায়ের যখন কোথাও কাজ থাকতো না প্রায়ই আমাদের বাড়িতে এসে ছেলেটাকে বাইরের বারান্দার মেঝেতে শুইয়ে রেখে নিজে যেচে আমার স্ত্রীর কাপড় কাঁচা, ফার্নিচার, গ্রিল, জানালার গ্লাস মোছা—এসব কাজ করে দিতো। তিন বছরের টিপু সুলতান বড় বড় দুটি চোখ নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে দেয়ালে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে থাকতো। খানিক বাদে ওর মা একটা শুকনো রুটি হাতে দিয়ে গেলে সেটা প্রসন্ন চিত্তে চিবোতে থাকতো। ওর পায়ের রক্ত-কষানি দুএক ফোঁটা মেঝেতে পড়লে যাওয়ার সময় জবা স্যাভলন দিয়ে যত্ন করে পরিষ্কার করে রেখে যেতো।

চারটে সন্তানের মধ্যে ও-ই সবচেয়ে ফরসা গয়ের রঙ আর প্রায় নিখুঁত চেহারা নিয়ে জন্মেছিল। টানা টানা চোখ টিকল নাক দেখলে মনে হতো কোনো অভিজাত ঘরের শিশু, নিশ্চয়ই বড় হয়ে নামকরা কেউ হবে। তাই জবার স্বামী ছেলের রাজপুত্তুরের মতো চেহারা দেখে আকাশ সমান স্বপ্ন নিয়ে নাম রেখেছিল রাজা-বাদশার নামের সাথে মিলিয়ে। কিন্তু তিন বছর না-হতেই পায়ের তলায় পচনের আভাস তাদের হৃৎপিণ্ডকে ক্রমে চুরমার করে দিতে থাকে। ওর পা দেখে বিভিন্ন জন নানান কথা বলতো। জবা লোকের পরামর্শে তার সাধ্যের মধ্যে সবকিছুই করবার চেষ্টা করেছে। কখনো ফকির-কবিরাজ, কখনোবা সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার। মাঝে মাঝে কিছু উন্নতির লক্ষণ—পায়ের কষানি বন্ধ হওয়া, ঘায়ে টান ধরা দেখে জবার মনে আশার আলো জ্বলতো। কিন্তু আবার হয়তো দুতিন মাস না-যেতেই আগের অবস্থা কিংবা আরো অবনতি।

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জন যেদিন দেখলেন ততদিনে টিপু সুলতানের বয়স সাড়ে দশ পেরিয়েছে। ডাক্তার রেগেমেগে বললেন, ‘তোমাদের নিয়ে বড় যন্ত্রণা, এই সাত-আট বছর কী করেছো? এখন ছেলেকে বাঁচাতে হলে দুটো পায়ের পাতাই কেটে ফেলতে হবে। এর মধ্যে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে কিনা সেটাও বায়োপসি করে যাচাই করতে হবে।’

ফিরবার সময় কলা-পাউরুটি কিনে ছেলেকে নিয়ে ঘামের গন্ধঅলা মানুষের ভিড় ঠেলে বাসে উঠে জবা আর ওর স্বামী। টিপু সুলতান সকাল থেকে কিছুই মুখে নেয়নি। বেলা প্রায় দুটো বাজে, কলা-পাউরুটির কিছুই সে স্পর্শ করে না। ছেলের শুষ্ক বিরস মুখের দিকে তাকিয়ে জবা বলে, ‘খা বাবা খা।’

কিছুক্ষণ বাইরে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে, তারপর হঠাৎ টিপু সুলতান হাউমাউ করে কেঁদে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘মা, পা ক্যাটে ফেললি আমি হাঁটপো কিরাম করে? আমি আরো ভাবছিলাম পা ভালো হলি আমি ফুটবল খেলতি পারব।’ ছেলের কথা শুনে জবাও চোখের জল আটকাতে পারে না। জবার স্বামী তখন একটা বিড়ি ধরানোর খুব তাগিদ বোধ করলেও ভিড়ের মধ্যে লোকের ধমকের ভয়ে বিড়িতে আগুন জ্বালাতে সাহস হয় না তার।

রাতে বড়বোনের পাশে নড়বড়ে চৌকিতে শুয়ে টিপু সুলতানের ঘুম আসে না। মনে হয় বুকের ভেতর শ্বাসটা কোথায় যেন কুণ্ডলি পাকিয়ে যাচ্ছে। বার বার এপাশ-ওপাশ করতে করতে শুনতে পায়, মেঝেতে শোয়া বাবা-মা তাকে নিয়েই শলাপরামর্শ করছে। এই ছেলে কি তবে ভিক্ষে করে খাবে? অপারেশন করার টাকা কীভাবে জোগাড় করা যায়—এইসব। টিপু সুলতানের কিছুতেই ঘুম আসছিল না। তার কেবলই মনে হচ্ছিল আচ্ছা আজ রাতে সে যদি মরে যেত তো কেমন হতো? বাবামা আর ভাইবোনেরা খুব কাঁদবে তাহলে সকালে? কাল সারাদিন? তারপর আরো কিছুদিন থেকে থেকে—তারপর একদিন কেউ আর কাঁদবে না। কেবল গোরস্থানের পথ ধরে যাওয়ার সময় শিরিষ গাছে নিচে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে মায়ের চোখজোড়া ভিজতে থাকবে বহুকাল। টিপু সুলতান কিছুদিন মক্তবে পড়তে গিয়ে লম্বাটে হুজুরের কাছে শুনেছিল মৃত্যুর পর পাপীদের কী ভয়ঙ্কর শাস্তি ভোগ করতে হয়। দোজখে কেবল সাপবিচ্ছুর দংশন, পায়ে পরানো হবে আগুনের বেড়ি, খেতে হবে কাঁটাগাছ আর রক্ত-পুঁজ। সে হিসেব করে দেখে এই জীবনে তার কিছু পাপ আছে। আব্বার পকেট কিংবা মায়ের কৌটা থেকে না-বলে পয়সা সরিয়ে রেখে সে চকোলেট, আইসক্রিম, চিপস কিনে খেয়েছে। এর-ওর গাছ থেকে কিছু ফল পেড়েছে, চুরি করেছে। ভাইবোনদের সাথে ঝগড়া-মারামারি করেছে। মায়ের কথা শোনেনি ঠিকমতো। এসব পাপের জন্য আল্লাহ কি তাকে দোজখে রাখবেন? তা হোক, পুড়বে না হয় দোজখে কিছুকাল। কিছুদিন পর পাপমুক্ত হতে পারলে তো অনন্ত শান্তির দেখা মিলবে। সেখানে মানুষের খিদে আছে, খাদ্য আছে; কিন্তু মলমুত্রের মতো বিরক্তিকর ব্যাপার নেই। মানুষের রোগ নেই, নেই ডাক্তার। পচা পায়ে যন্ত্রণা নিয়ে আর বাঁচতে ভালো লাগে না। মানুষের দুটো পা-ই যদি না থাকল, ইচ্ছেমতো ছুটতে না পারল, দেখতে না পারল চারপাশ—তার জীবনের কী দাম আছে?

আমি যখন জানলাম টিপু সুলতানকে পাওয়া যাচ্ছে না তখন মনে মনে অনুসন্ধান করতে থাকি ও কীভাবে হারাতে পারে। প্রথমেই আমার মনে হয় নদীর কথা। ওরা যেখানে থাকে তার ষাট-সত্তর গজ দূরেই তো নদী। নদীটা মরা অথচ ওতেই প্রতি বছর দুএকজন লোক ডুবে মরে। ছমাস আগে জুলেখা নামের গর্ভবতী এক যুবতী নির্জন দুপুরে গোসল করতে গিয়ে তলিয়ে যায়। অথচ জুলেখা দিব্যি সাঁতার জানতো—বালিকা বয়স থেকেই এই নদীতেই চিৎসাঁতার ডুবসাঁতার দিয়ে বড় হয়েছে সে। তাই লোকে বলছিল ওসব ভূতের কাণ্ড, গেছো ভূত কিংবা মেছো ভূত ওকে নির্জনে পেয়ে পানিতে চুবিয়ে মেরেছে। একবার মনে হয় ছেলেধরার হাতে পড়লো নাকি টিপু সুলতান? নাকি রাগ করে বাড়ি ছেড়েছে? তখন মনস্থির করি, বাড়িতে বসে সাত-পাঁচ না ভেবে বরং একবার সরজমিনে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসা যায়, আমার আর বিশেষ কাজ কী। তাছাড়া জবা আমাদের আপনজন বলেই জানে। শহরের শেষ প্রান্তে যেখানে গ্রাম এলাকা শুরু নদীর কাছে টিপু সুলতানদের বাড়িতে পৌঁছে যাই আধ ঘণ্টার মধ্যে। জবা উঠোনে বসে নানান কথা বলতে বলতে কাঁদছে, ওর চোখে জল শুকনোর দাগ। ওর স্বামী লোকজন নিয়ে হন্যে হয়ে রাস্তাঘাটে খোঁড়া ছেলে খুঁজে বেড়াচ্ছে। প্রতিবেশিরা আমাকে জানায় ওরা রাতে ঘুমিয়ে ছিল, ভোর বেলা ঘরের দরজা খোলা দেখে জবার সন্দেহ হয়, এবাড়িতে তার আগে তো কেউ জাগে না। সে তখনই খেয়াল করে টিপু সুলতান বিছানায় নেই। ঘরে নেই, উঠোনে নেই। আম বাগান, নদীর ধার, প্রাইমারি ইস্কুলের মাঠ, বটতলা বাজার কোত্থাও না।

জবা আমাকে দেখেও খানিক নির্বাক ছিল। হঠাৎ সে ফ্যাঁসফেঁসে কণ্ঠে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। ‘মামা, আমার টিপুর কাইল অপারেশন হওয়ার কথা ছিল, আইজ ভোরেরতে সে ছেলে উধাও। আমি এখন কী করব কতি পারেন?’ কোন সুবাদে যেন জবা আমাকে ‘মামা’ বলে ডাকে আর ওর ছেলেমেয়েরা ‘ভাইয়া’।

‘তুমি অতো ভেঙে পড়ো না। পা কাটার কথা শুনে মনে হয় ভয় পেয়েছে। কোথাও লুকিয়ে আছে দেখো ঠিকই চলে আসবে। দুটো দিন ধৈর্য্য ধরো।’

আমি নিশ্চিত নই টিপু সুলতান আদৌ ফিরে আসবে কিনা। ও বেঁচে আছে না মরে গিয়েছে, তবু মনগড়া সান্ত্বনা দিই জবাকে।

ও আমার পা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আপনি চিষ্টা করলি পারবেন। আপনি এ এলাকার নামকরা সাংবাদিক—ডিসি এসপি সবার সাথে জানাশুনা। আমার টিপু সুলতান ছাড়া আমি বাঁচপ কীরাম করে মামা?’

২.
আমি অভিজাত হাসপাতালটির ফটক থেকে দ্রুত পদক্ষেপে বেরিয়ে একটা চকচকে ট্যাক্সি ডাক দিই। যুবক ড্রাইভার বাম দিকের গ্লাস নামিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘স্যার কোথায় যাবেন?’
‘দূরে, শহরের বাইরে কোথাও। যাবেন?’
‘যাব, কিন্তু সিটি করপোরেশনের বাইরে গেলে যে ডাবল ভাড়া লাগবে স্যার।’
আমি ‘দেব’ বললে ড্রাইভার দরজা মেলে ধরে, আমি গা এলিয়ে সিটে বসে পড়ি।
গাড়ি বিশ্বরোডের কাছে এলে যুবক বলে, ‘স্যার, টঙ্গির দিকে যাব?’
‘যান। আমরা টঙ্গি, চৌরাস্তা পেরিয়ে ময়মনসিংহ রোড ধরব।’

আজ শুক্রবার আর ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে বলে রাস্তায় জ্যাম বেশ কম। বসুন্ধরার নিউলাইফ হসপিটাল থেকে পঁচিশ মিনিটেই গাড়ি টঙ্গি পেরিয়ে যায়। চৌরাস্তা অতিক্রম করে আরো খানিক বাদে শহরের কোলাহল পেছনে ফেলে এলে গভীর বিষণ্নতার মধ্যেও মনের উপরিতল খানিকটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে। ড্রাইভারকে বলি, ‘আপনার গাড়িতে গান নেই?’
যুবক সসংকোচে বলে, ‘আপনাদের শোনার মতো গান নেই স্যার।’
‘কী বলেন? শুধু নিজের দিকে খেয়াল দিলে হবে—যাত্রীদেরও তো একটা দাবি থাকতে পারে, না?’
‘স্যার, লালনের গান শুনবেন?’
‘শুনব তো, ছাড়েন। তবে যে বললেন সে-রকম গান নেই!’
যুবক ড্রাইভার রিমোট চাপ দিলে কয়েক সেকেন্ড পরে বেজে ওঠে—
বেদ বিধির পর শাস্ত্র কানা/ আর এক কানা মন আমার/ এসব দেখি কানার হাটবাজার।। এক কানা কয় আর এক কানারে/ চল এবার ভব পারে।/ নিজে কানা পথ চেনে না/ পরকে ডাকে বারংবার।। পণ্ডিত কানা অহংকারে/ সাধু কানা অনবিচারে/ মোড়ল কানা চোগলখোরে/ আন্দাজে এক খুঁটি গেড়ে/ জানে না সীমানা কার।

গানটা শুনতে শুনতে আমার মনের উপরিতল আবার বিষণ্ন হয়ে ওঠে। সে-বিষণ্নতা চেতনার গভীরতল, মগজ ও রক্তকণিকায় ছড়িয়ে পড়ে। তখন আমার মনে হয়—সত্যিই কি পৃথিবী কানার হাটবাজার, আসলে কেউ কিছু জানে না? বস্তুত ওয়েটিং ফর গডো? তাহলে এখন এই ঘূর্ণিঝড়ের পরিস্থিতিতে অগ্রপশ্চাৎ না-ভেবে আমার কী করা উচিৎ? আমি এই গাড়িটাকে আরও ত্রিশ-চল্লিশ কিলোমিটার বা তার চেয়ে বেশি পথ উত্তর বরাবর নিয়ে যাব। তারপর ড্রাইভারকে পাওনা বুঝে দিয়ে নাম না জানা গ্রামের নির্জনতায় নদীর তীরে নেমে পড়ব। নদীর তীরে কার যেন একটা ডিঙি নৌকা বাঁধা। নৌকার পানি সেচে আমি তাতে উঠে বৈঠা দিয়ে কূলে ধাক্কা দিয়ে ঘোলা জল কেটে নৌকা ছাড়ব। আমি যদিও বলেছি অগ্রপশ্চাৎ ভাবনা বাদ দিয়ে—বস্তুত আমি চেতনে-অবচেতনে দ্রুত অনেককিছু ভেবে তবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি।

কদিন পরপর সামান্য জ্বর আসছিল। প্যারাসিটামল খাই, কিছু দিন ভালো থাকি, আবার জ্বর। পরে আমার ডাক্তার একটি বড় প্রাইভেট হাসপাতালে প্রফেসরের কাছে রেফার করেন। ঢাকাতে অনেক আত্মীয়-স্বজন থাকলেও এই বয়সে কারো বাড়িতে গিয়ে উঠতে মন চায় না। আমি এয়ারপোর্টের কাছে একটা হোটেলে গিয়ে উঠি। দুটো দিন রক্ত, এক্স রে, বোন ম্যারো ইত্যাদি নানার রকম টেস্টের জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে হলো। ডাক্তার আমাকে স্পষ্ট করে না বললেও আমি বুঝতে পারি তিনি আমাকে যে ধরনের ইনভেস্টিগেশন দিচ্ছেন তাতে তার ধারণা আমি লিম্ফোমার প্যাশেন্ট। আজকে দুপুর আড়াইটাই ব্লাড টেস্ট হাতে পেয়ে আমি নিশ্চিত হই ডাক্তারের আশঙ্কাই সত্যি। ইন্টারনেট ঘেটে বুঝে নিই এটা তৃতীয় স্টেজ। এই পর্যায়ের রোগীর ভালো চিকিৎসা এদেশে নেই। দেশের বাইরে মানে সিঙ্গাপুর বা ব্যাংকক গেলে আমার জমানো টাকা মাসখানেকও টিকবে না। এবছর একমাত্র ছেলেটা আইএসসি পাশ করল। ওর যা রেজাল্ট, আমরা জানি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের যোগ্যতায় চান্স পাবে না। ওর মা তিল তিল করে এতো বছর ধরে ছেলেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবে বলে কুড়ি লাখের মতো টাকা জমিয়েছে। আমার এই অসুখের কথা শুনলে সুহিতা উদ্বিগ্ন হয়ে সব টাকা আমার হাতে তুলে দেবে। প্রেসের ব্যবসায় দীর্ঘদিন লস খেয়ে জেলা শহরে চার কাঠার ওপর পৈতৃক বাড়িটা ছাড়া আর কোনো সম্পত্তি আপাতত আমার নেই। আমার নিজের সম্পাদিত একটি সুপরিচিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল সেটা বন্ধ হয়েছে বছরখানেক। এই বয়সে বাড়িটা বিক্রি করার মতো অবিমৃশ্যকারিতা আমি দেখাতে চাই না। তাছাড়া বাড়ি বেচলেও আমার সুস্থ হবার সম্ভাবনা তেমন নেই, মিথ্যে আশা বুকে নিয়ে অচল গাড়ির পেছনে পয়সা ঢালার মতো স্বার্থপর আমি নই। জ্বর, ওজন কমা, অরুচি, বমিভাব, মাথার ভেতরে চক্কর, বিমর্ষতা—সব লক্ষণই আমি বহন করছি বেশ আগে থেকেই। ফলে রিপোর্ট হাতে পেয়ে আমি অটল সিদ্ধান্ত নিই আমার হেমাটোলোজিস্ট সুরিয়া কান্তি সিনহার সঙ্গে আর সাক্ষাৎ নয়, এবার বরং নিরুদ্দেশ হই। আজ হোক কাল হোক, সবাইকে তো ত্যাগ করতেই হবে। তখন কেন যেন মাসখানেক আগে হারিয়ে যাওয়া টিপু সুলতানের কোমল মুখটি আমার মনে ভেসে ওঠে।

দুপাশে শাল আর গজারি গাছের সারির ভেতর দিয়ে কালো রঙের এলিয়ন গাড়িটি আশি কিলোমিটার বেগে ছুটে চলেছে। আরো মিনিট চল্লিশেক পরে গাড়িটাকে রাস্তার ডান দিকে কোথাও রাখতে বলব। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বড় রাস্তা থেকে নেমে খানিক মেঠো পথ ধরে সন্তর্পণে হেঁটে একটা ছোট নদীর দেখা পাব। নদীর দুপাশে সবুজ ধানক্ষেত। আমি কিছুক্ষণ আনমনে দাঁড়িয়ে থাকব, দেখব শরতের বাতাসে কীভাবে তীক্ষ্ণ সবুজ পাতারা দোল খায়। সেখানে কীভাবে চলে আলোছায়ার খেলা। আশ্চর্য, এই বিকেল বেলা নদীর তীর ও বিস্তৃীর্ণ মাঠ জুড়ে কোনো জনমানুষের টিকি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তবে দৃষ্টিসীমার ভেতর অজস্র পাখি কলকাকলি করে বেড়াচ্ছে। নদীর জলে দেখছি কতক মাছ—চাঁদা, ডানকিনা, তিতপুঁটির ঝাঁক। এমন সময় আমার চোখে পড়বে নদীর কূলে একটা নৌকা বাঁধা। আনাড়ী হাতেও নৌকা বেয়ে ছোট নদীটি পেরুতে দশ মিনিটের বেশি লাগবে না। নদী পেরুতে বৈঠা মেরে আমি ঘেমে উঠব। শার্টের দুটো বোতাম খুলে দিয়ে বাবলা গাছটার তলায় বসে খানিক বাতাস গায়ে মাখব। সে-সময় হঠাৎ ধানখেতের পাশে একটা ঘাসের জমিনে প্রথম একজন মানুষের দেখা পাব। উচ্ছল ছেলেটা আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে বলবে, ‘ভাইয়া, আপনি এখানে?’
আমি অবাক হয়ে বলব, ‘আরে টিপু সুলতান তুই। ওদিকে তোর জন্য কেঁদে কেঁদে তোর মার তো চোখ অন্ধ হতে চলেছে।’ কথা বলতে বলতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে যাব। চেহারার সেই একই আদল। অথচ মুখ জুড়ে কী এক আশ্চর্য আলো ঠিকরে পড়ছে, আলোটা প্রগাঢ় জ্যোৎস্নার মতো।

‘আমি জানি, কিন্তু আমার যে ফেরার উপায় নেই।’ ওর চেহারায় বিষণ্নতা ছায়াপাত করে।

আমি পকেট থেকে চিনে বাদাম আর চিপস বের করব। দুজন মুখোমুখি বসে খুব ধীরে ধীরে খাবো। এক সময় সব অতীত ভুলে ঘাসে মাথা রেখে নীল আলোর আকাশ দেখতে দেখতে, পাখির কিচিরমিচির শুনতে শুনতে আমি আর টিপু সুলতান ঘুমিয়ে পড়ব। টিপু সুলতান এক সময় ঘুম থেকে জেগে উঠবে। জেগে মলিন আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখবে একটা কমলা রঙের কাটা ঘুড়ি উঁচু আকাশ থেকে মাটির দিকে পতিত হচ্ছে। ঘুড়ির নেশায় সে লাফ দিয়ে ওটার পিছু নিয়ে দে ছুট। তখনও আমি গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। পাখিদের কলকাকলি তীব্র হয়ে এক সময় আবার চারদিক শুনশান। দিন পেরিয়ে রাত হবে, ঝিঁঝিঁ ডাকবে, শুরু হবে শেয়ালের চিৎকার, বিপণ্ন কণ্ঠে ডাকবে রাতজাগা অচেনা পাখি, তখনও আমার চেতনা ফিরবে না। আমার বুকের উপর দিয়ে অন্ধকারে হেঁটে যাবে কাঁকড়া আর শামুকের ঝাঁক। শেষ রাতে মেঘ গর্জে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে, চারদিকে বৃষ্টির ঝুমঝুম বাতাসের শো শো আওয়াজ। একদিন দুদিন পাঁচ দিন যাবে, বৃষ্টি থামার নাম থাকবে না। সপ্তম দিবসে যখন ক্রন্দনরত আকাশ শান্ত হবে, পৃথিবী ধাতস্থ হবে, ততদিনে প্রায় সমগ্র দেশ প্লাবিত বানের বাঁকা জলে। আমার তন্দ্রাচ্ছন্ন দেহ ডুবে আছে বালু আর জলরাশির ভেতর। প্লাবনজল নেমে গেলে আমি পলির নিচে রোদে-বৃষ্টিতে কুয়াশায়, উত্তাপে-শীতলতায় ক্রমে পঞ্চভূতে বিলীন হতে থাকি। বছর পেরিয়ে আবারো আসবে এমন উজ্জ্বল শরৎ, বাতাসের সাথে খেলবে আজকের মতো সাদা মেঘের দল। তখন আমার পাঁজর ফুড়ে বেরোনো ঘাসগুলো কাশের গাছ হয়ে উঠবে, কতকদিন না যেতেই ওদের যৌবন আসবে। আমার বুকের জমিনে ফোটা কাশফুল গুলো দুলতে থাকবে এমনি মোহময় বাতাসে। সেই অনাগত বিকেলে কম্পমান কাশফুলের ফাঁকে কান পাতলে কেউ হয়তো শুনতে পাবে দূরের কান্নার মতো কোনো অস্ফুট ধ্বনি। হয়তো মানুষের কান্নাই—অনাদিকালের বহু মানুষের!

   

ফেরদৌস আরার প্রবন্ধের আলপথ বেয়ে পাঠক চলে যান জ্ঞানের সমুদ্রদর্শনে



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘লেখকের প্রচুর অধ্যয়ন, পাঠগভীরতা, নিবিড় অনুসন্ধিৎসা, ঘোরলাগা শব্দপুঞ্জে, ভাষার শিল্পিত সুষমায় লেখাগুলি প্রাণ পেয়েছে। তাই গ্রন্থের তথ্যসমৃদ্ধ বারোটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য শুধু নয়, নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, জানার তাগাদা তৈরি করবে—বোধে, তৃষ্ণায়, জীবনজিজ্ঞাসায়। নিজের কথাই বলি, ফেরদৌস আরা আলীমের চোখ দিয়ে পড়তে পড়তে আমি নিজে প্রায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আফরোজা বুলবুল কিংবা প্রতিভা মোদক (‘যে জীবন শিল্পের, যে শিল্প জীবনের’), করুণা বন্দোপাধ্যায়, রবিশংকর বলকে (‘চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর’) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে আস্বাদ করি সময়-পরিক্রমায় লেখক ফেরদৌস আরা আলীমের কলমের ক্ষুরধার ক্রমমুগ্ধকর সৌন্দর্য।’

শনিবার (৪ মে নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক গলিতে অবস্থিত মাসিক নারীকণ্ঠ পত্রিকা-আয়োজিত ‘বই আলোচনা’-অনুষ্ঠানে ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আলপথে শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের মূল আলোচকের আলোচনায় তহুরীন সবুর ডালিয়া এসব কথা বলেন। বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনায় আরও অংশ নেন নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা জিনাত আজম, সালমা রহমান ও মাধুরী ব্যানার্জী।

নারীকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আহমেদ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শাহরিয়ার ফারজানা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতারী ইসলাম বলেন, ‘নানা বিষয়ে ফেরদৌস আরা আলীমের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সহজভাবে তিনি আমাদের সমাজবাস্তবতার যে-চিত্র আঁকেন তা মনের গভীরে সাড়া জাগায়। তার লেখা পড়ে এটুকু বলতে পারি যে, তার লেখা আমাদের জন্য গবেষণা ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান আকর।’

প্রবন্ধের আলপথে বইয়ের প্রকাশক, কবি ও খড়িমাটি-সম্পাদক মনিরুল মনির বলেন, ‘নারীমুক্তি বিষয়ে এ-বইয়ে দুটি তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে আরও কাজ করার জন্য গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রকাশিত বই নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘বড় কিছু হওয়ার কথা ভেবে লিখিনি, মনের আনন্দেই গোপনে গল্প-কবিতা লিখেছি। এমন একসময়ে আমরা লিখতাম, লেখা প্রকাশ করতে খুব লজ্জাবোধ করতাম। অবশ্য লিখতে গিয়ে তেমন কঠিন বাধা আমাকে ডিঙোতে হয়নি। একালের চেয়ে আমাদের সময়টা ছিল অনেক সুন্দর ও ভালো। মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল সমাজে। গণ্ডগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে চড়ে ঢাকা গিয়েছি একা-একা, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। মা-বাবারাও নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকাল মেয়েরা পদে-পদে বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের কলুষিত সমাজব্যবস্থা ও নষ্ট রাজনীতি।’ সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রশংসার ভূমিকা কম নয়। একজন লেখক তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য পেলে অনুপ্রাণিত হন যা তাকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি জোগায়।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা ও সদস্য রোকসানা বন্যা, মহুয়া চৌধুরী, রেহানা আকতার, সাহানা আখতার বীথি, কানিজ ফাতেমা লিমা, বিচিত্রা সেন, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, চম্পা চক্রবর্ত্তী, প্রচার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জয়, কবি মেরুন হরিয়াল ও কবি মুয়িন পারভেজ প্রমুখ।

;

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

;

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;