‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলায় গবেষণা আরও বাড়ানো হবে’
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
কৃষি
কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলায় গবেষণা আরও বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুস শহীদ।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষিখাত। ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলায় গবেষণা কার্যক্রম আরও জোরদার করা হবে।
মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) রাজধানীতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং ফার্মিং ফিউচার বাংলাদেশ আয়োজিত ‘জলবায়ু কর্মকাণ্ড ও খাদ্য ব্যবস্থার রূপান্তর’ শীর্ষক দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক কর্মশালার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মন্ত্রী এসব কথা বলেন।
মন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলায় বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন সহিষ্ণু ফসলের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে। আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীদের হাত ধরে ইতোমধ্যে অনেক সাফল্য এসেছে।
তিনি বলেন, আমাদের বিজ্ঞানীগণ ও গবেষণা সংস্থাগুলো ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা বজায় রাখতে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
এর ফলে, জলবায়ু পরিবর্তনসহনশীল কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক এমএ সাত্তার মণ্ডলের সভাপতিত্বে ও সাবেক কৃষিসচিব আনোয়ার ফারুকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির সিনিয়র এসোসিয়েট ডিন জর্জ স্মিথ, ডিরেক্টর অব ইন্টারন্যাশনাল প্রোগ্রাম করিম মেয়ারদিয়া, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর সায়েন্সের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর শেইলা কাকা ওচুগবোজু, ফার্মিং ফিউচার বাংলাদেশের সিইও আরিফ হোসেন বক্তব্য রাখেন।
নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা অটুট রয়েছে। গত দুই বছর কোন ধান আমদানির প্রয়োজন পড়েনি। খাদ্যনিরাপত্তা বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে কারণ কৃষকরা সব চ্যালেঞ্জ উপেক্ষা করে চাষাবাদটা এখনও করে যাচ্ছেন। কিন্তু উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়াসহ অন্যান্য কারণে কৃষকরা যদি কৃষি কাজ থেকে সরে আসেন তাহলে মুশকিল হবে।
বার্তা২৪.কম-কে এসব কথা বলেছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক কৃষিবিদ ড. সুরজিত সাহা রায়।
এই কৃষিবিদ মনে করেন, বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ও সম্প্রসারণে ব্যাপক প্রচেষ্টা নেওয়ায় উল্লেখযোগ্য অর্জনে খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ে এখন যথেষ্ট আশাবাদী হওয়ার জায়গা তৈরি হয়েছে। কিন্তু কৃষি পণ্যের বিপণনে কাঙ্খিত সাফল্য এখনও আসেনি। যার ফলে কৃষি খাতের প্রধান অংশীজন কৃষকরা তাঁর কষ্টার্জিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তবে গবেষণার মাধ্যমে এই অচলায়তন থেকে বের হওয়ার উপায় বের করা গেলে সংকট নিরসন সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি।
চলমান তীব্র তাপপ্রবাহে কৃষি উৎপাদনে কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মাঠ পর্যায়ের কৃষিকর্মীদের সক্রিয় রাখার সঙ্গে স্যোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মেও এ সংক্রান্ত ভিডিও বার্তা ও লিফলেট প্রচার করা হচ্ছে, জানান এই কৃষিবিদ।
ড. সুরজিত সাহা রায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন বার্তা২৪.কম’র পরিকল্পনা সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম।
বার্তা২৪.কম: বোরোর ফলন কতটা ঘরে উঠেছে কৃষকের?
ড. সুরজিত সাহা রায়: নীচু অঞ্চল, যেমন ধরুন-হাওরাঞ্চল, সেখানে মোটামুটি কাটা শেষ। এ সপ্তাহে পুরোপুারই শেষ হয়ে যাবে। এমনকি, বাংলাদেশের চলনবিল বা অন্য নীচু এলাকা যেগুলো আছে-সেখানে কাটা হয়ে যাবে এরই মধ্যে। শুধু উত্তরবঙ্গে কিছুটা থাকবে। সেখানে ধান একটু পরে লাগায়, আলু তোলার পর। আর খুলনা ও বরিশাল অঞ্চল, যেখানে ঘেরের মধ্যে চাষ করে, তারা আগাম ধান লাগায় আবার আগামই কেটে ফেলে। আমরা নির্দেশ দিয়েছি, আগামী ২ তারিখের মধ্যে নীচু এলাকার (২ মে ২০২৪) সব ধান কেটে ফেলতে। কাটা প্রায় শেষ। কারণ ইতিমধ্যেই আমরা বৃষ্টির পূর্বাভাস পেয়েছি। সেই বৃষ্টিতে বন্যারও আশঙ্কা করছি।
বার্তা২৪.কম: এবারের তাপদাহ নিয়ে কথা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলেছেন, বাংলাদেশ বা এই অঞ্চলের দেশসমূহের জন্য এটি নতুন নয়। কৃষিতে এর প্রভাব কতটা?
ড. সুরজিত সাহা রায়: দীর্ঘ ৭৬ বছর পরে এত লম্বা সময় ধরে তীব্র তাপদাহ যাচ্ছে। পূর্বে যেটা হয়েছে-দুই দিন বা তিন দিন থেকেছে। আবার একটি বৃষ্টি হয়ে গেছে। আবার তাপ বেড়েছে। এতে করে গাছের ক্ষতিটা হয়নি। যেমন-আম ও লিচুর মুকুল আছে। এই তাপদাহে এর ক্ষতি হচ্ছে। আউস ধানের সমস্যা, পাটের সমস্যা-কিছুটা তো হচ্ছেই। তাপমাত্রা যখন ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করে তখন গাছেরও ফিজিওলজিক্যাল এক্টিভিটি স্টপ হয়ে যায়।
বার্তা২৪.কম: আমরা তো এখন আম রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছি। আমের ফলনে এই তাপদাহ কতটা প্রভাব পড়বে?
ড. সুরজিত সাহা রায়: এখন পর্যন্ত যা জানতে পারছি, খুব বেশি একটা প্রভাব পড়বে না। তবে আপনি জানেন যে, হাই টেম্পারেচার হলে পানি বার বার গাছের গোড়ায় দিতে হয়। পানি দিয়ে গাছের গোড়ায় ধরে রাখাটা খুব কঠিন। কৃষকরা মালচিং (আবর্জনা দিয়ে) দিয়ে চেষ্টা করছে যেন পানিটা থাকে। আর মাটির গোড়ায় পানি না থাকলে খাবার তুলতে পারবে না। তা না হলে আমও পুষ্ট হবে না। অন্যদিকে হাই টেম্পারেচার ফল পাকার জন্য খুব ভালো।
বার্তা২৪.কম: উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কৃষকদের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বিশেষ কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে কিনা?
ড. সুরজিত সাহা রায়: কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ইতিমধ্যেই বেশ কিছু পদেক্ষপ নিয়েছে। মাননীয় মহাপরিচালকের দিকনির্দেশনায় প্রতিদিনই এ নিয়ে আমরা কাজ করছি। কৃষকদের জরুরি পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা প্রদান করা হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে আমাদের কর্মীরা এবিষয়ে সচেষ্ট আছেন। আপনি জানেন, এখন তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগ। কৃষকরা যাতে সচেতন হতে পারেন এবং করণীয় ঠিক করতে পারেন, সেজন্য আমরা নিয়মিত প্রত্যক্ষ পরামর্শ প্রদানের পাশাপাশি স্যোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে পরামর্শ সম্বলিত ছোট ভিডিওবার্তা, লিফলেট প্রচার করছি। এতে কৃষকরা দ্রুত মেসেজটা পেয়ে যাচ্ছে। আমাদের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মাঠে যাচ্ছেন নিয়মিত। কে যে কোন মাধ্যমে দেখবে বা শুনবে তা বলা কঠিন, সেজন্য আমরা সবগুলো মাধ্যমেই তথ্য ও কৃষি পরামর্শ ছড়িয়ে দিচ্ছি।
ড. সুরজিত সাহা রায়: এখানে দু’ধরণের বাস্তবতা আছে। যেমন-আমরা গরমে পুড়ছি কিন্তু যাঁরা ধান চাষী তারা খুবই সন্তুষ্ট। কারণ হচ্ছে-তারা নিরাপদে ধানটা ঘরে তুলতে পারছেন। তারাও (কৃষকরা) আশা করছে, আরও ক’দিন পর যেন বৃষ্টিটা হয়। হাওরাঞ্চলে এখন তারা সুন্দর করে ধানগুলো কেটে ঘরে তুলছে। দামও পাচ্ছে ভালো। অন্যদিকে, উত্তরবঙ্গে অতিরিক্ত খরার কারণে সেচ দিয়ে কুলাতে পারছে না। সরকারও বোরো আবাদকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিদ্যুত সরবরাহ করছে। জেনে থাকবেন, গত দু’বছর এক ছটাক ধানও আমরা বাইরে থেকে কিনি নাই। এত খারাপ পরিস্থিতির মধ্যেও ধান কিনি নাই। আগামীতেও যাতে কিনতে না হয়, পারি যদি কিছু রপ্তানিও যাতে করা যায় আমরা সেই চেষ্টা করছি। এটা একটা ভালো অর্জন।
বার্ত২৪.কম: তার মানে বৈশ্বিক সংকটের মাঝেও আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা অটুট আছে?
ড. সুরজিত সাহা রায়: নিশ্চিতভাবেই বলা যাবে। তবে আপনি বলতে পারেন, দামটা বেড়ে গেছে। দাম বাড়ার ক্ষেত্রে কর্পোরেটগুলো বেশি ঝামেলা করছে বলেই মনে হচ্ছে। আমি আজ ৬৮ টাকা কেজিতে উস্তে কিনলাম। অথচ কৃষক ১৫ টাকায়ও বিক্রি করতে পারেন না। ধানের মূল্যের ক্ষেত্রেও যে ডেভিয়েশনটা হয়-কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে-আমি মনে করি মার্কেটিং বিভাগের এ নিয়ে প্রচুর কাজ করা প্রয়োজন। সিন্ডিকেটটাও ভাঙা প্রায়োজন।
বার্ত২৪.কম: মূল্যবৃদ্ধির এই যে শুভঙ্করের ফাঁকি, বিশেষ করে কৃষক তাঁর ন্যায্য দাম পান না কিন্তু ভোক্তা ঠিকই উচ্চমূল্যে কিনছেন। এই অচলায়তন কি কোন দিন ভাঙবে না?
ড. সুরজিত সাহা রায়: চেষ্টা চলছে। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারেও এটা বড় অগ্রাধিকার-দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা। কিছু মধ্যস্বত্ত্বভোগী ফায়দা লুটে, কোনভাবেই এটা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা খুব জোর দিতে বলেন অনেক সময়, কিছু কাজ হচ্ছে। আমি মনে করি, এনিয়ে গবেষণারও প্রয়োজন আছে। এই অচলায়তন ভাঙতে শক্ত হাতেরও প্রয়োজন। কৃষক সমিতিগুলো, সমবায়গুলো-একটা ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উৎপাদনের ভূমিকা উৎপাদন পর্যন্তই সীমিত। মার্কেটিংয়ের বিষয়গুলো দেখে অন্য বিভাগ। আমরা জড়িত না থাকলেও যেহেতু কৃষকরা আমাদের প্রধান অংশীদার, তাই চেষ্টা করি দায়িত্বের বাইরে গিয়েও কিছু ভূমিকা রাখার। জেনে থাকবেন, করোনাকালে-আমরা ম্যাঙ্গু ট্রেন চালু করেছিলাম, ক্যাটল ট্রেন চালু করা হয়েছিল। দিনাজপুর থেকে হাওরে কৃষি শ্রমিক পাঠানোর ব্যবস্থাও আমরা করেছি, তখন সব যান চলাচল বন্ধ ছিল। যদিও অন্য বিভাগের দায়িত্ব ছিল, কিন্তু আমরা আওতার বাইরে গিয়েও তা করেছিলাম কৃষকের স্বার্থে। বিশে^র উন্নত দেশগুলো সতর্ক করে বলেছিল, খাদ্যাভাব তৈরি হতে পারে। মানুষ না খেয়ে মারা যেতে পারে। সেটাও আমরা সফলভাবে মোকাবেলা করেছি। খাদ্যনিরাপত্তা বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে কারণ কৃষকরা সব চ্যালেঞ্জ উপেক্ষা করে চাষাবাদটা করেছেন। কৃষকরা যাতে তাদের কাজ থেকে সরে না আসে সেটাই আমরা চেষ্টা করছি। তাঁরা সরে এলে মুশকিল হবে।
বার্তা২৪.কম: বাণিজ্যিক কৃষি কি কোনো হুমকি তৈরি করছে?
ড. সুরজিত সাহা রায়: বাণিজ্যিক কৃষি, ইমপোর্ট সাবস্টিটিউট কৃষি বা এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড কৃষিও এখন সম্প্রসারিত হচ্ছে। তবে সাধারণ কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় মার্কেটিংয়েই আমাদের এখন নজর দিতে হবে। যেমন ধরুন-এবার সরিষার দাম পড়ে গেছে। দাম না পেলে কৃষকরা আর করতে চান না। সরিষার তেলটা ভোক্তারা এখনও এডিবল ওয়েল হিসবে নিতে পারিনি। এখনও আমরা এই তেলটা বিভিন্ন ভর্তা খাওয়ার মধ্যেই ব্যবহার সীমিত রেখেছি। যদিও এই তেলটা পরিমাণে কম লাগে। এর উপহার হলো, এই তেল পরিমাণে কম লাগে আবার ট্রান্সফ্যাট নেই-এতে ফ্যাটি লিভার, লিভার পাথর বা মুটিয়ে যাওয়া থেকে আমরা বাঁচতে পারি।
বার্তা২৪.কম: এই সময়ের কৃষির আর কি চ্যালেঞ্জ দেখছেন?
ড. সুরজিত সাহা রায়: বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যা এক্ষেত্রে বড় সংকট। জমির পরিমাণ কম এবং ক্রমাগত কমছে। এই পরিস্থিতি কৃষি উৎপাদনে বড় চ্যালেঞ্জ। অনেকটা ‘মাথা ঢাকলে পা বেরিয়ে যায় আর পা ঢাকলে মাথা’ এ রকম ব্যাপার। আমরা যদি কাছাকাছি দেশের পতিত জমি দীর্ঘ মেয়াদে লিজ নিয়ে চাষাবাদ করতে পারি সেটাও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নতুন সমাধান হতে পারে। প্রতিবেশী ভারতের আসামে প্রচুর পতিত জমি আছে। আমাদের পাহাড়ে যদিও অনেক অনাবাদী জমি আছে, কিন্তু সেখানে চাষাবাদে চ্যালেঞ্জও রয়েছে। আপনি জানেন, কৃষিটা প্রকৃতিনির্ভর। তারপরও আমাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যেভাবে নতুন জাত উন্নয়ন করছে, আমরা তা সম্প্রসারণ করছি, কৃষকের মাঠে নিয়ে যাচ্ছি-তাতে একটি ভালো অর্জন আসছে। বিশেষ করে ধান উৎপাদনে লবনাক্ততা একটি বড় সংকট ছিল দক্ষিণাঞ্চলে।
কিন্তু আমাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকগুলো জাত, যেমন ব্রি ধান৯৭, ব্রি ধান৯৮ ও ব্রি ধান৬৭-এই তিনটি জাত বিরাট বিপ্লব নিয়ে এসেছে। কৃষকরা ব্রি ধান২৮ ও ব্রি ধান২৯ চাষ করতো; আমরা এগুলো চাষে নিরুৎসাহিত করেছি। এবার সুবিধা হয়েছে-এগুলোর ফলনও ভালো, আগাম কাটাও সম্ভব। তারপরও এবার কিন্তু ব্রি ধান২৮ এ ব্লাস্টের আক্রমণটা হয়নি, কারণ বৃষ্টিটা একটু আগে হয়ে গেছে-ধানের থোর বেরুনোর আগে হয়েছে। ফুল বেরুনোর পর যদি বৃষ্টি হতো তাহলে ফলন বিপর্যয় হতো। যার ফলে ব্লাস্টের জীবাণুটা প্রথম বৃষ্টিতে মাটিতে পড়ে যায়, মাটিতে পড়ার সময় যদি সে ধানের শীষ পায় তাহলে শীষটা নষ্ট হয়ে যাবে। এবার শীষ বেরুনোর আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে। সব পড়েছে মাটিতে বা পাতায়, তাই তেমন ক্ষতি করতে পারেনি। এজন্য ধানের ফলন বেশ ভালো। একটু লস হচ্ছে, টেম্পারেচার যদি হাই হয় একে আমরা বলি রেসপারেশন লস, এতে ক্ষতি যেটা হয়েছে তা উল্লেখযোগ্য নয়। আবার তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় ধান আগে পেকেছে।
আবহাওয়ার যে পূর্বাভাস তাতে আগামী সপ্তাহে বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। এর মধ্যে ধানটা উঠে যাবে। অন্যান্য ফসলের বিশেষ কোনো ক্ষতি হবে না। প্রযুক্তি এখন অনেক আছে। কৃষকরা যদি প্রযুক্তিগুলো অনুসরণ করেন তাহলে আম ও লিচুর ক্ষতিটা পুষিয়ে নিতে পারবে। হয়তো দামটা একটু বেড়ে যাবে। যদিও এখনকার কৃষকরা খরচে খুব একটা কার্পণ্য করেন না। কারণ মার্কেট এখন খারাপ না। আমরা চাই কৃষক যাতে ন্যায্য দাম পায় এবং ভোক্তাও যাতে ন্যায্য দামে কিনতে পারেন। মাঝের মধ্যসত্ত্বভোগীর দৌরাত্ম যেন কমানো যায়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক উপাচার্য ড. আবদুস সাত্তার মণ্ডল চলমান তাপপ্রবাহে চলতি বোরো মৌসুমে ফলন বিপর্যয়ের আংশিক শঙ্কার সঙ্গে সুখবরও রয়েছে বলে জানিয়েছেন। দেশের সব অঞ্চলেই বোরোর ফলন সন্তোষজনক জানিয়ে এই কৃষি বিশেষজ্ঞ বলেছেন, অপেক্ষাকৃত বিলম্বে রোপণ করা ধানের ফোর্স ম্যাচিউরড হওয়ার শঙ্কা যেমন রয়েছে, তেমনি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ হাজার হেক্টর অতিরিক্ত আবাদের ফলে সম্ভাব্য বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার সম্ভাবনাও আছে।
বার্তা২৪.কম-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে চলমান তাপপ্রবাহে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে পরিবর্তিত জলবায়ুতে বাংলাদেশের কৃষিখাতের সংকট ও সম্ভাবনার নানা দিকও তুলে ধরেন ড. মণ্ডল। কথা বলেছেন পরিকল্পনা সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম।
বার্তা২৪.কম: চলমান এই তাপপ্রবাহে আমাদের খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া কতখানি ব্যাহত হতে পারে কিংবা এর কি নেতিবাচক প্রভাব কি পড়তে পারে?
ড. মো. আবদুস সাত্তার মণ্ডল: এটা এখনি বলা মুশকিল। এটা নিয়ে এখনও প্রামাণ্য কোন তথ্য আমাদের হাতে নেই। তাই আমরা যেন বিষয়টিকে কিছুতেই গুলিয়ে না ফেলি। আমরা যারা শহরের মানুষ, এই তাপে খুবই কষ্ট পাচ্ছি। সেটা যদি আমরা অন্য জায়গার সঙ্গে মিলিয়ে বোঝার চেষ্টা করি তাহলে অনেক ক্ষেত্রে একটু অতিরঞ্জন হয়ে যেতে পারে। ভুলও হতে পারে। ঢাকা শহর নিয়ে আমরা বেশি কষ্টে আছি বলে মনে করি গোটা বাংলাদেশ বোধহয় এরকম হয়ে গেছে। ঢাকা শহরের তাপমাত্রা গ্রামাঞ্চল অর্থাৎ যেখানে ফসল চাষাবাদ হয়, উন্মূক্ত মাঠ-ঘাট আছে, কিছুটা বায়ু প্রবাহ আছে (যদিও সূর্যের তাপটা বেশি) তবুও সেখানে তাপমাত্রা ২-৩ ডিগ্রি কম থাকে। খবরে যেগুলো দেখি সেগুলো সাধারণত শহরাঞ্চলে। এই দিকগুলো আমাদের মনে রাখতে হবে। তার মানে এই নয় যে তাপমাত্র বেশি না। বৈশাখ মাস এমনিতেই হটেস্ট মাস। এটা মনে রেখেই আমাদের আলাপটা করতে হবে। অনেক দিন বৃষ্টি নেই। প্রখর সূর্য রশ্মি। দেশের অনেক জায়গায় ধান কাটা লেগেছে। এই ধান কাটা হচ্ছে প্রধানত হাওর এলাকাতে। সেখানে ইতিমধ্যে যতদূর খবর পাচ্ছি, প্রায় অর্ধেক ধান কাটা হয়ে গেছে। ফলনও ভালো হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে লবনাক্তপ্রবণ এলাকাতে আমাদের গবেষণালব্ধ যে নতুন জাতের ধান (লবনসহিষ্ণু ধান) কাটা হচ্ছে, সেগুলোরও ফলন ভালো। হাওরে ফলন বেশ ভালো হয়েছে। এই অবস্থার মধ্যে তাহলে কৃষি নিয়ে আমাদের শঙ্কাটি কোথায়? শঙ্কার দিকগুলো যদি দেখি তা হচ্ছে-যে ধানগুলো বিলম্বে লাগানো সেগুলো পরিপক্ক হতে আরও দুই সপ্তাহ সময় লাগবে। যেহেতু তাপমাত্রা বেশি সেক্ষেত্রে এগুলোকে বলা হয় ফোর্স ম্যাচিউরড হতে পারে...নরমাললি ধানের থোর উঠার পর থেকে পরিপক্ক হতে এক মাস সময় লাগে। এখনো পরিপক্ক না হওয়া ধানের ক্ষেত্রে বলা যায়, যতটা পরিপক্ক হওয়ার কথা ছিল ততটা হয়ত নাও হতে পারে। অনেকটা ইম্যাচিউর বেবির মতো।
বার্তা২৪.কম: এবারের বোরো মৌসুমে ফলন বিপর্যয়ের কোন শঙ্কা কি আপনি দেখেন?
ড. মো. আবদুস সাত্তার মণ্ডল: বিষয়টি হল বাংলাদেশের কি পরিমাণ জমির ধান এখনো অপরিপক্ক সেই তথ্য আমাদের এখনও জানা নাই। এসব জমিতে তাপের প্রভাবে সময়ের আগেই পরিপুষ্ট না হয়ে পেকে গেলে ফলন বিপর্যয় হতে পারে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে-একেবারে নাভিতে যেগুলো লাগানো হয়েছে, তাপমাত্রার কারণে ফলন বিপর্যয়ের যে শঙ্কার কথা বললাম তা হচ্ছে মেইন ল্যান্ডে। অন্যদিকে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে বিলম্বে যারা ধান রোপণ করেছেন; বিশেষ করে আলুসহ অন্যান্য ফসল উঠানোর পর-এগুলোর ব্যাপারে যা হবে তা হচ্ছে-(এগুলো ভেজিটেটিভ গ্রোথ বলে) চলমান এই তাপের কারণে সেগুলো শুকিয়ে যেতে পারে। শুকিয়ে গেছে এমন কোন রিপোর্ট যদিও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, যদি তা হয় তবে ক্ষতি হতে পারে। এটা আমি বলছি, আশঙ্কার দিক বিবেচনা করে। কিন্তু আমাদের একটি সুখবরও আছে। সেটা হল এই বছর ধানের আবাদ অনেক বেশি হয়েছে। আমাদের ৫০ লক্ষ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান লাগানোর টার্গেট ছিল। কিন্তু হয়ে গেছে আরও বেশি। অন্ততঃ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আরও ২০ হাজার একর বেশি জমিতে বোরো আবাদ হয়ে গেছে। তাই যদি হয়-তাহলে সেখানে ফলন ভালো হবে। এই তীব্র তাপদাহে জনজীবনের দুর্বিষহ অবস্থা হচ্ছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু বোরো ফলনে বড় ধরণের কোন প্রভাব পড়বে এমন কোন তথ্য এখন পর্যন্ত নেই।
বার্তা২৪.কম: পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রভাব খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কতটা প্রকট হয়েছে?
ড. মো. আবদুস সাত্তার মণ্ডল: কিছু বিষয় ছাড়া পরিবর্তিত জলবায়ুর কারণে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়েছে এ কথা বলা যাবে না। অনেক চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। একটা বড় চ্যালেঞ্জ হল-আমাদের সেচ ব্যবস্থাটা এত বেশি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে যে সারা বছরই তা লাগছে। এতে কৃষির উপর বাড়তি খরচের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। সেই ক্ষেত্রে যে দামে ফসল কৃষকরা ব্রিক্রি করছেন, তাতে করে ধানের উৎপাদন অক্ষুন্ন রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এটা বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ। পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে এটা বোধগম্য হচ্ছে যে, আমাদের কৃষি ব্যবস্থাকে একটি চৌকষ কৃষি হতে হবে। এই যে পরিবর্তনগুলি আসছে, যুগ যুগ ধরে পরিবর্তন চলতেই থাকবে। আমরা জানি, কৃষি উৎপাদন মূলতঃ পানি ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভরশীল, এটি নির্বিঘ্ন ও প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করতে বিপুল বিনিয়োগ লাগবে। এটা কেবল সরকারের নয়, কৃষকের নিজেরও করতে হবে। ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে এই যে সেচ দেওয়া হচ্ছে, এতে ধান ও চালের যে দামটা পড়বে, তাতে খরচ পুষিয়ে নেওয়ার জন্য সেটার জন্যও তৈরি থাকতে হবে।
বার্তা২৪.কম: পরিবর্তিত জলবায়ুতে আমাদের কৃষি খাতকে সংহত রাখতে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপের বিষয়ে বলুন...
ড. মো. আবদুস সাত্তার মণ্ডল: অনেক পদক্ষেপই নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ করার বিষয় যে, কৃষি গবেষণায় জলবায়ুসহিষ্ণু জাত ও পারমাণবিক কৃষি গবেষণায় উদ্ভাবিত কিছু জাত এরই মধ্যে মাঠে গড়িয়েছে। এই জাত উদ্ভাবনটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় কার্যকর একটা পদক্ষেপ, যা সরকারের এ সংক্রান্ত পলিসির কারণে হয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে-বেসরকারি খাতও সরকারের পলিসির কারণে কৃষিতে যুক্ত হয়েছে, বিনিয়োগ করছে। দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোতে যেখানে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবস্থাপনার উল্লেখযোগ্য কোন উন্নয়ন এখন পর্যন্ত হয় নাই। বিনিয়োগেরও প্রশ্ন আছে। যে প্রশ্ন আছে সেটা বহুদিনের, সেখানে এখন পর্যন্ত কিছু আগায়নি। আরেকটি প্রসঙ্গ বলা হচ্ছে যে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এনিয়ে সরকারের পাশাপাশি একটি কোম্পানি কাজ করছে। তবে তেমনভাবে অগ্রসর হচ্ছে না, কারণটা আমাদের বুঝতে হবে। এটা প্যানেলের দাম বেশি নাকি অন্য কোন সমস্যা আছে-নতুন করে অর্গানাইজেশনাল কোন ড্রাইভ দিতে হবে কিনা তাও জানা জরুরি।
বার্তা২৪.কম: পরিবর্তিত জলবায়ুর ফলে কৃষিজ উৎপাদনের পরিবর্তনের সঙ্গে বৈচিত্র্যও এসেছে...
ড. মো. আবদুস সাত্তার মণ্ডল: পরিবর্তিত জলবায়ু কৃষিতে আমাদের জন্য সুফলও বয়ে এনেছে। পূর্বে রবি মৌসুম ছিল মাত্র দুই মাসের, তা এখন সাত-আট মাস ধরে থাকে। মানুষ প্রচুর ফসল ফলাতে পারছে। জমি খালি থাকছে না। কারণ সেইভাবে বর্ষা হয়ে জমিগুলো পানিতে নিমজ্জিত থাকে না। এসবও বুঝতে হবে। ফসলের নিবিড়তা বেড়েছে, নতুন নতুন জাতের ফসল আমরা ফলাতে পারছি। সমস্ত মাঠজুড়ে ফল তৈরি হচ্ছে। আমরা কি জানতাম আগে? এর সবই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই হয়েছে।
বার্তা২৪.কম: সামগ্রিক বিবেচনায় আগামীর কৃষি ব্যবস্থা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?
ড. মো. আবদুস সাত্তার মণ্ডল: এখন আমাদের কৃষিতে আসলে যা করতে হবে সেটা হচ্ছে, গ্রামে কৃষকরা উৎপাদন করে দেবেন আর আমরা শহরের মানুষরা কম দামে খাব, কৃষি এভাবে টিকবে না। কৃষককে তাহলে কে বাঁচাবে? তাকে (কৃষককে) ভালো একটা মূল্য দিতে হবে। এই জায়গাটা শক্তিশালী না করা গেলে কৃষি নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাবে।
চলমান তীব্র দাবদাহে জনজীবন বিপর্যস্ত। এর প্রভাব পড়ছে খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাতেও। এই পরিস্থিতিতে গ্রীষ্মকালীন ফল-ফসল উৎপাদনে করণীয় জানা অতিব প্রয়োজন। দেশজুড়ে চলমান তীব্র তাপপ্রবাহে কৃষিতে ১০টি করণীয় এখানে তুলে ধরা হলো। আশাকরছি, কৃষি সংশ্লিষ্টদের এই পরামর্শ সহায়ক হবে।
এক. ধানের জমিতে কমপক্ষে ২-৩ ইঞ্চি পানি ধরে রাখবেন। ধানে ফুল আসা অবস্থায় পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পানির ঘাটতি হলে ধান চিটা হয়ে যেতে পারে।
দুই. হাওড় এলাকায় সম্ভাব্য প্রাকৃতিক দূর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে ধান পেকে গেলে দ্রুত কেটে জমি থেকে ঘরে তুলবেন।
তিন. ধানে এ সময় ব্লাস্ট রোগের সংক্রমন শুরু হতে পারে তাই নিয়মিত মাঠ পর্যবেক্ষন করুন। এবং সম্ভব হলে উপযুক্ত ছত্রাকনাশক দিয়ে একটি স্প্রে করুন।
চার. ফলগাছের গোড়ায় বেসিন আকারে নালা করে সর্বদা পানি দিয়ে রাখুন। সম্ভব হলে গাছে পানি স্প্রে করুন। মনে রাখবেন এ সময় পানির ঘাটতি হলে গাছে ফল ধারন কম হবে এবং ফল ঝরে পড়ার সম্ভাবনা বেশী হবে।
পাঁচ. ফল বাগানে সপ্তাহে একবার প্লাবন সেচও দেয়া যেতে পারে। গাছের গোড়ায় খড়-কুটো বা কচুরীপানা দিয়ে মালচিং করে দিলে মাটির আদ্রতা রক্ষা পাবে।
ছয়. শাকসবজি চাষের ক্ষেত্রে মাটি বেশী করে জৈবসার দিন। এতে পুষ্টির পাশাপাশি মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ে।
সাত. হিট শক থেকে বাচতে গবাদিপশু ও পোল্ট্রি সেড বা ঘর শীতল রাখতে হবে। এক্ষেত্রে টিনের সেডের নীচে ইনসুলেটর দেয়া, টিনের চালে পানি দেয়ার ব্যবস্থা করা, সেডের ভিতর ফ্যান লাগানো বা পানি স্প্রে করে শীতল রাখতে হবে।
আট. গবাদিপশু ও পোল্ট্রি সেডের ভিতর পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য চারপাশে চট/ বস্তা এগুলো অপসারণ করে শুধু নেট দিয়ে রাখতে হবে। গবাদিপশুকে নিয়মিত গোসল করাতে হবে।
নয়. গবাদিপশু ও পোল্ট্রির জন্য স্যলাইন পানি সরবারহ করতে হবে। এছাড়াও পরিষ্কার পানির সাথে লবন, ভিটামিন সি ও গ্লুকোজ মিশিয়ে খেতে দিতে হবে।
দশ. মাছের ক্ষেত্রে পানির গভীরতা কমপক্ষে পাঁচ ফুট হতে হবে। পুকুরের কিছু অংশে কচুরিপানা দেয়া যেতে পারে। পানিতে লবন দেয়া এবং খাবারের সাথে ভিটামিন সি দিতে হবে। পুকুরে যাতে অক্সিজেনের ঘাটতি না হয় সেদিতে খেয়াল রাখতে হবে।
সর্বোপরি কৃষক ভাই-বোনরা এ সময় খুব সর্তক থাকবেন। আপনারা সুস্থ্য থাকলে আমাদের কৃষি সুস্থ্য থাকবে। হিটস্ট্রোক থেকে বাঁচতে খুব সকালে এবং বিকেলে জমিতে কাজ করুন। বেশী করে স্যলাইন পানি খাবেন। জমিতে মাথাল বা ক্যাপ পরে কাজ করবেন, খালি গায়ে থাকবেন না। কিছুক্ষণ পর পর মুখে পানির ঝাপটা দিন। দিনে ১-২ বার গোসল করুন। সহজে হজম হয় এমন খাবার গ্রহণ করুন। অসুস্থ্য বোধ করলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
আমরা প্রায়শই বলে থাকি কৃষিই কৃষ্টি। কৃষ্টি শব্দের অর্থ - কর্ষন, লাঙ্গল চালনা, কৃষি কর্ম বা সংস্কৃতি। এথেকেই বুঝা যায়, এ অঞ্চলের সংস্কৃতি মূলতঃ কৃষি নির্ভর। পহেলা বৈশাখ, যার আদ্যোপান্ত পুরোটাই আমাদের এই কৃষি, প্রকৃতি এবং অর্থনীতির অংশ। প্রকৃতির সঙ্গে সখ্য রেখেই কৃষক তার ফসলকে খাদ্যে রূপান্তরিত করে। মুঘল আমলে এটিকে অনুসরণ করেই শস্য উৎপাদন এবং খাজনা আদায়ের মধ্যে একটা সমন্বয় সাধনের জন্য স¤্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। আর তাই বাংলা নববর্ষ হলো নতুন এক ফসল চক্রের শুরু।
অনেক আগে থেকেই এ অঞ্চলের মানুষ ফসলের খাতিরে বছরকে মাস ও ঋতুতে বিভক্ত করে এসেছে। পূর্ণিমার চাঁদ রাশিচক্রের যে নক্ষত্রে (যেমন - বৈশাখা, জ্যৈষ্ঠা, আষাঢ়া, শ্রাবণা প্রভৃতি) দাঁড়িয়ে পূর্ণরূপে দেখা দিত, সে নক্ষত্রের নামানুসারে সে মাসের নাম হয়ে যায় বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ প্রভৃতি। ঠিক কবে থেকে সাল ও ঋতুর এরূপ ধারণা আমাদের হয়েছে তা সুচারুরূপে নির্ণীত নয়। তবে জানা যায়, রাজা শশাঙ্কের আমলে বাঙলা সনের ব্যবহার ছিল এবং সে সময় অগ্রহায়ণ মাসকে বছরের প্রথম মাস ধরা হত। কারন ‘হায়ণ’ আর্থ বছর, ‘অগ্র’ অর্থ প্রথম। হেমন্তের গোলা ভরা ধান আর নবান্নের উৎসবে মুখরিত মানুষ সে সময় অগ্রহায়ণে বাংলা নববর্ষের উৎসব করত।
চাঁদ, সূর্য ও নক্ষত্রের গতিবিধি, ঝড়-বৃষ্টি, শীত ও উষ্ণতার হ্রাস-বৃদ্ধি মানুষ জন্মলগ্ন থেকেই লক্ষ্য করে এসেছে। আর তারা বহু দিনের এই পর্যবেক্ষণকে প্রয়োগ করেছে কৃষি কাজে। ফসল ফলার প্রকৃতিগত পদ্ধতিকে মানুষ জেনেছে তা এক নির্দিষ্ট সময়ের প্রক্রিয়া। আমাদের দেশের বর্ণময় বিচিত্র প্রকৃতির সাথে এই বাংলা সন প্রবর্তনের সবচেয়ে বেশি সম্পর্ক বিদ্যমান। প্রকৃতি অনুযায়ী এ দেশের ফসল ফলে।
আর অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক হওয়ায় ফসল রোপণ ও সংগ্রহের মৌসুম অনুযায়ী বাংলা সনের প্রবর্তন হয়। এ জন্য বাংলা সনের আর এক নাম ‘ফসলী সাল’। এই ফসলী সাল খৃষ্টীয় সাল দিয়ে মাপা বেশ অসুবিধার ছিল কারণ ফসল রোপন ও সংগ্রহ করতে হত প্রকৃতির নিয়মে। প্রকৃতি ও ফসলের সাথে সঙ্গতি রেখে মোগল স¤্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। স¤্রাট আকবরের নির্দেশে সে সময়ের দিল্লী রাজদরবারের বিখ্যাত পন্ডিত আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজী বাংলা সন উদ্ভাবন করেন।
স¤্রাট আকবর প্রবর্তিত এ বাংলা সন তখনকার বৃহৎ বঙ্গ অর্থাৎ সুবে বাংলায় গৃহীত হয় এ দেশের আর্থ-সমাজ ব্যবস্থার চালিকা শক্তি রূপে। গ্রাম ও কৃষি-অর্থনীতি নির্ভর দেশের রাজস্ব আদায় হত তখন ফসল থেকে। সুতরাং কর আদায়ের এমন একটা সময় নির্বাচন প্রয়োজন ছিল যখন সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হয়। অনেকের মতে রাজস্ব আদায়ের জন্য বৈশাখ ছিল অগ্রহায়ণের চেয়ে নানা দিক থেকে সুবিধাজনক।
কার্তিক- অগ্রহায়ণ মাসে বাংলার নিম্নাঞ্চলের অনেক এলাকা জলমগ্ন অথবা কর্দমাক্ত থাকার কারণে জমিদারের নায়েব গোমস্তাদের চলাচলের অসুবিধা হয় এবং সে সময় দিন ছোট থাকার কারণে দিনের মধ্যেই দূর অঞ্চলের কর আদায় করে তারা সেরেস্তায় ফিরে আসতে পারে না। সে কারণে চৈত্র- বৈশাখের বড় দিন এবং শুষ্ক পথ-ঘাট কর আদায়ের জন্য বিশেষ সুবিধাজনক ছিল।
অতীতে সংস্কৃতির সঙ্গে অর্থনীতির দৃঢ় যোগাযোগ ছিল। কারণ এই অঞ্চলের জাতীয় অর্থনীতি তথা কৃষিজাতদ্রব্য উৎপাদন ও বাণিজ্যের লেনদেন পহেলা বৈশাখের সঙ্গেই জড়িত। কৃষি এবং ফসলের মঙ্গলকে কেন্দ্র করে এখানে বেশকিছু আচার বা উৎসব চালু ছিল। কৃষিজীবী সমাজের পারিবারিক পর্যায়ে এধরনেরই একটি মাঙ্গলিক উৎসবের নাম 'আমানী'।
চৈত্রসংক্রান্তির দিবাগত রাতে একটি নতুন পাত্রে পানি ঢেলে সেটিতে আতপ চাল এবং একটি কচি পাতাওয়ালা চারা আমগাছের চিকন ডাল ভিজিয়ে রাখা হতো। সকালে বাড়ির সবাইকে সেই ভেজানো চাল খেতে দেওয়া হতো। লোকবিশ্বাস ছিল, এতে সারা বছর বাড়ির সবার মঙ্গল হবে, কৃষির ফলন বাড়বে এবং এর কোনো অনিষ্ট হবে না। একই উৎপাদনব্যবস্থায় সংস্কৃতিকে বিচ্ছিন্ন করা কঠিন। তাই এই উৎসব হয়ে উঠেছিল সর্বজনীন এক উৎসব।
ধান-পাটের মৌসুমে ফসল বিক্রির টাকায় কৃষকরা পরিবারের সদস্যদের কাপড়-চোপড় এবং বছরের প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করতেন। তাই বাকিতে কেনাবেচা এবং নতুন ফসলি সনে প্রথম দিনে তা শোধ করা ছিল এক স্বাভাবিক রীতি। বছরের প্রথমদিন ব্যবসায়ীরা তাঁদের ক্রেতা-বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করে মিষ্টিমুখ করানোর মাধ্যমে সৌহার্দ্যপূর্ণ লেনদেনের জন্য নতুন হিসাবের হালখাতা খোলেন।
আর তাই এই দিনটি হয়ে ওঠে পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের একটা উৎস। আজ পহেলা বৈশাখে লাল-সাদার রঙের খেলায় বাঙালিরা নিজেদেরকে রাঙিয়ে তোলেন। এই রঙের সম্মিলন মূলত হালখাতার বৈশিষ্ট্যকেই প্রতিনিধিত্ব করে। কারন, লাল কাপড়ের মলাটে বাঁধাই করা শাদা কাগজের হিসাবের খাতাই ছিল 'হালখাতা'।
পহেলা বৈশাখের সময় কৃষি, কৃষক, অর্থনীতি এবং ব্যবসাকে কেন্দ্র করে উৎসবের এখানেই শেষ নয়। নতুন বছরের নতুন ধান ঘরে তোলার পর শস্য সম্পদে সমৃদ্ধ কৃষকরা নানারকম পণ্যসামগ্রী আদান-প্রদানের উদ্দেশ্যে নদীতীরে, বৃক্ষছায়ায় অথবা পাহাড়ের পাদদেশে মিলিত হতেন। এভাবেই একসময় গ্রামীণ অর্থনীতিতে যুক্ত হয় মেলা। পুরো বছরের উপকরণ, দৈনন্দিন জীবনের রসদ যাবতীয় জিনিসপত্র এখান থেকেই সংগৃহীত হতো।
ঐতিহ্যগতভাবেই বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে সবাই তাদের নিজ নিজ জমিতে চাষ দিতো। সব জমিতে একদিনে চাষ দেওয়া সম্ভব নয় বিধায় বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে প্রত্যেকটি জমিতেই এক পাক কিংবা দুই পাক করে লাঙ্গল দিয়ে রাখতো। এই রীতির নাম ছিল “হাল বৈশাখ”। বর্তমানেও অনেক জায়গায় এই রীতি প্রচলিত রয়েছে। হাল বৈশাখের অংশ হিসেবে বৈশাখের প্রথম দিনে গৃহপালিত গরুকে স্নান করিয়ে কপালে সিদুরের ফোটা দেয়া হয়।
এছাড়া কৃষিতে ব্যবহার হয় এমন উপকরণ (যেমন লাঙ্গল, জোয়াল, মই ইত্যাদি) পরিষ্কার করে পানি দিয়ে ধুয়ে সবগুলোর গায়ে তিনটি সিঁদুরের ফোটা দেয়া হতো। হাল বৈশাখ সম্পন্ন করার পর চাল, ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়া হয়। এছাড়া হাল বৈশাখের দিন আরেকটি কাজ করা হয়। সোলা দিয়ে গোল ফুলের আকৃতি তৈরি করা হয়। এই ফুলটি বিভিন্ন রঙের কাপড় দিয়ে সাজানো হয়। এরপর ওই ফুলটি ক্ষেতের মাঝখানে পুঁতে দেওয়া হয়। এরপর ফসলের শুভকামনায় জমির মালিক ফুলটি ক্ষেতের মাঝখানে পুঁতে দিতেন।
বৈশাখপূর্ব বাঙ্গালীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ন আচার হলো চৈত্রসংক্রান্তি। সংক্রান্তি মানে এক ক্রান্তি তথা এক কিনারা থেকে আরেক কিনারায় যাওয়া। চৈত্র মাসে চৈতালী ফসল উঠে গিয়ে পুরা মাঠই শুকনা খর খরে হয়ে যেতে পারে। এই সময় প্রকৃতিতে কি কি খাদ্য মানুষের এবং অন্য প্রাণীর জন্য থাকে তা জানা দরকার। তাই চৈত্র সংক্রান্তিতে প্রকৃতির খোঁজ খবর নেয়া হয়। চৈত্রসংক্রান্তির খাদ্য তালিকায় কোন মাছ-মাংস থাকবে না, থাকবে চৌদ্দ প্রকারের কুড়িয়ে পাওয়া শাক। চৌদ্দ রকম শাকের মধ্যে থাকে হেলেঞ্চা, ঢেকি, সেঞ্চি, কচু, থানকুনি, তেলাকুচা, নটে শাক, গিমা, খারকোন, বতুয়া, দন্ডকলস, নুনিয়া, শুশ্নি, হাগড়া, পাট, সাজনা ইত্যাদী। এই সব শাক কুড়াতে মেয়েরা ১-২ কিমি পথ পথ পাড়ি দেন। যদি এই দুরত্বের মধ্যে অন্তত চৌদ্দ রকমের শাক পাওয়া যায় তাহলে ধরে নেয়া হয় প্রকৃতি ও পরিবেশ ভাল আছে।
পরিবেশ-প্রকৃতির সাথে মানুষের আন্তঃসর্ম্পকের বিষয়টি প্রাগৈতিহাসিক। পূর্বে মানুষ বিশ্বাস করত প্রকৃতির মধ্যে অতি-ভৌতিক, জীবনধাত্রী এবং জীবনধারণ করার মত সকল শর্ত বিদ্যমান রয়েছে। এ জন্য প্রাগৈতিহাসিক সময়ের মানুষ প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখাত, প্রার্থনা করত। প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা মিশ্রিত চেতনা ছিল বলেই মানুষের সাথে প্রকৃতির সহমর্মিতার সম্পর্ক দৃঢ় ছিল।
কৃষির উৎপাদন পদ্ধতি এবং মানুষের জীবিকার উৎসকে কেন্দ্র করে যে সকল আচার অনুষ্ঠান সমাজে গড়ে উঠেছিল সেই সব উৎসবগুলো নানাকারনে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। যদি আমরা আবার স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে পারি, তাহলে কৃষির মাধ্যমে মানুষ ও প্রকৃতি-পরিবেশের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পূনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। যে কৃষি ও প্রকৃতি মানুষের প্রাণ বাঁচায়, সেই কৃষি ও প্রকৃতি যদি বাঁচে তবে তার সাথে জীবনের উৎসবসমূহ বাঁচবে অনন্তকাল। বাঙ্গালীর চিরন্তন উৎসবগুলো বেঁচে থাকুক আপন মহিমায়, এই প্রত্যাশায় সকলকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।