দেশে প্রথমবারের মতো পরিবেশবান্ধব পুরনো জাহাজ (গ্রিন শিপ) কিনেছে অন্যতম শিল্প প্রতিষ্ঠান পিএইচপি ফ্যামিলি। প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৭ হাজার মেট্রিক টনের এ জাহাজটি বঙ্গোপসাগরের বাড়বকু উপকূলের বর্হিনোঙরে এসে ভিড়েছে। ‘ওর ভিটোরিয়া’ নামের এ জাহাজটি ১৯৮৯ সালে জাপানে তৈরি করা হয়েছিল। ব্রাজিলের আকরিক লোহার খনি খননকারী মালিক ভ্যালে থেকে এটি কেনা হয়। আকরিক লোহা বহনের কাজে বিশাল এ জাহাজটি ব্যবহৃত হতো।
বিশাল এই জাহাজ আমদানির জন্য সরকার রাজস্ব ও শুল্ক পাবে পিএইচপি থেকে আনুমানিক ৮ কোটি টাকা।
কয়েক মাস আগে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো গ্রিন শিপ ইয়ার্ডের আন্তজার্তিক সার্টিফিকেট পায় পিএইচপি ফ্যামিলির মালিকাধীন বাড়বকুণ্ডের এই শিপইয়ার্ডটি। প্রায় ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে তারা ১৫ হাজার বর্গমিটারের পুরনো জাহাজ ভাঙার ইয়ার্ডকে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে আধুনিকায়ন করেছে।
‘গ্রিন শিপ’ অর্থাৎ পরিবেশবান্ধব এসব জাহাজের বৈশিষ্ট্য হলো- পরিবেশ সুরক্ষা একইসঙ্গে জাহাজ কাটার সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা। হংকং কনভেনশন অনুযায়ী এ ধরনের জাহাজ মালিকরা, জাহাজের কোন অংশে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর বর্জ্য রয়েছে, সে ব্যাপারে আগাম তথ্য দিয়ে থাকেন জাহাজ ক্রেতাদের। সাধারণত অন্য জাহাজগুলোতে বর্জ্য সংক্রান্ত কোনো তথ্য আগাম দেওয় হয় না।
এ ধরনের পুরনো জাহাজ বিক্রির আগে জাহাজ মালিকরা ক্রেতাদের ইয়ার্ড সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেন, সেটি আদৌ গ্রিন ইয়ার্ড কিনা। সর্ব্বোচ্চ নিলামকারীর কাছেও তারা জাহাজ বিক্রি করেন না, যদি না সেটা গ্রিন ইয়ার্ড হয়। এ ধরনের জাহাজ বিক্রির পর সেটি কাটতে বা ভাঙতে গিয়ে দূর্ঘটনায় কোনো প্রাণহানীর ঘটনা ঘটলে, তা নিয়ে বেশ বিতর্ক তৈরি হয়। এই ধরনের বিতর্কে সেই সব জাহাজ মালিকদের কোম্পানী শেয়ার মার্কেটে দরপতনের ঘটনা ঘটে। এ আশংকায়, হংকং কনভেনশনের সার্টিফিকেটধারী গ্রিন ইয়ার্ডের কাছে বাজার মূল্যের চেয়ে কমদামে পুরনো জাহাজ বিক্রিকে অগ্রাধিকার দেয়।
গ্রিন শিপ ইয়ার্ড ছাড়া গ্রিন শিপ কেনাবেচা হয় না আন্তর্জাতিক বাজারে। সাধারণত পুরনো জাহাজ থেকে পুরনো গ্রিন শিপের দাম তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম হয়। সেই দিকে থেকে পিএইচপি ফ্যামিলির এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যয়বহুল ব্যবসায়ীক উদ্যোগ অন্য শিপ ইয়ার্ড মালিকদের তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে পিএইচপি ফ্যামিলির পরিচালক ও অস্ট্রেলিয়ার ক্যানভেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইটি বিষয়ে উচ্চ ডিগ্রিধারী জহিরুল ইসলাম রিংকু বলেন, ‘বর্তমান সরকারের আন্তরিক সহযোগিতা ও বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহায়তায় প্রথমবারের মতো গ্রিন শিপ আমদানি করতে পেরে সকলের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমরা মনে করি, এ ধরনের উদ্যোগ পুরনো জাহাজ ভাঙার ব্যবসায় বাংলাদেশকে নিয়ে যে নেতিবাচক ধারণা ছিল সারা বিশ্বে সেটি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। এরই মধ্যে এ জাহাজ কেনাবেচা নিয়ে আন্তর্জাতিক অনেক সংবাদমাধ্যমে ইতিবাচক সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে। যা আমাদের জন্য গৌরবের।’
লন্ডন থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শিপিং সংবাদমাধ্যম ‘দ্যা মেরিটাইম এক্সিকিউটিভ’ ও ‘লয়েডস লিস্ট’সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বুলেটিনে এ খবর ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৬ জুলাই) দ্যা মেরিটাইম এক্সিকিউটিভ- এ প্রকাশিত সংবাদের হেডিং করা হয় এভাবে ‘ন্যাশনাল ফার্স্ট ফর বাংলাদেশ শিপ রিসাইক্লিং ইয়ার্ড’। এতে বলা হয়, হংকং কনভেনশনে শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশী কোম্পানি পিএইচপি বাংলাদেশের জন্য প্রথম একটি গ্রিন ভ্যাসেল কিনেছে। লয়েডস লিস্ট-এর সংবাদে বলা হয়, বাংলাদেশের একমাত্র হংকং কনভেনশনে সার্টিফিকেটধারী পিএইচপি ফ্যামিলি ভ্যালে থেকে একটি গ্রিন ভ্যাসেল অর্থাৎ পরিবেশবান্ধব জাহাজ কিনেছে। ১৯৮২ সালে শুরু করা এই শিপইয়ার্ডে প্রতিবছর পুরনো জাহাজ ভাঙার ক্ষমতা ৪ লাখ টন।
প্রায় ৪৫ বছর আগে বিশিষ্ট শিল্পপতি সুফি মিজানুর রহমান ১০০ টাকা বেতনের ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন।
অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা থেকে তাঁর সাত ছেলে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেন। ঢেউটিন, স্টিল, কাঁচ, বিটুমিন, মিডিয়া, ফিশারিজ, শিপইয়ার্ড ও রডসহ ২৭ ধরনের ব্যবসায় এখন বার্ষিক লেনদেন করে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। বছরে এ লেনদেন থেকে সরকার রাজস্ব ও শুল্ক বাবদ পায় ৬০০ কোটি টাকারও বেশি।