রুশ রূপকথা ফুরালো, ক্রোয়েশিয়া সেমিফাইনালে

, খেলা

এম. এম. কায়সার, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 22:02:51

রাশিয়া ২ (৩) : ক্রোয়েশিয়া ২ (৪)

সবকিছুই গল্পের প্লটের মতই চলছিল। রাশিয়া প্রথমে গোল পেল। জয়ের সুবাস ছড়াল। গল্পের বাঁক বদলে গেল ক্রোয়েশিয়ার সমতাসূচক গোলে। ম্যাচ গড়াল অতিরিক্ত সময়ে। যেটা রাশিয়া প্রাণপনে চাচ্ছিল। স্বপ্ন দেখছিল আরেকটি টাইব্রেকারের। অপেক্ষায় ছিল বিশ্বকাপে নিজেদের পথচলার রূপকথাকে আরও রঙিন করতে। তবে রাশিয়ার সেই রূপকথার গল্পের সমাপ্তি টেনে দিল ক্রোয়েশিয়া। টাইব্রেকারে ৪-৩ গোলে কোয়ার্টার ফাইনালে রাশিয়াকে হারিয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছে গেল ক্রোয়েশিয়া। যেখানে তাদের জন্য অপেক্ষায় আছে ইংল্যান্ড।

আর রাশিয়ার বিশ্বকাপ রূপকথার গল্প ফুরালো চোখের জলে। তবে কান্নায় বিশ্বকাপ মিশন শেষ হলেও বীরত্ব বন্দনাও কম পাচ্ছে না রাশিয়া!

সত্যিকার অর্থেই এই কোয়ার্টার ফাইনাল হয়েছে দারুণ উপভোগ্য এক ম্যাচ। ক্ষণে ক্ষণে ম্যাচের গতি বদলেছে। বাঁক বদলেছে। কখনো টেনশনে ক্রোয়েশিয়া। কখনো গ্যালারিতে কাঁদছে রাশিয়া। খানিকবাদেই আবার ভিন্ন রূপ। হতাশায় টেনশন। আনন্দে ফেটে পড়ছে রাশিয়া। শেষমেষ হাসি নিয়ে ফিরল ক্রোয়েশিয়াই।

কি দারুণ সমতায় শেষ হল নির্ধারিত সময় এবং অতিরিক্ত সময়ের খেলা। নির্ধারিত সময়ের খেলা ১-১ গোলে ড্র হলে ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। সেই সময়ের প্রথম অর্ধেই ভিদার গোলে এগিয়ে গেল ক্রোয়েশিয়া। কর্নার থেকে আসা হেডে গোল করে ক্রোয়েশিয়াকে জয়ের স্বপ্ন দেখান ভিদা। অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে গোল শোধের জন্য রাশিয়া উঠে পড়ে লাগে। ডাগআউটে দাড়িয়ে ক্ষ্যাপাটে সেনাপতির মতো দু’হাত উঁচিয়ে গ্যালারির দর্শকদের গলা ফাটিয়ে সমর্থন দিতে বলেন রাশান কোচ। সেই সমর্থনের জোরেই যেন ম্যাচে ফিরে রাশিয়া। অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শেষ হওয়ার মিনিট পাঁচেক আগে ফ্রিকিক থেকে পাওয়া বলে হেড করেন ফিগুয়েরা ফার্নান্দেজ, গো..ও..ল! এবং ম্যাচে ২-২ গোলে সমতা। শিহরণ জাগানো ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে।

যে লটারিতে ক্রোয়েশিয়া হাসল। তবে রাশিয়াও জানিয়ে দিল বিশ্ব ফুটবলের বড় শক্তি হয়ে উঠছে তারা। বিপ্লব মাত্র শুরু হয়েছে কমরেড!

ফুটবলের মোটিভেশন ক্লাসে একটা কথা প্রায় বলা হয়ে থাকেÑ যদি জিততে চাও, তবে প্রতিপক্ষকে মাঠে চমকে দাও। ঠিক সেই প্রেরণা নিয়েই কোয়ার্টার ফাইনালে নামে রাশিয়া। স্পেনের বিপক্ষে তাদের ম্যাচ দেখে ক্রোয়েশিয়া ভেবেছিল এই ম্যাচেও রক্ষণাত্মক ভঙ্গির রাশিয়ার দেখাই মিলবে। কিন্তু ভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে সোচিতে নামল রাশিয়া। ম্যাচের প্রথম মিনিট থেকেই মাঝ-মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিদ্যুৎগতিতে আক্রমণে উঠে এল। এমনকিছু হতে পারে এটার জন্য ক্রোয়েশিয়া প্রস্তুত ছিল না। রাশিয়ার আক্রমণের তেজে এলোমেলো হয়ে পড়ে ক্রোয়াটদের রক্ষণ। বিশালদেহী ষ্ট্রাইকার জুবা ও চেরিসেভ বল পায়ে কাঁপিয়ে দিচ্ছিলেন। প্রথমার্ধে রুশদের এই গতিময় ফুটবল জানিয়ে দিল এই ম্যাচে লিড নিয়েই সামনে বাড়তে চায় তারা। সেই ইচ্ছেটা তাদের পুরো হল। ম্যাচের ৩১ মিনিটের সময় মাঝমাঠ থেকে চেরিসেভ ও জুবার দুর্দান্ত বিল্ড-আপ রাশিয়াকে মনে রাখার মতো গোল এনে দিল। সেন্টার থেকে একটু সামনের জটলা থেকে বল নিয়ে সামনে বাড়লেন চেরিসেভ। ডিফেন্সের ফাঁক গলে বামদিকে থাকা জুবার দিকে বল ঠেলে দিলেন। জুবা বল ধরে দু’কদম এগিয়ে ফের ডানদিকে চেরিসেভের দিকে পাস বাড়ালেন। চেরিসেভের দু’পাশে দুই ডিফেন্ডার দাড়িয়ে। কিন্তু তারা কিছু বুঝে উঠার আগে প্রায় ৩০ গজ দূর থেকে বাম পায়ে কর্নার পোষ্টে শট নিলেন চেরিসেভ। সেই শট এতই আচমকা এবং গতিময় যে গোলপোষ্টে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রোয়েশিয়ার গোলকিপার সুভাসিচ শুধু চেয়েই থাকলেন এবং বল জালে, গো....ও...ল! টুর্নামেন্টে এটি চেরিশেভের চতুর্থ গোল।

ম্যাচে রাশিয়ার লিড। তাহলে বিশ্বকাপে রুশ রূপকথার নতুন অধ্যায় বুঝি শুরু হল!

তবে সেই গোলের রোমান্টিক সময়টা বেশিক্ষণ উপভোগ করতে পারেনি রাশিয়া। মরিয়া হয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায় ক্রোয়েশিয়া। আট মিনিটের মধ্যে ম্যাচে সমতা। জোনাল মার্কিং না করার শাস্তিটা পেল রাশিয়া। বামদিকে ফাঁকা জায়গা পেয়ে বল নিয়ে ডি বক্সে ঢুকে পড়েন মানজুকিচ। বক্সে ক্রস আসছে এটা জেনে নিজেকে একটু আগেভাগেই তৈরি করে রাখেন ক্রামনিচ। অবাক করার বিষয় হল এই সময়ে ছোট ডি বক্সে রাশিয়ার পাঁচজন খেলোয়াড় থাকলেও একজনও ক্রামনিচকে পাহারায় না রেখে এলোমেলে ভঙ্গিতে দাড়িয়েছিলেন! মানজুকিচের ক্রসে বলা যায় দেখেশুনে আয়েশ করে হেড নিয়ে ক্রামনিচ বল জড়িয়ে দেন, গো...ও...ল! এবং ম্যাচে সমতা!

ডাগআউটে দাড়িয়ে রাশিয়ান কোচ একহাতের তালুতে আরেক হাত ঠুকে হতাশা প্রকাশ করেন, ‘আহা, লিডটা হাত থেকে ছুটে গেল!’

দ্বিতীয়ার্ধে ক্রোয়েশিয়া গোলের জন্য বারবার আক্রমণে উঠে আসলেও রাশিয়া যেন ঠিক খোলসে ঢুঁকে পড়ে! গোল করার চেষ্টার চেয়ে গোল না খাওয়ার ইচ্ছেটাই বেশি দেখা গেল তাদের খেলায়, কৌশলে। বারকয়েক পাল্টা আক্রমণে উঠে এলেও বেশিরভাগ সময় রক্ষণ সামাল দিতেই বেশি ব্যস্ত থাকল রাশিয়া এই অর্ধে। গোলের নায়ক চেরিশেভ এবং জুবাকে তুলে নিয়ে রাশিয়ান কোচ জানিয়েও দিলেন এই ম্যাচ তারা অতিরিক্ত সময় ছাপিয়ে টাইব্রেকারে নিতে চায়। ডান বাম এবং মাঝখান তিনদিক থেকেই ধনুকের আকার সাজিয়ে রাশিয়ার পোষ্টে আক্রমণ চালায় ক্রোয়েশিয়া। ৫৯ মিনিটের সময় পেরিসিচ পোষ্টের মাত্র ৮ গজ দুরে থেকে শট নেন। গোলকিপার পরাজিত। কিন্তু সাইড পোষ্টে লেগে বল গোললাইনের সাদা দাগের সামান্য বাইরে দিয়ে অন্যপ্রান্তের পোষ্টের দিকে চলে যায়। এমন গোলও কিভাবে মিস হয়? দ্বিতীয়ার্ধের নির্ধারিত সময় শেষ হয় ১-১ গোলে। ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।

সেই লড়াইয়ে ফুরিয়ে গেল বিশ্বকাপে রাশিয়ার রূপকথার গল্প!

এ সম্পর্কিত আরও খবর