ডেরেক ওয়ালকটের কবিতা : উড়াল জাহাজ



অনুবাদ: বর্ণালী সাহা
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দ্য স্কুনার ফ্লাইট’ ডেরেক ওয়ালকটের একটি দীর্ঘ কবিতা। বর্ণসংকর এক নাবিক, যে আবার কবিও—এর কেন্দ্রীয় চরিত্র। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে তার সমুদ্রযাত্রা নিয়ে রচিত এই কবিতা, যেখানে উঠে এসেছে ওই অঞ্চলটির জাতিবৈরিতা এবং ইতিহাসের পরতে পরতে লুকোনো লাঞ্ছনা, প্রত্যাখানের আখ্যান। মূল চরিত্রটি বর্ণসংকর হওয়ার কারণে না কৃষ্ণাঙ্গ না শ্বেতাঙ্গ কোনো গোষ্ঠীতেই তার স্থান হয় না। কালোদের হাতে ক্ষমতা যাওয়ার আগে সে যেমন শ্বেতাঙ্গদের কাছে পরমানুষ ছিল, ক্ষমতা বদলের পর কালোদের কাছেও যথেষ্ট কালো না হওয়ার দরুণ সে বহিরাগত। আর এর মাঝে প্রেমিকা মারিয়া, সমুদ্র আর আকাশের তারার চেয়েও বিশালসংখ্যক দ্বীপপুঞ্জ তাকে ঘুরিয়ে মারে। তার অতীতচারণা আর বর্তমানের ঘটনাবলী পাঠকদেরকে শুধুমাত্র ক্যারিবিয়ার ইতিহাস আর বর্ণবৈষম্যের সাথেই নয় পরিচয় করিয়ে দেয় সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা সৃষ্ট গভীর-গহন ক্ষতের সাথে। সাম্রাজ্যবাদ যে বর্ণবৈষম্যের ধারণাটি শাদাদের মতোই কালোদের মধ্যেও রোপণ করে দিয়েছে—তার সাক্ষাৎ দলিল ওয়ালকটের এই অমর চরিত্রটি। এই কবিতাটি ডেরেক ওয়ালকটের মহাকাব্য ওমেরস-এর পূর্বে লিখিত। তাই এটি ওমেরসের ভাবনাবলয় সৃষ্টিতেও ওয়ালকটকে সাহায্য করেছে যথেষ্ট পরিমাণে। কবিতাটির সমুদ্রযাত্রা যেন এক মহাকাব্যের সূচনা কিংবা অন্যভাবে মহাকাব্যিক কাঠামোতে লিখিত একটি গীতিকবিতা। কবিতাটি ডেরেক ওয়ালকটের নির্বাচিত কবিতা ১৯৪৮-১৯৮৪ থেকে নেওয়া হয়েছে। - বিভাগীয় সম্পাদক


*
১ বিদায়, কারেনাজ, জলযানশোধনের ঘাট!

অলস আগস্টমাসে যখন সমুদ্র কোমল হয়ে ছিল,
আর এই ক্যারিবিয়ানের কিনারার
সাথে সেঁটে ছিল খয়েরি দ্বীপগুলি
গাছের পাতার মতো, তখন আমি
উড়াল নামের সেই জাহাজে নাবিক হয়ে চড়ব বলে
ফুৎকারে নিভিয়ে দিলাম বাতিখানি—
মারিয়া কনসেপশিওনের নিঃস্বপ্ন মুখের কাছেই যেটা জ্বলতেছিল।
আঙিনাটা পাংশুটে হয়ে যাচ্ছিল, আলো ফুটছিল যেই,
ওইখানে দাঁড়ালাম পাথরের মতো
আর বাকি সবকিছু অনড়, স্থবির,
শীতল সাগর ছোট তরঙ্গ ভাঙছিল, যেন ঢেউটিন,
আকাশের ছাদে গাঁথা পেরেকের ছিদ্রের মতো লাগছিল আকাশের তারাদের,
ততক্ষণে একটা বাতাস এসে গাছেদের সাথে কেমন
গায়ে-পড়া ভাব শুরু করে।
নিজের উঠান ঝাঁট দিচ্ছিল প্রতিবেশিনী,
রসকষ নাই মোটে তার, তাকে পার হয়ে ঢাল ধরে নেমে যেতে যেতে আমি প্রায়
বলেই বসছিলাম, “আস্তে ঝাঁট দে, শালি! ওর ঘুম পাতলা অনেক,”
তবুও সেই মাগি তাকাল আমার দিকে এমনভাবে,
যেন আমি নাই, যেন আমি মরা লাশ।
রুটের ট্যাক্সি এসে থামল, তখনো হেডলাইট জ্বলছিল।
ড্রাইভার ব্যাটা দেখি আমার ব্যাগের আগাপাশতলা দেখল হাসি-হাসি মুখে,
দাঁত ক’টা বের করে বলল, “এবার বুঝি, হাইব্রিড, সত্যই ভাগতেছ তুমি!”
গাধার বাচ্চাটাকে জবাব দিলাম না,
কেবল কোনোরকমে উঠে বসলাম আমি পিছনের সিটে।
ঘুলঘুলি বস্তির ঠিক উপরে
দেখলাম আকাশটা পুড়ছে অরুণিমায় গোলাপি হয়ে,
এমন গোলাপি যেন ঘুমের ম্যাক্সি তার, ঘুমের ভিতর যাকে ফেলে এসেছি।
রিয়ারভিউয়ের আয়নার দিকে চেয়ে দেখলাম,
সেখানে একটা লোক, দেখতে সে হুবহু আমার মতোই,
হাপুসনয়নে কাঁদছিল লোকটা
বাড়িগুলি, পথগুলি,
বালের দ্বীপটা জুড়ে যা আছে সকলই,
সকল কিছুরই জন্য।

যা কিছু ঘুমন্ত,
তা সবে রহম করো পরওয়ারদিগার!
রাইটসন রোডে যেই কুকুরটা পচতেছিল তারে দিয়ে শুরু ক’রে
আমারেও দয়া করো প্রভু,
আমিও তো এইসব রাস্তার কুকুর ছিলাম;
এই দ্বীপপুঞ্জরে ভালবাসবার বোঝা বহন করাই যদি আমার নিয়তি
হয় তবে আমার আত্মাপাখি উড়ে যাক পচনের থেকে।
কিন্তু জান কি, ওরা আমার আত্মাটাতে বিষ ঢালা শুরু করেছিল
ওদের বড় বড় বাড়ি আর গাড়ি আর বড় বড় অঙ্কের লুটপাট দিয়ে,
কুলি আর কালা আর সিরীয় কি ফরাসী দোআঁশলায় গুলজার,
তাই আমি ফেলে যাই এই সবকিছু
ওদের তরে, আর ওদের তামাশা-মোচ্ছবের তরে—
এই করে নিলাম আমি সাগরে গোসল,
এই চললাম পথ ধরে।
এই দ্বীপগুলিরে তো চিনি হাড়হদ্দ
দক্ষিণে মনস থেকে উত্তরের নাসাউ দ্বীপতক,
মগজে মরচে-ধরা নাবিক আমি,
নীলাভ সবুজ চোখ, হাইব্রিড বলে ওরা ডাকে আমাকে,
ভদ্রভাষায় লাল পিঁপড়া বলে যাকে; আমি, হাইব্রিড,
দেখেছি কেমন এই বস্তির মতো সাম্রাজ্যসকল
এককালে বেহেশত ছিল।
আমি এক সামান্য লাল পিঁপড়াই যার সাগর ভাল লাগে,
বিলাতি শিক্ষা ছিল দড়,
আমার মধ্যে আছে একাধারে ডাচ, কাউলা এবং ইংরেজ,
হয় আমি কেউ নই, নয়তো আমিই এক জাতি।

মারিয়া কনসেপশিওন তবু ছিল মোর ভাবনার সমস্তটাই,
সাগরের স্পন্দন, সাগরের ওঠানামা দেখতে দেখতে
জেলেদের ডিঙি আর পালতোলা জাহাজ আর প্রমোদের নাও-
ভেড়া বন্দর যেথা নবীন ছবিতে আঁকা সূর্যের তুলির টানে,
স্বাক্ষর করা তারই নাম সূর্যের প্রত্যেকটা প্রতিচ্ছায়া দিয়ে;
আঁধারের কালো এলোচুল নিয়ে সন্ধ্যা যখন
সূর্যাস্ত-রঙের উজ্জ্বল সিল্ক যেটা মারিয়ার ছিল,
সেটা গায়ে দিত,
আর ভাঁজ করে নিয়ে সমুদ্রটাকে
লুকিয়ে পড়ত চাদরের নিচে মারিয়ার সেই
বিখ্যাত তারা-ঝিলমিল হাসি হেসে,
আমি জানতাম আমি বিরাম পাবো নাকো, ভুলে যাওয়া আর হবে না।
কবরের পাশে বসে মৃতের স্বজনেরা বিলাপ করছে ধর, তখন যদি
পুনর্জন্মের কথা কেউ বলে ওদের কাছে,
ওরা তো চাইবে মৃত মানুষ বেঁচে উঠুক, ঠিক কিনা বল?
আগাগলুইয়ের কাছি খুলে গিয়ে উড়াল যখন
দোলবাজি দিয়ে দরিয়ার মুখে চলে যায়, তখন আমি নিজমনে হাসি:
“সাগরে জাল ছড়ালে মাছের অভাব হয় না—এই কথা
বারবার বলে লাভ কী?
আমি চাই না তাকে অসম্ভোগবিদ্ধা,
ভূষিত চাই না তাকে ফেরেশতানিন্দিত নূরে,
পর্ণমৃগের মতো বর্তুল ওই দু’টি কালো চোখ চাই,
ঘামে ভেজা রবিবার দুপুরে পিঠের ‘পরে নখাঘাতে সুড়সুড়ি দিত যে আঙুল,
ভেজা বালিকে শূলানো কাঁকড়ার মতো,
সে আঙুল চাই ততদিন
যতদিনে না আমি একটু হেলান দেবো, একটু হাসতে পাবো নির্ভাবনায়।”
এই যে কাজের মাঝে দেখছি সমুদ্রকে রেশমের মতো চিরে দিচ্ছে
আগাগলুইয়ের কাঁচি, তাকে পার হয়ে হু-হু ক’রে বাজে-বকা ঢেউ ছুটে আসতেছে,
তোমাদের বলি শোনো কসম খেয়ে –
মায়ের দুধের কিরা, রাত্রির চুল্লির থেকে আজ যত তারা
উড়বে, দোহাই তাদেরও—
ঠিকই ভালোবেসেছিলাম আমি
আমার ছেলেমেয়েকে, আমার বউকে আর ঘরকে আমার;
যেমন কবিরা ভালোবাসে সেই কবিতাকে, যে কবিতা কবিদেরই প্রাণনাশ করে,
যে নাবিক ডুবে মরে—সে যেমন ভালোবাসে সমুদ্রকে।

কখনো কি একাকী সাগরতটে চোখ তুলে
দেখেছ তুমি সুদূরে একটা জাহাজ?
এই যে কবিতাখানি লিখছি, আমার শব্দেরা সব সপসপে নুনে ভিজে যাচ্ছে;
তবে আমি যাই,
টেনে ধরি আর টাইট ক’রে গিঁট দিয়ে বাঁধি একএকটা লাইন এই মাস্তুলে-পালে;
সরল বয়ানে মোর সাধারণ ভাষা হোক পালের বাতাস,
কাগজের পাতা আজ পাল হোক তবে
উড়াল জাহাজের।
আগে তবে বলি শোনো কেমন করে এ কারবার শুরু হলো।

*

২ চরমানন্দ, অতলম্‌!

ও’হারার জন্য স্কচের বোতল কিছু পাচার করেছিলাম, বড় সরকারী চাঁই সে,
দারূবৃক্ষের দ্বীপ সেডরোজ থেকে মেইনল্যান্ডখণ্ডে, তাই
উপকূলরক্ষীরা ধরতে পারেনি আমাদের,
স্প্যানিশ কিশ্‌তি-কোশাগুলির সঙ্গে বরাবর আপস-রফাই হতো,
তবু একটা কণ্ঠ আমায় বলে যেত:
“দ্যাখ্‌ হাইব্রিড, এই ব্যবসাটা কীরকম বোম্বেটেগিরির!”
নিয়তির কথন, সে গেল নাকো খণ্ডানো! সমস্ত কারবার ধসে পড়ল। আর
আমি ধসে পড়লাম একজন নারীর কারণে,
তার ফিতা, জরি, সিল্কের কারণে,
মারিয়া কনসেপশিওন তার নাম।
আর হায়, এরপরই শুনলাম
তদন্ত কমিশন বসবে বিরাট অনুসন্ধানকল্পে, মজার ব্যাপার
হলো ও’হারা নিজেই চেয়ারম্যান হয়ে
অবৈধ মদ পাচারের কেস তদন্ত করবে নিজের।
আমার ভালই জানা ছিল গোয়ামারাটা কে খাবে,
হাঙরের চামড়ায় ঢাকা ওই হাঙরটা নয়, তার সঙ্গের ফেউমাছটা—
তোমার-আমার মতো খাকি প্যান্ট-পরা সাধারণ লাল পিঁপড়াই ছিল সে।
এর চেয়ে আরো বাজে ছিল, মারিয়ার সাথে আমার ঝগড়া চলছিল,
প্লেট-গ্লাস ছোঁড়াছুঁড়ি, জঘন্য, তাই আমি প্রতিজ্ঞা করি: “আর নয়!”
আমার বাড়ির লোক, আমার ফ্যামিলিটাকে চুরে-মেরে শেষ করে দিচ্ছিলাম আমি।
এমনই ফকির আমি হয়ে গেছিলাম,
সানগেলাস একখান আর একখানা শুধু মদের গেলাস
হলেই আমার চলে যেত,
অথবা চারটা করে গেলাস এবং সানগেলাস (যেমন
নাজাত পাওয়ার তরে ধর্মবিশ্বাসীর লাগে),
তাই নিয়ে বসে যাব চার-গেলাসীর রাজধানী শহরে;
পয়সা বলতে মোর ছিল শুধু সাগরের রুপালি কয়েন।

মন্ত্রীদেরকে নিশ্চয়ই দেখেছ আজকের বার্তা পত্রিকায়,
গরিবের বাপমা উনারা—ওদের পিঠের
উপর একটা হাত রাখা উনাদের,
আর একখানা পুলিশের দল রাখা
শুধু উনাদের বাড়ি পাহারা দিতেই,
স্কচের নহর বয়ে যাচ্ছে সেই বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে।
এখন আসা যাক সেই মন্ত্রী নামধারী পিশাচের কথায়–
মদ চোরাচালানের হোতা ছিল যে,
শালা আধা-সিরিয়ান গিরগিটি, ওর মুখটা
পুরু পাউডারে মাখানো,
আঁচিলগুলি আর পাথর চোখের পাতাগুলি দেখে মনে হতো
অনাদিকালের কোনো পচাগলা পাঁক চুয়ে চুয়ে
পিণ্ড জমাট বেঁধে গেছে;
ধনদৌলতে চুবিয়ে রাখা সে মুখটা
যখন আমি দেখলাম ঠাডা-পড়া, ক্যামেরার ফ্ল্যাশের নিকটে,
গায়ে জ্বালা ধরে গেল মোর।
বলে উঠলাম আমি, “হাইব্রিড, বুঝলানি, কী বালের এইসব!”,
তাতে ব্যাটা কাকে যেন ডেকে
লাথ মেরে ভাগাল আমারে,
বিদায় করাল তার অফিসের থেকে যেন আমি কোনো ভ্যাগাবন্ড আর্টিস্ট।
হারামির গুমোর কত!
সিংহাসনের থেকে নিচে নেমে এসে
নিজের পা লাগিয়ে লাথিটাও দেন না উনি।
এমন সব জিনিস চোখে দেখেছি,
যেসব দেখলে কেনা বান্দির পোলাদেরও বমি আসবে,
এই ত্রিনিদাদে, এই রক্ত-গন্ধশোঁকা ডালকুত্তাদের
মহাজনপদে।

মাথার ভিতর থেকে সাগরের কোলাহল ঝেড়ে ফেলে দিতে পারলাম না,
কর্ণলতির শঙ্খ শুধুই গাইছিল মারিয়া কনসেপশিওন,
তাই আমি কাজ শুরু করি
এক পাগলাচোদা আইরিশের সাথে উদ্ধারজাহাজের ডুবুরি হিসাবে,
লোকটার নাম ছিল ও’শনেসি, আর
ব্রিটিশ একটা মাল ছিল ‘হেড’ নামে;
কিন্তু এ ক্যারিবিয়ানের জল এমনই
রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে লাশে,
যেই না গলে-গলে মিশে যেতাম আমি পান্নাপানিতে,
মাথার উপরে জলছাদ ঢেউ তুলত
যেন কোনো রেশমের তাঁবু,
দেখতে পেতাম আমি প্রবালের দল: কেউ মগজ, কেউ আগুন, সাগরপাখা,
কেউ মরা মানুষের আঙ্গুল যেন,
আর তারপর, সাক্ষাৎ মরা মানুষ আমি দেখতে পেতাম।
সেনেগাল থেকে সালভাদর পর্যন্ত গুঁড়া-গুঁড়া পাউডার বালি
ওই মরা মানুষের হাড্ডি-চূর্ণ যেন, শাদা গুঁড়া করে রাখা আছে।
তিনডুবে গিয়ে আমি আতঙ্কে ভেসে উঠলাম,
একমাস নৌজীবী-হোস্টেলে থাকলাম। মাছের পাতলা ঝোল, সুরা-নসিহত।
যখনই মনে হতো, বউটারে আমার কী দুঃখ দিয়েছি,
যখনই নিজের যন্ত্রণা দেখতাম ওই অন্য মেয়েলোকটা নিয়ে,
সাগরজলের নিচে কানতাম আমি,
লবণে লবণ মিশায়ে,
রূপ তার তলোয়ার হয়ে পড়েছে এমনই আমার উপরে,
কোপ দিয়ে আলাদা তা করে দিয়েছে আমারে আমার সন্তানের থেকে,
মাংসের ভেতরেরও মাংস ওরা আমার; বাছারা আমার!

সেন্ট ভিনসেন্ট দ্বীপ থেকে আসা একখানা বজরা ছিল, যদিও সেটা
এতই গভীর ছিল, ভাসানো যেত না তাকে আর।
যখন আমরা মদ খেতাম, ব্রিটিশটা
পেরেশান হয়ে যেত ঘ্যানঘেনে কান্নায় মোর,
মারিয়া কনসেপশিওনের জন্য আমি এত কানতাম।
ব্যাটা বলত সে নাকি গাঁটের ব্যথায় ভুগতেছে—
গ্যাসবুদবুদ জমে ডুবুরির দেহে যেটা হয়।
কপাল ভাল ব্যাটার! মারিয়া কনসেপশিওনের জন্য মোর পরানে যে ব্যথা,
যে ব্যথা দিয়েছি আমি বউ আর ছেলেমেয়েদের,
তার চেয়ে ভাল গাঁটে ব্যথা হয়ে মরা।
জলের গভীরে যেই পুলক-সমাধি,
সেখানে এমন কোনো শিলা ছিল না,
যেটার ফাটলে আমি আমার আত্মামণি লুকিয়ে রাখতে পারতাম,
যেমন লুকিয়ে পড়ে উদোপাখি প্রতি গোধুলিতে,
এমন আলোর বালুতট কোনো ছিল না কোথাও,
যেখানে গিয়ে বিশ্রাম নেওয়া যেত, চিতিঠুঁটি পাখিরাও সেটা জানে,
তাই একবার আমি সমাধি নিলাম, আর খোদাকে দেখলাম
কোঁচবেঁধা বোল মাছ যেন, খুনআলুদা রক্তাক্ত শরীর,
দূরের কণ্ঠ এক গুমগুম নির্ঘোষে বলল আমায়, “হাইব্রিড যদি তুই
তারে ছেড়ে যাস যদি তারে ছেড়ে যাস,
তোর হাতে তুলে দেবো ভোরের তারা।”
যখন সে পাগলাগারদ ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম,
ভিন্ন মেয়েলোকের স্বাদ নিতে গেছি, তবু একবার কাপড় খুলত ওরা যেই,
ওদের ছুঁচালো মাঙ সিন্ধুসজারুর ডিমের মতন
লোমকাঁটা দিয়ে দাঁড়িয়ে যেত, তাই আমি
ডুব দিতে পারি নাই আর।
ইমাম সাহেবও এসে ঘুরে গেলেন। আমি পাত্তা দিলাম না।
কোথা আছে বিশ্রামশালা মোর, হায় খোদা? কোথায় আমার বন্দর?
কোথায় বালিশ যার ‘পরে মাথা রাখতে মূল্য চুকাতে লাগবে না?
আর সেই জানালা কোথায়, যার চৌকাঠ জীবনের কাঠামো হয়ে থাকবে,
যেই জানালার থেকে বাইরে তাকিয়ে র’ব আমি?

*
৩ হাইব্রিড ছেড়ে যায় মহাজনপদ

এখন আমার
আর কোনো দেশ নাই কল্পনা ছাড়া।
এখন তো ক্ষমতা কালাদের দিকেই ঝুঁকেছে,
ক্ষমতার দোলাচল ঘটার আগে
যেমন শাদারা চাইত না,
কালারাও একইভাবে চায় না আমাকে।
প্রথমজন এসে আমার হাতদুটোকে শেকলে বাঁধল আর মাফ চেয়ে বলল,
“ইতিহাস”;
দ্বিতীয়জন এসে বলল আমাকে আমি যথেষ্ট কালো নই,
জাতিগৌরবের যোগ্য হতে যতটা কালো হওয়া লাগে।
আচ্ছা বল দেখি,
কিসের কী ক্ষমতা-টমতা এই অচিন প্রস্তরের ভুঁয়ে—
পিচকারি-প্লেনওলা বিমানবাহিনী আর ফায়ার ব্রিগেড,
লাল ক্রস, পাইক রেজিমেন্ট,
দুইটা কি তিনটা পুলিশ-কুকুর
তোমার সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাবে
যতক্ষণ না তুমি হাঁক পেড়ে সারো,
“প্যারেড, সাবধান!”?
ইতিহাস সাহেবের সাথে একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল,
যদিও আমাকে উনি চিনতে পারেন নাই, পার্চমেন্ট—মানে
পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি কাগজ হয় যেমন, তেমন উনি
শাদা সেটেলারজাত শাদা ক্যারিবীয়,
শরীরে বৃদ্ধ এক সিন্ধুবোতলের
মতো ছিল অজস্র আঁচিল,
কাঁকড়ার মতো গুড়ি দিয়ে চলছিলেন
গ্রিল থেকে ছায়া যেই জালের মতন পড়ে বারান্দাতে, সেই জালের ফাঁকে।
ক্রিমরঙা লিনেনের কাপড়জামা, হ্যাট একই রঙ, লেফাফাদুরস্ত।
তাঁর মুখোমুখি হয়ে হেঁকে বললাম, “হুজুর, আমি হাইব্রিড!
ওরা বলে আমি আপনার নাতি। আপনার কি মনে আছে
আমার দাদীকে একটুও, আপনার
রাঁধুনি ছিল, জাতে কালো?”
হারামিটা খক্‌ করে থুতু ফেলল।
এরকম এক থুতু অগণন কথার সমান।
হারামজাদারা তবু আমাদের জন্য
বাকি রেখেছে তো শুধু ওই:
কথা আর কথা।

আমি আর বিপ্লবে বিশ্বাস করতাম নাকো।
নিজের মানবী বলে যাকে জানতাম তার ভালবাসার থেকে
বিশ্বাস উঠে যাচ্ছিল।
আলেক্সান্দর ব্লককে পড়েছি, তাঁর ‘ওরা বারো জন’ কবিতায়
ওই মুহূর্তটাকে পষ্ট করেই দেখিয়েছেন।
এক রবিবার দুপুরে,
মেরিন পুলিশ ব্রাঞ্চ আর ভেনেজুয়েলানা হোটেলের মাঝে আমি ছিলাম।
জোয়ান ছেলের দল ওদের গায়ের শার্ট খুলে পতাকা বানিয়েছিল,
ওদের বুক খোলা—বিদীর্ণ হয়ে যাবে সে অপেক্ষায়।
পাহাড়ের ভিতর এগিয়ে যাচ্ছিল ওরা দুর্বার, আর
যেই না সমুদ্রের ফেনা উঠে গেঁথে গেল বালির মর্মস্থলে,
ওদের কলধ্বনি থেমে গেল, আর
বৃষ্টির মতো ডুবে গেল তারা উজ্জ্বল পাহাড়ে,
প্রত্যেকে নিজ-নিজ বাদলা মেঘ সমেত ঝরে গেল, আর
রাস্তায় ফেলে গেল গায়ের জামা,
এবং ক্ষমতার প্রতিধ্বনি
রেখে গেল সরণির শেষ মাথাতে।
বেঁটে পাখাওলা ফ্যান ঘোরে সংসদীয় উচ্চসভার উপরে;
বিচাপতিরা নাকি, দুর্মুখে এও বলে, এখনো ঝরান
রঞ্জক-কেমিক্যাল মেশা লাল ঘাম,
ফ্রেডরিক সরণিতে গোঁফখেজুরের দল মিছিলযাত্রা করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিশ্চল,
নতুন বাজেট আসে, পাতা ওল্টাও এবে। সাড়ে বারোটার
সিনেমা দেখতে গিয়ে হলের প্রোজেক্টর নষ্ট না-হলেই বাঁচোয়া,
নইলে বিকল্প আছে: গিয়ে বিপ্লব দেখ!
পর্দার সামনের তৃতীয় সারিতে
আলেক্সান্দর ব্লক এসে বসে যান চকলেট কোন খেতে খেতে,
স্প্যাগেটি ওয়েস্টার্ন ঘরানার ছবি শুরু হবে একটু পরেই, ক্লিন্ট ইস্টউড
আছে এই ছবিতে; নামভূমিকায় আছে লী ভ্যান ক্লিফ।

*
৪ উড়াল পেরোয় রজকিনী গ্রাম

গোধূলিবেলা।
উড়াল পেরিয়ে যায় রজকিনী গ্রাম।
চাকার মতন যত সমুদ্রচিল।
আবার বন্দুকের ঘায়ে ফেনা শাদা থেকে বাদামী স্ফটিকরঙা হয়,
আকাশের তারাগুলি লাইটহাউজের সাথে শুরু করে দোস্তি জমানো,
প্রতিটি সাগরতটে এসে শেষ হয়ে যায় সুদীর্ঘ দিন,
সেখানে, বালির সেই বিস্তারে, তার শেষভাগে
একটি রিক্ত সৈকতে যেথা আলো ছাড়া আর কিছু নাই,
কার যেন গাঢ় হাত কালো সমুদ্রটার জালের খেপ ধরে টানা শুরু করে,
টেনে নিয়ে যেতে চায় তারে
গভীর, গভীর স্থলভাগে।

*
৫ (আদিদাস পন্থের) মজঝিম পাথারের মুখোমুখি হাইব্রিড

তার পরদিন ভোরে রান্নাঘরের দিকে হেঁটে গেলাম আমি, কিছু তাড়া ছিল,
একটু কফি বানাতে হবে;
সাগরের থেকে কুয়াশার কুণ্ডলী উপরের দিকে উঠছিল
ধোঁয়া বের হওয়া কেটলিখানার মতো,
কেটলিটাকে নামিয়ে রাখলাম ধীরে, অতিধীরে,
কারণ নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না:
দিগন্ত যেইখানে রুপালি এক অবচ্ছায়া হয়ে ছিল,
কুয়াশা সেইখানে পাক খেয়ে, ফুলে গিয়ে, হয়ে উঠেছিল
নৌবহরের পাল, এত কাছে যে
চাক্ষুষ দেখলাম ওইগুলি নৌকার পালই ছিল বটে,
চুল খাড়া হয়ে গেল, খামচে ধরল মোর খুলি,
কী যে ভয়ঙ্কর সেটা, তবু যে কী সুন্দর!
জাহাজের বহর তো নয় যেন মর্মর-পাতার জঙ্গল,
পালগুলি শুকনা কাগজ,
তারই মাঝ দিয়ে ভেসে গেলাম আমরা,
কাচের এপার থেকে দেখি আমি ওখানে মানুষ—
মরিচাধরা ওদের চোখের গর্ত,
কামানের খোলের মতন,
অর্ধ-উলঙ্গ ওই নাবিকেরা
সূর্যকে পাড়ি দিল যেই—
সূর্যের রশ্মিতে তুলে ধরা পাতা যেমন দেখা যায়—
ঠাহর করলে তুমি তেমনই দেখতে পেতে নাবিকগুলির হাড়গোড়
চামড়ার কলা ভেদ করে;
ফ্রিগেট, বার্কেনটিন—বিখ্যাত জাহাজ এসব—উজানের ঢেউ ক্রমশ তাদের বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।
দেখলাম ডেকের উপর
বড় বড় নৌসেনাপ্রধানেরা উদ্ধত দাঁড়িয়ে আছে,
রডনি, নেলসন, ডে গ্রাস প্রমুখ,
হুকুম করছে ওরা বাজখাঁই গলায় ওই জাহাজের হাইব্রিডদের,
জঙ্গলের মতো সেই মাস্তুলের ঝাড়
উড়ালকে ভেদ করে ভেসে চলে গেল, তারপর
জমিন ঘেঁষে বাতাস বয়ে গেলে পরে ঘাস শনশন করে যেরকম,
সেরকম অশরীরী শব্দ উঠল ঢেউয়ে, আর জাহাজের পাছাড়িতে
জড়ানো জলজ আগাছাগুলি
হিসহিস করল
ঢেউ যেই ওগুলিকে হিঁচড়ে নিয়ে গেল,
আর কিছু শোনা গেল না;
ঢেউগুলি ভেঙে ধীরে দোলা দিয়ে চলে গেল পুব থেকে পশ্চিম দিকে,
যেন এই গোলাকার পৃথিবীটা কোনো
হাতল-ঘোরানো এক জলচাকা কল,
কাঠের ছেঁওতি-বালতির মতো যেন তায় প্রতিটা জাহাজ—
অঝোরে ঢালছে জল, অতল তলের থেকে সেঁচা;
আমার অতীতস্মৃতি ঘুরপাক খাচ্ছিল আমার অগ্রজ
সকল নাবিককে কেন্দ্র করে,
তারপর সূর্য দিগ্বলয়ের অঙ্গুরিটাকে তাতিয়ে তুলল আর
বাষ্প হয়ে গেল ওরা।

এরপর পার হই বাণিজ্যতরী—ক্রীতদাস চালান দেওয়ার।
সব জাতিরাষ্ট্রের পতাকাখচিত,
পাটাতনের এত গভীরে সেঁধিয়ে আছে আমাদের পিতা-পিতামহেরা,
আমাদের হাঁকডাক শুনবে না মনে হয়। হাঁকডাক আমরা থামাই তাই।
কে জানে কে কার দাদা? নাম জানা সে তো আরো দূরের কথা।
কাল আমাদের গন্তব্যস্থল হবে বারবাডোজের তটরেখা।

*
৬ নাবিক ঝাউগাছকে গানের জবাব দেয় গানে

উনাদের দেখা যায় বারবাডোজের নিচু পাহাড়ের গায়ে
বাতাসেরে ঠেকা দিতে জড়া বেঁধে থাকেন,
ঝড়ে ফোলা বাতাসের মুখে তাঁরা এক একটা সুঁই,
সার বেঁধে ঢাল বেয়ে নেমে যান, ঠিক মাস্তুলের চেহারা,
আশেপাশে ছেঁড়া মেঘগুলি ছেঁড়া পালের মতন;
উনাদের মতো আমি সবুজ ছিলাম একদিন, সেসময়ে ভাবতাম
সাইপ্রেস বলে ডাকে যাঁরে,
সাগরের গায়ে হেলে পড়া যেই গাছগুলি সাগরের কোলাহল উর্ধ্বশাখায় বয়ে নেন,
আসলে সে গাছগুলি সাইপ্রেস নন, উনারা ঝাউগাছ।
কাপ্তান দেখি ক্যানেডিয়ান সেডার নামে ডাকে।
সেডার কি সাইপ্রেস কিবা ঝাউগাছ
যারা এইসব নামকরণ করেছিল, তারা জেনেবুঝেই করেছিল,
হয়তো দেখেছে তারা নুয়ে পড়া গাছেদের দেহ
হুহু ক’রে নারীদের মতো হাহাকার করে উঠছে ঝড়ের পরে—
হয়তো কোনো জাহাজ ঘরে ফিরেছে
আর সাথে নিয়ে এসেছে
আরো একজন নাবিকের ডুবে মরার সংবাদ।
একটা সময় “সাইপ্রেস” শুনতেই বেশি লাগসই মনে হতো সবুজ “ঝাউগাছ” এর চেয়ে,
যদিও বাতাসের
কাছে বেশকম নাই, যে শোকেই মূহ্যমান হয়ে তাঁরা নুয়ে পড়ে থাকুন না কেন,
যেহেতু উনারা তো গাছই মাত্র,
বেহেশতি ঝাঁপ আর কবর পাহারা দেওয়া ছাড়া
কী নিয়েই বা ভাবতে হয় উনাদের?
নামে তাই কী বা আসে যায়?
তবু দেখ, অবিকল তেমনই হয় জীবন—নাম যেরকম হয়ে থাকে।
বাঁচতে হবে তোমাকে বহিরাগত কোনো প্রভুর নিচে
বুঝতে হয় যদি নামের তফাত কত প্রকার ও কী কী,
জানতে হয় যদি কোন্‌ সে বেদনা ইতিহাসের যা শব্দেরা বহন করে,
বাসতে হয় যদি ভাল ওই বৃক্ষগুলিরে
হীনতর ভালবাসা দিয়ে, হয় যদি
বিশ্বাস করতে যে: “ওই ঝাউগাছেরা সাইপ্রেস গাছেদের মতো নুয়ে পড়েন,
নাবিকের বউদের মতো উনাদের চুল বৃষ্টিতে নিচে ঝুলে পড়ে।
বিশুদ্ধ বৃক্ষ উনারা, আর আমরা,
আমরা যদি কেবল আমাদের প্রভুগণ খুশি হয়ে যে নাম দিয়েছেন,
সেই নাম মোতাবেক বেঁচে থাকি, সাবধানে কপি করে যাই,
মানুষ হওয়ার কিছু চান্স তাতে আমাদের থাকলেও থাকতে পারে বটে।”

*
৭ উড়াল নোঙর ফেলে ক্যাস্ট্রিজ বন্দরে

যখন ক্যাস্ট্রিজের উপরে ছেয়ে থাকা তারাগুলি ছিলেন তরুণ,
শুধু তোমারেই আমি ভালোবেসেছিলাম আর ভালোবেসেছিলাম আমি সমস্ত ভুবন।
আমাদের দু’জনের আলাদা জীবন, তাতে কী বা আসে যায়?
আলাদা আলাদা সন্তান আমাদের, তাই তাদের ভালবাসার দায়ভার আছে?
যখন ভাবি তোমার বাতাসে বিধৌত
কাঁচা ঢলোঢলো মুখখানি,
তোমার গলার স্বর—সাগরের করাঘাত লেগে, আহা, সেই মধুহাসি?
সব বাতি নিভে গেছে লা টক-এর সিঁড়ি-অন্তরীপ জনপদে,
শুধু হাসপাতালের বাতিটা জ্বলছে।
ওদিকে ভিজির তটে প্রমোদতরণীদের ঘাটে
বাতিগুলি পাহারা দিচ্ছে। আমি কথা রেখেছি,
নিজের সম্পত্তি একটাই মোর,
তোমারেই সেটা দিয়ে যাই—
আমার কবিতা— তোমারেই,
সকলের আগে ভালোবেসেছি যারে।
আমরা এখানে শুধু একরাত আছি।
উড়াল আগামীকাল বিদায় নেবে।

*
৮ জাহাজে দাঙ্গা-ফাসাদ

এক হারামি ছিল জাহাজে, সে আমাকে নিশানা বানিয়েছিল—
জাহাজের কুক। চুতিয়াটা ছিল গ্রেনাডার মাল।
চামড়াটা ছিল যেন খইয়া বাবলা,
খসে খসে পড়া লাল গাছের বাকল,
ঝাপসা আবিল নীল চোখ; সে আমাকে একটুও তিষ্ঠাতে দিত না,
ভাবখানা যেন উনি শাদা মহাজন।
একটা খাতা ছিল আমার, এই যে এই খাতাটাই, যেটায় কবিতা লিখতাম,
তো একদিন এই শালা আমার হাত থেকে কেড়ে নিল সেটা,
ডানে-বাঁয়ে লোফালুফি শুরু করল সে,
অন্য নাবিকদের দিকে চিৎকার করে ছুঁড়ে দিয়ে বলল সে, “ধর্‌!”
ঠমক-লচক দিয়ে আমার হাঁটা দেখাল যেন আমি একটা মুরগি,
শুধু কবিতা লেখার দোষে।
কিছু কেস ঘুষির লায়েক,
দাঁড়ের গোঁজটা দিয়ে দু’ঘা দিলে কিছু কেস চুকেবুকে যায়,
কিছু কেস আছে যাতে ছুরি দরকার হয়ে পড়ে—
এইটা তেমনই কেস ছিল। আমি প্রথমে তো মিনতি করেছি,
বলেছি ফেরত দিতে খাতা, দিল নাকো,
উল্টো সে খাতা খুলে পড়তে লাগল, “অয়ি অর্ধাঙ্গিনী! মম সন্তানসন্ততি!”
আবার রঙ্গ করে কান্নার ভং ধরল সে যাতে নাবিকেরা হাসে;
হঠাৎ কী চলে গেল উড়ুক্কু মাছের মতন?
রুপার ছুরি আমার, ইস্পাতের ফলা
হামলা করল তার উপর, তার পায়ের ডিমের নধর মাংসটা বরাবর,
ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে গেল শালা, আর শাদা হয়ে গেল,
যতটুক শাদা সে নিজেকে ভেবেছিল তার চেয়ে বেশি শাদা।
আমি বাপু মনে করি মানুষে-মানুষে এইসমস্ত হওয়া প্রয়োজন।
ন্যায্য না, তবু যেটা যেমন, সেটা তেমনই। যন্ত্রণা পায়নি ততটা,
কেবল প্রচুর রক্ত,
ভিন্সি আর আমি ধরো খাস দোস্তো,
তবু আর কোনোদিন ওদের মধ্যে কেউ আমার কবিতা নিয়ে চুদুর বুদুর করবে না।

*
৯ মারিয়া কনসেপশিওন আর খোয়াবনামা

উড়ালের উপর যে ফাটা-বাঁশ বিমানটা চিল্লাচ্ছিল,
অতীতের একখানা পর্দা সে খুলে দিচ্ছিল।
“ঐ দেখা যায় ডমিনিকা!”
“এখনো ওখানে আদিবাসী পাবা।”
“একদিন আসবে যেদিন শুধু বিমান থাকবে, কোনো নৌকা রবে না।”
“আল্লাহ্‌ কি আকাশে উড়ার লেগে আদমেরে বানাইয়েছে, ভিন্স?”
“উন্নয়ন, হাইব্রিড, উন্নয়ন।
উন্নয়নই তো মূল কথা।
উন্নয়ন পিছে ফেলে যায় আমাদের মতো ছোট-দ্বীপ শরিকেরে।”
জাহাজ চালাচ্ছিলাম আমি, ভিন্স পাশে বসে ছিল
বর্শায় মাছ ধরছিল আর বাজে বকছিল।
শীতশুখা, চনমনে দিন আর চঞ্চল সাগর।
“উন্নয়ন কী জিনিস ঐ আদিবাসীদের জিজ্ঞেস কর।
ওদের তো ধরে ধরে নিকেশ করেছে লাখে লাখে, কিছু যুদ্ধে মরেছে,
বাদবাকি কিছু গেছে বেগার খাটুনি খেটে খনির ভিতর
রুপা খুঁজে খুঁজে,
তারপর কালাদের পালা; ল্যাও, আরো উন্নয়ন।
যতদিন না-দেখব সুস্পষ্ট প্রমাণ,
মানবজাতি যে বদলাবে, ভিন্স, এই কথা আমাকে বলো না।
উন্নয়ন—সে তো
হলো ইতিহাসের এক নোংরা তামাশা।
ঐ দেখো কাছে আসে দ্বীপের সীমানা, কী বিষণ্ণ সবুজ, তাকে জিজ্ঞেস কর।”
সবুজ দ্বীপগুলি দেখতে এমন যেন ফিটকিরিতে জারানো আমের ফালি,
এমন কড়া লবণে আমার ক্ষতরও কিছু উপশম হোক,
সমুদ্রনাবিক আমি, সতেজতা স্বভাবে আমার।
আকাশ ঝলকেছিল বরফের মতো সেই রাতে, এক আগুনে।
আদিবাসী যেন আমি, ছুটলাম ডমিনিকাময়,
নাকের রন্ধ্র মোর আটকে উঠল ধোঁয়াধূমার স্মৃতিতে;
আগুনে পুড়ছিল যে শিশুরা আমার,
আহারে, ওদের চিৎকার কানে শুনতে পেলাম,
খেয়েছি ব্যাঙের ছাতা (মগজের মতো) আর ছত্রাক নামই যার ‘শয়তানের ছাতা’
কুষ্ঠরোগে পচন ধরেছে এমন শাদা পাথরের তলে সেই ছাতা জন্মায়;
সকালের খানা ছিল আধাপচা পাতা
তলাফুটো ভেজা জঙ্গলে,
পাতাগুলি তার ইয়া বড়—মানচিত্র মাফিক,
যেই শুনি সৈন্যসামন্তের হইচই
এগিয়ে আসছে ঘন পাতার ফাঁক দিয়ে, উঠে দিই ছুট
লালকাঁটা গাছের ফলকদের মাঝখান দিয়ে
(বর্শার চে’ও বেশি ধার),
যদিও কলিজা ফেটে যাচ্ছিল মোর;
শরীরে আমার স্বজাতির রক্ত বয়, তাই নিয়ে
ছুটলাম আমি, ভাই রে, ছুটলাম যেন পটে আঁকা পাখি
ক্ষিপ্র পায়ের তলা শ্যাওলা-ত্বরিত;
তারপরে আমি পড়ে যাই, তবে পড়ি এক বরফঝোরার পাশে যেটা
ছিল সুশীতল এক ফার্নের ঝরনার নিচে। দেখি এক টিয়াপাখি,
চিৎকার দিতে দিতে গাছের শুকনা ডাল পাকড়ে ধরে সে আর আমি শেষমেশ
ধোঁয়ার গোটাকয়েক পেল্লায় আছড়ানো ঢেউয়ে ডুবে যাই;
যখন সেই কালো ধোঁয়ার সেই মহাসাগর সরে যায়,
আর আকাশ শাদা হয়ে যায়,
তখন সেখানে উন্নয়ন ব্যতিত আর কিছুই ছিল না,
যদি বা উন্নয়ন বলতে আমরা বুঝি একটা গোসাপ,
সূর্যের আলোপড়া কচি পাতার মতন প্রশান্ত স্থির।
মারিয়া এবং ওর খোয়াবনামার তরে হাউমাউ করে কাঁদি আমি।

ওর ঘুমে নোঙ্গর ফেলত খোয়াবনামা-বই,
অনিদ্রারোগীর বাইবেল,
ময়লা পুস্তিকা এক কমলা রঙের, ডমিনিক প্রজাতন্ত্র থেকে এ,
মাঝখানে একচক্ষু দানবের চোখ। খরখরে পাতাগুলি
যথারীতি কালো হয়ে ছিল ফালনামা আর ভবিষ্যবচনে,
উচ্চকিত স্প্যানিশে;
খোলা এক হাতের তালুও ছিল, ভাবী
সময়ের রায় দিতে, বিভাজিত, সংখ্যাচিহ্ন আঁকা
কসাইয়ের দোকানে
পশুর ছবি যেমন থাকে।
এক রাতে; জ্বরগায়ে, অসুখে জ্যোতির্ময়ী বলে উঠল সে,
“বইখানা নিয়ে আস, কেয়ামত এসে পড়েছে।”
বলে “স্বপ্নে দেখেছি ঝড় আর কতগুলি তিমি,”
কিন্তু সে স্বপ্নের অর্থ সে বইয়ে ছিল না।
পরে এক রাতে দেখি তিন বুড়ি স্বপ্নে,
রেশমপোকার মতো অবয়বহীন, তারা সেলাই করতেছিল ভাগ্য আমার,
চিৎকার করে আমি বাড়ির থেকে ওদের ভাগাতে গেলাম,
ঝাঁটা দিয়ে মেরে খেদিয়ে দিতেও চাইলাম,
কিন্তু তারা যতই বেরিয়ে যাচ্ছিল,
ততই আবার বুকে হেঁটে ফিরে আসছিল,
ততক্ষণে আমার চিৎকার ও কান্না শুরু হয়ে গেল,
শরীর বেয়ে বৃষ্টির মতো ঘাম ঝরতেছিল, মারিয়া
তন্নতন্ন করে ঘাঁটল সে বই স্বপ্নের অর্থের সন্ধানে;
কিছু মেলে নাই;
স্নায়ুগুলি গলে গেল মোর, জেলিফিশ ছাতাঝুরির মতন—
এই সেই সময় যখন আমি পুরোপুরি ভেঙে গেছিলাম—
ওরা খুঁজে পেয়েছিল মোরে
স্যাভানায়; তৃণমরু ঘিরে
তারস্বরে চিৎকারে রত:

আমারে তোরা সবে বাতাসের সাথে কথা বলতে দেখিস তাই,
ভেবেছিস বুঝি আমি উন্মাদ। ওরে,
এই হাইব্রিড দরিয়ার ঘোড়াদের মুখে লাগাম দিয়েছে;
তোরা তো দেখিস আমি সূর্যের দিকে চেয়ে থাকি
চোখের মণিদুটো ঝলসায় না যতক্ষণ,
তাই ধরে নিস হাইব্রিড উন্মাদ হয়ে গেছে, যত পাগলের দল!
শোনো, শোনো, তোমাদের ধারণাও নাই কত শক্তি আমার।
নারিকেল গাছগুলি দ্যাখ,
দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা আমার সৈন্য, প’রে হলদেটে খাকি,
অপেক্ষা করতেছে ওরা কবে হাইব্রিড এই দ্বীপসমুদায় দখল করবে,
ভয় কর্‌ সেদিনকে বরং, যেদিন আমি মানুষ রবো না আর, সুস্থ হয়ে যাব,
সেই ভাল হবে।
সকলের অদৃষ্ট এ আমার হাতে,
মন্ত্রী, ব্যবসাদার—হাইব্রিড সকলেরে কব্জা করেছে,
মুঠোয় ধরা বালির মতো, মামা, তোমাদের জীবনকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেবো আমি,
এই আমি যার কাছে কোনো অস্ত্র নাই,
আছে শুধু কবিতা আর আছে তালগাছ
(বল্লম তরবারি ওরাই আমার)
আর আছে চকচকে ঢাল সাগরের!

*
১০ গভীরতা, আয়ত্তের বাইরে

পরদিন, সাগর আন্ধার। গোয়ার ব্যথার মতো ভোর।
“বালের বাতাস
বদলায় হুটহাট, মাইয়ালোকের মন যানি।”
ধীরে ওঠানামা ঢেউ, বড় চূড়াগুলি
বরফধবল গিরিশৃঙ্গের মতো।
“হেইও, সারেং, আসমান এত কালো!”
“আশ্বিনে এই ভাব ঠিক লাগে নাকো।”
“এই আলো অদ্ভুত, এমন ঋতুতে
আকাশ থাকার কথা মাঠের মতন ফকফকা।”

চিলশঙ্কর মাছ ডিঙদৌড় দিলো
চাবুকের মতো লেজ বাড়ি দিয়ে সমুদ্র কেটে,
লম্বা শুঁড়ের মনোয়ার মাছ উপকূলপানে ভেসে গেল
লেত্তির পাক খোলা লাটিমের মতো,
লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়া তীরন্দাজির সই উড়ুক্কু মাছ
আমাদের পাশ দিয়ে ছুটে ছুটে গেল,
তুড়ুক্‌ তুড়ুক্‌!
ভিন্স বলে উঠল: “দ্যাখ্‌ মনা দ্যাখ্‌!”
কাউলা-কেশর এক তুমুল তুফান
হামলে পড়ল এসে পালের উপর
কুকুর খুবলে নেয় পায়রা যেভাবে, তারপর মটকালো ঘাড়
উড়াল জাহাজের, মাথা থেকে লেজ-অব্দি কাঁপিয়ে সে দিলো।
“খোদার কসম, কখনোই দরিয়াকে এত খেপতে দেখি নাই এত অল্প সময়ে!
ভগমান সাহেবের পিছ-পকেট থেকে এ বাতাস এসেছে!”
“কাপ্তান যায় কোথা? কানাচোদা নাকি!”
“মরার থাকলে মরবই, ভিন্স, কী বাল আসে যায়?”
“দোয়া পড়্‌, হাইব্রিড, জীবন যদি বা দোয়া না ভুলিয়ে থাকে!”

যথেষ্ট ভালোবেসেছি যাদের, তাদের ওটা ভালোবাসা নয়।
জলের পর্বতগুলির ফাঁকে উড়াল জাহাজ সই করে
শুরু হলো বৃষ্টির ঢিল-পাটকেল,
এর চেয়ে ভাল ছিল জোড়া পায়ে লাথি দেওয়া ডুবো-অগ্নিগিরির খাত।
ভয় লেগেছে কি?
পানির ফোয়ারা যেন তাঁবুর খুঁটি
হয়ে আকাশের সাথে করে কোলাকুলি,
মহাটলোমলো,
মেঘেদের সেলাই খুলে ও ছিঁড়ে যায়
আর আকাশ পানি ঢেলে ভেজায় আমাদের,
নিজের কান্না শুনি, “মারিয়ার খোয়াবনামার আমি সেই
সারেং, যে ডুবে মরে।” মনে পড়ে ছায়া-নৌযান,
প্যাঁচশূল দিয়ে বিঁধে ছিপি খুলে দিই যেন আমি সাগরের,
তলা ছেয়ে আছে যেথা সাগরের কীট,
একবাঁও দুইবাঁও, চোয়াল কঠিন হয় মুঠির মতন,
একটা জিনিসই শুধু ধরে রাখে কেঁপে-কেঁপে ওঠা এ আমারে—
নিরাপদে ঘরে আছে আমার ফ্যামিলি।
সেরকমই শক্তি এক মোরে গ্রাস করে, আর সেই শক্তি বলে:
“পিছিয়ে-পড়া জাতের মানুষ আমি,
যারা আজো খোদা-ভগবানেরে ডরায়।”
ঈশ্বর নিজে এসে কুপোকাত করুন
এ বিশাল সাগরদানোরে,
দরিয়ার তলে বিছানা পেতে যে দড়ি ফেলে দি’ছে,
ইচ্ছাশক্তি দিয়ে বেঁধে তুলে ফেলে দিন এই জন্তুরে;
এই সেই বিশ্বাস শিশু থেকে যেটা ক্রমে হালকা হয়েছে,
(বাটালি গলিতে সেই মেথডিস্ট চার্চ ছিল, ক্যাস্ট্রিজ শহরে)
তিমির ঘণ্টা যেই গেয়ে গেছে প্রার্থনাগান,
তিমির দেহের মতো খাঁজকাটা বেঞ্চিতে বসে, শোকগর্বভরে,
আমরা গেয়েছি গান কীভাবে যে টিঁকে আছে আমাদের জাত
সাগরের মুখগহবরে, সেই নিয়ে,
আমাদের ইতিহাস, বিপন্নতা নিয়ে, আর এখন,
এখন প্রস্তুত আমি, মরণ যা চায় তা-ই হোক।
কিন্তু এ ঝড় যদি কোনো শক্তি ধরে,
সেই শক্তি কাপ্তানের মুখে:
দাড়িতে পুঁতির মতো পানি লেগে আছে, চোখ অশ্রুতে নোনা।
জায়গায় আটকে আছে সে ক্রুশবিদ্ধ যেন বা,
শক্ত হাতে সে ব্যাটা ধরে আছে চাকা, ক্রস যেরকম খ্রিষ্টকে ধরে ছিল,
দু’চোখে আঘাত যেন কাঁদছে দু’চোখ শুধু আমাদের তরে,
তার মুখে ঢেলে দিতে থাকি শাদা রাম,
প্রতিটা জলের চূড়া সাগরদানোর হাতে চাবুক হাঁকায়,
উড়ালকে পিছনে হটায়,
দুই ক্রিমিনাল যেন আজ যুযুধান। সারা রাত্রি, বিরামহীন, থেকে ভোরবেলার
মতো লাল চক্ষু নিয়ে আমরা দেখি যে
প্রাণান্ত ক্লেশ বুঝি ফিকে হতে থাকে,
ফিকে হয়ে যায়,
আর তারপর দেখি কোনো ঝড় নাই।
দুপুরে সমুদ্র এত শান্ত হয়,
প্রভুর রাজ্য যেন প্রতিষ্ঠা হয়েছে।

*
১১ ঝড়ের পরে

যেকোনো ঝড়েরই পরে আসে এক কাঁচা আলো,
সাগর তখনো বিধ্বংসী যদিও;
জাহাজের পিছে তায় জেগে ওঠা উজ্জ্বল ফেনাতে
আমি দেখি ঘোমটায় মুখ ঢেকে মারিয়া কনসেপশিওন
দরিয়ারে বিয়ে করে দিয়েছে রওয়ানা;
স্রোতে ভেসে যায় পিছে ক্রমাগত প্রসারিত শাড়ির পাছাড়ি,
শাদা শঙ্খচিল, শাদা জলকুক্কুট মিতকনে-সখীসনে।
তারপর একেবারে গেল।
সেদিনের পরে আর কিছু চাই নাই।
মুখে মোর আড়াআড়ি ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল,
সূর্যের মুখে যেবা পড়ে।
শান্ত পারাবার।

আয় ধীরে, বৃষ্টি আয়, সমুদ্রের উদগ্র মুখে
পড়্‌ ছোট মেয়েদের গোসলের মতো; এই দ্বীপগুলি ধুয়ে জ্যান্ত করে দে
হাইব্রিড এককালে যেমন দেখেছে! সব পদচিহ্ন আর সব তপ্ত পথ
থেকে আজ গন্ধ উঠুক মারিয়ার হাতে
সদ্যই ইস্তিরি করা আর জলছিটা পড়া কাপড়ের। আমি শুয়ে স্বপ্ন শেষ করি:
যা কিছু বৃষ্টিতে ভেজে আর সূর্য করে ইস্তিরি—
শাদা মেঘ, সাগর, আসমান—একটা সেলাইয়ে জোড়া
মোর নগ্নতার তরে তেমন কাপড়জামা যথেষ্টই জামা।
যদিও উড়াল মোর পার হয়না কখনো জোয়ারের ঢেউ, যেটা ওঠে
অন্তিম বাহামার সশব্দ তট ছেড়ে সসাগরা জনস্থানমধ্যে এইখানে,
মোর খেদ নাই,
যদি এই হাত কোনো জাতের বেদনারে ভাষা দিয়ে থাকে।
মানচিত্র খুলে দেখো মিয়া,
টিনের থালের ‘পরে খোরাকির দানা যতগুলি,
তারো চেয়ে বেশি দ্বীপ দুনিয়াতে আছে—
ভিন্ন ভিন্ন সাইজ,
এক বাহামাতেই তো আছে এক হাজার
পর্বতের থেকে নিয়ে প্রবালপ্রাচীরে যত টুনি গাছ-ঝাড়,
সেসবের থেকে, আর এই পাল-বেঁধে-রাখা জাহাজের নাক থেকে
সকল শহরকেই দোয়া করি আমি,
আরো দোয়া করি সেই শহরের পিছনের পাহাড়ের ধোঁয়াতে যে নীল ঘ্রাণ থাকে
তারে, আর নিচের ঘরের চালা অব্দি ধীরে চলে যাওয়া এক ছোট রাস্তারে,
কাছির মতন সেটা; আমার জীবনে সার বলতে তো শুধু আছে এই:

এই মাস্তুল, দিকচিহ্ন, এ পিপাসা,
আর এই ঝাঁপ দেওয়া হৃদয়ের ক্রিয়া—
নিশানাকে সই করে এই উড়ে যাওয়া যার লক্ষ্য কভু মোদের জানা হবে না,
শুধুশুধু খুঁজে মরা একখানা দ্বীপ যার বন্দরে গেলে নাকি সব ব্যথা সারে,
আর এক নিষ্কলুষ দিগন্তরেখা,
কাঠবাদামের গাছ যেখানে বালিকে
ছায়া ফেলে ব্যথা দেয় না।
কত কত দ্বীপ!
ততগুলি দ্বীপ আছে, রাতের গাছের ডালে যত তারা ধরে।
শাখায়িত গাছটাতে ঝাঁকি লেগে উল্কা ঝরে পড়ে,
ফলের মতন খসে পড়ে চারিধারে
উড়ালকে ঘিরে।
সবকিছুকেই তবু ঝরে যেতে হয়,
আজীবন তেমনই ঝরেছে,
এক ধারে মঙ্গল, আরেক দিকেতে শুকতারা
ঝরে আর পড়ে আর রহে এক হয়ে এই পৃথিবীও অবিকল যেমনটা এক
ছোট দ্বীপ, তারাদের দ্বীপপুঞ্জমাঝে।
আমার প্রথম বন্ধু ছিল সাগর। আর এখন সে-ই শেষের বন্ধু।
এবার কথা থামাই। কাজে যাই, কিছু পড়া করি,
মাস্তুলের সাথে গাঁথা লণ্ঠনের নিচে বসে জিরাতে জিরাতে।
ভুলে যেতে চেষ্টা করি সুখ, কী ছিল তা,
তাতেও যদি বা কাজ হয় নাকো, তারাদের দেখি।
কখনো আমিই শুধু থাকি আর থাকে ফেনা নরম-কাটারি,
ডেক ক্রমে শাদা হয়ে যায়,
চাঁদাভাই খুলে দেয় একখানা মেঘের দরোজা,
মাথার উপরে শাদা চাঁদঢালা আলোপথ, সেই পথটা আমারে বাড়ি নিয়ে যায়।
হাইব্রিড তোমাদের গান শুনিয়েছিল
সাগরের অন্তস্তল থেকে।

   

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

;

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

;

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত

  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল মাল আবদুল মুহিত সাবেক অর্থমন্ত্রী। সবচেয়ে বেশিবার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড গড়া অর্থমন্ত্রী তিনি। দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষে রাজনৈতিক জীবন এবং স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে অবসর—সব ছিল তার বর্ণাঢ্য জীবনে। তার পর দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল ও বর্তমানে আবুল হাসান মাহমুদ আলী; কিন্তু কেউই আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারেননি। মুস্তাফা কামালের মন্ত্রিত্ব কালের পুরোটা সময় কেটেছে ‘অনুপস্থিতি’ আর বিবিধ ব্যর্থতা দিয়ে। নতুন অর্থমন্ত্রী মাত্রই নিয়েছেন দায়িত্ব, তাই তাকে এনিয়ে এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা কঠিন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত কেবল অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থমন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন লেখক, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি সরকারি চাকরি ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্বে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়েও দেন। সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। গণতন্ত্রে দেশকে ফেরানো হবে এই শর্তে তিনি এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর বছরখানেক দিন শেষে যখন দেখেন এরশাদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, তখন তিনি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ের পর যে মন্ত্রিসভা গঠন করে সেখানে শেখ হাসিনা তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। প্রবল প্রতিকূল দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন তার সুফল দীর্ঘদিন ভোগ করেছে দেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পসহ আরও অনেক প্রকল্প তার আমলে শুরু হয়। তিনি আর্থিক ব্যবস্থাপনার দিকটি সুনিপুণভাবে করে গেছেন। তার দায়িত্বকালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে ঊর্ধ্বগতির সঞ্চার হয়েছিল সেখান থেকে দেশ একটা সময়ে ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়।

মাথাপিছু আয়, জিডিপি, রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা খাতের ব্যবস্থাপনায় তিনি যে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন তার পথ ধরে পরের অর্থমন্ত্রীরা সেটা অব্যাহত রাখতে পারেননি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারেননি এবং পদে থেকেও তার কাজে অনুপস্থিতি দেশকে গভীর সংকটে নিপতিত করেছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুস্তাফা কামাল বিজয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখেননি শেখ হাসিনা, এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।

নানা কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এই দেশ স্মরণ রাখবে। তন্মধ্যে একটি যদি পেনশন ব্যবস্থা হয়, অন্যটি নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন। নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি এখনো আনুষ্ঠানিক হয়নি যদিও, তবে এনিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। নয় মাস আগে দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এবং এই নয় মাসে ব্যাপক সাড়া যদিও পড়েনি, তবে এখন পর্যন্ত ১ লাখ লোক এই সর্বজনীন পেনশনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রথমবার সবার জন্যে পেনশন চালুর কথা বলেন, তখন এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকেই। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে তিনি এক বৈঠকে সকলের জন্যে পেনশন চালুর ব্যবস্থার কথা বলে অনেকের বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। তবু তিনি এর একটা খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য।’ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে খসড়া তৈরি হয়ে আসার পর তিনি জানালেন, কিছুই হয়নি। এরপর তার নিজের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খসড়া তৈরির কাজ। তিনি এনিয়ে কথা বলতেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুল মাল আবদুল মুহিতের ওই উদ্যোগের পক্ষে ছিলেন, এবং কাজ করার নির্দেশ দেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর তথ্যগুলো একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের বাজেটে দেশের সকল নাগরিকের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি তার বাজেট বক্তৃতার ৫৯ নং পৃষ্ঠার পেনশন অধ্যায়ে বলেছিলেন ‘সরকারি পেনশনারগণ দেশের সমগ্র জনগণের একটি ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। তাই সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি সকলের জন্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অংশগ্রহণমূলক সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুকরণে আমরা কাজ করছি। আমাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ-রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।’ এর আগের বছরের বাজেটে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তার বক্তব্য তখন সে পর্যন্তই ছিল, এবং এক বছর পর পরের বাজেটে এসেছে স্বপ্নের পূর্ণ অবয়ব। আর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে। এরবাইরে আছে ২০১৮ সালে পেনশন নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্বোধন করা এক পাইলট প্রকল্পে, যেখানে ৫৭ জন ব্যক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। দেশের মানুষদের জন্যে পেনশন ব্যবস্থা চালু নিয়ে যে স্বপ্নের রূপরেখা দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সেটা তার জীবদ্দশায় পূরণ হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর সরকারি তরফে হয়েছে প্রকাশ্য এবং প্রধানমন্ত্রী করেছেন এর বাস্তবায়ন।

সম্প্রতি নারীদের গৃহকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। গত ২৩ এপ্রিল সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ সুপারিশ করা হয় বলে সংসদ সচিবালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নারীদের গৃহকর্মের এই মূল্যায়নে ঘরে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল পালন, বিভিন্ন জাতের সবজি উৎপাদনসহ নানা হিসাব এর মধ্যে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দেশের অন্তত ৪৩ শতাংশ নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে যোগ করা হলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ বা তার কাছাকাছি। এখন নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়নের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ছিল সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্ন। দায়িত্ব পালনকালে একাধিকবার তিনি এনিয়ে কথা বলেছেন, নারীদের কাজের রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের গুরুত্বারোপ করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে প্রয়াত এই অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশে ঘরের সেবামূলক কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। সে কারণে জিডিপিতে এর কোনো অন্তর্ভুক্তি নেই। এটার মূল্যায়ন করা জরুরি।’ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে এই মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘বিষয়টি আমরা পরিসংখ্যান বিভাগে যুক্ত করব এবং সরকারিভাবে আমরা এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাব।’

আবুল মাল আবদুল মুহিত নেই আজ দুই বছর। ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যান বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব। মৃত্যুর মাস দেড়েক আগে তাকে দেওয়া সিলেটে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের মূল্যায়নে বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।’ ৮৮ বছরের দীর্ঘ সময়কে তিনি বলতেন ‘মহাতৃপ্তির-মহাপ্রাপ্তির জীবন’।

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত।

;

চতুর ঘুঘু



শরীফুল আলম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

নেশাখোরের মত কখনো কখনো খিলখিল করে হাসি
প্রথমত দহন উষ্ণতায় ,
তারপর সুবিশাল শূন্যতায় ,
কখনো কখনো ছুঁয়ে ফেলি সাজানো প্রতিমা
জীবনের দাবী ,
তবে আপাতত গন্তব্য বলে কিছু নেই আমার
কবিতার অবয়ব এখনো যেটুকু আছে
তাকে আমি রঙ্গের উৎসবই বলি
কিম্বা যেটুকু আছে তা জীবনের দাবী ।

ক্রমাগত অন্তর্গত দ্বন্দে
অবাধ্য ভাষা এখন প্রাচীর তোলে
প্রসারিত মৃত্যুর কথা বলে ,
আমি তার গল্পের শেষটা জানার চেষ্টা করি
রাতের গহ্বর থেকে তোলে আনি মৃত্যুর পরোয়ানা ,
কিন্তু অস্পষ্টতা কিছু থেকেই যায়
আবার নিজে নিজেই বলি
আমার জলভূমিতে আবার কিসের নিঃসঙ্গতা ?

স্বপ্নবাসর ? সে এক চতুর ঘুঘু
আমি তার ক্ষণিকের হটকারীতা বুঝতে পারি
এমনকি চোখ বুজে
আমি ভুলে যাই তার সন্ধ্যার ঘায়েল
যেন দেখেও দেখিনা
বিনা মোহে সারারাত অহেতুক তার অহংকার
নিরর্থক বাজি ধরে সে
অর্কিড নিরালায় আমিও একা থাকি
ভাঙ্গা চোরা রাত জেগে থাকে আমার পাশে
মনে হয় চোখ দিয়ে ছুঁয়ে দেখি তার ঢাকাঢাকি
ফিরতি নজরে সেও আমায় দেখে
আমার মিষ্টি কবিতার মতই
আমিও থমকে যাই পাখীর ডাকে
দূর দরিয়ায় তখন উলুধ্বনি শংখ বাজে ,
ইচ্ছে হয় নাগরদোলায় আবার গিয়ে দুলি
আর জানই তো কবিরাই প্রেমে পড়ে
কবিরাও চুমু খায়
সুন্দরী পেলে তাঁরাও শুয়ে পরে।

*************************
শরীফুল আলম ।
২১এপ্রিল । ২০২৪ইং
নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।

;